প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ২০

অধ্যায় বিশ – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর, ভারতবর্ষ

‘অনুসন্ধান-আলোকপাত-কার্যকরণ; পরিকল্পনা খুবই সহজ, আমি আগের দিনই বলেছি,’ বলে শামান চোখ তুলে রাজা মানরু আর শাক্যপ্রধান শংকরাদিত্যকে দেখে নিয়ে নিজের দলের দিকে ফিরে তাকাল। ওর নির্দেশ অনুযায়ীই প্রত্যেকে একেবারে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু নিজের দলের এই পূর্ণ প্রস্তুতি দেখেও শামানের মনের ভেতরে শান্তি নেই। ও জানে একটা দলের প্রস্তুতি আসলে তাদের অস্ত্র আর পোশাকের ওপরে নির্ভর করে না। একটা দলের সত্যিকারের প্রস্তুতি হলো, নিজেদের ভেতরে সম্প্রীতি, যেটার কোনো ছায়াও এখনো এই দলের ভেতরে পড়েনি। যাই হোক, সেটা নিয়ে এখন কিছু করার নেই, আপাতত এই নিয়েই কাজে নামতে হবে।

‘কিন্তু আমরা এখানে এইভাবে কাজ করি না,’ শাক্যপ্রধান শংকরাদিত্য বলে উঠল।

শামান না চাইতেও হেসে উঠল তার মুখের ওপরে। ‘আপনার কি মনে হয়, আপনারা যেখানে যেভাবে কাজ করেন এই মুহূর্তে আপনাদের এলাকায় স্বাভাবিক পদ্ধতিতে কাজ করার উপায় আছে?’ বলে ও নিজের দল আর রাজা মানরুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে, যদি আমরা পুরো পরিস্থিতি বিবেচনা করি তবে আমারা খুবই নাজুক অবস্থায় আছি। আমরা জানি না সঠিকভাবে আমাদের শত্রু কারা, তাদের সংখ্যা কত, তারা আমাদের বন্দিদের কোথায় রেখেছে, সর্বোপরি তারা আসলে আমাদের ব্যাপারে কী জানে। তবে এটা মেনে বা বুঝে নিতে পারি যে শত্রুরা নামে-বেনামে-সংখ্যায়-শক্তিতে সব দিক থেকেই আমাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।’

‘সে হিসেবে বলতে গেলে এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হলো, আমাদের হাতে তথ্য নেই। সঠিক তথ্য নেই। যে পর্যন্ত আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য না জানতে পারছি সে পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারছি না, কোনো ব্যাপারটাতে আমাদের আসলে বেশি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। আর সেটা না করা পর্যন্ত আমাদের সঠিক করণীয় ঠিক করাটা অসম্ভব,’ বলে সে আবারো সবাইকে দেখে নিয়ে যোগ করল, ‘এ কারণেই যজ্ঞ বাবার কাছ থেকে তথ্য পাবার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেই ব্যাপারটা আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত। সেটা অন্তত এভাবে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে অনেক বেশি কাজের হবে বলে আমি বিশ্বাস করি,’ শামানের কথা শেষ হবার পরও সবাই চুপচাপ বসে রইল।

শামান আর বিধু থারুদের মাঝে আসার পর একদিন অতিবাহিত হয়েছে। প্রথম দিনই শামান নিজের দলের আর গোত্রপ্রধানদের মাঝে নিজের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করে দুই গোত্র প্রধানকে অনুরোধ করে চারপাশে নিজেদের ‘খবরি’ বা ‘জাসুস’ লাগানোর জন্যে। কারণ ও পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে যে চারপাশে আসলে কী হচ্ছে—এটা দুই গোত্র প্রধানের কাছেও সেটা পরিষ্কার না। এরা হয়তো টুকরো টুকরো কিছু ব্যাপারে জানে কিন্তু সম্পূর্ণ চিত্রটার ব্যাপারে কারোরই পরিষ্কার ধারণা নেই।

কাজেই ওদেরকে করণীয় ঠিক করতে হলে আগে সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে হবে। আর সে জন্যেই ওদের খবর দরকার। শামানের কথা অনুযায়ী দুই গোত্রপ্রধানেই নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী চারপাশে লোক লাগানোর পর প্রথম দিন কোনো খবর এসে পৌছায়নি। একদিন অতিবাহিত হবার পর আজ সকালে রাজা মানরুর এক লোক খবর নিয়ে আসে, যজ্ঞ বাবা নামে এক ব্রাহ্মণ সাধু নাকি খবর পাঠিয়েছে; তার কাছে কিছু তথ্য আছে, রাজা মানরু যদি নিজের বিশ্বস্ত লোক পাঠায় তবে সে আলোচনা করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে ওদেরকে যজ্ঞবাবার আস্তানায় যেতে হবে। এটা জানতে পেরে দুই গোত্রপ্রধানের মধ্যে দ্বিধা দেখা দিয়েছে।

কারণ তারা বুঝতে পারছে না যজ্ঞ বাবাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে কি না। অন্যদিকে শামান এই ব্যাপারে খোঁজ-খবর করতে আগ্রহী। কারণ ও জানে ঝুঁকি না নিলে এইরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ওরা কিছুই বের করতে পারবে না। আর সঠিক খবর জানতে না পারলে কিছুই করা সম্ভব নয়। আর এ কারণেই দুই গোত্রপ্রধানকে ডেকে ও নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর পাশাপাশি নিজের পরিকল্পনার গুরুত্বটাও সবাইকে বুঝিয়ে বলেছে। এখন দেখা যাক গোত্রপ্রধানেরা কী সিদ্ধান্ত নেয়।

শামানের কথা শেষ হবার পর এখনো সবাই চুপ হয়ে আছে। শামান তাকিয়ে আছে রাজা মানরুর দিকে। রাজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে একটা হাত তুলল। এমনিতেই সবাই চুপ হয়েই ছিল, তাকে হাত তুলতে দেখে আরো চুপ হয়ে গেল বাকিরা।

‘আমার মনে হয় লাল চুলের যোদ্ধা ঠিকই বলছে। এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে কিছুই হবে না, বিপদ দিনে দিনে কমবে না বরং বাড়বে। কাজেই এখনি মাঠে নামা উচিত, এমনকি ঝুঁকি থাকলেও।

‘কিন্তু…’ রাজা মানরুকে কথা শেষ করতে না দিয়ে শংকরাদিত্য কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রাজা আবারো হাত তুলে শাক্যপ্রধানকে থামিয়ে দিল।

‘তারচেয়ে বড়ো কথা, লাল চুলের যোদ্ধা আমাদের সঙ্গে একাত্মাতা ঘোষণা করেছে, তাকে আমরা ডেকে এনেছি নাকি সে নিজের ইচ্ছায় এসেছে সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হলো আমাদের বিপদকে সে নিজের বলে মনে করছে। ঠিক যেমনটি আমি থারু হবার পরও শাক্যদের বিপদকে নিজের বিপদ মনে করছি। মানুষ হিসেবে আমাদের এটাই তো দায়িত্ব,’ বলে সে একটু থেমে আবারো বলতে লাগল।

‘আমার কথা হলো, লাল যোদ্ধা যদি নিজে থেকে আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে থাকে তবে আমাদেরও উচিত তাকে তার মতো করে কাজ করতে দেয়া। আমরা তার নিকট সাহায্য চেয়ে যদি তার হাত-পা বেঁধে দিই তবে সেই সুযোগ সে কোনোভাবেই কাজে লাগাতে পারবে না। অন্তত আমার বিবেচনা তাই বলে। এ ছাড়া যজ্ঞবাবা ভিন্ন গোত্রের হলেও বহু বছর ধরে সে আমাদের মিত্র। কাজেই দেখা যাক সে আসলে কি বলতে চায়। তার কাছ থেকে যদি মূল্যবান কিছু আমরা উদ্ধার করতে পারি তবে সেটা আখেরে ভালোই হবে,’ বলে সে শামানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বলল, ‘যোদ্ধা, আপনি নিজের মতো কাজ শুরু করুন। যেকোনো প্রয়োজনে আমরা পাশে আছি। এখন থেকে আপনার দল আপনার নির্দেশেই পরিচালিত হবে।’

শামান মাথা নেড়ে তাকে ধন্যবাদ জানাল। সে দৃষ্টি উঁচু করে নিজের দলের দিকে ফিরে তাকাতে যাচ্ছিল তার আগেই দেখতে পেল রাজার বেশ অনেকটা পেছন থেকে একটা ছায়া সরে গেল। যদিও শামান চেহারা দেখতে পায়নি তবুও ও পরিষ্কার বুঝতে পারল মানুষটা কে। এখানকার অনেক কিছুই ও বুঝতে পারছে না, তার ওপরে আরেক রহস্য যোগ হয়েছে এই কালন্তি রহস্য। সেদিন নিজ থেকেই ওর দলে আসতে চাইল সে, এরপর থেকেই আর কোনো খবর নেই, একেবারে গায়েব। সে আসলে এমন করছে কেন, কী চায় কিছুই বুঝতে পারছে না শামান। অত ভেবে লাভ নেই।

নিজের দলটাকে নিয়ে রাজা মানরুর বাগানের বাইরে চলে এলো ও। ওখানে ওদের যাত্রার জন্যে সারি দিয়ে ঘোড়া সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

যোদ্ধা হিসেবে বহু বছরের যাত্রায় বহু ধরনের মানুষের সঙ্গে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে ওর। তবে এবারের মতো এতটা অসহায় এর আগে লাগেনি কখনো। অচেনা জায়গা, অচেনা মানুষ, অচেনা-অজ্ঞাত শত্রু, কার্যকরণ তো দূরে থাক, কী করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। তার ওপরে একদল একেবারেই অচেনা মানুষকে পরিচালিত করতে হবে ওর। নিজের দলের প্রতিটা মানুষকে দেখল ও মনোযোগ দিয়ে।

বিধু-ওর নিজের মিত্র, কিন্তু এরকম পাগলাটে মানুষ জীবনে খুব কমই দেখেছে ও। তবে তিরন্দাজ হিসেবে তার ওপরে ভরসা রাখা যায়। একদিকে থারু রাজা মানরুর লোকেরা; বাচ্চা-বাচ্চা চেহারার পাকানো শরীরের তলোয়ারবাজ—ধোয়ী, কালো মুশকো-ঘোষিতরাম, শাক্য বাহিনী থেকে আছে শংকরাদিত্যের খাস লোক জাথুরিয়া, জাথুরিয়ার সঙ্গে আরেকজন হালকা-পাতলা চেহারার যুবক। সেই ধূসর সুন্দরী কালন্তি এখানে নেই, তার কথা ভেবেও লাভ নেই।

নিজের দলটাকে একবার দেখে নিল শামান। ও যা করতে চাইছে—মানে রাজা বিক্রম আর ডুকপা লামাকে উদ্ধার করতে হলে এই দলটার ওপরে ভরসা রাখতে হবে ওর। তবে তার আগে দলটার ভরসা অর্জন করতে হবে নেতা হিসেবে, এদের প্রত্যেককে বুঝতে হবে, জানতে হবে। আবিষ্কার করতে হবে এদের শক্তি, স্মরণে রাখতে হবে প্রত্যেকের দুর্বলতা।

‘সবাইকে বলছি,’ সবাইকে দেখে নিয়ে কথা শুরু করল ও, কিছু নির্দেশনা দিতে হবে। ‘আমরা সবাই হয় আমাদের জন্যে শিরোধার্যদের আদেশে এখানে এসেছি, আর না হয় নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে এসেছি। হয়তো আমরা এখনে পরস্পরকে চিনি না জানি না, তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কথা হলো, আমরা যদি আমাদের প্রত্যেকের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই, তবে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা কে কোনো গোত্র, কে কোথা থেকে এসেছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের লক্ষ্য এক, আর সেই লক্ষ্য আমাদেরকে পূরণ করতে হবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। আমরা যদি—’

‘এই যে নেতাসাহেব, আপনার মূল্যবান বক্তব্য শেষ হয়ে থাকলে আমরা কি রওনা দিতে পারি?’ কালন্তি একটা সাদা ঘোড়ায় চেপে ওদের দলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই ফিরে তাকাল তার দিকে। ‘বেলা দুপুরের ভেতরে যজ্ঞবাবার ওখানে না পৌঁছাতে পারলে আমাদের বিপদ আরো বাড়বে। কাজেই চলো।’

শামান কিছু না বলে একবার তাকে দেখে সবাইকে যার যার পছন্দমতো ঘোড়া বেছে নিয়ে উঠে পড়ার জন্যে নির্দেশনা দিল। ও নিজে পছন্দ করল একটা কাঁঠালি রঙের ঘোড়া। ঘোড়াটার পিঠে চড়ে ওটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিতে ওরা সেই পানির ধারার কাছে চলে এলো। আজো ওরা পানির ধারাটার কাছে এসে দাঁড়াতেই ধীরে ধীরে অদ্ভুত ঘরঘরে শব্দ করতে করতে সেই কাঠের ভেলার মতো দেখতে পাটাতনটা উঠে এলো পানির নিচ থেকে।

শামান ঘোড়া নিয়ে বিধুর পাশে এসে দাঁড়াল। উঠে আসতে থাকা পাটাতনটা দেখে বিধু বাচ্চা ছেলেদের মতো খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল। প্রত্যেকেই একে একে পার হচ্ছে কাঠের পাটাতনটা, বিধুকে হাতের ইশারায় একটু পরে যেতে বলল শামান। অন্যরা একটু এগিয়ে যেতেই প্রথমে বিধুকে পার হতে বলল ওটা, তারপর নিজে পার হয়ে এলো শামান। ‘বিধু, তোর সঙ্গে কথা আছে,’ ওদের মধ্যে সম্পর্কটা এখন তুমি থেকে তুইতে নেমে এসেছে।

‘বলো ওস্তাদ, বিধুকে দেখে মনে হচ্ছে না সে খুব একটা দুঃশ্চিন্তায় আছে কিংবা পরিস্থিতি নিয়ে খুব একটা ভাবছে।

‘তুই কি পরিস্থিতি বুঝতে পারছিস?’ শামান আশপাশে একবার দেখে নিল। ওদের ঘোড়াগুলো থারুদের বসতি থেকে বেরিয়ে এসে জঙ্গলের পথ ধরে সারি দিয়ে এগোচ্ছে। ওরা দুজনেই সবার পেছনে তাই অন্য কারো শোনার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ‘তুই কি বুঝতে পারছিস, আমরা কী ধরনের ঝামেলায় আছি?’

‘নাহ গুরু, এক্কেরেই না,’ হাসিমুখে বলে উঠল বিধু। ‘আমি বুঝতে পারতাছি না, বোঝার চেষ্টাও করতাছি না। কারণ একে তো এত জটিল পরিস্থিতি বোঝার মতো বুদ্ধি আমার নাই। আর আমি বুইঝে কী করাম, এইসব বুঝার লাইগা তুমিই তো আছো। তুমি নির্দেশ দিবা আমি ঝাঁপায়া পড়ব। তুমারে একবার গুরু মানছি, এহন তুমি মরতে কইলে হেইটা করতেও আমার আপত্তি নাই,’ শামানের দিকে তাকিয়ে আবারো দাঁত কেলানো একটা হাসি দিল সে।

আনমনেই মাথা নাড়ল শামান। যোদ্ধা হিসেবে বিধু যতটা নির্ভরযোগ্য সহজাত সঙ্গী হিসেবে ঠিক ততোটাই মূর্খ। আর এটা সে অস্বীকারও করে না। ও হলো পাগলা ঘোড়ার মতো, একবার পথ দেখিয়ে দিলে সর্বোচ্চ গতিতে ছুটতে পারবে। কিন্তু ওকে পথটা দেখাতে হবে। শামান মনে মনে ভাবছে, ও নিজেই তো বুঝতে পারছে না আসলে পথ কোনোটা আর কি করতে হবে। বিধুকে দেখাবে কি।

‘ঠিক আছে বুঝতে পেরেছি, তুই মাথা ঘামাতে পারবি না, তবে আমার কথা শোন,’ বলে ও নিজের ঘোড়াটাকে বিধুর আরেকটু কাছে নিয়ে এলো। ‘কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে আমি চিন্তিত সেগুলো তোরও জেনে রাখা উচিত। কারণ কার কখন কী হয় কে জানে। মনে রাখিস আমাদের দুজনার কারো কিছু হলে ডুকপা লামাকে উদ্ধার করার দায়িত্ব অপরজনের ওপর এসে পড়বে, কাজেই তোরও কিছু ব্যাপার জেনে রাখা দরকার। বুঝতে পেরেছিস?’

বিধু হালকা মাথা চুলকে নিয়ে বলে উঠল, ‘হুম, কথা ঠিক আছে।’

‘প্রথম সমস্যা হলো, আমরা যেহেতু দুজন, কাজেই আমি তোর ব্যাপারে খেয়াল রাখব, তুই আমার ব্যাপারে রাখবি। মানে আমরা একজন আরেকজনের পিঠের দিকে খেয়াল রাখব। মনে রাখিস তোর তির আর আমার তলোয়ার দিয়ে আমাদের একে অপরকে পাহারা দিতে হবে।’

‘হ্যাঁ, এইটা ঠিক বলছো, গুরু,’ বলে সে পিঠের ওপর থেকে বিরাট ধনুকটা নামিয়ে আনতে লাগল।

একটা হাত দিয়ে তাকে থামাল শামান, আরে গাধা এখনকার কথা বলিনি, সবসময়ের কথা বলেছি,’ বলেই শামান সামনে দেখল। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিকে বয়ে যাওয়া পথটা সামনে বাঁক নিয়েছে। দলের সামনের ভাগে সেই কালো মুশকো ঘোষিতরাম ওদেরকে কোন দিকে এগোতে হবে সেটা দেখিয়ে সামনে এগোনোর ইশারা করল।

‘এরপরের গুরুতর ব্যাপারটা হলো; কে যে আসলে আমাদের শত্রু আমরা জানি না। থারুদের আমার ভালোই মনে হচ্ছে শুধু ওই মেয়েটা বাদে, কিন্তু এই ব্যাটা শাক্যদের কোনো ভরসা নেই। এরা বিপদে পড়ে থারুদের সাহায্য নিয়েছে কিন্তু এরা বিশ্বাসযোগ্য না, আর এদের ভেতরেও কোনো ব্যাপার আছে, এইটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তার ওপরে মনে রাখবি, প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে আমরা এদের নিজেদের ভেতরের ঝামেলায় জড়াচ্ছি কিন্তু আমাদের মূল কাজ হলো ডুকপা লামাকে উদ্ধার করা, মানে যদি উনি বেঁচে থাকেন। তারমানে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?’

‘কি?’ শামানের এত জটিল কথায় বিধুর মাথা আউলা হয়ে গেছে।

‘মানে হলো, এদের সঙ্গে আমরা যৌথভাবে বাজ করছি কারণ ডুকপা লামার ব্যাপারে খোঁজ করতে হলে এদের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন। অন্যদিকে ওরা আমাদের নিজেদের দলের ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে কারণ আমাদের ওদের প্রয়োজন, তারমানে একদিকে আমরা পরস্পরকে সাহায্য করছি, আবার দু-দলের কেউই আমরা বন্ধু নই। তারমানে কি?’ শামান থেমে যোগ করল। ‘আমাদের সাবধান থাকতে হবে। বুঝেছিস?’

আনমনেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়লে বিধু। কতটুকু বুঝতে পেরেছে কে জানে। ‘তুই ধীরে ধীরেই এগোতে থাক,’ বলে ও ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দলের একেবারে সামনের ভাগে চলে এলো।

কালন্তি দলের সামনে মাথা উঁচু করে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে। তার কাছাকাছি ঘোড়াটাকে নিয়ে গেল শামান। ফিরেও তাকাল না মেয়েটা। আরেকটু কাছে গিয়ে একবার কাশি দিল ও। কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আবারো কাশি দিতে যাবে তার আগেই ওর দিকে না তাকিয়েই সে বলে উঠল, ‘আমি কথা বলতে আগ্রহী নই।’

কিন্তু আমাদের কথা বলা দরকার, শামান ওর ঘোড়াটাকে কালন্তির আরেকটু কাছাকাছি নিয়ে গেল। ‘বিশেষ করে যদি আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই তবে…’

‘কিসের একসঙ্গে কাজ!’ শামানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ঝট করে ওর দিকে ফিরে তাকাল কালন্তি। ‘শুনুন, আমি কারো সঙ্গেই কাজ করছি না। না কোনো বেঈমান গোষ্ঠীর সঙ্গে যারা সারাজীবন শুধু বেঈমানি করে গেছে না কোনো অচেনা যোদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকাই যার পেশা,’ বলে সে নিজের ঘোড়াটাকে রাস্তার একপাশে সরিয়ে এনে দলটাকে সামনে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিল। শামানও নিজের ঘোড়া একপাশে সরিয়ে আনল। মেয়েটা রাগ দেখালেও ওর কথা শুনতে হবে ওকে, পরিস্থিতি বুঝতে হবে।

‘শুনুন, শাক্যরা ক্ষমতায় যাবার পর থেকে এই এলাকায় নরক নেমে এসেছে, এমন এক নরক যা চোখে দেখা যায় না। এই কন্নোর উপত্যকায় শুধু একটা সময়েই আক্ষরিক অর্থে শান্তির হাওয়া বইত যখন দুই বছর পর পর ডুকপা লামা এই এলাকায় পা রাখত। তার প্রতি ভালোবাসা থেকেই আমি এখানে এসেছি। অন্য কারো জন্যে নয়।

‘আপনার বাবাই তো শাক্যদেরকে—’

‘ভুল করছেন,’ বলে সে শামারে দিকে ঘোড়া নিয়ে এক ধাপ এগিয়ে এলো। ‘বাপু ভুল করছেন, আপনি এই এলাকার ইতিহাস জানেন না। আপনি জানেন না ওরা আমাদের সঙ্গে কী করেছে।’

‘কিন্তু আপনার বাবাকে আমার মোটেই বোকা মনে হয়নি, এতবড়ো ভুল উনি করবেন, এটা আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না যদি না কোনো নির্দিষ্ট কারণ…’ কালন্তি এগিয়ে এসে খপ করে শামানের ঘোড়ার রাশটা চেপে ধরল তারপর একেবারে সরাসরি শামানের চোখে নিজের দৃষ্টি স্থাপন করে বলে উঠল। ‘আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলুন, এই বিশাল কন্নোর এলাকায় আমরা থারুরা সেই জঙ্গলের গভীরে গিয়ে কেন বসতি স্থাপন করেছি?’

শামান কিছু না বলে কালন্তির ধূসর দৃষ্টির গভীরে তাকিয়ে আছে। এর আগে কারো চোখের গভীরে তাকিয়ে শূন্যে পতনের অনুভূতি হয়নি ওর কখনো। তাও এ এমন এক পতন যার কোনো শেষ নেই। ধূসর অন্ধকার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল ও। মেয়েটার প্রশ্নের জবাবে একবার স্রেফ কাঁধ ঝাঁকাল। ‘সেটা তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’

‘একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও বিগত বিশ বছর ধরে এই কন্নোরে শাক্যরা হলো আমাদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু, আমাদের এমন কোনো ক্ষতি নেই যা ওরা করেনি, এমনকি…যাই হোক,’ বলে মেয়েটা ওর ঘোড়ার রাশ ধরে টান দিয়ে সামনের দিকে এগোনোর নির্দেশ করল। দুজনেই সামনে এগোতে শুরু করল দুলকি চালে। মেয়েটা নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো বলতে লাগল, ‘সেই শাক্যরা বিপদে পড়া মাত্রই ওদের রং বদলাতে এক মুহূর্ত সময় লাগল না।’

‘তাহলে আপনার বাপু, মানে রাজা মানরু কেন মেনে নিলেন ওদের?’ কিছু ব্যাপার খানিকটা পরিষ্কার হতে শুরু করেছে শামানের কাছে, তবে এখনো অনেক কিছুই ঘোলাটে। ‘আপনি ওনার মেয়ে হয়ে যা বুঝতে পারছেন, উনি রাজা হয়ে কি সেটা বুঝতে পারছেন না?’

‘বাপু ভিন্ন এক দিক থেকে বিষয়টাকে বিবেচনা করেছে। বাপুর মতে আগে যা হয়েছে হয়েছে, কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। সময় এসেছে এই রক্তক্ষয়ী শত্রুতা ভুলে এক হবার, আর সেটার জন্যে বাপু এই সময়টা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। কারণ তার মতে এই বিপদে শাক্যদের সাহায্য করার বিনিময়ে যদি তারা আবার নিজেদের সাম্রাজ্য ফিরে পেতে পারে, তবে সেই সময়ে উপত্যকায় শান্তি ফিরে আসবে। তবে আমি জানি বাপুর এই হিসেব ভুল কারণ—’

—উনি সঠিকও তো হতে পারেন, তাই না?’ শামান ঘোড়াটাকে সাবধানে সামলাল। ওরা জঙ্গুলে পথে উঁচু ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করেছে। ‘আপনার বাবার চিন্তাধারাটা আমি ধরতে পেরেছি। এক অর্থে উনি ঠিকই আছেন, কারণ শত্রুতার কোনো শেষ নেই। শাক্যদের এই দুর্বল সময়ে তাদের সাহায্য করার বিনিময়ে যদি এই উপত্যকায় শান্তি ফিরে আসে তবে খারাপ কি?

শামানের কথা পুরোপুরি শেষ হবার আগেই আবারো ঝলকে উঠল কালন্তি। ‘কোনোদিনই না। আমি ওদেরকে ভালোভাবে চিনি। ওরা দুই মুখো সাপের শরীরের মতো। লেজে ছুঁলেও কামড়াবে, মাথায় ছুঁলেও কামড়াবে, এদেরকে সামলানোর একমাত্র সমাধান ওদের মাথা কেটে ফেলা। বাপুর মতে এই বিপদে ওদেরকে সাহায্য করে এই উপত্যকায় শান্তি ফিরিয়ে আনা উচিত। আর আমার মতে এই বিপদে ওদেরকে ঝাড়ে বংশে ধ্বংস করে এই উপত্যকায় শান্তি ফিরিয়ে আনা উচিত। আর সময় পেলে আমি সেটাই করব,’ কোনো মেয়েকে এর আগে এতটা হিংস্রভাবে হিস হিস করে উঠতে দেখেছে কি না-শামানের মনে পড়ল না। ও আবারো মেয়েটার চোখের মণির গভীরে তাকাতেই সেই পাহাড়ের চূড়া থেকে পতনের অনুভূতিটা ফিরে এলো। সেটাকে সামলে নিয়ে ও আনমনেই বলে উঠল, ‘আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না আপনি কেন এতটা…’

‘হুঁশ,’ হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল মেয়েটা। শামান কিছু বলার চেষ্টা করতেই তাকে থামিয়ে দিল হাতের ইশারায়।

পুরো দলটাই থেমে গেছে কোনো এক অজানা কারণে। ‘কি ব্যাপার, হচ্ছেটা—’ শামান প্রশ্ন শেষ করার আগেই এবার নিজেই শব্দটা শুনতে পেল। ঘোড়ার খুরের শব্দ, একটা দুটো না অসংখ্য। আর শব্দটা ভেসে আসছে পাহাড়ি ঢালের অন্যপাশ থেকে। শব্দটা পরিষ্কার হতেই কালন্তি অনুচ্চ স্বরে শিস দিয়ে উঠল। আর শামান সবাইকে ইশারা করল ঢাল বেয়ে আবার নিচে নেমে আসতে। সবাই ঢালের এপাশে নেমে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে এলো শামান। ঢাল বেয়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করল ওপরের অংশের দিকে।

সাপের মতো এঁকেবেঁকে ও উঠে এলো ঢালের ওপরে। মরা পাতা আর ঝোপের দঙ্গল সরিয়ে উঁকি দিল জঙ্গলের নিচু অংশের দিকে। ঢালটা ওদের সামনে ঢালু হয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। সেটার নিচু অংশের সঙ্গেই একটা পায়ে চলা পথ। সেটার ওপরে একদল ঘোড়সওয়ার দাঁড়িয়ে আছে, পুরো দলটার দৃষ্টি তাদের ডান দিকে। ঠিক তাদের বিপরীত দিক থেকে ভেসে আসছে ঘোড়ার খুরের শব্দ- যেটা শুনে ওরা সচকিত হয়ে উঠেছিল। শামান উঁকি দেবার একটু পরেই বিপরীত দিকে থেকে অন্য দলটা এসে দাঁড়িয়ে গেল প্রথম দলটার সামনে। এই নতুন দলটা আগের দলটার ঠিক বিপরীত। আগের দলটার প্রত্যেকের পরনে ভালো পোশাক। প্রত্যেকের সঙ্গে তলোয়ার আর বর্শা, কয়েকজনের সঙ্গে তির-ধনুক। এদের পায়ের পাতা থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্ত পরিষ্কার মজবুত আর পরিপাটি পোশাক।

আর বিপরীত দিক থেকে আসা দলটার এসবের কোনো বালাই নেই। ঘোড়ায় চড়ে থাকলেও শামান দেখল বেশির ভাগের খালি গা, নিম্নাঙ্গে ধুতি জাতীয় কিছু একটা পরনে। তবে প্রত্যেকের সঙ্গে খাটো তলোয়ার আর তির-ধনুক। এদের চেহারাও নোংরা, প্রায় প্রত্যেক পুরুষের এলোমেলো নোংরা চুল দাড়ি বাতাসে উড়ছে।

‘লিচ্ছবী।’

নিজের পাশে থেকে ভেসে আসা ফিসফিসে গলা শুনে ফিরে তাকাল শামান। ওর মতোই নিঃশব্দে ঢাল বেয়ে উঠে এসেছে আরো কয়েকজন। ওর পাশ থেকে কালন্তি কথা বলে উঠেছে। তার কথা শুনে আরেকবার সামনে ফিরে তাকাল ও। এরাই তাহলে শাক্যদের বিদ্রোহী জাত ভাই লিচ্ছবী। কিন্তু দুই দল দুইরকম কেন? বেশি ভাবতে হলো না, তার আগেই পাশ থেকে ফিসফিস করে জবাব দিল কালন্তি।

‘লিচ্ছবীদের দুই গোত্র, একটা সরাসরি রাজা হেমচন্দ্রের বাহিনী, অন্যটা আলাদা গোত্র।’

ঢালের নিচ থেকে বিধুরা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ইশারায় ওদেরকে চুপ থাকতে বলে ও আবারো ফিরে তাকাল সামনের দিকে।

দুই দলের ভেতরে কথোপকথন চলছে। পরিচ্ছন্ন বাহিনীর সামনে থাকা মানুষটা লিচ্ছবীদের কিছু জিজ্ঞেস করল। আর লিচ্ছবীদের প্রধান জবাবে হেসে উঠে টানা কথা বলে গেল কিছুক্ষণ। তারপর দুই দলই রাস্তাটা ধরে ফিরে চলল যেদিক থেকে এসেছে তার বিপরীত দিকে। ওরা চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে রইল ওরা। তারপর নেমে এলো ঢাল বেয়ে। শামানের মনের ভেতরে ঝড় বইছে।

শামান, কালন্তি আর জাথুরিয়া পাশাপাশি নেমে আসছিল হঠাৎ শামানের পাশ থেকে ওর একটা হাত চেপে ধরল কালন্তি। চমকে উঠে তার দিকে ফিরে তাকাল শামান। ‘কি ব্যাপার…?’

‘সর্বনাশ হয়ে গেছে,’ থেমে দাঁড়িয়েছে কালন্তি।

‘কেন, কি ব্যাপার?’ যদিও প্রশ্নটা করল শামান তবে দলের প্রায় সবাই কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে কালন্তির দিকে।

কেমন জানি উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল মেয়েটা, সে ফিরে তাকাল শামানের দিকে। ‘ওরা, মানে যাদেরকে এইমাত্র দেখলাম আমরা। ওরা কোন দিক থেকে এসে কোন দিকে গেল? মানে আমরা তো একটু পরে ঢালের ওপরে উঠেছি, আপনি কি দেখেছেন?’

‘হ্যাঁ, দেখেছি, শামান বুঝতে পারছে না, মেয়েটা হঠাৎ এমন করছে কেন। ‘ওদের একটা দল দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার ওপরে। আর অন্য দলটা এলো ডান দিক থেকে,’ বলে ও হাতের ইশারায় দেখাল কোন দিক থেকে এসেছিল ওরা। ‘ওদিক থেকে এসে যোগ দেয় অন্যদের সঙ্গে।’

‘সর্বনাশ!’ কালন্তি কিছু বলার আগেই অন্যদিক থেকে মুশকো ঘোষিত বলে উঠল। ‘ওদিকেই তো যজ্ঞবাবার ডেরা।’

‘তারমানে,’ শামান বুঝে ফেলেছে কে-কী বলতে চাইছে। ‘এক্ষুণি সবাই ঘোড়ায় উঠে বসো। আপনি পথ দেখান কোনোদিকে যেতে হবে। আমরা যতটা সম্ভব দ্রুত এগোব কিন্তু সবাই সাবধান।’

সবাই ঘোড়ায় চড়ে বসতেই ওদের দলটা দ্রুত এগোল ঘোষিতরামের দেখানো পথে। এবার আর সরাসরি ঢালের ওপরে না উঠে বরং ঢালটাকে বামে সমান্তরালে রেখে ওরা দ্রুত এগোল যজ্ঞবাবার ডেরার দিকে। মাইল দেড়েক চলার পর কালন্তি ওদেরকে ঘোড়া নিয়ে ঢালের ওপরে ওঠার নির্দেশ দিল। সারি দিয়ে ওরা এঁকে বেঁকে উঠে এলো ঢালের ওপরে। ঢালের অন্যপাশে বিস্তৃত বনভূমি। জঙ্গলের মাঝে বয়ে যাওয়া জলধারার তীরে মানুষের হাতে তৈরি কয়েকটা বাড়িঘর আর মন্দিরের মতো স্থাপনা চোখে পড়ল।

‘এটাই, যজ্ঞবাবার ডেরা,’ ওরা ঢালের ওপরে চড়ে বসতেই কালন্তি ঘোষণার সুরে বলে উঠল।

শামান দেখতে পেল জঙ্গুলে এলাকার ভেতরে পায়ে চলা পথটার পাশেই চমৎকার মাঠের মতো একটা জায়গা সেটার পাশেই কয়েকটা বাড়িঘর মন্দির। যদিও ছোটো ছোটো ঘর কিন্তু দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে অবস্থা বেশ ভালোই ওগুলোর। ‘যজ্ঞবাবা তো বেশ ভালোই সুখে থাকে মনে হয়,’ বলে ও নিজের ঘোড়াটাকে সাবধানে এগিয়ে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। অন্যরাও পিছু নিল ওর।

ঢাল বেয়ে ওরা নেমে এলো পথের ওপরে। পথটা ধরে এগোতে শুরু করতেই পেছন থেকে শিসের শব্দ শুনে ফিরে তাকাল শামান, সেই শিশু চেহারার পাকানো দড়ির মতো শরীরের লোকটা, নামটা মনে পড়ে গেল ওর, ধোয়ী। সে শিস দিয়ে উঠেছে। শামান ফিরে তাকিয়েই দেখল ধোয়ী পথের ওপরে ঘোড়া থেকে মাটিতে নেমে কিছু একটা দেখছে। শামান তার কাছে এগিয়ে যেতেই সে একটা হাত তুলে বলে উঠল, ‘দুই দল সৈন্য এগিয়ে গেছে এই পথে।’

‘সেটা তোমার বের করার দরকার কি, আমরাই তো দেখলাম, শামান কিছু বলার আগেই পেছন থেকে বলে উঠল কালন্তি। ‘চলো সবাই,’ দলের সবাইকে নিয়ে মূল পথ থেকে নেমে যজ্ঞবাবার বাড়ির পথের দিকে এগিয়ে গেল। শামানও মনে মনে অস্থির হয়ে উঠেছে কোনো একটা খবর পাবার জন্যে। ও দলের বাকিদের পেছনে এগোতে শুরু করল। ওর পাশে চলে এলো ধোয়ী। কিছু একটা বুঝলাম না,’ বলে সে বিড় বিড় করতে করতে পথের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল।

ওদের ঘোড়ার সারি যজ্ঞবাবার বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে এমন সময় দূর থেকে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ঝট করে সেদিকে ফিরে মুহূর্তের ভেতরে ধনুক টেনে একটা তির তাক করে ফেলল বিধু। তবে তার তিরটা এক হাত দিয়ে নামিয়ে দিল কালন্তি। ‘ও আমাদের পরিচিত মানুষ, যজ্ঞবাবার লোক,’ বলে সে লোকটার দিকে একটা হাত নাড়ল। লোকটা এখনো একইভাবে এগিয়ে আসছে।

‘সবাই সাবধান,’ চিৎকার না করলেও মৃদু কিন্তু দৃঢ়স্বরে বলে উঠল শামান।

‘কেন কি ব্যাপার…’ কালন্তি ওর দিকে পেছন ফিরে জানতে চাইল তবে তাকে পাত্তা না দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল শামান। ‘লোকটা মোটেই স্বাভাবিকভাবে হাঁটছে না,’ বলেই ও ঘোড়া ছোটাল। ওর পেছনে বাকিরা। মানুষটার কাছাকাছি পৌঁছে প্রায় পিছলে নেমে এলো ও ঘোড়া থেকে।

এগিয়ে আসতে থাকা মানুষটা এমনিতেই টলোমলো পায়ে হাঁটছিল, ওদেরকে দেখে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেই উলটো হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গেই শিউরে উঠল ওরা।

লোকটার পিঠে অন্তত তিনটে তির বিঁধে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *