অধ্যায় আঠারো – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর, ভারতবর্ষ
পুরো ব্যাপারটাই শামানের কাছে ধাঁধার মতো লাগছে। বিশেষ করে কালন্তির অস্বাভাবিক রাগ করার ব্যাপারটা নিয়ে পরে অনুসন্ধান করতে হবে-বিষয়টা মনের ভেতরে টুকে রাখল ও।
যা ঘটে গেল তার জন্যে আমি আবারো ক্ষমা প্রার্থনা করছি। শংকর, আপনি শুরু করুন,’ রাজা মানরুর ক্ষমা প্রার্থনা শেষ হতেই একবার মাথা নেড়ে শংকরাদিত্য বলতে শুরু করল।
‘তো যা বলছিলাম, প্রায় শতবর্ষ ধরে আমরা এই কন্নোর এলাকা শাসন করে আসছি। শাক্য গোত্রের মাঝে দুটো ভাগ বিদ্যমান। শাক্যরা প্রকৃতপক্ষে আদি মাথুরা ধর্মাবলম্বী ছিল কিন্তু রাজা আশোকের সময় থেকে এই উপমহাদেশে যখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু হয় তখন শাক্যদের মাঝে দুটো ভাগ হয়ে যায়। তৎকালীন শাক্য রাজা আদিত্য মহারাজ নিজে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন সেইসঙ্গে নিজের গোত্রের লোকজনকে আদেশ করেন এই ধর্মের অনুসারী হবার জন্যে। কিন্তু শাক্যদের সকলে এই নির্দেশ মানতে নারাজ হলে শাক্যদের একটা অংশ ভিন্ন ধর্মের অনুসারীই রয়ে যায়। শাক্যদের এই অংশটি আকারে বেশ ছোটো ছিল সেই সময়ে, তবে এরা প্রকৃতিগতভাবে বেশ হিংস্র তা ছাড়া এরা ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত গোড়া। শাক্যদের এই অংশটি শাসকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কন্নোর জলাভূমির ওদিকে নিজেদের বসতি স্থাপন করে। ওই জায়গাটা ওরা নিজেরাই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু দিন দিন তাদের উন্নতি না হয়ে আরো অবনতি হতে থাকে, এরা প্রায় সময়ই জলাভূমি এলাকা ও বনভূমিতে ডাকাতি করতে শুরু করে। এর ফলে আদিত্য মহারাজের পরবর্তী শাসকদের প্রায় সবাইকেই শাক্যদের এই অংশ নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।
‘এরাই কি লিচ্ছবী নামে পরিচিত?’ হঠাৎ শামান জানতে চাইল।
‘হ্যাঁ, এরাই,’ শংকরাদিত্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ‘এদেরকেই ডাকা হয় লিচ্ছবী। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জাতিগতভাবে পুরোপুরি রাহাজানি-ছিনতাই আর অন্যায়ের বশবর্তী হবার কারণে লিচ্ছবী বলতে মূলত ডাকাতদেরই বোঝানো হয়ে থাকে। তো এসব অনেক আগের ঘটনা। আমি এসব ইতিহাস লম্বা না করে বর্তমান সময়ে কী ঘটেছে সে প্রসঙ্গে বলছি। গত একমাস ধরে সাঁচির স্তুপাতে প্রস্তুতি চলছিল ডুকপা লামার দ্বিবার্ষিক ভ্রমণের। কারণ বৌদ্ধ প্রধান এলাকায় ডুকপা লামার দ্বিবার্ষিক সফরটা সবাই খুবই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে। এমন সময় পাটালিপুত্ৰে ঘটে সেই ঘটনা। শুঙ্গ সেনাপতি পুশ্যমিত্র মৌর্য রাজা বৃহদ্রথকে খুন করে রাজ্য দখল করে, সেইসঙ্গে মৌর্য বংশের বিলুপ্তি ঘোষণা করে সে প্রতিষ্ঠা করে শুঙ্গ সাম্রাজ্য। এরই সঙ্গে পুরো ভারতবর্ষজুড়ে শুরু হয় বৌদ্ধ গণহত্যা। জ্বালিয়ে দেয়া হয় হাজারো মঠ, ধ্বংস করা হয় শত শত স্তুপা। হত্যা করা হয় হাজারো শ্রমণ, ভিক্ষু আর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের,’ শংকরাদিত্য বলে চলেছে। তবে তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে যেন এখানে নেই। দৃষ্টি চলে গেছে বহুদূরে।
‘তবে ভারতজুড়ে এসব শুরু হলেও আমরা কন্নোরের মানুষেরা এসব নিয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিলাম না। কারণ একে তো আমাদের এলাকা একেবারেই বৌদ্ধ অধ্যূষিত এলাকা, তার ওপরে পুরো ভারত জুড়ে মারামারি-কাটাকাটি চলছিল হিন্দু আর বৌদ্ধদের ভেতরে। আমাদের এখানে হিন্দু বলতে গেলে প্রায় নেই। তবে আমার বড়োভাই মহারাজ বিক্রমাদিত্য ডুকপা লামার কাছে দূত পাঠিয়ে ভারতের পরিস্থিতির ব্যাপারে অবগত করে জানতে চান উনি কি এমতাবস্থায় নিজের সফর পরিচালনা করবেন? নাকি এবারের মতো আসবেন না? প্রতিউত্তরে আমরা জানতে পারি উনি এরমধ্যেই উনার সফরে বেরিয়ে পড়েছেন। কাজেই কন্নোরের সফর বাতিল করার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কাজেই আমরা সব ভাবনা বাদ দিয়ে উনার দ্বিবার্ষিক সফরের প্রস্তুতি পুরোদমে চালিয়ে যেতে থাকি। ডুকপা লামা সঠিক সময়েই এসে পৌঁছান। উনাকে বিশ্রাম করার জন্যে যথেষ্ট সময় দিয়ে আমরা একদিন বাদে বার্ষিক আয়োজন সম্পন্ন করার জন্যে রাজা বিক্রমসহ ডুকপা লামাকে নিয়ে সাঁচির স্তুপাতে পৌঁছাই। যজ্ঞের শুরু হয়েছে মাত্র এমন সময় সেখানে আক্রমণ হয়,’ বলে সে একটু থামল।
‘কারা আক্রমণ করে?’ খুব শান্ত স্বরে জানতে চাইল শামান। যদিও পরিস্থিতি কোনোদিকে যাচ্ছে ও ঠিকই বুঝতে পারছে তবুও জানতে চাইল। ‘লিচ্ছবীদের দল?’
‘হ্যাঁ,’ বলে শংকরাদিত্য বলে চলল। কারণ আক্রমণের আগ্রভাগে ওরাই ছিল। তবে ওরাই একমাত্র আক্রমণকারী ছিল না। ওদের পেছনেই ছিল পার্শ্ববর্তী মহিষদহ রাজ্যের লিচ্ছবীরা। লিচ্ছবীদের বহুদিন যাবৎ নজর ছিল আমাদের রাজ্যের ওপরে। আগেই বলেছি বহুবার লিচ্ছবীদের সঙ্গে আমাদের টক্করও লেগেছে কিন্তু প্রতিবারই লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছে ওদের। জাদুবিদ্যায় পারদর্শী লিচ্ছবীরা খুবই চতুর আর বিশ্বাসঘাতক ধরনের জাতি। বারবার ওরা পেছন থেকে আমাদের ওপরে হামলা করতে চেয়েছে কিন্তু কোনোবারই সুবিধে করে উঠতে পারেনি। তাই এবার পুরো ভারতবর্ষের গণ্ডগোলের সুযোগ নিয়ে চতুর লিচ্ছবীরা সুযোগ নিয়েছে,’ বলে একটু থামল সে। একজনকে ইশারা করল পানি দিয়ে যেতে। টানা কথা বলে নিশ্চয়ই গলা শুকিয়ে গেছে তার।
‘শুঙ্গরা ভারতবর্ষে কবজা করার পর পর থেকেই তাদের সঙ্গে একজোট ঘোষণা করে নিচু বর্ণের লিচ্ছবীরা। তারা বুঝতে পারছিল বৌদ্ধশাসিত কন্নোরকে কবজা করার এটাই সুযোগ। তাই আমরা যখন নিশ্চিন্তে ডুকপা লামার দ্বিবার্ষিক সফরের আয়োজন সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এই সময়ে লিচ্ছবীদের সব গোত্ৰ মিলে বিরাট এক বাহিনী গঠন করে তক্কে তক্কে ছিল। দ্বিবার্ষিক সফরের যজ্ঞ শুরু হতেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের ওপরে।’
‘আপনাদের রাজমহল আর সেনাবাহিনী তখন কি করছিল?’ শামান জানতে চাইল।
‘আমি তো কথা শেষ করিনি, লিচ্ছবীদের এই যৌথ বাহিনী শুধু সাঁচির স্তুপাতেই আক্রমণ করেনি বরং ওরা একযোগ তিন জায়গায় আক্রমণ করে, শাক্যপ্রধান আফসোসের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে উঠল।
‘তারমানে ওদের পুরো আক্রমণটাই অত্যন্ত পরিকল্পিত ছিল,’ শামান মাঝখানে বলে উঠল। ওর খুব ধোঁয়া টানতে মন চাইছে কিন্তু এখানে টানা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না।
শাক্যপ্রধান মুখ তুলে তাকাল শামানের দিকে, ‘আমি বললাম কি? এটা লিচ্ছবীদের বহু বছরের উদ্দেশ্য ছিল। আর তাই সুযোগ পেতেই কাজে নেমে যায়। আমাদের লোকেরা যখন দ্বিবার্ষিক যজ্ঞের আয়োজনে ব্যস্ত ওরা তখুনি সম্পূর্ণ পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলে। আর তাই সুযোগ বুঝেই আক্রমণ করে বসে আমাদের ওপরে। ওদের বাহিনীর বড়ো একটা অংশ আমাদের দুর্গে আক্রমণ করে প্রায় বিনা আয়াসেই বিধোরীর দুর্গ দখল করে ফেলে, একই সময়ে ওদের বাহিনীর আরেকটা অংশ রাজ্য সরকারের তহশিলখানা আর সামরিক দপ্তরে আক্রমণ করে। ওখানেও বলতে গেলে প্রায় কেউ ছিলই না, তাই বিনা আয়াসেই তারা তহশিলখানা থেকে শুরু করে ব্যারাক পর্যন্ত দখল করে নেয়। দুর্গে আর তহশিলখানায় যারাই ছিল একটা অংশকে বন্দি করা হয় পরিবারসহ। অন্য অংশটাকে একেবারে কচুকাটা করে ফেলা হয়।’
আপনাদের সৈন্যবাহিনী কোথায় ছিল তখন?’
সৈন্যবাহিনীর বড়ো একটা অংশ বিরোধীর দুর্গে ছিল। ওরা এখনো সেখানেই বন্দি অবস্থায় আছে। বাকি ছোটো একটা অংশ তখন সাঁচির স্তুপায় রাজা বিক্রমের সঙ্গে ছিল আর অন্য অংশটাকে নিয়ে আমি জঙ্গুলে এলাকায় টহলে ছিলাম। আমার সঙ্গে থাকা ওই অংশটাই মূলত এখন দেখছেন আপনারা, এ ছাড়া বলতে গেলে বাকি সবই তো ধ্বংস হয়েছে। তো যাই হোক ওরা এই দুই জায়গা দখল করার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই তিন সম্মিলিত বাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী অংশটা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁচির স্তুপাতে। ওখানে নাকি তখন উৎসবের আমেজ চলছিল। একরকম বলতে গেলে অপ্রস্তুত অবস্থাতেই ওদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে লিচ্ছবীদের সম্মিলিত বাহিনী। রাজা বিক্রমের সেনাবাহিনীর একটা অংশ প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রথম ধাক্কাতেই তার ওদের সেনাপ্রধান মারা যাওয়াতে পুরো বাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। লিচ্ছবীদের সম্মিলিত বাহিনীর সামনে শাক্য সেনাবাহিনী কচুকাটা হয়ে যায়।’
‘রাজা বিক্রম, উনার ভাগ্যে কি ঘটে? আর ডুকপা লামা?’ প্রশ্নের শেষ অংশটা উচ্চারণ করতে গিয়ে শামানের গলা কেঁপে উঠল।
‘যজ্ঞের দিনে আমি সেনাবাহিনীর একটা অংশ নিয়ে জঙ্গলে কেন টহল দিতে গেছিলাম, জানেন? আমাদের কাছে খবর ছিল-ওদিক থেকে নাকি আমাদের রাজ্যে আক্রমণ হতে পারে। রাজা বিক্রমের জীবন সংশয় দেখা দিয়েছে। আর সত্যিকার অর্থে হয়েছে উলটো,’ শংকরাদিত্য দুঃখের হাসি হেসে উঠল ।
‘তো যাই হোক। টহলের মাঝামাঝি আছি এমন সময় আমাদের কাছে খবর এসে পৌঁছায় আমাদের দুর্গ, সামরিক আখড়া আর সাঁচির স্তুপাতে আক্রমণ হয়েছে। আমরা সোজা সেখান থেকে সাঁচির স্তুপাতে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। মাঝপথে আমাদের সঙ্গে সাঁচি থেকে পলায়নরত বিচ্ছিন্ন বাহিনীর একটা অংশের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ওদের কাছে জানতে পারি সাঁচিতে আসলে কী ঘটেছে। ওদের কাছেই জানতে পারি যাদেরকে ওরা পেয়েছে মেরে ফেলেছে। ওরাই আমাদের জানায় রাজা বিক্রম আর ডুকপা লামাকে ওরা ধরে নিয়ে যেতে দেখেছে।
‘এরপর…মানে এরপর কী করলেন আপনারা?’ শামানের গলায় একটু হলেও স্বস্তি। ও আড়চোখে দেখল শাক্যপ্রধানের শেষ কথাটা শুনে ওর পাশ থেকে বিধুও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
‘ওরা আমাদের সাঁচিতে যেতে মানা করে, কারণ সেখানে নাকি বিরাট বাহিনী আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে, আর দূর থেকেই আমরা আকাশে কালো হয়ে ওঠা ধোঁয়া আর আগুন দেখতে পাই। আগুনের মাত্রা দেখে সহজেই অনুমান করতে পারি স্তুপাতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমরা জঙ্গল থেকে না বেরিয়ে বরং জঙ্গলের আরো গভীরে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে উত্তরের দিকে সরতে থাকি,’ বলে সে মুখ তুলে তাকাল থারু রাজা মানরুর দিকে। ‘আর সেখানেই রাজা মানরুর বাহিনীর সঙ্গে দেখা হয় আমাদের।’
‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, সাপ আর নেউলের শত্রুতা থারু আর শাক্যদের মাঝে, তো সাপ আর নেউল একসঙ্গে হলো কী করে?’ শামান জানতে চাইল।
‘সেটা রাজা মানরুর মহানুভবতা, শত্রু হবার পরও উনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন,’ শংকরাদিত্য মাথা নিচু করে বলে উঠল।
রাজা মানরু আনমনেই মাথা নাড়ল, ‘এর মধ্যে মহানুভবতার কিছু নেই। আমরা শত্রু হতে পারি কিন্তু অমানুষ নই যে অসহায় শত্রুর ওপরে নিজেদের পুরনো রাগ মেটাব। বরং যতই পুরনো শত্রুতা থাক আমি রাজা হবার পর থেকেই চেষ্টা করে আসছি এই উপত্যকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে। একটা ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে দিয়েও সেটা করা যায় তবেই বা খারাপ কি?’
‘রাজা মানরুর বাহিনীর সঙ্গে আমাদের দেখা হবার পর প্রথমে আমরা ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু উনি আমাদের কোনো ক্ষতি না করে বরং একটা শান্তি প্রস্তাব দেন। উনারা আমাদের নিজেদের আয়ত্তের ভেতরে আশ্রয় দেবেন, প্রয়োজনে রাজ্য ফিরে পেতে সহায়তাও করবেন কিন্তু এর বিনিময়ে যদি আমরা রাজ্য ফিরে পাই তবে পুরনো শত্রুতা ভুলে গিয়ে তাদের সঙ্গে সন্ধি করতে হবে—সেইসঙ্গে রাজ্য ফিরে পাবার পর উভয় গোত্রের ভেতরে রাজ্যের সুষম বণ্টন করতে হবে।’
‘ঠিক, যদিও আমার নিজের গোত্রের ভেতরেই অনেকে এটা মেনে নিতে নারাজ কিন্তু আমার কাছে এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে,’ বলে থারু রাজা আশপাশে তাকাল। শামান অনুমান করল সে নিজের মেয়ের খোঁজ করছে। কিন্তু কালন্তিকে কোথাও দেখা গেল না।
‘আমরা রাজা মানরুর আশ্রয় গ্রহণ করার পর অস্থায়ীভাবে নিজেদের বাসস্থান ঠিক করে রাজা মানরুর সঙ্গে বসে আমাদের পরবর্তী করণীয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করছি এমন সময়ে উত্তর থেকে, মানে তিব্বত থেকে খবর আসে লামা নোরবুর অনুরোধে লাল চুলের যোদ্ধা তার বাহিনী নিয়ে ডুকপা লামার খোঁজ করতে উপত্যকায় আসছে। আমরা খুশি হয়ে যাই খবর শুনে। কারণ সত্যি কথা হলো, থারুরা শান্তি প্রিয় জাতি, আর আমি সেনাবাহিনীর একটা অংশের দায়িত্বে থাকলেও সেভাবে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই আমার। আর তা ছাড়া লিচ্ছবীরা খুবই হিংস্র জাতি। ওদের বাহিনীর সম্মিলিত পদচারণে আমাদের রাজ্যের অবস্থা এখন এতটাই সংকীর্ণ যে আমরা আসলে কী করব বুঝেই উঠতে পারছিলাম না। এমন সময়ে অভিজ্ঞ একদল যোদ্ধার সহায়তা পেলে হয়তো আমাদের জন্যে অনেক কিছুই খুব সহজ হয়ে যাবে। তাই আমরা অপেক্ষা করতে থাকি আপনাদের জন্যে
‘কিন্তু আপনারা দুজনে উপত্যকায় আসার পর আমরা দ্বিধান্বিত হয়ে যাই। কারণ যেখানে একটা সুসজ্জিত বাহিনী আসার কথা সেখানে এসেছে মাত্র দুজন। তাও আবার লাল চুলের যোদ্ধার ব্যাপারে যে ধারণা আমরা করেছিলাম সেটাও মিলছিল না। তাই…’
‘ফাঁদ পেতে আমাদের পরখ করার চেষ্টা করেন, আনমনেই হেসে উঠল শামান। কোমরের ঝোলা থেকে বাঁশি বের করে সেটার মুখে একটা ছোটো পাথর বসিয়ে এক টুকরো আকরিক লোহা দিয়ে টান মারল ও, একবার-দুবার-তিনবারের সময়ে আগুন ধরে গেল বাঁশির মাথায় বসানো গুঁড়োতে। দুটান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়ল ও শূন্যে। সঙ্গে সঙ্গে অবাক হয়ে দেখল ওর সামনে উপবিষ্ট সবাই খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। শামান একটু অবাক হলো, কারণ ও বুঝতে পারছে না এরা কি কাউকে ধোঁয়া টানতে দেখেনি নাকি এই এলাকার লোকেরা অন্যভাবে ধোঁয়া টানে। মনে মনে ও একটু খুশিও হলো। কারণ এদেরকে একটু অবাক করতে না পারলে খুব সহজে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না ও। যেটা এই মুহূর্তে ওর জন্যে খুবই দরকার।
‘শুনুন, আমি দুঃখিত যে আমার বাহিনী নিয়ে আসতে পারিনি, তবে এটাও ঠিক যে এখানে পরিস্থিতি যা বুঝতে পারছি তাতে বাহিনী যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞ নেতৃত্ব। বিশ্বাস করুন সেটা দেয়ার যোগ্যতা আমার আছে। যদি আপনারা ভরসা করতে পারেন তবে আমার একটা পরিকল্পনা আছে। তবে সেটা করতে হলে আগে আমার একটা শক্তিশালী সাহসী দল দরকার। আমি তলোয়ারবাজ, আর বিধু দক্ষ তিরন্দাজ, শামান এই পর্যন্ত বলতেই আনন্দের সঙ্গে একটা হাত তুলে নিজের উপস্থিতি জানান দিল বিধু। শামান বলেই চলল।
‘তবে আমরা যথেষ্ট নই। আমাদের আরো লোক লাগবে। যেমন এই এলাকা খুব ভালো চেনে এমন একজনকে দরকার। এ ছাড়া আমি আর বিধু দুজনেই এখানকার ভাষা মোটামুটি জানলেও এই এলাকার সব ভাষা খুব ভালো জানে তেমন কাউকে দরকার আমাদের। সেইসঙ্গে অত্র এলাকার বসতির ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব স্তরে বিচরণ আছে এমন একজন লোকও লাগবে,’ বলে ও থারু রাজা শাক্যপ্রধানের দিকে দেখল একবার। কি মনে হয় পারবেন এমন লোকজন দিতে?’
‘না পারার কিছু নেই,’ বলে সে একবার শাক্য রাজার দিকে দেখল তারপর ফিরে তাকাল নিজের বাহিনীর লোকদের দিকে। তার তলোয়ার বাহিনীর ভেতর থেকে বেশ লম্বা-চওড়া গোলগাল দেখতে একজনকে ডেকে পাঠাল। রাজার নির্দেশ পাওয়া মাত্রই লোকটা নিজের দলের ভেতর থেকে এক পা এগিয়ে এলো ওদের দিকে।
শামান মনোযোগ দিয়ে দেখল মানুষটাকে, তার পরনে দলের অন্য পুরুষদের মতোই ধুতি জাতীয় পোশাক, উর্ধ্বাঙ্গে কালো ফতুয়ার মতো, কোমরে একটা বড়ো ছুড়ি আর পিঠের ওপরে খাটো বাঁকা ভারী তলোয়ার। শামান খুব মজার সঙ্গে খেয়াল করল লোকটার শরীরটা একেবারে দড়ির মতো পাকানো পেশিবহুল, কিন্তু তার মুখটা একেবারেই বাচ্চাদের মতো গোলগাল। শরীর আর চেহারার মধ্যে এরকম বিসদৃশ মানুষ এর আগে ও খুব কমই দেখেছে।
‘ওর নাম ধোয়ী, আমার বাহিনীর সেরা তলোয়ারবাজদের একজন। তবে এটাই ওর সেরা গুণ নয়, ওর সেরা গুণ হলো ও এই অত্র কন্নোর এলাকার সমস্ত জায়গা হাতের তালুর মতোই চেনে। ওর ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে কন্নোর এলাকার পথ-ঘাট, গলি-ঘুপচি বটেই এমনকি এই এলাকার প্রতিটি জলাশয়ের মাছ আর গাছের পাতাও ও চিনতে পারে,’ রাজার কথা শেষ হতেই শামানের দিকে তাকিয়ে ছোটো করে একবার মাথা ঝাঁকাল শিশু শিশু চেহারার লোকটা।
রাজা তখনো বলেই চলেছে। ‘ঘোষিত,’ বলে রাজা ডাক দিতেই হঠাৎ সুরুৎ করে সারি দিয়ে দাঁড়ানো তলোয়ারবাজদের পাশে অবস্থানরত কেউ একজন চট করে তাদের পেছনে চলে গেল। ‘ঘোষিত, আমি ডাকলাম না,’ রাজা ধমকে উঠতেই দলটার পেছন থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো কালো মুশকো দেখতে একজন মানুষ। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারল শামান, একটু আগে এই লোকটাই ওকে আর বিধুকে ছাগলের মতো দড়ি ধরে টেনে টেনে নিয়ে এসেছে পুরো পথ। এবার রাজা ওদের সঙ্গে কাজ কারার নির্দেশ দিতেই সে লুকানোর চেষ্টা করছিল।
‘ও হচ্ছে ঘোষিতরাম-পিচ্চি থেকে বুড়ো এই এলাকাতে এমন কোনো মানুষ নেই যার সঙ্গে সোমরস টানেনি ও। কাজেই ওই আপনাদের যেকোনো খবর সংগ্রহের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারবে। আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?’
শামান হাসিমুখে একবার ঘোষিতকে দেখল পরমুহূর্তে সে ফিরে তাকাল বিধুর দিকে। চরম আপত্তির সঙ্গে মানা নাড়তে নাড়তে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সম্মতি জানিয়ে দিল শামান। ‘আমার কোনো আপত্তি নেই,’ পাশ থেকে জোর কাশি দিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল বিধু তাকে—চোখের ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলল শামান।
‘আমার মনে হয়, এখানে আমার বাহিনী থেকেও কারো থাকা উচিত, হঠাৎ বলে উঠল শাক্যপ্রধান শংকরাদিত্য। কারণ লিচ্ছবীদের দখল করে রাখা দুর্গগুলোর ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো জানে আমার লোকেরাই,’ বলে সে শামান আর রাজা মানরুকে দেখতে লাগল। দুজনেই সম্মতি জানাতেই সে নিজের সেনাপ্রধান জাথুরিয়াকে বলল ওদের সঙ্গে যোগ দিতে।
আমিও থাকতে চাই এই দলে, হঠাৎ পাশ থেকে নতুন গলা শুনে সবাই একটু অবাক হয়ে ফিরে তাকাল। ‘আমার মনে হয় দুই দলেরই সার্বিক তত্ত্ববধানে এখানকার নেতৃস্থানীয় কারো থাকা উচিত, তা না হলে সমস্যা হবে,’ বলে রাজা মানরুর মেয়ে কালন্তি পেছন থেকে সামনে এসে ওদের বসে থাকা গোল চক্রের একেবারে কেন্দ্রে দাঁড়াল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শামানের দিকে। শামান রহস্যময় সেই ধূসর জোড়া চোখের মণির গভীরে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কী রহস্য লুকিয়ে আছে সেখানে।
‘কিন্তু কালন্তি তুমি…’ রাজা মানরু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই শামান কথা বলে উঠল।
‘মাফ করবেন রাজাসাহেব,’ বলে সে ধূসর মণি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফিরে তাকাল রাজার দিকে। আমারও মনে হয় আমার এই বিশেষ দলে এখানকার নেতৃস্থানীয় কেউ থাকলে বরং ভালোই হবে,’ বলে সে আবারো দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল ধূসর মণিজোড়াতে। ‘ডুকপা লামাকে খুঁজে বের করতে হলে আমাকে আগে বুঝতে হবে এখানে আসলে হচ্ছেটা কি,’ বলে ও দলের বাকিদের একে একে দেখল। দলকে নিজের মতো কাজে লাগাতে হলে আগে দলের মানুষদের বুঝতে হবে, প্রত্যেকের দুর্বলতাকে ছাপিয়ে অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই যেকোনো দলকে সফলভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। অন্তত ওর অভিজ্ঞতা তাই বলে।
‘কথা অনেক হয়েছে, আমার মনে হয় আমরা যত দ্রুত কাজে নামব ততই ভালো হবে আমাদের জন্যে,’ বলে ও একটু থেমে যোগ করল, ‘একমাত্র মাঠে নামলেই বোঝা যাবে প্রকৃত পরিস্থিতি।’