প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – পূর্বকথা – ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ

পূর্বকথা – ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ

বিহার, ভারতবর্ষ
মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটালিপুত্র থেকে শত ক্রোশ দক্ষিণ পূর্বে

অসীম শূন্যতার পানে তাকিয়ে থাকার মাঝে সবসময়ই অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করে।

প্রাসাদের বিরাট জানালা দিয়ে শূন্যের দিকে তাকিয়ে ভিন্ন সেই অনুভূতির খোঁজ করার চেষ্টা করছে মৌর্য সাম্রাজ্যের বর্তমান সম্রাট বৃহদ্রথ। তবে কেন জানি মনের গহিন কোণে ভালো কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। বরং অদ্ভুত সব শঙ্কা আর আকাঙ্ক্ষার মিশ্র এক অনুভূতি মনের ভেতরে হানা দিয়ে যাচ্ছে বারবার।

প্রাসাদের কামরাটা বিরাট হলেও জানালাটা কেন জানি সেই তুলনায় ছোটো মনে হচ্ছে সম্রাটের কাছে। সেই আফগান ভূমি থেকে শুরু করে সিংহল পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট সাম্রাজ্যের অধিপতি হবার পরও নিজের রাজধানী পাটালিপুত্র থেকে কখনোই খুব বেশি বের হয়নি সে। কিন্তু এবার বের হতে হয়েছে, অনেকটা বাধ্য হয়েই। রাজা তো আর জানে না, নিজের নিয়তিই তাকে টেনে নিয়ে এসেছে এই প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায়।

জানালার সামনের ছোটো পরিসরে পায়চারী করতে করতে মনে মনে সে হিসেব করতে লাগল, কতদিন পর নিজের প্রাসাদ ছেড়ে বের হয়েছে। আঙুলের কড়ে গুনে দেখল, সাত বছর। সিংহাসনে বসার পর একবারও নিজের রাজধানী ছেড়ে বের হয়নি সে। আবারো জানালার সামনে এসে থেমে গেল সম্রাট।

দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড় দেখা যাচ্ছে। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। কারণ যেদিকেই সে দৃষ্টি প্রসারিত করুক, আর যত দূরেই করুক; তত দূরেই নিজের মৌর্য সাম্রাজ্য বিস্তৃত। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। পৃথিবীর ইতিহাসে হাতে গোনা খুব অল্প কজন মানুষই এই সুখানুভূতি অনুভব করতে পেরেছে। এরকম মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই এসেছে, যেদিকে তাকাবে সমস্ত কিছুর মালিক সে। এই অনুভূতি সম্ভবত দু ধরনের মানুষ টের পেয়ে থাকে।

পাগল, আর না হয় সত্যিকারের সম্রাট। বৃহদ্রথ হলো সত্যিকারের সম্রাট।

আজ থেকে শতবর্ষেরও বেশি সময় আগে তার পূর্বপুরুষদের একজন—রাজা চন্দ্রগুপ্ত ও তার ধূর্ত উপদেষ্টা চানক্য মিলে গোড়াপত্তন করেছিল এই বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্য।

সে সময়টাও ছিল এখনকার মতোই বিক্ষিপ্ত। একদিকে বিশ্বজয়ী গ্রিক রাজা আলেকজান্ডারের বাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত উপমহাদেশ, অন্যদিকে স্থানীয় রাজনীতির বিষে বিষাক্ত স্থানীয় পরিবেশ। ঘোলা জলের মতো ঘোলাটে সেই সময়ের সঠিক ব্যবহার করে ঠিকই মাছ শিকার করতে পেরেছিল চন্দ্ৰগুপ্ত মৌর্য। এরপরে এসেছে সম্রাট আশোক, তারপর অন্যরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধু বিস্তারই ঘটেছে মৌর্য সাম্রাজ্যের। বেড়েছে রাজ্যের আকার, বদলে গেছে শাসন ব্যবস্থা, বদল হয়েছে ধর্মের। বদলায়নি শুধু সেই ক্ষমতার খেলা। সেটা তখনো যেমন ছিল, এখনো ঠিক তেমনিই আছে। ওটা সম্ভবত সবসময় একইরকম থাকে।

তবে পরিস্থিতি বদলে গেছে এইমুহূর্তে। আবারো ফিরে এসেছে গ্রিকরা চানক্যের পরামর্শ অনুযায়ী বৃহদ্রথের প্রপিতামহ রাজা চন্দ্রগুপ্ত গ্রিকদের আক্রমণকে অভিশাপ থেকে আশীর্বাদে রূপান্তর করতে পেরেছিল। আলেকজান্ডারের বিক্ষিপ্ত সেনাবাহিনী যখন পশ্চাদপসরণ করতে শুরু করেছে, সেই সুযোগে তাদের ফেলে যাওয়া রাজ্য একের পর এক সে দখল করে বিস্তার করতে থাকে নিজের সাম্রাজ্য। সেইসঙ্গে রচনা করতে থাকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী মৌর্য সাম্রাজ্যের ভিত।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রচিত ভিতের ওপরেই মহীরূহ বিস্তার করেছে আশোক। চন্দ্রগুপ্ত উত্তর-পশ্চিম থেকে শুরু করে মধ্য ভারত পর্যন্ত দখল করেছিল। এরপরে আশোক তার প্রভাব বিস্তার করেছিল দক্ষিণে একেবারে কলিঙ্গ পর্যন্ত। যদিও কলিঙ্গের সেই রক্তের ধারা শুধু দয়া নদীর পানিই লাল করেনি, রক্তাক্ত করেছিল আশোকের হৃদয়কেও। আর তাই সে ধর্মান্তরিত হয়ে গ্রহণ করে নেয় বৌদ্ধ ধর্মকে। বাকি জীবন সে শুধু শান্তির বাণীই প্রচার করে গেছে। তবে আশোকের শাসন শেষ হয়েছে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। এখন বৃহদ্রথের সময়।

তবে এমন এক সময় বৃহদ্রথ রাজা হয়েছে যখন মৌর্য সাম্রাজ্যের আকাশে ঘোর বিপদের ঘনঘটা। পশ্চিম ইউরোপ থেকে আরো বেশি শক্তি আর সামর্থ্য নিয়ে ফিরে এসেছে গ্রিকরা। প্রথম প্রথম শুধু উড়ো উড়ো কথাই কানে এসেছিল তাদের। এমনকি মৌর্য ‘জাসুস’রাও সঠিক কোনো খবর দিতে পারেনি। তবে সব উড়ো খবরই হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সত্যিটা একেবারে চাক্ষুষ সামনে চলে এলো যখন গ্রিসের ব্যাকট্রিয়ার রাজা ডিমিট্রিয়াস মৌর্য সাম্রাজ্যের সবচেয়ে উত্তরের এলাকা কাবুল ঝড়ের গতিতে দখল করে নিল।

ডিমিট্রিয়াসের আক্রমণে বিপর্যন্ত কাবুলের খবর বিহারের পাটালিপুত্রে এসে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বৃহদ্রথ তার উপদেষ্টাদের নিয়ে বসে কী করবে না করবে সেটা ঠিক করার আগেই ডিমিট্রিয়াসের বাহিনী এক ধাক্কায় একেবারে পাঞ্জাব পর্যন্ত দখল করে ফেলে। হইহই রব ওঠে, কী করতে হবে, কিভাবে করতে হবে। কারো বুদ্ধি আর পরামর্শের কোনো আগা-মাথা নেই। এরকম পরিস্থিতিতে রাজাকেই হতে হয় সবচেয়ে কৌশলী আর সাহসী। সকল বিপদ আর শঙ্কার রাশ টেনে ধরে যে রাজা পরিস্থিতি সামলাতে পারে সে-ই হয়ে ওঠে মহান রাজা। কিন্তু ওরকম পরিস্থিতিতে সঠিক নেতৃত্ব দিতে একরকম ব্যর্থই হয় বৃহদ্রথ। তার ওপরে সে সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে যায় যখন জানতে পারে রাজকোষে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ যথেষ্ঠ নয়।

বহু আগে কে বা কারা বলেছিল, যুদ্ধ আসলে সৈনিকরা জেতায় না, যুদ্ধ জেতায় অর্থ। কথাটা সঠিকের চেয়েও বেশি সঠিক।

ফাঁকা রাজকোষ দেখে বৃহদ্রথের মাথা গরম হয়ে ওঠে। যুদ্ধ চালানোর জন্যে চাই তাল তাল অর্থ, আর সেখানে কি না তার অর্থমন্ত্রী খবর নিয়ে এসেছে, রাজকোষ একরকম ফাঁকাই বলা চলে। এবার কি হবে?

একদিকে ডিমিট্রিয়াসের আক্রমণে বিপর্যস্ত সাম্রাজ্য, অন্যদিকে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা, তার ওপরে আবার ফাঁকা রাজকোষ। রাজা বৃহদ্রথ যে কি না কোনোদিনই কোনো শক্ত পরিস্থিতি মোকাবেলা করেনি তার জন্যে এ তো নরকসম পরিস্থিতি। আগে রাজা যেখানে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বলতে গেলে আয়েশ করেই সারাদিন কাটাত সেখানে তার আয়েশ-আরাম তো দূরে থাক নাওয়া- খাওয়াই উঠে যাবার জোগাড় হয়। পায়ের তালু থেকে শুরু করে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত গরম হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। এরকম পরিস্থিতিতে হঠাৎ একজন উপদেষ্টার পরামর্শ শুনে হালে খানিকটা পানি পায় বৃহদ্রথ। উপদেষ্টার বাতলে দেয়া পরামর্শটা তার কাছে একেবারেই সময়োপযোগী মনে হয়। যদিও এর মধ্যে খানিকটা ঘাপলা আছে।

কী সেই পরামর্শ? নিজের রাজধানী পাটালিপুত্র ছেড়ে বেরুতে হবে তাকে। জন্মের পর থেকেই বিরাট সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেও কখনোই নিজের এলাকা আর নিজের রাজ্য ছেড়ে বেরোয়নি রাজা বৃহদ্রথ। তাহলে এরকম বাজে পরিস্থিতিতে কেন তাকে বেরোতে হবে। বেরোতে হবে কারণ তার এলাকা বিহার থেকে কিছুটা দূরে-বহু পুরনো এক নগরী আছে।

হাজার বছরের পুরনো এই নগরীকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘খাণ্ডাল’ অর্থাৎ পরিত্যক্ত এক নগরী। বিরাট মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজা বৃহদ্রথ নিজের সমৃদ্ধ নগরী পাটালিপুত্র ছেড়ে এই অসময়ে খাণ্ডালে কেন আসবেন। এর পেছনেও কারণ আছে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে স্থাপিত হাজারো বছরের পুরনো এই নগরীর বিরাট ইতিহাস আছে।

বহু আগে অযোধ্যার রাজা হারিতের সময়ে স্থাপন করা হয়েছিল এই নগরী। হারিত ছিল ভারতবর্ষের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা হরিষচন্দ্রের বংশধর। যদিও তার জন্ম ইতিহাস অত্যন্ত পাপময়, তবে তার হাতেই গোড়াপত্তন ঘটেছিল এই নগরীর। কথিত আছে, প্রাচীন দেবতাদের সবচেয়ে কুখ্যাতদের একজন—কুবেরের হাত থেকে নিজের বিরাট ধনসম্পদ রক্ষা করার জন্যে আরেক দেবী গোমুখীকে উৎসর্গ করে বিশেষ কায়দায় বিশেষ জায়গায় স্থাপন করা হয়েছিল এই নগরী।

সৃষ্টির আদি থেকেই এটা যেখানে যেভাবে তৈরি করা হয়েছিল, সেভাবেই রয়ে গেছে। কেউ এতে হাত দিতে পারেনি। কথিত আছে স্বয়ং দেবী গোমুখী এই নগরী আর এর বিপুল ধনরাশির সুরক্ষা করে।

হাজার বছর ধরে এই নগরীর অভ্যন্তরে কোথাও না কোথাও লুকানো আছে রাজা হারিতের বিরাট ধনসম্পদের একাংশ। তবে হাজার বছর ধরেই অনেকে চেষ্টা করেছে সেটা উদ্ধার করার, কেউই পারেনি। বহু রাজা আর তাদের বাহিনী চেষ্টা করেও বের করতে পারেনি এই নগরীর লুকানো রহস্য। বরং ধ্বংস হয়ে গেছে নিজেরাই।

এরপর থেকে কঠিনভাবে এই নগরী এড়িয়ে চলে সবাই। বিশেষ করে স্থানীয় উপকথা বলে, এই নগরীতে কোনো সৈন্যবাহিনীর প্রবেশ নিষেধ। সেই সঙ্গে এই নগরীতে রক্তপাতও নিষেধ। হাজার বছরের ইতিহাসে কেউই ভাঙেনি এই নিয়ম। তবে বহু বছর পর অর্থের লোভে ইতিহাসের এই শক্ত শিকল ভাঙতে চলেছে সম্রাট বৃহদ্রথ। আর সেজন্যেই নিজের রাজধানী পাটালিপুত্র ছেড়ে দুটো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বেরিয়ে এসেছে সে এখানে।

নিজের উপদেষ্টার কথা শুনে প্রথমে ভয়ে চমকে উঠেছিল বৃহদ্রথ। হাজার বছরে যে নিয়ম কেউ ভাঙেনি সেটা সে ভাঙবে কী করে! উপদেষ্টা তাকে জানায় হাজার বছরের ভেতরে কেউ এমন বিপদেও তো পড়েনি যেমনটা এই মুহূর্তে মহারাজা মোকাবেলা করছে। আর হাজার বছরের নিয়ম ভেঙে যে সামনে এগিয়ে যায় সেই তো মহান রাজা। প্রথমে ব্যাপারটা আমলে নেয়নি বৃহদ্রথ, কিন্তু যতই সময় যেতে থাকে ধীরে ধীরে ব্যাপারটার গভীরতা অনুভব করতে থাকে সে। নিজের উপদেষ্টা আর সেনাবাহিনীর প্রধান পুশ্যমিত্রের কথামতো নিজের সেনাবাহিনীকে এই প্রাচীন নগরীর বাইরেই জড়ো করার নির্দেশ দেয় সে।

দুটো উদ্দেশ্যের একটি হলো, সে নিজে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবে। নিজের চোখে সে দেখতে চায় তার সেনাবাহিনীর সামর্থ আসলে কতটুক। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, কুচকাওয়াজের প্রদর্শনীর পরই প্রাচীন নগরীর প্রবেশমুখে শুরু হবে বিশেষ যজ্ঞ। এই যজ্ঞের পরই নগরীর ভেতরে প্রবেশ করবে সেনাবাহিনীর একটা অংশ, খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে গোমুখী দেবীর মন্দির আর তার নিচে লুকানো বিরাট সম্পদ।

পায়চারী থামিয়ে রাজা বৃহদ্রথ তক্তপোশের ওপরে রাখা রাজকীয় পোশাক পরে নিয়ে প্রাসাদের জানালাটার সামনে এসে দাঁড়াল। এখান থেকে দূরের পাহাড় সারি চোখে পড়ছে। পাহাড় সারির আগে একপাশে চিত হয়ে থাকা চিতল পাহাড়ের সামনে ত্রিশূল আকৃতির একটা শৈলশিলা চোখে পড়ল। রাজা জানে ওই ত্রিশূল আকারের শৈলশিলার পর থেকেই শুরু হয়েছে সেই প্রাচীন নগরী। ওই নগরীর সামনের পাহাড়ি উপত্যকায় নগর তোরণের অন্যপাশেই জমায়েত হয়েছে তার সেনাবাহিনীর একটা বিরাট অংশ। নিজে রাজা হলেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে কখনোই সরাসরি মোলাকাত হয়নি তার। এবারই প্রথমবারের মতো সে পর্যবেক্ষণ করতে যাচ্ছে তাদেরকে। এটাও একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে, সন্দেহ নেই।

হঠাৎ দরজায় কড়াঘাতের শব্দে নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো সে। ভেতরে আসার নির্দেশ দিয়ে পিঠ সোজা আর বুক টানটান করে ফিরে তাকাল দরজার দিকে। রাজাকে জনসম্মুখে সবসময় রাজার মতোই থাকতে হয়। একজন চাপরাশি প্রবেশ করল ভেতরে।

মাথা নিচু করে রাজার চোখে দৃষ্টি না মিলিয়ে সে বলে উঠল, ‘হুজুর, সব প্রস্তুত হয়েছে। সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে।’

লোকটাকে ইশারায় বিদায় দিয়ে বিছানার পাশেই রাখা সুরাপাত্র থেকে সরাসরি দুটোক সুরা গলায় ঢেলে নিল সে। আজ একটা বিশেষ দিন, খানিকটা নিয়ম ভাঙলে সমস্যা নেই। হাতের উলটোপিঠ দিয়ে মুখ মুছে আবারো শরীরটাকে টানটান করে বেরিয়ে এলো সে। কামরার বাইরে বেরোতেই দুইপাশ থেকে দুজন দেহরক্ষী তাকে কুর্নিশ করে পেছনে হাঁটতে লাগল।

‘কি ব্যাপার, রঙ্গলাল কোথায়?’ রাজা বৃহদ্রথ হাঁটতে হাঁটতেই জানতে চাইল। রঙ্গলাল তার প্রধান দেহরক্ষী। সাধারণত রঙ্গলাল আর তার বিশ্বস্ত প্রহরী ছাড়া রাজা কোথাও যায় না।

‘হুজুর, রঙ্গলালের আচানক শরীর খারাপ হয়েছে, সে ছুটিতে গেছে। আমাদেরকে দায়িত্ব বুঝায়ে দিয়ে গেছে,’ তার দ্বিতীয় প্রধান দেহরক্ষী সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে জানাল। রাজা বৃহদ্রথ একবার মাথা নেড়েই ব্যাপারটা ভুলে গেল। এখন তাকে আরো অনেক জরুরি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। এসব ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে মাথা না ঘামানোই শ্রেয়। নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে সরু গলি পথের মতো জায়গাটা পার হতেই তারা চলে এলো ফটকের গোলমতো একটা জায়গায়। এখানে রাজাকে বরণ করে নেয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। রাজা বৃহদ্রথ গিয়ে থামতেই একজন বৌদ্ধ পুরোহিত এসে তাকে পবিত্র শ্লোক পাঠ করে শোনাল। বহু পুরনো রীতি। এরপর রাজনিয়ম অনুযায়ী সমস্ত রীতি সম্পন্ন হবার পর সে রওনা দেয়ার অনুমতি পেল।

পুজোকর্ম শেষ হতেই সামনে এগিয়ে এলো রাজা বৃহদ্রথের প্রধান সেনাপতি ব্রাহ্মণ বংশদ্ভূত শুঙ্গ গোত্রের প্রতিনিধি পুশ্যমিত্র শুঙ্গ। পুরোপুরি সামরিক পোশাকে সজ্জিত সেনাপতি পুশ্যমিত্র আর তার সঙ্গীদের দেখে মনে হচ্ছে কুচকাওয়াজ নয় বরং যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে তারা। তাদের সামরিক সাজ-পোশাকের সামনে হঠাৎ রাজা বৃহদ্রথের খানিকটা হীনমন্যতা বোধ হতে লাগল। আসলে একজন বৌদ্ধ রাজার ব্রাহ্মণ সেনাপতি নিয়োগ দেয়া নিয়ে রাজমহলে অনেকেরই আপত্তি ছিল, কিন্তু রাজা কারো কথা না শুনে কেন জানি পুশ্যমিত্রের ওপরেই ভরসা করেছে। সে ভরসার ফলও পেয়েছে হাতেনাতে। মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এত প্রভাবশালী সেনাপতি খুব কমই এসেছে এর আগে। সেনাবাহিনীতে এমনকি রাজার চেয়েও অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পুশ্যমিত্র। রাজাকে কুর্নিশ করে সে সকল প্রস্তুতির বিস্তারিত বিররণ জানাল।

সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত আছে, পদাতিক সৈন্য, ঘোড়সওয়ার, হাতির সওয়ারি থেকে শুরু করে সকলেই নিজেদের কর্মদক্ষতা রাজাকে দেখানোর জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

রাজা এগোতে গিয়েও থেমে গিয়ে হঠাৎ জানতে চাইল হাজার বছরের নিয়ম উপেক্ষা করে সে যে এই প্রাচীন নগরীর ফটকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসেছে এটা নিয়ে সৈন্যদের মাঝে কোনো ক্ষোভ আছে কি না। রাজার প্রশ্ন শুনে তার ব্রাহ্মণ সেনাপতি একগাল হেসে জবাব দিল, ‘সৈন্যদের এত কথা শুনতে গেলে তো সেনাবাহিনী চালানো যাবে না। কর্তা ব্যক্তিরা নির্দেশ দেবে, সৈন্যরা পালন করবে এটাই শুরু, এটাই শেষ কথা।’

সেনাপতির জবাব শুনে রাজা বৃহদ্রথের বুকটা গর্বে ফুলে উঠল। এই না হলো মৌর্য সাম্রাজ্যের উপযুক্ত সেনাপতি। আবেগের আতিশয্যে সে হঠাৎ পুশ্যমিত্রকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানাল। একজন রাজার জন্যে ব্যাপারটা অত্যন্ত ব্যতিক্রম। পুশ্যমিত্র একবার কুর্নিশ করে সম্মান জানাল তাকে।

রাজা বৃহদ্রথ তার সেনাপতিকে পাশে নিয়ে পুরো বাহিনীর সম্মুখভাগে এসে দাঁড়াল। একবার সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে তারা নগর তোরণের ওপরে এসে উঠল। এখানে শুধু রাজা, সেনাবাহিনীর প্রধান আর তার বিশিষ্ট মন্ত্রীবর্গ ছাড়া আর কেউ উঠতে পারবে না। রাজা ওপরে এসে উঠতেই সেনাপ্রধানের লোকেরা পুরো জায়গাটা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় ঘিরে ফেলল। রাজা মশায় ওপরে এসে উঠতেই প্রথমে সৈন্যরা আনন্দধ্বনি করে উঠল। তারপর সুশৃঙ্খল পন্থায় শুরু হলো কুচকাওয়াজ। রাজা আনন্দের সঙ্গে দেখতে লাগল।

সূর্য মাথার ওপর থেকে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই দরদর করে ঘামতে লাগল রাজা। তবে হঠাৎই এক ঝলক পাহাড়ি বাতাসে কেমন যেন শিরশিরে ঠান্ডা অনুভূতি হলো তার। আচমকাই কুচকাওয়াজ ছাড়িয়ে তার দৃষ্টি চলে গেল পাহাড়ের পাদদেশে সেই ত্রিশূল আকৃতির শৈলশিলার দিকে। লোভের বশবতী হয়ে হাজার বছরের পুরনো নিয়ম ভাঙতে যাচ্ছে সে, কাজটা কি আসলেই ঠিক হচ্ছে? ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো হঠাৎ।

অনেকটা জোর করেই ওদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে ফিরে তাকাল নিজের লোকদের দিকে। কাউকে ডেকে পানি বা শরবত আনানোর নির্দেশ দেয়ার ইচ্ছে। কিন্তু অবাক হয়ে রাজা খেয়াল করল নগর তোরণের ওপরে এই মুহূর্তে শুধু সে একাই দাঁড়িয়ে আছে। সেনাপ্রধান, মন্ত্রী বা দেহরক্ষীরাও কেউ নেই। সে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল তার সেনাপ্রধান নিচ থেকে ওপরে উঠে এগিয়ে আসছে তার দিকে। একেবারে কাছে এসে থেমে গেল সে। একটু অবাক হয়েই রাজা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলল, ‘পুশ্যমিত্র…’

তার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। শক্তিশালী সেনাপ্রধান একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে বের করে আনল একটা বিরাট ছোরা। রাজা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একাধিকবার সেটা ঢুকিয়ে দিল রাজা বৃহদ্রথের বুকে-পেটে। বিস্মিত- রক্তাক্ত-বিহ্বল রাজার মৃতদেহটাকে সে ছুঁড়ে ফেলে দিল নগর তোরণের ওপর থেকে।

রক্তাক্ত রাজার মৃতদেহটা ছিটকে গিয়ে পড়ল তারই কুচকাওয়াজরত বাহিনীর একেবারে অগ্রভাগে। সঙ্গে-সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো সেনাবাহিনী। নগর তোরণের ওপর থেকে রাজাকে খুন করা রক্তাক্ত খঞ্জর হাতে চিৎকার করে ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুশ্যমিত্র নিজেকে রাজা ঘোষণা করল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল রক্তের হোলি খেলা।

সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের ময়দান থেকে শুরু করে বিহারের রাজধানী পাটালিপুত্র পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী প্রতিটি মানুষের প্রাণনাশের জন্যে উঠে-পড়ে লাগল পুশ্যমিত্রের বাহিনী।

দক্ষিণ ভারত থেকে শুরু করে নেপালের লুম্বিনি পর্যন্ত যাকে যেখানে পাওয়া গেল মেরে শেষ করা হলো বৌদ্ধদেরকে। পুড়িয়ে দেয়া হলো হাজার হাজার মঠ, আশ্রম, স্তূপ আর আশ্রয়স্থল। মৌর্যদের শাসন চিরকালের মতো নিশ্চিহ্ন করে রাজা পুশ্যমিত্র নিজেকে শুঙ্গ বংশের চিরস্থায়ী রাজা ঘোষণা করে নির্দেশ জারি করল; যে যেখানে পারো ভারতবর্ষের সকল বৌদ্ধদের ধরে নিয়ে আসো। সে পরিষ্কার ঘোষণা করল, প্রতিটি কর্তিত বুদ্ধ মস্তকের জন্যে সোনার মোহর পুরস্কার দেয়া হবে।

শুরু হয়ে গেল ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত গণহত্যাগুলোর একটি, যা চিরকালের মতো বদলে দিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি অংশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *