প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ১৯

অধ্যায় উনিশ – বর্তমান সময়
সুরমা এলাকা, আখালিয়া, সিলেট

পরিস্থিতি হঠাৎ ঘোলাটে হয়ে উঠলেও তানভীর মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল।

ডক্টর মিতায়নের বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসা চিৎকারটা শোনা মাত্রই সবাই যার যার অস্ত্র বের করে এনেছে। মূল দরজাটার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে তানভীর, আর অন্যপাশে সুলতান আর ইকবাল। হাতের আঙুল দিয়ে তিনবার ইশারা করল তানভীর।

এক… দুই… তিন…

তৃতীয় নম্বর আঙুলটা শূন্যে উঠে আসা মাত্রই সুলতানের হাতের ধাক্কায় খুলে গেল মূল দরজা। খোলা দরজা দিয়ে এক গড়ান দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল তানভীর। দরজার ভেতরে রুমটাকে প্রায় অন্ধকারই বলা চলে। অন্যপাশের একটা আধখোলা জানালা দিয়ে হালকা আলো ভেসে আসছে, সেই আলোতে দেখা গেল দরজার অন্যপাশে ছোটো একটা করিডরের মতো, সেই করিডরটা সংযুক্ত করেছে একটা খোলা বসার ঘর আর অন্যপাশে একটা খাবার কামরাকে। একবার চোখ বুলিয়ে তানভীর নিশ্চিত হয়ে গেল ভেতরে কেউ নেই। অন্যদেরকে ভেতরে ঢোকার জন্যে ইশারা করল ও।

প্রায় একই সময়ে ওকে কভার করে ওর ঠিক পেছনে ভেতরে ঢুকল সুলতান আর ইকবাল। সুলতানের হাতে বিরাট আকারের পয়েন্ট ফোর্টি ফাইভ বোরের পিস্তল। ওরা ভেতরে ঢুকতেই সোজা হয়ে দাঁড়াল তানভীর। সুলতানের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘মনে হচ্ছে—’ ওর কথা শেষ হবার আগেই এক চিৎকারের সঙ্গে ওর দিকে উড়ে এলো সুলতান। ওকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গেই তানভীর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানকার পেছনের দরজাটায় পর পর তিনটে গর্ত হয়ে গেল, গুলির শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। একহাতে তানভীরকে ধরে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে ওকে একটা জুতোর র‍্যাকের আড়ালে সরিয়ে আনল সুলতান।

‘সর্বনাশ! আরেকটু হলে…

‘ইকবালের কী হলো কে জানে,’ যেদিক থেকে সরে এসেছে ওরা ওদিকে তাকিয়ে ইকবালের খোঁজ করাতেই দেখতে পেল সে একটা শোকেসের পেছনে আড়াল নিয়েছে। ইকবালকে দেখার জন্যে মাথা বের করতেই ধাম ধাম অরো দুটো গুলি ভেসে এসে দেয়ালের প্লাস্টার খসিয়ে দিল। সুলতান মাথা সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এই জুতোর র‍্যাক মোটেই নিরাপদ না। যেকোনো সময় গুলির তোড়ে ভেঙে পড়তে পারে বা ওটা ভেদ করে গুলি এসে লাগতে পারে ওদের গায়ে।

‘সুলতান,’ নিজের পিস্তল যদিও ধরে আছে শক্ত হাতে কিন্তু তানভীর দেখল ওর পিস্তল ধরা হাত কাঁপছে।

‘স্যার?’ সুলতান নিষ্কম্প গলায় বলে উঠল I

‘আমাদেরকে দ্রুত অ্যাকশনে যেতে হবে। কারণ খেয়াল করেছো একবারে একটা একটা গুলি ভেসে আসছে। এর মানে একজন গুলি করছে অন্যপাশ থেকে। আমার মনে হয়, শত্রু যারাই হোক ওরা একজনকে দিয়ে আমাদেরকে ঠেকিয়ে রেখে অন্যকিছু করছে। তাই ইমিডিয়েট অ্যাকশনে না গেলে আমরা সোর্স হারাতে পারি—’

তানভীর কথা শেষ করার আগেই অন্যপাশ থেকে দুইবার গুলি হলো সেইসঙ্গে কাচ ভেঙে পড়ার শব্দ হলো। অন্যপাশের শো-কেসের আড়ালে এতক্ষণে ইকবালকে দেখতে পেল। স্যার, আমার মনে হয়,’ সুলতান কথা বলতে শুরু করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওদের পাশে থাকা জুতোর র‍্যাকটা মড় মড় করে উঠল। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে ওটা।

‘জলদি সুলতান,’ তানভীরের মনে হচ্ছে র‍্যাকটা ভেঙে পড়লেই ওরা শেষ।

‘স্যার আমি ইকবালকে নির্দেশনা দিচ্ছি, ও কোনোভাবে শ্যুটারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেই আমি উঠে দাঁড়িয়ে গুলি চালাব, আর আপনাকে ওদিকে দিয়ে, ‘ সে করিডরের একপাশে দেখাল। ‘আপনি ওই পর্যন্ত পৌছাতে পারবেন?

ইকবালকে টকিতে কথাগুলো বুঝিয়ে বলতেই সে শোকেসের আড়াল থেকে একদিক থেকে আরেক দিয়ে গড়ান দিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুলি ছুটে এলো তার দিকে। এই সুযোগে সুলতান উঠে দাঁড়িয়ে টানা গুলি করতে শুরু করল। একইসঙ্গে তানভীর একটা গড়ান দিয়ে সরে গেল কার্পেটের ওপর তারপর দৌড় দিল শ্যুটারের দিকে। সুলতান গুলি থামিয়ে দিয়েছে তানভীরকে জায়গা করে দেয়ার জন্যে।

তানভীর শ্যুটারের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে আর কয়েক ফিট দূরত্বে আছে এমন সময়ে দরজার আড়ালে কাউকে নড়তে দেখল, সেইসঙ্গে দেখতে পেল একটা অস্ত্রের নল ঘুরে যাচ্ছে ওর দিকে। তানভীর দৌড়রত অবস্থা থেকেই লাফ দিল শূন্যে। শ্যুটারের বেরিয়ে আসা নলটা একহাতে ধরে ওপরের দিকে তুলে দিল সেইসঙ্গে ওর ছুটন্ত দেহটা বাড়ি খেল শ্যুটারের দেহের সঙ্গে। দুজনেই ছিটকে পড়ল মাটিতে।

মাটিতে পড়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। দেখল মাটিতেই পড়ে আছে শ্যুটারের অস্ত্রটা। আর মুখ বাঁধা লোকটা ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে হামাগুঁড়ি দিয়ে একটা দরজার আড়ালে চলে গেল। নিজের অস্ত্র বের করে সাবধানে সেদিকে এগোল তানভীর। সেইসঙ্গে সুলতান আর ইকবালকে এগোনোর নির্দেশ দিল। পাশের রুমটা একটা বেডরুম। লণ্ডভণ্ড রুমটাতে কেউই নেই।

ব্যাপার কি, ব্যাটা গেল কই? ভাবতে ভাবতেই আশপাশে কোথাও থেকে হুটোপুটি আর মৃদু চিৎকার শুনতে পেল। ওদের দুজনকে এগোতে ইশারা করে ও এগিয়ে গেল শব্দ লক্ষ্য করে।

বেডরুমের সঙ্গেই লাগোয়া একটা বারান্দা। সেটার পেছনের গ্রিলের সঙ্গে ছোটো একটা দরজা এই মুহূর্তে হাট হয়ে খোলা। সেটার সামনে একটু আগের সেই শ্যুটার লোকটা দাঁড়িয়ে, তার পেছনে মুখ বাঁধা একজন মহিলাকে টানতে টানতে দরজা দিয়ে বের করার চেষ্টা করছে অন্য একজন। তানভীরকে বারান্দায় দেখা মাত্রই একটু আগের শ্যুটার লোকটা মহিলার গলার কাছে জামা খামচে ধরে তাকে টেনে নিয়ে এলো নিজের সামনে। তানভীর পিস্তল তোলা মাত্রই তাকে ঠেলে দিল তানভীরের দিকে।

কোনোমতে নিজের অস্ত্র সামলে নিল ও। আরেকটু হলেই পিস্তলের ট্রিগারের চাপে মহিলার মাথাটা গুঁড়িয়ে দিতে যাচ্ছিল ও। তবে অস্ত্র সামলে নিতে পারলেও নিজেকে সামলাতে পারল না ও, গায়ের ওপরে চলে আসা মহিলাকে নিয়ে উল্টে পড়ে গেল মাটিতে।

তানভীর মহিলাকে নিয়ে মাটিতে পড়েছে আর ঠিক সেইসময়েই বারান্দার এসে ঢুকল সুলতান। গ্রিলের অন্যপাশের মানুষদের একজন বাড়ির পেছনের দেয়াল টপকে অন্যপাশে চলে গেছে, অপরজন চড়ে বসেছে দেয়ালের ওপরে। সুলতান বারান্দায় ঢুকেই সোজা গুলি করল দেয়ালের ওপরে বসে থাকা লোকটাকে। গুলি খেয়েই হোক আর আগে লাফ দেবার কারণেই হোক লোকটা দেয়ালের অন্যপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। সুলতান লাফিয়ে বেরিয়ে গেল গ্রিলের দরজাটার ফাঁক দিয়ে। তানভীর সোজা করে বসাল মহিলাকে। ওর সঙ্গে এসে হাত লাগাল ইকবাল।

মহিলার মুখের আবরণ সরিয়ে দিতেই সে টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগল। মহিলার মুখের আবরণটা সরিয়েই তানভীর প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল ভদ্রমহিলা ঠিক আছে কি না কিন্তু তার আগেই মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে গা গুলিয়ে উঠল ওর। ইকবালের দিকে স্রেফ একবার তাকিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল ও। যেই সদর দরজা দিয়ে বাড়িটাতে প্রবেশ করেছে একটু আগে সেটা দিয়ে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। ড্রাইভওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকবার মনে হলো পেটের সব উগড়ে দেবে ও। অবশেষে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হলো।

‘বস, আপনি ঠিক আছেন?’ সদ্যই সুলতান বেরিয়ে এসেছে বাংলোর ভেতর থেকে।

তানভীর একবার হাতের ইশারা করল শুধু। ‘বস পানি লাগবে? আপনার…’ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল সুলতান আবারো তানভীরের হাতের ইশারায় থেমে গেল।

বড়ো বড়ো করে দম নিয়ে খানিকটা স্থির হলো তানভীর। পিস্তলটা এতক্ষণ হাতেই ধরে রেখেছে খেয়াল করেনি ও। ওটাকে হোলস্টারে ঢুকিয়ে সোজা হলো ও। আরো কয়েকবার ফ্রি স্টাইলে ব্রিদিংয়ের মতো করে দম নিয়ে সুলতানকে নিয়ে ফিরে এলো বাংলোর ভেতরে। তানভীরের চেহারা দেখে চুপ হয়ে আছে সুলতান। ওরা সোজা চলে এলো বাংলোর শোবার ঘরে।

ইকবাল সেই মহিলাকে বিছানায় বসিয়ে তাকে পানি খেতে দিয়েছে। তানভীর সোজা এগিয়ে গেল তার দিকে। হতবিহ্বল মহিলা ওদের দেখে ফিরে তাকাল। তার মুখ লাল হয়ে আছে, আর চোখ দুটো আগেই ভয়ে বড়ো বড়ো হয়ে ছিল আরো বড়ো হয়ে গেল খানিকটা।

তানভীর তার সামনে গিয়ে বহুকষ্টে ভাবলেশহীন গলায় বলে উঠল, ‘হ্যালো, লায়লা। নাকি আমার বলা উচিত মিসেস মিতায়ন?’

লায়লার হাতে ধরা পানির গ্লাসটা টাইলস করা মেঝের ওপরে পড়ে ঠাশ করে ভেঙে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *