প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৪০

অধ্যায় চল্লিশ – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর, ভারতবর্ষ

কাঠের খুঁটিতে হেলান দিয়ে শামান মুখ থেকে সরু ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে একবার বিধুর দিকে দেখল, তারপর ফিরে তাকাল ঘোষিতের দিকে।

‘বিধু, তোরা দুজন কি নিশ্চিত যে তোদের পরিবারের পূর্বপুরুষদের ভেতরে কোনো সম্পর্ক নেই?’ শামান ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তেই মৃদু স্বরে বলে উঠল। বিধু আর ঘোষিত দুজনেই হাসতে-হাসতে এক অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়ছিল আর মজা করে চামড়ার থলে থেকে বের করা গুঁড়ো নাকে টেনে নিচ্ছিল। শামানের কথা শুনে দুজনেই চোখ গোল গোল করে তাকাল।

ওদের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে নিজের চাবুকটাকে পালিশ করতে-করতে ধোয়ীর সঙ্গে কথা বলছিল কালন্তি, শামানের মন্তব্য শুনে হেসে উঠল সে। আর ধোয়ী একবার তার গোল মুখটাকে ঝাঁকিয়ে নিয়ে আবারো আগের মতো হয়ে গেল।

শামান মুখটাকে খুব গম্ভীর করে দুই হাত তুলে বলে উঠল, ‘না মানে, দুজনের গায়ের রংটাকে বাদ দিলে এত মিল হয় কী করে!’

‘ওস্তাদ দেখো—’ বিধু খুব রেগে-মেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সরল গোল মুখ বাঁকিয়ে ধোয়ী যে কথা বলে উঠল। ‘লাল চুলের যোদ্ধা তো ঠিকই বলেছে। তোগো দেখলে মনে হয় জমজ ভাই। আর দুজনের গায়ের বিশ্রী গন্ধটাও প্রায় একইরকম, বলে সে শামানের দিকে ফিরে বিস্ময়ের ভান করে বলে উঠল ‘দুটোই খালি খায় আর জীবনেও মনে হয় গোসল করে না…’

প্রায় সবাই সমস্বরে হেসে উঠল। শামান ফিরে তাকাল কালন্তির দিকে, সে হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখে শাক্যদের তাঁবুর দিকে দেখছে। ওখানেই রাজা মানরু, রাজা বিক্রম আর শংকরাদিত্য নিজের বাহিনীর প্রধানদের নিয়ে বন্দি লিচ্ছবী সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলছে।

ছিলা প্রস্তুতকারীদের গ্রাম থেকে ওদেরকে ধরে আনার পর প্রথমে সৈন্যরা খুব গরম দেখিয়েছে, তারপর বিধু আর জাথুরিয়ার হাতে কয়েক ঘা খাবার পর একেবারে চুপ হয়ে গেছে। এরপরে আরো কয়েক দফা তাদেরকে ধোলাই দেয়ার পর রাজা মানরু বলেছে আগে ওদের সঙ্গে কথা বলতে চায় সে, এসব মারামারিতে তার ঘোর আপত্তি আছে। এরপরেই রাজা বিক্রম সে আর অন্যরা মিলে কথা বলতে গেছে সৈন্যদের সঙ্গে। আর শামানেরা অপেক্ষা করছে বাইরে।

‘এত চিন্তা করছো কেন?’ কালন্তির দিকে ফিরে বলে উঠল শামান। ‘অবশ্য আমার নিজেরও যে চিন্তা হচ্ছে না তা না।’

‘নাহ, ভাবছি গোটা ব্যাপারটাই কি বিশ্রী তাই না,’ বলে কালন্তি গভীরভাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘ধর্ম হলো শান্তির জন্যে অথচ ধর্ম নিয়েই কত বিবাদ। একে অপরকে বদনাম করার জন্যে কত আয়োজন। অথচ এই আয়োজনটা যদি মানুষ সবার মঙ্গলের জন্যে ব্যয় করত তবে কতই না ভালো হতো।’

‘হ্যাঁ, সবাই যদি এভাবে চিন্তা করত তবে তো ভালোই হতো,’ বলে শামানও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘কিন্তু মানুষ তো এভাবে চিন্তা করে না। ডুকপা লামার না জানি কী হাল?’

ওর চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে কালন্তি বলে উঠল, ‘আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ডুকপা লামাকে উদ্ধার করতে পারবে, শান্তি ফিরে আসবে এই উপত্যকায়,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল। ‘আর তুমি অবশ্যই একদিন খুঁজে বের করতে পারবে নিজের গোত্র, হয়তো বা নিজের সত্যিকারের পরিচয়,’ কালন্তি এখনো একইভাবে তাকিয়ে আছে শামানের চোখের দিকে।

আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অন্যদিকে ফিরে তাকাল শামান। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বলে উঠল, ‘একটা সত্যি কথা বলি তোমাকে। আমি প্রথম যখন এখানে আসি এর পেছনে কয়েকটা কারণ ছিল। প্রধান কারণ ছিল-ডুকপা লামা নাকি আমার আসল পরিচয় জানে। একমাত্র ডুকপা লামাই জানে আমাকে উদ্ধার করার সময়ে আমার সঙ্গে বিজাতীয় ভাষায় লেখা যে তঞ্জুর ছিল সেটা কোথায় আছে। সেটা জানার জন্যেই মূলত আমি এখানে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে আসার পর একটার পর একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার…আমার ভেতরটা আসলে বদলে গেছে।’

‘কেন জানি এখন সেই ব্যাপারটা আর গুরুত্ব রাখে না। এখানে আসার পর প্রতি পদে আমি উপলব্ধি করেছি, আমি ডুকপা লামা, শান্তির মঠ আর আমার শৈশবকে কতটা ভালোবাসি। যদিও আমি শান্তির মঠের একজন হতে পারিনি কিন্তু কেন জানি মনে হয় সেই না হতে পারাটাই আমার ভেতরের হাহাকারটাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। আমি যদি ডুকপা লামাকে উদ্ধার করে শান্তির মঠে ফিরিয়ে নিতে পারি সেটাই হবে আমার সবথেকে বড়ো পাওয়া। এমনকি উনি যদি কখনো আমাকে সেই তঞ্জুরের ব্যাপারে নাও বলেন তবে সেটারও কোনো গুরুত্ব নেই, ‘ বলে শামান আবারো মৃদু হেসে উঠল।

সময় মানুষকে বদলে দেয়,’ বলে কালন্তি যোগ করল। ‘আর মানুষকে বদলে যাওয়া মানুষের সবথেকে বড়ো পরিবর্তন হলো তার চাহিদাগুলো বদলে যাওয়া। আমি মনে করি…’ কালন্তি কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই রাজা মানরুরা যেখানে কথা বলছিল সেদিক থেকে কথোপকথনের শব্দ ভেসে এলো।

শামান তাকিয়ে দেখল রাজা মানরু রাজা বিক্রমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসছে।

‘কাজ হলো?’ শামান মাথা ঝুঁকিয়ে রাজা মানরুকে অভিবাদন করে জানতে চাইল। ‘কিছু জানতে পারলেন?’

রাজা মানরু কিছু না বলে হেসে উঠল, ‘কাজ হওয়া কি এতই সহজ! তবে হ্যাঁ প্রক্রিয়াটা কষ্টকর হলেও শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু ব্যাপার জানতে পেরেছি।’

‘কিভাবে?’ শামানের পাশ থেকে কালন্তি জানতে চাইল।

‘ওদের জীবনের বিনিময়ে, যাই হোক এসব বাদ দিয়ে আমরা বরং মূল বিষয়টাতে আলোকপাত করি,’ এবার কথা বলে উঠল রাজা বিক্রম।

‘আমরা এটা বের করতে পেরেছি, ডুকপা লামাকে রাখা হয়েছে বিধোরীর দুর্গে,’ বলে একটা হাত তুলল সে। ‘ব্যাপারটা আমার অনুমানের সঙ্গে একেবারে মিলে গেছে। আমি এর আগে যতবার মনে মনে কল্পনা করেছি রাজা মানরুকে কোথায় রাখা হয়ে থাকতে পারে প্রতিবার কেন জানি আমার বিধোরীর দুর্গের কথাই মনে হয়েছে।’

‘এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে?’ শামান জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ, আছে,’ রাজা বিক্রমের হয়ে উত্তর দিল শংকরাদিত্য। ‘কারণ বিধোরীর দুর্গটা হলো আমাদের কন্নোরে যে কয়টা দুর্গ আছে তার ভেতরে সবচেয়ে বড়ো। তবে এইটাই মূল কারণ নয়। বিধোরীর দুর্গটা উপত্যকার শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে ওটা গিয়ে মিশেছে একটা হ্রদের সঙ্গে, দুর্গের একটা অংশ থেকে ওই হ্রদের প্রধান জলপ্রপাতের সঙ্গে সংযুক্ত।’

‘তারমানে, বিধোরীর দুর্গের নিজস্ব পানির প্রবাহ রয়েছে, আনমনেই বলে উঠল শামান।

‘শুধু পানির প্রবাহই নয়। বিধোরীর দুর্গের এই পানির প্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে নিজস্ব একটা অস্ত্রাগার। যদিও গত প্রায় বিশ বছর ধরে অস্ত্র নির্মাণের কাজ ওটাতে বন্ধ আছে, তবে আমার বিশ্বাস এই অস্ত্রাগারেই আবারো উরগদেরকে দিয়ে কাজ শুরু করিয়েছে লিচ্ছবীরা।’

‘স্বাভাবিক,’ রাজা মানরু মন্তব্য করল। ‘ওরা যা করতে চাইছে সেটা করার জন্যে একটা অস্ত্রাগারের চেয়ে ভালো জায়গা আর কী হতে পারে? এখন আপনারা কী করতে চান?’

‘অভিযান চালাতে হবে,’ শামান খুঁটির গায়ে হেলান দিয়ে বসেছিল এতক্ষণ। সেটা থেকে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ‘আমি হিসেব করে দেখেছি, যদি আমরা বিধোরীর দুর্গ থেকে ডুকপা লামাকে উদ্ধার করে আনতে চাই তবে দুটো পন্থা আছে; হয় সরাসরি আক্রমণ করতে হবে—যেটা করার সামর্থ আমাদের নেই। আর না হয় চোরাগুপ্তা অভিযান চালানো। আমাদেরকে অবশ্যই দ্বিতীয়টা করতে হবে। আর সেটাও করতে হবে আজই, আজ রাতেই।’

‘দেখো যোদ্ধা, তোমার সব আগ্রহ ডুকপা লামাকে উদ্ধার করার জন্যে হতে পারে। কিন্তু আমরা সেটার পাশাপাশি ওই বুদ্ধ মূর্তিটা ধ্বংস করতে চাই। ওটাই আমাদের প্রাধান্য,’ শংকরাদিত্য বলে উঠল, শামানের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

হাতের ধোঁয়া টানার নলটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে দুই পা এগিয়ে এলো শামান। ‘আচ্ছা, আমার তো মনে হয় আপনাদের আগ্রহ তারচেয়ে বেশি রাজা হেমচন্দ্রের ব্যাপারে,’ বলে সে রাজা বিক্রমের দিকে ফিরে তাকাল। ‘আপনারা কি ভেবেছেন বিধোরীর দুর্গে রাজা হেমচন্দ্র থাকে এটা আমি জানি না। শুনুন, আপনাদের উদ্দেশ্য যাই থাক না কেন আমার প্রথম কাজ ডুকপা লামাকে নিরাপদে উদ্ধার করা, পরেরটা পরে,’ শামান শংকরাদিত্যের একেবারে কাছে গিয়ে তার চোখের সামনে আঙুল নেড়ে কথাগুলো বলে উঠল।

‘দেখো যোদ্ধা মুখ সামলে…’

‘শান্তি, শান্তি,’ রাজা বিক্রম ধমকে উঠল। ‘শংকর চুপ,’ বলে সে শংকরকে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিল। ‘লাল চুলের যোদ্ধা যেভাবে নিজের প্রাণ বাজি রেখে আমাকে উদ্ধার করেছে এরপরও তুই তার সঙ্গে তর্ক করিস,’ রাজার ধমক খেয়ে শংকরও চুপ হয়ে গেছিল, সে আবারো মুখ তুলে বলে উঠল, ‘আমি—’

‘একদম চুপ, রাজা বিক্রম ধমকে উঠে শামানের দিকে ফিরে তাকাল। ‘দুঃখিত যোদ্ধা। ওর হয়ে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি অস্বীকার করব না যে এই অভিযানে ডুকপা লামাকে উদ্ধার করার পাশাপাশি সেই মূর্তিরও একটা গতি করতে চাই আমরা। এর সঙ্গে রাজা হেমচন্দ্রের ব্যাপারেও আগ্রহ আছে আমাদের। তবে, সেটা পরে। আগে প্রথম দুটোর সুরাহা হোক, পরেরটা পরে দেখা যাবে,’ বলে সে একেবারে শামানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘যোদ্ধা, আমি আশা করি তুমি বুঝতে পারছো যে এইবারই আমাদের শেষ একটা সুযোগ। এবার যদি লিচ্ছবী আর উরগদের কিছু একটা করতে না পারি আমরা, বিশেষ করে হেমচন্দ্রের ব্যাপারে যতক্ষণ কোনো একটা ব্যবস্থা নিতে না পারছি-এই উপত্যকা নরকই রয়ে যাবে। আজকের অভিযানের পর যদি মূর্তি নষ্টও করতে পারি আমরা। সেইসঙ্গে ডুকপা লামাকেও উদ্ধার করতে পারি, কিন্তু হেমচন্দ্রের একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে তোমার কি ধারণা সে আমাদের ছেড়ে দেবে। এই এলাকায় বৌদ্ধ শাসন চিরতরে শেষ হবে।‘

কথা বলতে বলতে রাজা বিক্রম উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ‘এই অভিযানে যদি লিচ্ছবীদের শাসন অবসান করতে না পারি তবে এই এলাকা নরকই রয়ে যাবে।

কারণ থারু-শাক্য বৌদ্ধ কেউই নিরাপদ তো থাকবেই না বরং সব ধ্বংস করবে হেমচন্দ্র। কাজেই এবারের অভিযানেই সকল যন্ত্রণার অবসান করতে হবে,’ বলে সে তাকিয়ে রইল শামানের দিকে তারপর ফিরে তাকাল রাজা মানরুর দিকে।

সবাই চুপ। রাজা মানরু একবার মাথা নেড়ে বলে উঠল, ‘আমি রাজা বিক্রমের সঙ্গে একমত পোষণ করি। উনি ঠিকই বলেছেন। এবারের অভিযানেই সবকিছুর সমাধান করতে হবে। তা না হলে আসলেই এই উপত্যকায় জ্বলতে থাকা আগুন কোনোদিন নিভবে না। শান্তিপূর্ণভাবে কেউই টিকতে পারবে না এখানে। কাজেই আমার মনে হয় এক অভিযানে সব সমাধান করাটাই সব দিক থেকে ভালো হবে।’

‘ঠিক আছে,’ শামান বলে উঠল। ‘সবাই যদি তাই মনে করে তবে তাই হবে। তবে আমারও একটা কথা আছে, আগে ডুকপা লামাকে উদ্ধার করা হবে, বাকি সব পরে হবে। যদি এতে সবাই একমত পোষণ না করে তবে আমিও আপনাদের কথা মানব না, আপনাদেরকে সহায়তা করব না।’

রাজা মানরু বলে উঠল, ‘আমার মনে হয় যোদ্ধা ঠিকই বলেছে।’

সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই শামান যোগ করল। ‘আরেকটা কথা, অভিযান আজ রাতেই চালাতে হবে।’

‘আজকেই?’ কালন্তি অবাক হয়ে বলে উঠল। ‘বেলা তো প্রায় পড়তির দিকে। এরকম একটা অভিযান চালানোর জন্যে যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার তার কিছুই এত অল্প সময়ের ভেতরে নেয়া সম্ভব নয়।’

‘এখুনি প্রস্তুতি নিতে হবে আর অভিযানও আজ রাতেই চালাতে হবে,’ শামান তাকিয়ে আছে থারু আর শাক্যদের দিকে। অনেকেই মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাচ্ছে। শামান বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলতে শুরু করল। ‘কেন আজই সেটা আমি বুঝিয়ে বলছি। গতকাল আমরা মন্তলার হাটে অভিযান চালিয়ে রাজা বিক্রমকে উদ্ধার করে এনেছি। আজ আবার ছিলা প্রস্তুতকারীদের বাড়ি থেকে ধরে এনেছি রাজা হেমচন্দ্রের সেনাপতির নিজের লোককে, আপনাদের কি ধারণা এরপরেও পরিস্থিতি আগের মতোই থাকবে?’ প্রশ্নটা করেই ও সবাইকে এক পলক দেখে নিল।

‘অবশ্যই না। গতকালের অভিযানের পরই সব পাল্টে গেছে, আজ আমরা সেনাপতির লোকদেরকে ধরে আনতে পেরেছি, সেটা আমাদের সৌভাগ্য ছিল। তবে আজ হেমচন্দ্রের সেনাপতি যখন ধরতে পারবে যে তার লোকেরা ছিলা প্রস্তুতকারীদের বাড়ি থেকে ফিরে আসেনি, তখন কাল ঠিকই সেনাপতির বাহিনী হাজির হবে ছিলা প্রস্ততকারীদের বাড়িতে। ওখানে কী ঘটেছে একবার বের করতে পারলে দুর্গে আর একটা মশাও ঢুকতে পারার মতো পরিস্থিতি থাকবে না। কাজেই যা করার আজই করতে হবে।’

‘আমি যোদ্ধার কথা শতভাগ সমর্থন করি,’ রাজা বিক্রম ঘোষণা দেয়ার মতো বলে উঠল। যা করার আজই করতে হবে। তবে হ্যাঁ, সেটাও করা সম্ভব কারণ একটা দিক থেকে আমরা এগিয়ে আছি। আমি এই বিধোরীর দুর্গে জন্মেছি, বড়ো হয়েছি। এই দুর্গের প্রতিটি ধূলিকণা আমি চিনি। সেই তুলনায় লিচ্ছবীরা এই দুর্গে একেবারেই নতুন। কাজেই আমরা চাইলে এমন কিছু করতে পারব যা ওরা পারবে না,’ এই পর্যন্ত বলে সে সবাইকে সামনের দিকে এগোনোর নির্দেশ দিয়ে নিজে শংকরাদিত্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই শংকর তার হাতে একটা তলোয়ার ধরিয়ে দিল।

সবাইকে গোল হয়ে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দিয়ে সে রাজা মানরুর বাড়ির সামনের মাটিতে তলোয়ারের ডগা দিয়ে সময় নিয়ে একটা দুর্গের মতো আকৃতি এঁকে ফেলল। একহাতে আহত কাঁধের অংশটা চেপে ধরে সামান্য ঝুঁকে কাজটা করল সে।

আঁকা শেষ করে সে সবার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘এটা হলো বিধোরীর দুর্গের মূল অবকাঠামো,’ বলে সে আকৃতিটার একটা জায়গায় নির্দেশ করে বলল, ‘এইটা হলো দুর্গের মূল প্রবেশদ্বার যেটা একেবারে উপত্যকার নিচ থেকে শুরু হয়ে ওপরের দিকে উঠে যাওয়ার রাস্তা ধরে যাওয়া যায়। দুর্গটার মূল প্রবেশ পথটা বেশ দীর্ঘ আর পথটার দুই পাশের খাদও তুলনামূলক কম গভীরতা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বেশি গভীরতার দিকে এগিয়ে গেছে।’

‘তারমানে পথটা ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে একেবারে প্রবেশ পথের মূল সিংহদ্বারে গিয়ে শেষ হয়েছে, তাই না?’ শামান প্রশ্ন করল।

‘একদম ঠিক,’ রাজা বিক্রম যে তলোয়ারের চোখা প্রান্তটা দিয়ে দেখাতে লাগল। ‘এটা হলো দুর্গের মূল আকৃতি। মূল দুর্গটার তিনপাশে আছে তিনটে সুউচ্চ বুরুজ। এই বুরুজগুলো মূলত দুর্গের গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের বাসস্থান। তিনটে বুরুজের মাঝখানে এই জায়গাগুলো হলো দুর্গের সামরিক ব্যারাক, রাজার মহাল, খাবার ব্যবস্থা,’ একটা একটা করে দেখাতে লাগল সে। ‘আর এই জায়গা দিয়ে এগোলে দুর্গের নিচের একটা প্রান্ত গিয়ে মিশেছে দুর্গ সংশ্লিষ্ট জলধারার সঙ্গে। এটা অনেকটা দুর্গের পাতাল বলা চলে। এই অংশেই সেই অস্ত্রাগার আর অস্ত্রাগারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনের থাকার ব্যবস্থা। আমার বিশ্বাস এই জায়গাতেই সেই মূর্তি নির্মাণের কাজ চলছে, এখানটাতেই বন্দি করে রাখা হয়েছে ডুকপা লামাকে।’

‘সবই বুঝলাম, কিন্তু এরপর আমরা কিভাবে কি করব?’ শামান জানতে চাইল রাজা বিক্রমের দিকে তাকিয়ে। ।

রাজা বিক্রম হেসে উঠল। ‘আমি যে মুহূর্তে শুনলাম ডুকপা লামাকে বিধোরীর দুর্গে বন্দি করে রাখা হয়েছে, সেইসঙ্গে রাজা হেমচন্দ্রও অবস্থান করছে এই দুর্গেই, প্রথমে আমি খুশি হয়ে উঠেছিলাম তারপরের মুহূর্তে বেজার। আগে বেজার হবার কারণটা বলে নিই। বিধোরীর দুর্গ অত্র মুল্লুকের সবচেয়ে সুরক্ষিত দুর্গ। এখানে প্রহরীর নজর এড়িয়ে একটা বেড়ালেরও ঢোকারও উপায় নেই। ‘

রাজা বিক্রমের কথা শুনতে শুনতে শামানের ভ্রু কুঁচকে উঠেছে। ‘আর খুশি হবার কারণটা?’

‘খুশি হবার কারণ হলো, আগেই বলেছি আমি এই দুর্গেই জন্মেছি, এতেই বড়ো হয়েছি। কাজেই এই দুর্গের প্রতিটা অংশ আমি চিনি। সকল দুর্গের মতোই এই দুর্গেরও কিছু গোপনীয়তা আছে। আছে চোরাগুপ্তা গোপন পথ। কাজেই সেগুলোর সন্ধানও জানা আছে আমাদের,’ বলে রাজা বিক্রম হেসে উঠল।

‘যা বলতে চাইছেন পরিষ্কার করে বলুন,’ এবার কালন্তি বলে উঠল। সবাই কৌতূহলের সঙ্গে তাকিয়ে আছে রাজা বিক্রমের দিকে।

সবার কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে রাজা বিক্রম একটু নাটকীয়ভাবে বলে উঠল, ‘আমার একটা পরিকল্পনা আছে। সেটা ঠিকমতো অনুসরণ করতে পারলে আমরা যা করতে চাচ্ছি সেটা ঠিকই সম্পন্ন করতে পারব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *