প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ২২

অধ্যায় বাইশ – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
যজ্ঞবাবার ডেরা, কন্নোর, ভারতবর্ষ

কারো মৃত্যু অবলোকন করা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। এ মুহূর্তে সেটাই করতে হচ্ছে শামানদের।

দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মানুষটাকে ভালোভাবে শুইয়ে দিল শামান। বিধু এগিয়ে এসে লোকটার পিঠ থেকে টান দিয়ে একটা তির খুলে নিল। ‘এ কেমন তির,’ ছোটো আকারের কালো তিরটা ওদের ব্যবহৃত তির থেকে একেবারেই আলাদা।

বিধুর কথাকে পাত্তা না দিয়ে কালন্তির দিকে ফিরে শামান জানতে চাইল, ‘কে এই লোকটা? তোমরা চিনতে?’

‘হ্যাঁ,’ কালন্তিকে কেমন জানি বিহ্বল দেখাচ্ছে। সে একবার শামানকে দেখল সেই সঙ্গে যজ্ঞবাবার ডেরার দিকে দেখল। যজ্ঞবাবার খাস লোক ও। আমরা যতবার এখানে কোনো না কোনো প্রয়োজনে এসেছি প্রতিবার এই লোকটাই আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে আসত।’

বিধু আর ঘোষিতরাম কিছু একটা বলছিল, ওদেরকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল শামান। উঠে দাঁড়িয়েই খাপ থেকে বের করে আনল কাতানা। ‘সবাই সাবধান, ঘোড়াগুলোকে এখানেই রেখে আমরা সামনে এগোব,’ বলে ও যজ্ঞবাবার ডেরার দিকে দেখাল। ‘ওখানে আসলে কী ঘটেছে এখনো জানি না আমরা। কাজেই খুবই সাবধানে এগোবে সবাই। আমি দলের মাঝখানে অবস্থান করব। আমার সর্ববামে থাকবে তিরন্দাজ জাথুরিয়া, আর সর্বডানে বিধু,’ দুই তিরন্দাজকে দলের দুই পাশে রেখে বাকিদের অবস্থান বুঝিয়ে দিয়ে ওরা ধীর পায়ে সাবধানে এগোতে লাগল সামনের দিকে।

ডেরার আরেকটু কাছাকাছি আসতেই ওরা পরিষ্কার দেখতে পেল ডেরার এখানে ওখানে ছোটোখাটো ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন, দুয়েকটা পোড়া জায়গা থেকে ধোঁয়াও উঠতে দেখা গেল। কিন্তু কোথাও কোনো মানুষ নেই।

‘ব্যাপার কি, কোনো মানুষ নাই কেরে?’ ওদের ডান থেকে বিধু বলে উঠল।

‘কথা কম। কালন্তি, যজ্ঞবাবার ঘর কোনোটা?’ শামান জিজ্ঞেস করতেই কিছু না বলে ডেরার মাঝামাঝি ঘরের সারির ভেতরে একটা বড়ো ঘরের দিকে নির্দেশ করল কালন্তি।

‘যেভাবে বলেছি সেভাবে,’ বলে দলের সবাইকে একবার দেখে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে শুরু করল শামান। বাকিরা ওর দুই পাশে, একজনের থেকে আরেকজন খানিকটা পিছিয়ে, একে অপরের দিকে নজর রাখছে, যাতে বিপদ ঘটলে সাহায্য করতে পারে। ওরা তিনটে বাড়ির মাঝখানের অপেক্ষাকৃত বড়ো বাড়িটার দেউরি পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করল, এটা আসলে ঘরের আদলে বানানো খোলা একটা মন্দির। ওরা বড়ো কামরাটা পার হয়ে পেছনে চলে এলো। যত এগোচ্ছে বাড়ির ভেতরের দিকে, পেছন থেকে জলধারার কুল কুল শব্দ ভেসে আসছে।

বড়ো কামরাটা পার হয়ে বাড়ির পেছনে চলে এলো ওরা। এখানে বড়ো একটা বেদির ওপরে কিম্ভুত দেখতে একটা মূর্তি, সেটার পাদদেশে ফুল আর অর্ঘ্য সাজানো। ‘গোমুখী, আনমনেই বলে উঠল জাথুরিয়া। যজ্ঞবাবা তাহলে গোমুখী দেবীর পূজারি ছিল,’ জাথুরিয়ার দিকে কেউই খেয়াল করল না বরং বেদির নিচের লাল রঙের পাটতন ততোধিক লাল করে দিয়ে তার ওপরে পড়ে আছে প্রায় উলঙ্গ দেখতে খাটো চুল আর লম্বা দাড়িওয়ালা একজন মানুষ।

তাকে দেখেই অস্ফুট শব্দ করে সেদিকে এগিয়ে গেল কালন্তি। ‘যজ্ঞবাবা,’ পাটাতনের ওপরে পড়ে থাকা মানুষটাকে সোজা করে শুইয়ে দিল সে। শামান পায়ে পায়ে এড়িয়ে গেল সেদিকে। নিজের কাতানা খাপে ঢুকিয়ে বসে পড়ল মানুষটার কাছে। বয়স্ক মোটাসোটা একজন মানুষ কপালে তিলক আঁকা। মানুষটাকে ইচ্ছেমতো প্রহার করা হয়েছে। নাক-মুখ তো বটেই শরীরের অনেক জায়গায় বড়ো বড়ো ক্ষতচিহ্ন। এরকম ক্ষত নিয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।

‘কেউ একজন পানি নিয়ে এসো,’ রীতিমতো চিৎকার করে উঠল কালন্তি। যজ্ঞবাবার নাকের কাছে আঙুল নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল শামান। পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও ওর কাছে মনে হলো বেঁচে নেই মানুষটা। ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটা নারকেলের মালায় করে পানি নিয়ে এলো ধোয়ী। নাকে-মুখে পানি ছিটিয়ে দিল কালন্তি। পরপর কয়েকবার পানি ছিটানো হলেও কোনো কাজ হলো না। কালন্তি বারবার পানি ছিটিয়ে দিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছে এমন সময় শামান দেখল বাবার বুকের ডানপাশে কিছু একটা আটকে আছে। বুকের কাছের কাপড় সরিয়ে দেখল ছোটো একটা চাকুর মতো কিছু বিঁধে আছে ওখানে। একটা হাত বাবার বুকের ওপরে রেখে অন্য হাতে একটানে বের করে আনল জিনিসটা।

ও ভুল ভেবেছিল, জিনিসটা আসলে চাকু না, ছোটো একটা গোল চাতকির মতো। সেটার চারপাশে খাঁজ কাটা। জিনিসটা থেকে রক্ত মুছে নিয়ে ভালোভাবে দেখবে তার আগেই খক খক করে কেশে উঠল বাবা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার মাথাটা তুলে ধরল কালন্তি। বাবা চোখ মেলে ওকে দেখল, চিনতে পেরেছে কি না বোঝা গেল না। বারবার নাম ধরে তাকে ডাকতে লাগল কালন্তি। আনমনেই বিড় বিড় করে উঠল বাবা।

সে কী বলছে শোনার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেও পুরোপুরি বুঝতে পারল না কালন্তি। বাবাকে আরেকবার পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করতেই সে সামনের দিকে একটা হাত তুলে দেখাল। তারপর বেশ জোরেই বলে উঠল।

কাল বাদে পরশু।

উপস্থিত সবাই শুনেছে কথাটা। কালন্তিই বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে জানতে চাইল, ‘কাল বাদে পরশু কি?’

বিড় বিড় করতে-করতেই মাথাটা ঢলে পড়ল তার। বিহ্বলের মতো একে অপরকে দেখল শামান আর কালন্তি। ‘কাল বাদে পরশু কি?’ এবার শামান জানতে চাইল, কিন্তু জবাব না দিয়ে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে রইল কালন্তি। ‘ওটা কি তোমার হাতে?’

‘এটা যজ্ঞবাবার বুকে বিঁধে ছিল,’ বলে জিনিসটা এগিয়ে দিল ও মেয়েটার দিকে। গোল চাকতিটার মাঝখানে একটা চিহ্ন আঁকা, দুটো চোখের মতো, তার নিচে বাঁকা দুটো চোখা দাঁত। ‘এটাতো সাপের মুখ মনে হচ্ছে,’ আনমনেই বলে উঠল শামান।

‘দেখি দেখি,’ বলে ওদের দিকে এগিয়ে এলো বিধূ। তার হাতে ধরা সেই ছোটো কালো তিরটা। সেটা সে এগিয়ে দিল কালন্তির দিকে। ওটার কাঠের মসৃণ গায়েও একই চিহ্ন আঁকা। জিনিসটা দেখে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কালন্তি। সঙ্গে সঙ্গে ডাক দিল ধোয়ী আর ঘোষিতকে। দুজনকেই জিনিসটা দেখিয়ে প্রশ্ন করল, ‘বুঝতে পেরেছো কিছু?

‘উরগ, এইটা তো উরগদের চিহ্ন, ওরা এইখানে আসবে কোত্থেকে?’ ধোয়ীকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে হঠাৎ।

‘হচ্ছেটা কি এখানে? কথা পরিষ্কার না করলে কিভাবে হবে?’ শামান রাগের সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। ওদের এই ফুসুর ফুসুর কথা ওর ভালো লাগছে না।

শামান, এই চাকতি আর তীরের গায়ে, উরগদের চিহ্ন আঁকা,’ কালন্তিকে দেখে মনে হচ্ছে সেও খুব দ্বিধায় ভুগছে।

কালন্তির শেষ কথাটা শুনে ওদের দিকে এক পা এগিয়ে এলো জাম্বুরিয়া। ‘তারমানে রাস্তার ওপরে অন্য দলটা আসলে লিচ্ছবীদের ভিন্ন কোনো গোত্র ছিল না বরং…’

‘তো কি হয়েছে, এই উরগ কারা?’ শামান অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘উরগ বা উরঙ্গও বলা হয় এগোরে,’ ঘোষিত বলে উঠল। ‘এরা সাপের দেবীর পূজা করে। এরা খুব ভয়ংকর। আমরা জানতাম উরগরা দুনিয়া থাইক্কা হারায়া গেছে বহুত আগে। তাইলে এইহানে এই চিহ্ন ক্যান?’

যদি উরগরা এখানে এসে থাকে তবে—’ কথা শেষ না করে কালন্তি ছুটে গেল বাবার দিকে। বাবাকে উল্টে দিয়ে একটানে ছিঁড়ে ফেলল পিঠের পোশাক। মানুষটার সাদা পিঠের চামড়া পুড়িয়ে বিরাট একটা সাপের মাথা আঁকা হয়েছে।

‘উরগরা এইহানেই আছে, এহনো,’ হঠাৎ ধোয়ী ঘোষণার মতো বলে উঠল। ‘পথের ওপরে পায়ের ছাপ দেইহা আমার কেমন জানি উল্টাপাল্টা লাগতাছিল। এহন বুজতাছি আসলে আইছিল তিনদল ফিইরা গেছে দুই দল। ওরা এইহানেই আছে,’ বলে সে একটানে বের করে আনল নিজের তলোয়ার। ‘সবাই সাবধান।’

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। শামান এগিয়ে গেল তার দিকে। ‘ধোয়ী তুমি কি নিশ্চিত?’

ওর প্রশ্নের জবাবে সে তলোয়ার উঠিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই কিছু একটা ছুটে এসে বিচিত্র শব্দ তুলে বিঁধে গেল শামানের পিঠে। শামানের মনে হলো হঠাৎ ওর পিঠে জোরে কিল মেরেছে কেউ। বুঝে ওঠার আগেই দেখল সবাই তাকিয়ে আছে ওর পিঠের দিকে। একটা হাত দিয়ে টান দিয়ে জিনিসটা পিঠের বর্মের মতো বোনা লোহার জালের ওপর থেকে খুলে আনতেই দেখল ছোটো একটা তির। সঙ্গে সঙ্গে ও বুঝতে পারল আসলে কী ঘটছে। ও সাবধান করে দেবার আগেই আশপাশে আরো কয়েকটা তির বিঁধে গেল।

চিৎকার করে সবাইকে সাবধান করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল ও আর কালন্তি। দুজনেই কয়েক গড়ান দিয়ে সেই মূর্তির বেদির আড়ালে চলে এলো। শামানের চোখের দিকে তাকিয়ে কালন্তি বলে উঠল, ‘আমরা ফাঁদে পড়ে গেছি।’

প্রথমবারের মতো কালন্তির পরিবর্তে রাগ দেখাল শামান।

বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে ও বলে উঠল, ‘সেটা না বললেও চলবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *