প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ১২

অধ্যায় বারো – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর, ভারতবর্ষ

বনের ভেতর থেকে ভেসে আসা চিৎকারটা শুনে দুজনারই মুখের হাসি বন্ধ হয়ে গেছে।

ওরা দুজনেই অভিজ্ঞ যোদ্ধা, তাই চিৎকারের শব্দটা কানে এলেও চট করে কেউই নড়ে উঠল না। বিধুর দিকে তাকিয়ে একবার ইশারা করল শামান। সঙ্গে সঙ্গে বিধু মাটি থেকে ধনুকটা তুলে তাতে একটা তির জুড়ে নিল চট করে। শামান এগোনোর আগেই তির-ধনুক বাগিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল বিধু, হাতে জোড়া কাতানা নিয়ে সাবধানে তাকে অনুসরণ করল শামান।

ওরা যেখানে অবস্থান করছে সেখান থেকে উপত্যকা বরাবর জঙ্গল প্রায় পাঁচ শ গজের মতো দূরত্বে অবস্থিত। দুজনেই যার যার অস্ত্র হাতে নীরবে দৌড়ে চলল সেদিকে। জঙ্গলে প্রবেশের আগে কাঁধের কাছে ঝুলতে থাকা পোশাকের বাড়তি একটা অংশ দিয়ে নিজের চুল আর মুখের অর্ধাংশ ঢেকে নিল শামান। তার বিচিত্র রঙের এই চুল অযথাই মানুষের কৌতূহলের সৃষ্টি করে। আপাতত নিজের প্রকৃত চেহারা কাউকে দেখাতে চাইছে না ও।

ওরা জঙ্গলে প্রবেশ করামাত্র আবারো শোনা গেল চিৎকার। এবার অনেক নিকটে। ওরা চিৎকারের উৎস অনুমান করে সেদিকে দৌড়ে চলল। পাহাড়ি খাড়াইয়ের একেবারে নিচের সমভূমি থেকে শুরু হয়েছে সবুজ বনভূমি, তাই এদিকটায় জঙ্গল তেমন একটা ঘন নয়, চিকন চিকন গোল পাতাওয়ালা গাছের সারির ভেতরে লম্বা পাতার বিচিত্র এক উদ্ভিদের জঙ্গল। সেটা মাথার ওপরে ততধিক বিচিত্র এক চাদোয়ার মতো তৈরি করেছে বড়ো বড়ো গাছ।

গাছপালা ভেদ করে এগিয়ে চলল ওরা সামনের দিকে। হঠাৎ বিধুকে হাতের ইশারায় থামতে বলল শামান। একেবারেই কাছ থেকে মানুষের কথোপকথন আর একজন মহিলার আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসছে। ওরা দুজনেই আগের চেয়ে ও সাবধানে লম্বা পাতার বিচিত্র সেই সবুজ গাছের পাতা সরিয়ে সামনে উঁকি দিল।

ওদের সামনের জঙ্গল আরো ঘন হয়েছে, তবে তার ফাঁক দিয়ে চলে গেছে ধূসর বালিময় পথ। সেটার ওপরেই ঘোড়ায় টানা ছ্যাকড়াগাড়ি একদিকে কাত হয়ে আছে। গাড়ির সামনে কাউকেই দেখা গেল না। তবে একপাশে তাকাতেই ওরা পরিষ্কার দেখতে পেল, একজন টাকমাথা মোটামতো লোককে মাটিতে ফেলে বেদম প্রহারে রত দুই ষণ্ডা, অন্যদিকে খাটো বাঁকা তলোয়ার একহাতে ধরে অন্যহাতে এক মহিলাকে গাড়ির ভেতর থেকে টেনে বাহিরে নামানোর চেষ্টা করছে মুষকো কালো দেখতে আরেক ষণ্ডা।

পরিষ্কার ডাকাতির ঘটনা। সামনের দৃশ্যটাতে একবার চোখ বুলিয়েই শামান বুঝে গেল কী ঘটছে ওখানে। ও পাশ ফিরে বিধুকে নির্দেশনা দিতে যাবে তার আগেই দেখতে পেল ঘোড়া আর দস্যুদলের দিকে তেড়ে চলেছে বিধু, তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে জান্তব সব খিস্তি। আপনমনেই একবার মাথা নেড়ে শামানও এগোতে লাগল ঘটনাযজ্ঞের দিকে।

বিধু এক দৌড়ে গিয়ে একজনের মাথায় বসিয়ে দিল তার ধনুকের এক প্রান্ত, তারপর বীরের মতো এগিয়ে গেল মহিলাকে ধরে টানতে থাকা ষণ্ডার দিকে। লোকটা বিধুকে এগোতে দেখে মহিলাকে ছেড়ে তার দিকে তলোয়ার তাক করল, আপন মনে হেসে উঠল বিধু।

লোকটা তাকে লক্ষ্য করে তলোয়ার চালাল, স্রেফ শরীরটাকে এদিক-সেদিক নাড়িয়েই সেটা এড়িয়ে গিয়ে নিজের ভীম বাহু দিয়ে এক ঘুসি মেরে মাটিতে ফেলে দিল সে কালুয়াকে

অন্যদিকে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটাকে মারতে থাকা ষণ্ডা দুজনে যখন দেখল তাদের অপর দুই সঙ্গী কাবু হয়ে গেছে, যার যার অস্ত্র বাগিয়ে বিধুর দিকে এগোতে লাগল তারা, এমন সময়ে তাদের সামনে ঝড়ের মতো আবির্ভূত হলো শামান। পরবর্তী দুই মিনিট কোথায় কী হলো কেউই সঠিক বুঝতে পারল না, তবে বাকি দুজনকেও মাটিতে শুইয়ে দিয়ে শামান যখন সোজা হলো, বিধু আর ছ্যাকড়াগাড়ির মহিলা দুজনেই ওর দিকে একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

তবে বিধুই সক্রিয় হলো আগে। সে শামানের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মহিলার দিকে ফিরে তাকাল গদ গদ ভঙ্গিতে। হাসিমুখে কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল সে কিন্তু তার হাসি মুখেই রয়ে গেল। মুখের ওপরেই মহিলার এক লাথি খেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ল সে, হাত থেকে ছুটে গেছে ধনুক। বিধুকে এক লাথিতে মাটিতে ফেলে দিয়েই অনুচ্চ স্বরে শিস বাজাল মহিলা। শামান নড়ে ওঠার আগেই অন্তত দশজন অস্ত্রধারী চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলল ওদেরকে। পুরো ব্যাপারটাই একটা সাজানো ফাঁদ ছিল, আর তাতে বোকার মতো ধরা দিয়েছে ওরা।

অস্ত্রধারীরা সুশৃঙ্খলভাবে ওদেরকে ঘিরে রাখল। কয়েকজন এসে মাটিতে শুইয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলল দুজনার। তারপর টেনে দাঁড় করিয়ে দিল মূর্তির মতো। অস্ত্রগুলো কেড়ে নিয়েছে আগেই।

ধরা পড়েও বোকার মতো হাসতে থাকা বিধুর দিকে তাকিয়ে রাগে গা জ্বলে উঠল শামানের। এরকম অবস্থায় ব্যাটা হাসছে কিভাবে? এই মোটুর গাধামির জন্যেই বোকার মতো ধরা পড়তে হয়েছে ওদের। গাধাটা সকালবেলা উঠেই সোমরস খেয়ে ঝামেলা শুরু করেছিল ওর সঙ্গে। এরপর থেকেই যত যন্ত্রণার উৎপত্তি। ডাকাতগুলোর কাছে এভাবে ধরা পড়ার পেছনে ওর নিজেরও বোকামি আছে। একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা হবার পরও এমন বোকামি কিভাবে করতে পারল ও ভাবতেই রাগের মাত্রা আরো এক ধাপ ওপরে চড়ে গেল।

তীব্র রাগের সঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল বিধুকে, তার আগেই ওকে বেঁধে রাখা দড়িতে ধরে টান দিল মুশকো কালো মতো দেখতে পাহারাদার। ধরা পড়ার আগে ব্যাটার মুখে ঘুসি মেরে নিচের ঠোঁট ফাটিয়ে দিয়েছিল শামান। সেটা দেখে একটু শান্তি লাগল ওর।

তবে সেই শান্তি পুরোপুরি উপভোগ করার আগেই আবারো ওদেরকে টান মারল কালুয়া। দুজনারই হাত বাঁধা দড়ির লম্বা অংশ ধরে আছে ঘোড়ায় বসা কালো লোকটা। তার টান খেয়ে আরেকটু হলেই মাটিতে হোঁচট খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল ও কোনোমতে সামলে নিল নিজেকে। গালি দিয়ে উঠল জোরে। ব্যাটা বুঝল কি না কে জানে—তবে ওর দিকে পেছন ফিরে একগাল হেসে মাটিতে একদলা রক্তাক্ত থুতু ফেলল সে। আবারো দড়িতে টান দেয়ার আগেই জোরে পা চালাল শামান।

শুরু হলো জঙ্গলের পথে ওদের যাত্রা। ওদের সামনে চলল ঘোড়ায় বসা লোকগুলো, আর ওরা হেঁটে চলল। ওদের কাফেলাটা জঙ্গলের পথে লম্বা সময় ধরে এগিয়ে চলল। শামানের আন্দাজ যদি ঠিক হয়ে থাকে তবে ওরা জঙ্গলের পথে প্রায় তিন ক্রোশের মতো জায়গা হেঁটে পার হয়ে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত বিরক্ত শামান আরেকবার মুখ তুলে প্রশ্ন করল ওদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারো কোনো বিকার নেই। ওদের সঙ্গে থাকা ঘোড়ার গাড়িটা ওদেরকে ছাড়িয়ে চলে গেছে বহু আগেই। এখন ঘোরসওয়ারি আর পায়ে হাঁটা দশ বারো জনের দলটা একেবারেই নীরবে এগিয়ে চলেছে। দলের অগ্রভাগে মুখ ঢাকা সেই মহিলা।

শামান মনোযোগ দিয়ে লোকগুলোকে খেয়াল করতে লাগল। এদেরকে দেখেই বোঝা যায় যোদ্ধা, কিন্তু কোনো সেনাবাহিনীর অংশ বা অন্তর্ভুক্ত বলে মনে হচ্ছে না। কারণ একেকজনের পোশাক একেক রকম, প্রত্যেকেরই পরনে চামড়ার ফালির তৈরি এক ধরনের পাজামা, পায়ে খোলের জুতো, আর ঊর্ধ্বাঙ্গে ফতুয়ার মতো হাতে কাটা সুতোর তৈরি জামা। প্রত্যেকেই বহন করছে খাটো বাঁকা তলোয়ার আর ছুরি। আর দলের একটা অংশের লোকদের সঙ্গে তির-ধনুক। তারমানে দলের এই অংশটা তিরন্দাজ।

এই দলটাকে দেখে কয়েকটা ব্যাপার শামানের কাছে খুব অবাক লাগছে। প্রথমত, দলের দুটো অংশের লোকজনের চেহারা একেবারেই দু রকম। দ্বিতীয়ত, দলটা যেভাবে ওদেরকে ধরল এতে পরিষ্কার বোঝা যায় ওদেরকে ধরাই এদের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ওদেরকে এভাবে ধরল কেন সেটা পরিষ্কার হচ্ছে না শামানের

কাছে, সাধারণ ডাকাতদল এভাবে ওদেরকে ধরার পেছনে কোনো কারণ নেই—কারণ ওদের সঙ্গে মূল্যবান কিছু নেই।

তবে ওকে সবচেয়ে বেশি অবাক করছে দলের নেতার ব্যাপারটা। নেতা না বলে আসলে নেত্রী বলাটাই শ্রেয়। এরকম একটা দস্যু দলের নেতা একজন মহিলা, ব্যাপারটা কোথায় যেন ঠিক মিলছে না শামানের কাছে। অবশ্য পাহাড়ি যোদ্ধা শামানের কাছে সমতল উপত্যকার জীবনযাপন আর ওদের আচার-আচরণ কখনোই পরিষ্কার নয়। ও পাশ ফিরে বিধুকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই হঠাৎ একটা ব্যপার মাথায় আসতেই ভেতরে ভেতরে ভীষণ চমকে উঠল শামান।

এরা দাস ব্যবসায়ী নয়তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *