প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ১০

অধ্যায় দশ – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর, ভারতবর্ষ

একজন যোদ্ধা হিসেবে শামানের শরীর আর মনের মধ্যে অসাধারণ সমন্বয় আছে।

এ কারণেই অদ্ভুত খটখট শব্দটা শুনে চট করে সতর্ক হয়ে উঠল সে। যোদ্ধা হিসেবে বহুদিনের পুরনো অভ্যাস। যদিও সে চোখ খোলেনি কিংবা শরীরের কোনো পেশি এক ইঞ্চিও নাড়ায়নি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার যোদ্ধা সত্তা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে গেছে। চোখের পাতাটা মৃদু ফাঁক করে তাঁবুর পরিচিত কালচে অবয়ব চোখে পড়তেই সতর্ক হয়ে ওঠা শরীরটা ঢিলে করে দিল শামান।

এই সতর্কতা এই অভ্যাস অনেকটা বুনো প্রাণীর জঙ্গলে টিকে থাকার মতো একটা ব্যাপার। কুকুরের যেমন অন্যান্য যেকোনো প্রাণীর চেয়ে ঘ্রাণশক্তি অনেক বেশি, বেড়াল যেমন যে কারো চেয়ে অন্ধকারে অনেক বেশি দেখতে পায়, ঠিক তেমনি একজন যোদ্ধাকেও নিজের মতো কিছু অনন্য ক্ষমতা বৃদ্ধি করে নিতে হয়। কেউ হয়তো তলোয়ার ভালো চালাতে পারে, কেউ হয়তো অসাধারণ তিরন্দাজ, কেউ হয়তো শত্রুর চিহ্ন খুব ভালো অনুসরণ করতে পারে। একজন যোদ্ধা হিসেবে এগুলোর যেকোনো অন্তত একটি কিংবা একাধিক ব্যাপারে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করতে না পারলে ভয়ংকর যোদ্ধা জীবনে টিকে থাকা অসম্ভব। শামান অবশ্য এগুলোর ভেতরে বেশ কটাতেই দক্ষ।

তবে ওর প্রধান সখ্যতা তলোয়ারের সঙ্গে। ছোটোবেলায় শান্তির মঠে থাকার সময়ে প্রথমে কাতানা দিয়ে ওর প্রথম প্রশিক্ষণ হয়েছিল। এরপরে নিজের ভয়ংকর যোদ্ধাজীবনে বহুবার বহুভাবে নানা ধরনের তলোয়ারের সঙ্গে গড়ে উঠেছে ওর সখ্যতা আর ভালোবাসা। হঠাৎ নোরবুর দেয়া জোড়া কাতানার কথা মনে হতেই ঘুমানোর মাদুরের নিচ থেকে টান দিয়ে বের করে আনল কাতানা জোড়া। আনমনেই হাত বোলাতে লাগল ওগুলোর গায়ে।

স্বাভাবিক আর দশটা কাতানা যে মাপের হয় এটা তারচেয়ে একটু বেশি লম্বা, অনেক বেশি পাতলা, আগাটা চোখা। শামান দু হাতে ধরে জিনিসটা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে আবার লুফে নিল দক্ষ হাতে। নোরবুর কাছে শোনা অস্ত্র জোড়ার বিস্তারিত ইতিহাস মনে পড়ে গেল ওর।

জোড়া হিম্বা নামের এই কাতানা দুটো তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ এক ধরনের ধাতু দিয়ে। এই ধাতু পৃথিবীর পরিচিত কোনো ধাতু নয়। সেই সময়ে মোঙ্গলদের সঙ্গে চৈনিকদের মারাত্মক যুদ্ধ চলছিল, এক পর্যায়ে তিব্বতও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। রাজা মহীশূড়ের পূর্বপুরুষরা ছিল চৈনিকদের পক্ষে।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে মান্দানিজরা রাজা মহীশূড়ের পূর্বপুরুষদের কাছে সহায়তা চায়। তারা সাহায্যের জন্যে এগিয়ে যাবার পথে হিমালয়ের পাদদেশে নিজেদের বাহিনী দিয়ে অবস্থান নেয়। যুদ্ধ শুরু হবে হবে এমন সময়ে এক উল্কার আঘাতে দুই বাহিনীই সমূহ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে তারা দুই পক্ষই সন্ধির আওতায় আসতে বাধ্য হয়। রাজা মহীশূড়ের পূর্বপুরুষরা পাহাড়ের পাদদেশে আঘাত করা সেই উল্কাপিণ্ডের ভেতরের অর্ধগলিত লাভার মতো জ্বলতে থাকা ধাতু দিয়ে তৈরি করেছিল এই জোড়া কাতানাসহ আরো কিছু অস্ত্র, সেইসঙ্গে সংগ্রহ করেছিল সেই ধাতুর বেশ কিছুটা। তবে ওরা উল্কাপিণ্ডের কাছে পৌঁছানোর আগেই নাকি পাহাড়ি আরেক সর্পপূজারি গোত্র এই ধাতুর বেশ অনেকটা নিয়ে পালিয়েছিল।

এই ধাতু এতটাই ভয়ংকর যে, কথিত আছে রাজার পূর্বপুরুষরা এই অস্ত্রগুলো হাতে আসার পরে অদমনীয় হয়ে ওঠে তারা। পুরো তিব্বতসহ মান্দানিজ উপত্যকা থেকে শুরু করে মোঙ্গল দেশ পর্যন্ত তারা শাসন-শোষণ আর রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। তাদের তীব্র আগ্রাসন চলতে থাকে প্রায় এক শ বছর ধরে, যতদিন পর্যন্ত না তারা স্বয়ং বুদ্ধের সংস্পর্শে এসে বদলে যায়। এরপরে একসময় বুদ্ধ স্বয়ং নাকি রাজা মহিশূড়ের পূর্বপুরুষদের হয়ে অন্ধকারের দেবতাদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন এই কাতানা দিয়ে। সেই থেকে এই জোড়া তরবারির নাম দেয়া হয় ‘হিম্বা’।

ইতিহাস ভাবতে ভাবতেই শামান পরিচ্ছন্ন হয়ে নিজের পোশাক পরে নিয়ে পিঠের ওপরে ঝুলিয়ে নিল জোড়া কাতানা আর কোমরে নিজের প্রিয় কুকরি মানে বাঁকা ছুরিটা, তারপর একটা চাদর কাঁধে ফেলে বেরিয়ে এলো বাইরে।

মাথার লালচে রঙের লম্বা চুলগুলো একটা ছোটো চামড়ার ফালি দিয়ে বেঁধে নিয়ে আড়মোড়া ভাঙল। ওদের তাঁবুটা বসানো হয়েছে পাহাড়ি উপত্যকার প্রায় শেষ সীমানায়। তাঁবুর একপাশে একটা হাতে বানানো ছোটো চুলা থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখে শামান অনুমান করল বিধু আশপাশেই কোথাও আছে। গায়ের চাদরটা আরেকটু টেনে মাথাসহ নিজের চুলগুলো ঢেকে দিয়ে পাহাড়ি শৈলশিলার কিনারায় এসে দাঁড়াল শামান।

এখান থেকে পাহাড়ি পথটা সামান্য বাঁক নিয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। আধ মাইলের মতো এগোনোর পরেই শুরু হয়েছে সবুজে ছাওয়া ঘন জঙ্গল। একেবারে পাহাড়ি এলাকা ছেড়ে ওরা চলে এসেছে অর্ধ সমতল ভূমিতে। তবে ছোটোবেলা থেকে পাহাড়ের কোলে বড়ো হওয়া শামানের কাছে পাহাড়ই হলো ওর মাতৃভূমি রুক্ষ পাহাড়ের বুকেই ও শান্তি খুঁজে পায়। তাই চিরকালই সবুজে ঢাকা সমভূমি থেকে ধূসর পাহাড়ই ওর কাছে বেশি স্বস্তির জায়গা। তবে এবার না চাইলেও কন্নোরের এই এলাকাতে ওকে আসতেই হতো। কারণ আর কিছুই না; এতিম-অসহায়-অবোধ শিশুটিকে পাহাড়ি জঙ্গুলে পথের প্রান্ত থেকে তুলে নিয়ে যে মানুষটা আশ্রয় দিয়েছিল—সেই মানুষটা আজ জীবন-মরণের খেলার এক নিষ্ঠুর উপাদানে পরিণত হয়েছে। মানুষটা আদৌ বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তারও কোনো হদিস নেই।

পাহাড়ি শৈলশিলার কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল শামান। নিজের পোশাকের সঙ্গে কোমরে ঝুলানো চামড়ার বন্ধনী থেকে বাঁশির মতো দেখতে একটা ছোটো জিনিস বের করে আনল। থলের ভেতর থেকে এক ধরনের গুঁড়ো বের করে হাতে ডলল কিছুক্ষণ। গুঁড়োগুলো অনেকটা মন্ডের আকার ধারণ করতেই সেটাতে ঢুকিয়ে দিল বাঁশিটার এক প্রান্তে। মণ্ডটাকে আঙুলে টিপে ঠিকমতো বসিয়ে ছোটো দুটো চকচকে আকরিক পাথর ঠুকে আগুন ধরিয়ে দিল মণ্ডের এক প্রান্তে। কষে দুই টান দিয়ে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল আগুনটা, এবার বাঁশিটার মাথায় মন্ডের এক প্রান্তে ধিকি ধিকি করে জ্বলতে লাগল আগুন। আরো দু-দফা কষে টান দিয়ে ধোঁয়া ওড়াল শামান। তারপর ডুবে গেল নিজের ভাবনার জগতে।

ওর মনের কোণে বারবার ভেসে উঠছে মঠ থেকে বিদায় নেয়ার সময়ে লামা নোরবুর বলা শেষ কথাগুলো। আনমনেই ওর একটা হাত চলে গেল নিজের চুলে। আলতো করে হাত বোলাতে বোলাতে ও ভাবতে লাগল, নোরবু যা বলেছে সেটা সরাসরি না জানলেও এতদিন ধরে একটা উপলব্ধি অবশ্যই ওর ভেতরে কাজ করত। ছোটোবেলা থেকেই ও জানত ওকে পথের ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিল ডুকপা লামা। কিন্তু ও এও জানত ওর পরিচয়ের মধ্যে অবশ্যই কোনো না কোনো গূঢ় রহস্য রয়েছে।

কারণ দেখতে ও এই এলাকার মানুষদের থেকে একেবারেই আলাদা। ওর চুলের রং লাল, সামান্য কোঁকড়ানো, যেখানে এই এলাকার লোকদের চুল হয় ঘন কালো, একেবারে সোজা। তা ছাড়া ওর নাক একেবারে সটান খাড়া, এই এলাকার লোকজনের নাক হয় বোঁচা। এ ছাড়াও চোখের রং, গায়ের রং, শারীরিক আকৃতি থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ওকে দেখলেই বোঝা যায় ও কোনোভাবেই এই এলাকার মানুষ নয়।

এমনকি ওর নিজের যোদ্ধাজীবনে পশ্চিমে সুদূর চৈনিক দেশ থেকে শুরু করে উত্তরে মূর্খাভূমি, মধ্যবর্তী এলাকার মোঙ্গলদের দেশ পর্যন্ত কয়েক হাজার ক্রোশ ও ভ্রমণ করেছে নানা প্রয়োজনে, কিন্তু কোথাও এমনকি ওর মতো চেহারার কোনো মানুষ আজ পর্যন্ত ওর চোখে পড়েনি। এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয় যে একেবারে কোথাও কোনো সম্পর্ক ছাড়া হাজার ক্রোশের ভেতরে একজন মানুষ অন্যদের থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম হবে। তবে নোরবুর কাছে ও যা জানতে পেরেছে ওর পরিচয় নিয়ে ডুকপা লামার কাছে…

হঠাৎ পেছনে সামান্য শব্দ হতেই শামানের শরীর শক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু নড়ে ওঠার আগেই পেছন থেকে একটা ভারী কণ্ঠস্বর সাবধান করে দিল ওকে, ‘এক্কেরে নড়বা না,’ শামানের শরীরটা পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল, কারণ ওর ধারণা ও জানে এরপর কী হতে যাচ্ছে। আর সত্যি সত্যি হলোও তাই।

শামান স্থির হয়ে যেতেই ওর মুখের সামনে দিয়ে হুঁশশ করে বেরিয়ে গেল কিছু একটা।

জিনিসটা বেরিয়ে যাবার সময়ে ওর হাত থেকে ছোঁ দিয়ে নিয়ে গেল বাঁশিটা। পরমুহূর্তে শামান দেখতে পেল ওর হাতে ধরা বাঁশিটার ভগ্নাংশ একটা ছোটো তীরের মাথায় গেঁথে আছে পাহাড়ের গায়ে। তিরের পালক লাগানো লেজের অংশটা এখনো তিরতির করে কাঁপছে। রাগের সঙ্গে ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল শামান। মেজাজের কাঁটা মুহূর্তের ভেতরে তুঙ্গে চড়ে গেছে।

উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল, মুখে একদলা বিগলিত হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে টিটকিরির হাসি হাসছে বিধু। হাতে ধরা বিরাট ধনুকটা নামিয়ে নিয়েছে এরই মধ্যেই। সেটার ওপরে একটা হাত রেখে বিজয়ীর ভঙ্গিতে সে বলে উঠল, ‘দেখলে বাপু আমার নিশানা, চাইলে অবশ্য বাঁশিটার সঙ্গে সঙ্গে তোমার দুটো আঙুলও পাঠিয়ে দিতে পারতাম পাহাড়ি খাদে,’ বলে সে আবারো সেই টিটকিরির হাসি হাসতে লাগল।

রাগের সঙ্গে আরো দুই পা এগিয়ে এলো শামান, একটা হাত স্থির কাতানার বাঁটের ওপরে।

‘বিধু, পাগলামির একটা সীমা থাকা উচিত, গত কদিন ধরে দেখছি তোর পাগলামি, আমরা এখানে একটা কাজে…’ কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছিল শামান, খট করে আরেকটা তির এসে বিঁধল ওর পায়ের কাছের পাথুরে মাটিতে। মুখটা প্রায় হা হয়ে গেল শামানের। কারণ মুহূর্ত আগেও ধনুকটা প্রায় মাটির কাছে নামানো ছিল, ধনুক ওঠানো আর তির ছোড়ার কাজটা বিধু এতটাই দ্রুত আর দক্ষতার সঙ্গে করেছে বলতে গেলে শামানের চোখেই পড়েনি।

ওর হা হয়ে থাকা মুখের সামনে আবারো খিকখিক করে হেসে উঠল বিধু। ‘অয় অয়, আমরা এইখানে কামে আসছি,’ বলে সে ধনুক তুলে ইশারায় সামনের সমতল ভূমি দেখাল। ‘এইহান থাইক্কা আমগো চিনা-জানা এলাকা শেষ, শত্রু এলাকা শুরু। কাজেই,’ এই পর্যন্ত বলে সে বাঁকা থেকে সোজা হয়ে ধনুকটা একটানে হাতে তুলে নিল। ওটার একটা প্রান্ত দিয়ে বাড়ি মারল শামানের কোমরে।

‘আমারে বুজতে হইবে তোমারে নিয়া আমি কামে নামতে পাইরবো কি না। মানে তুমি আমার উপযুক্ত সঙ্গী কি না, এই বিপজ্জনক কামে,’ বলে সে আবারো বাড়ি মারল শামানের কোমরে। এবার আরেকটু জোরে।

পর পর দুবার কোমরে বাড়ি খেয়েও শামান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সে খুব শান্ত দৃষ্টিতে হিসেব করার চেষ্টা করছে। বিধুর মাথার বেণি করা লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, চোখ দুটো টকটকে লাল। তার একটা কান থেকে যে আরেকটা কান ছোটো এবার বেশ ভালোভাবেই চোখে পড়ছে সেটা। সেদিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে শামান বলে উঠল, ‘বিধু তুই এই সকালবেলা সোমরস খেয়েছিস?’

বলতে বলতে চট করে এক পা সরে গেল শামান। মনে মনে হিসেব করার চেষ্টা করছে বিধু আসলে কতটা মাতাল। ওর জানামতে বিধু গোর্খা বংশোদ্ভূত। গোর্খা জাতির লোকজন এমনিতেই অসাধারণ যোদ্ধা হয়, তার ওপরে বিধু আসাম- ত্রিপুরার দরবার আর সিংহল রাজার সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, যুদ্ধ করেছে। কাজেই তির-ধনুকে তো বটেই তলোয়ারেও তার দক্ষতা অপরিসীম।

গত সাত দিনের ভ্রমণে ও যা অনুধাবন করেছে, সম্ভবত অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেই সিংহল রাজার বাহিনী থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে আসন্ন বিপজ্জনক অভিযানে সঙ্গী হিসেবে ওকে দরকার শামানের, আর তাকে উপযুক্ত সঙ্গী হিসেবে পেতে হলে—সেই সঙ্গে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিধুর চোখে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে ওর। অপর পক্ষে সম্ভবত বিধুও একই উদ্দেশ্য ওকে খোঁচাচ্ছে। ঠিক আছে, বিধুর উদ্দেশ্য যদি ওকে পরখ করাই হয়ে থাকে তবে সেটাই হোক।

চট করে আরেক পা সরে এলো ও একপাশে। নিজে তো সরছেই সেই সঙ্গে বিধুর নড়াচড়াও পরীক্ষা করছে ও। ‘এই সকালবেলা বিধু,’ বলে একবার টিটকিরিসুলভ হাত নাড়ল। ‘তুই আসলে না খেয়ে থাকতে পারিস না, তাই না?’ ও আরো দ্রুত নড়তে শুরু করেছে। বিধুকে কেন্দ্র করে এক পা এক পা করে পেছাতে শুরু করেছে। এইজন্যেই বিধু, তাই না? এই জন্যেই সিংহল রাজার বাহিনী থেকে তোকে বের করে দিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বিধুর চোখ ছোটো হয়ে গেল, বদলে গেছে মুখের ভাব।

‘তোর চোখ দেখে মনে হচ্ছে আমি ঠিকই বলেছি,’ বলে ও পেছাতে পেছাতে চট করে থেমে গেল। ‘আহহা, আমি শুনেছি ওরা নাকি বহিষ্কার করা সৈন্যদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে। হাজার হাজার পদাতিকের সামনে তলোয়ার দিয়ে পোশাক কেটে টুকরো টুকরো করে ন্যাংটো করে ফেলে। তারপর নাকি…’ শামান কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই এগিয়ে এলো বিধু। ঝট করে হাতের ধনুকটা পিঠে লটকে দিয়ে একটানে বের করে আনল নিজের খাটো তলোয়ারের মতো দেখতে ভারী অস্ত্রটা। বিদ্যুৎবেগে সেটা দিয়ে কোপ মারল শামানের মাথায়। বাতাসের বেগে নেমে আসতে থাকা ভারী বাটালটা নিজের কাতানা দিয়ে ফিরিয়ে দিল শামান।

‘ওগোরও এত সাহস নাই। বিধুরে এমনে অপমান করবে। তার আগেই বিধু…’

‘পলাইছে, তাই না?’ বিধুর বাটালটাকে একপাশে নামিয়ে দিয়ে নিজের কাতানার ডগা দিয়ে ওটার মাথার বাড়ি মারল শামান। উদ্দেশ্য বিধুকে আরো রাগিয়ে তোলা। বলতে গেলে শতভাগ সফল হলো ও।

‘শামান, মুখ সামলে কথা বলবি,’ নিজের ভারী অস্ত্রটা উঁচিয়ে ধমকে উঠল ও। ‘পাহাড়ি রাস্তার এক লুটেরার কাছে আমার জবাব দিতে হইবে না। আমি যদি রাজার সৈন্যবাহিনী থেইকে পলায়ে থাকি তো তুই কি করছোস, তুই একটা ডাকাইত…’ বিধু কথা শেষ করার আগেই এবার শামান আক্রমণ চালাল। নোরবুর কাছ থেকে পাওয়া জোড়া হিম্বার একটা উলটো করে একপাশ থেকে বাড়ি মারল বিধুকে। বাড়ি খেয়ে খেপে উঠল বিধু। আবারো মারল শামান। ও ইচ্ছে করেই ছোটো ছোটো আঘাত করছে বিধুকে খেপিয়ে তোলার জন্যে। দ্বিতীয়বার আঘাত পেয়ে শামানের দিকে অনেকটা অন্ধের মতো এগিয়ে এলো বিধু। ঠিক এই ব্যাপারটাই চাইছিল শামান।

মুহূর্তের ভেতরে শরীরের অবস্থান বদলে শরীরটাকে টানটান করে ফেলল ও। রাগে-ক্ষোভে অন্ধ বিধু তার বিরাট দেহ নিয়ে ঝড়ের মতো এগিয়ে আসছে। বাঁকা হয়ে থাকা শরীরটাকে আরেকটু বাঁকিয়ে এগিয়ে আসতে থাকা বিধুর তলোয়ারটাকে এড়িয়ে নিজের তলোয়ারের উলটোপিঠ দিয়ে বাড়ি মারল শামান। সঙ্গে সঙ্গে মাটি কাঁপিয়ে পড়ে গেল বিধু

বিধু পড়ে যেতেই শরীরটাকে সোজা করে কাতানাটা খাপে ভরে সোজা হলো ও। খানিকটা পিছিয়ে এসে ফিরে তাকাল বিধুর দিকে, এই শিক্ষাটা খুব দরকার ছিল ওর। হাঁপাতে হাঁপাতে সোজা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল বিধু। ‘আহ্,’ আধশোয়া থেকে উঠে বসল সে। একটা হাত তুলে ওর দিকে ফিরে বলল, মানতে বাধ্য হইছি শামান, তুমি তলোয়ার চালাইতে জানো,’ বলে সে আরেকটু হাঁপাল। ‘যেই বিধুরে কেউ কুনোদিন কাইতও করতে পারে নাই, তুমি তারে…’

ওর দিকে দুই পা এগিয়ে গেল শামান। মুখে মৃদু হাসি। ওষুধ কাজে দিয়েছে মনে হচ্ছে। সে একটা হাত বাড়িয়ে দিল বিধুর দিকে। ওর হাতটা ধরল সে। ‘তয়, তুমি তো তুমার খেল দেহাইলা, এইবার আমার খেল দেহানো বাকি,’ বলেই সে শামানের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। শামান সতর্ক হবার আগেই অন্য হাতে ধরে থাকা ধনুকটা দিয়ে বাড়ি মারল ওর হাঁটুতে। হাঁটুর ওপরে শক্ত বাড়ি খেয়ে উল্টে পড়ে গেল ও।

নিজেকে সোজা করে বিধুর দিকে তাকাতেই দেখল ধনুকে এরই মধ্যে একটা তির জুড়ে ওর দিকে তাক করে ফেলেছে সে, আপনাতেই ওর দুই হাত ঢেকে ফেলল নিজের মুখটা। সঙ্গে সঙ্গেই হুঁশ করে একটা শব্দের সঙ্গে ও অনুভব করল কিছু একটা চলে গেল ওর কোমর ছুঁয়ে। নিচে তাকিয়ে দেখল ওর তামাকের ঝোলাটা ছিঁড়ে নিচে পড়ে আছে। মুখ তুলে তাকাল ও বিধুর দিকে।

পরিষ্কার বুঝতে পারল ইচ্ছে করেই এই দুষ্টামিটা করেছে বিধু, চাইলেই সে ওর পেটে ঢুকিয়ে দিতে পারত তিরটা। রাগের একটা হল্কা বয়ে গেল ওর শরীরে। মুহূর্তের মধ্যে শরীরটাকে শূন্যে তুলে মাটিতে ঝাঁপ দিল ও। একটা গড়ান দিয়ে একপাশে সরে গেল, সোজা হবার পাশাপাশি হাতে বের হয়ে এসেছে কাতানা। অন্যদিকে ধনুকে আরেকটা তির জুড়ে ফেলেছে বিধু, ও এগিয়ে যেতেই সেটা ছুড়ে দিল শামানের দিকে, অগ্রগামী অবস্থাতেই শূন্যে কাতানা চালিয়ে তিরটাকে ও বাড়ি মারল কাতানা দিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে দিক পরিবর্তন করে অন্যদিকে চলে গেল সেটা।

বিধুর মুখ হাঁ হয়ে গেছে। কোনো মানুষ শূন্যে চলমান তীরের দিক পরিবর্তন করিয়ে দিতে পারে কাতানা দিয়ে-এটা কল্পনাতেও আসেনি ওর। তার এই বিস্ময়ের সুযোগ নিল শামান।

শরীরটাকে আরেক গড়ান দিয়ে এগিয়ে গেল বিধুর দিকে। বিধুর বিস্মিত মুখের হাঁ আরেকটু বড়ো হয়ে গেল কাতানার হালকা বাড়িতে ধনুকটা হাত থেকে ছুটে যেতেই। ধনুকটাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে, কোমর দিয়ে বিধুকে একটা ধাক্কা মারল শামান, সেইসঙ্গে ভারসাম্য হারানো বিধুকে এক হাতে কাঁধ মুচড়ে ধরে কাতানার ডগাটা হালকাভাবে ঢুকিয়ে দিল তার মুখের ভেতরে।

হাঁপাতে হাঁপাতে হাসিমুখে শামান জানতে চাইল, ‘যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে, নাকি আরো কিছু শেখাতে হবে?’

বিস্মিত বিধু তলোয়ারের ডগাটা মুখ থেকে সরিয়ে হেসে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল—তার আগেই ভেসে এলো একজন মেয়ে মানুষের চিৎকার, দুজনেই অবাক হয়ে একে-অপরকে দেখল, আশপাশেই কোথাও বিপদে পড়েছে কেউ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *