প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৩৯

অধ্যায় উনচল্লিশ – বর্তমান সময়
সার্কিট হাউস, সিলেট

সার্কিট হাউসের ভেতরটা একেবারে খালি, লোকজন নেই বলতে গেলে। জালাল আর তানভীর ইকবালের সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করতেই রিসিপশন রুমের পাশ থেকে উত্তপ্ত কথোপকথন ভেসে এলো। ইকবাল ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো রিসিপশনের পাশে ছোট্ট একটা কামরায়।

কামরাটার অবস্থান দেখে তানভীর আন্দাজ করল ওটাতে সম্ভবত সিকিউরিটি গার্ডরা বিশ্রাম নেয়। রুমের বাইরে দাঁড়ানো দুই সিকিউরিটি গার্ড ওদেরকে দেখে স্যালুট ঠুকল। তানভীর আর জালালকে নিয়ে ইকবাল চলে এলো রুমের ভেতরে।

কামরার ভেতরে একদিকে একটা পানির ফিল্টার, তার অন্যপাশে একটা খাট, আর রুমের ঠিক মাঝখানে একটা টেবিলকে ঘিরে তিনটে চেয়ার। তিন চেয়ারের একটাতে বসা সুলতান। তার ঠিক বিপরীতে বসে আছে সাদা লুঙ্গি আর সাদা ঢোলা শার্ট পরনে এক লোক। সে খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে চিৎকার করে সুলতানকে কিছু একটা বলছিল, ওদেরকে দেখে থেমে গেল। তানভীর তাকিয়ে দেখেল লোকটা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে থাকলেও তার দুটো পোশাকই বেশ দামি, হাতে সোনালি রঙের বিরাট একটা ঘড়ি, গলায় চকচক করতে থাকা সোনার চেইনটাও বেশ মোটা।

লুঙ্গি পরা মানুষটা ওদের তিনজনকে দেখে সোজা তানভীরের দিকে দৃষ্টি স্থির করল। বুদ্ধিমান লোক, দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছে দলটার নেতৃত্ব কার হাতে। ‘এইয়া, স্যার, এগু দেখরায় খিতা খইয়ের। আমার মতন একগা বালা মানুষরে এমনিছাই ধরিয়া আনিয়ের…..

‘আপনার নাম কি নচি বিশ্বাস?’ তানভীর শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল। ওদেরকে দেখে সুলতান উঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তাকে চুপ থাকতে বলে তানভীর একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

‘দেখুক্কা অপিসার, আমি কিন্তুক সম্মানি লুক, এগুক্কা আমারে মাঝ দুফরো এমনিছাই ধরিয়া রাখতা ফারিয়ের না। আমি কানুন জানি। খুলাউরার এমপি আমার বাই লাগের, এখতন হের কানে খবর গেলে…’

‘আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন, নচি বিশ্বাস?’ লোকটার কথা শুনে গা জ্বলে যাচ্ছে তানভীরের। ‘এত উত্তেজিত হবার মতো কিছু হয়নি। আপনাকে কেউ ধরে আনেনি এখানে। আমাদের কিছু জিনিস জানা দরকার সে ব্যাপারে-

তানভীরের কথা শেষ হবার আগেই নচি বিশ্বাস লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। ‘আফনেগর খিতা জানুনের আছুইন হেয় খিতা আমি খইয়ের নাকি?’ বলেই সে লুঙ্গির ভাঁজ থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল করতে করতে বলতে লাগল, ‘আমি অসরতরে খবর দিয়ার, হেয় এগু আইলে এখবার দেখরাম এগু আবাদিগুলান কি খরিয়ের আমরারে…’

‘আবাদি’ শব্দটা শুনতেই গায়ে আগুন ধরে গেল তানভীরের। এটা এক ধরনের গালি। ও কড়া ভাষায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই অনুভব করল ওর পেছনে একটা ছায়া নড়ে উঠল। ।

ওসি জালাল স্রেফ বাতাসের একটা ঝলকের মতো এগিয়ে গেল নচি বিশ্বাসের দিকে। মোবাইল ডায়াল করতে করতে নচি বিশ্বাস আবারো বসে পড়েছিল চেয়ারে, জালালের এক লাথি খেয়ে উড়ে গেল চেয়ারটা। তবে নচি বিশ্বাস মাটিতে পড়ল না, চেয়ার সরে যাবার আগেই একহাতে তার সাদা শার্টের কলার ধরে পেটে একটা ঘুসি বসাল জালাল।

তানভীর প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘জালাল—’

কে শোনে কার কথা।

জালাল নচি বিশ্বাসের পেটে ঘুসি মেরে তাকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলল দেয়ালের সঙ্গে লাগানো ছোটো বিছানাটার ওপরে। এগিয়ে যেতে যেতে পিস্তল বের করে ফেলল সে। বিছানায় পড়ে থাকা নচির ওপরে চেপে ধরে পিস্তলের বাঁট দিয়ে হালকা একটা বাড়ি মারল তার চোয়ালে। সঙ্গে সঙ্গে হা হয়ে গেল নচির মুখ। তার মুখের ভেতরে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে দিল জালাল। তারপর মৃদু হেসে খুব শান্ত স্বরে যেন রসালাপ করছে এমন স্বরে কথা বলে উঠল, ‘কলেজে থাকতে আমার খুব শখ ছিল…’ সে খুব আরামে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তানভীরের ধমক খেয়ে থেমে গেল।

‘জালাল, স্টপ ইট,’ তানভীর আনমনেই সামনে এগিয়ে গেছে এক ধাপ। সবাই ঘিরে দাঁড়িয়েছে ওদেরকে। ‘জালাল।’

জালালের কোনো বিকার নেই, সে বলে চলেছে, ‘এখন তুই আমারে ক, তুই কি কথা কইবি? নাকি, আমি এইটা টিপ্পা দিব?’ নচি কচরমচর করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, তানভীর আবারো ধমকে উঠল। জালাল তানভীরের দিকে ফিরে শান্ত স্বরে বলে উঠল, ‘রিল্যাক্স, বস,’ বলে সে ওর উদ্দেশ্যে একবার চোখ টিপল তারপর নচির দিকে ফিরে মৃদু হেসে পিস্তলের ট্রিগার টিপে দিল।

***

সকাল বেলা মিটিং শেষ করার পর একের পর এক সাফল্য পেয়ে টমি পোদ্দার আজ কাজের তুঙ্গে ছিল কিন্তু হেকমত আবদুল্লার বাড়ি আর তার আশপাশের বাড়িগুলোতে সিসি টিভি খুঁজতে গিয়ে তার সেই মুডের বারোটা বেজে গেল। প্রথমত, হেকমতের বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যেখানে রেকর্ড হতো সেই হার্ড ড্রাইভ ফুটেজ সব নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। তানভীররা বাড়িতে আসার আগেই এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত হয়েছে কিন্তু ওরা বেরিয়ে যাবার পর আশপাশের বাসাগুলোতে ক্যামেরা খুঁজতে শুরু করে রীতিমতো ঘোল খেয়ে গেল টমি আর তার টিম।

সিসি টিভি কোথায় আছে আর কোনোটা ওই বাড়ির সীমানা কভার করে কেউই সঠিকভাবে বলতে পারে না। ওই বাড়ির আশপাশে সব খুঁজে সে যখন হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে এমন সময় তার চোখে পড়ল একটা মোবাইল কোম্পানির সার্ভিসিং ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মোড়ে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ব্যাপার মাথায় খেলে গেল তার।

এটা দিয়ে কাজ হলে হতেও পারে।

***

জালাল ট্রিগার টিপে দিতেই একটা শিহরণ খেলে গেছিল তানভীরের শরীরে। মনের কোণে হাহাকার করে উঠেছিল এক অদ্ভুত ভয়। একদিকে তার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় একজন মানুষের মৃত্যুর দায়ভার কাঁধে নেয়ার ভয়, অন্যদিকে একমাত্র সূত্রটা হারানোর ভয়।

কিন্তু জালাল ট্রিগার টেপার সঙ্গে সঙ্গে হ্যামারটা সিলিন্ডারের নির্দিষ্ট জায়গায় বাড়ি মারতেই ক্লিক করে চেম্বার খালি থাকার যে শব্দটা শুনতে পেল ও সেটা মনে হয় ওর জীবনের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত শব্দগুলোর একটা।

‘হা হা,’ করে হেসে উঠল জালাল, আর রাগের সঙ্গে তাকে টেনে নচি বিশ্বাসের সামনে থেকে সরিয়ে দিল তানভীর

মুখ থেকে পিস্তলের নলটা বেরিয়ে যেতেই, ফুসসস করে একটা শব্দ করে উঠল নচি বিশ্বাস-ফোলানো বেলুন হঠাৎ ছেড়ে দিল বাতাস বেরুনোর সময়ে যেরকম শব্দ হয় তার মুখ দিয়ে বেরুনো শব্দটা অনেকটা তেমন।

‘দেখো, ব্যাটা আবার বিছানাটা নষ্ট করে ফেলল কি না?’ পেছন থেকে টিপ্পনি কেটে বলে উঠল জালাল। তার দিকে একবার চোখ গরম করে তাকিয়ে ইকবাল আর এক সিকিউরিটি গার্ডকে বলল নচিকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিতে।

‘নচি বিশ্বাস, তোমার সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই কিন্তু তোমার কাছে যে তথ্য আছে সেটা আমাদের দরকার। আর সেটা বের করার জন্যে আমরা কোনোকিছুর ধার ধারব না সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো তুমি?’

নচি বিশ্বাস কিছু না বলে মাথা নাড়ল। তার চোখ নিচের দিকে। ‘আমি খোনতা জানিয়ের না, আমি–’

‘নচি, মিথ্যে কথা বলবে না। তুমি প্রথমে সব শুনলে তারপর ফট করে বলে বসলে তুমি কিছুই জানো না, এটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়,’ রুমের একপাশ থেকে ভেসে আসা সিগারেটের গন্ধে তানভীরেরও সিগারেটে তৃষ্ণা পেয়ে বসল। মনে হচ্ছে রক্তে নিকোটিনের নেশা আবারো পুরোপুরি পেয়ে বসেছে।

‘এই শহরে অবৈধ মদ কতখানি আর অস্ত্র কার কাছে কয়টা আছে—তুমি অবশ্যই জানো,’ পেছন থেকে ইকবাল বলে উঠল।

নচি হাতের উলটোপিঠ দিয়ে নাক-চোখের পানি মুছে চোখ তুলে তাকাল। তানভীর একেবারে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ‘হুজুর, আমি যদি আপণেরে খইয়ের, আপনে বড়ো সায়েবরে চড় মারুক্কা, আপণে খিতা মাইরবেন?’

এ কেমন কথা। তানভীর টেবিলের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুলতানকে দেখল একবার। সুলতান রাগের সঙ্গে তার দিকে এক পা এগিয়ে ধমক দিয়ে বলে উঠল, ‘নচি, কথা না পেঁচিয়ে সোজা কথা বলো।

নচি তাকে একবার দেখে নিয়ে তানভীরকে দেখল। ‘হুজুর, এই বিষয়ে খতা কইতে অইলে আমার উফরে বড়ো বিপদ আইয়ের, যার কথা হেয় আমার গুরু অছিল এক কালে, এহন হেয় বিরাট কারবারি খিন্তুক…’ বলে সে আবারো থেমে গেল। দুই হাত জোড় করে বলে উঠল, ‘হুজুর, আমি কোনোতা কইলে আমার বাল-বাচ্চা সমেত মাইরে ফেলাইয়ের।’

‘না বললে আমিই মারবো তোরে এহন—’ আবার ধমকে উঠল জালাল।

‘নচি, তোমাকে আমরা বিপদে ফেলতে চাই না কিন্তু তোমার জানা তথ্য আমাদের দরকার। তুমি আমাদেরকে স্রেফ একটা সূত্র দাও, তোমাকে আমরা বিপদে ফেলব না,’ তানভীর চিন্তিত। এত ভয় দেখানোর পরও লোকটা কথা বলতে চাচ্ছে না, ঘটনা কী। ‘প্রয়োজনে তোমাকে আমরা প্রটেকশন দেব।’

তানভীরের কথা শুনে হেসে উঠল নচি বিশ্বাস। হেসে উঠেই সে ভয়ের সঙ্গে হাসি থামিয়ে জালালকে দেখল। ‘স্যার, আমারে পরটেকশন দেওয়ার দরখার নাই, আমি খালি আপনেগোরে কয়েখটা খতা খই, আপনেরা যে অস্তরের খতা খইয়ের আর যেই লুকগুলান ওই লাক্কাতুরা য়াছিল, এই ব্যাপারে একজনই জানতে ফারিয়ের,’ বলে সে মুখটা অপ্রয়োজনেই কিছুটা সামনে নিয়ে এলো। ‘খানা মাতবর,’ নচি বিশ্বাস কথাটা বলতেই তানভীর ফিরে তাকাল ইকবালের দিকে। ইকবাল মাথা নেড়ে জানাল সে চেনে।

‘কানা মাতবর কে? আর তার সঙ্গে ওদের কি সম্পর্ক?’ তানভীর জানতে চাইল।

‘হুজুর, আমি যদি অবৈধ অস্তর আর মদের দালাল অইয়ের, হেয় অইলো প্রেসিডেন্ট। হের নিজের অস্তর বানানির কারখানা আছে। আপনা লঞ্চের মেরামতি আছে। ইখতা বড়ো খতা, যেই আদিবাসীগো আপণেরা লাক্কাতুরায় মারুক্কা ওই লুখগুলায় তামাবিলের কাছেই পাহাড়ি মাতলা নামের এক আদিবাসীর লুখ। হেরা ভাড়ায় কামে আহে—কাম মানে খুনাখুনি মারামারি এই গুলান। হেগোরে বাড়ায় আনা নেয়ার কাম একজনই খরিয়ের, এলা এই কানা মাতবর। ওইরহম আতে বানানি অস্তর মাতলার লুখেরাই ব্যবয়ার খরিয়ের। হেরা খুবই বালা অন্তরের কারিগর।’

‘স্যার, এই ব্যাটা যার কথা বলছে সে কিন ব্রিজের অন্যপাশে কদমতলি এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার। সিলেট শহরে সবাই তাকে চেনে। তার বাড়িও তামাবিলের ওদিকেই। সম্ভবত সেও কোনো আদিবাসী গোষ্ঠীর লোক,’ ইকবাল তার দুই ভ্রুর মাঝখানের তিলটা আঙুলে ঘসতে ঘসতে বলে উঠল তানভীর আগেও খেয়াল করেছে ছেলেটা নার্ভাস হলে দুই ভ্রুর মাঝের তিলটা তর্জনি দিয়ে ঘষতে থাকে।

‘এই কানা মাতবরকে কোথায় পাওয়া যাবে?’ তানভীর প্রশ্ন করল।

‘হুজুর, আমি জানি। আইজ আমি বন্দর আওয়ার ফরেই হুনিয়ের হেয় আজইকা পলিটেকনিকের লগে হের একটা কারখানা আর অপিস আছের, হেনে আইয়ার,’ যেন গোপন কোনো ষড়যন্ত্র করছে এরকম স্বরে বলে উঠল নচি বিশ্বাস।

তুমি যেহেতু জানো সে কোথায় আছে,’ বলেই তানভীর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কানা মাতবরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ‘তুমি আমাদের নিয়ে যাবে তার ডেরায়।’

তানভীর কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে নচি বিশ্বাসের ষড়যন্ত্রকারী ভাব মুহূর্তের মধ্যে গায়েব হয়ে গেল। ভয়ের সঙ্গে হাউমাউ করে উঠল সে। ‘হুজুর, সর্বনাশ অইয়ের, হেতেরা আমারে মাইরবো, আমার পরিবারের… ‘

‘কানা মাতবর কোথায় আছে না দেখালে আমি তোরে এহনি মারব,’ জালাল এক পা এগিয়ে এলো। ‘তোর কি আমারে দেইখা অ্যারেস্ট করার মতো লোক মনে হয়?’

নচি বিশ্বাস দম দেয়া কলের পুতুলের মতো দুইদিকে মাথা নাড়ল। ‘তাইলে এহনি নিয়া চল।’

নচি বিশ্বাস চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। ‘ঠিক অয়, আমি ল‍ই যাইয়ার, খিন্তুক আমি, দূর থেইকা দেহায়া দিয়ার হেয় খই আছে।’

‘চলবে,’ ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে তানভীর বলে উঠল। ‘সুলতান, ইকবাল তোমরা নচিরে নিয়া গাড়িতে ওঠো। আমি আর জালাল আসছি।’ সুলতান আর ইকবাল নচিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

রুমের ভেতরে এখন শুধু তানভীর আর জালাল। জালাল তাকিয়ে আছে তানভীরের দিকে। তার একটা হাত অস্ত্রের দিকে এগোচ্ছে ওয়ালজ নাচের মুদ্রার মতো ঝড়ের বেগে তার দিকে এগিয়ে গেল তানভীর। জালালের হাত অস্ত্রের কাছে পৌঁছে গেছে, শূন্যে থাকা অবস্থায় সেটার ফাঁক দিয়ে নিজের হাত গলিয়ে দিল ও। জালাল নড়ে ওঠার আগেই তার হাত আর কাঁধ নিখুঁত আমলকে আটকে ফেলল তানভীর।

বিখ্যাত অমেরিকান অভিনেতা স্টিভেন সিগালের অবিষ্কার করা মার্শাল আর্টের ইতিহাসে সবচেয়ে ডেডলি আমলকগুলোর একটি এটি। একহাতে কবজি ধরে অন্য হাতটা কনুই আর কবজির উলটো দিক দিয়ে টান দিলে হাত আর কাঁধের মধ্যে সংযোগকারী পেশিতে সরাসরি টান পড়ে। ফলে ভেঙে যেতে পারে হাত, নয়তো খুলে আসতে পারে কাঁধের হাড়।

ওসি জালালের ক্ষেত্রে অবশ্য এই দুটোর কোনোটাই হলো না। তানভীর খুব বেশি চাপ না দিয়ে বরং এক ঝটকায় আটকে ফেলল তাকে। সেইসঙ্গে ঠেলা দিয়ে তাকে মিশিয়ে দিল দেয়ালের সঙ্গে। একহাতে জালালকে আটকে রেখেই অন্যহাতে বের করে আনা ডেজার্ট ঈগল পিস্তলটা চেপে ধরল জালালের কপালে।

‘আরে, আরে আরে,’ আর্ম লকে আটকে থাকার কারণে তীব্র ব্যথায় মুখ কুঁচকে রাখলেও জালাল হাসছে। ‘আরে, কমান্ডার তুমি… ‘

‘একটু আগে কী হচ্ছিল, জালাল?’ তানভীর পিস্তলটা আরো জোরে চেপে ধরল জালালের মুখের ওপরে। ‘এখানে কমান্ডার কে? তুমি যত অভিজ্ঞ হও,

সিনিয়র হও আর যাই হও। কেস যতক্ষণ আমার কমান্ডে থাকবে, আমার কথামতো চলতে হবে। তুমি মানুষকে ধরে ধরে ভিক্টিমাইজ করবে, আর আমি সেটা সহ্য করব, তা হবে না। বুঝতে পেরেছো?’ একহাতে পিস্তল চেপে ধরে অন্য হাতে চাপ বাড়াতেই আবারো কুঁচকে উঠল জালালের মুখ।

‘উফ্,’ জালাল নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই তানভীর আরো জোরে চেপে ধরল তাকে। কমান্ডার, তোমার কি ধারণা, উফ্,’ জালাল কথা বলার চেষ্টা করছে। ‘আমি আমি এই প্রথমবারের মতো পিস্তলের মুখে পড়েছি?’

চুপ, কোনো কথা শুনতে চাই না, এবার যা করেছো, করেছো, এরকম আর যেন না হয়,’ বলে তানভীর জালালকে ছেড়ে দিতেই সে চট করে সরে গেল একপাশে। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে বসে পড়েছে টেবিলের ওপরে।

তানভীর ওর পিস্তলটা ঢুকিয়ে রাখল হোলস্টারে। জালাল নিজের হাত আর কাঁধ ডলছে, টেবিলের ওপরে রাখা পানির বোতলটা তার দিকে এগিয়ে দিল তানভীর। কিছু না বলে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বোতলটা নিয়ে নিল সে। পানি খেতে খেতে তার চেহারায় রং ফিরে এলো কিছুটা। পানি খেয়ে মুখ মুছতে মুছতে সে তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘বাপরে কমান্ডার, তোমার হাতে জোর আছে মানতে হবে,’ বলে সে হেসে উঠল সেই পুরনো হাসি। ‘পাশা স্যারের কাছে আমি তোমার অনেক নাম শুনেছি, সেই তোমাকে যখন লাক্কাতুরায় বাংলোর সামনে ভেজা বিড়ালের মতো কাঁপতে দেখলাম, আমি ভাবলাম, ব্যাপার কি, পাশা স্যারের মতো লোক তো ভুল করার কথা না। কিছু একটা তো আছে তোমার মাঝে।’

‘কথা কম, জালাল ভাই,’ তানভীর একটা হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। ‘চলো।’ তানভীরের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা দেখে একটা টিটকিরির হাসি দিল জালাল, তারপর কী মনে করে হাতটা ধরতেই একটানে তাকে তুলে ফেলল তানভীর। ‘কানা মাতবররে ধরতে হবে এইবার।’

দুজনেই বাইরে এসে দেখল নচিকে নিয়ে ইকবাল আর সুলতান দাঁড়িয়ে আছে মাইক্রোর সামনে। ওরা বের হয়ে সামনের দিকে এগোতেই তানভীর খেয়াল করল সুলতান একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে, বিশেষ করে কাঁধ ডলতে থাকা জালালের দিকে। ‘কি ব্যাপার? চলো,’ সুলতানের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলে উঠল তানভীর।

সবাই মিলে মাইক্রোতে উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল ড্রাইভার রসুল মিয়া। ‘বল, কোন দিকে যেতে হবে?’ বলে নচির কাঁধে হালকা একটা চাটি মারল ইকবাল। বহু আগে ছোটোবেলায় বাংলা বইতে একটা গল্পে পড়েছিল তানভীর, হাতে বন্দুক থাকলে নাকি নিরীহ মানুষের চোখও পশুপাখির দিকে যায়। শান্তশিষ্ট সুদর্শন ইকবালকে দেখে ওর মনে হলো জালালের গরম কিছুটা ওর মধ্যেও প্রবেশ করেছে। তা-না হলে তার মতো শান্ত মানুষ নচিকে চড়-চাপড় মারছে ব্যাপারটা ঠিক মেনে নেয়ার মতো না।

ইকবালের চাপড় খেয়ে নচি নির্দেশনা দিতে লাগল ড্রাইভারকে। রসুল মিয়া সার্কিট হাউসের সামনে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলো কিন ব্রিজের গোড়ায়। গোড়ার জ্যাম ঠেলে ধীরে ধীরে গাড়ি উঠে পড়ল ব্রিজের ওপরে। ব্রিজ পার হয়ে নিচে নামছে এমন সময় নচি বলে উঠল, ‘ব্রিজ তাখি নামিয়া ডাইনে।’ তার নির্দেশনা মতো গাড়ি ডানে ঘুরিয়ে দিল রসুল মিয়া। রাস্তার ওপরে প্রচুর লোকজন, হর্ন দিলেও নড়ে-চড়ে না। রসুল মিয়া গালি বকতে বকতে এগোতে লাগল।

‘একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন আপনারা কেউ,’ তানভীর বলে উঠল। ‘আমাদের দেশের লোকজন কোনো এক অদ্ভুত কারণে রাস্তার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে খুব পছন্দ করে। হর্ন বাজালেও সহজে সরে না। প্রথমে শুনবে, তারপর ঘুরে দেখবে, তারপর সরবে। এর কারণ কি?’

‘সবতেরে নবাবের নবাব, মোগলের বংশধর তো, বেখতেই নিজেরে মোগলাই মনে খরিয়ের, রসুল মিয়া সামনে থেকে রাগের সঙ্গে বলে উঠল!

হুম্, সবাই নিজেরে মোগলাই মনে করে দেইখাই যে মন চায় এসে খেয়ে যায়। পর্তুগিজ, ব্রিটিশ…’

এরকম টেনস সিচুয়েশনেও হেসে উঠল তানভীর। কথা ভুল বলেনি জালাল। ওদের মাইক্রো ডানে মোড় নিয়ে এগোচ্ছে। বেশ অনেকটা এগোনোর পর সামনে সিলেট পলিটেকনিক পড়ল। পলিটেকনিক ছাড়িয়ে ওদের মাইক্রো আরো সামনে এগিয়ে গেল। ‘কি ব্যাপার, কই লইয়া যাইতাছোস?’ মাইক্রোর পেছন থেকে ধমকে উঠল জালাল। এলাকাটা প্রায় নির্জন। তানভীরের নিজেরও একটু উদ্বেগ হচ্ছে।

‘স্যার, মনে অয় এই ব্যাটা কই যাচ্ছে আমি বুঝতে পেরেছি,’ ইকবাল বলে উঠল। ‘আগেও একবার একটা কাজে ওসি স্যারের সঙ্গে আমি এখানে এসেছিলাম। ঠিকই আছে, কানা মাতবরের ডেরা এইদিকেই।’

‘ওই যে,’ হঠাৎই বলে উঠল নচি বিশ্বাস। ওরা যেখানটায় আছে জায়গাটা মেইন রোড ছাড়িয়ে বেশ আরেকটু সামনে। ইট বিছানো পায়ে চলা একটা পথ ধরে চলে গেছে সামনে। কয়েকটা গাছের ছোটো একটা জটলামতো পার হয়ে সামনে কয়েকটা গুদামঘর দেখা গেল। একটা পুরনো আমলের লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির সামনে বেশ কয়েকজনকে দেখা গেল দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ‘ওই কালা পাঞ্জাবিই কানা মাতবর, আমি যাইয়ার?’

‘আরে দাঁড়া,’ জটলাটা দেখিয়ে দিয়েই নচি বিশ্বাস মাইক্রো থেকে নামার জন্যে মাইক্রোর দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে ছিল কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে তার সাদা পোশাকের কলার ধরে ফেলল জালাল। ‘আগে নিশ্চিত অয়া নেই, ওইটাই আমাদের লোক।’

‘ইকবাল, ভালো করে দেখো তো এই লোকই কানা মাতবর কি না?’ তানভীর বলে উঠল।

‘মনে হচ্ছে স্যার,’ ইকবাল সামনের দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ‘জ্বি, স্যার ওটাই।’

‘বিচিরে, মানে নচিরে চেক করো, ওর কাছে থাকা মোবাইলটা রেখে দাও,’ তানভীর নির্দেশ দিল ইকবালকে। ‘তা-না হলে মোবাইলসহ এই ব্যাটাকে ছেড়ে দিলে ওদেরকে সাবধান করে দিতে পারে।’

‘হুজুর, মা-বাপের খিরা…’

‘এই চুপ,’ ইকবাল ধমকে উঠল। সে নচির লুঙ্গির কোঁচ থেকে তার বিরাট আকারের মোবাইল বের করে তানভীরকে দেখাল। ‘এটা তোমার কাছে রাখো। নচি, তুমি পরে একসময় থানায় গিয়ে ইকবালের কাছ থেকে ওটা নিয়ে যেও। আর এখন তুমি সিলেট শহর ছাড়বে না, যাও,’ বলতেই নচি একটানে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। তার হাঁটার গতি দেখলে যে কেউ ভাববে অতি সম্প্রতি সে অলিম্পিকে ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিতে যাচ্ছে।

‘জলদি চলো, কানা মাতবরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আচ্ছা এই কানা মাতবরের আসল নাম কি? আমরা তো আর তার সঙ্গে কথা বলার সময়ে কানা মাতবর বলে ডাকতে পারব না,’ তানভীর তাকিয়ে দেখল নচি হাওয়া হয়ে গেছে। তার কাছে জানতে চাইবার আর কোনো উপায় নেই।

‘স্যার, আমরা কি সোজা গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলব?’ ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে সুলতান জানতে চাইল।

‘নাহ, আগে আশপাশটা অবজার্ভ করে নিতে হবে,’ বলে ও আশপাশে দেখল। জায়গাটা খুবই নির্জন। ‘রসুল মিয়া সামনে যাও। ইকবাল ফোর্সে রিপোর্ট করেন, আমরা কোথায় আছি।’

ওদের মাইক্রো গাছের জটলা ছাড়িয়ে সামনে চলে এলো। এখন লোকগুলোকে আরো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

চারজন মানুষ। দুজন একেবারে যুবক আর দুজন বয়স্ক। বয়স্কদের ভেতরে একজন কালো পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পরা, লোকটা কথা বলতে বলতেই একপাশে মুখ ঘুরিয়ে পানের পিক ফেলল। অন্য লোকটা শার্ট-প্যান্ট পরা, চোখে চশমা। তার হাতে একটা ব্রিফকেইস। ‘কানা মাতবর আর তার ডান হাত, জালেম মোস্তফা,’ ওদেরকে দেখিয়ে বলে উঠল ইকবাল। ‘কানা মাতবর ক্যাডার হলে কী হবে সে অশিক্ষিত, তার সব হিসাব রাখে এই জালেম মোস্তফা। খুবই হারামি লোক। তার হারামিপনার জন্যেই মানুষে তাকে জালেম মোস্তফা ডাকে।’

‘রসুল মিয়া মাইক্রো আরো স্লো করো, ওরা বেশ খানিকটা এগিয়েছে এমন

সময় লোক চারজনের ভেতরে কম বয়স্ক দুজন কথা বলে হাত নেড়ে গুদামঘরের মতো দেখতে জায়গাটার ভেতরের দিকে চলে গেল। বাকি দুজন, মানে কানা মাতবর আর জালেম মোস্তফা দাঁড়িয়ে থাকা লাল গাড়িটায় গিয়ে উঠল।

‘স্যার, খিতা খরিয়ের?’ রসুল মিয়া জানতে চাইছে কী করবে এখন সে।

‘ধীরে-ধীরে এগোতে থাকো। যদি গাড়ি ঘুরিয়ে আমাদের এদিকে আসে তাহলেও এগোতেই থাকবে। আর যদি অন্যদিকে যায় তবে ধীরে-ধীরে অনুসরণ করবে,’ লোকগুলো হঠাৎ গাড়িতে ওঠাতে তানভীর একটু দ্বিধায় পড়ে গেছে। একবার জালালের দিকে দেখল। জালাল আস্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল।

‘লাল গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। ওরা দেখল সেটা ওদের দিকে না এসে বরং খানিকটা ঘুরে পায়ে চলা একটা পথ ধরে এগোতে শুরু করেছে। স্বস্তির একটা নিশ্বাস ছাড়ল তানভীর। ‘ধীরে-ধীরে অনুসরণ করো,’ রসুল মিয়াকে নির্দেশনা দিয়ে ইকবালের কাছে ও জানতে চাইল, ‘এদিকে সামনে কী আছে?’

‘সামনে তো মনে হয় সুরমা নদী,’ ইকবালের গলার স্বর শুনে বোঝা যাচ্ছে— সে নিশ্চিত নয়।

‘আরে ধূর, সুরমা নদী তো পেছনে ফেলে এলাম,’ মাইক্রোর সামনে থেকে সুলতান বলে উঠল।

‘হুম্, তাইতো,’ ইকবাল তার তিলের ওপরে আঙুল ঘষতে শুরু করেছে। মনে হয়—’ ইকবালের কথা শেষ হবার আগেই দূর থেকে দেখা গেল সামনের লাল গাড়িটা একটা ইটের দেয়ালের একপাশে নীল রঙের একটা গেটের সামনে থেমে গেল। ইটের দেয়ালের ওপাশে বেশ বড়ো ফ্যাক্টরি বা এরকম কিছু আছে। ওরা যেখান থেকে রওনা দিয়েছিল সেখান থেকে মাইলখানেকের মতো এগিয়ে এসেছে।

‘রসুল মিয়া গাড়ি থামান, সামনে ঝোপঝাড়ের মতো একটা জায়গা। নীল গেটের সামনে দাঁড়ানো গাড়ি থেকে লোকজন বেরিয়ে আসার আগেই মাইক্রোটাকে সেটার আড়ালে থামিয়ে ফেলার নির্দেশ দিল তানভীর।

লাল গাড়িটা থেকে মোবাইলে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো কালো পাঞ্জাবি পরা কানা মাতবর, তার পেছনে খোলা খাতায় কিছু একটা দেখতে দেখতে এগোচ্ছে জালেম মোস্তফা। দুজনেই নীল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। গেটের অন্যপাশে একদিকে ফ্যাক্টরির মতো অন্যদিকে দেয়ালের মতো দেখতে লাল ইটের একটা সুন্দর বাংলোবাড়ির খানিকটা দেখা যাচ্ছে। তানভীর অনুমান করল ওখানেই গিয়ে ঢুকেছে ওরা।

‘আমরা এখন কি করব?’ সুলতানের প্রশ্নের জবাব তানভীর এক মুহূর্ত ভেবে জবাব দিল, ‘অপেক্ষা, কারণ আমার মনে হয় না কানা মাতবররা খুব বেশি সময়ের জন্যে ওখানে গেছে। যদি তাই যেত তবে গাড়িটা গেটের ভেতরে ঢোকাত। যেহেতু ওরা গাড়ি গেটের বাইরে রেখে গেছে, তারমানে যে প্রয়োজনেই যাক ওরা দ্রুতই বেরিয়ে আসবে।’

‘তারপর কানা মাতবরের সঙ্গে কথা বলব কিভাবে?’ জালাল জানতে চাইল। ‘সেটাও ভেবেছি,’ তানভীর তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘কানা মাতবরের যে হাবভাব দেখলাম তাতে মনে হয় না তাকে স্বাভাবিক পন্থায় ধরে বা থানায় নিয়ে চাপ দিলে কোনো কাজ হবে। এই পথে ফেরার সময়েই তাকে আমরা এখানেই পাকরাও করব,’ বলে মৃদু হেসে উঠল তানভীর। ‘এরপর আমি ভরসা করছি জালাল ভাইয়ের ওপরে।’

তানভীরের দিকে এক মুহূর্ত অবিশ্বাসের সঙ্গে তাকিয়ে রইল জালাল, তারপর তার ঠোঁটে ফুটে উঠল সেই বেপরোয়া টিটকিরির হাসি, তাতে এবার সামান্য বন্ধুত্বের ছোঁয়া।

***

অন্যদিকে টমি পোদ্দারের মুখে ফুটে উঠেছে বত্রিশ ভোল্টের হাসি। কারণ আধা ঘণ্টা আগেও তার কাছে যা অসম্ভব মনে হচ্ছিল তা এখন অনেকটাই সম্ভব মনে হচ্ছে মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারের কারণে। মোবাইলের টাওয়ারের সামনে ম্যানটেইনেন্স ভ্যানটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওটাতে খোঁজ করে সে জানতে পারে মোবাইল টাওয়ারের স্টেশনে বসানো একাধিক ক্যামরার মধ্যে কয়েকটা ক্যামেরা প্যানারোমা অর্থাৎ তিন শ ষাট ডিগ্রি ক্যামেরা, এই ক্যামেরাগুলোতে খুঁজে দেখলে হয়তো কোনো না কোনো ক্যামেরাতে হেকমত আবদুল্লার বাড়ির সামনের অংশের ভিউ পাওয়া যেতে পারে।

টাওয়ারের দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলে মোবাইল কোম্পানির অফিস থেকে অনুমতি নিয়ে ক্যামরাগুলোর ভিউ দেখতে বসেছে টমি আর ফরেনসিকের একজন অফিসার। মোট চারটা ক্যামেরা তার মধ্যে দুটো প্যানারোমা ভিউ ক্যাপচার করে। ‘আপনি ওই দুটো ক্যামেরার ফুটেজ চেক করেন। আমি এই তিনটে দেখছি,’ বলে সে ফরেনসিকের লোকটাকে সম্ভাব্য সময় আর ফুটেজগুলো বুঝিয়ে দিয়ে নিজের ফুটেজগুলো নিয়ে বসল। ভিডিওগুলো চলে যাচ্ছে একটার পর একটা, আধা ঘণ্টা ধরে দেখতে দেখতে প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছে এমন সময় ফরেনসিকের লোকটা হঠাৎ বলে উঠল, ‘স্যার, এই গাড়িটা দেখেন। হেকমত আবদুল্লার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে।’

অনেক দূর থেকে দেখা গেল একটা লাল গাড়ি বেরিয়ে এলো হেকমত আবদুল্লার বাড়ি থেকে। মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারের ক্যামেরা বলেই এতদূর থেকে দেখা যাচ্ছে, কোনো সাধারণ সিসি টিভি হলে কিছুই বোঝা যেত না। গাড়িটা বেরিয়ে উলটো দিকে রওনা দিয়ে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের বাইরে চলে গেল।

‘এটা অন্য ক্যামেরাতে পাওয়া যেতে পারে,’ বলেই এতক্ষণ নিজে যেগুলো চেক করছিল সেটার মনিটরের সামনে চলে এলো। বেশ কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করার পর একটা ক্যামেরাতে গাড়িটার এক পাশের সাইড ভিউ চোখে পড়ল। নির্দিষ্ট সময়ের ফুটেজটা কপি করে নিজেদের ল্যাপটপে নেয়ার পর, ফুটেজের নির্দিষ্ট জায়গার ইমেজ নিয়ে ফিল্টার করার পর ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা একজনের চেহারা মোটামুটি পরিষ্কার বোঝা গেল। চেহারাটা দেখামাত্রই একটা শিস দিয়ে উঠল টমি।

দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডে ফরেনসিকের ওপর পড়ালেখা করার সময়ে টমির একটা কোর্স ছিল পৃথিবীর সব মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনালদের কেস স্টাডির ওপরে। সেখান থেকে সে জানতে পারে পৃথিবীর সেরা অ্যান্টিক থিফদের একটা চক্রের ব্যাপারে, যে-চক্রের প্রধানের নাম ‘জেড মাস্টার’। ইমেজটা দেখামাত্রই টমির মনে পড়ে গেল সেই জেড মাস্টারের কথা।

চট করে সে মোবাইলটা হাতে তুলে নিল সে। তানভীর আর সুলতানদের সাবধান করে দিতে হবে। তারা জানেও না কিসের ভেতরে হাত দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *