প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ১১

অধ্যায় এগারো – বর্তমান সময়
নির্মাণাধীন ল্যাব, শাহী ঈদগাহ, সিলেট

বাতাসে কেমন জানি বিপদের গন্ধ, কথাটা মনে হতে আনমনেই মৃদু হেসে উঠল তানভীর। অতিরিক্ত থ্রিলার বই পড়ার ফল।

কেয়ারটেকার এসে জানাল তানভীরের জন্যে কামরা প্রস্তুত করা আছে, চাইলে ও সেখানে যেতে পারে। এসআই ইকবাল আর শ্যুটারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তানভীর কেয়ারটেকারের পিছু নিয়ে চলে এলো গেস্ট হাউসে। টানা অনেকগুলো রুম দেখা গেল, তবে বেশির ভাগই এখনো থাকার অনুপযোগী। সেগুলো পার হয়ে কাঠের কারুকাজ করা একটা দরজার সামনে চলে এলো কেয়ারটেকার। এখানে লম্বা ঝুল বারান্দা সংলগ্ন তিনটে কামরা দেখতে পেল তানভীর। ও অনুমান করল এই তিনটে কামরাই সম্ভবত মেহমানদের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে।

কামরার সামনে এসে লক খুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল কেয়ারটেকার, আর আশপাশে তাকিয়ে তানভীর দেখতে লাগল আধুনিক ভবনটা। চতুষ্কোন আকৃতির ভবনটাতে ওপর থেকে স্কাইলাইটের মতো দেখতে একটা জায়গা দিয়ে আলো আসছে। চারপাশে লম্বা লম্বা খোলা বারান্দা দিয়ে বাইরের সবুজ গাছের সারি চোখে পড়ে। চমৎকার, মনে মনে ভাবল ও।

কেয়ারটেকার দরজার তালা খুলে ওকে চাবি বুঝিয়ে দিতেই ভেতরে চলে এলো ও। একজন থাকার মতো সুন্দর একটা কামরা। একপাশে সুন্দর বসার ব্যবস্থা-অন্যপাশে বেডরুম, লাগোয়া ওয়াশরুম। ওর ব্যাকপ্যাকটাকে দেখতে পেল একটা কাবার্ডের ওপরে রাখা। নিজের পিস্তলটাকে হোলস্টারসহ খুলে টেবিলের ওপরে রাখল ও। তারপর দ্রুত ফ্রেশ হয়ে কাজ শুরু করে দিল। পিস্তলের পাশেই রাখল এই কেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফাইলটাকে। এরপর পেজারটা তুলে নিয়ে বিশেষ একটা সিগন্যাল পাঠাল ঢাকায় পিবিআইয়ের অ্যানালিসিস উইংয়ে। সিগন্যালটা পাঠানোর একটু পরেই ওর মোবাইলে একটা বিশেষ নম্বর থেকে কল এলো।

এই কলটা ভিন্ন একটা লাইন থেকে করা হয়। সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থা, এমনকি মোবাইল কোম্পানির লোকজনও এটা ট্রেস করতে কিংবা এই লাইনে আড়ি পাততে পারবে না। ও বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল অ্যানালিসিস উইংয়ের প্রধান হাবিব আনোয়ার পাশা স্যারের সঙ্গে। চুপচাপ তানভীরের ব্রিফিং শুনে সে কিছু বিশেষ নির্দেশনা দিল ওকে। পাশা স্যারের সঙ্গে কথা শেষ করে ও কল দিল মাকে। তখন ঠিকমতো কথা বলতে পারেনি। এবার চেষ্টা করতে হবে মায়ের রাগ ভাঙানোর। কাজে নামার আগে মায়ের মন খারাপ চেহারাটা বারবার চোখে ভেসে ওঠাতে ভালো লাগছে না ওর। কিন্তু কল করে মায়ের মোবাইল বন্ধ পেল ও।

মোবাইল রেখে এবার কেসের ফাইলগুলো নিয়ে বসল ও। এই অল্প সময়ে খুব বেশি কিছু দেখা সম্ভব নয়, তবে আসন্ন মিটিংয়ে আলোচনা করার মতো জরুরি কয়েকটা বিষয় দেখে নিয়ে ওর মোবাইলের নোটপ্যাডে নোট করে নিল সেগুলো। কাজ শেষ করে দেখল ওর নির্দেশিত আধা ঘণ্টা পুরো হতে আরো কয়েক মিনিট বাকি। তবে মিটিংয়ের জন্যে সবাই একত্রিত হলে সুলতানই ওকে জানাবে কাজেই তাড়াহুড়ো না করে নিজের গেজেটগুলো পরীক্ষা করে দেখতে বসল ও।

প্রথমেই জ্যাকেট আর শার্ট খুলে পাটোয়ারীর দেয়া বুলেট প্রুফ ভেস্টা ফিটিং করে নিল শরীরে। আগের দিনের ভয়ানক ভারী সিসার পাত আটকানো বুলেট প্রুফ ভেস্টের সঙ্গে পলিমারের তৈরি হালকা এই জিনিসটার কোনো তুলনাই চলবে না। এটা যেমন হালকা তেমনি কাজেরও বটে। ভেস্টটা ঠিক করে নিয়ে ওপরে শার্ট আর লেদার জ্যাকেটটা পরে নিল ও। পেজারটা চেক করে বেল্টের একটা বিশেষ খাপের ভেতরে রেখে দিল, পাটোয়ারীর দেয়া স্টিলেটোটা নিজের পায়ের সঙ্গে আটকানো খাপে ভরে ব্যাকপ্যাকের ভেতর থেকে বের করল একটা খাকি রঙের প্যাকেট। ওটার ওপরে ওর নাম লেখা। খাকি খামের ওপরে মার্কার দিয়ে লেখা হাতের লেখা দেখেই ও চিনতে পারল এটা মৌসুমি আপার হাতের লেখা।

মৃদু হাসি দিয়ে প্যাকেটটা খুলতেই ওর হাসি আরেকটু চওড়া হলো। ভেতরে একটা মাল্টি টাস্কিং টুল কিট। জিনিসটা অনেকটা পুরনো দিনের ম্যাকগাইভার টিভি সিরিয়ালে দেখানো মাল্টি টাস্কিং সুইস নাইফের উন্নত ও অধুনিক রূপ। হাসি মুখে ওটাকে চালান করে দিল লেদার জ্যাকেটের পকেটে।

টেবিলের ওপর থেকে হোলস্টারটা তুলে নিয়ে ওটার ভেতর থেকে ডেজার্ট ঈগল পিস্তলটা বের করে আগে ডার্ক ট্যান রঙের হোলস্টারটাকে সেট করে নিল লেদার জ্যাকেটের ভেতরে সাদা শার্টের ওপরে। পিস্তলের একস্ট্রা ক্লিপগুলো ঠিকমতো বসিয়ে নিল হোলস্টারের সঙ্গে আটকানো ছোটো ছোটো খোপের ভেতরে। সবশেষে ও বসল সিলভার-ব্লু রঙের ডেজার্ট ঈগল পিস্তলটা নিয়ে।

ম্যাগনাম আই-এম-আই ডেজার্ট ঈগল, এল ফাইভ মডেলের এই বিশেষ পিস্তলটা ২০১৬ সালে লঞ্চ করা ম্যাগনাম গান ল্যাবের বিশেষ গবেষণার ফসল। আধুনিকেরও অত্যাধুনিক এই পিস্তলকে বলা হয়ে থাকে বাজারে প্রচলিত হ্যান্ডগানগুলোর ভেতরে সেরাগুলোর চেয়েও সেরা। পিস্তলটা হাতে তুলে নিতেই জার্মান পুলিশের বন্দুক বিশেষজ্ঞের কথাগুলো মনে পড়ে গেল ওর। ওদের ট্রেনিংয়ের একটা বিশেষ অংশ ছিল যেখানে ওদেরকে নানা ধরনের আর্টিলারির ব্যাপারে ধারণা প্রদান করা হয়েছে। এর ভেতরে হ্যান্ডগান থেকে শুরু করে হেভি আর্টিলারি পর্যন্ত ছিল—যেগুলো প্রচলিত কাজে প্রয়োজন হতে পারে।

পিস্তলটা হাতে তুলে নিতেই দুটো জিনিস নজর কাড়ল তানভীরের। জিনিসটার ওজন, আর রং। রংটা পুরোপুরি কালোও না আবার সিলভারও না। বরং রংটা অনেকটা নীলচে রুপালি। অন্যদিকে জিনিসটা বানানো হয়েছে বিশেষ এক ধরনের ফর্জিং স্টিল ব্যবহার করে, যে কারণে ওজনটা আর দশটা সাধারণ পিস্তল কিংবা হ্যান্ডগান থেকে অনেক কম। এই পিস্তলের আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, এর ম্যাগজিনকে ম্যাগজিন না বলে বলা হয়ে থাকে বুলেট কেইস। বুলেট কেইসে ষোলটা গুলি ধরে। গুলিগুলোও একটু আলাদা।

পিস্তলটার বুলেট কেইস বের করে গুলি পরীক্ষা করে চেম্বার থেকে গুলি বের করে এনে দুই তিনবার ট্রিগার চেপে দেখল তানভীর। সুপার লাইট ট্রিগার। সামান্য চাপেই গুলি বেরিয়ে যায়। আর এর মেশিন কোয়ালিটি টানা প্রায় সাবমেশিনগানের মতো দ্রুত একটার পর একটা বুলেট উগড়ে দিতে পারে। পরীক্ষা শেষ করে গুলি ভরে বিল্ট ইন লেজার এইম আর একস্ট্রা সাইলেন্সারটা পরীক্ষা করে নিল ও। তারপর ওগুলো খুলে ঢুকিয়ে রাখল হোলস্টারের বিশেষ খাপে। সবশেষে পিস্তলের সেফটি অন করে হোলস্টারে রেখে উঠে দাঁড়াল ও।

হাতঘড়িতে সময় দেখল। চল্লিশ মিনিটের ওপরে হয়ে গেছে। মন ও মস্তিষ্ক দুটোকেই শান্ত করার জন্যে একটু মেডিটেশন করতে মন চাচ্ছে ওর কিন্তু সেটা না করে বরং দুই মিনিট ব্রিদিং করে টেবিলের ওপর থেকে ফাইল তুলে নিয়ে মোবাইলের নোট প্যাডে টুকে রাখা পয়েন্টগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো তানভীর। এবার কাজে নামতে হবে।

বাইরে বেরিয়ে করিডর ধরে এগিয়ে সেই ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই কেয়ারটেকার ছেলেটা এসে জানাল দোতলায় মিটিং রুমে সবাই ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। লেদার জ্যাকেটের চেইন টেনে দিয়ে কেয়ারটেকার ছেলেটার পিছু নিয়ে সেদিকে এগোল তানভীর ।

ছেলেটার সঙ্গে ও চলে এলো দোতলার মিটিং রুমে। মিটিং রুমের কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। তবে কাজ চালানোর মতো ব্যবস্থা হয়েছে। চারপাশে কাচঘেরা রুমটার একপাশে শ্রেণিকক্ষের মতো সাদা একটা বোর্ড লাগানো। তার ঠিক সামনে রুমের মাঝখানে মনে হয় কোনো টেবিল বসানো হবে। তবে সেটার কাঠামো বানানো হলেও সেখানে টেবিল বসানো হয়নি এখনো। তার পরিবর্তে কাজ চালানোর জন্যে টেবিলের গোলচে আকৃতি ঘিরে ছোটো ছোটো ডেস্কের মতো বসানো হয়েছে।

তানভীর দেখেই বুঝতে পারল, এটা সাময়িক ব্যবস্থা; সম্ভবত আজকের মিটিংয়ের জন্যেই বসানো হয়েছে। টেবিলের চারপাশে বসানো ডেস্ক ঘিরে এই মুহূর্তে বসে আছে কয়েকজন মানুষ। তাদের ভেতরে শ্যুটার সুলতান আর সুদর্শন এসআই ইকবালকে দেখতে পেল তানভীর। টেবিলের একপাশে একটা প্রজেক্টর বসানো। সেটার আলো গিয়ে পড়েছে টেবিলের অন্য প্রান্তে থাকা সাদা বোর্ডটার ওপরে। কিন্তু প্রজেক্টরের সামনে কাউকে দেখতে পেল না ও।

তানভীর কামরায় প্রবেশ করতেই ওকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সবাই। একটু অস্বস্তি লাগতে শুরু করল তানভীরের। নিজেকে কেমন জানি মাস্টার মাস্টার মনে হচ্ছে।

‘প্লিজ, বসুন আপনারা,’ বলে ও টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল। দুই পা এগোতেই কাঁচা-পাকা দাড়িওয়ালা এলোমেলো চুলের হালকা-পাতলা সুদর্শন একজন মানুষ এসে হাত মেলাল ওর সঙ্গে। ‘মিস্টার তানভীর,’ বলে সে তানভীরের একটা হাত ধরে মৃদু ঝাঁকিয়ে দিল। আমি ডক্টর প্রবীর, এই ল্যাবটা আমার অধীনেই নির্মিত হচ্ছে।’

তানভীর খুব অবাক হয়ে সুদর্শন মানুষটাকে দেখল। ওর অবাক হবার কারণ কাঁচাপাকা চুল-দাড়ির এই মানুষটার সঙ্গে ওর খুব প্রিয় একজন স্প্যানিশ অভিনেতা হিউগো সিলভা’র অস্বাভাবিক মিল দেখে। কথাটা বলতে গিয়েও কী মনে করে থেমে গেল ও।

‘আমি তানভীর মালিক, সিনিয়র অ্যানালিস্ট। আপাতত এই কেসের দায়িত্বে আছি,’ বলে ও মৃদু হেসে আরো কিছু যোগ করতে যাচ্ছিল তার আগেই হঠাৎ টেবিলের নিচ থেকে একটা চড়া কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

‘কি ব্যাপার, সবাই দাঁড়িয়ে আছে কেন?’ টেবিলের নিচ থেকে উঠে এলো অদ্ভুত দেখতে একজন মানুষ। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকার পরও অস্বাভাবিক জোরে কথা বলছে সে। যাক প্রজেক্টরের লাইনটা ঠিকমতো লাগাতে পেরেছি। কী যে করে এরা! কোথায় বিল্ট ইন প্রজেক্টর থাকার কথা, সেখানে একটা ভালো মাল্টিপ্লাগ পর্যন্ত দিতে পারেনি। এত অকর্মা লোকজন জিন্দেগিতেও দেখিনি,’ বলে সে একটু অবাক হয়ে সবার চেহারা দেখল। ‘অহ, কী যেন জানতে চাইছিলাম, সবাই দাঁড়িয়ে আছে কেন?’ বলে সে এতক্ষণে খেয়াল করল তানভীরকে। ওকে দেখে একগাল হেসে এগিয়ে এলো ওর দিকে।

‘আপনি নিশ্চয়ই সিনিয়র অ্যানালিস্ট তানভীর মালিক,’ বলে একটা হাত এগিয়ে দিল সে তানভীরের দিকে। তানভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল মানুষটাকে। একেবারেই ছোটোখাটো মানুষটার উচ্চতা পাঁচ ফিটের চেয়ে একটু কমই হবে, পরনে অসংখ্য স্মাইলি আঁকা একটা গেঞ্জির কাপড়ের থ্রি-কোয়ার্টার আর সমুদ্রসৈকতের ছবি আঁকা একটা আকাশি রঙের টি-শার্ট। ছোটো-খাটো শরীরটার মাঝামাঝি জায়গায় তার সমুদ্রসৈকতের টি-শার্ট ঠেলে বেরিয়ে আছে বেশ উন্নত মানের গোলচে ভুঁড়ি। মাথায় আবার পুরনো আমলের ইটালিয়ান নাবিকদের মতো দেখতে টুপি, যে টুপি সত্তরের দশকের পরে মনে হয় বাঙাল মুলুকে আর কেউ পরেনি। মানুষটার নরম তুলতুলে হাতটা ধরে সামান্য ঝাঁকিয়ে দিয়ে তানভীর বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আমিই তানভীর। এই কেসের কমান্ডার।’

‘অহ, যা ভেবেছিলাম, একটু মেয়েলি ঢঙে বলে উঠল মানুষটা। ‘আমি এই কেসের সাইবার সাপোর্ট হিসেবে কাজ করছি। বাই দ্য ওয়ে, আমি টমি, টমি পোদ্দার।’

কিঞ্চিত হাস্যকর দেখতে মানুষটা ততোধিক হাস্যকর নামটা শুনে আরেকটু হলেই ফিক করে হেসে ফেলেছিল তানভীর। কোনোমতে হাসি আটকে ও বলে উঠল, ‘মিস্টার পো… আই মিন, মিস্টার টমি আপনি কি পিবিআইয়ের হয়ে কাজ করছেন? মানে পাশা স্যার আপনার কথা বলেছিল আমাকে,’ বলে একটু কাঁধ ঝাঁকাল তানভীর। ‘আসলে এই কেসের ব্যাপারে অনেককিছুই পরিষ্কার না আমার কাছে। কাজে নামার আগে সব বিষয়ে কথা বলতে হবে। প্রথমেই আমাকে বুঝতে হবে, কে আসলে কার প্রতিনিধিত্ব করছে, কার ফাংশন কি?’

‘একদম ঠিক বলেছেন,’ আবারো অস্বাভাবিক জোরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে তালি দিয়ে উঠল টমি পোদ্দার নামের আজব মানুষটা। ‘এই কাজের জন্যেই আমি আছি এখানে। আমি পিবিআইয়েরও লোক না, আসলে আমি সিলেটে এসেছিলাম এই ল্যাবের সাইবার ম্যাটেরিয়াল সেট করার জন্যে। আপনারা হয়তো জানেন যে সিআইডি-পিবিআই আর হোমিসাইড ডিভিশন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের প্রতিটি বড়ো-বড়ো জেলায় ‘

একটা হাত তুলে বক বক করতে থাকা টমি পোদ্দারকে থামিয়ে দিল তানভীর। ‘এসব আমি জানি, আমার ধারণা এই কামরার সবাই জানে। আমি কেসের ব্যাপারে জানতে চাই। তার আগে জানতে চাই, এই কেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মানুষকে। কে কার প্রতিনিধিত্ব করছে আর কার ফাংশনই বা কি। কাজে নামার আগে প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত না জেনে, পরিকল্পনা ঠিক না করে আমি একটা পা-ও ফেলতে আগ্রহী না,’ বলে ও একটা আঙুল তুলল।

‘আরেকটা ব্যাপারে আমি সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছি, এই কেসটা নিয়ে এখনো খুব বেশি না জানলেও এটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি যে এই কেসের কাজ শুরু হতে এরই মধ্যেই খানিকটা দেরি হয়ে গেছে। আরো যত দেরি হবে আমাদের জন্যে কাজ উদ্ধার করা ততই কঠিন হবে। কজেই আমাদের এক্ষুণি সব ঠিক করে কাজে নামা উচিত। যত দেরি, তত ঝামেলা।’

তানভীর একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল সামনের দিকে। ওর লেকচার শুনে সবাই চুপ হয়ে আছে। তবে টমি পোদ্দারের কোনো বিকার নেই। সে আরো একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, ‘ফেয়ার এনাফ, তাহলে আমিই শুরু করি।

‘নাহ, আপনি শুরু করার আগে আমি রুমে অবস্থিত সবার সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। পরিচয় বলতে হয়তো আমি দুয়েকজনকে চিনি, আপনারা হয়তো একে অপরকে চেনেন কিংবা চেনেন না। কিন্তু আমি চাই একই টিম হিসেবে কাজ করতে হলে, সবাইকে সবার ব্যাপারে অন্তত একটা কমন গ্রাউন্ডে জানা প্রয়োজন, সেইসঙ্গে কার কি ফাংশন সেটাও। সুলতান আপনি শুরু করুন,’ বলে তানভীর সুলতানের দিকে ফিরে ইশারা করল।

সুলতান একটা চেয়ার টেনে বসার পাঁয়তারা করছিল তানভীরের কথা শোনামাত্রই রোবটের মতো সটান সোজা হয়ে গেল, রুমে অবস্থানকারী বেশির ভাগ পুরুষের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি বেশি উঁচু হবে সে। দুই পা ফাঁক করে দুই হাত পেছনে নিয়ে গেল মিলিটারির ভঙ্গিতে, তারপর ভারী স্বরে বলতে শুরু করল, ‘আমি সুলতান, পিবিআইয়ের স্পেশাল স্ট্রাইকিং ফোর্সে ফিল্ড অপারেশন অফিসার। আমি সরাসরি পাশা স্যারের অধীনে কাজ করি। নাইন এমএম ম্যাগনাম থার্টি টু বোরের জোড়া পিস্তল চালানোতে দক্ষতা আছে আমার,’ সুলতানের এই কথাটা শোনামাত্রই শিস দিয়ে উঠল টমি পোদ্দার।

তানভীরও চমকে উঠল সুলতানের এই কথাটা শুনে, ওর চোখে ভেসে উঠল ‘ডার্টি হ্যারি’ সিনেমাতে ক্লিন্ট ইস্টউডের হাতে ধরা বিরাট আকারের পিস্তলটা। ওরকম পিস্তল এমনকি শক্তিশালী পুরুষেরাও ব্যবহার করার আগে দুইবার চিন্তা করে।

‘এই কেসে কমান্ডার তানভীরকে সার্বিক সহায়তা করা ও তার ব্যাকআপ হিসেব কাজ করার নির্দেশ আছে আমার ওপরে, সুলতানের শেষ কথাটা শুনে তার দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা ঝাঁকাল তানভীর। সুলতানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সাব ইন্সপেক্টর ইকবাল। সুলতানের কথা শেষ হতেই সে কথা বলে উঠল।

‘আমি সাব ইন্সপেক্টর ইকবাল, আমি একেবারে শুরু থেকেই এই কেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। মূলত এখানে আমি পুলিশ ফোর্সের প্রতিনিধিত্ব করছি। তবে…’

ইকবালের কথার মাঝখানে কথা বলে উঠল তানভীর। দুঃখিত, আপনাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিলাম। তবে আমার মনে হয় আপনার কাছ থেকে আমরা পরে শুনব। কারণ আপনার সঙ্গে আরো বিস্তারিত কথা বলতে হবে। আমরা বসে কথা বলতে পারি,’ সবাইকে বসার ইশারা করে টমিকে নির্দেশ দিল কথা বলার জন্যে।

‘আমি টমি, এরই মধ্যে আপনারা প্রায় সবাই আমার পরিচয় জানেন, মূলত আমি এই কেসের যাবতীয় রিসোর্স ম্যাটেরিয়াল অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করব। আমি কেসের ব্যাপারে বিস্তারিত সব একটা ফাইলে আপনাদের সবার সামনে রেখে দিয়েছি। আর সেই ফাইলেরই একটা স্লাইড ভার্সন আমি প্রজেক্টরে দেখাব, যাতে পুরো ব্যাপারটা সবাইকে পরিষ্কার বোঝাতে পারি। তবে আমি প্রেজেন্টেশন শুরু করব সাব ইন্সপেক্টর ইকবাল প্রাথমিক ব্যাপারগুলো বলার পরে।’

‘বাকি রইলাম আমি,’ বলে দুই হাত একটু ওপরে তুলে হেসে উঠল কাঁচাপাকা চুলের বয়স্ক ডক্টর প্রবীর। ‘আমি আসলে সরাসরি এই কেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না। আমি ল্যাবের কর্মকর্তা,’ বলে মৃদু হেসে সে যোগ করল, ‘মহাপরিচালকও বলতে পারেন। আমার ওপরে নির্দেশ আছে যদি সম্ভব হয় যেকোনো ব্যাপারে কমান্ডার তানভীরের টিমকে সহায়তা করা। আপনারা চাইলে আপনাদের মূল আলোচনায় আমাকে নাও রাখতে পারেন,’ বলে সে কাঁচাপাকা চুল নেড়ে সামান্য হেসে উঠল।

‘নাহ, আপনি থাকুন, হয়তো কোনো ব্যাপারে আমাদের সরাসরি সাহায্য করতে পারেন,’ তানভীরও মানুষটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল। ‘ঠিক আছে, এবার আমার পরিচয়টা বলছি। আমি তানভীর মালিক, পিবিআইয়ে ক্রিমিনাল অ্যানালিসিস উইংয়ের সিনিয়র অ্যানালিস্ট। ক্রিমিনাল বিহেভিয়রের ওপরে আমার কিছু দক্ষতা আছে। এ ছাড়াও ফিল্ড অপারেশনের ওপরে বিশেষ ট্রেনিং আছে আমার,’ আসলে ফিল্ড লেভেলে এটাই ওর প্রথম কেস সেটা বলতে গিয়েও চেপে গেল। কেন জানি ওর মনে হচ্ছে টিম কন্ট্রোল করতে গেলে নিজের দুর্বলতা বেশি প্রকাশ না করাই ভালো। যদিও এই অপারেশনে আমি ইমার্জেন্সি অ্যাকশন ফোর্সের প্রতিনিধিত্ব করছি, তবে সেটা শুধুই সাময়িক। তো আমরা কাজের আলোচনায় ফিরে যাব। আমার মনে হয় আগে আমি সাব ইন্সপেক্টর ইকবালের কাছ থেকে সব শুনব,’ শেষ কথাটা ও সুদর্শন সাব ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল ।

তানভীরের কথা শেষ হতেই একবার মাথা নেড়ে ইকবাল শুরু করল। ‘আমি সিলেট সদর থানায় কর্মরত আছি। আজ থেকে দুইদিন আগে সকালবেলা আমাদের থানায় এক ভদ্রমহিলা কমপ্লেইন নিয়ে আসেন, তার স্বামী নাকি মিসিং,’ বলে সে যোগ করল। ‘উনিই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজির নিখোঁজ অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডক্টর মিতায়ন আহমেদের স্ত্রী। তো শুরুতে সবকিছু শুনে তার বক্তব্য রেকর্ডে রেখে তাকে জানানো হয়, এই ব্যাপারে খোঁজখবর করা হবে,’ বলে সে যোগ করল, ‘ভদ্রমহিলা ব্যাপারটা আমাদের অবগত করার কিছুক্ষণ পরেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে থানায় কল করে জরুরি ভিত্তিতে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলার জন্যে থানাকে অবগত করা হয়। এর একটু পরেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে ফোন পাই আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নেতৃত্বে একটা দল পাঠানো হয় ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্যে। ওখানে গিয়ে কথাবার্তা বলে আমরা যা জানতে পারি সেটা বেশ,’ এই পর্যন্ত বলে ইকবাল একবার মাথা ঝাঁকাল। ‘কি বলা চলে, বেশ গুরুতরই বটে। ডক্টর মিতায়ন আহমেদ-,’

ইকবাল এই পর্যন্ত বলতেই তানভীর একটু থামাল তাকে। ‘মিতায়ন আহমেদ? উনি কি মুসলিম? নাকি অন্য ধর্মাবলম্বী? কারণ নামটা একটু অন্যরকম লাগছে আমার কানে।

‘এই ব্যাপারে আমি বলতে পারব,’ ইকবাল জবাব দেয়ার আগেই পাশ থেকে টমি পোদ্দার বলে উঠল। ‘উনি ট্রাইবাল পরিবার থেকে এসেছেন। আগে বুদ্ধিস্ট ছিলেন পরে মুসলিম হিসেবে কনভার্ট করেন।’

‘ঠিক আছে, তার ব্যাপারে পরে শুনব, আগে পুরো ঘটনাটা শুনে নেই, ইকবাল বলুন প্লিজ।’

‘যা বলছিলাম, ডক্টর মিতায়নের কেসটা প্রথমে স্রেফ একটা মিসিং পারসনের কেস ছিল কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করার পর আমরা খতিয়ে দেখতে গিয়ে ব্যাপাটা ধরা পড়ে। আসলে উনার কেসটা শুধু একজন ব্যক্তিবিশেষের মিসিং কেস না। ডক্টর মিতায়ন আন্তর্জাতিক একটা সংস্থার সঙ্গে কোলাবরেশনে ভারতের আসামের একটা বিশেষ এলাকায় গত কয়েক বছর ধরে একটা আর্কিওলজিক্যাল এক্সপিডিশন চালাচ্ছিলেন। সূত্র মতে জানা যায়, এই অপারেশনের সঙ্গে আসামিজ কর্তৃপক্ষ জড়িত ছিল। ডক্টর মিতায়ন আর তাঁর টিম মাঝেমাঝেই আসাম গিয়ে নিজেদের কার্যক্রম চালাতেন। এইবারও তারা প্রায় এক মাসের ওরকম একটা অপারেশান শেষ করে মাঝরাতের পর তামাবিল বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে প্রবেশ করার ঘণ্টাখানেক পরেই তার স্ত্রী মিসেস মিতায়ন আহমেদের সঙ্গে তার কথা হয়, সে জানায় তার সঙ্গে থাকা বিদেশি অতিথিকে সিলেট এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়েই সে বাসায় চলে আসবে সকালের ভেতরে। কিন্তু সে বা তার বিদেশি অতিথি কেউই জায়গামতো পৌছায়নি,’ বলে ইকবাল একটু থামল।

‘সত্যি কথা হলো, আমরা এই কেসে শুধু ডক্টর মিতায়নের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কাজ করছি না। আসলে সেদিন রাতে তামাবিল বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর শুধু ডক্টর মিতায়ন নয় তার পুরো টিমই গায়েব হয়ে গেছে। এমনকি তাদের বাহনটা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডক্টর মিতায়ন, ডক্টর টেড চ্যাঙ ও তাদের টিম মেম্বার বাকি চারজন ও ট্রাক ড্রাইভারসহ পুরো দলটা স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে সেদিন রাতে,’ বলে তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে থাকা প্রতিটি মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল সাব ইন্সপেক্টর ইকবাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *