প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ২

অধ্যায় দুই – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
তিব্বতের কোনো এক প্রত্যন্ত অঞ্চল

বাতাসে ভোরের আগমনী গন্ধ।

প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে ব্যাপারটা অনুভব করতে পারছে শামান। নিজের অবস্থানে অনড় থেকে মাথা তুলে দিগন্তের দিকে তাকাল সে। যেকোনো সময় পাহাড়ের আড়াল থেকে টুপ করে বেরিয়ে আসবে ডিমের কুসুমের মতো হলদে- লাল সূর্য। পুরো উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়বে অদ্ভুত সুন্দর এক সোনালি আলো। এই সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না। ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির নির্জনে যে এই সৌন্দর্য নিজে অবলোকন করেছে, একমাত্র সেই জানে এই সৌন্দর্যের গভীরতা কতটুকু।

তবে শামানের মনের ভেতরে আসন্ন সৌন্দর্যের চিন্তা প্রাধান্য পাচ্ছে না, বরং তার মন আর মস্তিষ্ক দুটোই ডুবে আছে আসন্ন সংঘাত আর যুদ্ধের চিন্তায়। ওর দলের লোকজন আশপাশে খোঁজখবর করে যতটুকু জানতে পেরেছে তাতে এটা পরিষ্কার যে, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই আসবে ওরা। মৃত্যু আর আতঙ্কের প্রতিনিধি হয়ে ছুটে আসবে।

যদিও একেবারে সরু একটা জায়গায় স্থির হয়ে আছে শামান তবুও রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্যে শরীরটাকে একটু টানটান করার চেষ্টা করল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাল উপত্যকার দিকে। ওরা এই মুহূর্তে যেখানে অবস্থান করছে জায়গাটা একটা সরু শৈলশিলার মতো। দুটো ছোটো ছোটো পাহাড়ি টিলার মাঝ বরাবর চলে গেছে সরু একটা পথ। সেটা পার হয়ে উপত্যকায় প্রবেশ করার আগেই ছোটো একটা গোলমতো ফাঁকা জায়গা। এই জায়গাটাই ওদের প্রধান লক্ষ্য। শামান চারপাশে চোখ বুলিয়ে প্রত্যেকের অবস্থান ঠিক আছে কি না আরেকবার দেখে নিল। তার পরিকল্পনামাফিক সবকিছু সাজানো আছে।

পাহাড়ি পথের শেষে ছোট্ট গোলমতো জায়গাটা পার হয়ে প্রবেশ করতে হয় মূল উপত্যকায়। ভোরের লালচে আলোতে দেখা যাচ্ছে উপত্যকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোটো-বড়ো মূর্তি। প্রাচীন হারুকি বংশ আর শৈন ধর্মের প্রতীক ওগুলো। নিজের পুরনো দিনের শিক্ষা থেকে শামান জানে শৈন ধর্ম এই বিশাল ভূখণ্ডের সবচেয়ে পুরনো ধর্মগুলোর একটি। এই ধর্মের অনুসারীদের ভেতরে আবার হারুকি বংশের লোকেরা হলো সবচেয়ে পুরনো আর সম্পদশালী। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব বদলে যায়।

সময়ের গর্ভে হারিয়ে গিয়ে বিশালাকায় সরীসৃপ পরিণত হয় ছোট্ট টিকটিকিতে। শৈন ধর্মের অনুসারী হারুকিদের জন্যে একই পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে বর্তমানে। ধর্মীয় অন্তর্কোন্দল, নিজেদের ভেতরে বিবাদ আর সম্পদ নিয়ে কাড়ি কাড়ি তাদেরকে দুর্বল করে ফেলেছে। এতটাই দুর্বল যে দানবের আক্রমণে বিপর্যস্ত হারুকিদের এখন অন্য মানুষের সহায়তা নিতে হচ্ছে। আর এখানেই দেখা দিয়েছে শামান আর তার দলের ভূমিকা।

‘ব্যাপার কি, কারো দেখা নেই কেন? ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, ‘ ওর পাশ থেকে আধা তিব্বতি আর আধা নেপালি ভাষার সমন্বয়ে বলে উঠল শামানের দলের ডানহাত গোর্খা যোদ্ধা খোম্বু। ‘পুরোহিত মশায়ের কথা ঠিক থাকলে তো এই সময়েই ওদের আসার কথা,’ খোম্বুর মন্তব্যের জবাবে শামান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই খোম্বুর অন্যপাশ থেকে কথা বলে উঠল আরেকজন।

‘এইখানে আসাটা কি আমাদের ঠিক হয়েছে?’ কালকি নামের এই যোদ্ধা শামানের দলের সর্বশেষ নিয়োগ। নেপালের উত্তরাঞ্চলের লোক সে, তাই কথার ভেতরে নেপালি ভাষার প্রভাব কড়াভাবে কানে বাজে। ‘শুনেছি ওরা নাকি ভয়ংকর। অজানা-অচেনা একদল গ্রামবাসীর জন্যে কটা স্বর্ণমুদ্রার লোভে নিজেদের জীবন বিপন্ন করাটা কি ঠিক হয়েছে? হাজার হলেও এই গ্রামের লোকেরা ভিন্ন ধর্মের মানুষ। কে জানে এদেরকে বাঁচালে আবার ভগবানের কোপে পড়তে হবে কি না।’

কালকির কথায় আধা শোয়া থেকে অনেকটা সোজা হয়েই বসে গেল শামান। ‘আমরা…’ আগের কথার পিঠে নতুন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কালকি কিন্তু শামানকে ঝট করে উঠে বসতে দেখে কথার মাঝখানে হঠাৎ থেমে গেল। কালকি থেমে যেতেই সচেতন হয়ে উঠল খোম্বুও। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে, তার আগেই শামান তাকে আঙুলের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। শামানকে উঠে বসতে দেখেই সচেতন হয়ে গেছে সবাই। একে-অপরের দিকে ইশারা করে কিছু একটা বুঝতে চাইছে। কিন্তু শামানের মুখ পাথরের চেয়েও স্থির। ঈগলের মতো সতর্ক দুই চোখ, শার্দুলের মতো খাড়া হয়ে আছে দুই কান। ভোরের বাতাস যেন স্থির হয়ে ঝুলে আছে টানটান হয়ে থাকা তারের মতো

হঠাৎ সে সামনের দিকে হাত তুলে একটা ইশারা করল। এই ইশারার মানে জানা আছে সবার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিঃশব্দে প্রস্তুত হয়ে গেল শামানের দলের প্রতিটি লোক, বিশেষ করে তিরন্দাজেরা ছিলায় একটা করে তির জুড়ে নিল। ইশারা পেয়ে সবাই প্রস্তুত হয়ে গেছে কিন্তু এখনো কোনো মানুষ তো দূরে থাক এমনকি একটা পাহাড়ি ছাগলও দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

‘ব্যাপার কি! কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না…’ খোম্বুর মুখের কথা শেষ হবার আগেই মৃদু একটা শব্দ পাওয়া গেল। পাহাড়ি চামরি গাইয়ের বড়ো দল একসঙ্গে উপত্যকা পার হবার সময়ে যে রকম শব্দ হয় প্রায় তার কাছাকাছি একটা শব্দ। খুরের সঙ্গে শক্ত মাটি আর ছোটো নুড়ি পাথরের ঠোকাঠুকির শব্দ। শব্দটা প্ৰায় কাছাকাছি হলেও কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। চামড়ি গাইয়ের দলের চলাচলের শব্দ হয় এলোমেলোভাবে কিন্তু এই শব্দটা হচ্ছে সুশৃঙ্খলভাবে। শব্দটা কানে আসার একটু পরেই উপত্যকার শেষ প্রান্তে দেখা গেল দলটাকে।

দলটা চোখে পড়া মাত্রই শামানের দলের প্রত্যেকের শরীর টানটান হয়ে গেল। ভয়ের একটা মৃদু শিহরণ বয়ে গেল অনেকের মেরুদণ্ড বেয়ে। একবার দলটাকে দেখে নিয়ে নিজের দলের কয়েকজনের ওপরে চোখ বুলাল খোম্বু, তারপর ফিরে তাকাল শামানের দিকে।

শামানের ভেতরে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠে আসতে থাকা দলটার দিকে। যদিও নিজের মুখে ধীর-স্থির একটা ভাব ধরে রেখেছে সে কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিচলিত হয়ে উঠেছে। কারণ একে তো অচেনা জায়গা তার দলের লোকজনের মানসিকতার ওপরে চাপ তো ফেলছিলই তার ওপরে ওরা শত্রু সংখ্যা যা আশা করেছিল শত্রুরা সংখ্যায় তারচেয়ে অনেক বেশি। মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করল শামান। নিজের লোকজন, নাকি প্রতিজ্ঞা কোনোটাকে প্রাধান্য দেবে, দোদুল্যতার মাঝে মুহূর্তের জন্যে একটা হালকা পর্দা ঝুলে রইল।

কিন্তু সেটা ওই মুহূর্তের জন্যেই। উদ্দেশ্য ঠিক করে ফেলতেই সে এক হাত উঠিয়ে দুইদিকে ইশারা করল। আক্রমণের আগে এটাই শেষ ইশারা এর পরের ইশারাতেই আক্রমণ হবে। শামানের ইশারা পেয়ে আরেকদফা দ্বিধার পর্দা ঝুলে রইল সবার মনে।

‘কিন্তু ওরা তো…’ আবারো খোম্বু কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই শামান তাকে থামিয়ে দিল

‘কোনো উপায় নেই, পিছিয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। সবাই প্রস্তুত হও,’ বলেই সে এক হাতে ধরা কুকরির ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। শরীরটাকে প্রায় তিন শ ষাট ডিগ্রি ঘুরিয়ে শেষবারের মতো দেখে নিল তার দলের প্রত্যেকের অবস্থান। শেষবারের মতো মাথার ভেতরে ঝালিয়ে নিল পুরো পরিকল্পনা। শত্রু যা ধারণা করেছিল তার প্রায় দ্বিগুণ, অন্যদিকে সর্বসাকুল্যে তার লোক সংখ্যা ওদের প্রায় তিনভাগের একবার। তবে সংখ্যা দিয়ে নয় বরং দক্ষতা আর ক্ষিপ্রতা দিয়ে পরাজিত করতে হবে শত্রুদের। আর সেটা করতে হলে নিখুঁতভাবে কাজে লাগাতে হবে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা।

ওর পরিকল্পনটা খুব সহজ। সর্বসাকুল্যে ওর দলে লোক আছে এগারোজন। এই এগারোজনকে চারটা দলে ভাগ করে উপত্যকার চার জায়গায় বসিয়েছে ও। চারটি দলের ভেতরে দুটো দল তিরন্দাজদের, অন্য দুটো দল তলোয়ারবাজদের। আগমনরত দলটার ওপরে আক্রমণের জন্যে নির্ধারিত করা হয়েছে উপত্যকার সবচেয়ে সরু জায়গাটা। কারণ আক্রমণরত দস্যুদল যত বড়োই হোক না কেন, উপত্যকার এই নির্দিষ্ট সরু জায়গাটাতে এলে প্রাকৃতিক কারণেই দলটাকে একসঙ্গে না এগিয়ে বরং সারি দিয়ে একজন একজন করে এগোতে হবে। এই সুযোগটাই নিতে চেয়েছিল শামানের দল কিন্তু লোকসংখ্যায় দস্যুদল যে এতটা বড়ো হবে সেটা কল্পনাতেও আসেনি কারো। কিন্তু এত দূর এসে পিছিয়ে যাবার কোনোই উপায় নেই। কারণ পিছিয়ে গেলে নিজেরা হয়তো প্রাণে বাঁচতে পারবে কিন্তু তাদের কাপুরুষতার বলি হতে হবে সাধারণ কিছু মানুষকে। শেষবারের মতো সব ঝালাই করে নিয়ে সামনে তাকাল শামান।

পাহাড়ি উপত্যকা বেয়ে দস্যুদের দলটা উঠে আসছে দ্রুত গতিতে। সবার সামনে মাথা উঁচিয়ে আছে বিশালাকায় একজন মানুষ। কখনো সামনা-সামনি না দেখলেও এই লোকের বর্ণনা লোকের মুখে এত বেশি শুনেছে যে দূর থেকে দেখা মাত্রই তাকে চিনতে এক বিন্দু সমস্যা হলো না শামানের।

মোঙ্গল দস্যু তামাঙ লি। মোঙ্গল রাজ পরিবারের দ্বিতীয় পুরুষ শী লিনের অবৈধ সন্তান তামাঙ লি তিব্বত আর মান্দারিন এলাকার জীবন্ত ত্রাসের নাম। ছয় ফিটের ওপরে দীর্ঘ, খালি হাতে মারামারির বিশেষ উপাধি ‘সুনা’ অর্জনকারী তামাঙ লিকে নিয়ে প্রচলিত উপকথার কোনো শেষ নেই। সে নাকি কখনো ঘুমায় না, সে নাকি চব্বিশ ঘণ্টা ঘোড়ায় চড়ে দূরদেশ পাড়ি দিতে পারে। দলের সর্বাগ্রে অবস্থানকারী তামাঙ লিকে দেখে দাঁতে দাঁত চাপল শামান। ‘আজ দেখব কত তেজ তোমার,’ কথাটা বলেই একটা হাত উঁচু করল সে।

এটা একটা ইশারা, পাহাড়ের অপর পাশে অবস্থানরত তিরন্দাজদের ভেতরে দুজনকে বিশেষ একটা দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। শামানকে বিশেষ কায়দায় হাত ওঠাতে দেখেই তারা দুজনে সতর্ক হয়ে উঠল।

দস্যুদের দলটা একই গতিতে এগিয়ে আসছে, এবার দলের প্রায় প্রত্যেক ঘোড়সওয়ারকেই চোখে পড়ছে। শামান আন্দাজ করল দলে তারা কম করে হলেও ত্রিশজনের বেশি হবে। দলটা এগোতে এগোতে প্রায় ওদের কাছে চলে এসেছে এমন সময় উঁচু করে রাখা হাতটা ঝট করে নামিয়ে আনল শামান।

তাৎক্ষণিক কিছু হলো না। কিন্তু একটু পরেই মৃদু একটা কম্পন টের পাওয়া গেল। বেশ মৃদুভাবে শুরু হলেও কম্পনটা বাড়তে লাগল ধীরে ধীরে। শামান অনুভব করল পায়ের নিচের মাটিতে কম্পনটা পাহাড়ের এপাশে থেকেও ওরা টের পাচ্ছে। তবে দস্যুদলটা থামছে না কেন। দস্যু দলটা এগিয়ে আসছিল হঠাৎ ওদেরও গতি ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগল। মনে হচ্ছে ওরাও টের পেয়েছে, কিছু একটা হচ্ছে।

এমন সময় পাহাড় কাঁপিয়ে ঝোপ-ঝাড়ের আড়াল থেকে উদয় হলো বিশাল আকারের এক পাথর। পায়ের নিচের মাটি কাঁপিয়ে দিয়ে পাহাড়ি পথটা যেখানে একেবারে সরু হয়ে গেছে সেখানে গিয়ে পড়ল। আরেকটু হলেই দস্যুদলের অন্তত দুজনকে ভর্তা করে ফেলত ওটা।

পাথরটা আছড়ে পড়তেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল শামান। কারণ একদিকে তামাঙের দলটাকে চমকে দিয়ে ওদেরকে থামানোটা যেমন জরুরি ছিল অন্যদিকে আবার ওদের কেউ মারা পড়লে বিপদ হতো। কারণ শুরুতেই বিনা রক্তপাতে অন্তত একবার হলেও ওদের সঙ্গে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করবে শামান। যদিও তাতে কাজ হবার কথা নয় তবুও একজন যোদ্ধা হিসেবে এই সম্মানটুকু ওকে রাখতে হবে।

পাথরটা পথের ওপরে আছড়ে পড়তেই ধীরে ধীরে দলটা স্থবির হয়ে আসতে লাগল। ওরা খানিকটা স্থির হতেই নিজের দলের লোকদের আরেকবার প্রস্তুত থাকতে বলে উঠে দাঁড়াল শামান। একটা হাত ভারী কুকরির বাঁটে রেখে খানিকটা এগিয়ে চলে এলো ছোটো পাহাড়টার একেবারে কিনারায়। এখান থেকে নিচে দেখা যাবে পরিষ্কার। সেইসঙ্গে নিচের লোকজনও দেখতে পাবে ওকে। জায়গামতো দাঁড়িয়ে নিচের দিকে উঁকি দিল শামান।

থেমে দাঁড়িয়েছে তামাঙ লির দল। দলের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ এই অত্র এলাকায় ওরা কখনোই কোনো ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। আজ হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই ভোরবেলা এভাবে পথের ওপরে আস্ত একটা পাথর এসে পথ আটকে দিলে ওরা অবাক আর ক্ষিপ্ত তো হবেই।

‘তামাঙ, ফিরে যাও,’ যথাসম্ভব পরিষ্কারভাবে স্থানীয় তিব্বতি ভাষায় পাহাড়ের কিনারা থেকে চিৎকার করে উঠল শামান। ‘এখানে তোমার জন্যে কিছু নেই। নিরীহ গ্রামবাসীদের বিরক্ত না করে ফিরে যাও। অথবা আত্মসমর্পণ করো। কথা দিচ্ছি প্রাণ ভিক্ষা দেয়া হবে তোমার লোকদেরকে,’ কথাগুলো যথেষ্ট দৃঢ় স্বরে বললেও নিজের কানেই কেমন জানি হাস্যকর শোনাচ্ছে। তবে এতে কাজ হলো খুবই দ্রুত।

ও কথা শেষ করতে না করতেই একটা ছোটো ভারী তলোয়ার স্থানীয় ভাষায় যাকে বাটাল বলে—এরকম একটা বাটাল ছুটে এলো ওর দিকে। ঝট করে মাথা সরিয়ে না নিলে মাথার অর্ধেকটা হারাতে হতো। ছুটে আসা বাটলটা এড়িয়ে আপনমনেই একবার মাথা নাড়ল শামান। মনে মনে বলল, ডাকাতে না শোনে ধর্মের কাহিনি। কথাটা বলেই আবারো একটা হাত উঁচু করে দুইবার নাড়ল ও, সেইসঙ্গে সরে এলো পাহাড়ের কিনারা থেকে।

ওরা যেখানে বসে আছে সেই জায়গাটা আসলে পাহাড়ি শৈলশিলার বেরিয়ে থাকা একটা জিভের মতো। ওর সঙ্গে এখানে আছে তিনজন সেইসঙ্গে আরো দুজন অবস্থান করছে ওদের থেকে একটু দূরেই আরেকটা শিলশিলার ওপরে। তিনজন তিনজন করে ছয়জনের দুটো দলকে ভিন্ন দায়িত্ব দিয়ে অন্য দুদিকে বসানো হয়ছে। শামান ইশারা করতেই আবারো পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে লাগল।

নিচে তামাঙ লির দস্যুদল হল্লা করছিল আবারো কম্পন শুরু হতেই ওরা থেমে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাটি কাঁপিয়ে আরেকটা বড়ো আকারের পাথর ছুটে এলো, এবার দলটা যে সরু শৈলশিলায় অবস্থান করছে সেটার উলটো দিকে। শামানের পরিকল্পনা ছিল খুবই সহজ। প্রথমে ওদের সামনের দিকে একটা পাথর ফেলে সতর্ক করে দেয়া হবে। যদি তারা কথা শুনে ফিরে যায় তবে তো কথাই নেই। যদি না শোনে তবেই ছোড়া হবে দ্বিতীয় পাথরটা। যাতে সরু পাহাড়ি পথটাতে তারা দুদিক থেকে আটকা পড়ে। একবার সরু পথে তাদেরকে আটকে ফেলতে পারলে যত বড়ো দলই হোক না কেন তিরন্দাজ বাহিনী তাদের একেবারে নাস্তানাবুদ করে ফেলতে পারবে। সেইসঙ্গে ওরা ওপর থেকে নিক্ষেপ করবে পাথর।

পরিকল্পনাটা ছিল অসাধারণ কিন্তু প্রথমেই বাগড়া বাঁধল দলের আকৃতি। তামাঙ লি ওদের ধারণার চাইতেও অনেক বড়ো দল নিয়ে হাজির হয়েছে। তাও সমস্যা হতো না কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনাটাই একেবারে পরিকল্পনার বারোটা বাজিয়ে দিল।

দ্বিতীয় পাথরটা সঠিকভাবে পথের ওপরে পড়লেই আর কোনো ঝামেলা হতো না। ওটা ছুটে এলো ঠিকঠাক মতোই কিন্তু সরু পাহাড়ি পথটার যেখানে দস্যুদলটা অবস্থান করছে সেটার শেষ প্রান্তে না পড়ে বরং পাহাড়ি পথটার একেবারে ওপরে যেখানে দুটো ছোটো টিলার নিচ দিয়ে পথটা গেছে সেই টিলা দুটোর ওপরে এসে আটকে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠল তামাঙ লির দলটা। প্রথমে একটা পাথর, তারপর শামানের সতর্কবাণী তারপরে আবারো পায়ের নিচের মাটি কেঁপে ওঠাতে এমনকি তামাঙের মতো দূর্ধর্ষ ডাকাতও বুঝে উঠতে পারছিল না আসলে হচ্ছেটা কি। কিন্তু দ্বিতীয় পাথরটা ছুটে আসতেই সে বুঝে গেছে শামানরা আসলে কী করতে চাইছিল। কিন্তু ততক্ষণে কিছুই করার ছিল না তার। তবে যেই মাত্র পাথরটা আটকে গেল সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠল সে। সামনের পথ রুদ্ধ, খোলা আছে একমাত্র পেছনের পথ। নিজের দলটাকে সেদিকেই ফিরে যাবার নির্দেশ দিল সে কিন্তু ওইপথে পাথরটা এমনভাবে ঝুলে আছে ঘোড়া নিয়ে ফেরা সম্ভব না।

অন্যদিকে শামান দেখল তার পরিকল্পনা পুরোপুরি মাঠে মারা গেছে। দস্যুদলটা পেছন দিকে রওনা হবার আগেই সে অন্য দুই পাশে অবস্থানরত তিরন্দাজদের ইশারা করল। ওরা প্রস্তুতই ছিল, সঙ্গে সঙ্গে ছয়জন তিরন্দাজ সক্রিয় হয়ে উঠল। এক ঝাঁক তির ছুটে গেল দুই পাথরের মাঝে অবস্থারত তামাঙ লির দলটার দিকে।

তামাঙ লি পেছন দিকে ফিরে যাওয়ার জন্যে রওনা দিয়ে দেখতে পেল ঘোড়া নিয়ে ওই পথে ফেরা সম্ভব নয়। সে আর তার দলবল ঘোড়া থেকে নেমে এই দ্বিতীয় পাথরটার নিচ দিয়ে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে-এমন সময় তিরগুলো ছুটে গেল তাদের দিকে।

প্রাথমিক ধাক্কায় একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রায় প্রতিটা তির বিদ্ধ করল তামাঙের দলের লোকদের। শামানের দল দক্ষ হতে পারে তবে বছরের পর বছর ধরে কুকাজে অভ্যস্ত তামাঙ লির দলটাও কম দক্ষ আর অভিজ্ঞ নয়। কয়েকজন মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই সতর্ক হয়ে উঠল বাকিরা। ঘোড়া থেকে নেমে নিজেদের ঢাল মাথার ওপরে চেপে ধরে অনেকটা ছাদের মতো তৈরি করে ফেলল তারা। সেইসঙ্গে দ্রুত বেরিয়ে আসতে শুরু করল আটকে পড়া পাথরের নিচ দিয়ে। একদিকে ক্রমাগত তিরের বৃষ্টি, তার ওপরে শামানের দলের লোকেরা ক্রমাগত ছোটো-বড়ো পাথর ছুড়ে মারছে ওদের দিকে। ওরাও উলটো তির ছুড়তে শুরু করেছে কিন্তু নিচে অবস্থান করার কারণে খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারছে না। তবে তামাঙের নেতৃত্বে বেশ দ্রুত তারা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে পেছনের পাথরের নিচ দিয়ে।

শামান দেখল একদিকে ওদের লোকবল কম, তার ওপরে আক্রমণ করার পরও খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারছে না ওরা। সেইসঙ্গে দ্রুত গতিতে যেভাবে ওরা পাথরের নিচ দিয়ে খোলা উপত্যকায় বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে এভাবে বেরুতে থাকলে কিছুক্ষণের ভেতরেই ওরা বেশির ভাগই বেরিয়ে এসে সোজা আক্রমণ চালাবে ওদের ওপরে। আর একবার সরাসরি আক্রমণে গেলে ওরা স্রেফ হাওয়ায় উড়ে যাবে তামাঙের দলের সামনে।

কিছু একটা করতে হবে। একবার ওদের অবস্থানরত শৈলশিলাটা দেখল আরেকবার নিচের পথটা দেখল। সেইসঙ্গে দুই শিলার মাঝে আটকে থাকা পাথরটাও। মুহূর্তের মধ্যেই নিজের উদ্দেশ্য ঠিক করে নিয়ে নিজের লোকদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে নির্দেশনা দিল, সেইসঙ্গে হাতের ইশারা করল তিরন্দাজদের উদ্দেশে। ওর পাশ থেকে খোম্বু চেঁচিয়ে উঠে থামতে বলল ওকে কিন্তু ততক্ষণে শূন্যে লাফ দিয়েছে শামান।

একদিকে নিজের তলোয়ার সামলে সে জিভের মতো বেরিয়ে থাকা শৈলশিলা থেকে প্রায় বিশ ফিট নিচে গিয়ে পড়ল। ওর শরীরটা পুরোপুরি মাটিতে পড়ার আগেই পাহাড়ি ঢাল বেয়ে গড়িয়ে দিল শরীরটাকে। পাথুরে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়তে পড়তেই একবার দেখে নিল দুই শিলার মাঝে আটকে থাকা পাথরটার অবস্থান। পাহাড়ি ঢালের কিনারায় যেতেই পতনরত শরীরটাকে অনেকটা জ্যা মুক্ত তিরের মতো টানটান করে দিয়ে শূন্যে লাফ দিল ও। ঢাল থেকে নিচে ঝাঁপ দিয়ে প্রায় পঁচিশ ফিট নিচে শিলায় আটকে থাকা পাথরটার ওপরে শরীরের পূর্ণ ওজন দিয়ে পড়ল।

শামান প্রায় পঁচিশ ফিট ওপর থেকে শরীরের পূর্ণ ওজন নিয়ে পাথরটার ওপরে লাফিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একপাশের পাহাড়ি শিলা থেকে ওটার একটা কিনারা ছুটে গেল। ওই মুহূর্তে পাথরটার নিচ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল দুই দস্যু, পাথরটা ছুটে যেতেই তাদেরকে চিঁড়ে চ্যাপ্টা করে দিয়ে মাটিতে পড়ে পথটা আটকে দিল ওটা। শামান গড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

মাটিতে পড়ে একটা গড়ান দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবারো শরীরটাকে বাঁকিয়ে কাত হয়ে গেল উলটো দিকে। কারণ আরেকটু হলেই একটা তলোয়ারের ফলা দুই ভাগ করে দিতে যাচ্ছিল তাকে। উলটো হয়ে থাকা শরীরটাকে সোজা না করে বরং সেটাকে পেছন দিকে গড়িয়ে দিল শামান। উলটো দিকে ঘুরে সোজা হবার সময়ে শরীরের ঘূর্ণনের সঙ্গে একই তালে বের করে আনল নিজের তলোয়ার। সামনের যোদ্ধা কিছু টের পাবার আগেই প্রথমে নিজের তলোয়ার হারাল তারপর পেটে একটা বিরাট ক্ষত নিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। খানিকটা সুস্থির হয়ে মাটি থেকে একটা ঢাল তুলে নিয়ে একহাতে তলোয়ার বাগিয়ে ও ফিরে তাকাল সামনের দিকে।

তামাঙ লি ওর থেকে বেশ অনেকটাই তফাতে, তবে তার লোকেরা ঘিরে ধরেছে ওকে। পাহারি ঢালের একদিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও, আর ঠিক ওর সামনেই তামাঙের লোকেরা। ওকে কোণঠাসা দেখতে পেয়ে একে একে অস্ত্র বের করে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল তারা। শামান আড়চোখে দেখল ওর লোকেরা পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসছে, তবে এখনো সময় লাগবে ওদের নামতে। তামাঙের লোকদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। ‘এমনটাই তো চাই।’

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে শরীরটাকে একটু নিচু করে মাটিতে একটা গড়ান দিয়ে একপাশে সরে সর্বডানের মানুষটার কাছে চলে এলো। যেকোনো অসি কিংবা মল্লযুদ্ধের প্রাথমিক নিয়মগুলোর ভেতরে এটা একটা। শত্রু যদি সংখ্যায় একের অধিক হয় তবে প্রথমেই একপাশে সরে যাও। এতে করে তুলনামূলক কম লোকের মোকাবেলা করতে হবে।

শত্রু সংখ্যা অনেক, কাজেই প্রথমেই গড়ান দিয়ে ডানে সরে এসে প্রথমজনের হাতে ধরা ঢাল আর তলোয়ারের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিল নিজের কাতানা। বিশেষ কায়দায় দুজনকে একসঙ্গে গেঁথে শরীরটাকে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে ঢাল আর কাতানা ছাড়িয়ে নিতেই দুই প্রতিপক্ষই ছিটকে পড়ল দুদিকে। বসা অবস্থা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল শামান। বাম হাত থেকে ঢালটা ফেলে দিয়ে কোমর থেকে লম্বা মাথা বাঁকানো ছুরি বের করে আনল। তলোয়ার আর ছুরি দুটোকেই শূন্যে ঘুরিয়ে ফিরে তাকাল সামনের ডাকাতদের দিকে।

মুহূর্তের ব্যবধানে দুজনকে হারিয়ে একটু চমকে গেছে শত্রুরা। শামানকে ছুরি আর তলোয়ার হাতে উঠে দাঁড়াতে দেখে এবার আর আগের মতো বোকামি করল না। তিনজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অর্ধবৃত্তাকারে এগিয়ে আসতে লাগল। কিন্তু তাদের এই সুশৃঙ্খল আক্রমণের বারোটা বেজে গেল একাধিক লোকের চেঁচামেচিতে। ঢালের দিকে তাকিয়ে শামান দেখল ওর দলের লোকেরা নেমে এসেছে উপত্যকায়। তামাঙ লির দলটা শামানের সঙ্গে মারামারির প্রস্তুতি নিচ্ছিল তার আগেই ওর দলের লোকেরা পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল লির লোকদের ওপরে। সমানে সমানে লড়াই শুরু হয়ে গেল।

সেই আক্রমণকারী তিনজনের একজন তির বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, অপর একজন দৌড় দিল পেছন ফিরে। সর্বশেষ জন তলোয়ার বাগিয়ে ছুটে এলো ওর দিকে। লোকটাকে সামলে নিয়ে সোজা হবার আগেই তীব্র আঘাতে একপাশে ছিটকে পড়ল নিজেই। মাটিতে পড়তেই কালো একটা ঝিলিক দেখতে পেল ও। কোনোমতে ডানহাতে ধরা তলোয়ারটা মুখের ওপরে তুলে আঘাতটা ঠেকিয়ে দিল ও। তবে আঘাতের তীব্রতায় আরেকটু হলেই হাত থেকে ছুটে যাচ্ছিল নিজের তলোয়ার। তলোয়ারের আঘাত ফিরিয়ে দিতেই একটা ছুটে আসা লাথি হাঁটু দিয়ে আটকে দিল ও। ধরে ফেলা পা-টাকে সামান্য পেছনে ঠেলে দিয়ে উলটো দিকে গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়াল শামান।

ওর অপর দিকের যোদ্ধাও সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। একটু আগে তলোয়ারের আঘাতটা যখন ফিরিয়ে দিল, আঘাতের তীব্রতা দেখে বোকা বনে গেছিল শামান। মনে মনে ভেবেছিল কার আঘাতে এত শক্তি। এবার বুঝতে পারল আঘাতটা আসলে কে করেছিল।

মোঙ্গল ডাকু তামাঙ লি।

এই মুহূর্তে মাটির প্রায় সাড়ে ছয় ফিট ওপর থেকে ওর দিকে ছোটো ছোটো চোখের কুঁত কুঁতে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। এক হাতে ধরে রেখেছে বিরাট আকারের একটা তলোয়ার। বিশেষ সাদা লোহার তৈরি এই তলোয়ারকে মোঙ্গলদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘কাঞ্চুকি’। বলা হয়ে থাকে হাজার বছরের পুরনো পাহাড়ি বরফের নিচে জমা হওয়া আকরিক লোহা দিয়ে বানানো হয় এই তলোয়ার। নিজের বিরাট আকারের তলোয়ারটাকে দুইবার পাক খাওয়াল লি।

নিজের পাতলা কাতানার চামড়ার ফালি মোড়ানো বাঁটে হাত রেখে বিশেষ একটা কায়দায় দাঁড়িয়ে গেল শামান। একটা পায়ের পাতা সামনের দিকে, অপর পাতাটা বাম পাশে কাত করা। শরীরের অবস্থান ঠিক করে তলোয়ারটার ডগাতে খালি হাতের আঙুলের গাট দিয়ে টুঙ করে একটা শব্দ করল শামান। পাহাড়ি নিয়মে এটাই দ্বৈত লড়াইয়ে যুদ্ধের ঘোষণা।

কিন্তু ও অবাক হয়ে খেয়াল করল তামাঙ লি ওকে আক্রমণ করল না। বরং ওকে মাঝখানে রেখে ঘুরতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে গেল শামান। যেকোনো যুদ্ধে জয়-পরাজয় যতটা না দক্ষতার ওপরে নির্ভর করে তারচেয়ে বেশি নির্ভর করে প্রতিপক্ষের মানসিকতার ওপরে কতটুক চাপ সৃষ্টি করতে পারছে তার ওপরে। এই মুহূর্তে তামাঙও তাই করছে।

শামানকে যুদ্ধের ভঙ্গিতে দাঁড়াতে দেখেই সে বুঝে গেছে তার মতোই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধা ও। শামানের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে ফেলার জন্যেই সে সরাসরি আক্রমণ না করে ঘুরতে শুরু করেছে। যাতে তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে শামানকে সমকোণী ভঙ্গিটা ভেঙে পেছন ফিরতে বাধ্য হয়। কিন্ত তামাঙ লি ঘুরতে শুরু করার পরেও শামান স্থির দাঁড়িয়েই রইল। একটা বাজি খেলতে চাইছে ও। সফল হলে ভালো, না হলে সর্বনাশ। শামানকে ঘুরতে না দেখে একটু অবাক হয়ে ওর ঠিক পেছনে এসে থেমে গেল লি।

সময় থমকে গেছে। চারপাশে মারামারি, তলোয়ারের সঙ্গে তলোয়ারের ঝলকানি, তির ছুটছে বিক্ষিপ্তভাবে। এরই মধ্যে দুই যোদ্ধা পরস্পরকে ঘায়েল করার জন্যে রচনা করে চলেছে অদ্ভুত এক যুদ্ধ কাব্য।

শামানের পেছনে দাঁড়িয়েই তামাঙ লি নিজের তলোয়ারের হাতলে আঙুলের চাপ শক্ত করল। তার মুখে নিঃশব্দে ফুটে উঠেছে জয়ের হাসি। শামান তার দিকে পেছন ফেরা অবস্থাতেই প্রস্তুত হয়ে গেল আক্রমণের জন্যে। তামাঙ লি ওর দিকে ছুটে এলো পাহাড়ি ঝোড়ো বাতাসের মতো। সেই সঙ্গে ওর মাথা বরাবর নামিয়ে আনল নিজের ভারী তলোয়ার। সে প্রায় শতভাগ নিশ্চিত ছিল পেছন ফেরা অবস্থায় এই তীব্র আঘাত কোনো মানুষেই ফেরাতে পারবে না। কিন্তু তাজ্জব হয়ে দেখল তলোয়ারটা নেমে যাচ্ছে-যাচ্ছে পেছন থেকে শামানের ঘাড় প্রায় ছুঁয়ে ফেলবে এমন সময় আচমকাই শামানের শরীরের ওপরের অংশ একটু ঘুরে গিয়ে নিজের পাতলা কাতানা দিয়ে ঠেকিয়ে দিল বিরাট তরবারির আঘাত।

সঙ্গে সঙ্গে লির মুখের হাসি নিভে গেল। এরকম কিছু ঘটতে পারে দীর্ঘ যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় কখনো তার কল্পনাতেও আসেনি। তবে সে তো আর জানে না, পেছন ফিরে থাকলেও তার দেহায়বব নয় বরং বিপরীত দিক থেকে আসা সূর্যের আলোতে শামান আসলে তার ছায়াকে অনুসরণ করছিল। ফলে পেছন ফিরে থাকলেও তার ছুটে আসা, তার তলোয়ার ওঠানো সবই চোখে পড়েছে ওর। তাই আঘাতটা হানতেই সময়মতো ঠেকিয়ে দিয়েছে সেটাকে। তবে ওর হিসেবে গরমিল হয়ে গেল একটু।

ওর পরিকল্পনা ছিল শরীর ঘুরিয়ে আঘাতটা ঠেকিয়ে দিয়ে অন্য হাতে ছুরি বের করে সেটা বসিয়ে দেবে লির গলায়। কিন্তু লির আঘাতের তীব্রতা এতই বেশি যে ওটাকে ঠেকিয়ে দেতে পারলেও আঘাতের তীব্রতায় ছিটকে পড়ল মাটিতে। আরেকটু হলেই তলোয়ারের চোখা ফলাটা ওর পাঁজরের পাশ দিয়ে ঢুকতে যাচ্ছিল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে শরীরের ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে বাম হাতে বের করে আনল ওর ছুরিটা। লি মাটি থেকে তলোয়ারটা ওঠানোর আগেই নিজের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে তামাঙ ছুটে গেল তার দিকে। মাটি থেকে তলোয়ারটা ওঠানোর সময়ে একগাদা ধুলোসহ সেটার একটা অংশ লি ছুঁড়ে দিল ওর দিকে।

একহাতে চোখ ঢেকে ফেললেও কিছু ধুলোবালি ঢুকে গেল শামানের নাকে- মুখে। কিন্তু থামল না ও। তলোয়ারটাকে সামনে ধরে আরো দুই ধাপ এগিয়ে সোজা আঘাত করল লিকে। কিন্তু লি ততক্ষণে সামলে নিয়েছে নিজেকে। কাতানার আঘাতটাকে ফিরিয়ে দিয়েই উলটো আঘাত করল নিজের তলোয়ার দিয়ে। শামান জানে ওই বিশাল তলোয়ারের আঘাত ওর পাতলা কাতানা পরোপুরি সামলাতে পারবে না। তাই আঘাতটা পুরোপুরি না ঠেকিয়ে একদিকে সরিয়ে দিল ওর কাতানা দিয়ে। নিজের ছুরিটাকে বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল লির বুকে। বুকের শক্ত বর্মে লেগে পিছলে গেল ছুরি। সরে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল শামান।

গত কয়েক মিনিটের তীব্র যুদ্ধে প্রথমবারের মতো একটু ফুসরত পেল ও। আশপাশে তাকাতেই দেখতে পেল চারপাশের যুদ্ধ প্রায় থেমে গেছে। পক্ষ-বিপক্ষ দুই দলেরই লোকজন প্রায় গোল হয়ে ঘিরে ধরেছে ওদের দুজনকে। তিব্বতের সবচেয়ে বিখ্যাত আর কুখ্যাত দুই যোদ্ধার লড়াই দেখছে সবাই উৎসুক হয়ে। শামান ভিড়ের ভেতরে গ্রামবাসীদেরও দেখতে পেল। দ্রুত একবার চারপাশে দেখে নিয়ে ও দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল লির ওপরে।

লির ঠোঁটের কোনায় রক্ত দেখা যাচ্ছে। রাগে-ক্রোধে বিকৃত হয়ে আছে মুখ। সম্ভবত তার দীর্ঘ যুদ্ধের জীবনে এমন মুহূর্ত বহু বছর অসেনি। কিংবা কে জানে হয়তো কখনোই আসেনি। তলোয়ারটাকে এক হাতে ধরে সে কোমরের পেছন থেকে বের করে আনল একটা ছোটো কুঠার। শামানও একহাতে কাতানা সামলে অন্যহাতে বের করে আনল নিজের কুকরি।

এবার লি এগিয়ে আসার আগেই তলোয়ারটাকে শূন্যে দুইবার পাক দিয়ে শামানই ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপরে। ও তলোয়ার ধরে শূন্যে লাফ দিল। মাটিতে পড়ার আগেই শরীরটাকে গড়িয়ে দিল একপাশে। সরাসরি আঘাত না করে ডান দিক থেকে কাতানার ফলা দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করল লির গায়ে। তবে ওর আঘাত খুব সহজেই ঠেকিয়ে দিল লি। বরং উলটো নিজের কুঠার দিয়ে দু-টুকরো করে দিতে চাইল শামানের ছুরি ধরা হাত। ছুরি ফেলে দিয়ে খপ করে কুঠারের হাতলটা ধরে ফেলল শামান। এই সুযোগটাই নিল লি। সে কুঠার ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে শামানকে শূন্যে তুলে আছড়ে ফেলল মাটিতে।

হাত থেকে কুঠার, ছুরি আর তলোয়ার সবই ছুটে গেছে। আঘাতের চোটে মনে হচ্ছে হাড়গোড় গুঁড়ো হয়ে গেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বসার আগেই এক লাথিতে ছিটকে পড়ল ও একপাশে। আরেকবার লাথি এসে লাগার আগেই লির একটা পা ধরে ফেলল ও। অন্যহাতে মাটি থেকে তুলে নিল নিজের ছুরিটা। লি ভেবেছিল শামানকে সে কাবু করে ফেলেছে। ওই অবস্থাতেই শামান লির তলপেটে আঘাত করল।

যদিও ওর আঘাতটা খুব সহজেই ঠেকিয়ে দিয়েছে লি, কিন্তু ওটা ঠেকাতেই শুরু হলো আসল আক্রমণ। লির জড়ো করা হাতটা একসঙ্গে ধরে ফেলল শামান। সেইসঙ্গে নিজের শরীরটাকে মুহূর্তের জন্যে অনেকটা স্প্রিংয়ের মতো গুটিয়ে সেটাকে ছড়িয়ে দিল লির দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে। লির পেছনে পৌঁছে সোজা হয়ে সর্বশক্তিতে নিজেকে টান দিল লির জড়ো করা দুই হাত ধরে। ফল হলো ভয়াবহ।

অনেকটা উড়ে গিয়ে উলটো দিকে ছিটকে পড়ল লি। নিজেকে সামলে নিয়ে মাটি থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল শামান। লির মধ্যে উঠে বসার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। প্রথমে শামানের দলের লোকেরা উল্লাসধ্বনি করে উঠল, এরপর ওদের সঙ্গে যোগ দিল গ্রামবাসীরা।

কিছুক্ষণের ভেতরেই লিসহ তার দলের বাকি লোকদের বন্দি করে বুঝিয়ে দেয়া হলো গ্রামবাসীদের মোড়লের কাছে। বয়স্ক মোড়ল লোকটা ওর কাছে এসে ওর দুই হাত ধরে ফেলল কৃতজ্ঞতায়। স্থানীয় ভাষার সঙ্গে ভাঙা তিব্বতি মিশিয়ে সে বলে উঠল। ‘আপনারা না থাকলে আজ আমাদের গ্রামটা তছনছ হয়ে যেত, তার দুই চোখে পানি চলে এসেছে।

শামান তার হাত শক্ত করে ধরে বলে উঠল। ‘এটাই তো আমাদের কাজ।’ ওর পেছনে দলের লোকেরাও এসে দাঁড়িয়েছে। কয়েকজন বেশ আহত হয়েছে। বাকিদের প্রায় সবার অবস্থাই বিধ্বস্ত।

মোড়ল আরেকবার এসে ওকে ধন্যবাদ জানাল। তারপর একে একে ওর দলে সবাইকে। ধন্যবাদ জানানো শেষ করে সে শামানের দিকে ফিরে বলল, ‘কাল মাঝরাতে আপনারা গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসার পর আপনার নামে একটা বার্তা এসেছে,’ বলে সে জামার ভেতর থেকে একটা গোল করা চামড়ার ফালির মতো দেখতে জিনিস বের করে দিল

ওপরে বিশেষ এক ধরনের সুতো দিয়ে বাঁধা জিনিসটা। সুতোর ওপরে একটা বিশেষ সিলমোহর বসানো। ওটা দেখে একটু চমকে উঠল শামান। বার্তাটা খুলে পড়ল ও।

‘কি ব্যাপার, ওস্তাদ? কোনো বিশেষ খবর?’ ওর পাশ থেকে খোম্বু জানতে চাইল। একটু আগের যুদ্ধে গাল কেটে গেছে তার। সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু মুখে হাসি।

তবে তার হাসিতে যোগ দিতে পারল না শামান। একবার দিগন্তের দিকে দেখে নিয়ে ও খোম্বুসহ দলের বাকি সবার দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘আমার নামে একটা বিশেষ বার্তা এসেছে,’ বলে ও একটু থেমে যোগ করল। ‘খোম্বু, আমি না ফেরা পর্যন্ত তোমাকে দলের নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছি। তোমরা ডেরায় ফিরে যাও, আপাতত আমার আর ফেরা হচ্ছে না। কারণ আমাকে শান্তির মঠে যেতে হবে, সবার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে ও আবারো ফিরে তাকাল দিগন্তের দিকে। নিজের বাড়ি থেকে ডাক এসেছে তার।

ফিরে যেতে হবে ঘরে, নিজের শৈশবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *