রক্তের রঙ ২.৮

আট

হেলিকপ্টারের শব্দে ঘাড় কাত করে ভ্রূ কুঁচকে ছাতের দিকে চাইল কর্নেল শেখ। রোটর ব্লেডের কর্কশ শব্দটা থেমে যেতেই এক-টুকরো মুরগির রোস্ট বেঁধানো কাঁটা চামচ মুখে তুলল।

‘ফিরে এল খবর নিয়ে,’ বলল জেনারেল এহতেশাম।

‘এক্ষুণি জানা যাবে সব,’ বলল উ-সেন। ‘সোজা এখানেই আসবে এখন লোইকা। ডাক্তার, তুমি কিছুই খাচ্ছ না যে? এত কম খেলে শরীর টিকবে কি করে?’

‘রুচি নেই, উ-সেন,’ জবাব দিল হুয়াং। ‘এক সন্ধ্যার তুলনায় অতিরিক্ত উত্তেজনা হয়ে গেছে আজ। বেশি ঝুঁকি নেয়া হয়ে গেছে। মাথাটা ঘুরছে তাই। ওই মাসুদ রানা লোকটা যতক্ষণ জ্যান্ত থাকবে ততক্ষণ বোধহয় রুচি ফিরবে না আমার। ভয়ঙ্কর লোক।

‘ঠিক বলেছ। এত দুর্দান্ত একজন লোককে হত্যা করতে আমার রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। কী আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস দেখেছ? এত ভয়ঙ্কর শত্রুর মুখোমুখি হইনি আমি আর। ওকে দেখে ‘মুসলিম বাংলার’ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দেহ এসে গেছে আমার মনে।

‘সন্দেহ কেন?’ প্রশ্ন করল কর্নেল শেখ

‘আপনাদের কথা শুনে আমার মোটামুটি ধারণা হয়েছিল বাঙালী একটা আবেগপ্রবণ হুজুগে জাতি, যে কোন একটা হুজুগ তুলতে পারলেই বানের জলে ভেসে যাবে। অপরিণামদর্শী। অলস। চায়ের কাপে ঝড় তুলতেই কেবল ওস্তাদ। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন প্ল্যানিং নেই ওদের। কিন্তু এই ছেলেটিকে দেখে এবং এর কথা শুনে বুঝতে পারছি পরিষ্কার, আপনারা ভুল বুঝিয়েছিলেন আমাকে। বাঙালীদের সম্পর্কে ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে আমার।

‘কি রকম?’

‘একজন সাধারণ স্পাই…’

‘ও সাধারণ নয়, মিস্টার উ-সেন,’বাধা দিয়ে বলল কর্নেল শেখ।

‘যাই হোক, ওর কথা থেকে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি আমি, বাঙালীদের ভবিষ্যৎ মোটেই হতাশাব্যঞ্জক নয়। একবার কাজে যখন নেমেছি, এর শেষ দেখে ছাড়ব আমি—কিন্তু আমার ধারণা জন্মেছে, অত সহজ হবে না ব্যাপারটা। যে উৎসাহ নিয়ে ওরা দেশ গড়তে লেগেছে, ওদেরকে বিপথে চালনা করা সহজ হবে না।’

‘বিপথ বলছেন কেন?’ প্রশ্ন করল জেনারেল। আমরা ওদের ভুল ভেঙে দিয়ে পথে আনবার চেষ্টা করছি। ওদের ভালর জন্যেই…’

‘ভাঁওতা দিয়ে আর ওদের ভোলানো যাবে বলে মনে হয় না। সত্যিই যদি ওরা প্রোডাকশনের দিকে জোর দেয়, তাহলে এই জাতিকে ঠেকিয়ে রাখবার ক্ষমতা পৃথিবীর কারও নেই। বন্যাটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই আগামী কয়েক বছরে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাবে ওরা। সেই সাথে যদি গোটা কয়েক স্টীল মিল তৈরি করতে পারে, ন্যাচারাল গ্যাসকে সত্যি সত্যিই কাজে লাগাতে পারে, অজস্র মাছ ধরে ক্যানিং করে বিদেশে রপ্তানী করতে পারে, কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানী না করে নিজেদের মিলে হাজারো পদের ফিনিশ্ড্ জুট প্রোডাক্ট তৈরি করে বিদেশে রপ্তানী করতে পারে, ভেঙে পড়া চা শিল্পকে আবার দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে রুখবে কে ওদের? জনসংখ্যা তখন ওদের একটা রিসোর্সে পরিণত হবে। কেন বাঙালীরা আপনাদের ইচ্ছের শিকার হবে বুঝতে পারছি না আমি। বাঙালীদের চরিত্রের দৃঢ়তা আর দুর্দমনীয় সাহসের নমুনা হিসেবে যদি মাসুদ রানাকে ধরা যায়, তাহলে আপনাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। হাজার কয়েক ধর্মান্ধ ফ্যানাটিক, আর কিছু চিহ্নিত দালাল নিয়ে গোটা বাঙালী জাতির গায়ে একটা চিমটিও কাটতে পারবেন না আপনারা।

‘আপনি কি আপনার সহযোগিতা উইথড্র করার কথা ভাবছেন?’ সরাসরি প্রশ্ন করল জেনারেল।

‘নো, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড।’ হাসল উ-সেন। ‘আপনারা সফল হোন বা বিফল হোন, সেটা সম্পূর্ণ আপনাদের নিজস্ব ব্যাপার। যতদিন টাকার স্রোত আমার দিকে বইবে ততদিন আমি ঠিকই আছি আপনাদের সাথে। আপনারা পাস করুন বা ফেল করুন আমার কিছুই এসে যায় না।’

ঘরে ঢুকেই স্যাল্যুট করল হেলিকপ্টারের পাইলট।

‘কি খবর লোইকী? এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?’ প্রশ্ন করল উ-সেন।

‘সেই ইয়টটা আকিয়াবে নেই। বারাক নদী বেয়ে পলেতোয়া পর্যন্ত চলে গেছে। আমি নিজে চেক করেছি। ইয়ট খালি। একটা লোকও নেই। অস্ত্রশস্ত্র কিছুই নেই।’

‘ট্রেনিং ক্যাম্পে খবর দিয়েছ?’

‘ইয়েস, স্যার। কর্নেল আদিব আর মেজর উলফতকে জানিয়েছি সব ঘটনা। ওঁরা বলছেন, অবজার্ভেশন পোস্টের রিপোর্ট হচ্ছে, দারুণ উত্তেজনা আর চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে আরাকানীদের মধ্যে। নিশ্চয়ই অস্ত্র পৌঁছে গেছে ওদের হাতে। এখনি আক্রমণ করে বসলে হয়তো সব অস্ত্র উদ্ধার করা যেতে পারে, দেরি করলে হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে, তখন মহা মুশকিল হয়ে যাবে।’

‘কথাটা ঠিকই বলেছে,’ বলল জেনারেল এহতেশাম।

‘ওঁরা প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছেন আপনার আদেশের জন্যে। সম্ভব হলে আজ রাতেই জানাতে বলেছেন আপনার অর্ডার। রাতের মধ্যেই কাজটা সেরে ফেলতে চান ওঁরা।’

চিন্তিত দেখাচ্ছে জেনারেলকে। উ-সেনের দিকে ফিরল। ‘আপনি কি বলেন, মিস্টার উ-সেন?

আমার তো মনে হয় অত তাড়াহুড়োর কিছুই নেই। আমাদের আগের প্রোগ্রাম ঠিকই আছে। কাল সকালে যাচ্ছি আমরা ট্রেনিং ক্যাম্পে। ওখানে গিয়েই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।

‘আজ রাতের মধ্যে অস্ত্র ছড়িয়ে পড়বে না চারদিকে?’

‘কত আর ছড়াবে?’ পুডিং শেষ করে কফির কাপ তুলে নিল উ-সেন। ‘ওদের হাতে অস্ত্র থাকা না থাকা সমান কথা। প্যাপনের আদেশ ছাড়া একটা অস্ত্রও ব্যবহার করবে না ওরা। আর আধ ঘণ্টা পর কোনদিন কোন আদেশ দেয়ার ক্ষমতা থাকবে না প্যাপনের।’

‘ওকেও শেষ করে দিচ্ছেন?’

‘সবাইকে। এরা ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। কাজেই ভেঙে ফেলাই ভাল।’

‘মাসুদ রানাকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিলে বোধহয় ভাল হত।’ বলল কর্নেল শেখ।

‘এক অনুরোধ বারবার করবেন না, কর্নেল। দ্বিতীয়বার সুযোগ পেলে আধমরা অবস্থায় ফেলে যাবে না ও আমাকে। আপনারাও নিস্তার পাবেন না। আমাদের সবার স্বার্থেই ওকে শেষ করে দেয়ার প্রয়োজন আছে।’ হাসল উ-সেন। ‘পুডিংটুকু শেষ করে নিন, চলুন দেখা যাক, হাতের নিশানা কেমন আছে। এককালে খুব ভাল নাইফ থ্রোয়ার ছিলাম আমি।’

.

টর্চার চেম্বারে নিয়ে আসা হলো ওদের চারজনকে।

বড় সড় একটা ঘর। ত্রিশ ফুট লম্বা, ত্রিশ ফুট চওড়া। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা কাচের ঘর। এক ইঞ্চি পুরু কাচ। দশ ফুট লম্বা, দশ ফুট চওড়া, দশ ফুট উঁচু। কাচের ঘরটার মধ্যে কিচ্ছু নেই, একেবারে ফাঁকা। এক ফুট ব্যাসের একটা পাইপ ঘরের ছাত থেকে নেমে এসে ঢুকেছে কাচের ঘরে ছাত ফুঁড়ে, বাথরুমের শাওয়ারের মত অসংখ্য ফুটোওয়ালা একটা ঝাঁঝরি দেখা যাচ্ছে পাইপের এ মাথায়।

ঘরের চারপাশের দেয়ালের দিকে চেয়ে চক্ষুস্থির হয়ে গেল রানার। প্রাচীন ও মধ্য যুগে যত রকমের নির্যাতন যন্ত্র ছিল তার প্রায় সবই সংগ্রহ করেছে উ-সেন। বিচিত্র, বিদঘুটে সব যন্ত্র সাজানো রয়েছে দেয়ালের গায়ে, ঘরের ছাতে ফিট করা রয়েছে বিভিন্ন সাইজের পুলি, কিছু কিছু যন্ত্র যেগুলো দেয়ালে টাঙানো সম্ভব নয়, সেগুলো রাখা আছে মাটিতে। জাদুঘরের মত যত্নের সাথে ঝেড়ে মুছে চমৎকার করে সাজানো আছে সবকিছু। অনেক কিছুই চিনতে পারল রানা। কাঁটা বসানো লোহার নেকলেস রয়েছে, থাম্ব স্ক্রু রয়েছে কয়েক সাইজের, ছয় সের ওজনের স্কাল ক্যাপ আছে, স্ক্যাভেঞ্জার্স ডটার রয়েছে সাতটা, বিশ সেরী ফেটার রয়েছে দুটো, তিন সাইজের তিনটে আয়রন মেইডেন রয়েছে—ওর ভিতর ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে চেপে মেরে ফেলা হত এক সময়ে অপরাধীকে। এছাড়া বুকের উপর কাঠের তক্তা ফেলে তার ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্যে কড়া লাগানো আধমনী লোহার ওজন রয়েছে বিশ ত্রিশটা। ঘরের এক কোণে রয়েছে একটা লায়ার র্যাক, এক এক করে শরীরের সমস্ত হাড় ভেঙে ফেলার যন্ত্র রয়েছে তার পাশেই। জ্যান্ত ভাজা করবার জন্যে ঘরের অন্য কোণে রয়েছে মধ্য যুগীয় চুলো, চারদিকে গজাল মারা মানুষ সমান লম্বা কাঠের পিপে রয়েছে একটা—এর ভিতর মানুষ ভরে মুখ আটকে গড়িয়ে দেয়া হত পিপেটা পাহাড়ের উপর থেকে, তীক্ষ্ণ গজালের খোঁচায় মোরব্বা – কাচা হয়ে মারা যেত অপরাধী। অপরাধ কবুল করাবার জন্যেও রয়েছে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, সূচ, কাঁটা বসানো চেয়ার, নানান কিছু।

কেমন যেন থমথমে ভাব ঘরটায়। দমে গেছে হাসি খুশি প্যাপন মং লাইও। মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মিসেস গুপ্ত আর সোফিয়ার মুখ। রানার চোখে চোখ পড়তেই হাসবার চেষ্টা করল সোফিয়া, কান্নার মত দেখাল হাসিটা।

ভয় পেয়েছে রানাও। ভাবছে, স্যাডিস্ট নাকি লোকটা? নইলে এইসব যন্ত্র সংগ্রহ করবে কেন? ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার মৃত্যু অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে?

‘ভয় পাবেন না। এসব আপনার উপর ব্যবহার করা হবে না, মিস্টার মাসুদ রানা।’

যেন রানার চিন্তার সূত্র ধরেই কথা বলে উঠল উ-সেন পিছন থেকে। নাটুকেপনা আছে লোকটার মধ্যে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল রানা ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে উ-সেন, ডক্টর হুয়াং, স্যুই থি, জেনারেল এহতেশাম আর কর্নেল শেখ।

‘এককালে নির্যাতন দেখতে খুবই পছন্দ করতাম। চোখ নষ্ট হয়ে যাবার পর দেখতে পেতাম না, কিন্তু অন্তিম চিৎকার শুনতে ভালই লাগত। কিন্তু একবার একজন লোককে সন্দেহের ওপর ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন করেছিলাম এখানে। কিছুতেই অপরাধ স্বীকার করাতে পারলাম না ওকে দিয়ে। নখের ভিতর সূচ দেয়া হলো, পায়ের বুড়ো আঙুলে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হলো ছাত থেকে, শেষকালে একটা একটা করে ভেঙে ফেলা হলো শরীরের সব কটা হাড়—মরে গেল, কিন্তু একটি কথাও বলল না লোকটা। দুদিন পরে জানতে পারলাম, লোকটা কালা ও বোবা ছিল। ভুল সন্দেহ করে ধরা হয়েছিল ওকে। সেই থেকে নির্যাতনের ওপর অভক্তি এসে গেছে আমার, নেহায়েত বাধ্য না হলে ওসবের মধ্যে যাই না। এখন বেশির ভাগ সময়ই এই কাচের ঘরটা ব্যবহার করি—দেয়ালে টাঙানো যন্ত্রপাতি ভীতি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে রেখে দিয়েছি এখনও।’ হাসল উ-সেন। ‘আপনাদের কাছ থেকে আমার আর কিছু জানবার নেই, কাজেই নির্যাতনের প্রয়োজনই পড়ে না অবশ্য ফ্যান সুর কথা একটু স্বতন্ত্র। আপনাদের মত বিনা-কষ্টের মৃত্যু লাভ করার যোগ্যতা ওর নেই। এদিকে এসো, ফ্যান সু, শেষ দেখা দেখে নিই তোমাকে।’

বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মিসেস গুপ্ত। উ-সেনের ইঙ্গিত পেয়ে দুপাশ থেকে দুজন প্রহরী চেপে ধরল ওর দুই হাত, টেনে নিয়ে গেল উ-সেনের কাছে। দুই হাতে ছুঁয়ে দেখল উ-সেন ওর মুখ, নাক, কপাল, চিবুক।

বাহ্, কী সুন্দর! আমি তৈরি করেছিলাম তোমাকে, আজ নিজের হাতেই নষ্ট করে দিচ্ছি। অথচ এই অপচয়ের কোন প্রয়োজন ছিল না, ফ্যান সু। তুমি যে এমন ভাবে বিশ্বাস ভঙ্গ করবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।’

‘ক্ষমা চাইছি আমি, উ-সেন।’

‘আমার মধ্যে ওই জিনিসটার বড়ই অভাব, ফ্যান সু। বহু কষ্টে খানিকটা সংগ্রহ করে দিয়েছিলাম তোমাকে একবার। আর ক্ষমা আমার স্টকে নেই। দুঃখিত।’ হঠাৎ ঝট করে ডান হাতটা উপরে উঠল উ-সেনের, ঝিক করে উঠল হাতে ধরা ছুরি। ঘ্যাচ ঘ্যাঁচ করে তিনবার বুলাল সে ছুরিটা মিসেস গুপ্তের দুই গালে, কপালে। তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার বেরোল ওর কণ্ঠ থেকে। ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত। একটা চেয়ারে বসে পড়ল উ-সেন। প্রহরীদের উদ্দেশে বলল, ‘ডান হাতের বুড়ো আঙুলে রশি বেঁধে টেনে তুলে দাও একে মেঝে থেকে তিন হাত ওপরে। ওই শেষ মাথায়। কাপড় খুলে নিয়ো।’

টেনে নিয়ে গেল ওরা মিসেস গুপ্তকে। নালিশের ভঙ্গিতে রানার দিকে চাইল একবার মিসেস গুপ্ত। চিরে গিয়ে ফাঁক হয়ে আছে দুই গাল আর কপালের চামড়া। এদিক ওদিক চাইল রানা। দুটো মেশিন পিস্তল তৈরি আছে ঠিক তিন হাত পিছনে। হাত কড়া লাগানো অবস্থায় কিছুই করবার উপায় নেই। যেতে যেতে পিছু ফিরে আবার চাইল মিসেস গুপ্ত রানার দিকে। বলল, ‘অনেক অন্যায় করেছি। পারলে মাফ করে দিয়ো আমাকে, রানা।’

চোখ সরিয়ে নিল রানা। কথা বলে উঠল উ-সেন। জোরে জোরে বলল যাতে শুনতে পায় মিসেস গুপ্ত।

‘নাইফ থ্রোয়িং প্র্যাকটিস করব একটু। এক কালে খুবই ভাল হাত ছিল, অভ্যাস নেই বহুদিন, এখন কেমন আছে কে জানে। চোখে দেখতে পাই না তো, তাই নিশ্চিত হতে পারছি না। দশটা ছুরি ছুঁড়ব আমি ওর দিকে। তার পরেও যদি ওর মৃত্যু না হয়, মাফ করে দেব আমি ওকে।

কাচের ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেল ওরা মিসেস গুপ্তকে নিয়ে ঘরের শেষ প্রান্তে। বুড়ো আঙুলে দড়ি পরাচ্ছে। মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে প্যাপন মং, লাই, সোফিয়া দাঁড়িয়ে আছে রক্তশূন্য মুখে বাপের গা ঘেঁসে।

‘কিন্তু আপনাদের এ ধরনের মধ্যযুগীয় পন্থায় হত্যা করা হবে না, মিস্টার মাসুদ রানা। সর্বাধুনিক পন্থা ব্যবহার করব আমি আপনাদের বেলায়। ওই যে কাচের ঘরটা দেখতে পাচ্ছেন—ওটা একটা বহুগুণ সম্পন্ন টর্চার কাম ডেথ চেম্বার। কাচেঁর ঘরটা সম্পূর্ণ এয়ার টাইট। ছাতের ওপর যে হোজ পাইপের মত দেখতে পাচ্ছেন, ওটা দিয়ে কয়েক রকমের কাজ করা যায়। এই যে সুইচ প্যানেল দেখছেন,’ রানা চেয়ে দেখল দেয়ালের গায়ে একটা সুইচ বোর্ডে বিশ পঁচিশটা বিভিন্ন রঙের সুইচ দেখা যাচ্ছে, ‘এর একেকটা টিপে দিলে একেক রকম ফল পাওয়া যায়। একটা টিপ দিলে ঝর ঝর করে বরফের মত ঠাণ্ডা পানি নামবে ঝর্ণা থেকে, আরেকটা টিপলে নামবে ফুটন্ত গরম পানি। কাচের ঘর কানায় কানায় ভরে গেলেও একফোঁটা পানি বাইরে আসবে না। একটা বোতাম টিপলে সমস্ত পানি শুষে নেবে পাইপটা। একটা টিপলে ঘরের সমস্ত বাতাস টেনে নেবে। একটাতে ভয়ঙ্কর গ্যাস নেমে আসবে ঝাঁঝরি দিয়ে। আরেকটায় আসবে শুধু গরম বাতাস। বুঝতে পারছেন? এর একেকটা সুইচে একেক রকম শাস্তির ব্যবস্থা আছে। কাউকে ইচ্ছে করলে দিনের পর দিন কষ্ট দেয়া যায়, ইচ্ছে করলে এক সেকেন্ডে মেরে ফেলা যায়। বিশ লক্ষ টাকা খরচ করেছি আমি এটা তৈরি করতে।’ প্রহরীদের উদ্দেশে গলা উঁচু করে বলল উ-সেন, ‘কই, হলো তোমাদের?

‘ইয়েস, স্যার।’ উত্তর দিল একজন।

বুড়ো আঙুলে বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে মিসেস গুপ্ত। ব্যথায় নীল হয়ে গেছে মুখটা। মনে হচ্ছে যেন ব্যথার মুখোশ পরিয়ে দিয়েছে কেউ ওকে। দশটা ছুরি ধরিয়ে দিল হুয়াং উ-সেনের হাতে।

‘আপনাদের তিনজনের বিরুদ্ধে আমার কোন ক্ষোভ নেই,’ যেন মজার একটা গল্প বলছে, এমনি আসরী ভঙ্গিতে কথা বলে চলল উ-সেন। আপনাদের দুর্ভাগ্য, প্রতিদ্বন্দ্বী আপনাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাই মরতে হবে আপনাদের। তবে,’ সাঁই করে একটা ছুরি ছুটে গেল ওর হাত থেকে। সোজা গিয়ে বিঁধল মিসেস গুপ্তের নগ্ন বাম ঊরুতে। কেঁপে উঠল শরীরটা, সেই সাথে ভেসে এল তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। তেমনি কথা বলে চলেছে উ-সেন, ‘খুব অল্প সময়ে যেন মৃত্যু হয় সেদিকে লক্ষ রাখব আমি। ভাবছি, কাচ-ঘরে আটকে ক্লোরিন গ্যাস দিয়ে মারব আপনাদের। পনেরো সেকেন্ডের মধ্যেই কয়েকটা খিঁচুনি আসবে সর্বশরীরে, তারপরেই সব শেষ হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় ছুরিটা হাত থেকে ছুটে যেতেই রীতিমত অবাক হলো রানা। ডান ঊরুতে গিয়ে বিঁধেছে সেটা। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো প্রথম ছুরিটা বাম ঊরুর ঠিক যেখানটায় লেগেছিল, দ্বিতীয় ছুরিটা ডান ঊরুর ঠিক সেই জায়গাটাতেই লেগেছে। পাকা হাত উ-সেনের, খেলাচ্ছে মিসেস গুপ্তকে। আরও নিঃসন্দেহ হলো সে যখন তৃতীয় ছুরিটা সোজা গিয়ে বাম বাহুতে প্রবেশ করল। কিছু একটা করা দরকার, কিন্তু একবিন্দু অসতর্ক হচ্ছে না দুজন প্রহরীর একজনও। অসহ্য হয়ে উঠেছে মিসেস গুপ্তের চিৎকার।

‘আপনি চঞ্চল হয়ে উঠেছেন, মিস্টার মাসুদ রানা। প্যাপন, তুমিও অস্থির হয়ে উঠেছ বুঝতে পারছি। তোমাদের বিশ্বাস করি না আমি। পিস্তল ধরে থাকা অবস্থাতেও যা খুশি করে বসা সম্ভব তোমাদের দ্বারা। হুয়াং…’ চতুর্থ ছুরিটা গিয়ে বিধল ডান বাহুতে। ‘টেম্পটেশন থেকে এদের মুক্ত করতে পারো? কিন্তু আমি চাই নৈপুণ্য দেখিয়ে ওদের মুগ্ধ করতে, দর্শক না থাকলে খেলার মজা থাকে না।’

সাথে সাথেই উত্তর এল, ‘লাইটিক দেয়া যায়।‘

আশার আলো জ্বলে উঠল রানার মনে। কান খাড়া করল উ-সেনের উত্তরটা শোনার জন্যে। খুশি হয়ে উঠল উ-সেন। বলল, ‘তোমার তুলনা হয় না, ডাক্তার। ভাল সমাধান বের করেছ। তাই দাও।’

পঞ্চম ছুরিটা সোজা গিয়ে ঢুকল নাভিতে। ইতোমধ্যেই রক্তে ভিজে গেছে মেঝেটা, এবার কলকল ধারায় নামল দুই পা বেয়ে। দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছে না রানা, মাঝে মাঝে পাগলামি চাপতে চাইছে মাথায়; ইচ্ছে হচ্ছে, যা থাকে কপালে, ঝাঁপিয়ে পড়বে উ-সেনের উপর।

কিন্তু তার সুযোগ হলো না। কাচের ঘরে নিয়ে আসা হলো ওদের। এক দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এসেছে স্যুই থি মিসেস গুপ্তের কসমেটিক কেসের ভিতরের সেই ছোট্ট বাক্সটা। সবার অলক্ষ্যে বার দুই চোখ টিপল রানা সোফিয়া ও প্যাপন মং লাইকে উদ্দেশ্য করে। কিছু বুঝতে পারল কিনা বোঝা গেল না ওদের মুখ দেখে।

রানাকেই প্রথম দেয়া হলো ইঞ্জেকশন। দশ সেকেন্ডের মধ্যেই এলিয়ে পড়ল রানার শরীর। টেনে নিয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসিয়ে দেয়া হলো ওকে। এবার সূচ ফুটানো হলো সোফিয়ার শিরদাঁড়ায়। উৎকণ্ঠিত রানা চোখের সামনে দৈখতে পেল কিভাবে এলিয়ে পড়ছে সোফিয়া। ঠিক একই ভাবে এলিয়ে পড়ল প্যাপন মং লাই। বিরাট একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল রানা। রানার পাশে সার বেঁধে বসানো হলো ওদের দুজনকে। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মিসেস গুপ্তকে। দুই স্তনে বিঁধে আছে দুটো ছুরি। অষ্টম ছুরিটা বিঁধল গিয়ে গলায় কণ্ঠার হাড় সংলগ্ন গোল গর্তটায়। নবম ছুরি সোজা গিয়ে ঢুকল হৃৎপিণ্ডে। দশম ছুরিটা শরীরের কোথাও লাগল না, ডান হাতের বুড়ো আঙুলের ঠিক এক ইঞ্চি উপরে কুচ করে রশিটা কেটে দিয়ে খটাং করে লাগল গিয়ে দেয়ালে। ধড়াস করে মেঝের উপর পড়ল মিসেস গুপ্ত—মৃত।

শব্দটা শুনেই উঠে দাঁড়াল উ-সেন মুখে একগাল হাসি নিয়ে। বলল, ‘যদি এর পরেও বেঁচে থাকে, তাহলে মাফ করে দেব আমি ওকে। কেউ কোন কথা বলছে না কেন? ডাক্তার, রেজাল্টটা জানাবে না আমাকে?’

‘ডেড। পরীক্ষা না করেই উত্তর দিল হুয়াং।

‘গুড। এইবার বাকি তিনজন। তাই না?’ কাচের ঘরে এসে ঢুকল উ-সেন। ‘ভয় নেই, মিস্টার মাসুদ রানা পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে মৃত্যু ঘটবে আপনাদের।’

কাচের বলটা তুলে নিল উ-সেন মিসেস গুপ্তের ছোট্ট বাক্স থেকে। বলল, ‘এই বলটা ফাটিয়ে দেব আমি এঘরের ভিতর। সাথে সাথেই বন্ধ করে দেয়া হবে এয়ার টাইট দরজাটা। যদি ভগবানে বিশ্বাস থাকে ডেকে নিন আধ মিনিটের ভিতর। ডাক্তার, ওদের হাতকড়া খুলে দাও। লাইটিকের পর আবার হাতকড়ার কি দরকার?

চোখের তারা স্থির থাকছে না রানার। তবু লক্ষ করল, হুয়াং-এর মুখে কোন সন্দেহের ছায়া পড়ে কিনা। না। হাতকড়া খুলে দিয়েই সরে গেল সে দরজার কাছে। বড় করে দম নিল রানা।

ভগবান আপনাদের মঙ্গল করুন।’ দরজার ফাঁকটা ছোট করে এনেছে উ-সেন।

সাঁই করে ছুটে এল কাচের বলটা। ঝন ঝন করে ভেঙে গেল রানার মাথার ঠিক এক হাত উপরে, দেয়ালে লেগে।

খটাং করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ক্লিক করে শব্দ হলো হ্যান্ডেল তোলার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *