প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ১

অধ্যায় এক – বর্তমান সময়
তামাবিল বর্ডার, সিলেট

প্রকৃত সুখ সম্ভবত একেই বলে। এই মুহূর্তে সত্যিকার অর্থেই নিজেকে তার পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে।

চার বছরের কঠিন প্রচেষ্টার ফল অবশেষে হাতে এসেছে। তার মতো গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ এত লম্বা সময় ধরে যে ব্যাপারটার পেছনে লেগেছিল, সেটা যদি সফল না হতো তবে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতো না। তবে এখন সফলতার সময়, সাফল্য উপভোগ করার সময়। আনমনেই একবার সে ট্রাকের পেছনের ছোটো ফোকরটা দিয়ে ফেলে আসা তামাবিল বর্ডারের দিকে ফিরে তাকাল।

তার প্রচেষ্টার শেষ বাধা ছিল বর্ডারটা পার হওয়া, সেটা যেহেতু কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই পার হওয়া গেছে, আর তেমন কোনো ঝামেলা নেই। স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে আনমনেই একবার মাথা ঝাঁকিয়ে ঘড়ি দেখল সে।

এয়ারপোর্টে পৌছাতে আরো কমপক্ষে দুই ঘণ্টার যাত্রা। কপাল ভালো হলে সময় আরেকটু কম লাগতে পারে। হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে চোখ বুজল সে। ক্লান্তি লাগছে। সেই লন্ডনের রয়াল ক্লাব থেকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের লাইব্রেরি। এরপরে সেখান থেকে যে যাত্রার শুরু হয়েছিল অবশেষে সেটা শেষ হতে চলেছে। কথাটা মনে হতেই তার মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি।

যাত্রা আসলে শেষ নয়, বরং শুরু হতে চলেছে। এই যাত্রা নতুন জীবনের যাত্রা। এ জীবন হবে অন্য এক জীবন।

আজ থেকে চার বছর আগে, সময়টা তখনো খারাপ কাটছিল না। থাইল্যান্ড থেকে দামি একটা অ্যান্টিক মেরে দিয়ে ইংল্যান্ডের ব্ল্যাক মার্কেটে সবেমাত্র সেটার নিলাম শেষে সে ভাবছিল কিছুদিন বিশ্রাম নেবে। পুরনো দুয়েকটা ক্লাবে ঢুঁ মারবে। ইয়ট ভাড়া করে ইউরোপ ঘুরে বেড়াবে, এমন সময় পুরনো এক ক্লাবেই এক বন্ধুর মাধ্যমে তার পরিচয় হয় প্রফেসরের সঙ্গে।

দুজনেই দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী, তাই আড্ডা জমতে বেশি সময় লাগেনি। কথায় কথায় সে প্রফেসরের কাছে জানতে পারে এক অদ্ভুত রহস্যের কথা। দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মানবসভ্যতার আড়ালেই রয়ে গেছে এই রহস্য। শুধু মিথটা প্রচলিত হয়ে রয়ে গেছে মানুষের মুখে মুখে। ব্যাপারটা শুনে প্রথমে সে খুব বেশি পাত্তা দেয়নি কিন্তু পরবর্তীতে বিষয়টার গভীরত্ব অনুভব করে মাথা গরম হয়ে উঠেছিল তার। প্রফেসরের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে শুরু হয় দুজনের গবেষণা আর খোঁজ।

এক বছরের পড়ালেখা, আর এরপর বিস্তর খোঁজখবর করে তারা যখন প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছে এমন সময় ভাগ্য এগিয়ে আসে তাদের সহায়তা করার জন্যে।

নেপাল ভূমিকম্প।

২০১৫ সালে নেপালের সেই ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের পর উল্টেপাল্টে যায় অনেক কিছু। সেই ভূমিকম্পের পর নেপালের থামেল থেকে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনি, লুম্বিনি থেকে ভক্তপুর পর্যন্ত পিছু নিয়ে তারা খুঁজে বের করতে সক্ষম হয় সেই ঐতিহাসিক সূত্র-যেটার সন্ধান অনেকেই করেছে কিন্তু খুঁজে বের করতে পারেনি কেউই। তারাও পারত না, যদি নেপালের সেই ভূমিকম্পটা না ঘটত। নেপালের সেই ভূমিকম্পের পর লম্বা সময় ধরে খুঁজতে থাকা মানুষটার সন্ধান পায় তারা, কারণ ভূমিকম্পের সময়ে বেশ আহত হয়ে প্রায় মরার দশা হয়েছিল লোকটার।

তবুও মানুষটা মুখ খুলত না যদি না তার সঙ্গে একটা বিশেষ সমঝোতায় আসা যেত। যাই হোক অবশেষে মানুষটা তাদের জানায়, কোথায় আছে সেই মহার্ঘ বস্তু—যেটার সন্ধানে গত কয়টা বছর ধরে অর্ধেক পৃথিবী চষে ফেলেছে তারা। নেপাল থেকে ওটার সন্ধান বের করে তারা চলে যায় আসামে। এবার শুরু হয় আসামের গহিন জঙ্গলে ট্র্যাক ডাউন। দীর্ঘ সময়ের কঠিন অনুসন্ধানের পর অবশেষে খুঁজে বের করতে পেরেছে…

ট্রাকের সামনে থেকে ঠক ঠক শব্দ হলো। সামনের ছোটো কাঠের প্যানেলটা সরিয়ে সে জানতে চাইল, ‘কি ব্যাপার, রঘু? কি হয়েছে?’

‘স্যার, সাইমনে পাথরের টেরাকের লাম্বা লাইন, মূল রাস্তা দিয়াই যায়ার,

নাই ভিতরে দিয়া যায়ার?’ আধা আসামিজ আর আধা বাঙালি ড্রাইভার রঘুবীরের বাংলায় অদ্ভুত এক টান।

ড্রাইভারের প্রশ্নটা শুনে এক মুহূর্ত ভাবল সে। মনে মনে হিসেব করল জিনিসটা আসাম থেকে এত করে উদ্ধার করার পর এটাকে ঝুঁকি নিয়ে আবার বাংলাদেশে ঢোকানোর পেছনে অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম একটা কারণ হলো, তার আন্তর্জাতিক কানেকশন যতই থাকুক না কেন চাইলেও সে আসাম থেকে জিনিসটাকে নিয়ে ফ্লাই করার মতো প্লেনের বন্দোবস্ত করতে পারেনি। তাই তামাবিল বর্ডার দিয়ে ঢুকে তারা সোজা চলে যাবে সিলেট এয়ারপোর্ট। সেখানে আগে থেকেই চার্টার করা প্লেন ঠিক করা আছে। জিনিসটাকে নিয়ে স্রেফ প্লেনে তুলে দিলেই তার লোকেরা ফ্লাই করবে। আরেকবার ঘড়ি দেখল সে।

চার্টার প্লেনটা ছাড়ার জন্যে যে সময় নির্দিষ্ট করা আছে সেটা পূরণ হতে আরো ঘণ্টা দুয়েক সময় এখনো বাকি। কিন্তু ঝুঁকি নেয়ার দরকার নেই। ‘মূল রাস্তা থেকে নামিয়ে শর্টকাটে চলো।’

তার অনুমতি পেতেই ড্রাইভার আরেকটু এগিয়েই ট্রাকটাকে মূল রাস্তা থেকে সরু একটা কাঁচা রাস্তায় নামিয়ে দিল। এতক্ষণ বেশ স্থির ভঙ্গিতে চললেও এবার হেলেদুলে ঝাঁকি খেতে খেতে এগিয়ে চলল ট্রাক। ঝাঁকির কারণেই কি না কে জানে তার পাশেই শুয়ে থাকা ঘুমন্ত প্রফেসর নড়ে-চড়ে উঠল। আসাম থেকে রওনা দেয়ার সময়ে তাকে হেভি সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। নিশ্চয়ই সেটার মেয়াদ এতক্ষণে শেষ হয়ে আসছে। আসাম থেকে জিনিসটাকে নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পেছনে আরেকটা কারণ হলো এই প্রফেসর।

তাকে আসামে মেরে ফেলে রেখে এলে কোনোভাবে যদি তার পরিচয় উদ্ধার হয়ে যেত তবে সর্বনাশ হতো। এ কারণেই তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে হয়েছে। প্রফেসরকে নিয়ে কী করবে এই ব্যাপারে একটা পরিকল্পনা আছে তার। এয়ারপোর্টে পৌছে প্লেনে ওঠার আগেই ব্যাপারটা সামলাতে হবে। সেই সঙ্গে আরো একজনের ব্যাপারে ফয়সালা করতে হবে।

প্রফেসর ধর-মর করে উঠে বসেই পানি খেতে চাইল। এক হাতে মোবাইল প্যান্টের পকেটের ভেতরে পিস্তলটা চেপে ধরে অন্যহাতে পানির বোতল এগিয়ে দিল তার দিকে। ঢক ঢক করে পানি গলায় ঢেলে দিয়ে খানিকটা ছিটিয়ে দিল সে নিজের চোখে-মুখে। ‘আমরা এখন কোথায়?’ কড়া সিডেটিভের কারণে তার গলার স্বর খানিকটা অস্পষ্ট।

‘আমরা আধাঘণ্টা আগে তামাবিল বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশের প্রবেশ করেছি,’ খুব শান্ত স্বরে কথাটা বলল সে।

কিন্তু তার কথার প্রতিক্রিয়া হলো সাংঘাতিক। প্রফেসর পানির বোতলটা ফেলে দিয়ে ঝট করে ফিরে তাকাল তার দিকে।

‘তারমানে আমি প্রায় পনেরো ঘণ্টার মতো ঘুমিয়ে ছিলাম,’ বলে সে মাথা নাড়তে লাগল। ‘এটা কিছুতেই স্বাভাবিক ঘুম হতে পারে না। তুমি আমাকে কিছু একটা করেছিলে!’ অবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা নাড়তে লাগল প্রফেসর। ‘এতসব কিছুর পরেও! তুমি কিভাবে…’ কথাগুলো বলতে গিয়ে সে চুপ হয়ে গেল। তার মাথার ভেতরে কিছু একটা জট পাকিয়ে উঠেছে। কিছু একটা পরিষ্কার ধরতে পারছে সে। ‘তুমি আসামিজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ না করেই ওটাকে নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছো, তাই না? তার মানে উলফাদের সিস্টার কনসার্নের সঙ্গে এত মারামারি করে উদ্ধার করা জিনিসটা তুমি…’

আর লুকিয়ে লাভ নেই। পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে প্রফেসরের দুই চোখের মাঝখানে চেপে ধরল সে। ‘একেবারে ঠিক ধরতে পেরেছেন আপনি, তবে একটু দেরিতে…’ বলে সে হাসতে লাগল। তার সঙ্গে যোগ দিল ট্রাকের ভেতরে থাকা তার অস্ত্রধারী দুই সঙ্গী।

‘প্রফেসর, আপনি যত বোকাই হোন না কেন, একটা কথা বলতে দ্বিধা নেই। এই পুরো ব্যাপারটাতে আপনি যা করেছেন-যে খেল দেখিয়েছেন। বিশেষ করে নেপাল থেকে ওই ব্যাটার নির্দেশনা অনুসরণ করে যে তীক্ষ্ণ মেধার সঙ্গে জিনিসটা আপনি খুঁজে বের করেছেন সেটা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে যা কেউ পারেনি আপনি সেটা করে দেখিয়েছেন। আপনি সত্যিই অতুলনীয়।’

কিন্তু তাতে লাভ কি হলো? জিনিসটা আমি ভুল লোকের হাতে তুলে দিলাম, প্রফেসরের মাথা আনমনেই নিচু হয়ে গেছে। ‘এখন কি করতে চাও তুমি?’

এক মুহূর্ত ভাবল সে। কিছুই না, প্রফেসর। আপনি চুপচাপ বসে থাকুন, আর ঘণ্টাখানেকের ভেতরে আমরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাব। এরপর আমি আমার রাস্তায়, আপনি আপনার রাস্তায়। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে এটুকু আমি করতেই পারি।’

‘আর জিনিসটা?’ প্রফেসর অসহায়ের মতো জানতে চাইল।

সে পিস্তলটা নামিয়ে আবারো পকেটে রেখে দিতে চাচ্ছিল কিন্ত তার আগেই চরম বিস্ময়ের সঙ্গে প্রফেসরের দিকে তাকাল। মনে মনে সে ভাবতে লাগল, এত মেধাবী একটা লোক এতটা বোকা হয় কিভাবে। সে বলেছে, এয়ারপোর্টে পৌঁছে তাকে ছেড়ে দেবে আর এই লোক সেটা বিশ্বাস করে বসে আছে। কোথায় সে নিজের প্রাণ বাঁচানোর কথা ভাববে, উলটো সে জিনিসটার কথা জানতে চায়।

‘প্রফেসর, আপনি একটা গর্দভ। নিম্ন মানের গর্দভ,’ বলে সে একটু এগিয়ে এলো প্রফেসরের দিকে। ‘শুনুন, আপনি ওই জিনিসটার কথা বাদ দিয়ে নিজের পরিণতি নিয়ে ভাবুন। কারণ আমি যা বলেছি সেটা মিথ্যে। আমি আসলে আপনাকে…’ কথাটা শেষ করার আগেই হঠাৎ স্কিড করে থেমে গেল ট্রাক। একে তো কাঁচা রাস্তা তার ওপরে ঝাঁকি খেয়ে থেমে যাওয়াতে ট্রাকের ভেতরের লোকজন একে অপরের গায়ে ছিটকে পড়ল।

নিজেকে সামলে নিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলার কাঠের ছোটো প্যানেলটা সরিয়ে ধমকে উঠল সে, ‘রঘুবীর, হলোটা কি? এভাবে কেউ গাড়ি থামায়!

হুজুর, সামনে একটা চেকপোস্ট, হামাদেরকে গাড়ি থামার ইশারা করেছে।’ ‘কী, চেকপোস্ট! এখানে? অসম্ভব। দেখি,’ বলে সে গলা বাড়িয়ে দিল। অন্ধকারের ভেতরে কমলা রঙের একটা পুলিশি আলো চমকাতে দেখা যাচ্ছে। এক মুহূর্ত ভাবল সে, ‘ঠিকই আছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাও। উলটোপাল্টা কিছু করো না। আমাদের কাছে সব কাগজপত্র আছে। কাজেই কোনো সমস্যা হবে না,’ বলে সে নিজের দুই অস্ত্রধারী সঙ্গী আর প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘সবাই সাবধান, সামনে একটা পুলিশ চেকপোস্ট দেখা যাচ্ছে। ওরা সম্ভবত ইয়াবার চালান বা তামাবিল বর্ডার দিয়ে প্রবেশ করা অবৈধ কিছুর খোঁজে সার্চ করছে। আমাদের সঙ্গে সব কাগজ আছে, কাজেই কোনো সমস্যা হবে না। তবে সবাই অস্ত্র সামলে স্বাভাবিক হও।’

হঠাৎ এই মাঝরাতে জঙ্গলে চেকপোস্টের সামনে পড়াতে সব পরিকল্পনার বারোটা বাজতে চলেছে। তবে ঠান্ডা মাথার লোক সে, সব সামলে নিতে পারবে, শুধু প্রফেসরকে ঠিক রাখতে হবে। কাঠের প্যানেলটা সরিয়ে ড্রাইভারকে ডাক দিল, ‘রঘুবীর।’

ধপ করে একটা শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রাকের সামনের কাচ ফেটে গেল। ছোটো একটা চিৎকারের সঙ্গে ট্রাকের হুইলের ওপরে গড়িয়ে পড়ল রঘুবীর। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকের মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। শব্দটা কিসের ঠিকই চিনতে পেরেছে সে। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল দিয়ে গুলি করেছে কেউ রঘুবীরকে। তার মানে সামনে পুলিশি চেকপোস্ট নয় বরং কেউ অ্যামবুশ করেছে।

কথাটা ভেবে শেষ করার আগেই মৃত ড্রাইভারের শরীরের নিচে ড্রাইভিং হুইলটা পাক খেয়ে ট্রাকের মাথাটা ঘুরে গেল ডান দিকে। রাস্তা থেকে নেমে ট্রাকটা গিয়ে বাড়ি খেল একটা গাছের সঙ্গে। ট্রাকের ভেতরে উল্টে-পাল্টে পড়ল সবাই।

সবার আগে নিজেকে সামলে নিল সে। প্রথমেই তাকাল প্রফেসরের দিকে। তাদের জন্যে পুরো ব্যাপারটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো হলেও প্রফেসরের জন্যে অ্যামবুশটা একটা আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছু নয়।

তবে প্রফেসরের ভেতরে সুবিধা কাজে লাগানোর মতো কোনো ভাব দেখা গেল না। সেও অন্যদের সঙ্গে উল্টেপাল্টে পড়ে আছে। একবার প্রফেসরকে দেখে নিয়ে আরেকবার ট্রাকের মেঝেতে মুড়িয়ে রাখা জিনিসটাকে দেখল সে। ধাক্কা লাগলেও ওটার কোনো ক্ষতি হয়নি। বাইরে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, সব নীরব। এই নীরবতা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। চট করে পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে আনল। ‘বেরোও, সবাই বেরোও এক্ষুণি,’ বলে সে পিস্তল হাতেই ট্রাকের পেছনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। একটানে তুলে ফেলল কার্গো ট্রাকের পেছনের ডালাটা।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শক্তিশালী ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় চোখ ঝলসে গেল। ‘সারেন্ডার, সারেন্ডার করুন। অস্ত্র ফেলে দিয়ে সারেন্ডার করুন,’ ভাঙা ভাঙা একটা গলা বলে উঠল।

‘দেখুন আপনারা ভুল করছেন, জানি না আপনারা কাদেরকে…’ বলতে বলতেই সে ট্রাকের নিচে নেমে এলো। পিস্তলটা এরই মধ্যে কোমরের পেছনে লুকিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কথা শেষ করার আগেই তার পায়ের কাছে এক পশলা গুলি এসে লাগল।

‘খবরদার! কোনোরকম চালাকির চেষ্টা চলবে না। হাত ওপরে তুলে ট্রাক থেকে সবাই বেরিয়ে আসুন।’

ফ্ল্যাশ লাইটের ওপাশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরটা শুনে সে ভেতরে ভেতরে চমকে উঠেছে দুটো কারণে। একে তো প্রথমে ভেবেছিল ওরা হয়তো ভুল করেছে কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়। ওরা মোটেই ভুল করেনি। দ্বিতীয়ত যে লোকটা কথা বলছে তার কণ্ঠস্বর শুনেই সে আন্দাজ করতে পারছে মানুষটা কে হতে পারে। মানে পুরো ব্যাপারটার ভেতরে বিরাট ঘাপলা আছে। এখন চালাকি না করলে খবর আছে।

‘দেখুন আপনারা বুঝতে পারছেন না। আমরা সরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল, আমরা…’ কথা বলতে বলতেই সে মাথার ওপরে তুলে রাখা হাতে বিশেষ একটা ইশারা করল। ট্রাকের ভেতরে থাকা তার দলের লোকজনের অবশ্যই বুঝে ফেলা উচিত এর মানে কি। সে কথা বাড়াতে লাগল। ‘স্রেফ গবেষণার কাজে…’ তার কথা শেষ হবার আগেই ট্রাকের ভেতর থেকে উড়ে এলো কিছু একটা। মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওটা ফেটে গিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরোতে লাগল।

আসামের জঙ্গলে ক্যাম্প করার আগে এই স্মোক ক্যান দিয়ে তারা পোকামাকড় আর মশা পরিষ্কার করত। ক্যানটা ফাটতেই ধোঁয়ার চোটে ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ঘোলাটে হয়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে নিজের লোকদের উদ্দেশে চিৎকার করে মাটিতে একটা গড়ান দিয়ে পিস্তলটা বের করে ফ্ল্যাশ লাইট লক্ষ্য করে অন্ধের মতো গুলি চালাল সে। গুলি লাগল কি লাগল না, সেটা দেখার সময় নেই। সে দৌড় দিল ট্রাকের সামনের দিকে। কোনোমতে ট্রাকটাকে চালু করতে হবে। কারণ এই ট্রাক আর জিনিসটাকে ফেলে সে কিছুতেই পালাবে না।

ট্রাকের সামনের দিকে প্রায় পৌঁছে গেছে এমন সময় শক্ত কিছু একটা এসে বাড়ি মারল তার পায়ে। তীব্র বেগে দৌড়ানো অবস্থায় প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল সে মাটিতে। ব্যথার চোটে অন্ধকারের ভেতরে আরো অন্ধকার দেখছে চোখে। হাত থেকে পড়ে গেছে পিস্তলটা। পরিষ্কার দেখতে না পেলেও অনুভব করল কেউ একজন শক্তিশালী হাতে তাকে খানিকটা শূন্যে তুলে ফেলল।

খানিকটা তুলেই আছড়ে ফেলল মাটিতে। তারপর আবার, তারপর আবার। তীব্র ঝাঁকিতে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছে তার। যেকোনো সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে মনে হচ্ছে। এবার আর মাটিতে আছড়াল না কেউ তাকে বরং দুজনে মিলে দাঁড় করিয়ে দিল। সেই সঙ্গে কেউ একজন বিজাতীয় ভাষায় তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠল।

‘বেশি চালাকি, না? ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা? একমাত্র আমরাই জানি তুমি কে, বলে খনখনে গলায় হেসে উঠল মানুষটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *