অধ্যায় পাঁচ – বর্তমান সময়
টোলারবাগ এলাকা, মিরপুর
‘তুই কি আমার কথা শুনছিস, নাকি আমি বাতাসের সঙ্গে বকবক করছি?’
‘হুম্, কি?’ একটু বিরক্ত হয়েই মায়ের দিকে ফিরে তাকাল তানভীর। মনে মনে কিছু একটা ভাবছিল ও, মায়ের কথা শুনে ভাবনার তাল কেটে গেছে। ‘কি বললে?’
যা ভাবছিলাম! তুই আমার একটা কথাও শুনোস নাই,’ ওরা পাশ থেকে রাগের সঙ্গে বলে উঠল মা।
‘না না শুনছি তো, মনে মনে ও ভাবার চেষ্টা করছে মায়ের কথা থেকে মনোযোগ হারানোর আগে শেষবার কী শুনেছিল। সম্ভবত বাসার কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিল মা। ঝড়ে বক মারতে হবে, উপায় নেই। ‘বললাম তো ডায়নিং টেবিল এ মাসেই বানাতে দেব। আর তোমার গাছগুলোর জন্যে বড়ো বড়ো কয়টা ড্রাম কিনে মাটি ভরে দেব, যাতে তুমি পেঁপে, হাবি জাবি যা যা চাষ করতে চাও, করতে পারো। ঢাকায় বাসার ছাদে তো লোকজন এখন এভাবেই বাগান করে, কথা শেষ করে মায়ের প্রতিক্রিয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল ও। মনের ভেতরে দুরাশা, হয়তো ঝড়ে বক মরেছে।
কিন্তু ওর দুরাশা মনেই রয়ে গেল, বক আর মরল না। প্রথমে দেখতে পেল মায়ের মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠল, তারপর সেই রাগের জায়গা দখল করে নিল হতাশ একটা ভাব।
‘তুই…’ কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেল মা। হতাশার সঙ্গে বলে উঠল, ‘তুই আমার সঙ্গে চাপা মারতে চাস?’ বলে সে তানভীরের একটা হাত ধরে আবারো হাঁটতে শুরু করল। ‘দেখ বাবা, তোর বুঝতে হবে আমার বয়স হচ্ছে। তোর বাবা মারা গেছে আজকে তিন বছর। তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোরে তো আমি কাছে পাই না। ঠিক আছে, তোরে আমি আর পাবো না এইটা আমি বুঝে গেছি। কিন্তু আমার তো একটা সঙ্গী দরকার,’ বলে সে তানভীরে দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘আমার স্কুলের চাকরি আর দুই বছর আছে। একবার অবসরে গেলে আমি কী করব, বল তো? কাকে নিয়ে থাকব। তুই তো দিন-রাত দেশে-বিদেশে টোটো করে বেড়াবি। আমারে তুই একটা সঙ্গী দে,’ বলে সে থেমে গেল। তানভীরের কাঁধে একটা হাত রেখে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘বাপ, এইবার বিয়াটা কর। এক হারামজাদির জন্যে জীবনটা আর কত নষ্ট করবি?’
‘মা!’ বলে তানভীর একবার অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘তুমি তো একজন শিক্ষিত মানুষ। তুমি যদি আর দশজনের মতো করো, হবে বলো?’ বলে ও একটু থেমে যোগ করল। ‘আর তুমি ভালো করেই জানো তুমি যা বলছো ব্যাপারটা মোটেই ওরকম কিছু না।’
‘তাইলে কীরকম আমারে বল, সেইটাও তো বলতে পারবি না। তোর কি ধারণা আমি কিছু বুঝি না!’ রাগের সঙ্গে ঝাপটা দিয়ে তানভীরের হাতটা ছাড়িয়ে সামনে হাঁটতে লাগল মা।
‘আরে, সকালবেলা এমন করলে হয়। এতদিন পরে দেশের বাইরে থেকে এলাম। আসতেই শুরু করেছো তোমার প্যানপ্যানানি!’ মায়ের পেছন পেছন জোরে হাঁটতে লাগল তানভীর। ‘তোমার জন্যে আনা ঘড়িটা পছন্দ হয়েছে কি না?’
জোরে জোরে হাঁটছিল মা হঠাৎ থেমে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। ‘তোর কাছ থেকে ঘড়ি না, তোর একটু সময় চাই আমি। দিতে পারবি?’ বলে সে আবারো হাঁটতে লাগল।
‘আরে, কী করে!’ বলে তানভীর জোর করে মাকে এসে ধরে ফেলল। তানভীরদের বাসা মিরপুর এক নম্বরের কাছেই টোলারবাগ এলাকায়। ওর বাবা সরকারি চাকরি করতেন। অবসরে যাবার পর ওদের তিনতলা বাড়িটা তৈরি করে যান উনি। বছর তিনেক আগে বাবা মারা যাবার পর থেকে সেটারই দোতলায় মা আর ছেলে মিলে থাকে ওরা। দেশে থাকলে আর কাজের চাপ না থাকলে সাধারণত প্রতিদিন সকালে মাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয় তানভীর।
ওর ট্রেনিংয়ের শেষ পর্যায়ে দেশ থেকে জরুরি তলব পেয়ে হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে রওনা দিয়ে কাল সন্ধের দিকে দেশে এসে ল্যান্ড করে ওর প্লেন। বাড়ি আসতে আসতে রাত। এতদিন পরে ছেলেকে পেয়ে মা খুশিতে আত্মহারা। তবে মায়ের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেয়ার মতো অবস্থায় ছিল না ও। জলদি ঘুমিয়ে গেছিল ক্লান্তির কারণে। তবে সকাল হতে ঠিকই মাকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে।
টোলারবাগ এলাকাটা সুন্দর, রাস্তা-ঘাটগুলোও ঢাকার অন্যান্য জায়গার তুলনায় ভালো। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা প্রচুর লোক হাঁটাহাঁটি করে। একটু পর পর পানি-ডাব এসবের দোকান তো আছেই সেইসঙ্গে আছে প্রেসার-ডায়াবেটিস মাপানোর ব্যবস্থা।
মা রাগ করার পরে বহুক্ষণ ধরে এটা-ওটা বুঝিয়ে অনেকটাই শান্ত করে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মার ডায়াবেটিস মাপছে-এমন সময় তানভীরের ট্রাউজারের পকেটে থাকা পেজারটা বাজতে লাগল। পকেট থেকে ওটা বের করে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে রইল ও।
সকালে হাঁটতে বেরোলে সাধারণত মোবাইলটা বাসায় রেখে আসে তানভীর। তবে ও যে সংস্থায় কাজ করে সেটার নিয়ম অনুযায়ী মোবাইল না থাকলেও যেখানেই যাক বিশেষ একটা পেজার ওদেরকেই অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হয়। যাতে করে যেকোনো সময় অফিস ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। পেজারে আসা টেক্সটা পড়ে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল তানভীর ।
ডায়াবেটিস মাপানোর জন্যে তর্জনী ফুটো করে রক্ত নিয়েছিল যে আঙুল থেকে—সেই আঙুলটা মুখে পুরে কঠিন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ছে মা।
‘খবর এসে গেছে, তাই না?’ বলে আরেকবার কাঁধ ঝাঁকাল তানভীরের মা। ‘সব মা দোয়া করে সন্তান যেন আরো পরিশ্রমী হয়, আর আমি দোয়া করি, আমার ছেলেটা যেন একটু আলসে হয়। আমি একটা জিনিস বুঝি না, তোর বাপে যা রেখে গেছে সেটা দিয়েই তোরা কয়েক পুরুষ বসে খেতে পারবি। তাহলে তুই এমন কাজ পাগলা হয়েছিস ক্যান?’
তানভীর এগিয়ে এসে মার একটা হাত ধরে হাঁটতে লাগল। ‘কাজ তো আর শুধু টাকার জন্যে না। তুমি তো জানোই আমি এই অভ্যাস তোমার কাছ থেকেই পেয়েছি। বাবা সারাজীবন ভালো চাকরি করেছে তারপরও তুমি কাজ করেছো কাজের আনন্দে। আসলে আসলে-’ তানভীর মাকে বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
‘শোন, বাবা। তোরা অল্প বয়সের পোলাপান মনে করিস দুনিয়ার সব বুঝিস। আসলে কিছুই বুঝোস না,’ বলে ছেলের একটা হাত ধরে সে বলে উঠল, ‘বাবা, একটা কথা মনে রাখবি কাজ-সফলতা-বিফলতা-ভালোবাসা এগুলো জীবনের অংশ হতে পারে কিন্তু এগুলোর কোনোটাই পরিপূর্ণ জীবন না। ওই মেয়েটা তোর সঙ্গে যা করেছে সেটা হয়তো তোকে অনেকটাই বদলে ফেলেছে-কিন্তু মনে রাখিস এইগুলা সবই জীবনের অংশ বরং কোনোটাই…বাদ দে। বাসায় চল। তোকে আবার অফিসে যেতে হবে।’
মায়ের আগের কথাগুলো শুনে তানভীর কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু চুপ হয়ে গেল। বাড়িতে ফেরার জন্যে রিকশা ডাক দিল ও।
নিজের বাড়ি আসলে নিজের বাড়িই। দুনিয়ার যেখানেই যাক আর যাই করুন না কেন, সবসময়ই ওর মনের একটা অংশ পড়ে থাকে এই বাড়িতে, নিজের পরিবারের কাছে। বিশেষ করে বাবা মারা যাবার পর থেকে মা একেবারেই একা হয়ে গেছে। নিজে তো সঙ্গ তেমন দেয়ই না, তার ওপরে মা বারবার বিয়ে করার জন্যে চাপ দেয়ার পরও এসব নিয়ে ভাবারও সময় পাচ্ছে না ও। ব্যাপারটা মনে আসতেই নিজের ভেতরে একটা অপরাধবোধ কাজ করে ওর। কী করার আছে, জীবনটাই বদলে গেছে এমনভাবে।
ঘরে ঢুকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কামরার দিকে চলে এলো ও। বাড়ির বাইরে থাকলেও মা সমসময়ই ওর কামরা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে। ওর মায়ের ওসিডি আছে, মানে বাংলায় যাকে বলে শুচিবায়ু আছে। বাসা-বাড়ির কোথাও এতটুকু এলোমেলো দেখতে পারে না। একই অভ্যাস ওরও। বরং বলা চলে ওর ওসিডি মায়ের চেয়ে একটু বেশিই।
বাসায় থাকলে নিজের কামরা থেকে শুরু করে নিজের সবকিছু ও নিজেই গুছিয়ে রাখে। এমনকি চরম ব্যস্ততার সময়ও এলোমেলো থাকতে পারে না ও। এটা নিয়ে বাড়িতে, অফিসে-বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ওকে ঝামেলাও কম পোহাতে হয়নি। তবে অভ্যাস তো অভ্যাসই, ওর ধারণা কখনোই এর হাত থেকে মুক্তি নেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের কামরাসংলগ্ন ওয়াশরুমে এসে ঢুকল তানভীর।
ইংল্যান্ডে থেকে কেনা ফিলিপস ট্রিমার দিয়ে দাড়ি ট্রিম করে নিল। একসময় নিয়মিত ক্লিন শেভ করলেও গত কয়েক বছর ধরে ক্লিন শেভ করে না। শেষবার কবে ক্লিনশেভ করেছে মনেও নেই। দাড়ি রাখতে রাখতে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে এখন। ট্রিম শাওয়ার সেরে কাঠের আলমিরা থেকে পছন্দসই পোশাক বের করল।
এই জন্যেই মাকে ওর ভালো লাগে। ও বাড়ি না থাকলেও ওর প্রতিটা পোশাক সুন্দরমতো লন্ড্রিতে দিয়ে ওয়াশ করে এনে গুছিয়ে রাখবে। ফেড ডেমিন জিন্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডে থেকে কেনা ডানহিলের সাদা শার্ট পরে নিল ও। অ্যাশ কালারের ব্লেজারটা বের করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ডিসেম্বর মাসের ঠান্ডা বাইরে বেশ জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে। ব্লেজার রেখে ইটালিয়ান লেদারের ডার্ক ট্যান জ্যাকেটটা বের করল ও। পোশাক পরা শেষ করে হাতে ফসিলের ঘড়ি পরে ওর প্রিয় ফাইটার ব্র্যান্ডের বুট পায়ে গলিয়ে পাশা স্যারের জন্যে ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা প্যাকেটটা নিয়ে যখন ডায়নিং রুমে এলো ততক্ষণে টেবিলে নাশতা সাজিয়ে ফেলেছে মা।
ও টেবিলে এসে বসতেই দেখতে পেল মা তার ওষুধের বাক্স বের করে সিরিঞ্জে ইনসুলিন ভরছে।
‘দাঁড়াও, আমি দিয়ে দিচ্ছি,’ বলে ও উঠে এলো মায়ের কাছে। ‘কত দাও এখন তুমি?’ মায়ের কাছ থেকে ওষুধের মাত্রা শুনে নিয়ে সেই অনুযায়ী মিক্স করে ইনসুলিন পুশ করে দিল মার হাতে।
নাশতা করতে করতে কথা বলতে লাগল মার সঙ্গে। ‘তোমার ডায়াবেটিস দিন দিন এরকম বাড়ছে কেন? আমি না থাকলে বুঝি হাঁটো না?’
‘তুই না থাকলে তো হাঁটতে ইচ্ছে করে না,’ নীরবে খেয়ে চলেছে মা।
‘কেন, সুমন ভাইয়ের মা আর যায় না?’
‘না সে তো বেশ অসুস্থ অনেকদিন ধরে, ইদানীং আর হাঁটে না,’ বলে উনি তানভীরের দিকে না তাকিয়েই জানতে চাইলেন। ‘সকালবেলা দেখলাম তোর ওটা বাজছে,’ পেজারটার কথা বলছে মা। ‘এখন আবার এত সাজগোজ করে বেরুচ্ছিস। আবার কোথাও যাবি নাকি?’
‘আরে নাহ,’ নাশতা করতে করতেই জবাব দিল তানভীর। ‘সেরকম কিছু না, এখন আর ঢাকার বাইরে যাব না। কিছুদিন নিয়মিত অফিসের বাইরে কিছুই করার ইচ্ছে নেই,’ প্লেটের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলল ও। মায়ের সঙ্গে দৃষ্টি মেলানোর ইচ্ছে নেই। কিন্তু ঠিকই কিছুক্ষণ পর মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল খাওয়া বন্ধ করে মা এক দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
কি? খাওয়া থামিয়ে দিয়েছো কেন?’ তানভীর হাসতে হাসতে জানতে চাইল।
‘তোর ওই মেশিনটা এখন পর্যন্ত যতবার বেজেছে ততবারই তুই কত দিনের জন্যে গায়েব হয়েছিস খোদা জানে,’ বলে মা আবার খেতে শুরু করল। তানভীর খাওয়া শেষ করে পেছন থেকে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এবার তেমন হবে না,’ বলে ও এবার চলে এলো নিজের কামরায়। নিজের পিস্তলটা নিতে ভুলে গেছিল।
কাবার্ড থেকে বের করে নিজের স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু নাইন এমএম ল্যুগারটা একবার পরীক্ষা করে নিয়ে কোমরে বেল্টের সঙ্গে আটকে গলায় একটা সিল্কের স্কার্ফ পেঁচিয়ে বেরিয়ে এলো ডায়নিং রুমে। ‘মা আমি বেরুচ্ছি। তোমার ইনসুলিন দেখলাম প্রায় শেষ। সন্ধেবেলা আসার সময়ে আমি নিয়ে আসব। আর তুমি একটা কল করে দিও সুমন ভাইয়ের দোকানে, ওরা এসে টেবিলের মাপ নিয়ে যাক। আমি পরে ডিজাইন ঠিক করে একটা ডায়নিং টেবিল আর ছয়টা চেয়ার অর্ডার করে দেব,’ বলে ও একটা হাসি দেয়ার চেষ্টা করল।
‘টেবিল-চেয়ার বানালেই বা লাভ কি। ওতে বসবে কে?’ গম্ভীর মুখে বলেই মা হেসে ফেলল। ‘আচ্ছা, ঠিক আছে যা। এখন বেরুচ্ছিস বেরোবার আগে মুখ গোমড়া করব না।’
মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ও চলে এলো গ্যারেজে। পাশা স্যারের জন্যে নিয়ে আসা গিফটের প্যাকেটটা বাইকের পেছনে নেটের সঙ্গে আটকে বাইক স্টার্ট দিল ও।
মিরপুর টোলারবাগ থেকে ধানমণ্ডি চার নম্বরে আসতে ওর সময় লাগল মোট ছাব্বিশ মিনিট। মনে মনে ও ভাবল, ব্যাপার কি, ও ঢাকা ছেড়েছে ছয় মাস হয়েছে। এরই মধ্যে কি ঢাকা শহরের জ্যাম কমে গেল নাকি। সঙ্গে সঙ্গেই এই দ্রুত আগমনের রহস্যটা ধরতে পারল ও। একে তো সকালবেলা তার ওপরে আবার মঙ্গলবার। মনে মনে ও ভাবল, আচ্ছা এই তাহলে রহস্য। ঢাকা শহরের জ্যাম চিরজীবী হোক, কথাটা মনে মনে বলে ও বাইকটা পার্ক করে পিবিআইয়ের মূল ভবনের দিকে এগোল।
পিবিআই পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের ক্রিমিনাল অ্যানালিসিস উইংয়ের সিনিয়র অফিসার তানভীর মালিক আজ থেকে চার বছর আগে পিবিআইতে জুনিয়র অ্যানালিস্ট হিসেবে যোগদান করে বছর দুয়েক কাজ করার পর পিবিআই থেকে আলাদা করে যখন ক্রিমিনাল অ্যানালিসিসের আলাদা উইং গঠন করা হয় তখন তাতে সিনিয়র অফিসার হিসেবে ট্রান্সফার করা হয় তানভীরকে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে পদোন্নতি পেয়ে বর্তমান অবস্থানে কাজ করছে ও।
এরই মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ কাজে বেশ দক্ষতা দেখানোর পর মাস ছয়েক আগে ক্রিমিনাল অ্যানালিসিস উইংয়ের বর্তমান প্রধান হাবিব আনোয়ার পাশার মাধ্যমে বিদেশে ট্রেনিংয়ে যাবার সুযোগ আসে ওর। ইংল্যান্ডের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর জার্মান পুলিশের বিশেষ একটা টেকনো স্ট্রাইকিং ফোর্সের ট্রেনিংয়ের একেবারে শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে এমন সময় ওকে জরুরি তলবের মাধ্যমে ডেকে পাঠানো হয় দেশে।
ছয় মাস আগে ওর বস হাবিব আনোয়ার পাশা বিদেশে ট্রেনিংয়ে যাবার জন্যে যখন ওকে মনোনীত করল ব্যাপারটা অফিসের সবাইকে তো অবাক করেছিলই, তবে বেশি অবাক হয়েছিল ও নিজে। কারণ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর জার্মান পুলিশের এই যৌথ ট্রেনিংয়ে যাবার জন্যে ওদের অনেক ফিল্ড এজেন্টই মুখিয়ে ছিল। অফিসের সব ফিল্ড এজেন্টদের রেখে ওর মতো ডেস্কে বসা অফিসারকে বাইরে ট্রেনিংয়ে পাঠানোটা অবাক করার মতোই একটা ব্যাপার ছিল। সবশেষে ট্রেনিংয়ে যাবার জন্যে দুজনকে মনোনীত করা হয়। একজন ও নিজে আর অন্যজন আরেক ফিল্ড এজেন্ট শারিয়ার। দুজনে মিলে মাস ছয়েক আগে লন্ডনে পাড়ি দেয়। শারিয়ারের সঙ্গে শুরুতে ওর সম্পর্কটা খুব একটা ভালো না থাকলেও একসঙ্গে ট্রেনিংয়ে অনেকটা সময় কাটানোর পর দুজনের ভেতরে সুন্দর একটা বোঝাপড়া গড়ে ওঠে। তবে ওকে এভাবে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠানোর ব্যাপারটা একটু দ্বিধার সৃষ্টি করেছে ওর ভেতরে।
এসব ভাবতে ভাবতেই ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে লিফটে উঠে চলে এলো টপ ফ্লোরে। মূলত ক্রিমিনাল অ্যানালিসিস উইং এখন পর্যন্ত পিবিআইয়ের একটি শাখা হলেও ওরা অনেকটা স্বতন্ত্রভাবেই কাজ করে। আর তাই ওদের বস হাবিব আনোয়ার পাশা চেষ্টা করছেন দাপ্তরিকভাবে এটাকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার।
ওকে দেখতে পেয়ে শটগান হাতে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড এক গাল হেসে কাচের দরজাটা মেলে ধরল। ভেতরে প্রবেশ করে দুয়েকজন কলিগের সঙ্গে সাধারণ শুভেচ্ছা বিনিময় করে সোজা চলে এলো হাবিব আনোয়ার পাশার কামরার সামনে। পিবিআইয়ের ক্রিমিনাল অ্যানালিসিস উইংয়ের প্রধান হাবিব আনোয়ার পাশার কামরার সেগুন কাঠের কারুকাজ করা দরজার ঠিক বাইরেই কাচঘেরা আরেকটা অফিস।
অফিসটা পাশা স্যারের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি মৌসুমি জাফরিনের। এই মুহূর্তে সে তার টেবিলের ওপাশে বসে খুব মনোযোগের সঙ্গে কম্পিউটারের কি-বোর্ডে খটাখট কিছু একটা টাইপ করে চলেছে। তার টাইপ করার স্পিড যেকোনো প্রফেশনাল কম্পোজারকেও লজ্জায় ফেলে দিতে পারে।
হালকা ঘোলাটে কাচের অন্যপাশে থেমে গেল তানভীর। হঠাৎ সামনে গিয়ে কিছু একটা বলে চমকে দেবার ইচ্ছে ছিল ওর কিন্তু তার আগেই অন্যপাশ থেকে ভারী গলায় মৌসুমি বলে উঠল, ‘হইছে! আমি চমকাইছি, এখন সামনে আয়,’ মৌসুমির কথাগুলো শুনে তানভীর হতাশ ভঙ্গিতে সামনে চলে এলো।
‘আমি একটা জিনিস আজো বুঝতে পারলাম না, এই ঘোলা কাচের অন্যপাশ থেকে তুমি সবসময় ক্যামনে বুঝে যাও কে আসছে। বোঝা সম্ভব, কিন্তু তাই বলে প্রতিবার সঠিক কিভাবে বলা সম্ভব?’ তানভীর এগিয়ে এসে মৌসুমির ডেস্কের এক কোনোায় বসে পড়ল। বসের সেক্রেটারি মৌসুমির সঙ্গে তানভীরের সম্পর্কটা বড়ো বোন আর ছোটো ভাইয়ের মতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে ক্রিমিনোলজিতে মাস্টার্স পড়াকালীন সময় থেকেই মৌসুমির সঙ্গে তানভীরের পরিচয়। ওর থেকে বয়সে বেশ বড়ো মৌসুমি আপা ছিল ওদের ব্যাচের সেরা ছাত্রী। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র তানভীর ক্রিমিনোলজির মাস্টার্সে যখন একেবারেই ভালো করতে পারছিল না তখন এই মৌসুমি আপাই ছিল ওর একমাত্র ভরসা। সেখান থেকেই ওদের দুজনার ভেতরে ভাই-বোনের সম্পর্ক। কর্মক্ষেত্রে একইসঙ্গে কাজ করতে করতে সেটা আরো গভীর হয়েছে।
‘তিসরি আঁখ, বালক,’ বলে মৌসুমি কি-বোর্ডে টাইপ থামিয়ে ওর দিকে ফিরে তাকাল। ‘শোন, তুই মাঝে মাঝে ভুলে যাস বিহেভিয়র অ্যানালিসিসে আমি বরাবরই তোর চেয়ে ভালো ছিলাম। সবসময় মনে রাখবি মানুষকে যতটা না তার আকৃতি দিয়ে চেনা যায় তার চেয়ে বেশি চেনা যায় তার নড়াচড়া দিয়ে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট রেটিনা এসব যেমন প্রতিটা মানুষের আলাদা ঠিক তেমনি প্রতিটা মানুষের শরীরের নড়াচড়াও আলাদা।
নড়াচড়াও আলাদা। একবার যেকোনো মানুষের সূক্ষ্ম মুভমেন্টগুলো বুঝে ফেলতে পারলে তাকে তুই হাজারজনের ভেতর থেকেও খুব সহজেই আলাদা করতে পারবি। বুঝছিস?’
‘এটা তো বুঝলাম কিন্তু তুমি ফিল্ড লেভেলে না গিয়ে এই ডেস্ক জবে কেন এলে সেটা আজো বুঝতে পারলাম না,’ বলে ও হাতের প্যাকেটটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখল। ‘তোমার যা মেধা, দারুণ করতে তুমি।’
‘দুই বাচ্চার মা হলে বুঝতি,’ বলে সে আবারো চোখ রাঙাল। ‘এসব বাজে প্যাচাল বাদ দে। ইমার্জেন্সি পেজ করার দেড় ঘণ্টা পর এসেছিস তুই। এটা কোনো কথা। তোর এই শাস্তি মওকুফ হবে, আগে বল ইংল্যান্ড থেকে যা আনতে বলেছিলাম সেটা এনেছিস কি না?’
‘সরি আপা,’ বলে ও দুই হাত তুলল। ‘এমনভাবে ডেকে পাঠালে তোমরা, কোনো কেনাকাটাই তো করতে পারলাম না,’ বলে ও হাতের প্যাকেটটা খুলে সেটার ভেতর থেকে বড়ো এক বাক্স চকোলেট বের করে মৌসুমি আপার হাতে তুলে দিল। ‘তাও শেষ মুহূর্তে এয়ারপোর্ট থেকে এটা কিনেছি।’
‘বাহ্, চকলেট। দারুণ,’ বলে সে প্যাকেট খুলে চকলেট বের করে মোড়ক ছিঁড়ে কামড় বসাল। ‘অহ্, মাই গড! আসল বর্নভিল, শ্যালে…তুই নিশ্চয়ই এত্তোগুলা চকলেট আমার জন্যে আনিসনি?’ বলে সে ভ্রু কুঁচকাল।
‘আরে, তোমার জন্যেই এনেছি। এখানে অনেক চকলেট। তুমি অফিসের সবাইকে দিয়ে দিও,’ বলে ও টেবিলের ওপর থেকে নেমে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। বসের জন্যে নিয়ে আসা প্যাকেটটা রেখে দিল টেবিলের ওপরে।
‘ওটার ভেতরে আবার কি? নিশ্চয়ই বসের জন্যে। আমাদের জন্যে স্রেফ চকলেট আর বসের জন্যে গিফট।’
‘এটা আমার কেনা গিফট না, বসের জন্যে তার বন্ধু আমাদের চিফ ট্রেনিং প্রোগ্রাম অফিসার দিয়েছেন। ওসব বাদ দিয়ে আগে বলো, এত জরুরি তলব কিসের? কিছু হয়েছে নাকি?’ তানভীর কাজের কথায় ফিরে আসতে চাইছে।
ওর কথা শুনে মৌসুমি আপাও একটু গম্ভীর হয়ে গেল। সে একবার মনিটরের দিকে দেখে নিয়ে বলে উঠল, ‘আর বলিস না! কাল রাতে এগারোটায় বাসায় গেছি। আজ আবার সকালে সাতটায় অফিসে ঢুকে এখনো টানা কাজ করে যাচ্ছি।’
‘হয়েছেটা কি? সেটা বলো,’ তানভীর ভেতরে ভেতরে কৌতূহল বোধ করছে। মৌসুমি একটু চুপ থেকে কি জানি ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমি জানি না তা বলব না, তবে তুই বসের কাছ থেকেই জেনে নে। দাঁড়া এক মিনিট,’ বলে সে ইন্টারকমে কথা বলতে লাগল। কথা শেষ করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘ভেতরে যা, বস অপেক্ষা করছেন।’
তানভীর মাথা নেড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ‘দেখি, ভেতরে কী অপেক্ষা করছে,’ মৌসুমি আপার দিকে পেছন ফিরতে ফিরতে শুধু দেখতে পেল তার মুখে রহস্যময় হাসি।
বছর দুয়েক আগে এই সেকশনে আসার আগে ও সবার মুখে শুধু হাবিব আনোয়ার পাশার নামই শুনেছে। তাই মনের ভেতরে একটা ইমেজ দাঁড় করিয়েছিল মানুষটার। তাই এই সেকশনে আসার আগে ও যখন বিশেষ একটা ভাইভা ফেস করতে যায় তখন মানুষটার সঙ্গে কথা বলে বেশ অবাক হয়েছিল। কারণ ওর মনের ভেতরে যে ইমেজ ও দাঁড় করিয়েছিল, মানুষটার সঙ্গে তার কোনো মিলই নেই। হাসিখুশি একজন মানুষ। তবুও এই সেকশনে জয়েন করার পর বসের সঙ্গে ওর সম্পর্ক খুব একটা গভীর ছিল না। তবে ও জয়েন করার পরেই একটা বিশেষ ঘটনা ওদের দুজনকেই খুব কাছাকাছি নিয়ে আসে। তানভীর ভারী কাঠের দরজায় একবার নক করে ভেতরে ঢোকার জন্যে দরজায় চাপ দিল ।
ভেতরে ঢুকতে প্রথমেই ওর দৃষ্টি গেল বসের বিরাট টেবিলটার দিকে। কিন্তু ওটার পেছনে কেউ নেই। ও সামনে এগোতেই রুমের এক কোনো থেকে থেকে কেউ বলে উঠল, ‘আরে, তানভীর, মাই বয়, কাম অন,’ হাবিব আনোয়ার পাশা বইয়ের একটা সেলফের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ফাইল ঘাঁটছিল ওকে দেখতে পেয়ে সামান্য এগিয়ে একবার ওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটা নির্দিষ্ট ফাইল তুলে নিয়ে ডেস্কে বসে পড়ল। বলো, কি অবস্থা তোমার?’
‘এই তো স্যার,’ বলে ডেস্কের সামনে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল ও। টেবিলের ওপর দিয়ে প্যাকেটটা এগিয়ে দিল আনোয়ার পাশার দিকে। ‘স্যার এটা আমাদের ট্রেনিংয়ের চিফ আপনাকে দিয়েছেন।’
‘অহ্, টেডি। ওল্ড ফ্রেন্ড। তুমি আর শারিয়ার যেমন ট্রেনিং করতে গেছো একসঙ্গে, ঠিক একইভাবে বহু আগে আমি আর টেডি আমেরিকাতে গেছিলাম প্রায় এ ধরনেরই একটা ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে। অহ, মাই গড এটা কি?’ উনি প্যাকেট থেকে বের করে আনা অস্ত্রটা দেখে তাজ্জব হয়ে গেছেন। ‘এটা সাবমেশিনগান নাকি?’
‘না, স্যার। এটা আরো অনেক উন্নতমানের জিনিস। আমি দেখাচ্ছি,’ বলে ও দেখাতে লাগল জিনিসটা কিভাবে কাজ করে। ‘এটাকে ওরা বলে স্টান সাবমেশিনগান,’ বলে ও সব ব্যাখ্যা করে যোগ করল, ‘এইযে এখান দিয়ে কারেন্টের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বিশেষ অ্যাডাপ্টর দিয়ে ঠিকমতো চার্জ দিলেই কাজ করে। যদিও ওরা এটাকে নাম দিয়েছে স্টান সাবমেশিনগান আমি এটাকে নাম দিয়েছি বিদ্যুৎ চক্রবাণ।’
ছোটো বাচ্চারা নতুন খেলনা পেলে যেরকম খুশি হয় আনোয়ার পাশা সেভাবেই দেখছে জিনিসটা। ‘কি দারুণ জিনিস বানিয়েছে, না?’ বলে সে চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে। ‘কি বললে, বিদ্যুৎ চক্রবাণ না? মহাভারতের সেই চক্রবাণ থেকে। যথাযথ নামকরণ হয়েছে। থ্যাঙ্কু,’ বলে আবার প্যাকেটে মুড়িয়ে রেখে দিল সে অস্ত্রটা। ‘এয়ারপোর্টে এটা পার করতে তোমার সমস্যা হয়নি?’
‘না, স্যার। বিশেষ অনুমতিপত্র ছিল।’
‘তা তোমার ট্রেনিং নাকি খুব ভালো হয়েছে। পারফর্মেন্সও নাকি খুব ভালো ছিল। বিশেষ করে শেষ অপারেশনে তুমি নাকি দুর্দান্ত সাফল্য দেখিয়েছো?’ বলে সে হাসতে লাগল। যদিও বসকে গুলি করা কিন্তু খুব একটা কাজের কথা নয়, এটা বলে সে খুব রহস্যময় একটা হাসি দিল।
তানভীরও একটু লাজুক হাসি দিল। ‘স্যার, আপনি তো তাহলে সবই জানেন। শারিয়ার আর আমি শুরুতে মাস তিনেক একই টিমে ছিলাম। পরে ওকে ভিন্ন টিমে ট্রান্সফার করা হয়। তবে শুনেছি ও ভালো করছে। ও তো শেষ পর্যন্ত
থাকতে পারছে তাও,’ শেষ কথাটা ও ইচ্ছে করেই একটু ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বলল।
ওর কথাটা শুনে আনোয়ার পাশার মুখে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠল। ‘তানভীর, তুমি কি একটা ব্যাপার জানো, আমাদের দেশে সরকারিভাবে বিদেশ থেকে যখন কোনো স্কলারশিপ, ফান্ডিং কিংবা ট্রেনিংয়ের সুযোগ আসে তখন সেটার পেছনে কী পরিমাণ লবিং হয়?’
তানভীর বসের চোখের দিকে তাকিয়েই জবাব দিল। ‘জ্বি, স্যার। আমি দুই- দুইটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। আমি জানি, স্যার। আমার প্রশ্নটাও সেখানে। এত এত ভালো ফিল্ড এজেন্ট থাকতে ডেস্কের পেছনে বসা একজন অ্যানালিস্টকে কেন বিদেশে ট্রেনিংয়ে পাঠালেন আপনি?’
‘আমি যে পাঠিয়ে ভুল করিনি সেটার প্রমাণ তো আমার হাতেই আছে,’ বলে সে উঁচু করে ফাইলটা দেখাল।
তানভীর বুঝতে পারল এতক্ষণ বস ওর ফাইলই পড়ছিল কোনো বিশেষ কারণে। ‘এমনকি ফিল্ড এজেন্ট শারিয়ারের চেয়েও তোমার ট্রেনিং পয়েন্ট অনেক বেশি। ঠিক কি না?’
‘স্যার, সেটা আপনারাই বলতে পারবেন,’ তানভীর একটু অস্বস্তি বোধ করছে। ‘তবে এগুলোর কোনোটাই তোমাকে বেছে নেয়ার পেছনে মূল কারণ নয়। কারণ একটা আছে, তবে সেটা আজ না, আরেকদিন বলব। এখন কাজের কথা হবে,’ বলে সে ছোটো একটা রিমোট হাতে নিয়ে ওদের পেছনের দেয়ালে বসানো বড়ো একটা মনিটর ওপেন করল। ‘তোমার ট্রেনিং হাতেকলমে কাজে লাগানোর সময় এসে গেছে। একটা বিশেষ ঘটনা ঘটেছে। যেটার জন্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে সেই ইউরোপ থেকে টেনে এনেছি এখানে।’
‘তুমি তো জানো আমি বহুদিন ধরে স্বাধীনভাবে কাজ করার মতো একটা ডিপার্টমেন্ট তৈরি করতে চাচ্ছি। সেটার প্রাথমিক কিছু প্রস্তুতিও নেয়া শুরু করেছি। সেটারই অংশ হিসেবে আমি একটা বিশেষ কাজ করতে চাচ্ছি,’ বলে সে রিমোটে একটা বাটন চাপতেই মনিটরে একজন মানুষের চেহারা ফুটে উঠল।
‘উনার নাম বাবুল আহমেদ। তুমি তো নিশ্চয়ই ইমার্জেন্সি অ্যাকশন ফোর্সের নাম শুনেছো। সংক্ষেপে যাদেরকে ইএএফ নামে ডাকা হয়। বাবুল আহমেদ ওটার প্রধান। উনি আমার কাছে একটা বিশেষ কাজে সহায়তা চেয়েছেন। উনি নির্দিষ্টভাবে তোমার নাম বলেছেন এই ব্যাপারে। যে কারণে তোমাকে তলব করা হয়েছে,’ বলে তানভীরের দিকে ফিরে তাকাল সে।
‘সিলেটে একটা ঘটনা ঘটেছে দুই দিন আগে। ওরা ব্যাপারটার কোনো সুরাহা করতে পারছে না। আমি চাই তুমি ওখানে গিয়ে ব্যাপারটা দেখো।’
‘সিলেটে?’ তানভীরের একটা ভ্রু কুঁচকে উঠল। সিলেট শব্দটা কানে যেতেই স্মৃতির মানসপটে ফুটে উঠল চলমান সিনেমার মতো কিছু দৃশ্য। ‘তবে আমি কেন?’ ‘বাবুল আহমেদ কেন তোমাকে চেয়েছেন আমি সঠিকভাবে জানি না। তবে এর পেছনে একটা কারণ হতে পারে, ঘটনাটার সঙ্গে তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সংযোগ আছে।’
‘সাস্টের?’ তানভীর পুরোপুরি চমকে উঠেছে। ‘মানে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের?’
‘হ্যাঁ, সাস্টের। সাস্টের আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের একজন টিচার হারিয়ে গেছে। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই ঘটনার সঙ্গে আরো কিছু আন্তর্জাতিক ব্যাপার জড়িয়ে গেছে। আমি চাই তুমি সিলেটে গিয়ে ব্যাপারটার একটা সুরাহা করো।