প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৩৫

অধ্যায় পঁয়ত্রিশ বর্তমান সময়
শাহী ঈদগাহ, আম্বরখানা, সিলেট

‘আমার মনে হয় সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে অবশ্যই ব্ল্যাক বুদ্ধা খুঁজে বের করা সম্ভব,’ ট্রিম করা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে আনমনেই বলে উঠল তানভীর। মনে মনে ও সম্পূর্ণ পরিস্থিতি অ্যনালিসিস করছে। ‘সম্ভব এই কারণেই, যেহেতু আমরা ধারণা করছি ওটা এখনো সিলেট শহরেই আছে। আমার প্রশ্ন হলো, আমাদের কেসে এই ব্ল্যাক বুদ্ধা এলো কিভাবে?’ টমির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল তানভীর।

‘আমার ধারণা মানে বাংলো থেকে উদ্ধার হওয়া কাগজ থেকে যা বুঝতে পেরেছি ডক্টর মিতায়নরা অফিসিয়ালি যা বলেছে আসলে তারা সেরকম কিছু এক্সপ্লোর করেনি বরং তারা ব্ল্যাক বুদ্ধার অনুসন্ধান করছিল। সম্ভবত ওটা তারা খুঁজেও পেয়েছিল।’

‘সর্বনাশ! যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আসলে ঘটেছিল কি?’ সুলতান বলে উঠল

‘সেটা আমরা বুঝতে পারব একমাত্র ডক্টর মিতায়নের জ্ঞান ফিরে এলেই, ‘ তানভীর বলে উঠল। ‘ইকবাল, আপনি একটু খবর নেন তো ডক্টর মিতায়নের এখন কী অবস্থা?’

‘জি, স্যার,’ বলে ইকবাল বেরিয়ে গেল।

‘টমি, ব্ল্যাক বুদ্ধার ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পেরেছি। এখন বাকি ব্যাপারগুলো বলো। যা যা বলেছিলাম সেগুলোর ব্যাপারে খোঁজ করা হয়েছে?’ তানভীর প্রশ্ন করল, ওকে এখন পুরো ঘটনার টুকরো টুকরো অংশগুলো জোড়া লাগাতে হবে। ‘ওগুলোর ব্যাপারে যা যা জানতে পেরেছো সেগুলো একটা একটা করে জানাও। সুলতান তুমি নোট নাও। আচ্ছা, ওসি জালাল কোথায়, সকাল থেকে তো তাকে দেখতে পেলাম না?’ কাজের চাপে আর নানাবিধ চিন্তায় ওসি জালালের কথা ভুলেই গেছিল ও।

‘কমান্ডার, আমি এইখানে,’ তানভীর তাকিয়ে দেখল কনফারেন্স রুমের স্লাইডিং ডোর ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল ওসি জালাল। সে ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই কড়া সিগারেটের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল এসি রুমে। খুক খুক করে উঠল দুয়েকজন। হাসল না কাশল সেটা ঠিক বুঝতে পারল না তানভীর কি ব্যাপার, আপনি এত দেরি করে—’

‘স্যার আমি বাইরেই ছিলাম,’ বলে সে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল কারো অনুমতির তোয়াক্কা না করে। ‘বাইরে থাইক্কা শুনলাম ওই পোদ্দার মিয়া কী সব মূর্তি-ফুর্তি নিয়া কথা বলতাছে, এইগুলা আবার আমার সয় না। আমি হলাম মাঠের মানুষ, এসি রুমের টেবিলে বইসা এই সব কচকচানি শুনলে আমার গা গুলায়।’

‘তা তো গুলাবেই, এসি রুমে তো আর বিড়ি খাওয়া যায় না,’ বিড় বিড় করে কথাটা বললেও আশপাশের সবাই কথাটা শুনে মৃদু হেসে উঠল। ‘টমি বলে যাও।’

‘স্যার, প্রথমেই সেই জায়গাটার ব্যাপারে, মানে যেখানে ওই বাংলোটা অবস্থিত, ডক্টর মিতায়নকে যেখান থেকে উদ্ধার করেছেন আপনারা। জায়গাটা লাক্কাতুরা টি-এস্টেট আর মালিনীছড়া টি-এস্টেটের মাঝামাঝি একটা প্রাইভেট প্রপার্টি। সেটার মালিক আসলে কে, সেই ব্যাপারে খোঁজ লাগানো হয়েছে কাল রাতেই, আশা করি কিছুক্ষণের ভেতরেই সঠিক খবর জেনে যাব।’

ইকবাল এসে তানভীরের কানে কানে কিছু একটা বলল। কথাটা শুনে তাকে বসতে ইশারা করল তানভীর। ‘টমি, বলো।’

‘দ্বিতীয় ইস্যু, সেই চার্টার করা প্লেন। এটার ব্যাপারে খুব ইন্টারেস্টিং তথ্য আছে। চার্টার করা একটা প্লেন সত্যিই সেদিন এয়ারেপোর্টে ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে সেটা ফ্লাই করার কথা ছিল কিন্তু কোনো অদ্ভুত কারণে প্লেনটা সময়ের আগেই এয়ারপোর্ট ছেড়ে চলে যায়। এরপরে ওই দিন নাকি ওই প্লেনের ব্যাপারে আর কেউ কোনো খোঁজখবর করতেও আসেনি।’

‘ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা কি?’ তানভীর জানতে চাইল।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, প্লেনটা এয়ারপোর্টে রেজিস্ট্রি করা ছিল যে কোম্পানির নামে ওই নামে কোনো প্রাইভেট এয়ারলাইনই নেই। দ্বিতীয়ত, যে লোক প্লেনটা ভাড়া করেছিল, মানে যার নামে রেজিস্ট্রি করা সেই নামেও ডক্টর মিতায়নের টিমে কেউই নেই।’

‘মোদ্দা কথা ওইখান থেকে কিছুই বের করা যাবে না? তাইতো?’ তানভীর প্রশ্ন করল। টমি মাথা নেড়ে জানাল তাই। ‘তারপরও যে লোকের নামে প্লেনটা রেজিস্টি করা ছিল তার ব্যাপারে খোঁজ লাগানোর চেষ্টা করো। আচ্ছা এখন সেই অস্ত্রটার ব্যাপারে বলো। ডক্টর মিতায়নের বাড়ি থেকে যেটা উদ্ধার করার পর সুলতান বিশদ বর্ণনা দিয়েছিল।’

‘এখান থেকে একটা লিড আমরা পেতে পারি। সুলতান ভাই,’ বলেই টমি নিজেকে শুধরে নিল। ‘মানে সুলতান আপা যা বলেছিল ব্যাপারটা একদম ঠিক। আমাদের এক্সপার্টরাও এই ব্যাপারে একই মত পোষণ করেছে। জিনিসটা আসলেই ইউনিক। একেবারেই হাতে তৈরি। ওই অস্ত্রটার সঙ্গে যোগ হয়েছে লাক্কাতুরার বাংলো থেকে পাওয়া অস্ত্রগুলো। প্রতিটি অস্ত্রই পুরনো আর গঠনের ভিত্তিতে আলাদা।’

টমির কথার সঙ্গে সঙ্গে তানভীরের মনে পড়ে গেল বাংলোর সামনের আঙিনায় চেপে ধরা সেই দোনলা বন্দুকের কালো নলটা। আনমনেই শিউড়ে উঠল ও। পলকের ওপর দিয়ে বেঁচে গেছে কাল। ‘ওখান থেকে কী লিড পাওয়া গেল?’

‘স্যার, এখানে আমি একটু বলি,’ ইকবাল বলে উঠল পাশ থেকে। ‘যেই অস্ত্রগুলা নিয়ে আমরা কথা বলছি, এইগুলোর ব্যাপারে তথ্য দেয়ার মতো একজন মানুষই আছে এই এলাকায়। সিলেট শহরে অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানের অন্যতম একজন মাধ্যম সে। লোকটা আবার আমাদের ইনফর্মার হিসেবেও কাজ করত এক সময়। তার নাম নচি বিশ্বাস।’

‘কি? বিচি বিশ্বাস!’ এতক্ষণ চুপ করা থাকা ওসি জালাল হঠাৎ পাশ থেকে বলেই হেসে উঠল। ‘এ কেমন নাম?’

চেষ্টা করেও হাসি থামাতে পারল না তানভীর। হাসতে হাসতেই ও ফিরে তাকাল ইকবালের দিকে। সবার হাসি দেখে বেশ বোকার মতো তাকিয়ে আছে ইকবাল।

তার দিকে তাকিয়ে তানভীর বলে উঠল, ‘ইকবাল, আপনি এই বিচি বিশ্বাস, মানে নচি বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, নরমভাবে না, শক্তভাবে। তাকে যেখান থেকে পারেন ধরে নিয়ে আসেন। প্রায়োজনে ইএএফের সহায়তা নেন। আর টমি তুই বাংলোর মালিকের ব্যাপারে খোঁজখবর করে তার সঙ্গে যোগাযোগ কর। সুলতান, তুমি সহায়তা করো টমিকে। টমি তুই তোর সোর্সের মাধ্যমে প্লেন চার্টার করা ওই লোকটার ব্যাপারেও খোঁজ নেয়ার চেষ্টা কর,’ বলে ও উঠে দাঁড়াল ‘জালালসাহেব, আপনি আমার সঙ্গে চলেন, ডক্টর মিতায়নের জ্ঞান ফিরেছে। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে আমাদের। এই রহস্যেও শিকড় লুকিয়ে আছে ডক্টর মিতায়নের মাথার ভেতরে, যেভাবেই হোক সেটা টেনে বের করতে হবে।’

ওসি জালালকে নিয়ে বাইরে চলে এলো ও। বিল্ডিংয়ের বাইরে বেরিয়েই পকেট থেকে প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল ওসি জালাল। তানভীরের দিকে ফিরে এক দঙ্গল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে উঠল, ‘কমান্ডার, আপনি বয়সে আমার ছোটোই হবেন। আপনার সামনে ক্রমাগত বিড়ি খাচ্ছি, কিছু মনে করেন না।’

তানভীর রসুল মিয়াকে ইশারা করে মাইক্রোটা নিয়ে আসতে বলল। তারপর ওসি জালালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সিগারেট তো খেয়েই ফেলেছেন, বলে আর কী হবে,’ বলে ও ওসি জালালের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে একটা সিগারেট ঠোঁটে লাগাল। ওসির ধরানো সিগারেট দিয়ে সেটা ধরিয়েই বলে উঠল, ‘আপনি মনে হয় পাশা স্যারের সঙ্গে অনেকদিন ধরেই পরিচিত। বিশেষ করে গেল বছর গাজীপুরে এক দুর্নীতিগ্রস্ত ওসি গিয়াসুদ্দিন আর আন্ডারওয়ার্ল্ড এক ডনের কেসে আপনি নাকি স্যারকে হেল্প করেছিলেন। ওই কেসের কথা স্যার প্রায়ই বলেন আমাদের। বিশেষ করে আপনার সাহসিকতার কথা।

ওদের গাড়ি চলে আসাতে তাতে উঠে বসে রসুল মিয়াকে ও জানাল কোথায় যেতে হবে।

তানভীর ভেবেছিল লোকটার প্রশংসা করাতে সে খুশি হবে। কিন্তু তার মধ্যে কোনো বিকার দেখা গেল না। সে একমনে সিগারেট টেনে চলেছে। ‘এইগুলান ভুয়া কথা, বুঝছেন কমান্ডার। আপনে মনে হয় নতুন মাঠে নামছেন। আপনেরে দেইখাই বোঝা যায়। শোনেন, আমি যেইগুলা করি এইগুলা সাহসিকতা না। এইগুলা হইলো পাগলামি। এই পাগলামির কারণেই একদিন আমি মরব। আসল সাহসিকতা কি জানেন,’ বলে সে ফিরে তাকাল তানভীরের দিকে। নিজের মুখোমুখি হওয়া। নিজেরে সামলানি হইলো দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো সাহসিকতা। নিজেরে নিজে ছাড়ায় যাওয়া হইলো সবচেয়ে বড়ো সাহসিকতা। যেইটা আমগো দেশের প্রত্যেকটা মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েরা করে। প্রত্যেকটা দিন ছোটো ইনকাম লয়া নিজের অপিস, নিজের বস, দেশের সরকার থেকে শুরু করে নিজের সন্তানের সঙ্গে হেরা লইড়াই যাইতাছে। এইডা এমন এক যুদ্ধ যেই যুদ্ধ কুনোদিন শেষ অইবে না। বুঝলেন কমান্ডার যে সাহস আমরা দেহাই হেই সাহস কুনো সাহস না, ওই সাহস অইলো আসল সাহস, যেহানে আপণে জানেন যেই যুদ্ধে কুনো জয়- পরাজয় নাই, যেই যুদ্ধ কুনোদিন শেষ অয় না। আমি মাইনষের চোক্ষের দিকে তাকায়া মাইনষেরে গুলি কইরা মারতে পারি কিন্তুক অই সাহস আমি দেহাইতে পারি নাই। আমি সংসার করতে পারি নাই।’

বলেই সে হেসে উঠল। ‘পাশা স্যারের মতো মানুষরে আমি, শ্রদ্ধা করি ক্যান জানেন, এইরকম মানুষগুলা সিস্টেমের সঙ্গে লড়াই করতে জানে। সেই সাহস হেগো আছে। তাগো এই লড়াইডা প্রকারান্তরে দেশের ওই সব মধ্যবিত্ত মানুষগুলার কামে আয়ে। পচা গলা নোংরা এই সিস্টেমের মধ্যে পাশা স্যারের মতো মানুষগুলান অইলো দুয়েকটা শালুক ফুলের মতো। যাগকা অনেক কথা কইলাম। তয় কমান্ডার আমার মনে অইতাছে আমাগো এই কেসে বহুত ঘাপলা আছে। আপণে সাবধান থাইক্কেন। গুলি করন লাগলে আমি আছি, সুলতান আছে। কিন্তুক মনে রাইখেন আপণের টিমে বড়ো ঘাপলা সামলানির মতো লুক একটাও নাই। ওইডা কিন্তুক আপণেরই করণ লাগব। বিশেষ কইরা এই কেসের ব্যাপারে যা শুনছি তাতে ইএএফ এরই মধ্যে—’  

‘স্যার, চলি আইয়ার,’ সামনের সিট থেকে রসুল মিয়া বলে উঠল।

‘চলুন, জালাল সাহেব,’ বলে বাইরে বেরিরে এলো, সঙ্গে জালাল উদ্দিন। সে বাইরে বেরিয়েই মুখে ধরানো সিগারেটের মোথাটা মাটিতে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে দিল। ‘চলেন, কমান্ডার।’

পুলিশ হাসপাতালটা বেশ বড়ো কিন্তু লোকজন বলতে গেলে একেবারেই নেই। বাইরে দুজন সেন্ট্রিকে বসে থাকতে দেখল ও। জিন্স আর লেদার জ্যাকেট পরিহিত তানভীরকে দেখে তাদের মধ্যে কোনো বিকার দেখা গেল না, কিন্তু পুলিশের পোশাক পরা জালালকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেল দুজনেই। ডক্টর মিতায়নকে কোথায় রাখা হয়েছে সেটা ওদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে সোজা তিনতলায় চলে এলো ওরা। হাসপাতালের লম্বা করিডরের দু পাশে সারি সারি কামরা। রিসিপশনে একজন নার্সকে দেখা গেল খুব আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এক পুলিশ কনস্টেবলের সঙ্গে গল্প করছে। ছেলেটা প্রথমে ওদেরকে দেখে চমকে উঠল, তারপর জালাল তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকতেই ভড়কে গেল একেবারে।

‘এই, এদিকে আয়,’ হাতের ইশারায় জালাল তাকে ডাকতেই বন্দুক সামলাবে না নিজেকে সামলাবে বুঝে উঠতে-উঠতে প্রায় দৌড়ে এগিয়ে এলো সে।

‘স্যার,’ পা ঠুকল স্যালুটের ভঙ্গিতে।

‘তুই, কি এইহানে প্রফেসরের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছোস?’ জালালের হাত আনমনেই চলে গেছিল পকেটে রাখা সিগারেটের প্যাকেটের দিকে কিন্তু জায়গাটা হাসপাতাল মনে পড়তেই সে নিজেকে সামলে নিল।

‘জি, স্যার আমি এইহানে আর বাইরে আরো দুইজন আছে, ছেলেটা একবার জালালকে দেখছে অরেকবার তানভীরকে ।

‘এই তোর নিরাপত্তা? নার্সের লগে গপ্প করার লাইগা তোরে রাখছে এইহানে, জালাল এক পা এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে আর ছেলেটা এক পা পিছিয়ে গেল। ‘হারামজাদা, আরেকবার যদি দেহি ঠিকমতো ডিউটিতে নাই, খবর কইরা ছাইড়া দেব, বুঝছোস?’

বিদ্যুৎ বেগে মাথা ঝাঁকাতে থাকা কনস্টেবলকে দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় তার মাথাটা স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো খুলে যেতে পারে।

‘ডক্টর মিতায়ন কোনো রুমে আছে?’ প্রশ্নটা তানভীর করেছিল তরুণ কনস্টেবলকে উদ্দেশ্য করে কিন্তু জবাব পেল পেছন থেকে।

‘তানভীর ভাই, এদিকে,’ রিনরিনে গলা শুনে পেছন ফিরে দেখল শায়লা দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে।

‘কি ব্যাপার, তুই এখানে?’ তানভীরও হাসিমুখে জানতে চাইল।

‘আমার বোনের বিপদ তো আমি এখানে থাকব না তো কে থাকবে?’ শায়লা ওদেরকে পথ দেখিয়ে সামনের দিকে নিয়ে চলল।

‘তোর মা নেই তো আবার, উনি থাকলে তো—’

তানভীরের কথা শুনে মুচকি হেসে উঠল শায়লা। ‘তুমি কি মাকে এখনো ভয় পাও?’ শায়লার কথার জবাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তানভীর তার আগেই একটা হাত তুলে ওকে আস্বস্ত করল সে, ‘মা নেই, তোমার ভয় পাবারও কোনো কারণ নেই। তবে তানভীর ভাই, তোমাকে আমার একটা বিরাট ধন্যবাদ দেয়ার আছে,’ শায়লা সরাসরি তাকিয়ে আছে তানভীরের চোখে। ‘দুলাভাই, মানে মিতায়ন ভাইকে তুমি এতটা জলদি ফিরিয়ে আনতে পারবে, আমরা কেউ ভাবতেও পারিনি। মা তো ভাবছিল—’

‘তোর মায়ের ভাবনা আমার কাছে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। আর আমি যা করেছি সেটা একেবারেই প্রফেশনাল ব্যাপার,’ বলে ও প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইল। ‘পরিচয় করিয়ে দিই, উনি ওসি জালাল উদ্দিন। আমার সঙ্গে এই অপারেশনে কাজ করছেন। সত্যি কথা হলো উনি না থাকলে গতকাল আমরা সবাই গেছিলাম,’ বলে তানভীর একটা বিশেষ ভঙ্গি করল গলা কাটার, শায়লা হেসে উঠল।

জালাল কিছু না বলে শায়লার দিকে তাকিয়ে একবার মাথা নাড়ল।

‘হ্যাঁ, আমি আপার কাছে শুনেছি, কী ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলে ওখানে তোমরা। ভেতরে এসো,’ ওরা নির্দিষ্ট কেবিনের দরজার সামনে চলে এসেছে। ‘দুলাভাই এখন ভালোই আছে। কাল রাতে জ্ঞান ফিরেছে। আপাও আছে ভেতরে।’

কেবিনের ভেতরে ঢুকে তানভীর একটু অবাক হয়ে গেল। বাইরের সাদামাটা করিডরে দাঁড়িয়ে ও ভাবতেও পারেনি ভেতরের কেবিন এতটা সুসজ্জিত হবে। ও অনুমান করল এটা সম্ভবত ভিআইপি কেবিন, তা না হলে এতটা ভালো হবার কথা নয়। ভেতরে সোফা আছে, অতিরিক্ত বেড আছে, আবার রুমে এলইডি টিভি, সবমিলিয়ে বেশ ভালো আয়োজন।

ভেতরে ঢুকে দেখল বেডের ঠিক পাশেই একটা চেয়ারে লায়লা বসে আছে, বেডের ওপরে শুয়ে থাকা মানুষটার একটা হাত ধরে আছে। ওদেরকে দেখে একটু সরে গেল সে।

ওরা এগিয়ে যেতেই তানভীরকে দেখে লায়লা ভাঙা গলায় বলে উঠল, ‘কেমন আছো, তানভীর?’

লায়লার দুই চোখ প্রায় গর্তে বসে আছে, চেহারা একেবারেই রুক্ষ আর এলোমেলো। গতকালও তাকে এতটা বিধ্বস্ত লাগেনি, আজ তাকে দেখে মনে হচ্ছে বয়স যেন হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে। লায়লার দিকে তাকিয়ে আবেগের একটা ঝোঁক তানভীরের গলা বেয়ে উঠে আসতে চাইল, কিন্তু বহু কষ্টে সেটা দমন করে ওর দিকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল তারপর যেন যন্ত্রের মতো বলে উঠল, ‘আমি ভালোই আছি,’ ডক্টর মিতায়নের দিকে দেখিয়ে বলল। ‘আমরা ডক্টর মিতায়নের সঙ্গে কথা বলব। ভালো হতো যদি তোমরা একটু বাইরে অপেক্ষা করতে।’

লায়লা তাকিয়ে আছে তানভীরের দিকে। কিছু না বলে একবার ওকে দেখল, তানভীরের চোখে কোনো ভাব নেই। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শায়লার দিকে ফিরে ইশারায় কিছু একটা বলে বেরিয়ে গেল দুজনে। তানভীর এতক্ষণ ডক্টর মিতায়নের দিকে ভালোভাবে তাকায়নি। এবার তাকিয়ে দেখল।

একটু মঙ্গলয়েড ধাঁচের চেহারা তার আদিবাসী পরিচয় বহন করছে। যদিও শুয়ে আছে তবুও তাকে দেখে ও আন্দাজ করল ডক্টর খুব বেশি লম্বা হবে না, বড়োজোড় পাঁচ ফিট চার বা পাঁচ হতে পারে। মাথায় এই মুহূর্তে পুরনো দিনের বাংলা সিনেমার নায়কদের মতো একটা পট্টি লাগানো, একটা হাত স্লিংয়ে ঝোলানো, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ বন্ধ।

‘উনি কি ঘুমিয়ে আছেন?’ রুমে একটু আগে একজন নার্স প্রবেশ করে একটা মেডিকেল কিটের মতো কিছু একটা রাখতে যাচ্ছিল টেবিলের পাশে, তাকে উদ্দেশ্য করে জানতে চাইল তানভীর। কিন্তু নার্স জবাব দেয়ার আগেই চোখ বন্ধ অবস্থায় ডক্টর বলে উঠল, ‘তুমি! তুমি কেন?’

‘মানে?’ তানভীর খুব অবাক হয়ে জানতে চাইল। ডক্টর এখনো চোখ খোলেনি। ওসি জালালের দিকে তাকিয়ে তানভীর কাঁধ ঝাঁকাল। ওসি জালাল নার্সের কাছ থেকে ডক্টরের মেডিকেল হিস্ট্রির চাটটা নিয়ে ওতে চোখ বুলাচ্ছিল, সেও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তানভীরের দিকে

‘সরি, ডক্টর মিতায়ন, আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারিনি,’ তানভীর একটা চেয়ার টেনে ডক্টরের মুখোমুখি বসে জালালকেও বসতে ইশারা করল।

ডক্টর মিতায়ন আচমকাই চোখ খুলে মাথাটা একটু এগিয়ে আনল তানভীরের দিকে। ‘আপনি লায়লাকে সরাসরি তুমি বললেন, কারণটা কি?’ বলে সে যেন মৃদু হেসে উঠল। হাসিটা এমন সেটা ঠোঁটের কোণ থেকে শুরু হলো কিন্তু চোখের কোণে যাবার আগেই হারিয়ে গেল। ‘অফিসার, আপনার নামটা যেন কি?’ ডক্টরের বাংলা উচ্চারণ একটু অদ্ভুত। কোনো এলাকার টান নাকি অন্য কোনো ভাষার টান- তার কথায় তানভীর ঠিক বুঝতে পারল না।

চেয়ারটাকে আরেকটু বিছানার দিকে এগিয়ে আনল তানভীর। ডক্টর, আমার নাম তানভীর, তানভীর মালিক, এই কেসের কমান্ডিং অফিসার,’ তানভীর তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছে। ‘আপনার সঙ্গে আমাদের বেশ কিছু কথা আছে।’

ডক্টর কিছুই না বলে জানালার দিকে ফিরে তাকাল। তানভীর আশা করেছিল ওর নামটা শুনে ডক্টরের মুখে আবারো সেই হাসির রেখাটা ফুটে উঠবে কিন্তু তার পরিবর্তে যেন খানিকটা আঁধার ঘনিয়ে এলো তার মুখে। ‘অফিসার তানভীর, আমার মনে হয় আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত, আমাকে প্ৰাণে বাঁচানোর জন্যে কিন্তু আমি সেটা করতে পারছি না। আমি আসলে কিছুই করতে পারছি না। আমার জীবনের সেরা আবিষ্কার ওইখানেই কোথাও অন্য কারো হাতে আছে,’ বলে সে জানালা দিয়ে বাইরে দেখাল। ‘অথচ আমার পক্ষে বিছানা থেকে ওঠাই সম্ভব না। এরচেয়ে কষ্টের আর কিছু হতে পারে না,’ বলে সে আবারো ফিরে তাকাল তানভীরের দিকে। এবার একেবারে সরাসরি ওর চোখের দিকে।

‘অফিসার, জীবনে কখনো খুব তীব্রভাবে কিছু চেয়েছেন? নিজের জীবন, নিজের পরিজন, নিজের সৃষ্টি নিজের অর্জনের চেয়েও অনেক বড়ো কিছু? অনেক অনেক বড়ো কিছু। তারপর একদিন আচমকাই সেটা পেয়ে গেলেন,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল, ‘পেয়েই দেখলেন আপনার কাছের প্রতিটা মানুষ আপনার সঙ্গে বেঈমানি করল। আপনাকে সেটা হারাতে হলো। কেমন লাগবে অফিসার?’ ডক্টর মিতায়ন একটু খেপাটে ভঙ্গিতে নিজের চোখের মণি একেবারে স্থির করে রেখেছে তানভীরের চোখে। ‘কোনোকিছু না পাবার চেয়ে পেয়ে হারানো কতটা কষ্টের আপনি জানেন অফিসার,’ বলে সে পাগলাটে ভঙ্গিতে হেসে উঠল। হয়তো আপনিই ভালো জানেন,’ বলে সে হাসতে লাগল।

ডক্টরের শেষ কথাটা শুনে তানভীরের গলার কাছটায় কেমন জানি একটা ঠান্ডা অনুভূতি হলো, দীর্ঘক্ষণ পিপাসার্ত থাকার পর হঠাৎ অনেক বেশি ঠান্ডা পানি খেয়ে ফেললে এর কাছাকাছি একটা অনুভূতি হয়। ডক্টর কি ওর আর লায়লার ব্যাপারটা জানে, মনের ভেতরে আনমনেই এই প্রশ্নটাই জাগল সবার প্রথমে। কিন্তু ও বাস্তবে ফিরে এলো ওসি জালালের কথা শুনে।

‘ডক্টর অকারণে কাহিনি না ঘুরায়া শুরু থাইক্কা বলেন,’ জালাল একটা চেয়ার টেনে বসেছে। তার হাতে ডক্টরের মেডিকেল রিপোর্ট। ‘প্রথম কথা, আপনেরা আসামে যে অপারেশনের কথা কইছিলেন এইটা পুরাটাই ভুয়া ছিল, তাই না?’

ডক্টর আবারো জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তানভীর তাকে বেশ কড়া সুরেই বলে উঠল, ‘শুনুন ডক্টর। আপনি যদি মুখ না খোলেন তাহলে আপনিই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন। কাজেই একেবারে শুরু থেকে সব খুলে বলুন।’

‘শুরুটা হয়েছিল অনেক আগে। আজ থেকে চার বছর আগে হবে মনে হয় সময়টা,’ ডক্টর জানলার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলতে শুরু করেছে। ‘আমি তখন সবেমাত্র আমার ডক্টরেট শেষ করে ছুটিতে ছিলাম। নিজের ক্যারিয়ার বা কর্মক্ষেত্র নিয়ে ঠিক কী করব সিদ্ধান্ত নিইনি। এমন সময় লন্ডনের এক পাবে একজন অ্যাকাডেমিক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয় প্রফেসর টেড চ্যাঙের সঙ্গে। উনি আর আমি প্রায় কাছাকাছি অ্যাকাডেমিক ফিল্ডের মানুষ, আবার উনি সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের হর্তাকর্তা—তাই আড্ডা জমে উঠতে খুব একটা সময় লাগেনি। পাবে আড্ডা দিতে দিতে বেশ রাত হয়ে যায়, এমন সময় ডক্টর চ্যাঙ আমাকে তার বাসায় আমন্ত্রণ জানান একটা জিনিস দেখাবেন বলে। ততক্ষণ কয়েকদফা পেগ চড়ে যাবার পর আমার অবস্থাও খারাপ, তাই ভাবলাম যাই দেখি কি জিনিস। আর তেমন কিছু না হলে রাতটা উনার ওখানে থেকে তারপর হোটেলে ফেরা যাবে। উনার বাসা পাব থেকে কয়েক ব্লক দূরেই ছিল। তাই আমরা হেঁটেই গেলাম। ছোটো একটা অ্যাপার্টমেন্ট, বইপত্র আর নানা ধরনের পুরনো আমলের জিনিসে ভর্তি। ওখানে যাবার পর উনি আমাকে এমন এক জিনিস দেখান, আমার নেশা ছুটে যায়। জিনিসটা ছিল একটা তলোয়ার। সঠিকভাবে বলতে গেলে একটা কাতানা। কালো ধাতু দিয়ে নির্মিত সোনালি বর্ডারের ওরকম জিনিস আমি জীবনেও দেখিনি।’

‘কি এমন তলোয়ার, বিশেষত্ব কি ওটার?’ তানভীর জানতে চাইল। মোবাইলের নোট প্যাডে নোট নিতে শুরু করেছে ও।

‘একেবারেই ব্যতিক্রম জিনিসটা। কাতানা বেশির ভাগই জাপানিজদের তৈরি কিন্তু এই কাতানাটা জাপানিজ কাতানা থেকে একেবারেই ভিন্ন। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, জিনিসটা নির্মিত হয়েছে অদ্ভুত এক ধাতু দিয়ে, যে ধাতুর অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে। প্রফেসর আমাকে জানান এই ধাতুটার অবস্থান নাকি সায়েন্সেও নেই। এই ধাতুর একটা হইপোথেটিক্যাল নাম আছে-হিম্বা কিন্তু বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব এতদিন ছিল না। যতদিন না এই কাতানাটা খুঁজে পাওয়া গেছে।’

‘টেড চ্যাঙ ওটা পেয়েছিল কোথায়?’

‘জিনিসটার অরিজিন তিব্বতে। ১৯২৫ সঙ্গে যখন চায়না তিব্বত দখল করে নেয়, তখন তিব্বতের বিভিন্ন মঠে ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়। সেই সব মঠগুলো থেকে লুটপাটের জিনিসগুলো পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জায়গায়। কিছু জিনিস চায়না, নেপাল আর ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক লোকজনের মাধ্যমে স্থান পায় বিভিন্ন সরকারি জাদুঘরে, আর বেশির ভাগ জিনিসই ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া আর ইউরোপের চোরা বাজারে। যে ব্যাপারটা কেউ জানত না সেটা হলো এই সব লুটপাটের জিনিসগুলোর ভেতরে কিছু জিনিস সংরক্ষিত ছিল একেবারেই লোকচক্ষুর অন্তরালে নেপালের রাজপরিবারের ব্যক্তিগত সংগ্রহে। এসব জিনিস হয়তো চিরকাল নেপালের রাজপরিবারের অন্ধকার কুঠুরিতেই বন্দি থাকত যদি না ২০০১ সঙ্গে নেপালের রাজপরিবারে রাজা জ্ঞ্যানেন্দ্রর মাধ্যমে সেই হত্যাকাণ্ডটা সংঘটিত না হতো।’

‘নেপালের রাজকুমার জ্ঞানেন্দ্র পরিবারের সবাইকে গুলি করে মারে, ওই ঘটনা?’ জালাল বলে উঠল। ‘পত্রিকায় পড়েছিলাম।’

হ্যাঁ, ওটাই। তা ওই ঘটনার সময়ে যেটা ঘটে; নেপালের রাজপরিবারে গণ্ডগোলের সুযোগে মহলের কর্মচারীরা রাজপরিবারের মূল্যবান অনেক জিনিস চুরি করে বাইরে বিক্রি করে দেয়। এর মধ্যে একটা ছিল এই কাতানা। বিভিন্ন হাত ঘুরে এই জিনিসটা চলে যায় থাইল্যান্ডে। দেখতে অতোটা সুন্দর নয় বলে ওটা থাইল্যান্ডের এক অ্যান্টিকের চোরা মার্কেটে কোনো এক অখ্যাত দোকানের প্রদর্শনীর কাচের নিচে পড়ে থাকত যদি না জিনিসটা প্রফেসর টেড চ্যাঙের নজরে পড়ত। থাইল্যান্ডের চোরা বাজার থেকে ওটা কিনে টেড চ্যাঙ জিনিসটা নিয়ে কাজ শুরু করে, প্রথমেই তার নজর কাড়ে ধাতুটা। ওটা নিয়ে খোঁজ করতে গিয়েই বেরিয়ে আসে জিনিসটা আসলে কি। ওটা যে ধাতু দিয়ে নির্মিত তার হাইপোথেটিক্যাল নাম ‘হিম্বা। এই ধাতুর অস্তিত্ব এতদিন শুধু মিথেই ছিল। বাস্তবে এরকম কিছু আছে কেউই বিশ্বাস করত না। টেড চ্যাঙের মুখে হিম্বার নাম শুনে আমি চমকে উঠি। কারণ এই ধাতুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেকটা মিথ আছে। এই ধাতু দিয়ে নির্মিত একটা মাত্র জিনিসই পৃথিবীতে আছে।’

‘ব্ল্যাক বুদ্ধা,’ আনমনেই বলে উঠল তানভীর।

‘হাজার বছরের পুরনো সেই মূর্তি যাকে বলা হয়ে থাকে বুদ্ধের অন্ধকার অবতার। যে মূর্তির মুখ দিয়ে নাকি স্বয়ং বুদ্ধ কথা বলতেন। তখনো চমক বাকি ছিল। চ্যাঙ আমাকে আরো অদ্ভুত এক জিনিস দেখায়। কাতানাটার হাতলের একটা জায়গায় মোচড় দিতেই সেটা আলগা হয়ে খুলে যায়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা পুরনো রোল করা চামড়ার পার্চমেন্ট। জিনিসটাতে চোখ বোলাতেই আমি বুঝতে পারি এটা তিব্বতি ভাষার বহু পুরনো এক রূপ। প্রফেসর আমাকে জানায়, এটাকে ডিসাইফার করার জন্যেই সে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল বহুদিন ধরে। তার বিশ্বাস এটা ডিসাইফার করতে পারলেই আমরা ব্ল্যাক বুদ্ধার সন্ধান পাবো।’

সত্যিই কি তাই ছিল?’ প্রফেসর মিতায়নের গল্প শুনতে শুনতে নিরাসক্ত জালালও আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

‘না, টেড চ্যাঙ ভুল ভেবেছিল। কাতানাতে পাওয়া বার্তাটা ডিসাইফার করতে অনেক সময় লেগে যায়। তবে ওটার অর্থ উদ্ধার করে আমরা যা জানতে পারি সেটা খুবই হাতাশাজনক। ওতে থাকা মেসেজটা অসম্পূর্ণ, কারণ একইরকম অরেকটা কাতানা আছে। দুটোর মেসেজকে এক করতে পারলেই তবে পুরো জিনিসটার অর্থ উদ্ধার করা যাবে, খুঁজে পাওয়া যাবে ব্ল্যাক বুদ্ধা। আমরা বুঝতে পারি আমাদের মাঠে নামতে হবে। আমরা থাইল্যান্ডের সেই দোকান থেকে ট্রেস করা শুরু করি। প্রায় এক বছর খোঁজ করার পর জানতে পারি জোড়া কাতানার অন্যটা নেপালেই আছে,’ বলে ডক্টর মিতায়ন চোখ বন্ধ করে ফেলল।

ডক্টরের বক্তব্য শুনতে শুনতে তানভীরের মনে পড়ে গেল ডক্টরের ডেস্কে দেখা নেপালের সেই পেপারওয়েটের কথা। তারমানে নেপালের সঙ্গে এদের ঘটনার একটা সংযোগ অবশ্যই আছে।

‘বিশ্বাস করেন, নেপালের লিঙ্ক পেয়ে…’ ডক্টর বলে চলেছে। ‘…আমরা পুরো নেপাল স্রেফ চষে ফেলি কিন্তু কোনো খোঁজ বের করতে পারিনি। এমন সময় ২০১৫ সালে নেপালের সেই কুখ্যাত ভূমিকম্প হয়। নেপালের জন্যে অভিশাপ হলেও আমাদের জন্যে ওই ভূমিকম্প দেখা দেয় আশীর্বাদ হিসেবে। ভূমিকম্পের পরে আমরা প্রথমে যাই লুম্বিনিতে। তারপর সেখান থেকে নেপালের ভক্তপুরে আমাদের এক সোর্সের মাধ্যমে জানতে পারি যা খুঁজছি এরকম কিছু একটার সন্ধান আছে তার কাছে। লুম্বিনি থেকে আমরা ছুটে যাই ভক্তপুরে। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত ভক্তপুরে সেই সোর্স আমাদের নিয়ে যায় এক বৃদ্ধের বাড়িতে। ভূমিকম্পে আহত হয়ে বৃদ্ধের অবস্থা খুবই গুরুতর। তার পরিবারের লোকজনের সামর্থ নেই তার চিকিৎসা করানোর। সেই বৃদ্ধ আমাদের জানায় সে এক সময় নেপালের রাজপরিবারের খানসামা ছিল। রাজপরিবারে গণ্ডগোলের সময়ে সে রাজবাড়ি থেকে বহুকিছু চুরি করে পালিয়েছিল। দামি জিনিসগুলো বিক্রি করে দিলেও টুকিটাকি কিছু জিনিস রয়ে গেছে তার কাছে। সেগুলোর ভেতরেই আমরা খুঁজে পাই সেই জোড়া কাতানার দ্বিতীয়টা। সেই বৃদ্ধের পরিবারকে তার চিকিৎসা করানোর অর্থের বিনিময়ে আমরা কিনে নেই সেটা। শুরু হয় আমাদের গবেষণার দ্বিতীয় পর্ব।’

ডক্টর মিতায়ন এই পর্যন্ত বলে পানি খেয়ে আবার শুরু করল। ‘জোড়া কাতানার দ্বিতীয়টা থেকে আরেকটা চামড়ার পার্চমেন্ট পাই আমরা, সঙ্গে একটা ম্যাপ। মেসেজটা অ্যানালিসিস করে জানতে পারি ব্ল্যাক বুদ্ধার অবস্থান সেভেন সিস্টার্সের আসামের কোথাও। আর ম্যাপটা কাজে লাগবে জায়গামতো পৌঁছানোর পর। এতদিন পর্যন্ত আমাদের অভিযান ব্যক্তিগত পর্যায়েই ছিল, এবার আমরা বুঝতে পারি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা লাগবে। টেড চ্যাঙ আমাকে আস্বস্ত করে বলে অর্থ নিয়ে যেন আমি চিন্তা না করি। কিন্তু আমাদের একটা কভার দরকার ছিল। কোনো কভারে, কোনো একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করে কাজটা ভালোভাবে সারা যায় সেটা নিয়ে আমরা ভাবছিলাম-এমন সময় চোখে পড়ে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট খুলতে যাচ্ছে। সেখানে প্রফেসর ও অভিজ্ঞ শিক্ষক দরকার। টেড চ্যাঙই আমাকে বুদ্ধি দেয় যদি আমি সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে পারি তবে আমাদের জন্যে সরকারি লেবাস পরিয়ে কাজটা করতে সুবিধে হবে। আমি তখন ব্ল্যাক বুদ্ধার খোঁজ বের করার জন্যে অন্ধ। ফলে চ্যাঙ যা বলল তাই করলাম, সিলেটে এসে শাবিপ্রবিতে যোগ দিলাম, বিয়ে করলাম, আর ডিপার্টমেন্টের সহায়তায় সরকারি অর্থায়নে আর সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে একটা ভূয়া কেস স্টাডি সাজিয়ে অভিযান চালিয়ে যেতে লাগলাম আসামে।’

‘আসামের সরকারি কর্তৃপক্ষ কোনো ঝামেলা করেনি?’ তানভীর জানতে চাইল।

‘উলটো ওরা সহায়তা করেছে, এটাও চ্যাঙেরই বুদ্ধি ছিল। চ্যাঙই এমন ব্যবস্থা করেছিল যে বাংলাদেশের সরকারি প্রজেক্ট হওয়াতে ওরা বরং উলটো আমাদের লোকবল দিয়ে সহায়তা করেছে।’

‘আপনার কাছে একবারও মনে হয়নি এভাবে সরকারি রিসোর্স ব্যবহার করে ভুয়া অভিযান চালানোটা ঠিক হচ্ছে না?’ জালাল বলে উঠল।

ডক্টর মিতায়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে ফিরে তাকাল ওসি জালালের দিকে। ‘আপনি কখনো কোনো অ্যাকাডেমিকের সঙ্গে কাজ করেছেন? করেননি, আমার ধারণা। তাদের মাথায় যখন কিছু জেঁকে বসে সেটার বাইরে তারা আর কিছুই দেখতে পায় না। আমিও তখন প্রায় অন্ধ হয়ে গেছিলাম। চ্যাঙ যা বুঝিয়েছে তাই বুঝেছি। চ্যাঙ আমাকে বুঝিয়েছিল আমরা যা করতে যাচ্ছি তাতে আখেরে দেশেরই লাভ হবে। আগে থেকে সব জানা থাকলে সরকারি কর্তৃপক্ষ অনুমতি নাও দিতে পারে, আসামের ওরা ভাগ বসাতে পারে। তারচেয়ে সব গোপনে সেরে জিনিসটা উদ্ধার করতে পারলে তখন আমরাই সরকারকে জানাব। আর যেহেতু সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন আমাদের পেছনে আছে, কাজেই সরকারও তখন কিছু করতে পারবে না। পরে কী করা হবে সরকার আর অ্যাসোসিয়েশন মিলে সেই সিদ্ধান্ত নেবে। আমার কাছেও এটাই ঠিক মনে হয়েছে। সত্যি কথা হলো, আমি এতকিছু ভাবিইনি। আমার উদ্দেশ্য ছিল যেভাবেই হোক ব্ল্যাক বুদ্ধা উদ্ধার করা। এটা উদ্ধার করতে পারলে তুতেম খানের মমি আবিষ্কারের পর সবচেয়ে বড়ো আবিষ্কার হবে আর্কিওলজির জগতে।’

‘তারপর, পেরেছিলেন আপনারা ব্ল্যাক বুদ্ধা আবিষ্কার করতে?’

ডক্টর কড়া দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল তানভীরের দিকে। ‘আপনার কি মনে হয়, যদি নাই পারতাম তবে আমার এই মুহূর্তে এই অবস্থা কেন?’

‘মাই গড! তারমানে আপনারা ঠিকই ব্ল্যাক বুদ্ধা…

‘ঠিক, আমরা সেই দুটো লেখা মিলিয়ে প্রায় তিন বছর ধরে ধীরে ধীরে আসামের সেই বিরাট মন্দির এলাকা খুঁজে বের করি। তারপর কাজ শুরু করি দ্বিতীয় ম্যাপ নিয়ে। একদিকে আসাম কর্তৃপক্ষকে ধোঁকা দেয়া, অন্যদিকে উলফাদের একটা সিসটার মিলিট্যান্সি গ্রুপের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ লাগে, ওরা ঠিকই বুঝে ফেলেছিল আমরা ভিন্ন কিছু করতে যাচ্ছি। সবমিলিয়ে দুনিয়ার সব ঝামেলা পার করে আমরা ব্ল্যাক বুদ্ধা শুধু খুঁজেই বের করিনি, সেই মন্দিরের তল থেকে সেটাকে উঠিয়ে এনে ঠিকই ওই দিন রাতে দেশে প্রবেশ করি ওটাকে নিয়ে।

—তাহলে গোলটা বাঁধল কখন?’ জালালের প্রশ্ন। মানে ঝামেলা লাগল কখন?’ ‘ঝামেলাটা কখন লাগল সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। চ্যাঙ আসলে খুবই বিচিত্র আর অবাক করার মতো একজন মানুষ। তার গুণের যেমন কোনো শেষ নেই তেমনি ধৈর্যও অপরিসীম। তবে অভিযানের শেষ দিকে এসে চ্যাঙকে মাঝে মাঝে আমার খুব অস্থির মনে হতো, আবার হঠাৎ হঠাৎ সে খুবই হিংস্র আর জঘন্য ব্যবহার করত। তার মতো অ্যাকাডেমিকের সঙ্গে যেটা একেবারেই মেলে না। তবে অভিযানের শেষ দিকে আমার ওপরে সে খুব নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল, তাই মাঝেমধ্যে খারাপ ব্যবহার করলেও অতিরিক্ত কিছু করত না। আসাম থেকে জিনিসটা উদ্ধার করার পর সেই মিলিট্যান্সি গ্রুপ আমাদের পিছু লাগে। তখন খুব দৌড়ের ওপরে ছিলাম আমরা, জিনিসটা নিয়ে কোনোমতে দেশে প্রবেশ করতে পারলেই বাঁচি। তখন কী যে ঘটেছিল আমার ঠিক খেয়াল নেই, তবে ওরকম বাজে অবস্থাতেও আমার মনে হচ্ছিল আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি, ঘুম ভাঙে একেবারে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর। জেগে ওঠার পর আমি বুঝতে পারি কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। তখন চ্যাঙ আমাকে জানায়, সে আসলে এতদিন নিজের পরিচয় গোপন করেছে। সে মনে হয় আমাকে মেরেই ফেলত, কিন্তু এমন সময় ঘটে ভিন্ন এক ঘটনা। আমাদের ট্রাকের ওপরে আক্রমণ হয়।’

‘আক্রমণ হয় মানে?’ তানভীর অবাক হয়ে জানতে চেয়ে আবার জালালের দিকে ফিরে তাকাল।

‘জানি না, ব্যাপারটা আসলে কি? কিন্তু সত্যি সত্যি আমাদের ওপরে আক্রমণ হয়। এরপর কী হয়েছিল আর না হয়েছিল আমি বলতে পারব না। কারণ ওখানেই আক্রমণকারীরা আমাকে বেঁধে কোনো একটা ইনজেকশন পুশ করে। এরপর থেকে ওষুধের ঘোরে থাকার কারণেই হয়তো আমার আর কিছু পরিষ্কার কিছু মনে পড়ে না।’

‘লোভে পাপ, পাপে বাচ্চার বাপ,’ মৃদু টিটকিরির সুরে বলে উঠল ওসি জালাল। ‘আমি একটা জিনিস বুঝলাম না আপনার মতো দশ ঘাটের পানি খাওয়া একজন মানুষ এটা বুঝতে পারল না যে চ্যাঙের মতো একজন মানুষের সঙ্গে মিলে এভাবে দুই দেশের সরকারের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে আপনারা একটা অভিযান চালাবেন আর সেটার ফলাফল চ্যাঙের মতো একজন লোক নিজের কাজে না লাগিয়ে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরবে!’ বলে জালাল নিজের দুই হাত তুলে ধরল। ‘দুনিয়ার উন্নয়নের জন্যে?

ডক্টর কথা না বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ‘এখন আমি যাই বলি না কেন সবই মিথ্যে আর বানোয়াট শোনাবে, কারণ আমি ধরা খেয়ে গেছি। আর ধরা খাওয়া মানুষের কথা পৃথিবী শোনে না, কখনোই না,’ বলে সে খানিকটা দুঃখের হাসি হাসল। ‘তবে একটা সত্যি কথা হলো, পুরো ব্যাপারটা আপনারা এখন যে দৃষ্টিতে দেখছেন অথচ আজ থেকে তিন বা চার বছর আগে ব্যাপারটা এমন ছিল না,’ বলে সে উঠে বসল।

‘চ্যাঙকে আমার কাছে মাঝেমধ্যে খুবই জ্ঞানী মনে হতো। সব কাজে তার নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, সেইসঙ্গে তার নিজস্ব একটা ফিলোসফিও। অস্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমি চ্যাঙকে পছন্দ করতাম। আমরা দুজনে মিলে ভেবেছিলাম এমন একটা কিছু করব যেটা সবার কাজে লাগবে। সত্যি বলতে আমরা আমাদের আবিষ্কারকে নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডি কিংবা কোনো দেশের সীমানার ভেতরে আটকে ফেলতে চাইনি। এই কারণেই এতসব লুকোছাপা। চ্যাঙের একটা কথা আমার খুব পছন্দের ছিল, ‘হয় তুমি পৃথিবীকে বদলে দাও, আর না হয় পৃথিবীই তোমাকে বদলে দেবে,’ ডক্টর উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল জানালা দিয়ে, সে ফিরে তাকাল তানভীরের দিকে। ঠিক না মিস্টার তানভীর, আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোই আমাদের সবচেয়ে বেশি বদলে দেয়। যাদের আমরা সবচেয়ে বেশি আপন মনে করি।’

ডক্টর একেবারে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তানভীরের চোখে। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা গভীর নিশ্বাসটাকে আবারো বুকের ভেতরেই চালান করে দিয়ে তানভীরও একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডক্টরের দিকে।

‘ডক্টর, আপনাদের ফিলোসফিতে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি ঘটনার ওপরে ফোকাস করতে চাই। আপনি যা বলছেন তাতে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, আপনি আর চ্যাঙ মিলে ব্ল্যাক বুদ্ধা উদ্ধার করে দেশের ভেতরে প্রবেশ করেন, এরপরে আপনাদের ওপরে হামলা হয়। ব্যাপারটা কারা ঘটিয়েছে কিংবা কী ঘটেছে—এই ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণা আছে?’

‘এখানে আপনাদের একটা ব্যাপার বলা হয়নি। পুরো অভিযানে শুধু আমি আর চ্যাঙ ছিলাম না। আমাদের একজন ফিন্যানশিয়ার ছিল,’ বলে ডক্টর মাথা নেড়ে বলল, ‘চাইলে স্পনসরও বলতে পারেন। বছর দুয়েক আগে তখন আমরা অভিযানের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গায় আছি এমন সময় সরকারি সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে আমাদের অভিযান বন্ধ করে ফিরে আসতে হয়। এমন সময় আমাদেরকে শুধু অর্থ সহায়তা নয় বরং লোকবল থেকে শুরু করে অন্যান্য সব ধরনের সহায়তা করে একজন মানুষ।‘

‘লাক্কাতুরার সেই বাংলোর মালিক?’ তানভীর নোট নিচ্ছিল তার মাঝেই হঠাৎ বলে উঠল।

‘হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছেন। আপনাদের সঙ্গে কি তার দেখা হয়েছে? ডক্টরের চোখে দপ করে আলো জ্বলে উঠল যেন।

‘মানুষটা কে, সেটাই তো জানতে পারিনি এখনো?’ তানভীর একবার জালালের দিকে দেখে নিয়ে বলে উঠল।

‘সিলেটের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হেকমত আবদুল্লাহ। আমরা যখন হন্যে হয়ে আমাদের অভিযানের জন্যে একজন স্পনসর খুঁজছিলাম তখন উনিই আমাদের সব ধরনের সহায়তা করার প্রতিজ্ঞা করেন। ওই বাংলোটাকেও উনি আমাদের টেম্পোরারি অফিস করার অনুমতি দেন।’

‘বিনিময়ে?’ জালাল জানতে চাইল। ‘আমি হেকমত আবদুল্লাকে চিনি না কিন্তু তার মতো ব্যবসায়ীদের খুব ভালোভাবে চিনি। বিনিময়ে সে কি চায়? নিশ্চয়ই মহানুভবতা দেখানোর জন্যে তার মতো একজন লোক একটা অ্যাকাডেমিক প্রজেক্টের পেছনে টাকা ঢালতে শুরু করেনি।’

ডক্টরের মাথা নিচু হয়ে গেল। ‘এই ব্যাপারটাও আমি সঠিক জানি না। কারণ চুক্তিটা করেছিল চ্যাঙ। তাদের ভেতরে কী চুক্তি হয়েছিল সেটা আমি জানি না, তবে এটা বুঝতে পারতাম সেটা ভালো কিছু না। কারণ প্রায়ই আমরা অভিযানে যাবার সময়ে দেখতাম ট্রাকে আমাদের জিনিসপত্রের আড়ালে নানা ধরনের মাল তোলা হতো। ফেরার সময়েও একই ঘটনা ঘটত।’

‘তারমানে বুঝেছেন?’ জালাল তানভীরের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘অ্যাকাডেমিক ছাড়পত্র ব্যবহার করে ওরা ট্রাকে করে অবৈধ জিনিসপত্র আনা নেওয়া করত। চোরাচালান আর কি। মনে হয় অস্ত্র চোরাচালান করত। কারণ ড্রাগ আজকাল এমনেই আসে যায়। ওটার জন্যে এত কাহিনির দরকার পড়ে না। তবে অস্ত্র নিয়ে ঝামেলা আছে। তাই ওরা অ্যাকাডেমিক পারপাসকে ব্যবহার করে এর আড়ালে সম্ভবত অস্ত্র আনা নেয়া করত।’

‘তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, আপনারা দেশে ঢোকার পর একেবারে সঠিকভাবে সঠিক সময়ে আপনাদের ওপরে হামলা হলো, ব্যাপারটা আমাকে খোঁচাচ্ছে। এই ব্যাপারটা জানতো একমাত্র-’

‘হেকমত আবদুল্লাহ,’ ডক্টর বলে উঠল। দীর্ঘক্ষণ কথা বলাতে তাকে এখন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, সেইসঙ্গে কিছুটা ক্লান্তও। ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন অফিসার। আমার বিশ্বাস ঠিক যেভাবে চ্যাঙ আমাকে ধোঁকা দিয়েছে ঠিক একইভাবে হেকমতও চ্যাঙকে ধোঁকা দিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে মূর্তিটা। আমার বিশ্বাস ব্ল্যাক বুদ্ধা সিলেট শহরেই আছে,’ বলে ডক্টর একটু বিরতি দিয়ে নিজেকে সামলে নিল। ‘আর সেটা আছে হেকমত আবদুল্লার কবজায়। সম্ভবত চ্যাঙও তার হাতেই বন্দি।’

জালালের দিকে তাকিয়ে তানভীর বলে উঠল, ‘টমি আর ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হেকমত আবদুল্লার খবর নিতে হবে এক্ষুণি।’ জালাল একবার ডক্টর আর একবার তানভীরকে দেখে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বাইরে চলে গেল।

‘ডক্টর, আপনি যখন ওই বাংলোতে ছিলেন আপনার কোনো স্মৃতি মনে পড়ে? বা ওরা কি আপনাকে কিছু বলেছে, অথবা এমন কিছু যা আমাদের কাজে সহায়তা করতে পারে?’

‘অফিসার আমি—’ ডক্টর মিতায়ন বলতে শুরু করার আগেই তানভীরের মোবাইল বাজতে লাগল। ও মোবাইল বের করে দেখল সুলতানের কল। ও কলটা রিসিভি করার আগেই ওসি জালাল প্রবেশ করল রুমে। তার চেহারা দেখেই তানভীর অনুমান করল গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে। ও সুলতানের কলটা রিসিভ না করে কেটে দিল।

‘কি ব্যাপার-’

‘কমান্ডার আমি টমিকে কল দিয়ে হেকমত অবদুল্লার কথা বললাম কিন্তু ও ভূমি অফিস থেকে জমি রেজিস্ট্রির দলিল ঘেঁটে বাংলোর মালিক যে হেকমত এটা আগেই বের করে ফেলেছিল। ওটা বের করে ও হেকমতের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে জানতে পারে হেকমত আবদুল্লার লাশ পাওয়া গেছে,’ বলে সে হতবিহ্বল ভঙ্গিতে একবার তানভীরকে দেখল সেইসঙ্গে অধিক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ডক্টর মিতায়নকেও।

‘নিজ বাড়িতে এক দিন আগে খুন হয়েছে সে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *