ছায়াচরাচর – ৯

নয় 

অপরাহ্ণ হইয়া গিয়াছে, তিন্তিড়ী বৃক্ষের ঊর্ধ্বশাখার উপর দিনান্তের রৌদ্র কবিতার অন্তিম চরণের ন্যায় পড়িয়া আছে। আজ পূর্ণিমা তিথি—টোলের পঠন-পাঠন বন্ধ। নিজ কক্ষে উন্মুক্ত কবাটের নিকট কমলনয়ন কী একটি পুথির উপর দেহকাণ্ড আনমিত করিয়া বসিয়া ছিল। সহসা পুথির পৃষ্ঠার উপর কাহার যেন ছায়া আসিয়া পড়িল। কমলনয়ন সচকিতে মুখ তুলিয়া তাকাইল। দেখিল, সম্মুখে যাদবানন্দ দাঁড়াইয়া আছে। 

যাদবানন্দ হইল কমলনয়নের অগ্রজ। দীর্ঘকাল কমলনয়ন উনসিয়া ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছে; কতদিন তাহারা কোনো সংবাদ নাই— পিতামাতা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছেন। পাড়া-প্রতিবেশী সকলে পিতামাতার নিন্দা করিতেছে, এত সহজে কমলনয়নকে তাঁহারা গৃহত্যাগের অনুমতি দিয়াছেন বলিয়া। গৃহে কমলনয়ন ও তাহার দাদা যাদবানন্দ একত্রে পিতার নিকট অধ্যয়ন করিত, কমলনয়ন চলিয়া আসায় যাদব একেবারে একা হইয়া গিয়াছে। অধ্যয়নে আর মন লাগে না। একদিন সে পিতার সমীপে কহিল, “তাত! আমি ভ্রাতার সন্ধানে নবদ্বীপ যাইব। তাহার কোনো সংবাদ নাই। তাহার কী হইল? তাহাকে আমি ফিরাইয়া আনিব।” 

পিতা পুরন্দর বৃদ্ধ হইয়াছেন; যাদবের এই প্রস্তাবে তিনি প্রমাদ গণিলেন। পুত্র কমলনয়নকে তিনি সম্যক চিনিতেন। সে বড়ো দৃঢ়চিত্ত। তাহাকে ফিরানো অত সহজ নহে। আবার কমলনয়নের প্রভাবে যাদব না গৃহত্যাগ করিয়া বসে। পুরন্দর তৎক্ষণাৎ যাদবকে কিছু বলিলেন না। 

বিষয়টি লইয়া পুরন্দর পরে কমলনয়নের জননীর সহিত আলাপ করিলেন। জননী কিন্তু বলিলেন, “যাদব বড়ো হইয়াছে। কমলনয়ন দাদার কথা খুব মানিত। এতদূর হইতে গিয়া কহিলে দাদার কথা কমলনয়ন উপেক্ষা করিতে পারিবে না বলিয়া মনে হয়। যদি সে ফিরিয়া আইসে…” 

জননীর মন কিছুতেই আশা ছাড়িতে পারে না। যাদব বড়ো হইয়াছে, কমলনয়ন কি বড়ো হয় নাই? তাহার কি কোনো নিজস্ব চিন্তা, স্বকীয় পৃথিবী গড়িয়া উঠে নাই? জননী ভাবেন, যে-সন্তানটি দূরদেশে আছে, সে এখনও ছোটোটিই আছে, তাঁহারই অঞ্চলনিধি হইয়া আছে, তাহার বয়স বাড়ে নাই, চিন্তা পরিণতি লাভ করে নাই! একটু অনুরোধ করিলেই সে ফিরিয়া আসিবে। আসিতেও তো পারে, যদি আইসে… 

অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা করিয়া পিতামাতা যাদবকে নবদ্বীপ যাইবার অনুমতি দিলেন। যাদব কিন্তু কমলনয়নের ন্যায় উদ্‌ভ্রান্তবৎ পথ হাঁটে নাই, প্রসিদ্ধ পথ ধরিয়া সে ধীরে ধীরে নবদ্বীপে আসিয়া পৌঁছিল। তথাপি, সময় লাগিল ঢের। 

নবদ্বীপে উপনীত হইয়া যাদব অনেক অনুসন্ধান করিয়া মথুরানাথ তর্কবাগীশের টোলে কমলনয়নের দেখা পাইল। যাদব দেখিল, কমলনয়ন ভক্ত হইয়া যায় নাই, টোলের বিদ্যার্থী হইয়াছে। ভ্রাতাকে দেখিয়া যাদবের প্রাণে আশার সঞ্চার হইল। কমলনয়ন অগ্রজকে প্রণাম নিবেদন করিল। তৎপশ্চাৎ উভয় ভ্রাতা প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ হইল। এতদিন পর ভ্রাতার দেখা পাইয়া কমলনয়নের চক্ষে জল আসিল। কিন্তু সে-অশ্রুবিন্দু ভাদ্রের মেঘের ন্যায় তাহার ভালদেশে স্তম্ভিত হইয়া রহিল, আষাঢ়ের ধারাবিন্দুর ন্যায় ঝরিয়া পড়িল না। 

যাদব বহু কথা কহিতে লাগিল। গ্রামের কথা, নদীর কথা, সমবয়স্ক বালক- বালিকাদিগের কথা, পিতামাতার কথা, পাড়াপ্রতিবেশীর কথা, তাহাদের গোশালার ধবলী গাভিটির কথা। কমলনয়নও সেসকল কথায় যোগ দিল। পরিশেষে যাদব কহিল, “অনেকদিন তো হইল রে। এইবার গৃহে ফিরিয়া চল। কতদিন আর বিদেশে থাকিবি?” 

দাদার মুখের উপর ‘না’ বলিলে দাদা আহত হইতে পারে। তাই সরাসরি কিছু না বলিয়া কমলনয়ন চুপ করিয়া রহিল। সে ভাবিতেছিল, গৃহ হইতে বাহির হইয়া আসিয়া যে-নূতন জগতের সংবাদ সে পাইয়াছে, পাইতেছে; উনসিয়ায় ফিরিয়া গেলে তাহা আর পাইবে কি? নদী একবার পাহাড় হইতে নামিয়া আসিলে, সেই নদী কি আর উৎসে প্রত্যাবর্তন করে? 

যাদব দেখিল, কমলনয়ন চুপ করিয়া আছে। যাদব ভাবিল, ‘মৌনং সম্মতিলক্ষণম্’–এই চুপ করিয়া থাকাই গৃহে ফিরিবার ইঙ্গিত। যাদব বুঝিল না, মৌন বা বাক্যাভাব অস্বীকৃতির লক্ষণও হইতে পারে। অভাবও যে একটি পদার্থ এবং সেই অভাবেরও যে সুগভীর তাৎপর্য থাকিতে পারে, যাদব অত তলাইয়া ভাবে নাই। 

যাহাই হউক, রাত্রিতে আহারান্তে বিশ্রামের পর যাদব লেখাপড়ার কথা পাড়িল। কহিল, “সম্প্রতি কী পাঠ করিতেছিলি?” 

কমলনয়ন উত্তর দিল, “উহা গঙ্গেশ উপাধ্যায় বিরচিত তত্ত্বচিন্তামণি’ গ্রন্থের উপর আমার আচার্য মথুরানাথ তর্কবাগীশকৃত টীকা— তত্ত্বালোক-রহস্য।” 

যাদব হাসিয়া বলিল, “আমরা তো ইহার নামও জানি না। আমরা এখনও উদয়নের ‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি’ লইয়াই পড়িয়া আছি।” 

কমলনয়ন গম্ভীরভাবে কহিল, “এখানে আসিবার পূর্বে আমিও জানিতাম না। আসলে ন্যায়শাস্ত্রের বিপুল অগ্রগতি হইয়াছে। প্রভূত গবেষণা চলিতেছে। পূর্বেকার কোনো কথাকে এখন অলঙ্ঘ্য ভাবিবার আর উপায় নাই। যুক্তি দ্বারা ধোপে টিকিল ভালো, না হইলে পুরানো মত ফেলিয়া দিয়া নূতন করিয়া চিন্তা করিতে হইবে।” 

“বলিস কী? প্রাচীন গ্রন্থের প্রামাণিকতা আর থাকিবে না?” 

“না, দাদা, থাকিবে না। তুমি দেখিয়া লইও, কালে কালে আরও পরিবর্তন সাধিত হইবে। আজ আমরা কেবল যুক্তিবিচার লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছি। কিন্তু কল্য হয়তো যন্ত্রবিদ্যার এরূপ উন্নতি হইবে যে, জড়জগৎ সম্বন্ধে আমাদের চিরাচরিত সিদ্ধান্তগুলিও প্রত্যাখ্যাত হইবে। হয়তো ম্লেচ্ছদেশে এখনই এইরূপ উন্নতি হইতেছে, আমরা জানি না।” 

“তাই বলিয়া কি ঋষিদের মত ভ্রান্ত হইতে পারে? আর ঋষিদের মত ছাড়িয়া আমরা কি যাবনিক মত গ্রহণ করিব?” 

“দাদা, কথাটা কে বলিতেছেন, ইহা সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ নহে। কী বলিতেছেন, তাহাও সময়ে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ। ম্লেচ্ছ যবনদিগের বিদ্যা যদি আমাদের ঋষিমুখাগত তত্ত্বের তুলনায় সত্যের অধিকতর সমীপবর্তী হয়, তবে তাহাও গ্রহণ করিতে হইবে। আবার যবনে কহিলেই যে সত্য হইবে, তাহাও নহে। পরীক্ষা করিয়া যাহা টিকিবে, তাহাই গৃহীত হইবে, অন্যথায় ‘বালভাষিত’ বলিয়া উড়াইয়া দিতে হইবে।” 

“এ যে একেবারে নূতন কথা কহিতেছিস! আমি ভালো বুঝিতে পারিতেছি না।”

“দাদা, একটা কথা বলি, বুঝিয়া দেখ। ন্যায়-মতে আপ্তোপদেশঃ শব্দঃ’ অর্থাৎ ঋষিরা আপ্ত ও সর্বজ্ঞ। তাহা হইলে জ্যোতির্বিদ্যার সামান্য সামান্য তত্ত্বে তাঁহারা এত কেন অজ্ঞানের পরিচয় দিয়াছেন? কেহ বলিতেছেন, পৃথিবী ত্রিকোণ। কেহ-বা বলিতেছেন, বাসুকি নাগের মস্তকের উপর পৃথিবী অবস্থান করিতেছে, আরও কত কী! এসকল কথা, যিনিই বলিয়া থাকুন না কেন, আমি সহজে স্বীকার করিয়া লইতে পারি না। প্রমাণ কই? প্রমাণ দাও; স্বীকার করিব।” 

“তবে কি তুই নাস্তিক হইয়া গিয়াছিস? এত পড়িয়া তোর এই হইল?” 

“না, দাদা। নাস্তিক বা আস্তিক নহি। কারণ, আমি নাস্তিক বা আস্তিক হইলাম, তাহাতে সত্যের কিছু যায় আসে না। সত্য যা, সত্য তাহাই। আমি কোনো দিকেই দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিতে চাহি না। সকলের মত শুনিতে চাই, বিচার করিতে চাই। পরিশেষে যাহা গ্রহণ করিবার যোগ্য, তাহাই গ্রহণ করিব। পাঠ ও চর্চার ভিতর দিয়া মনের অন্ধকার কাটে। যে-স্থলে নিকষ অন্ধকার ছিল, সেই স্থলে জ্ঞানের স্বচ্ছ আলোক আসিয়া পড়ে। আমি নাস্তিক বা আস্তিক নহি, আমি প্রজ্ঞাপন্থী। জ্ঞান আমাকে নির্ভয়ে প্রশ্ন করিতে শিখাইয়াছে। আর জ্ঞান কোনো স্থবির পদার্থ নহে। উহা সতত চলিয়াছে, সূর্য যেমন সারা দিনমান ধরিয়া চলে, মাস-বর্ষ-মন্বন্তর-মহাযুগ ধরিয়া সূর্য চলিতেছে। তাহার চলার বিরাম নাই।”

যাদব মুগ্ধ হইয়া অনুজের কথা শুনিতেছিল। এই সেই তাহাদের উনসিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র বালক—কমলনয়ন! তাহার সেই বাল্যের খেলার সাথি। কত পথ পার হইয়া, কত অভিজ্ঞতার মণিমুক্তা সঞ্চয় করিয়া সে সম্মুখে নির্ভীকচিত্তে অগ্রসর হইতেছে। সে ক্ষুদ্র বালক আর নাই, এ এখন পরিণত চিন্তক, প্রাগ্রসর নৈয়ায়িক। বলিতেছে, চলাই তাহার ধর্ম! যাদব মনে মনে কত কথাই ভাবিতেছিল। 

কক্ষের নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করিয়া কমলনয়ন কহিয়া উঠিল, “দাদা, আমি বলি কী, তুমি গৃহে না ফিরিয়া এইখানেই কিছুকাল অবস্থান করো। পিতার নিকট যাহা শিখিয়াছ, তাহার পর আরও শিক্ষা করো। নবদ্বীপের ন্যায় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র এখন ভূভারতে বিরল। আর মথুরানাথ তর্কবাগীশ শ্রেষ্ঠ নৈয়ায়িক। তুমি তাঁহার এই টোলে প্রবেশ করো। উনসিয়ায় ফিরিয়া গিয়া কী করিবে? এখানে কত কী জানিতে পারিবে। মনের কত দুয়ার খুলিয়া যাইবে। জ্ঞানের ভিতরেই সেই আনন্দ, তুচ্ছ সাংসারিকতায় যাহা নাই।” 

কমলনয়নের কথা যাদবের ভালো লাগিতেছিল। মন্দ বলে নাই, মথুরানাথ তর্কবাগীশের নিকট হইতে পাঠ লইলে মন্দ হয় না। কত কিছু অজানা রহিয়া গিয়াছে, কত ভ্রান্ত ধারণা লইয়া হয়তো সে বসিয়া আছে। কমলনয়নের কথা শুনিতে শুনিতে যাদবের মনে হইতে লাগিল, সে যেন রহস্যাবৃত অন্ধকার এক গুহাকক্ষের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে। ইহার রহস্য তাহাকে গভীরভাবে নিকটে আকর্ষণ করিতে লাগিল। 

কথায় কথায় যাদব অন্য কথা পাড়িল। বলিল, “তুই যে বলিয়াছিলি, শ্রীগৌরাঙ্গের পদানুগ ভক্ত হইবি? তাহার কী হইল?” 

কমলনয়ন যেন অন্তরের কোন্ গভীর প্রকোষ্ঠে তলাইয়া গেল। সেই গোপন প্রকোষ্ঠের তমসার ভিতর যেন একখানি অনাদৃত ধুলামলিন বীণা পড়িয়া আছে। যাদবের প্রশ্ন সেই সংগোপন হৃদয়বীণার তারে নিভৃতে ঝংকার তুলিল। রক্তক্ষরণ হইতেছিল, কিন্তু কমলনয়ন অন্তরের সেই ক্ষতচিহ্ন দাদাকে দেখাইল না। মুখ নামাইয়া লইয়া দীর্ঘশ্বাস গোপন করিয়া সে ধীরে ধীরে বলিল, “আমি এখানে অসিয়া শুনি, তিনি নবদ্বীপ ছাড়িয়া পুরী যাত্রা করিয়াছেন। তাঁহার সঙ্গে আমার দেখা হইল না।” 

তাহার পরই কী একটি প্রশ্ন, কী একটি জিজ্ঞাসা কমলনয়নের মানসসরসীর তলদেশ হইতে ‘উঠি, উঠি’ করিয়া ফুটিয়া উঠিতে চাহিল। প্রথমে সেই জিজ্ঞাসার আকার কমলনয়ন দেখিতে পাইতেছিল না। কিন্তু ক্ষণপরেই তাহার মনে পড়িল। মনে পড়িবামাত্র উদ্‌গ্রীব হইয়া সে যাদবকে প্রশ্ন করিল, “আচ্ছা দাদা! উনসিয়া গ্রাম হইতে আমারই ন্যায় কেহ কি শ্রীগৌরাঙ্গের আশ্রয় লইতে আসিয়াছিল, তুমি জানো?” 

যাদব উত্তর দিল, “না তো!” 

কমলনয়ন আবার জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, আমাদিগের গ্রামে ‘রাজীবলোচন’ নামে কোনো বালক ছিল কি?” 

যাদব বলিল, “রাজীবলোচন? নাঃ, এই নামে তো কেহ ছিল না! কেন, কী হইয়াছে?” 

কমলনয়ন কহিল, “ভালোভাবে মনে করিয়া দেখ তো! আমারই সমবয়স্ক, আমারই ন্যায় উনসিয়া হইতে নবদ্বীপ আসিয়াছিল, শ্রীগৌরাঙ্গের চরণাশ্রয় লইবার নিমিত্ত… তাহার নাম রাজীবলোচন… কাহারও কথা মনে আসিতেছে কি?” 

যাদব ঈষৎ বিরক্ত হইয়া কহিল, “আরে কী বলিতেছিস? উনসিয়া গ্রামের সমস্ত বালকদিগকে আমি যেমন চিনি, তুইও তো তেমনই চিনিস। ‘রাজীবলোচন’ নামে সেখানে কেহ নাই। কী হইয়াছে, বল না!” 

কমলনয়ন কিছুক্ষণ নির্বাক হইয়া থাকিয়া পরিশেষে বলিল, “নাহ, কিছু না!” কিছুক্ষণ পর যাদব ঘুমাইয়া পড়িল। কিন্তু কমলনয়নের চক্ষে ঘুম আসিল না। রাজীবলোচন তবে কে? যে উনসিয়া হইতে নবদ্বীপে শ্রীগৌরাঙ্গ-পদানুগ হইতে আসিয়াছিল? আচ্ছা, ‘রাজীবলোচন’ আর ‘কমলনয়ন’ দুইটা সমার্থক শব্দ, না? এ কী প্রহেলিকা? রাজীবলোচনের সহিত শ্রীগৌরাঙ্গের দেখা হইয়াছে। রাজীবলোচনকে লইয়া তিনি পুরী গিয়াছেন। অথচ, কমলনয়ন তাঁহার দেখা পাইল না। অদ্ভুত! বড়ো অদ্ভুত!! 

কিন্তু এই চিন্তা তাহাকে অধিক কাল অধিকার করিয়া রাখিতে পারিল না। কিছু পরে সেও নিদ্রাতুর হইয়া পড়িল। 

এইরূপে কয়েক মাস কাটিয়া গেল। দিন কি কাহারও জন্য বসিয়া থাকে? যাদবানন্দ টোলে প্রবেশ করিয়াছে। তাহারও মেধা প্রখর, যদিও মথুরানাথ তাহাকে এখনও সাক্ষাৎ পাঠ দিতে আরম্ভ করেন নাই। সে মধ্যম শ্রেণীতে অন্য বিদ্যার্থিদিগের নিকট পড়িতেছে। পাঠে, চর্চায় যাদবের দিনগুলি আনন্দেই কাটিতেছে। 

এদিকে কমলনয়নের পাঠ শেষ হইয়া আসিল। মথুরানাথের নিকট জ্ঞানের, প্রজ্ঞার যত মধু ছিল, কমলনয়ন তাহার সকল মধুই আহরণ করিয়া লইয়াছে। 

একদিন মথুরানাথ নিভৃতে কমলনয়নকে আহ্বান করিলেন। বলিলেন, “মধুসূদন! তোমাকে একটি কথা বলিবার ছিল।” 

কমলনয়ন যুক্তকরে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিল। 

মথুরানাথ বলিলেন, “নব্যন্যায়শাস্ত্র তোমার করতলাধিগত হইয়াছে। আহরণ করিবার এখন আর কিছুই নাই। গবেষণা করিবার প্রবল সম্ভাবনা আছে। তাহা তুমি করিতে পারো। সতত আমার সহায়তা পাইবে। কিন্তু আমরা নৈয়ায়িকগণ দীর্ঘকাল একটি সংকটে পড়িয়া আছি। উহা আমাদের গলার কাঁটা। কেহ সেই সমস্যা আজিও মিটাইতে পারে নাই।”

কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “কী সেই সমস্যা?” 

“সেই সমস্যা হইল অদ্বৈতবাদ। তুমি জানো, আজ হইতে আট শত বর্ষ পূর্বে আচার্য শংকর উহার প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার যুক্তিপ্রণালী অতি দুরূহ। তদুপরি, আমরা নৈয়ায়িকরা ওই যুক্তিপ্রণালী ভালো ধরিতে পারি না। এই অদ্বৈত বেদান্ত আমাদের প্রবল প্রতিপক্ষ; আমাদের সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ। তুমি তো জানো, নৈয়ায়িকরা দ্বৈতবাদী। আমাদিগের মতে জীব, জগৎ, ঈশ্বর পরস্পর ভিন্ন। কিন্তু অদ্বৈতমতে এই জগৎ কল্পিত বা মিথ্যা। ঈশ্বরের বিগ্রহ বা তাঁহার রূপচিত্তন কিংবা উপাসনা—সেও মায়িক অর্থাৎ কল্পিত। একমাত্র নির্বিশেষ ব্রহ্মই সত্য। আর জীব ব্রহ্ম একই; অভেদ। সর্বথা সর্বপ্রকারে এই অদ্বৈতমত আমাদিগের দ্বৈতভাবাত্মক উপাসনার প্রতিকূলতা করিয়াছে।” 

কমলনয়ন অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া কহিল, “কেহ কি ইহা খণ্ডন করিবার চেষ্টা করেন নাই?” 

“করিয়াছেন। দ্বৈতবাদী মধ্বাচার্য, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজাচার্য, ভেদাভেদবাদী ভাস্করাচার্য এবং তাঁহাদের শিষ্য-প্রশিষ্যগণ যুগে যুগে এই মতের বিরোধিতা করিয়াছেন। কিন্তু সেসকল বাধার প্রাচীর বিদীর্ণ করিয়া অদ্বৈত বেদান্তের দার্শনিকগণ পরাক্রান্ত মহীরূহের ন্যায় বারংবার উঠিয়া দাঁড়াইয়াছেন।” 

“আচ্ছা, তাহা হইলে শ্রীগৌরাঙ্গ অর্থাৎ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তিবাদেরও তো ইহা ঘোর বিরোধী!” 

“হাঁ, ঠিকই ধরিয়াছ। যদিও শ্রীমহাপ্রভু স্বয়ং কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নাই, কিন্তু তাঁহার শিষ্য-প্রশিষ্যগণ তাঁহার ভাব অবলম্বন করিয়া ভেদাভেদবাদকে পরিপুষ্ট করিতেছেন। অদ্বৈতবাদ মহাপ্রভুর ভক্তদিগের সেই মতেরও বিরোধিতা করে।” 

কমলনয়নের মুখমণ্ডল তেজে ও প্রেমে আরক্তিম হইয়া উঠিল। কী? মহাপ্রভুর মতেরও বিরোধিতা করে অদ্বৈতবাদ? তাহার মনে হইল, সে মহাপ্রভুর দর্শন পায় নাই, সেবা করিবার সুযোগ পায় নাই। এতদিনে সেই সেবার সুযোগ মিলিল। যাহারা মহাপ্রভুর বিরোধিতা করিতেছে, সে তাহাদের খণ্ডন করিয়া চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দিবে। কমলনয়ন সাগ্রহে প্রশ্ন করিল, “আমি কি অদ্বৈতবাদ খণ্ডন করিবার চেষ্টা করিতে পারি না?” 

মথুরানাথ বিষণ্ণ হাসিয়া বলিলেন, “কী করিয়া করিবে? তুমি তো অদ্বৈতবাদ জানো না। তুমি উহা শিক্ষা করিলে কবে? যে-মত তুমি জানো না, শিক্ষা করো নাই, তাহা কাটিয়া ফেলিবে কীরূপে? শত্রুকে পরাস্ত করিতে হইলে শত্রুর শক্তি কত, তাহা তো পূর্বে জানিতে হইবে।” 

নবোদ্যমে বলীয়ান হইয়া কমলনয়ন কহিল, “আমি যদি উহা শিক্ষা করি? কে আমাকে অদ্বৈতবাদ শিক্ষা দিতে পারে?” 

মথুরানাথ কহিলেন, “নবদ্বীপে কেহ নহে। অদ্বৈতবাদের চর্চা এখানে হয় না। শিখিতে হইলে তোমাকে বারাণসী কাশী যাইতে হইবে। সেখানে রামতীর্থ-নামক এক মহা ধুরন্ধর পণ্ডিত সন্ন্যাসী আছেন। তাঁহার নিকট হইতে অদ্বৈত বেদান্তমত ভালোভাবে শিক্ষা করিতে পারো। কিন্তু…” 

কমলনয়ন অধীর হইয়া কহিল, “কিন্তু?” 

মথুরানাথ উত্তর দিলেন, “কিন্তু তোমাকে রামতীর্থের নিকট তোমার অভিপ্রায় গোপন করিতে হইবে। যদি তিনি একবার বুঝিতে পারেন, তুমি তাঁহাদেরই মত খণ্ডন করিবার জন্য তাঁহারই নিকট শিক্ষালাভ করিতে গিয়াছ, তাহা হইলে তিনি তোমাকে আর উহা শিক্ষা দিবেন না।” 

“অর্থাৎ, আমাকে পরিচয় গোপন করিতে হইবে।” 

“হাঁ। তুমি যে নৈয়ায়িক, কিংবা তোমার যে দ্বৈতবাদের প্রতি অনুরাগ, ইহা রামতীর্থের সম্মুখে কখনোই প্রকাশ হইতে দিবে না। কহিবে, সামান্য ব্যাকরণচর্চা করিয়াছ। এক্ষণে অদ্বৈতবাদ শিক্ষা করিতে চাও, ইত্যাদি।” 

“বেশ, তাহাই করিব। আমি কাশী যাইব। রামতীর্থের নিকট অদ্বৈতবাদ শিক্ষা করিব। আমি যে দ্বৈতবাদী, ইহা তাঁহাকে বুঝিতে দিব না। অদ্বৈতবাদ শিক্ষা করিয়া লইয়া তাহার পর প্রবল যুক্তি সহায়ে ওই অদ্বৈতবাদ আমি খণ্ডন করিব। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের ভক্তিবাদের জয়ধ্বজা আকাশে তুলিব।” 

মথুরানাথ রহস্যপূর্ণ হাস্য করিয়া বলিলেন, “বেশ। তবে প্রস্তুত হও। অসমাপ্ত কার্য যাহা আছে, কয় দিনে সম্পন্ন করিয়া লও। তাহার পর শ্রীহরি সহায় করিয়া কাশীযাত্রা করো। আমার আশীর্বাদ তোমার চলিবার পথে সতত বর্ষিত হইবে।” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *