রক্তের রঙ ১.১১

এগারো

নিশ্চিন্তে কাগজ দেখছিল সরোজ গুপ্ত, টেরও পায়নি হয়তো ইয়েন ফ্যাঙের প্রবেশ। বোঝা যাচ্ছে, বেশি কথা খরচা করেনি ফ্যাঙ-ল্যুগারটা কপালের দিকে তাক করে টিপে দিয়েছে ট্রিগার।

কেন?

সরোজ গুপ্তকে হত্যা করার পর অপেক্ষা করছিল ও কার জন্যে? রানা? না মিসেস গুপ্ত? নাকি দুজনের জন্যেই? রানাকে হত্যা করতে চাওয়ার সহজ কারণ বোঝা যায়, কিন্তু গুপ্ত দম্পতির উপর চোখ পড়ল কেন ওদের? রানা যে মিসেস গুপ্তের সাথে ডিনার খেয়েছে গতকাল, এই কথাটাই হয়তো জানতে পেরেছে উ-সেনের লোক, কিন্তু এর মধ্যে এতখানি গুরুত্বপূর্ণ কি খুঁজে পেল ওরা যে মৃত্যুদূত পাঠিয়ে দিয়েছে একেবারে?

ঘোলাটে ঠেকছে ব্যাপারটা রানার কাছে। ওরা কি জানে এদের ভূমিকা সম্পর্কে? জানে যে এরা ভারতীয় এজেন্ট, এবং গোপনে লোক পাচার করাই এদের মুখ্য কাজ? ধরে নেয়া যাক একথা জানা আছে উ-সেনের দলের; কিন্তু তবু তো এরকম আকস্মিক আক্রমণের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

এর সঠিক উত্তর দিতে পারবে মিসেস গুপ্ত।

কাজেই অপেক্ষা করতে হবে ওকে।

ঘর অন্ধকার করে দিয়ে সোফার উপর বসে পড়ল রানা। অনুভব করল, আজ সন্ধের তৎপরতা বেশ খানিকটা ক্লান্ত করে ফেলেছে ওকে। পা দুটো টান করে আড়মোড়া ভাঙল সে, তারপর আয়েশ করে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরাল একটা।

ঠিক পোনে এগারোটার সময় করিডরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। পিস্তলটা হাতে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসল রানা। দরজা খুলে যেতেই করিডরের ম্লান আলো দেখা গেল। চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে আছে মিসেস গুপ্ত। গুন গুন করে গান গাইছিল, থেমে গেল গান।

প্রথমেই হাত বাড়িয়ে বাতি জ্বেলে দিল মিসেস গুপ্ত, ইয়েন ফ্যাঙকে দেখে চমকে উঠল, ঝট করে ফিরল রানার দিকে।

‘আপনারা কি করছেন এই ঘরে? সরোজ কোথায়?’

‘পাশের ঘরে।’ নির্বিকারভাবে বলল রানা।

রানার হাতের পিস্তলটার দিকে চাইল মিসেস গুপ্ত, দৃষ্টিটা সরে স্থির হলো চোখের ওপর, তারপর আবার চাইল ইয়েন ফ্যাঙের দিকে। চেহারায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না। মহিলার মানসিক শক্তি দেখে সত্যিই অবাক হলো রানা।

‘কি ব্যাপার?’ আবার প্রশ্ন করল মিসেস গুপ্ত। ‘ব্যাপারটা কি, সেটা আপনার কাছ থেকে জানার জন্যেই অপেক্ষা করছি আমি।’

‘সরোজ কোথায়?’

‘বললাম তো, পাশের ঘরে।’ উঠে দাঁড়াল রানা।

পাশের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল মিসেস গুপ্ত। ওর পিঠের কাছে রানা।

‘আপনি খুন করেছেন ওকে!’ চাপা ফ্যাসফেঁসে স্বরে বলল মিসেস গুপ্ত। ‘আশ্চর্য!’ সত্যিই আশ্চর্য হলো রানা। ‘আপনার এ ধারণা হলো কেন? আমি ওকে খুন করতে পারি এটা যখন সম্ভাবনার মধ্যেই ধরেছেন আপনি, নিশ্চয়ই সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আছে আপনার? কারণটা ব্যাখ্যা করতে হবে আপনাকে। যত তাড়াতাড়ি পারেন কান্নাকাটি সেরে নিন, অনেক কথা আছে আপনার সাথে। হাতে সময় কম। ‘

একটু অবাক হয়ে চাইল মিসেস গুপ্ত রানার দিকে। তারপর হাসল। ‘জীবনে কাঁদিনি আমি, আব্বাস মির্জা। জন্মের সময়ও না। কান্না আমার আসে না। তাছাড়া সরোজ আমার স্বামী ছিল কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও এখন ও একটা লাশ।’ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল মিসেস গুপ্ত, ‘আপনি বলতে চান, আপনি ওকে খুন করেননি?’

‘পিস্তলটা পাশের ঘরের বন্ধুটির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি আমি। আমি পৌছুবার আগে মারা গিয়েছেন আপনার স্বামী। ওই লোকটাকে চেনেন?

মাথা নাড়ল মিসেস গুপ্ত। চেনে না।

বেডরূমের দরজাটা ভিড়িয়ে দিল রানা। ‘তাহলে গোটা কতক কাজের কথা সেরে ফেলতে পারি আমরা?’

‘আপনি আমাকে জেরা করতে চান?’

বিছানার পাশে বসে পড়ল রানা। বলল, ‘তার আগে কি সার্চ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন?’

রানার সামনে এসে দাঁড়াল মিসেস গুপ্ত। দুই হাত তুলল মাথার ওপর বলল, ‘আমি অস্ত্র ব্যবহার করি না।’

‘আমার এক বান্ধবীও ঠিক এই কথাই বলে। কিন্তু আমি জানি ওর শরীরে কোথাও না কে যাও ছোট্ট একটা টু-ফাইভ ক্যালিবারের অ্যাসট্রা পিস্তল থাকে সবসময়।

‘অর্থাৎ…’ কথাটা শেষ না করেই শাড়ি খুলতে শুরু করল মিসেস গুপ্ত। এক এক করে সব কাপড়-চোপড় খুলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলল সে কার্পেটের ওপর, তারপর মাথার ওপর হাত তুলে ধীরে ধীরে ঘুরল একপাক।

সাংঘাতিক এক অস্ত্র আবিষ্কার করল রানা ওর শরীরে। যৌবন। এমন নিটের সুন্দর শরীর লাখে একটাও মেলে না। ঠিক যেন শিল্পীর সারা জীবনের সাধনা, স্বপ্ন আর কল্পনা মূর্ত হয়ে উঠেছে ওই রক্ত মাংস দিয়ে গড়া প্রতিমায়। শিল্পী না বলে সার্জন বলা উচিত। কারণ ক্ষীণ অস্পষ্ট হলেও প্লাস্টিক সার্জারীর চিহ্ন দেখতে পেয়েছে রানা।

‘কার হাতের কাজ?’ প্রশ্ন করল রানা। ‘কে অস্ত্রোপচার করেছিল? ডক্টর হুয়াং কি?’

ভয়ানকভাবে চমকে উঠল মিসেস গুপ্ত প্রশ্নটা শুনে। কিন্তু আশ্চর্য ক্ষমতার বলে সামলে নিল মুহূর্তে। ‘কেন? একথা বলছেন কেন?’

মুচকে হাসল রানা। বলল, ‘ঠিক আছে, জবাব না দিলেও চলবে। এবার বলুন, সরোজকে একা রেখে কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?’

‘সিনেমায়।’

‘সে কথা পাশের ঘরের লোকটা জানল কি করে?’

‘পোর্টারকে দিয়ে ট্যাক্সি আনিয়েছিলাম, হয়তো তার কাছ থেকে শুনেছে।’

‘আপনি যখন এ ঘর ছেড়ে যান, সরোজ তখন জীবিত ছিল?’

‘নিশ্চয়ই। আপনি আবোল তাবোল প্রশ্ন করছেন, মিস্টার আব্বাস মির্জা। হত্যাকারীকে আপনি নিজ হাতেই আহত, নিরস্ত্র এবং বন্দী করেছেন। অন্তত আপনার বক্তব্য তাই। এখন আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন দয়া করে। আপনি এখানে কেন? আমি যতদূর জানি, আপনার ওপর আদেশ আছে, প্রাথমিক কন্ট্যাক্টের পর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথে যোগাযোগ করবেন না…’

আমার কাজ শেষ। আপনাদের সাহায্যে রেঙ্গুন থেকে পালাবার কথা ছিল, তাই এসেছি।’

‘কাজ শেষ? আজ সন্ধেবেলাতেও আপনাকে দেখে মনে হলো কাজ শুরুই করেননি, আর এখন এসে বলছেন কাজ শেষ। এক সন্ধ্যায় কি কাজ উদ্ধার করলেন আপনি?’

‘আমার কাজে বেশি সময় লাগে না।’ হাসল রানা। ‘আপনার পুরো নাম কি মিসেস ফ্যান সু গুপ্ত?’

‘আপনি জানলেন কি করে?’ তেরছা চোখে চাইল মিসেস গুপ্ত রানার চোখে।

‘আজ সন্ধ্যায় উ-সেনের ওখানে ডিনারের দাওয়াত ছিল আমার।

ভুরু কুঁচকে গেল মিসেস গুপ্তের। বসে পড়ল ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলে পায়ের উপর পা তুলে। রানা বুঝল দ্রুত চিন্তা চলছে ওর মাথায়। অনেকটা আপন মনে বলল, ‘সেকথা বোঝা উচিত ছিল আমার আগেই। আজ সন্ধ্যায় স্যুই থির সাথে আপনাকে দেখে…’ মাথা ঝাঁকিয়ে একগুচ্ছ অবাধ্য চুল পেছনে সরিয়ে দিল মিসেস গুপ্ত, সরাসরি চাইল রানার দিকে। ‘আমার সম্পর্কে কতটা জানেন আপনি?’

‘ইচ্ছে করলেই কাপড় পরে নিতে পারেন,’ বলল রানা।

‘আমার প্রশ্নের জবাব দিন।’ গম্ভীর মিসেস গুপ্ত।

‘সত্যি কথা বলতে কি, তেমন কিছুই জানি না। আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছি। আপনার মুখেই শুনতে চাই আপনার সম্বন্ধে।’ একটা সিগারেট ধরাল রানা। ‘আমার কৌতূহল নিবৃত্ত হলেই আমি সন্তুষ্ট। প্রথমে বলুন উ-সেনের সাথে আপনার কি সম্পর্ক? ‘

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে চুপচাপ কিছুক্ষণ ভাবল ফ্যান সু গুপ্ত। গভীর গোপন কোন সিদ্ধান্ত নিল। রানার আক্ষেপ হলো থট-রিডিং জানা নেই বলে। মধুর করে হাসল ফ্যান সু রানার চোখের দিকে চেয়ে। ‘যা বলব, বিশ্বাস করবেন?’

‘বিশ্বাসযোগ্য হলে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করব।’

‘সব কথা জেনে কি করবেন?’

‘সিদ্ধান্ত নেব আপনার সাহায্য নেয়া যায় কিনা। যদি দেখি যায় না, নিঃশব্দে বেরিয়ে যাব আমি এ ঘর থেকে। আপনার গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত কাটবার ইচ্ছে আমার নেই। কথাটা বিশ্বাস করলে সুখী হব।’

‘আমি যদি বলি আমি একজন ডাবল এজেন্ট, তবুও শাস্তি না দিয়েই চলে যাবেন?’

‘আপনাকে শাস্তি দেয়ার অধিকার আমার নেই, মিসেস গুপ্ত। তাছাড়া আমি ভারতের স্পাই নই। বাংলাদেশ থেকে এসেছি আমি আমার দেশের শত্রুকে শায়েস্তা করতে, আমার কাজ শেষ, দেশে ফেরার পালা এখন। যতদূর বোঝা যাচ্ছে আপনার সাহায্য নেয়া যাবে না, আমার পথ আমার নিজেকেই করে নিতে হবে।’

‘আপনি বাংলাদেশের লোক? তাহলে আপনাকে সাহায্য করার আদেশ দেয়া হলো কেন আমাদের?’

‘আমার বর্তমান মিশনের সাথে ভারতের স্বার্থও সংশ্লিষ্ট। ব্যাপারটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে দুজন বিশ্বস্তু এজেন্টের পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যাওয়াটা আপনাদের চীফ তেমন কোন ক্ষতি বলে মনে করেননি।’ সিগারেটে টান দিল রানা, ঘড়ি দেখল। ‘নিন, শুরু করুন।’

‘আমি উ-সেনের লোক।’

‘সে কথা আমি জানি। শুধু জানি না, উ-সেনের দলের লোক হয়েও আপনি আক্রান্ত হচ্ছেন কেন?’

সেই কথাটাই ভাবছি আমি এতক্ষণ ধরে। সরোজকে মেরে ফেলা মানে আমার সাহায্যের আর কোন প্রয়োজন নেই ওদের। ওরা ভাল করেই জানে, আমার কাছ থেকে এর ফলে ভবিষ্যতে কোনরকম সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। তবু যখন কাজটা করেছে, তখন বুঝতে হবে, আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে ওদের কাছে। সেক্ষেত্রে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবারও কোন মানে হয় না। আমি জানি, শুধু সরোজকে হত্যা করতে পাঠানো হয়নি ওকে। আমাকেও, এবং খুব সম্ভব আপনাকেও হত্যা করতে পাঠানো হয়েছে।’ হঠাৎ কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে বলল, ‘আমি একটা ফোন করতে পারি?’

এক সেকেন্ড ভেবে বলল রানা, ‘পারেন।’

রিসেপশনিস্টের কাছে বাইরের লাইন চাইল মিসেস গুপ্ত। লাইন পেয়ে ডায়াল করল। মিনিটখানেক রিং হলো, কিন্তু ধরল না কেউ। এবার অন্য একটা নম্বরে ডায়াল করল সে। ওপাশে রিসিভার ওঠাবার শব্দ হলো।

‘হ্যালো? ইয়ান লাও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এক্সচেঞ্জ? দেখুন, আপনাদের পনেরোতলার মিস্টার উ-সেনের নাম্বারে রিং করছি গত দশ মিনিট ধরে, আপনি কি বলতে পারবেন ওর টেলিফোনটা খারাপ কি না?’ চুপচাপ শুনল মিসেস গুপ্ত বেশ কিছুক্ষণ, তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘কখন? মানে, কয়টার সময়?’ আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনে নামিয়ে রাখল রিসিভার 1

রানা ভুরু নাচাল। ‘কি বলল?’

‘ঘণ্টা খানেক আগে উ-সেনকে নিয়ে ডক্টর হুয়াং কি, স্যুই থি এবং আরও দুজন বিদেশী ভদ্রলোক চলে গেছে এয়ারপোর্টে। উ-সেনকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভয়ানক অসুস্থ দেখাচ্ছিল তাকে।’ চোখজোড়া ছোট হয়ে এল মিসেস গুপ্তের, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চিন্তা করল এক সেকেন্ড। ‘উ-সেনের এই হঠাৎ অসুস্থতার সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই তো, মিস্টার আব্বাস মির্জা? কিছু একটা আঁচ করতে পারছি যেন আমি। আপনাকে চিনি কিনা জানতে চাওয়া হলো আমার কাছে রাত আটটায়, আপনি ডিনার খেলেন উ-সেনের সাথে রাত নয়টায়, আর অসুস্থ উ-সেনকে নিয়ে চলে গেল ওরা এয়ারপোর্টে রাত দশটায়। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?’

‘খুবই সাধারণ ব্যাপার। উ-সেনকে হত্যা করে ওর কাছ থেকে কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করবার জন্যে পাঠানো হয়েছিল আমাকে। আমার কাজ শেষ।’

হাঁ হয়ে গেল মিসেস গুপ্তের মুখ, চোখ দুটো বিস্ফারিত-যেন ঠিক বুঝতে পারছে না রানার কথাগুলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল, ঢোক গিলল একটা। ‘অসম্ভব! মিথ্যো কথা! নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছেন আপনি!’

‘মিথ্যে কেন বলব?’ গেঞ্জির নিচে থেকে ফাইলটা বের করে দেখাল রানা। ‘এটাও কি মিথ্যে? বাংলাদেশকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়ার প্ল্যান রয়েছে এটার মধ্যে। নিশ্চয়ই চাওয়ামাত্র ভদ্রতা রক্ষার খাতিরে তুলে দেয়নি এটা উ-সেন আমার হাতে?’

‘মারা গেছে উ-সেন?

‘সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু আমি ভাবছি, এত রাতে কি প্লেন পাবে ওরা?’

‘প্লেন নয়, হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ওরা। উ-সেনের নিজস্ব…’

‘কোথায় গেছে আন্দাজ করতে পারেন?’

‘অনুমান করার দরকার কি? আমি জানি কোথায় গেছে। মান্দালয়।’

‘আপনাকে হত্যা করবার আদেশটা কে দিল? ডক্টর হুয়াং, না স্যুই থি?’

‘ওরা দুজনই অপছন্দ করে আমাকে হয়তো দুজনেই দিয়েছে।

‘যাক, কারা আদেশ দিয়েছে বোঝা যাচ্ছে, এবার বলুন দেখি, কেন আদেশটা দেয়া হলো?’

উঠে দাঁড়িয়ে কার্পেটের উপর থেকে শাড়িটা তুলে আলগোছে কোনমতে পেঁচিয়ে নিল সে শরীরে। আবার বসল টুলের উপর। বলল, ‘সিগারেট আছে?’

সিগারেটের প্যাকেট এবং ম্যাচটা ফেলল রানা ওর কোলের উপর 1 স্থিরদৃষ্টিতে লক্ষ করল, সামলে নিয়েছে মিসেস গুপ্ত, একটুও কাঁপল না হাত সিগারেট ধরাতে গিয়ে।

‘ব্যাপারটা গোড়া থেকেই বলছি। ব্যাংককের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। আশ্চর্য এক মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মেছিলাম আমি। পাঁচ বছর বয়সেই আমি মুখে মুখে বিরাট সব যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করতে পারতাম। আমার আই. কিউ. ছিল একশো তিরাশি-অর্থাৎ জিনিয়াসের ইন্টেলিজেন্স কোশিয়েন্ট। কিন্তু এক মোটর দুর্ঘটনায় বাবা-মা মারা যাওয়ায় ছয় বছর বয়সেই ভয়ানক অসুবিধায় পড়ে গেলাম। লেখাপড়া তো দূরের কথা, দুবেলা খাবার জোগাতেই আমার ছোট্ট মাথাটা প্রচুর পরিমাণে ঘামাতে হয়েছে। ভয়ানক কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে বারোটা বছর। সেসব কষ্টের কথা ভাবতেও ভয় হয় এখন আমার। কোথাও কারও কাছে এতটুকু স্নেহ ভালবাসা পাইনি আমি। মানুষের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ভয়ঙ্কর বীভৎস কুৎসিত ছিলাম আমি দেখতে। আমার মা পর্যন্ত ভয় পেয়েছিল জন্মের পর প্রথম আমার মুখ দেখে। আমার দিকে চাওয়ার সাথে সাথেই মুখ না ঘুরিয়ে নিয়ে উপায় ছিল না। সন্ধের পর কোনদিন ঘর থেকে বেরোতাম না আমি রাস্তার লোকজন ভয় পাবে বলে।’ পর পর দু’তিনটে টান দিল সে সিগারেটে। ‘সেই সময় পরিচয় হয় উ-সেনের সাথে। আমার এই রূপ, এই সুন্দর দেহ, সবই উ-সেনের দান। যদিও কোনদিন পছন্দ করতে পারিনি আমি লোকটাকে, পরিষ্কার জানি নিজের স্বার্থোদ্ধারই ওর এই সাহায্যের একমাত্র উদ্দেশ্য, আমাকে ব্যবহার করবার জন্যেই এত টাকা খরচ করেছে সে আমার পেছনে-কিন্তু কৃতজ্ঞতা বোধকে কিছুতেই সরাতে পারিনি মন থেকে। ওর কথামত ভালবাসার অভিনয় করে বিয়ে করি আমি সরোজকে। অভিনয় করতে গিয়ে কখন যে ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম টের পাইনি, টের পেলাম বিয়ের ছয় মাস পর যখন সরোজের বিরুদ্ধে একটা কাজ করবার আদেশ দিল আমাকে উ-সেন। কিছুতেই করতে পারলাম না সেটা, কেঁদে পড়লাম উ-সেনের কাছে। সেবারের মত মাফ করে দিল উ-সেন আমাকে, কিন্তু বিশ্বস্ততার লিস্ট থেকে কেটে দিল সে আমার নাম।’

গল্পটা লম্বা হয়ে যাচ্ছে। রানা বুঝল এভাবে ঢালাও সুযোগ দিলে রাত কাবার করে দেবে মিসেস গুপ্ত। কাজেই দ্রুত কাহিনী শেষ করতে সাহায্য করল সে।

‘উ-সেন আপনার সাহায্য গ্রহণ করা বন্ধ করে দিল?’

‘ঠিক তা নয়। কাজ আমি ঠিকই করতে থাকলাম, উ-সেন বুঝে নিল সরোজের কোন ব্যক্তিগত ক্ষতি আমাকে দিয়ে করানো যাবে না, কিন্তু অন্যান্য সব তথ্য পাবে সে আমার কাছে ঠিক ঠিকই। কাজেই আপনার সম্বন্ধে আমার দেয়া রিপোর্ট সে বিশ্বাস করেছিল অকপটে।’

‘ভুল রিপোর্ট দিতে গেলেন কেন?’

‘কথাটা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, সরোজের প্রতি ভালবাসা আমার ক্রমে ভারতের প্রতি ভালবাসায় রূপ নিচ্ছিল অনেকদিন থেকেই। ভারতের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা আমার কাছে সরোজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার সমান অপরাধ বলে মনে হচ্ছিল কিছুদিন থেকে। আপনাকে সত্যি কথাই বলব, আগে যদি জানতাম আপনার পরিচয়, কিছুতেই মিথ্যা বলতাম না উ-সেনের কাছে। আপনি যে ওর বিরুদ্ধে কোন মিশন নিয়ে এসেছেন সেকথা কল্পনাতেও আসেনি আমার। আমি এটাকে মনে করেছিলাম উ-সেনের রুটিন চেক-নতুন কেউ রেঙ্গুনে এলেই তার সম্পর্কে খোঁজ খবর করা উ-সেনের নিয়ম। আমি ভেবেছিলাম, অনর্থক একজন ভারতীয়কে ব্ল্যাকমেইলের শিকার না করে ছোট্ট একটা মিথ্যা বলে দিলে কারও কোন ক্ষতি হবে না। আমি জানতাম না, এই ছোট্ট মিথ্যা কথার ফলে আকাশ ভেঙে পড়বে আমার মাথার ওপর, সরোজকে হারাতে হবে, নিজের প্রাণের উপর হামলা আসবে, চিরশত্রু হয়ে যাব গোটা দলটার, উ-সেনের মৃত আত্মার কাছে চিরদিন অপরাধী থাকতে হবে, চিরদিন নিজেকে অকৃতজ্ঞ নরকের কীট ছাড়া কিছু ভাবতে পারব না আর। জানলে এ কাজ করতাম না.।’

রানা বুঝল সত্যি সত্যিই কি ভয়ঙ্কর অবস্থায় পড়েছে মিসেস গুপ্ত সামান্য একটু ভুলের জন্যে। বেঁচে থাকাই মহা সমস্যা হয়ে যাবে ওর!

আপনার মনের কথা পরিষ্কার জানিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। এখন কি করবেন স্থির করেছেন কিছু? যা ঘটবার সে-তো ঘটেই গেছে, এবার আপনার প্রোগ্রাম কি?’

এক মুহূর্ত দেরি হলো না মিসেস গুপ্তের উত্তর দিতে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে অনেক আগেই।

‘সবকিছু এমন গোলমাল পাকিয়ে গেছে যে এখন পালানো ছাড়া আর কোন গত্যন্তর দেখছি না। অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে রেঙ্গুন এখন আমার জন্যে। আপনার জন্যেও!’

আমার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনার নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবুন!

‘আমার কথা ভাবতে গিয়ে আপনার কথা এসে পড়ে স্বাভাবিক ভাবেই। কিছুই করতে পারব না আমি এখন আপনার সাহায্য ছাড়া।’

‘আমাকে সরোজ সাজিয়ে নিয়ে এখান থেকে পালাবার কথা ভাবছেন এখনও?’

‘এছাড়া আর কোন উপায় দেখতে পাচ্ছি না।’

‘উ-সেনের লোকের কাছে ধরা পড়বার সম্ভাবনা নেই?’

‘আমার মনে হয় না। আমার ধারণা, ইয়েন ফ্যাঙকে আমাদের মেরে ফেলার হুকুম দিয়েই চলে গেছে হুয়াং মান্দালয়ে। এই ধরনের আদেশ গোপনে দেয়াই স্বাভাবিক। খুব সম্ভব আর কেউ জানে না। হুয়াং-এর অনুপস্থিতিতে আমরা অনায়াসে চলে যেতে পারব ব্যাংকক।’

‘ইয়েন ফ্যাঙকে চেনেন না বলেছিলেন কেন?’

‘আপনি কতদূর কি জানেন জানা ছিল না বলে।’

‘ওকে কি করবেন ভাবছেন?’

‘মেরে ফেলব।’

‘তারপর লাশ দুটো?’

‘ও দুটো পাশের কোন খালি রূমে রেখে দেব আমরা দুজন মিলে টেনে নিয়ে গিয়ে। এই ফ্লোরে প্রায় প্রত্যেকটা ঘরই খালি। সরোজের দাড়ি কামিয়ে ফেলব, ফলে কেউ বুঝতে পারবে না পাশের ঘরের মৃত যুবক আসলে বৃদ্ধ সরোজ গুপ্ত। সকাল বেলা ফোন করে টিকেট বুক করব। রিসেপশনে জানিয়ে দেব হঠাৎ বেড়ে গেছে মিস্টার গুপ্তের অসুস্থতা, আজই চলে যাচ্ছি আমরা ব্যাংকক।

দুই সমকামী বন্ধু, তাদের ঝগড়া, ফলে একজন অপরজনকে গুলি করে, তারপর শোকে উদ্ভ্রান্ত হয়ে হোক, পুলিসের ভয়ে হোক, আত্মহত্যা করা-মিসেস গুপ্তের চিন্তাধারাটা কোন খাতে বইছে টের পেয়ে হাসল রানা মনে মনে। তবে বুদ্ধিটা যে ভাল বের করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে আর দুএকটা প্রশ্ন করে এতেই হয়তো রাজি হয়ে যেত সে, কিন্তু পালানো সম্ভব নয় এখন ওর পক্ষে। সোফিয়ার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে।

‘ব্যাংককে গিয়ে কি করবেন? ওখানেও তো উ-সেনের লোক আছে।’

‘ব্যাংককের ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স চীফের কাছে রিপোর্ট করব প্রথমে, তারপর ব্যবসা গুটানোর ভার তার ওপর দিয়ে আমি চলে যাব কলকাতায়। ওখানে আমার নাগাল পাবে না উ-সেনের দল। আপনি চলে যাবেন আপনার কাজে।’

‘ব্যবসাটা কি সরোজের ব্যক্তিগত ছিল?’

‘হ্যাঁ। এর প্রতিটা পাই পয়সা ওর নিজের ইনভেস্টমেন্ট।’

‘গুড।’ উঠে দাঁড়াল রানা। মিসেস গুপ্তের কোলের ওপর থেকে তুলে নিল সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচ। ‘আপনার প্ল্যানটা ভাল, কিন্তু এটার কিছুটা অদল বদল করতে হবে।’

‘কি রকম?’ সপ্রশ্ন দৃষ্টি তুলল মিসেস গুপ্ত রানার মুখে

‘আমি আপনার সাথে যাচ্ছি না।’

‘তাহলে?’ হতাশা ফুটে উঠল মিসেস গুপ্তের চোখেমুখে। ‘আমার কি হবে? আপনার সাহায্য না পেলে আমি পালাব কি করে? একজন সরোজ গুপ্ত ছাড়া যে একেবারে অচল হয়ে যাব আমি, মিস্টার আব্বাস মির্জা। প্লীজ! আমাকে সাহায্য করতেই হবে আপনার। নইলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে খুন হয়ে যাব আমি ওদের হাতে।’

‘ইয়েন ফ্যাঙকে নিয়ে যান সরোজ হিসেবে।’ আঙুল দিয়ে পাশের ঘরের দিকে ইঙ্গিত করল রানা। এই সহজ সমাধানটা কেন মিসেস গুপ্তের মনে আসেনি, ভেবে একটু বিস্মিত হলো সে মনে মনে

‘কি করে? ও কো-অপারেট করবে কেন!’ মিসেস গুপ্তের চোখ বিস্ফারিত।

‘ঘুমের ওষুধ খাওয়ালেই সহযোগিতা পাওয়া যাবে ওর। ঘুম পাড়িয়েই নিয়ে যেতে পারবেন ওকে ব্যাংকক পর্যন্ত। সরোজের হত্যাকারীকেও তুলে দিতে পারবেন চীফের হাতে।

হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মিসেস গুপ্তের চোখমুখ। ‘ঠিক বলেছেন। দারুণ বুদ্ধি আপনার মাথায়! ঘুমের ওষুধ লাগবে না, চমৎকার একটা ওষুধ আছে আমার কাছে।’ একটা তাকের উপর রাখা ফার্স্ট এইডের বাক্সের দিকে চাইল সে। ‘আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে, মিস্টার মির্জা। জাস্ট এক মিনিটের ব্যাপার। একটু ধরতে হবে লোকটাকে।’

‘ঠিক আছে, আসুন আপনি…আমি দেখি জ্ঞান ফিরেছে কিনা লোকটার। দরজাটা খুলেই ধক করে উঠল রানার বুকটা। ইজিচেয়ারের উপর নেই ইয়েন ফ্যাঙ। পরমুহূর্তেই চোখ গেল ওর মেঝের দিকে। বাঁধন খুলতে পারেনি, কিন্তু ছেঁচড়ে নেমে গেছে ফ্যাঙ নিচে। গড়িয়ে গড়িয়ে দরজার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

দুই কাঁধ ধরে টেনে তুলে দিল রানা আবার ওকে ইজিচেয়ারের ওপর খানিক বাদেই একটা সিরিঞ্জ হাতে ঘরে ঢুকল মিসেস গুপ্ত। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রাণপণ শক্তিতে ছটফট শুরু করল ইয়েন ফ্যাঙ। হাত পা এমনভাবে নাড়াচ্ছে যেন কিছুতেই সুচ ঢোকানো সম্ভব না হয়।

ঠেসে ধরল রানা। কিন্তু লোকটাকে সামলানো মুশকিল। দারুণ শক্তি ওর গায়ে। দুই হাতে ঠেসে ধরেও নড়াচড়া বন্ধ করা যাচ্ছে না। বাম হাঁটু তুলে দিল রানা ওর বুকের ওপর। চেপে ধরল।

এগিয়ে এল মিসেস গুপ্ত। রানার পাশে এসে দাঁড়াল। ছটফট্ করছে ইয়েন ফ্যাঙ, কিন্তু ঠেসে ধরায় নড়তে পারছে না বেশি!

হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা অনুভব করল রানা পিঠের কাছে, মেরুদণ্ডের উপর। চমকে পিছু ফিরল সে। দেখল সরে যাচ্ছে একটা সিরিঞ্জ ধরা হাত, একফোঁটা ওষুধও নেই আর ওতে।

কয়েক পা সরে গেল মিসেস গুপ্ত। মধুর হাসি হাসল রানার দিকে চেয়ে।

‘মাফ করবেন। ইয়েন ফ্যাঙের চেয়ে আপনাকেই আমার বেশি পছন্দ। প্ল্যানটা খানিক বদলে নিয়েছি আমি ইতিমধ্যেই। ব্যাংকক যাচ্ছি না আমরা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *