প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৪৯

অধ্যায় উনপঞ্চাশ – বর্তমান সময়
সুরমা নদীর ওপরে, সিলেট

কানের সঙ্গে লাগানো ঘড়ির ব্যাটারির মতো দেখতে কমিউনিকেশন ডিভাইসটার একদিকে চাপ দিয়ে ওটাকে চালু করতেই খুবই সামান্য প্রায় চোখে দেখা যায় না-এরকম একটা আলো জ্বলে উঠল। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে যেন চুল ঠিক করছে এমনভাবে জিনিসটা কানে পরে নিল সুলতান।

ওর দিকে তাকিয়ে থাকা এক বয়স্ক মুরুব্বির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে নিজের ব্লেজারের ওপরের দুটো বাটন বন্ধ করে দিল ও। কোনোভাবেই ওর বিকট দর্শন দুই পিস্তলের একটা কারো চোখে পড়লেই হলো, নরক নেমে আসবে লঞ্চে।

পকেট থেকে মোবাইল বের করে যেন ওটাতেই কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে মোবাইলটা কানের পাশে লাগিয়ে কথা বলতে লাগল ও। বারকয়েক চেষ্টা করে কোনো সাড়া না পেয়ে কানের ডিভাইটা সে হাতের আড়াল করে আবার বের করে আনল। ব্যাপার কি, হেড সেটটা কি কাজ করছে না, নাকি উচ্চ শব্দের কারণে সে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। ও আশপাশে তাকাল।

এই মুহূর্তে সে অবস্থান করছে লঞ্চটার দ্বিতীয় ডেকে। তানভীর নির্দেশ দেয়া মাত্রই যেন খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে দৌড়ে আসছে এমন একটা ভাব করে লঞ্চ ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে লঞ্চে উঠে এসেছে সে। উঠেই নিচের ডেকে আড়াল না পাওয়াতে চলে এসেছে লঞ্চের দ্বিতীয় তলায়। এখানে অনেক লোকজন বসে আছে, চেয়ারে লঞ্চের ডেকে ইত্যাদি ইত্যাদি জায়গায়। উচ্চ শব্দের সঙ্গে বাজছে হিন্দি সিনেমার গান।

লঞ্চটার বিভিন্ন দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছে সুলতান। সেইসঙ্গে মনে মনে এটার মালিকের রুচির প্রশংসা করেছে ও। কারণ লঞ্চটা একেবারেই সাধারণ লঞ্চ, আকারেও খুব একটা বড়ো না কিন্তু সাজানো হয়েছে খুব সুন্দর করে। ভেতরটা দেখলে মনে হবে কোনো দামি কমিউনিটি সেন্টার কিংবা ফাইভ স্টার হোটেলের ভেতরে চলে এসেছে।

দ্বিতীয় তলায় শব্দের অত্যাচার থেকে বাঁচতে ওপরের তিন নম্বর ডেকে চলে এলো সুলতান। এখানেই হলুদের মূল অনুষ্ঠান সঞ্চালিত হবে মনে হচ্ছে কিন্তু এখনো প্রস্তুতি পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। রেস্টুরেন্টের মতো বসার সারি দেয়া চেয়ারের সামনে বিরাট আকারের একটা স্টেজ বানানো হয়েছে, সেটাকে এখন মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ফুল দিয়ে। কাজ প্রায় শেষের দিকে।

এই জায়গাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন দেখে কানে পরানো হেড সেটটা আবারো খুলে ভালোভাবে কানে লাগাল ও। এবারও কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে মনে মনে গালি দিয়ে উঠল ও। ব্যাপার কি, কেউ সাড়া দিচ্ছে না, নাকি মেশিন কাজ করছে না, বুঝতে পারছে না ও। আবারো জিনিসটাকে বের করে আনবে কি না ভাবছে তার আগেই পাশ থেকে বেশ ভারী একটা গলা বলে উঠল, ‘আফনে কেডায় আইয়ার? আফনেরে তো চিনতায় ফারিয়ের না?’

সুলতান পাশ ফিরে দেখল মুরুব্বি কিসিমের দেখতে বয়স্ক এক লোক ওকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা বলেছে। কিন্তু লোকটা একেবারে খাস সিলেটি ডায়লেক্টে কথা বলায় কিছুই বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে রইল ও।

***

রেলিং চেপে ধরা হাতটা পিছলে যেতেই এক টানে প্রায় ফুটখানেক নিচে নেমে গেল তানভীর। পা দিয়ে শরীরটা আটকানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না। সোজা ধেয়ে চলল নিচের দিকে। যেই মুহূর্তে ও ভাবছে আর কিছুই করার নেই হঠাৎ ওর শরীরটা আটকে গেল।

মাথা তুলে দেখল লঞ্চের রেলিংয়ের ওপরে ঝুঁকে ওর লেদার জ্যাকেটের কলার ধরে ফেলেছে জালাল। কিন্তু ধরে রাখতে পারবে না, জালালের হাতটা পিছলে যাবার আগেই রেলিংয়ের সামান্য ওপরে পা-টাকে একটুখানি বাঁধিয়ে ওপরের দিকে ঠেলা দিল তানভীর নিজের শরীরটাকে, সেইসঙ্গে জালাল যতটা পারল টান দিল ওকে। শরীরটা একটু উঁচু হতেই খপ করে একটা রেলিং ধরে ফেলল ও। আরো একটু উঁচু হতেই জালালের জন্যে খানিকটা সুবিধে হলো, জোরে টান দিল সে। এবার পা দিয়ে রেলিংয়ের নাগাল পেতেই তানভীর শরীরটাকে টেনে নিয়ে এলো রেলিঙের ওপরে, তারপর দুজনেই গড়িয়ে পড়ে গেল ডেকে।

প্রাণপণে হাঁপাচ্ছে। ‘ওই মিয়া, ছোটোবেলায় তোমগো স্কুলে লং জাম্প আছিল না? আটু হইলে তো—’

‘ছিল দেখেই তো বেঁচে গেলাম আজ, তানভীর উঠে বসল। অনেক কাজ পড়ে আছে।

‘তাইলে মনে অয় দৌড়ের কোনো খেলা ছিল না,’ তানভীরের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে উঠে বসলো জালাল। বাপরে, বিড়ি খাইতে খাইতে শ্যাষ আমি। একটু কিছু করলেই জান বের হয়ে যায়।

‘জালাল ভাই, চলো। কপাল ভালো, লঞ্চের পেছনে কেউ ছিল না, না হলে,’ পকেট থেকে হেডসেট বের করে কানে লাগাতে লাগাতে বলতে লাগল তানভীর। ‘মনে হয় সবাই সামনের দিকে অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত।’

জালাল উঠে দাঁড়িয়ে তার কোটের ভেতর থেকে অস্ত্র বের করার জন্যে হাত দিতেই তানভীর তার হাতটা ধরে ফেলল। ‘মনে নেই? কোনো অবস্থাতেই অস্ত্র বের করা যাবে না। এমনিতেই পাবলিক বলয়ের ভেতরে আছি, তার ওপরে একবার প্যানিক ছড়ালে উপায় থাকবে না আর। হ্যালো, হ্যালো,’ হেডসেটে সুলতানের সাথ যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগল ও।

ওপাশ থেকে সুলতানের অস্থির গলা ভেসে আসতেই স্বস্তির একটা পরশ, বয়ে গেল তানভীরের শরীরে। হ্যালো সুলতান, তুমি ঠিক ঠাক উঠতে পেরেছো?… গুড, আমরা লঞ্চের পেছন দিকে আছি। এক কাজ করো, তুমি কোনো ফ্লোরে আছো এখন?’

সুলতান জবাব দিতেই ও বলে উঠল ভেরি গুড, তুমি তৃতীয় ডেক থেকে সার্চ শুরু করবে, প্রথমে তৃতীয় ডেক পুরোটা সার্চ করবে, তারপর দ্বিতীয়টাতে নামবে, নিচেরটা আমরা দেখছি,’ বলেই আবারো মনে করিয়ে দিল। ‘মনে আছে তো, অস্ত্ৰ বের করবে না, খুব সাবধানে সহজাত ভঙ্গিতে চলাচল করো। এমনভাবে মুভ করো যেন গেস্ট, কেউ কিছু জানতে চাইলে বলবে ওয়াশরুম খুঁজছো। ওকে,’ বলেই ও জালালকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল।

‘জালাল ভাই, নিচের ডেকটাই সবচেয়ে বড়ো, কাজেই আমি আপনি এটাই থরোলি চেক করব। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ওই ব্যাটারা থাকলে নিচের ডেকেই আছে। আপনি ডান দিক দিয়ে দেখেন আমি বাঁ দিক দিয়ে দেখছি।’

জালাল মাথা নেড়ে সায় জানাতেই দুজন দুদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তানভীর চলে এলো পেছনের ডেকের একেবারে ডান দিকে।

লঞ্চটাতে হালকা চালে একবার চোখ বুলিয়ে তানভীর মনে মনে বলতে বাধ্য হলো লঞ্চের ভেতরের ডেকোরেশন অসাধারণ। বাম দিকে এগিয়ে কন্ট্রোলরুমের কাছে চলে এলো। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল ভেতরে দুজন মেকানিক কাজ করছে। একজন মেকানিক গজ গজ করে কী যেন বলছে অন্যজন আরো রাগের সঙ্গে চেঁচিয়ে জবাব দিল। কিন্তু দুজনের কারো কথাই ইঞ্জিনের শব্দের কারণে বুঝতে পারল না ও।

ওখান থেকে সরে এসে রওনা দিল নিচের ফ্লোরের সামনের অংশে।

***

মুরুব্বি লোকটাকে দেখে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল সুলতান। লোকটা আবারো তড়-বড়ো করে কী জানি বলছে কিছুই বুঝতে পারল না ও। লোকটা কি বলছে মাথায় ঢুকছে না। আচমকাই ওর চোখ চলে গেল স্টেজের দিকে, সেখানে ফুলের ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে বড়ো করে লেখা হয়েছে ‘হলুদ সন্ধ্যা’ তার ঠিক নিচেই একটা ছেলে আর একটা মেয়ের হৃদয় আকৃতির ছবি লাগানো হয়েছে। মেয়েটার ছবির নিচে তার নাম লেখা কনি।

‘চাচা আমি কনির বা…’ বলেই আটকে গেল ও। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে ওর চেয়ে অনেক ছোটো হবে, তাই বান্ধবি বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে বলে উঠল। ‘আমি কনির বড়ো বোন, ঢাকা থেকে এসেছি।’

‘ঢাকা খনে?’ বলে লোকটা খুবই অবাক হয়ে ফিরে তাকাল আরেকজনের দিকে। ‘কনি তো জিন্দেগিতেও ঢাকাত…’

‘আরে চাচা আজকাল কি বন্ধু বড়ো বোন এসব সরাসরি হয় নাকি? আমি কনির ফেসবুক বড়ো বোন,’ বলেই আর অপেক্ষা না করে চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে রওনা দিলে ডেকের ভেতরের দিকে

পেছনে শুনতে পেল চাচা অন্য লোকটার কাছে জানতে চাইছে, ‘কিয়ের বুক?’ অন্য লোকটা মনে হয় তাকে কিছু একটা বুঝিয়ে বলল, শুনে চাচা বলতে লাগল, ‘খিতা যে হুনিয়ের সময়ের লগে!’ দুজনেই এই বিষয়ে জরুরি আলোচনা শুরু করে দিল।

সুলতান ওদের কাছ থেকে বেশ অনেকটাই দূরে সরে এসেছে এমন সময় খর খর করে উঠল ওর কানের হেডসেট। ‘হ্যালো, হ্যালো, কমান্ডার,’ অস্থির হয়ে বলতে লাগল ও। বিপরীত পাশ থেকে তানভীরের গলা ভেসে আসতেই স্বস্তির পশলা বয়ে গেল ওর শরীরে। ‘কমান্ডার, আপনারা ঠিক আছেন? এত দেরি হলো… আচ্ছা… আমি তৃতীয় ডেকে আছি… ঠিক আছে… আমি এই দুটো ডেক চেক করে দেখছি,’ বলে ও অন্যপাশের কথা শুনতে লাগল। ‘মনে থাকবে কমান্ডার, কোনো অস্ত্র প্রদর্শন করব না, চাল-চলন স্বাভাবিক রাখব, আর সন্দেহজনক কিছু পেলে সবার আগে আপনাকে জানাব। ওকে, শেষের কথাগুলো মুখের কাছে হাত চাপা দিয়ে বলল ও যাতে কারো কানে না যায়। কথা শেষ করে ও পুরো ডেকটাতে চোখ বুলাল একবার।

নিচের ডেকটা মনে হয় সবচেয়ে বড়ো, দ্বিতীয় ডেকটা তারচেয়ে ছোটো, আর সবার ওপরের ডেকটা সবচেয়ে ছোটো। রেস্টুরেন্টের মতো খানিকটা জায়গা সাজানো হয়েছে, ছোটো একটা মঞ্চের মতো আর খাবার সার্ভ করার ব্যবস্থা, এই হলো তৃতীয় ডেক। এক চক্কর দিতেই এই ডেক পরীক্ষা করা শেষ হয়ে গেল।

প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে সুলতান নেমে এলো নিচের দিকে। এই ডেকটা দুই ভাগে ভাগ করা। একদিকে যাত্রীদের থাকার জন্যে ছোটো ছোটো কয়েকটা কেবিন, অন্যদিকে লাউঞ্জের মতো বসার ব্যবস্থা। লাউঞ্জটাতে একটা চক্কর দিয়ে সুলতান চলে এলো ছোটো ছোটো কেবিনগুলোর সামনে। বেশির ভাগ কেবিনই বন্ধ। দুটো কেবিনের দরজা খোলা দেখে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে মনে হলো বিয়ে বাড়ির লোকজনই ওগুলোর ভেতরে সাজগোজ মেহেদি লাগানো এসব নিয়ে ব্যস্ত। বাকি তিনটে কেবিনের সামনে এসে দেখল দরজার নিচ দিয়ে কোনো আলো আসছে না। তারমানে ওগুলোর ভেতরে কেউই নেই। তবু প্রতিটা কেবিনের সামনে কিছুক্ষণ অবস্থান করে বোঝার চেষ্টা করল ভেতরে কোনো সাড়া-শব্দ আছে কি না। কিন্তু কোনো শব্দ না পেয়ে বুঝল ওগুলোর ভেতরে আসলে কেউই নেই।

কেবিনগুলো চেক করে চলে এলো ডেকের পেছন দিকে। কমান্ডার, দুটো ডেকই পরীক্ষা করে দেখলাম কিন্তু কোনোটাতেই সন্দেহজনক কিছু নেই,’ সুলতান একটু হতাশ হয়েই তানভীরকে রিপোর্ট করল। ‘ঠিক আছে কমান্ডার, আমি এখানেই অবস্থান করছি। আপনারা নিচের ডেক পুরোটা পরীক্ষা করে ওপরে চলে আসুন তারপর আমরা পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিব আসলে কী করা যায়।

তানভীরের সঙ্গে কথা শেষ করে সুলতান ডেকের দিকে ফিরে তাকাল। ওদের লঞ্চ সিলেট শহর ছাড়িয়ে গভীর নদীর দিকে চলে এসেছে। এখনো শহরের আলো দেখা যাচ্ছে সুরমা নদীর দু পাশে তবে কমে এসেছে অনেক। ডেকের সামনের অংশ থেকে ভেসে আসছে হই-হুল্লোড়ের শব্দ, তারমানে মূল অনুষ্ঠান মনে হয় শুরু হয়ে গেছে। ডেকের ওপরে দাঁড়িয়ে পানির দিকে ফিরে তাকাল। আলো ঝলমলে লঞ্চটা পানি কেটে এগিয়ে চলেছে, আশপাশের কোথাও থেকে সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। হঠাৎ সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়ে বসল ওর। ব্লেজারের পকেট থেকে সিগারেটে প্যাকেট আর লাইটার বের করে ঠোঁটে লাগাল সুলতান। লাইটার দিয়ে ধরাতে গিয়ে কয়েকবার খস খস করল কিন্তু আগুন ধরল না।

বিরক্ত হয়ে লাইটারটা পকেটে রেখে সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ কোথা থেকে আসছে সেদিকে এগোল। ডেকের একেবারে কিনারায় আরেকটা ছোট্ট কেবিনের মতো। দরজাটা সামান্য খোলা, সেটার ভেতর থেকে ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। মনে মনে সুলতান ভাবল এই কামরাটা তো আগে চোখে পড়েনি। ওটার দিকে এগিয়ে যেতেই ভেতর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরটা শুনে একটু চমকে উঠল ও। আরো ভালোভাবে শোনার জন্যে কান পাতল। কথাগুলো শুনতে শুনতে প্ৰথমেই মনে হলো কমান্ডারকে জানাতে হবে।

কিন্তু কিছু করার আগেই ধাম করে দরজাটা খুলে গেল, দরজায় দেখা গেল দুজন মানুষ। একজনের পরনে গ্যাবার্ডিন প্যান্ট আর ফতুয়া, অন্যজনের পরনে হাফ-হাতা শার্ট আর লুঙ্গি। এই দুজনই কথা বলছিল। সুলতানকে দরজার ওপর প্রায় ঝুঁকে থাকতে দেখে একজন ধমকে উঠল, ‘এই, এইনে কি?’

সুলতান একটু আমতা আমতা করে জবাব দিল যে সে ওয়াশ রুম খুঁজছিল। দুজনেই একে অপরের দিকে দেখল। বোঝাই যাচ্ছে, দুজনার একজনও ওর কথা বিশ্বাস করেনি। গ্যাবার্ডিন প্যান্ট লুঙ্গিওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘ধরের এইয়ারে।’

লোকটার কথা কানে যেতেই সুলতানের একটা হাত চলে গেছিল ব্লেজারের ভেতরে থাকা পিস্তলের বাটের ওপরে, কিন্তু ওটা বের করে আনার আগেই ধপ করে নিভে গেল পুরো লঞ্চের সব আলো। সেইসঙ্গে তীব্র কট কট শব্দের সঙ্গে থেমে গেল ইঞ্জিন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডেকের ওপরে গড়িয়ে পড়ে গেল সুলতান। ওর গায়ের ওপরে এসে পড়ল লোক দুজনার একজন।

***

অন্যদিকে তানভীর আর জালাল পড়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে।

নিজেদের ভেতরে কথা শেষ হতেই জালাল আর তানভীর ছড়িয়ে পড়েছে দুইদিকে। ইঞ্জিন রুম পার হয়ে তানভীর চলে এলো নিচের ডেকের মাঝামাঝি। এই ডেকের বেশির ভাগ অংশই লঞ্চের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সামনের দিকে অনুষ্ঠানের আয়োজক আর যাত্রীদের জন্যে রিসিপশন ও বসার জন্যে লাউঞ্জের মতো আছে। ইঞ্জিন, পাওয়ার কন্ট্রোল, স্টোররুম, কিচেন সবই নিচের ডেকে অবস্থিত। ইঞ্জিন রুম পার হয়ে তানভীর চলে এলো কিচেনে। সেখানে জানালা দিয়ে দেখল প্রচুর ব্যস্ততার সঙ্গে শেফ থেকে শুরু করে বাবুর্চিরা কাজ করছে। কিচেন পার হয়ে লাউঞ্জের কাছাকাছি এসে থেমে গেল। ও যে অংশ চেক করছে সেখানে সন্দেহজনক কিছুই পায়নি। ও লাউঞ্জের কাছাকাছি এসে দেখল জালাল এরমধ্যেই লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে আছে।

‘জালাল ভাই,’ মৃদু স্বরে ডাক দিল ও। ওকে দেখে এদিকে ফিরে তাকাল জালাল। ‘কি ব্যাপার, তুমিও চলে এসেছো। কিছু পেয়েছো?’

মাথা নেড়ে না বলল তানভীর। ‘কিছুই তো পেলাম না। আপনি?’ জালাল পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এনেছে। ‘একটা ইন্দুরও নাই এই লঞ্চে। চলো পেছন দিকে যাইয়া বিড়ি খাইয়া মাথা ঠান্ডা করতে হবে।’

এমন সময় হেডসেটে সুলতান কথা বলে উঠল। ওর সঙ্গে কথা শেষ করে জালালের দিকে তাকিয়ে তানভীর হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল, সুলতানও কিছু পায়নি। আমরা কি ভুল করলাম, জালাল ভাই?’

‘কিছুই তো বুঝতাছি না, সুলতান কই?’

‘সুলতান ওপরে দ্বিতীয় ডেকে আছে,’ বলে একটু ভেবে জালালকে বলল ও। ‘এক কাজ করি চলেন পেছন দিকে না গিয়ে ওপরে দ্বিতীয় ডেকে চলে যাই।

ওইখানে গিয়ে তিনজনে মিলে পরামর্শ করে পরবর্তী কী করব সেটা ঠিক করতে হবে। কি বলেন?’

‘আমারও মনে হয় সেইটাই ভালো হবে,’ বলে জালাল হাঁটতে শুরু করল। ওকে অনুসরণ করল তানভীর। ‘যেহেতু আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়নি কাজেই নতুন করো—’ জালাল কথা শেষ করার আগেই ধপ করে পুরো লঞ্চের আলো নিভে গেল। ‘কি ব্যাপার-’ তানভীর কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ তীব্র শব্দের সঙ্গে থেমে যেতে লাগল লঞ্চটা। সামলানোর চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারল না ওরা। তানভীর গড়িয়ে পড়ল জালালের ওপরে, দুজনে মিলে গড়াগড়ি খেতে লাগল করিডরে।

‘ঘটনা কি, আলো সব নিভে গেল তারপর আবার আপনি ঠিক আছেন, জালাল ভাই?’ জালালকে উঠে বসতে দেখে জানতে চাইল তানভীর।

মাথা নেড়ে জালাল জবাব দিল, ঠিক আছে সে, উঠে বসেই প্রথমে নিজের পিস্তল দুটো পরীক্ষা করে বলে উঠল, ‘ঘটনা অবশ্যই খারাপ। কারণ তা না হলে এভাবে মাঝ নদীতে লঞ্চ থেমে যাবার কোনো কারণই নেই। চলো দেখি—’ বলেই জালাল উঠে দাঁড়িয়ে একটা হাত বাড়িয়ে দিল তানভীরের দিকে। তানভীর সেটা ধরতেই একটানে তাকে উঠিয়ে ফেলল ওপরে। ‘আচ্ছা-’ তানভীর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই স্পিকারে একটা গলা ভেসে এলো।

‘আমি লঞ্চের প্রধান সারেং বলছি, সাময়িক অসুবিধার জন্যে প্রথমেই আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, হঠাৎ আমাদের ইঞ্জিনে গোলযোগ—’ সারেং বলে চলেছে তানভীর জালালের দিকে তাকিয়ে আধো অন্ধকারের ভেতরে বলে উঠল, ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার—’ তানভীর ওর কথা শেষ করার আগেই জালাল একটা হাত তুলে থামিয়ে দিল ওকে।

তানভীর একটু অবাক হয়েই বলে উঠল, ‘কি ব্যাপার, ভাই-’

‘শশশ,’ জালাল একটা হাত তুলে থামিয়ে তো দিলই সেইসঙ্গে কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছে। ‘শুনতে পাচ্ছো?’ তার প্রশ্ন শুনে তানভীর একটু বোকার মতো তাকিয়ে রইল। সেও মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করল কিন্তু কানে এলো না কিছুই। ‘কই কিছুই তো—’ বলতে গিয়েও থেমে গেল। কিছু একটা যেন কানে আসছে ওরও। মৃদু একটা গুঞ্জনের মতো। প্রথমবার অস্পষ্টভাবে কানে এলেও সারেঙের কণ্ঠস্বর ছাড়িয়ে এবার পরিষ্কার শুনতে পেল একটা মৃদু গুঞ্জনের শব্দ। ‘এটা তো…’

‘একদম ঠিক, অবশ্যই এটা একটা শ্যালো নৌকা অথবা কোনো মোটরওয়ালা নৌকার শব্দ,’ বলে তানভীরের দিকে ফিরে তাকাল জালাল। ‘তারমানে বুঝতে পেরেছো শালাদের পরিকল্পনা-’

‘চলেন চলেন জলদি চলেন, মনে হচ্ছে শব্দটা—’

‘লঞ্চের পেছন দিক থেকে আসছে,’ তানভীরের কথাটা সম্পূর্ণ করে দিল জালাল। এরই মধ্যেই সে রওনা দিয়েছে লঞ্চের পেছন দিকে। তানভীরও দ্রুতবেগে অনুসরণ করল তাকে। লঞ্চের কেবিন এলাকা ছাড়িয়ে ওরা চলে এলো লঞ্চের পেছন দিকে। কিন্তু লঞ্চের পেছন দিকে কিছুই নেই। ‘ব্যাপার কি, এখানে তো—’ জালাল তার বক্তব্য শেষ করার আগেই তানভীর থমিয়ে দিল তাকে। মৃদু একটা ভট ভট শব্দ শুনতে পেয়েছে ও। আর সেটা ভেসে আসছে লঞ্চটার কোনো এক পাশ থেকে। ‘জালাল ভাই, এদিকে,’ বলেই হোলস্টার থেকে বের করে আনল নিজের পিস্তল। জালালের দিকে তাকিয়ে দেখল সেও বের করে এনেছে নিজের পিস্তল। দুজনেই খুব সাবধানে পা টিপে চলে এলো একপাশে।

জায়গাটা লঞ্চের একবারে কোনোায়। এখান থেকে ওপরে ওঠার জন্যে প্যাচানো একটা সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। সেটা থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে লঞ্চের একপাশে উঁকি দিল তানভীর, ওর ঠিক পেছনেই জালাল। সরু সিঁড়িটা দুজনকে আড়াল করার জন্যে যথেষ্ট নয়। তাই একজনের পেছনে আরেকজন অবস্থান করছে। দুজনেই নিজেদের যথা সম্ভব আড়াল করে উঁকি দিল সামনের দিকে।

লঞ্চের একপাশে একটা সাদা রঙের নৌকো বেঁধে রাখা হয়েছে। অন্ধকারের ভেতরে হলেও তানভীর অনুমান করল সাদা রঙের নৌকো যেহেতু তারমানে এটা সাধারণ কাঠের নৌকা না, সম্ভবত প্লেক্সিবোর্ডের ইঞ্জিন লাগানো নৌকো। জিনিসটা নৌকো আর স্পিডবোটের মাঝামাঝি একটা জিনিস। অল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্যে খুব কাজের। নৌকাটা যেখানে বেঁধে রাখা সেখানেই লঞ্চের রেলিংয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন মানুষ, এদের ভেতরে একজনের মাথা বাকি সবাইকে ছাড়িয়ে উঠে গেছে আধ হাত ওপরে। ‘শেখারভ,’ আনমনেই বলে উঠল তানভীর। অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে দুজনেই তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। দ্বিতীয় একজন ব্যক্তি উঠে আসছে, বাচ্চা কোলে নেয়ার মতো করে রেলিংয়ের ওপর দিয়ে তাকে টেনে ওপরে তুলে ফেলল শেখারভ। ‘এটা কে?’

‘তারচেয়ে বড়ো কথা, ওইটা কি?’ ওর পাশ থেকে জালাল ফিস ফিস করে বলে উঠল। মানুষ দুজন রেলিংয়ের এপাশে উঠে আসতেই নৌকায় বসা লোক দুজন একটা চেইনের সঙ্গে আটকানো কাঠের একটা কফিনের মতো দেখতে বাক্স রেলিংয়ের সঙ্গে আটকানো কপিকলের মতো চেইনের সঙ্গে আটকে দিল। কপিকলের চেইনের সঙ্গে বাক্সটা আটকে দিতেই একপাশে দাঁড়ানো দুজনে টেনে তুলতে লাগল জিনিসটা।

‘ব্ল্যাক বুদ্ধা,’ আনমনেই বলে উঠল তানভীর।

‘হতে পারে, আবার নাও পারে,’ জালাল বলে উঠল। ‘জিনিসটার ভেতরে ব্ল্যাক বুদ্ধা থাক আর না-ই থাক শেখারভ তো আছেই আর শেখারভের সঙ্গে ওটা টেড চ্যাঙ মানে জেড মাস্টার হবার সম্ভাবনাই বেশি।’

‘কি করব আমরা তাহলে?’ তানভীর জালালের কাছে পরামর্শ করার সুরে জানতে চাইল। ‘আমার মনে হয় সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্ত হবে, ইকবালকে কল করে কোস্টগার্ডকে সতর্ক করে দেয়া। আর কোস্টগার্ড না আসা পর্যন্ত আমরা লঞ্চেই ঘাপটি মেরে বসে থাকব। কারণ লঞ্চে অনেক সাধারণ লোকজন আছে কিছু করতে গেলে যদি গুলি চলে তবে ওদের ক্ষতি হতে পারে।’

‘আমারও মনে হয় এটাই ঠিক হবে,’ ওরা উঁকি দিয়ে দেখল রেলিংয়ের এপাশে থাকা লোকগুলো চেইনের সঙ্গে আটকানো বাক্সটা টেনে তুলে ফেলেছে প্রায়। জালালকে সিঁড়িতে অপেক্ষা করতে বলে ও সরে এলো খানিকটা। মোবাইল বের করে কল দিল ইকবালকে। কথা প্রায় শেষ করে এনেছে এমন সময় ধপ করে আলো জ্বলে উঠল।

হঠাৎ করে তানভীর একেবারে ফাঁকা জায়গায় পড়ে গেল, এমনভাবে আলো জ্বলে উঠবে ভাবতেই পারেনি ও। জালালের দিকে তাকিয়ে দেখল জালাল এখনো সিঁড়ির পেছনেই অবস্থান করছে। সন্তর্পনে সরে আসার জন্যে ইশারা করল ও জালালকে। লঞ্চের অন্যপাশে লোকজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। তারমানে লোকগুলো এগিয়ে আসছে এদিকেই। জালাল অনেকটাই সরে এসেছে এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে চেঁচিয়ে উঠল কে যেন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধুপধাপ আওয়াজের সঙ্গে প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ল একজন মানুষের দেহ, তাকে অনুসরণ করল আরেকজন।

দুজনেই সিঁড়ি বেয়ে ছিটকে এসে পড়ল ডেকের ওপরে। তাদের পেছন পেছনে ডেকের ওপরে লাফিয়ে নামল আরেকজন মানুষ। জিন্স আর ব্লেজার পরা মানুষটার হাতে বিরাট একটা পিস্তল। সেটা তুলে মাটিতে পড়ে থাকা মানুষটার দিকে তুলে শাসিয়ে কিছু একটা বলেই লাথি মারল সে। তারপর হঠাৎ হুঁশ হতেই সে আশপাশে তাকিয়ে বেকুব বনে গেল।

একদিকে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে জালাল আর মোবাইল হাতে তানভীর, অন্যদিকে ডেকের কোনোর দিকে একটা বড়ো কাঠের বাক্স মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ, তাদের ঠিক সামনেই আরো তিনজন। আর এই দুই দলের ঠিক মাঝখানে পিস্তল হাতে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে সুলতান।

সময় যেন থমকে গেল মুহূর্তের জন্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *