অধ্যায় বত্রিশ – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
মন্তলার হাট, কন্নোর, ভারতবর্ষ
ময়লার স্তূপের এখানে সেখানে খুঁজতে খুঁজতে ওরা যখন প্রায় ক্লান্ত হয়ে হাল ছাড়ার দশা তখনই ঘোষিত আর জাথুরিয়ার দলের একজন হঠাৎ চিৎকার করে বাকি সবাইকে ডাকল। মাটির কিনারা আর ময়লার স্তূপ যেখানে খালের সঙ্গে মিশেছে সেখানে পানির কাছাকাছি ঝোপঝাড়ের দঙ্গলের ভেতরে সে নাকি কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। অন্যদেরকে খোঁজ চালিয়ে যেতে বলে কাছাকাছি থাকা ঘোষিত চলে এলো লোকটার কাছে।
ঝোপের কাছাকাছি পানিতে বিভিন্ন হাবিজাবির সঙ্গে বেশ বড়ো আকৃতির কিছু একটা আছে বলে মনে হচ্ছে, তবে সেটা পানির খোলা ঝোপঝাড়ের অংশ হওয়াটাও একেবারে বিচিত্র নয়।
‘জিনিসটা ভালোভাবে দেখে নিয়ে লোকটাকে ঘোষিত বলল, ‘এক কাজ কর, বড়ো একটা লাঠি দিয়ে ওটাকে টেনে আন।’
একটু খুঁজে পেতেই একটা বড়ো একটা বাঁশের লাঠি দিয়ে টেনে আনার চেষ্টা করল সে জিনিসটা কিন্তু নাগাল না পেয়ে অবশেষে পানিতে নামতে হলো। লোকটা কোমর পানিতে নেমে জিনিসটা টেনে নিয়ে এলো একেবারে পাড়ের কাছে। ওপরের আবরণটা সরাতেই খুশিতে প্রায় চিৎকার করে উঠল ঘোষিত। ‘এই পেয়েছি। এইদিকে চলে আয় সবাই।’
বাকিদেরকে নিয়ে জাথুরিয়া চলে এলো ঘোষিতের কাছাকাছি।
ভেলার মতো জিনিসটার ওপর থেকে ঝোপের মতো দেখতে লাতা-পাতার দঙ্গল সরাতেই দেখা গেল কাঠের বড়ো বড়ো টুকরো জোড়া লাগিয়ে অনেকটা ভেলার মতো বানিয়ে সেটার ওপরে পাতলা আচ্ছাদন দিয়ে তার ওপরে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটা তলোয়ার-তির ধনুক আর বর্শা। শাবাশ,’ ঘোষিতের পাশ থেকে বলে উঠল জাথুরিয়া। ‘আর নেই? একটাই পাওয়া গেছে?’ জনতে চাইল সে।
জাথুরিয়ার প্রশ্ন শুনে পানিতে থাকা লোকটাকেও একই প্রশ্ন করল ঘোষিত। ‘না ওস্তাদ, আর নাই, একটাই আছে,’ লোকটা ময়লা ইত্যাদির আড়ালে উঁকি-ঝুঁকি মারতে মারতে জানাল।
‘দরকার নেই, সময় কম, যত দ্রুত সম্ভব এগুলো পৌঁছাতে হবে ওদের কাছে, বলে উঠে ঘোষিত বাকিদেরকে নির্দেশনা দিতে লাগল জিনিসটা উঠিয়ে আনার জন্যে।
‘এই কি হইচ্ছে এখানে?’ কড়া গলায় ধমক শুনে ফিরে তাকাল সবাই। ছয়- সাতজন সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে ঘোষিত মাটি থেকে তুলে আনা অস্ত্রের স্তূপটার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াল যেন সৈন্যদের দল সেটাকে দেখতে না পায়। কিছু না, হুজুর, আমরা,’ বলেই সে পাশে দাঁড়ানো নিজেদের লোকটার মাথায় একট চাটি মারল। ‘আর বইলেন না হুজুর আমরা ঝালাইকার, আর আমার দলে এই গাধাটা ঝালাই করার যন্ত্রপাতি পানিতে ফালায়া দিছে,’ বলেই সে আবার নিজের লোকটার দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘যা তুই উঠায়া আন পানি থাইক্কা,’ সৈন্যদের দিকে ফিরে একটা বোকা বোকা হাসি দিল সে। ওর হাসির সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরাও হাসতে লাগল।
‘আমারে একটা কথা, ঘোড়ার ওপরে বসা নেতাগোছের সৈন্যটা মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘তরা হইলি ঝালাইকার, তরা বাজারে না বইসা এইহানে কী করছ?’
‘আমরা, আমরা…’ ঘোষিত কথা খুজে না পেয়ে জাথুরিয়ার দিকে ফিরে তাকাল।
‘শোন্, গাধার বাচ্চারা, আমরা অনেকক্ষণ ধইরা তগো ওপরে নজর রাখতাছি, তরা…’ দ্বিতীয় একজন সৈন্য বলে উঠল। তবে সে কথা শেষ করার আগেই জাথুরিয়া নড়ে উঠল। সে যেই বুঝতে পেরেছে ঘোষিত ওদের সঙ্গে কথায় পারবে না-একটু একটু করে নড়তে শুরু করেছিল, লোকটার কথার মাঝে হঠাৎ ঘোষিতের বান্ডিল থেকে একটা বর্শা বের করে ছুঁড়ে দিল সৈন্যদের দিকে। কিন্তু লোকটা সাবধান ছিল, জাথুরিয়ার ছুঁড়ে দেয়া বর্শাটা খুব সহজেই এড়িয়ে গেল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ধনুক তুলে তির যোজনা করতে শুরু করল জাথুরিয়ার দিকে। লোকটা তির ছোড়ার আগেই পেছন থেকে বিধুর ছুঁড়ে দেয়া তির গলা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল তার। ঘোষিত আর জাথুরিয়া যে যার অস্ত্র তুলে নিয়ে সৈন্যদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সেইসঙ্গে সৈন্যদলের পেছন থেকে তাদের ওপরে আক্রমণ চালাল বিধু আর ধোয়ীর দল।
মদারু ওদেরকে সাবধান করে দিতেই ওরা ঘোষিতদের সাহায্য করতে জলধারার কিনারায় এসে শাক্য সৈন্যদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ চালায়। দুই দলের সম্মিলিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে উঠল শাক্য সৈন্যরা। যেখানে ওরা কোনো প্রতিরোধই আশা করেনি বরং ভেবেছিল ফাঁদ পেতে ধরবে দলটাকে সেখানে দুই দলের সম্মিলিত আক্রমণে কচুকাটা হয়ে গেল কিছুক্ষণের ভেতরেই।
সৈন্যদেরকে নিকেশ করে তাদের অস্ত্র আর ঘোড়া দখল করে নিল ওরা। নিজের বর্শার ওপরে ভর দিয়ে জাথুরিয়ার দিকে ফিরে ধোয়ী সরল মুখে মৃদু টিটকিরির হাসি হেসে বলে উঠল, ‘বর্শা কিভাবে মারতে হয় শিখতে এখনো তোমার দেরি আছে।’
জাথুরিয়া রাগের সঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ঘোড়ার পিঠে চড়া বিধু তাড়া লাগাল সবাইকে। ‘জলদি জলদি, ওস্তাদ শামান আর ওদেরকে সতর্ক করে দিতে হবে, ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে ওরা। আমরা অস্ত্র যা পেয়েছি—’
সে কথা শেষ করার আগেই বাজারের অন্য দিক থেকে শিঙ্গার শব্দ ভেসে এলো। প্রায় সবাই একসঙ্গে ফিরে তাকাল যেদিক থেকে আওয়াজ ভেসে এসেছে সেদিকে, নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু ঘটছে ওদিকে।
***
রাজা বিক্রমাদিত্যকে ঘোড়ার গাড়ির ভেতর থেকে বাইরে ফেলে দেয়ার পর বলতে গেলে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো মঞ্চের দিকে। সেইসঙ্গে বাকি বৌদ্ধ শ্রমণদেরকেও। তিন শ্রমণ আর বিক্রমাদিত্যকে টেনেহিঁচড়ে মঞ্চের ওপরে তুলে জোর করে বসিয়ে দেয়া হলো হাঁটু গেড়ে।
একটু পরেই দুই পাশে সৈন্যদের সারি নিয়ে মঞ্চের ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল লিচ্ছবীদের রাজা হেমচন্দ্র।
একটানে কালন্তির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল শামান। ‘সময় নেই, আমি কী বলি মনোযোগ দিয়ে শোন,’ বলে সে কালন্তির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কথা বলতে শুরু করল। বলা শেষ হতেই কালন্তি রীতিমতো ঝামটে উঠল। ‘শামান, তুমি যা করতে যাচ্ছে সেটা বোকামি হবে, বিধু ঘোষিত অস্ত্র নিয়ে না পৌঁছালে…’
‘ওরা অস্ত্র নিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সব শেষ হয়ে যাবে,’ বলেই সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে নিজের লোকদের সাবধান হতে বলে ফলের ঝুড়ির একপাশ থেকে টান দিয়ে তুলে নিল একটা দড়ির বাণ্ডিল। সেটাকে নিজের কোমরের সঙ্গে আটকে নিয়ে দ্রুত রওনা দিল মঞ্চের দিকে। শরীর বাঁকিয়ে লোকজনের ভিড় ঠেলে প্রায় পৌঁছে গেল মঞ্চের কাছাকাছি। ওর উদ্দেশ্য মঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছে মঞ্চের নিচে ঢুকে যাবে। মঞ্চের একবারে গোড়ার দিকে পৌঁছে গেছে এমন সময় কানে এলো মঞ্চের ওপর থেকে রাজা হেমচন্দ্র জনতার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কিছু একটা বলতে শুরু করেছে, ‘সম…’ শামান মঞ্চের প্রায় কাছে পৌঁছে গেছে হঠাৎ রাজার গলা ছাপিয়ে বেজে উঠল একটা শিঙ্গার আওয়াজ।
রাজাও তার কথা থামিয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, শামানও থেমে গেছে মঞ্চের কাছে। আবারো জোরে বেজে উঠল শিঙ্গা। শামান বুঝতে পারছে না শব্দটা আসছে কোথা থেকে, এটা বাজানোই বা হচ্ছে কী কারণে। আনমনেই ওর হাত চলে গেল নিজের পিঠের কাছে। অস্ত্র যে নেই সেটা মনেই নেই ওর। মনের ভেতরে বিপদসংকেত বেজে উঠেছে, হঠাৎই মঞ্চের নিচ থেকে বেরিয়ে এলো বেশ কয়েকজন সৈন্য, ওদের সঙ্গে রাজার পাহারাদারদের কয়েকজন যোগ দিয়ে ঘিরে ধরল শামানকে। আচমকা একেবারেই হঠাৎ নিজেকে ও আবিষ্কার করল একদল সৈন্যের মাঝখানে।
একজন এগিয়ে এসে ওকে ধরার চেষ্টা করতেই তাকে ঘুসি মেরে ফেলে দিল শামান। দ্বিতীয় একজনকে ফেলে দিল লাথি মেরে, তৃতীয় একজন খোলা তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপরে, তলোয়ারের কোপ এড়িয়ে লোকটাকে ধরতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে চারজনে মিলে ধরে ফেলল ওকে। একজন এগিয়ে এসে খপ করে ওর মাথার ওপরে বেঁধে রাখা কাপড়টা টান দিয়ে সরিয়ে দিতেই খোলা লাল চুল ছড়িয়ে পড়ল।
‘লাল চুলের যোদ্ধা ধরা পড়েছে,’ একজন মঞ্চের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠল। তাৎক্ষণিক শামানের কাছে মনে হলো পুরো ব্যাপারটাই একটা সাজানো ফাঁদ ছিল তাহলে। লোকটা মঞ্চের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠেই হাত বাড়াল শামানকে ধরার জন্যে।
বাতাসে শিস কাটার মতো শব্দের সঙ্গে তার হাতটা আটকা পড়ে গেল একটা চামড়ার ফালির সঙ্গে। ফালিটা ধরে শক্ত টান পড়তেই উল্টে পড়ে গেল লোকটা। শামান দেখল চাবুক ছুঁড়েছে কালন্তি।
সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠল শামান। ওকে ধরে থাকা একজনের হাঁটুর ওপরে লাথি মারতেই একটু আলগা হয়ে গেল, টান দিয়ে নিজের একটা হাত ছুটিয়ে ফেলল ও। খোলা হাত দিয়ে ঘুসি বসিয়ে দিল অন্য হাত ধরে থাকা লোকটাকে। ঘুসি খেয়ে দুর্বল হয়ে গেলেও সে ছাড়ল না ওকে। বরং আরো কয়েকজন মিলে ধরে ফেলল ওকে। লোকগুলো এখনো তলোয়ার চালায়নি, সম্ভবত ওকে জীবিত ধরার নির্দেশ আছে ওদের ওপরে।
শামানকে বন্দি করেই ওকে সবাই মিলে চাপ দিয়ে মাটিতে বসিয়ে দিল। একজন দড়ি হাতে এগিয়ে এলো ওকে বেঁধে ফেলার জন্যে।
খট করে একটা শব্দ হলো অনেকটা কাঠের সঙ্গে কাঠের বাড়ি লাগার মতো। শামান দেখল দড়ি হাতে লোকটার খুলিতে একটা তির এসে বিঁধেছে, ধাম করে সটান মাটিতে পড়ে গেল লোকটা। শামানকে ধরে থাকা আরো একজন উল্টে পড়ল তির খেয়ে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল শামান। ও নিজে যেমন চমকে গেছে, তেমনি ওকে বন্দি করে রাখা সৈন্যরাও চমকে গেছে।
ঘোড়ার খুরের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দেখল চার পাঁচটা ঘোড়া এগিয়ে আসছে, সবার অগ্রভাগে একটা ঘোড়ার ওপরে তির-ধনুক হাতে ঘোড়া চালকের পেছনে বসে আছে বিধু। খুশির সঙ্গে সামনের একজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল ও। আরেকটু এগিয়ে আসতেই, ‘ওস্তাদ,’ বলে এক চিৎকার করে একটা তলোয়ার ওর দিকে ছুঁড়ে দিল বিধু। তলোয়ারটা ছুটে এসে মাটিতে ওর সামনে গেঁথে গেল। ওটাকে তুলে নিয়ে পাগলের মতো কয়েকবার চক্কর কাটাল ও চারপাশে। আশপাশের সবাই খানিকটা দূরে সরে গেছে দেখা মাত্রই কালন্তির দিকে তাকিয়ে একটা চিৎকার করে মঞ্চের দিকে দৌড় দিল ও।
একাধিক সৈন্যকে মেরে কেটে লাফিয়ে উঠে এলো ও মঞ্চের ওপরে। লিচ্ছবী সৈন্যরা একেবারেই বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে, এ কারণে সংখ্যায় অনেক বেশি থাকার পরও তারা সুবিধে করে উঠতে পারছে না।
সৈন্যদের একটা অংশের সঙ্গে বিধু ঘোষিত জাথুরিয়াদের সঙ্গে খণ্ড যুদ্ধ চলছে, অন্য অংশের একটা ভাগ রাজা হেমচন্দ্রকে নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে গেছে কিন্তু তাকে নিয়ে তারা নেমেছে মঞ্চের উলটো দিকে ফলে জাথুরিয়াদের সঙ্গে খণ্ড যুদ্ধের কারণে রাজাকে নিয়ে তারা ঘোড়ার গাড়ির কাছে পৌঁছাতে পারছে না, অন্যদিকে সৈন্যদের বাকি একটা অংশ ঘোড়ার গাড়িতে বসে আছে, মঞ্চের এ পাশে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না ওরা। হেমচন্দ্রের বাহিনীর শেষ অংশটা মঞ্চের ওপর থেকে বুদ্ধ শ্রমণ আর রাজা বিক্রমাদিত্যকে টেনে নামাতে ব্যস্ত।
শামান লাফিয়ে মঞ্চের ওপরে উঠে একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে পুরো পরিস্থিতি ঝালিয়ে নিল। হেমচন্দ্রের সৈন্যদের ভেতরে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা লেগে গেছে। কে কাকে মারছে, আর কাকে মারবে-কাকে ধরবে আর কাকে রক্ষা করবে কিছু বুঝতে পারছে না ওরা। শামান অনুমান করল লিচ্ছবীদের একাধিক বাহিনীকে একসঙ্গে করার ফলেই এমনটা ঘটছে। ওদের ভেতরে একে অপরের ভেতরে সমন্বয় তো নেই তার ওপরে ওরা ভেবেছিল নিরস্ত্র কিছু বুদ্ধ শ্রমণ আর তাদের সম্ভাব্য যোদ্ধাদেরকে কোণঠাসা করে হত্যা করবে। কিন্তু পাশার দান পাল্টে যেতেই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে তারা। এই সুযোগটা পুরোপুরি কজে লাগাতে হবে, যদি ওরা এখান থেকে বেরুতে চায়।
শামান মঞ্চে উঠেই প্রথমে মঞ্চের ওপরে অবস্থানরত তিন সৈনিককে ঘায়েল করল। তারপর প্রথমে বিধু জাথুরিয়াদেরকে নির্দেশ দিল হেমচন্দ্রের সৈন্যদেরকে কবজা করে রাখার। তারপর চিৎকার করে কালন্তিকে বলল প্রবেশদ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটে ঘোড়ার গাড়ির একটা নিয়ে আসার জন্যে।
নির্দেশনা দিয়ে সে চলে এলো মঞ্চের মাঝামাঝি মস্তক ছিন্নকরণের জন্যে বানানোর তিন বেদির দুটোতে দড়ি বেঁধে দিল আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী। কাজ সেরেই সে রওনা দিল মঞ্চের ডান দিকে। ওখানে ছয় সাতজন সৈন্য তিন বুদ্ধ শ্রমণ আর রাজা বিক্রমকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘোড়ার গাড়ির দিকে। এক হাতে তলোয়ার তো ছিলই যাবার পথে মাটি থেকে একটা বর্শা তুলে নিল। একহাতে বর্শা আর অন্য হাতে তলোয়ার নিয়ে মৃত্যু দূতের মতো সৈনিকদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল ও।
কোপ দিয়ে এক সৈনিকের হাতটা ছিন্ন করে দিল শামান। দ্বিতীয় জনের মাথা নামিয়ে দিল সে সতর্ক হবার আগেই। আড়চোখে দেখল তৃতীয় শ্রমণ আর রাজা বিক্রমকে টেনে ঘোড়ার গাড়ির পেছনে তুলছে দুই সৈনিক মিলে। হাতের বর্শাটা মাটিতে পড়ে গেছিল ওটা তুলে নিয়ে সোজা ছুঁড়ে দিল একজনের বুকে। অপরজন ওকে এগোতে দেখে রাজা আর শ্রমণকে ছেড়ে দিয়ে জোরে দৌড় দিল উলটো দিকে
তৃতীয় ভিক্ষু আর রাজা বিক্রমের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠল ও। ‘রাজা বিক্রম, আমার সঙ্গে আসুন,’ বলেই শ্রমণদের আর রাজাকে আগলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই দেখতে পেল পালিয়ে যাওয়া সৈনিকটা গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো প্রবেশদ্বারের কাছে অবস্থানরত সৈনিকদের ডেকে নিয়ে আসছে। ‘জলদি, জলদি, ‘ ওদেরকে নিয়ে মঞ্চের অন্যদিকে রওনা দেবে, তার আগেই কালন্তির ডাক শুনে থেমে গেল ও। দেখল একটা ঘোড়ার গাড়ি এগিয়ে আসছে। ওটার অগ্রভাগে বসে আছে কালন্তি।
শামান মনে মনে হিসেব করে দেখল ঘোড়ার গাড়ি আর প্রবেশদ্বারের কাছে অবস্থান করা সৈনিকেরা প্রায় একই সময়ে পৌঁছে যাবে এখানে। সেক্ষেত্রে ওদেরকে গাড়ির দিকে এগোতে হবে। মঞ্চের ওপর থেকে সেই দড়ির এক মাথা হাতে তুলে নিয়ে বাকিদেরসহ ও যতটা জোরে পারা যায় দৌড়াতে লাগল গাড়ির দিকে। সৈনিকদের তীরের আঘাতে পড়ে গেল আরেকজন শ্রমণ। জীবিত একমাত্র বুদ্ধ শ্রমণ আর রাজা বিক্রমকে নিয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল শামান। বাঁচতে হলে যেভাবেই হোক কালন্তির গাড়ির কাছে পৌছাতে হবে।
কালন্তি গাড়িটাকে নিয়ে এসে এক চক্কর খেয়ে ওটা থেমে গেল ওদের সামনে, প্রথমে রাজা বিক্রমকে তুলে দিল ও গাড়ির ভেতরে। বুদ্ধ শ্রমণকে উঠানোর জন্যে তুলে ধরতেই একটা তির এসে তার কামানো খুলিতে সেঁধিয়ে গেল। শ্রমণের আলগা হয়ে যাওয়া শরীরটা নিয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল ও। রাজা বিক্রম একটা হাত বাড়িয়ে টেনে তুলল ওকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজার কাঁধের একপাশে এসে বিঁধল একটা তির। চিৎকার করে রাজার ঢলে পড়া দেহটা কোনোমতো তুলে গাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে দিল ও।
কালন্তিকে চিৎকার করে গাড়ি ছাড়তে বলল।
‘তুমি?’ কালন্তি ঘোড়ার গায়ে চাবুক হাঁকাতে হাঁকাতে জানতে চাইল। শামান দেখল সৈন্যরা প্রায় পৌঁছে গেছে, কালন্তি গাড়ি ছাড়লেও ওরা নিরাপদে পার হতে পারবে না। ওর চারপাশে এখানে-ওখানে এসে লাগছে তির। যেকোনো সময় একটা এসে বিদ্ধ করতে পারে ওকে, জলদি বেদির সঙ্গে আটকানো দড়ির আলগা শেষ প্রান্তটা বেঁধে দিল ও গাড়ির পেছনে, তারপর চিৎকার করে বলে উঠল। ‘তুমি যাও, যত জোরে পারবে গাড়ি ছোটাবে বুঝেছো?’ কালন্তি কিছু না বলে সর্বশক্তি দিয়ে চাবুক হাঁকাল।
আর শামান দৌড় দিল মঞ্চের দিকে।
কালন্তির গাড়ি ছুটে চলেছে গেটের দিকে, সৈন্যরা ছুটে আসছে শামানের দিকে, শামান মঞ্চের ওপর দিয়ে দৌড় দিল যতটা জোরে পারে। কালন্তির গাড়ি বেশ অনেকটা এগোতেই এক পর্যায়ে টান পড়ল দড়িতে। শামানও থেমে গেল।
মুহূর্তের জন্যে মনে হলো দড়িটা ছিঁড়ে যাবে কিংবা গাড়িটারই শেষ প্রান্ত ভেঙে পড়বে কিন্তু মুহূর্তখানেক আটকে থেকে মড় মড় করে উঠল পুরো মঞ্চ। শামান থেমে গেছিল, মঞ্চ মড় মড় করে উঠতেই আবারো দৌড় লাগাল ও।
কালন্তির গাড়ি গেটের বাইরের দিকে রওনা দিল, আর গাড়ির পেছনে আটকানো দড়িটা বাঁধা ছিল মঞ্চের দুই বেদির সঙ্গে, গাড়িটা মঞ্চের একটা অংশ ভেঙে দিয়ে টেনে নিয়ে চলল ওটার সঙ্গে। প্রবেশদ্বারের কাছ থেকে আসা সৈন্যরা থেমে গেছে, থেমে গেছে বিধুরাও, সবাই তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে। আর শামান দৌড়ে চলেছে ভেঙে পড়তে থাকা মঞ্চের ওপর দিয়ে।
কালন্তির গাড়ি মঞ্চটার একটা অংশ ভেঙে দিয়ে বেরিয়ে গেলে গেট দিয়ে। শামান লাফিয়ে নেমে এলো মঞ্চের অন্যদিকে। বিস্ফোরণের মতো টুকরো হয়ে ওর পেছনে ভেঙে পড়ল পুরো মঞ্চটা।
ওটার এক দিকে আটকা পড়েছে প্রবেশদ্বারের দিক থেকে আসা সৈন্যরা, অন্যদিকে আটকা পড়েছে রাজা হেমচন্দ্রের বাহিনী। শামান মাটিতে নেমে হাঁপাতে লাগল। একাধিক ঘোড়া এসে থামল ওর পাশে। একটা হাত টেনে তুলল ওকে ঘোড়ার ওপরে। বিধু ঘোষিত জাথুরিয়া আর অন্যদের সঙ্গে বাজারের নিচু দেয়াল টপকে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল ওদের ঘোড়ার বাহিনী।
শামান বিধুর পেছনে বসে আছে, ক্লান্তির চোটে মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়বে। জঙ্গলের পথে চলতে চলতে শামানের মনে একটাই ভাবনা জেগে রইল, কালন্তি রাজা বিক্রমকে নিয়ে থারুদের বসতিতে পৌঁছাতে পেরেছে কি না। যদি না পারে তবে এত কষ্টের সবই বৃথা যাবে।
ওদের ঘোড়ার দল জঙ্গলের পথে প্রবেশ করে দুই ভাগ হয়ে গেল। ভিন্ন ভিন্ন পথে এগোবে ওরা। আরো ঘণ্টাখানেকের মতো চলার পর কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই ওরা নির্দিষ্ট বসতিতে এসে পৌঁছাল। সেই কাঠের সেতু পার হয়ে সোজা চলে এলো রাজা মানরু আর শাক্যদের বসতির ওখানে। বাইরেই কালন্তিকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির একটা পরশ বয়ে গেল শামানের শরীরে।
ওকে দেখে প্রায় দৌড়ে এগিয়ে এলো কালন্তি। তার কপালের কাছটায় একটা ক্ষত থেকে রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে আছে। ওকে দেখেই শামান বলে উঠল, ‘তুমি ঠিক আছো?’ কালন্তি মাথা নেড়ে উত্তর দিয়ে প্রায় একই প্রশ্ন করল ওকে।
জবাব না দিয়ে ও জানতে চাইল, ‘রাজা বিক্রম?’
‘ভেতরে আছে,’ বলে ও রাজা মানরুর বাড়ির ভেতরের দিকে দেখাল। শামান কিছু না বলে সোজা চলে এলো বাড়ির ভেতরে। বসার কক্ষের পাশেই একটা বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে রাজা বিক্রমকে। তার শিয়রের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রাজা মানরু আর শাক্যপ্রধান শংকরাদিত্য। ‘উনি সুস্থ আছেন?’ বলে শামান দেখল ওর হাতের এক জায়গা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আহত হয়েছে উত্তেজনার চোটে সেটা বুঝতেই পারেনি ও।
‘দাদা আহত, তবে মারা যাবে না,’ শংকরাদিত্য বলে উঠল। ‘শঙ্কা কেটে গেছে।
স্বস্তির একটা পরশ বয়ে গেল শামানের শরীরে। ‘উনি কি কিছু বলেছেন?’ শামান প্রশ্নটা শেষ করার আগেই হঠাৎ রাজা বিক্রম শোয়া থেকেই বিড় বিড় করে উঠল।
শামান আর শংকরাদিত্য এগিয়ে গেল তার শিয়রের দিকে। যে দুজন বিক্রমাদিত্যের পরিচর্যা করছিল তারা একটু দূরে সরে গেল। রাজা বিক্রম আবারো বিড় বিড় করে কথা বলে উঠল।
‘কি বলছেন উনি?’ শামান জানতে চাইল।
শংকরাদিত্য জবাব দেয়ার আগেই পেছন থেকে রাজা মানরু কথা বলে উঠল। শামান পেছন ফিরে দেখল রাজা মানরুর কালো চেহারা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। কি বললেন উনি?’ শামান জানতে চাইল।
‘অবতার, বুদ্ধের অন্ধকার অবতার নামিয়ে আনা হচ্ছে পৃথিবীতে, একেবারে পাংশু মুখে জবাব দিল রাজা মানরু।