প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৩৭

অধ্যায় সাঁইত্রিশ – বর্তমান সময়
দক্ষিণ সুরমা আবাসিক এলাকা, সিলেট

মৃত্যুর কি কোনো গন্ধ আছে?

ব্যাপারটা বিভিন্ন বইতে পড়েছে তানভীর। বিশেষ করে থ্রিলার বইতে বিভিন্ন পন্থায় বর্ণনা করা থাকে কিভাবে নায়করা মৃত্যুর গন্ধ পায়-বিপদের গন্ধ ভেসে বেড়ায় বাতাসে।

ব্যাপারগুলো কতটা সঠিক কখনো অনুধাবন করতে পারেনি ও। তবে হেকমত আবদুল্লার বাড়িতে প্রবেশ করে বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ না পেলেও মৃতদেহের গন্ধ ও ঠিকই টের পেল।

সিলেটের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ডক্টর মিতায়নদের আসাম অভিযানের অর্থ যোগানদার হেকমত আবদুল্লার বাড়ির ভেতরে খুবই বাজে একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাড়িটাতে প্রবেশ করা মাত্রই মাংস পচা গন্ধটা যেন নাকে এসে বাড়ি মারল।

পুলিশ হাসপাতালে ডক্টর মিতায়নের সঙ্গে কথা বলার সময়ে ওসি জালাল এসে যখন খবর দিল টমিরা জানতে পেরেছে হেকমত আবদুল্লাহ মারা গেছে, সঙ্গে সঙ্গে ও আর জালাল বেরিয়ে টমির নির্দেশিত দক্ষিণ সুরমায় অবস্থিত হেকমত আবদুল্লার বাড়ির দিকে রওনা দেয়। পথিমধ্যে সুলতান আর ইকবালের সঙ্গে কথা হয়। ওরা নচি বিশ্বাসকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। ওদেরকে তানভীর নির্দেশ দেয় নচি বিশ্বাসকে পাওয়ামাত্রই যেন ওকে জানানো হয়, কারণ ও নিজে নচি বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে চায়। উদ্ধার হওয়া অস্ত্র আর বাংলোতে মারা যাওয়া আদিবাসী লোকগুলোর ব্যাপারে জানতে হলে এখন নচি বিশ্বাসই একমাত্র ভরসা।

খুব অল্প সময়ের ভেতরেই ওদের গাড়ি দক্ষিণ সুরমা এলাকায় প্রবেশ করে। সিলেট শহরে দুটো সুরমা এলাকা আছে। একটা আখালিয়া সুরমা, অন্যটা দক্ষিণ সুরমা। আগে সিলেটে থাকার সুবাদে তানভীর জানে দক্ষিণ সুরমা মূলত অভিজাত লোকজনের এলাকা। টমির নির্দেশিত ঠিকানা খুঁজে বের করে ওরা বিরাট একটা বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে মাইক্রো নিয়ে। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়িটার অবস্থান। বাড়ির সামনে খোলা জায়গাতে সুন্দর বাগান, বাড়ির সামনে নির্মিত বাড়িটার মার্বেলে মোড়ানো বিরাট বিরাট থাম। বাড়ির আঙিনাতে বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়ানো। সবগুলোই পুলিশ কিংবা ফরেনসিকের গাড়ি।

তানভীর আর জালাল মাইক্রো থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই বিশ্রী গন্ধটা ওদের নাকে লাগে। ওদেরকে দেখে টমি দৌড়ে এলো। ‘বস, আর বইলেন না, বাজে অবস্থা। বাড়ির দারোয়ান, হেকমত আবদুল্লার সেক্রেটারি আর হেতকম আবদুল্লাহ, তিনজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বাড়ির রান্নাঘর থেকে। তিনজনকেই একইভাবে গুলি করা হয়েছে।’

‘আমি ডেডবডিগুলো দেখব,’ বলে তানভীর টমিকে পথ দেখাতে বলল। টমি ওদেরকে পথ দেখিয়ে সোজা লম্বা হলওয়ের মতো ডায়নিংরুমে নিয়ে এলো। সেখানে তিনটে মৃতদেহ সারি দিয়ে রাখা হয়েছে। ফরেনসিকের একজন নিচু হয়ে একটা মৃতদেহ পরীক্ষা করছিল ওদেরকে দেখতে পেয়ে মৃতদেহটার ওপরে রাখা ক্লথের মতো জিনিসটাকে আরেকটু সরিয়ে ধরল।

তানভীর মুখে রুমাল চাপা দিয়ে এগিয়ে গেল ওটার দিকে, টমি আগে থেকেই মুখে মাস্ক পরে ছিল। কিন্তু জালালের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলো তানভীর। লোকটার কোনো বিকার নেই। সোজা তাকিয়ে আছে দেহটার দিকে। মুখে রাখা একটা ম্যাচের কাঠি এদিক থেকে সেদিক করছে সে। তানভীর কোথায় যেন পড়েছিল অতিরিক্ত ধূমপান নাকি মানুষের কিছু কিছু ইন্দ্রিয় ভোতা করে দেয়। এই লোকেরও মনে হয় তাই হয়েছে।

নজর সরিয়ে দেহটার দিকে তাকাল ও। ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সের এক যুবক। এরই মধ্যে অনেকটা ফুলে উঠলেও দেখলেই বোঝা যায় যুবক বেশ সুদর্শন আর স্বাস্থ্যবান ছিল। ‘গুলি কোথায় করা হয়েছে?’ জানতে চাইল তানভীর।

‘এখানে স্যার,’ বলে লোকটা প্লাস্টিকের মতো কাপড়টা টেনে আরেকটু সরিয়ে দিল। নিখুঁত গোল একটা ফুটো, বুকের ঠিক বাম পাশে হৃৎপিণ্ডের ওপরে। ওটার চারপাশে গোল হয়ে ছড়িয়ে আছে শুকনো রক্ত, খানিকটা গড়িয়েও পড়েছে বাইরে। ‘ইনি নিশ্চয়ই হেকমত আবদুল্লাহ নন?’

‘নাহ স্যার,’ টমি বলে উঠল ওর পাশে থেকে। যুবকের পাশেই এক মধ্যবয়স্ক একজন লোকের দেহ রাখা। কাপড় সরাতেই দেখা গেল ছাগুলে দাড়িওয়ালা পাতলা চুলের একজন মানুষ। ‘একেও কি….?’

তানভীর প্রশ্ন শেষ না করতেই ফরেনসিকের লোকটা বলে উঠল, ‘একই স্যার। ঠিক হৃৎপিণ্ডের ওপরে নিখুঁত ফুটো।’

স্যার, খুবই প্রফেশনাল হাতের কাজ—’

ওসি জালাল মৃতদেহের একবারে শিয়রে বসে গুলির ফুটোটা দেখছিল। ‘যে গুলি করেছে তাকে শুধু প্রফেশনাল বললে অপমান করা হবে। একেবারে আন্তর্জাতিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং অভিজ্ঞ।’

‘তাই নাকি?’ একটু টিটকিরির সুরে বলে উঠল তানভীর। ‘শুধু গুলির ক্ষতমুখ দেখেই খুনির ট্রেনিংয়ের বিবরণও দিয়ে দেবেন মনে হচ্ছে?’

জালাল আগুন চোখে তানভীরের দিকে ফিরে তাকাল। ‘গুলিটা শুধু ঠিক জায়গামতোই করা হয়নি, এমনভাবে অ্যাঙ্গেল করে করা হয়েছে যাতে কাজ ঠিকই হয় আবার পরিমাণে বেশি রক্তও না ঝরে,’ বলেই সে ফিরে তাকাল ফরেনসিকের লোকটার দিকে। ‘কি, ঠিক বলেছি?’

লোকটা একবার একবার তানভীরকে দেখে নিয়ে জালালের দিকে ফিরে জবাব দিল, ‘জি, স্যার।’

এবার জালালের মুখে ফুটে উঠল টিটকিরির হাসি। ‘কমান্ডার, আমি যতই পিস্তল চালাই এরকম গুলি এমনকি আমিও চালাতে পারব না।’

‘কখন মারা হয়েছে এদেরকে?’ ফরেনসিকের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। ‘স্যার, নির্দিষ্ট সময়টা বলতে গেলে তো অবশ্যই পোস্টমর্টেম করতে হবে তবে অবশ্যই দুদিন হবে,’ বলে সে সঙ্গে যোগ করল। ‘প্রাথমিক সুরতহাল দেখে তাই মনে হচ্ছে। প্রত্যেকের বুকের ওপরে পিস্তল চেপে ধরে একটা করে গুলি করা হয়েছে।’

‘তৃতীয় লোকটা কে?’ জালাল জানতে চাইল।

‘বাড়ির দারোয়ান, স্যার।’

তানভীরের গা গুলাতে গুলাতে এখন ওর বমি লাগছে। ও ইশারায় টমি আর জালালকে বাইরের দিকে বেরুতে ইশারা করে নিজেও সেদিকে এগুলো। বাইরে লনে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে খানিকটা সুস্থির লাগল।

জালালের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘জালাল ভাই, একটা সিগারেট দেন তো।’

টমি আর জালাল দুজনেই বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল ওকে। বিশেষ করে জালাল, একে তো ভাই ডাকছে আবার সিগারেট চাইছে-কিছু না বলে যন্ত্রের মতো একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিল সে তানভীরের দিকে। ওটা ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তানভীর বলে উঠল, ‘টমি কিভাবে কী হলো, বল দেখি। এভাবে সিলেটের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি দুই দিন ধরে খুন হয়ে পড়ে আছে তার নিজের বাড়িতে, কেউ টের পেল না, এটা কিভাবে সম্ভব? আর তুই বা একে বের করলি কিভাবে?’

‘স্যার, আপনারা বের হয়ে যাবার পর প্রথমেই আমি ভূমি অফিসে একজনকে কাজে লাগিয়ে দিই। মজার ব্যাপার হলো, সে কাজ শুরু করার আগেই জানতে পারে ডক্টর মিতায়নকে উদ্ধার করা হয়েছে যেখান থেকে সেই বাংলোর মালিক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হেকমত আবদুল্লাহ। কারণ ভূমি অফিসের অনেকেই মুখে মুখে জানে ওই এলাকার বহু জমির মালিক হেকমত আবদুল্লাহ। আমাকে জানাতেই আমি তাকে কাগজপত্র চেক করে কনফার্ম করতে বলি। এরপর আমি আমার কাজে লেগে যাই। ডাটাবেজ থেকে তার ব্যাপারে বিস্তারিত বের করে তার সেক্রেটারিকে কল দিই। মোবাইল বন্ধ পাই। হেকমত আবদুল্লার ব্যবসার মূল অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পারি সে নাকি দেশের বাইরে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে সঠিকভাবে কেউই বলতে পারে না। পরে আরো বিস্তারিত খবর নিয়ে জানতে পারি দেশের বাইরে নাকি গেছে তার পরিবারের লোকজন, সবাই মিলে লন্ডনে গেছে হেকমত আবদুল্লার ছোটো বোনের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে। হেকমতও যাবার কথা ছিল কিন্তু সে যায়নি,’ এই পর্যন্ত বলে টমি একটু থামল।

‘ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে, কারণ হেকমত সাহেব অফিসে বলেছে দেশের বাইরে গেছে অথচ পরিবারের সবাইকে সে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে গেল না, আবার তার ও তার সেক্রেটারি দুজনের মোবাইল বন্ধ। আমি তার বাড়িতে লোক পাঠাই। সেই লোক এসে দেখে পুরো বাড়ি সুনসান, গেটে এমনকি দারোয়ানও নেই। সে দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে দেখে এই অবস্থা। বস, আপনাদের আমি একটা জিনিস দেখাতে চাই,’ বলে সে বাড়ির ভেতরের দিকে যাবার ইশারা করল সবাইকে।

দুজনেই টমিকে অনুসরণ করল। আবারো সেই জৌলুসময় করিডর, বসার ঘর আর ডায়নিংরুম পার হয়ে ওরা চলে এলো কিচেনে। ‘এখানে কি?’ জানতে চাইল তানভীর।

‘এখানেই মজা, দেখেন বস,’ বলে সে আলমিরার মতো বিরাট আকারের ফ্রিজের দরজাটা একেবারে হা করে খুলে ধরল। ভেতরের দৃশ্য দেখে তানভীর আর জালাল দুজনেই বেশ অবাক হলো।

না, ভেতরে কোনো মৃতদেহ নেই। মানুষের কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও নেই। বরং পুরো ফ্রিজ ভর্তি খাবার। কাচা শাক-সবজি থেকে শুরু করে রেডিমেইড স্যান্ডউইচ, বার্গার পর্যন্ত হেনতম কোনো জিনিস নেই যা ফ্রিজে নেই। পুরো ফ্রিজ বলতে গেলে খাবারে একেবারে উপচে পড়ছে।

‘এত খাবার-’ তানভীর একটু অবাক হয়েই বলে উঠল।

টমি পোদ্দার খুশিতে তালি দিয়ে উঠল। ‘একদম ঠিক বলেছেন বস। এত খাবার। ব্যাপারটা খেয়াল করে দেখেন, একজন লোক তার অফিসে জানাল সে বিদেশ যাচ্ছে। তার পরিবারের লোকজনকে সে বিদেশ পাঠিয়ে দিল এই বলে যে তার অফিসে কাজ আছে। আবার তার ফ্রিজ ভর্তি খাবার,’ এই পর্যন্ত বলে টমি চুপ হয়ে রইল সিনেমাতে দেখানো সাসপেন্স দৃশ্যের মতো।

‘তাতে কি, ফ্রিজে খাবার থাকব না তো কি কাঁথা-বালিশ থাকবে?’ জালাল বলে উঠল।

‘আরে…’

তানভীরের মোবাইল বাজতে লাগল। ও দেখল ইকবালের কল। ইকবালের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে সবাইকে বাইরে যাবার ইশারা করে ও হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠল। টমি একদম ঠিক বলেছে, ব্যাপারটা মোটেই স্বাভাবিক না। যে লোক দুই জায়গায় দুই কথা বলে ফ্রিজ ভর্তি করে রেখেছে খাবার দিয়ে অবশ্যই তার ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য ছিল। সম্ভবত তার এখানে কারো আসার কথা ছিল যার সঙ্গে তার গোপন কাজ ছিল,’ অনেকটা ঘোষণার মতো বলে উঠল তানভীর ।

বিশেষ করে এর দুই দিন পরেই যদি সে খুন হয়। অবশ্যই সে কিছু একটা করার তালে ছিল, ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পারলেও সরাসরি কোনো সমাধানে এভাবে পৌঁছানোটা একেবারেই ঠিক হবে না, ওরা বাইরে এসে সোজা চলে এলো মাইক্রোর কাছে। ‘আমার আরো এভিডেন্স চাই। এটা একটা পাজলের টুকরো মাত্র, পুরো পাজলটা ধরতে হলে আরো অনেক আলগা সুতা জোড়া লাগাতে হবে।’ ড্রাইভারকে মাইক্রো স্টার্ট করতে বলে ও ফিরে তাকাল টমির দিকে। টমি, তুমি তো ব্যাপক কাজ দেখিয়েছো হে। এত অল্প সময়ে সব জানলে কিভাবে?’

‘স্যার,’ টমি খুব বিগলিত মুখে বিরাট একটা গল্প শুরু করতে যাচ্ছিল তার আগেই জালালের দিকে ফিরে তানভীর বলে উঠল। ‘ইকবাল কল করেছিল, আমাদেরকে বন্দরের দিকে যেতে হবে। ওরা নচি বিশ্বাসকে খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু ব্যাটা নাকি খুব ঝামেলা করছে,’ বলেই ও আবারো টমির দিকে ফিরে বাড়ির গেটের ওপরে থাকা সিসি টিভির দিকে দেখাল। টমি বাড়ির সব সিসি টিভির ফুটেজ চেক করো। আমি—’

‘কিচ্ছু নাই, বস। এরই মধ্যে চেক করা হইছে। সব নষ্ট।’

‘স্বাভাবিক, যেভাবে তাদের খুন করা হয়েছে এরকম প্রফেশনাল লোকেরা সিসি টিভি ফুটেজ রেখে যাবার কথা নয়, বলে ও একটু ভাবল। ‘এক কাজ করো, ফরেনসিককে ওদের কাজ শেষ করে লোকাল পুলিশে খবর দিয়ে বলো ডেড বডি ইত্যাদির ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে হেকমত আবদুল্লার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আর তুমি, আশপাশের বাড়িগুলোতে খুঁজে দেখ, কোনো সিসি টিভিতে কিছু পাও কি না। বিশেষ করে আশপাশে যদি কোনো ব্যাংকের এটিএম বুথ কিংবা যদি কোনো সুপারশপ থেকে থাকে তবে ওদের ক্যামেরা অনেক সময় সামনেটা কভার করে। ওগুলোও ঘেঁটে দেখ,’ বলে ও আরো যোগ করল। ‘খুনের সম্ভাব্য সময়টা বের করে ওই সময়টা ঘিরে খোঁজ লাগাও। কিছু পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে।

টমি মাথা নেড়ে সায় জানাতেই ওরা গাড়িতে উঠে বসল, ‘রসুল মিয়া, বন্দরের দিকে চলেন,’ বলে চোখে সানগ্লাসটা পরে নিয়ে জালালের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘দেখি এই ব্যাটা নচি বিশ্বাসের কী সমস্যা।’

জালাল মাইক্রোর জানালা দিয়ে মুখে থাকা ম্যাচের কাঠিটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে তানভীরের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘এই ব্যাটা বিচি বিশ্বাস যদি বেশি উল্টা-পাল্টা করে, খোদার কসম ব্যাটার বিচি আমি গলায়া দেব।’

***

সিলেট শহরের অনেক প্রাচীন ঐতিহ্যের ভেতরে অন্যতম দুটি হলো; কিন ব্রিজ আর আলী আমজাদের ঘড়ি। দুটো স্থাপনাই সিলেটের উত্তর সুরমা এলাকায় প্রায় পাশাপাশি অবস্থিত। ১৮৭৪ সালে যখন ঘড়ি জিনিসটার তেমন প্রচলন ছিল না—সেই সময়ে কুলাউড়ার জমিদার আলী আমজাদ খান ঘড়িটা স্থাপন করেছিল। বহুবার চালু আর বন্ধ অবস্থায় থাকার পর আড়াই ফিট ডায়ামিটার আর দুই ফিট লম্বা একেকটা কাটার ঘড়িটা এখন আবার বন্ধ। কিন ব্রিজের কাছাকাছি অবস্থিত এই ঐতিহাসিক ঘড়ির নিচেই ইকবালের অপেক্ষা করার কথা।

ওদের মাইক্রো দক্ষিণ সুরমা থেকে রওনা দিয়ে বন্দর এলাকায় পৌঁছাতে বেশ সময়ে লেগে গেল। একেবারে মধ্যদুপুর হওয়াতে জায়গায় জায়গায় বেশ জ্যাম। বন্দর পৌছানোর একটু আগেই ইকবালের নির্দেশনা অনুযায়ী রসুল মিয়া গাড়ি ঘুরিয়ে বামে মোড় নিল। ওদিক দিয়ে কিন ব্রিজে ওঠার আগেই একটু ডানে কাটলেই আলী আমজাদের ঘড়ি। ওটার ঠিক নিচেই দাঁড়িয়ে থাকার কথা ইকবালের।

‘নির্দিষ্ট দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে রসুল মিয়া সোজা চলে এলো আলী আমজাদের ঘড়ির সামনে। ‘এনু কই অফেক্ষা খরিয়ের না…’

‘ওই যে, ইকবাল আসছে,’ মাইক্রোর জানলা দিয়ে সুরমা নদীর পাশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সুন্দর পায়ে চলা পথটা ধরে প্রায় দৌড়ের গতিতে এগিয়ে আসতে থাকা ইকবালকে দেখা গেল। ওদের গাড়ি উদ্দেশ্য করে হাত নাড়ছে সে। ইকবাল কাছে আসতেই মাইক্রোর দরজা খুলে দিল তানভীর।

‘কি ব্যাপার, কি সমস্যা হয়েছে?’ তানভীর একটু উদ্বিগ্ন স্বরেই জানতে চাইল। ‘স্যার,’ প্রায় দৌড়ে আসাতে ইকবাল এখন হাঁপাচ্ছে। ‘এই ব্যাটা নচি বিশ্বাস, দুই দিন আগেও ছিল পুলিশের পোষা কুত্তা, হারামজাদা কিছুদিন হলো টাকা-পয়সা বানিয়েছে আর কিছু নেতা-ফেতার সঙ্গে উঠবস করে। হারামজাদার পা মাটিতে পড়ে না।’

‘ইকবাল, এত কথা না বলে হয়েছে কি, সেটা বলো,’ তানভীর পয়েন্টে আসতে চাইছে।

স্যার, শালারে বের করতে আমার আর সুলতানা আপার জান বের হয়ে গেছে,’ ইকবাল সুলতানকে ভুলে সুলতানা বলছে। শালারে এত কষ্ট করে বের করলাম, ফাজিলে কি না আমাদের সঙ্গে পল্টি নেয়। সব শোনার পরে সে বলে কিছু জানে না, সে কিছু বলতে পারবে না। এইযে গোঁ ধরল শালায় আর কিছু বললই না। আমরাও ছাড়ি না, আমি ওসি স্যারকে কল দিলাম। সে বলল ওরে সার্কিট হাউসে নিয়ে তারপর আপনাকে খবর দিতে।’

‘ও কি এখন সার্কিট হাউসে?’

তানভীর প্রশ্ন করতেই ইকবাল একটা হাত তুলে ওরা কিন ব্রিজের যে দিকে ওরা অবস্থান করছে তার উলটো দিকে দেখাল। ‘জি, স্যার। ওরে সার্কিট হাউসে যাওয়ার কথা বলতেই শালায় শুরু করল তেড়িবেড়ি। কয় ওমুক নেতারে কল দেব, ওর কোনো ক্ষতি করলে খবরই আছে, এমপি সাবরে কল দেব, হ্যান ত্যান। এরপরে সুলতানা আপা পিস্তল বের করে ধরতেই রওনা দিল কিন্তু তেজে ফনফন করছে। অপনারা ফোন করতেই ওকে কোনোরকমে সার্কিট হাউসের এক রুমে বসায়া সুলতানা আপা আর দুজন সিকিউরিটিরে বাইরে রেখে আমি দৌড়ে আসছি।’

ইকবাল উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল রসুল মিয়া। ।

‘দ্রুত চলো, যত দেরি, তত সমস্যা,’ তানভীর আনমনেই বলে উঠল। ‘এই ব্যাটা অবশ্যই কিছু জানে,’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ওসি জালাল।

‘অবশ্যই জানে,’ তানভীর বলে উঠল। ‘তা না হলে সে এরকম অস্বীকার করত না। যদি তার কোনো তথ্য শেয়ার করার নাই থাকত তবে সেটা সে প্রথমেই করত। পুরোটা শোনার পর মানা করত না। যেহেতু পুরোটা শোনার পর সে বেঁকে বসেছে, তারমানে অবশ্যই সে কিছু না কিছু ধরতে পেরেছে।’

আলী আমজাদের ঘড়ির সামনে থেকে সার্কিট হাউসের সামনে আসতে দুই মিনিট লাগল। তানভীরের কথা শেষ না হতেই ওদের মাইক্রো সার্কিট হাউসের সামনে এসে থেমে গেল।

‘কিন্তু প্রশ্ন হলো, ব্যাটার কাছ থেকে এই স্বল্প সময়ের ভেতরে তথ্য বের করব কিভাবে?’ তানভীর নামতে নামতে বলতে লাগল।

‘তথ্য বের করার ব্যাপারটা আমার ওপরে ছেড়ে দেন কমান্ডার,’ বলে ওসি জালাল মাথাটা দুই দিকে ঝাঁকিয়ে ঘাড়ের হাড় ফুটাল কট কট করে। ‘ওই ব্যাটা কথা কইবে না মানে, গান গাইবে। আর কথা না কইলে ব্যাটার লম্প-ঝম্ফ আমি ওর ‘ভারতের সমুদ্রসৈকত’ দিয়া ঢুকায়া দেব,’ বলে সে সার্কিট হাউসের ভেতরের দিকে রওনা দিল।

ইকবাল মাইক্রো থেকে নেমে তানভীরের পাশে দাঁড়িয়ে খুব চিন্তিত মুখে প্ৰশ্ন করল, ‘স্যার, ভারতের সমুদ্রসৈকত মানে?’ মাথা চুলকাতে চুলকাতে সে বলে উঠল, ‘ও আচ্ছা, গো…’ তানভীরের রাগত চাহনি দেখে শব্দটা শেষ না করেই থেমে গেল।

রাগের সঙ্গে তার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কিছু না বলে জালালের পিছু নিল তানভীর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *