ছায়াচরাচর – ২১

একুশ 

“তোমাকে অনেকদিন দেখি নাই, মধুসূদন। সকলই কুশল তো?” 

“হাঁ, আচার্য! আপনার আশীর্বাদে আমাদের সর্ববিধ ও সর্বাঙ্গীন কুশল। আসলে মঠ-পরিচালনা সংক্রান্ত নানাবিধ কর্মে ব্যাপৃত থাকায় বহু দিন এইদিকে আসিতে পারি নাই। আপনার শরীর এখন সুস্থ আছে?” 

রামতীর্থ বলিলেন, “হাঁ মধ্যে বসন্ত হইয়াছিল। শিষ্য-প্রশিষ্যদিগের সেবায় শরীর সুস্থ হইয়াছে। আমি জানি, তুমি ইদানীং বড়ো ব্যস্ত। শ্রীমৎ বিশ্বেশ্বর সরস্বতী ব্রহ্মলীন হইবার পূর্বে মঠাধ্যক্ষের দায়িত্ব তোমার হস্তেই অর্পণ করিয়া গিয়াছেন। যাহাই হউক, ইহা তোমার প্রারব্ধ কর্ম ছিল নিশ্চয়। অবিচলিত চিত্তে এ কর্ম তোমাকে ভোগ করিতে হইবে। সর্বদা বিশ্বনাথস্মরণ করিয়া কার্য করিও। উহাই সর্বতোভদ্র হইবে।” 

কমলনয়নের বৃন্দাবনবাসের পর সত্যই বহু বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। ইতোমধ্যে কমলনয়ন মধ্যবয়স্ক ও রামতীর্থ বৃদ্ধ হইয়াছেন। দীর্ঘকাল পর কমলনয়ন রামতীর্থসকাশে আসিল। মধ্যে মধ্যে সংবাদ লয়, কিন্তু এদিকে বড়ো একটা আসা হয় না। আজ আসিয়া দেখিল, রামতীর্থ শয্যায় শায়িত; বিশ্রাম লইতেছেন। কক্ষের ভিতর নৈঃশব্দ্য আসিয়া নামিয়াছে। ঈষৎ চিন্তা করিয়া কমলনয়ন রামতীর্থের উদ্দেশে বলিল, “মঠ পরিচালনা ব্যতীত আরও একটি কর্ম শ্রীমৎ বিশ্বেশ্বর সরস্বতী আমার উপর ন্যস্ত করিয়া গিয়াছেন। তাহারই জন্য প্রাণপাত হইয়া যাইতেছে!” 

“আর কী কার্য?” 

“দ্বৈতবাদী বৈষ্ণবদিগের মধ্যে প্রচলিত একটি গ্রন্থ সম্প্রতি আপনার নয়নপথে পড়িয়াছে কি?” 

“ব্যাসতীর্থকৃত ন্যায়ামৃত’র কথা বলিতেছ?” 

“হাঁ, উহাই। এই গ্রন্থমধ্যে পরম্পরাক্রমে অদ্বৈত বেদান্তের উপর যতরকম আক্রমণ করা হইয়াছিল, তাহারই সারসংকলন করা হইয়াছে। গ্রন্থটি বহুল প্রচারিতও হইতেছে। ইহা যদি আরও বিস্তার লাভ করে—” 

“অদ্বৈতমত নির্মূল হইয়া যাওয়ার সম্ভাবনা। বিশ্বেশ্বর কি তোমাকে এই গ্রন্থের খণ্ডনার্থ নূতন কোনো গ্রন্থরচনা করিবার আদেশ দিয়া গিয়াছেন?” 

“আপনার অনুমান নির্ভুল,আচার্য! তাঁহারই আদেশে আমি এই ‘ন্যায়ামৃত’র প্রত্যক্ষর প্রতিবাদ রচনা করিতেছি।” 

“বিশ্বেশ্বর যোগ্য ব্যক্তিকেই আদেশ দিয়াছেন। ন্যায়শাস্ত্রে তোমার যেরূপ প্রতিভা, তুমি ছাড়া এ কাজ বারাণসীতে অন্য কেহ করিতে সমর্থ, আমি তো দেখি না। গ্রন্থের কী নাম হইবে ঠিক করিয়াছ?” 

“অদ্বৈতসিদ্ধি!” 

“সুন্দর নাম। এমন করিয়া ইহা রচনা করো যে, দ্বৈতবাদ যেন আর কোনোমতে মুখ তুলিতে না পারে। ব্যবহারিক ভূমিতে যতক্ষণ অহংবুদ্ধি আছে, ততক্ষণ দ্বৈতবাদাত্মক উপাসনার গুরুত্ব আমিও অস্বীকার করি না। কিন্তু উহাকেই উহারা যখন চরম সিদ্ধান্ত বলিয়া প্রচার করে, তখন সত্যের সঙ্গে পর্যাপ্ত অপলাপ ব্যতীত আর কিছুই হয় না।” 

“আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন, যেন এ কার্যে আমি সফল হই। ‘মিথ্যাত্বলক্ষণ’ দিয়া আরম্ভ করিয়াছি। অদ্বৈতমতে জগৎকে যে মিথ্যা বলা হয়, সেই মিথ্যাত্বের সংজ্ঞা নিরূপণ আগে করা কর্তব্য। উহা না-বুঝিয়াই দ্বৈতবাদীরা যত গোল করে।” 

“আমি যাহা বুঝিতেছি, তোমার গ্রন্থ বৃহৎ কলেবর হইবে। তাহা হউক। গ্রন্থ রচিত হইবার পর ইহার পরিপাটিরূপে অধ্যাপনা করাও তোমার কর্তব্য। আমাকে মধ্যে মধ্যে দেখিতে দিও।” 

“নিশ্চয়। নানা স্থলে সংশয় হয়। আপনাকে জিজ্ঞাসা করিব… আজ তবে আসি, আচার্য?” 

“আইস। দ্বিপ্রহরে এইখানেই প্রসাদ পাইয়া যাইও।” 

মাধ্যাহ্নিক আহারের পর কমলনয়ন মঠে ফিরিতেছিল। রৌদ্র প্রখর হইয়াছে। চরাচর যেন দগ্ধ হইয়া যাইতেছে। গঙ্গার উপর তাপতরঙ্গ থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। নির্মেঘ নীল আকাশের বুকে একটি বিহঙ্গও নাই। এই খররবিতাপ, যাহা অন্যের নিকট অসহ্য বোধ হয়, কমলনয়নের নিকট তাহাই আজ বড়ো সুন্দর বোধ হইতেছিল। রৌদ্রের এই কর্কশতা, নিদাঘের এই নির্মমতা, আলোকের এই সকল কিছু প্রকাশ করিয়া দিবার নির্মোহতা বড়ো ভালো লাগিতেছিল। একবার সে প্রচণ্ড মার্তণ্ডের দিকে চক্ষু তুলিয়া তাকাইবার প্রয়াস করিল, সূর্যের দীপ্তিতে তৎক্ষণাৎ চক্ষু ঝলসিয়া গেল। ইহাতে কমলনয়নের যেন জেদ চাপিয়া গেল। সে সরাসরি সূর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করিবেই। করপুটে চক্ষু আড়াল করিয়া পুনরায় দৃষ্টি উপরের দিকে তুলিল; তাহার পর সহসা করপল্লব সরাইয়া নির্নিমেষ সূর্যের দিকে চাহিল। উত্তপ্ত তাপকটাহের চারিপাশ হইতে নীলাভ সবুজ দীপ্তি বিকীর্ণ হইতেছে। মুহূর্ত পরে দৃষ্টি নামাইলে সমস্ত বিশ্বকে যেন তমসামলিন ছায়াচরাচরের মতো দেখাইল। সব অন্ধকার! 

তাহার পর সে ঘরে ফিরিয়া আসিয়াছে। মঠ নিস্তব্ধ। বাতায়নপথে কী এক অজানা বিহগের চকিত কাকলিতে সেই নৈঃশব্দ্যের সূত্র ছিন্ন হইয়া যায়। কমলনয়ন ব্যাঘ্রাজিনের উপর বসিল। পীঠিকার উপর সদ্যোসূচীত পুথিটি রাখা আছে। সামান্যই অগ্রসর হইয়াছে। ‘প্রতিপন্নোপাধৌ ত্রৈকালিকনিষেধ প্রতিযোগিত্বং মিথ্যাত্বম্।’ প্রতিপন্ন—অর্থাৎ জ্ঞানের বিষয়। এস্থলে ‘উপাধি’ পদের অর্থ হইল অধিকরণ বা আধার। ত্রৈকালিক নিষেধ—অর্থাৎ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ তিনকালে যে-অভাব। সেই নিষেধের প্রতিযোগী। যেমন, অন্ধকারে ভ্রমবশতঃ রজ্জুকে সৰ্প বলিয়া বোধ হয়। এস্থলে ওই কল্পিত সর্পটির অধিকরণ বা আধার হইল রজ্জু। সেই রজ্জু প্রতীতির বিষয়। ওই রজ্জুতে তিনকালে—অর্থাৎ অতীতে, বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে সৰ্প ছিল না, নাই ও থাকিবে না। রজ্জুতে সর্পের তিনকালে নিষেধ করা হইতেছে। প্রতীত রজ্জুতে সর্পের এই ত্রৈকালিক নিষেধের প্রতিযোগী হইল কল্পিত সপটি, আর এইরূপ প্রতিযোগিত্বই মিথ্যাত্ব। যাহা যাহাতে তিনকালেই নাই, তাহাতে তাহার অত্যন্তাভাব। সেই অত্যন্তাভাবের প্রতিযোগিত্বই মিথ্যাত্ব। বলা হইল, রজ্জুতে সর্প কোনোকালেই নাই। এই সৰ্প না-থাকা সত্ত্বেও এই যে তাহাকে দেখিতেছি, ইহাই ভ্রান্তি। অধিষ্ঠান ব্রহ্মে জগৎও ওইরূপ ভ্রমবশেই দেখা যাইতেছে। 

বেলা পড়িয়া আসিতেছে। ঊর্ধ্বাঙ্গ স্বেদাক্ত হইয়া উঠিল। এই গ্রন্থ রচিত হইবার পর আর কোনো দ্বৈতাপত্তি উঠিতে পারে না। উঠিলেও তাহা অমূলক। এই গ্ৰন্থ সহায়ে ভাবীকালের অদ্বৈতবাদিগণ বিরুদ্ধবাদীদের মতবাদ খণ্ডবিখণ্ড করিয়া দিবে। কমলনয়ন লিখিতে লিখিতে শ্রান্ত বোধ করিতেছে। অসমাপ্ত পুথিটির পৃষ্ঠার দিকে তাকাইল। 

দ্বৈতবাদীদিগের বড়ো জয়োল্লাস! অদ্বৈতমত কাটিয়া ফেলিতেছে—কী সাহস! সকল নর্তন-কুর্দনের এখানেই সমাপ্তি। বৃন্দাবনে দেখিয়াছিল বটে। মন্দিরে মন্দিরে এই দ্বৈতবাদীদিগের কী ঘটা করিয়া শাস্ত্রব্যাখ্যা করা। এক-একটি পেটমোটা গোঁসাই। সহসা ‘বৃন্দাবন’ কথাটা মনে পড়িলেই বুকের ভিতর একটা চিনচিনে ব্যথা উঠিয়া আসে কেন যে? 

সেসব চন্দ্রালোকিত রাত্রি চলিয়া গিয়াছে। বৃন্দাবন হইতে চলিয়া আসিবার কয়েক মাস পরই সেই ঘোর কাটিয়া যায়। পুনরায় শাস্ত্রসমুদ্রে সে ডুব দিয়াছিল। হৃদয়ে প্রেমের বাষ্প জ্ঞানের উত্তাপে বায়ুভূত হইয়া গেল। সেসব মনে পড়িলে কমলনয়নের এখন হাসি পায়। তরুণ বয়েসের ভাবাবেগ! কী সব পাগলের মতো ভাবিত! পরমপ্রেমাস্পদে লীন হইবে! কে কাহাতে লীন হইবে? আমিই তো সেই আত্মস্বরূপ। এই আত্মাই একমাত্র সত্য। আর সবই তো ইহাতে কল্পিত হইয়াছে মাত্র। প্রেম, ভক্তি, প্রণয়—সব! 

কাহাকে যেন সে কৈশোরে ভালোবাসিয়াছিল। তপ্তকাঞ্চনকায় গৌরচন্দ্র। দেখা হইল না। নাইবা হইল! কী ক্ষতি হইয়াছে? এসকল প্রেম আসলে দুর্বলতা। তবু কাহার যেন মুখারবিন্দ মনে ফুটিয়া উঠিতে চায়। কাহার? যাহাকে দেখে নাই, তাহার? রাইকিশোরীর আবেশ? না, না, ও সকল আর ভাবিবে না। মিথ্যা! মিথ্যা!! ‘প্রতিপন্নোপাধৌ ত্রৈকালিকনিষেধ প্রতিযোগিত্বং মিথ্যাত্বম্’। 

তথাপি অতীত দিনের পটভূমিকা হইতে কাহার একটি কণ্ঠ যেন স্মৃতিপথে রণিত হইতে থাকে। কে যেন সুদূর অতীতে বসিয়া উচ্চহাস্যসহকারে বলিয়াছিল : “সাবধান! আপনি আজ নব্য নৈয়ায়িক। বলিতেছেন, অদ্বৈতবাদ খণ্ডন করিবেন। কিন্তু যে-উৎসাহ লইয়া আপনি আজ অদ্বৈতবাদের দুর্বলতা সন্ধান করিতে যাইতেছেন, ততোধিক উৎসাহে একদিন আপনিই হয়তো দ্বৈতবাদী ভক্তদিগের সর্বনাশ করিতে উদ্যত হইবেন। কে বলিতে পারে?” 

কে যেন বলিয়াছিল! তাহারই মতো দেখিতে কে একজন। নবদ্বীপের ঘাটে। ওহ, কতদিন যে চলিয়া গিয়াছে… 

কক্ষের ভিতর কাহার যেন ছায়া আসিয়া পড়িল। দ্বারপথে ময়ূখ দাঁড়াইয়া আছে। ময়ুখ এক কিশোর, কমলনয়নের বিশেষ অনুরাগী। তাহাকে দেখিয়া কমলনয়ন স্মিতহাস্যে বলিল, “আইস, কিছু সংবাদ পাইলে?” 

ময়ূখ সাগ্রহে কক্ষে প্রবেশ করিয়া কমলনয়নের চরণবন্দনাকরতঃ বলিল, “হাঁ, পাইয়াছি। হরিশচন্দ্রঘাটের নিকটে তিনি থাকেন। একটি জীর্ণ দেবালয়ে। দেবালয়মধ্যে চন্দনকুঙ্কুমলিপ্ত শ্রীরামচন্দ্রের একটি প্রস্তরবিগ্রহ আছে।” 

“হুম, আর কী দেখিলে?” 

“দেখিলাম, তাঁহার সদ্যোলিখিত পুথি হইতে কী একটি দোঁহা গুনগুন করিয়া গান করিতেছেন আর মধ্যে মধ্যে পুথি খুলিয়া সংশোধন করিতেছেন।” 

“সে-গানের ভাষা কী?” 

“আওধি।” 

“আওধি? আচ্ছা! তা বিশ্বনাথ মন্দিরের সমীপে তাঁহাকে লইয়া শীঘ্রই যে বিচারসভা বসিবে, তিনি কি তাহা জানিয়াছেন?” 

“হাঁ, জানিয়াছেন, দেখিলাম।” 

“তাহাতে তাঁহার কোনো ভয়বিকারের লক্ষণ দেখিলে?” 

“নাহ, কিছুমাত্র না। আমি সে-প্রসঙ্গ তুলিয়াছিলাম। তিনি কেবল হাসিতে লাগিলেন। পরে আমাকে কেন জানি বলিলেন, তোমার মুখচন্দ্র ঠিক আমার রঘুবীরের ন্যায় দেখিতে। অমনই সুন্দর, অমনই শ্যাম।” শেষ কথাটা বলিবার সময়ে ময়ূখ নিতান্ত লজ্জা বোধ করিতেছিল। 

কমলনয়ন গম্ভীর হইয়া বলিল, “তুমি এখন আসিতে পারো। পরে কথা হইবে।” ময়ুখ উঠিয়া গেল। 

এই এক নূতন যন্ত্রণা কাশীতে উপস্থিত হইয়াছে। কে এক কবি, সম্প্রতি কাশীতে আসিয়া বসিয়াছে। নাম তুলসীদাস। সে এক নূতন রামায়ণ রচনা করিয়াছে। সংস্কৃতে নয়, আওধি হিন্দিতে। প্রতিদিন তাহার রামায়ণ গান শুনিতে কাশীর ঘাটে মানুষের প্রবল ভিড় হইতেছে। এই লইয়া কাশীর পণ্ডিতমণ্ডলী নিতান্ত বিরক্ত। মর্যাদা- পুরুষোত্তম রাম! তাঁহার লীলাকথা কিনা দেবভাষা সংস্কৃতে না হইয়া লোকভাষা আওধিতে রচিত ও গীত হইবে? সর্বনাশ! মর্যাদার তবে আর রহিল কী? 

লোকটি সম্পর্কে ময়ূখের নিকট হইতে কমলনয়ন বহু তথ্য সংগ্রহ করিয়াছে। শূকরক্ষেত্র সরন বলিয়া একটা পাণ্ডববিবর্জিত গ্রামে তাহার জন্ম। এক অশুভলগ্নে জন্ম হইয়াছিল; তাই শৈশবেই তাহার জনক তাহাকে বর্জন করে। জননী পুত্রশোকে মরিয়া যায়। এক দাসী তাহাকে মানুষ করিয়াছিল। পরে এক ব্রাহ্মণের আনুকূল্যে সে কাশীতে আসিয়া বিদ্যাভ্যাস করে। দেশে ফিরিলে বিবাহ হয়। স্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ছিল। একবার স্ত্রী পিতৃগৃহে গিয়াছিল। পত্নীবিরহ সহ্য করিতে না-পারিয়া তুলসীদাস ঝড়ের রাত্রে নদী সাঁতরাইয়া শ্বশুরালয়ে গিয়া উপস্থিত হয়। ইহাতে তাহার স্ত্রী সাতিশয় বিরক্তি বোধ করিয়া বলিয়াছিল, আমার এই অস্থিমাংসময় দেহ! ইহাতে তোমার এত আসক্তি! ইহার অর্ধেকও যদি তোমার ইষ্টদেবতা রামচন্দ্রের উপর হইত তো তরিয়া যাইতে। এই কঠোরবাক্যে লোকটার চেতনা হয়। সে প্রথমে কাশীতে পরে অযোধ্যায় গিয়া রামভজন করিতে শুরু করে। ফল—এই আওধি ভাষায় রচিত রামায়ণ! কাণ্ডই বটে! 

এখন এই অপভ্রংশাত্মক আওধিভাষায় রামকথার চর্চা কাশীর পণ্ডিতমণ্ডলী কোনোমতে মানিয়া লইতে পারিতেছেন না। তাঁহারা বিশ্বনাথ মন্দিরের সম্মুখে আগামী নবমী তিথিতে বিচারসভা ডাকিয়াছেন। তুলসীদাসের বিচার হইবে। তুলসী তাহার রামায়ণ পড়িবে এবং কাশীর পণ্ডিতবৃন্দ ইহাতে রামকথার অসম্মান করা হইয়াছে কি না বিচার করিবেন। এই ব্রাহ্মণেরা আবার কমলনয়নকে বিচারের মধ্যস্থ মানিয়াছেন। কী জ্বালা! একেই তাহার এত কাজ, তাহার উপর আবার… 

কমলনয়ন ভাবে, একটা লোক আওধি ভাষায় রামায়ণ রচিয়াছে, বেশ করিয়াছে। তাহাতেই বা এই কাশীর পণ্ডিতসমাজের এত গাত্রদাহ কেন? এইসব দ্বৈতবাদী পণ্ডিত—ইহারা প্রচার করে, এ জগতের সকল কিছুই নাকি ঈশ্বরেচ্ছায় হইতেছে। অর্থাৎ, তাহাদের আদায় – বিদায়-সামঞ্জস্য অর্থাৎ পূজার পর প্রসাদের থালি নাকি ঈশ্বরেচ্ছাতেই তাহাদের ঘরে গিয়া ঢুকে। তাহাই যদি হইল, তবে আর একটা লোকের প্রাকৃত ভাষায় রামায়ণচর্চা—তাহাতে কী এমন অপরাধ হইয়াছে? সেও কি আর ঈশ্বরেচ্ছায় হইতেছে না? কা তার্কিক-প্রতিভা!! 

তবে হাঁ, ইহাও ভাবিতে হইবে, আওধি ভাষায় কাব্যচর্চা আদৌ কি সম্ভব? সংস্কৃতভাষার অতুলনীয় শব্দভাণ্ডার, উপমাপ্রাচুর্য, ছন্দোসম্ভার, অলংকার বৈভব— এসব আওধি ভাষায় মিলিবে কোথা হইতে? উহা লোকসাধারণের নিমিত্ত নিতান্ত কাজ চালাইবার ভাষা। সেই ভাষায় ললিত কাব্যরচনা করিয়া রামকথার পরিবেশন ইহা তো বাতুলের স্বপ্ন! যাহাই হউক, শুনিয়া দেখিতে হইবে, তুলসীদাস সত্যই কী লিখিয়াছে। যদি উহা উৎকৃষ্ট কাব্য না হয়, যদি ইহাতে লোকপাবন রামচরিত্রের সত্যই অবমাননা ঘটিয়া থাকে, তবে উহা নিষিদ্ধ হওয়াই ভালো। 

দেখিতে দেখিতে নবমী আসিয়া পড়িল। মধ্যাহ্ন অপরাহ্ণের ভিতর ঢলিয়া পড়িতেছে দেখিয়া কমলনয়ন বিশ্বনাথ মন্দিরের চত্বরে আসিয়া দেখিল, পণ্ডিতগণ সমবেত হইয়াছেন। কমলনয়ন তথায় উপস্থিত হইলে তাহাকে সকলে সমাদরপূর্বক মধ্যস্থের আসনে বসাইল। দিনের অন্তিম প্রহর। 

কিছুক্ষণ পর এক শীর্ণকায় ব্যক্তি সভামধ্যে প্রবেশ করিল। হেঁটো ধুতি পরনে, গায়ে একটা উড়ানি। কৃষ্ণবর্ণ চেহারা, শিখাসূত্র আছে—তাই ব্রাহ্মণ বলিয়া চেনা যায়। নতুবা মনে হইত চাষাভুষা লোক। অন্যদের ভাবসাব দেখিয়া বুঝা গেল, এই-ই তুলসীদাস! 

এ কবি? নিতান্ত গ্রাম্য লোক বলিয়া মনে হইতেছে। কোথাও কিছু নাই, শুধু মুখটিতে কী একপ্রকার দীপ্তি—উহা সারল্যের নাকি প্রতিভার বুঝা গেল না। আর দেখিবার মতো তাহার চোখ। উৎফুল্ল মুখাবয়বে চোখদুটি কেবল বিষাদমাখা; তাহাতে যেন বেলাশেষের আলো—শৈশবে পিতামাতার দ্বারা পরিত্যক্ত, যৌবনে স্ত্রীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হইবার বেদনামায়া তাহার দৃষ্টির ভিতর যেন এক চিরবিষণ্ণতার স্থায়ী ছাপ রাখিয়া গিয়াছে। 

সঙ্গে বস্ত্রখণ্ডে বাঁধা একটি পুথি; ইহাই তাহার কাব্য হইবে। খুব লজ্জাভরে পরম মমতায় সে বস্ত্রের গাঁট খুলিয়া কোলের উপর পুথিটি রাখিল। সকলকে নমস্কার করিল; ভালো করিয়া সকলের দিকে তাকাইতেও পারিতেছে না—লোকটি বড়ো লাজুক। পণ্ডিতবর্গ পুথি হইতে কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ পড়িতে আদেশ করিলেন। লোকটি ধীরে ধীরে পাঠ শুরু করিল। 

প্রথমে মঙ্গলাচরণ, গুরু-গণেশ-দেবাদির বর্ণনা। যথাবিহিত শিষ্টাচার আছে বটে! গুরুবন্দনা করিল- 

“বন্দউঁ গুরুপদ পদুম পরাগা। 
সুরুচি সুবাস সরস অনুরাগা।।” 

গুরুচরণপদ্মের সুরুচিকর সুবাসিত সরস অনুরাগমাখা পরাগ শিরে মাখিয়া লইল। কবিতা সরল, অনুভূতিময়। কণ্ঠস্বরটি তো ভারি মিষ্ট! সুর ঠিকমতো লাগে। হৃদয়ের ভিতর আলোড়ন উঠে। দেখা যাক, আরও কী পাঠ করে। 

সেই চিরন্তন রামকথা। দাশরথি রাম ও লক্ষ্মণ বিশ্বামিত্রের যজ্ঞভঙ্গকারী রাক্ষসদিগকে শাসন করিবার পর মিথিলায় জনকের রাজসভায় গিয়াছেন। সেখানে হরধনুভঙ্গ করিয়া রামচন্দ্র সীতার পাণিপ্রার্থী হইলেন। রাম-সীতার বিবাহ প্ৰসঙ্গ বিবাহসভায় রাম দাঁড়াইয়া আছেন। সীতা বরমাল্য লইয়া উপস্থিত হইয়াছেন। সীতা- রামের বর্ণনাটি ভারি সুন্দর। তুলসী গাহিল- 

“কুঅঁরু কুঅঁরি কল ভার্বেরি দেহী। নয়ন লাভু সব সাদর লেহী ॥ 
জাই ন বরনি মনোহর জোরী। জো উপমা কছু কহোঁ সো থোরী।।”

সুকুমার বর ও সুকুমারী কন্যাটিকে বড়ো সুন্দর দেখাইতেছে। তাঁহাদের আদরভরে দেখিয়া সকল লোক নয়নের তৃপ্তিবিধান করিতেছে। এ মনোহর যুগলের বর্ণনা হয় না; যাহা উপমা দিব, তাহাতেই কম পড়িয়া যাইবে। 

কমলনয়ন লক্ষ করিল, ইহার কাব্যের দুই প্রকার গঠন। দোঁহা আর চৌপাই। চৌপাই বলিতে চতুষ্পদী বুঝাইতেছে। চৌপাইগুলি বড়ো মিষ্টি, তাহার সুর চিত্তদ্রাবী। 

মন্থরার পরামর্শে ও কৈকেয়ীর চক্রান্তে শ্রীরামের রাজ্যাভিষেক হইল না। রাম পিতৃসত্যরক্ষার্থে বনে চলিলেন। লক্ষ্মণ সঙ্গে চলিলেন। সীতা ও রামের সহিত বনে যাইবেন বলিতেছেন। সকলে তাঁহাকে নিষেধ করিতেছে। কিন্তু 

“সিয় মনু রাম চরণ অনুরাগা। ঘরুন সুগমু বনু বিষমু ন লাগা।। 
ঔরউ সবহি সীয় সমুঝাঈ। কহি কহি বিপিন বিপতি অধিকাঈ।।” 

সীতার মন রামের চরণে অনুরক্ত। তাই, গৃহপরিবেশকে উত্তম এবং বনবাসকে বিষম তাঁহার মনে হইল না। সবাই অরণ্যে কত বিপদ আছে, সে-কথা বলিয়া বলিয়া সীতাকে বুঝাইতেছেন, কিন্তু সে-সকল কথা সীতা শুনিলেন না। 

কমলনয়নের মনে হইতে লাগিল, এক অর্থে বাল্মীকির রামচন্দ্রের সহিত এই সরলপ্রাণ কবির রামচন্দ্রের পার্থক্য আছে। যদিও কাহিনিগঠন একই, তথাপি বাল্মীকির রচনা হইতে তুলসীর রচনায় রসপার্থক্য ঘটিয়াছে। বাল্মীকির নায়কের ভিতর মনুষ্যভাব প্রবল, তুলসীর রাম দেবতা—তুলসীচন্দনে লিপ্ত ভক্তিপ্রেমের আশ্রয়। ইহার কবিতার ছন্দ সহজ, সুর মেঠো, এইসব দোঁহার গাত্রে অনেক আন্তরিকতা, পৃথিবীর অনেক তৃণশষ্পধুলাবালি লাগিয়া আছে। রাম ইহার দেবতা, তথাপি সেই দেবতা উত্তর ভারতের খেতির আলপথ বাহিয়া নামিয়া আসিয়াছেন। বাল্মীকির রামচন্দ্র রঘুকুলপতি সম্রাট—তিনি মানুষের সমতল হইতে ক্রমে ক্রমে ক্ষমতার ঐশী উচ্চতায় উঠিয়া গিয়াছেন। বাল্মীকির রামচন্দ্রকে দূর হইতে একটি প্রণাম করা যায় মাত্র, তুলসীর রঘুরাইকে কিন্তু বুকে জড়াইয়া ধরা যায়। 

কমলনয়ন ভাবিতে লাগিল, অন্য পণ্ডিতদিগের না জানি কেমন লাগিতেছে। ইতোমধ্যে তুলসী নির্বাচিত শ্লোকাবলী পড়িয়া চলিয়াছে, বনবাসে রাবণ ভিক্ষুকের বেশে সীতাহরণ করিতে আসিয়াছে। জোরপূর্বক সীতাকে রথে তুলিয়া লইল। তখন— 

“সীতহি জান চড়াই বহোরী। চল উতাইল ত্রাস ন থোরী।। 
করতি বিলাপ জাতি নভ সীতা। ব্যাধ বিবস জনু মৃগী সভীতা।।” 

সীতাকে রথে চড়াইয়া রাবণ দ্রুতবেগে রথ চালাইতেছে। রাবণের চিত্তেও ভয় কিছু কম ছিল না। সীতা আকাশপথে বিলাপ করিতে করিতে চলিতেছেন। যেন ব্যাধের ভয়ে ত্রস্তা এক হরিণী। 

এই তো সুন্দর উপমা আসিয়াছে! ভীতকম্পিতা জানকীর সহিত ব্যাধভয়ে ত্রস্তা হরিণীর উপমা। বেশ সুন্দর হইয়াছে। কাহিনি কিন্তু আরও অগ্রসর হইতেছে। হনুমান অশোকবনে নির্বাসিতা সীতার নিকট রামের অঙ্গুরীয়ক আনিয়াছে। উহা দেখিয়া সীতার মনে কী ভাব উঠিতেছে? 

“তব দেখী মুদ্রিকা মনোহর। রাম নাম অঙ্কিত অতি সুন্দর।। 
চকিত চিত মুদরী পহিচানী। হরষ বিষাদ হৃদয়ে অকুলানী।।” 

তখন সেই মনোহর অঙ্গুরীয়কে অতি সুন্দর রামনাম মুদ্রিত আছে, সীতা দেখিলেন। অঙ্গুরীয়কটি চিনিতে পারিয়া তিনি অবাক হইয়া গেলেন। সীতার হৃদয় হরষ ও বিষাদে আকুল হইয়া উঠিল। 

প্রিয়তমের অভিজ্ঞান দেখিয়া হৃষ্ট, আবার প্রিয়বিরহে বিষণ্ণ। আহা! কবিতায় এ যুগপৎ ভাবের একত্র সম্মিলন ঘটাইয়াছে! কমলনয়ন মুখ তুলিয়া তুলসীকে একবার দেখিল। সেই চাষাভুষার মতো দেখিতে মানুষটার দুই গণ্ডদেশ অশ্রুজলে ভাসিয়া যাইতেছে। এ কে? এ তো সামান্য নয়! কমলনয়ন আজ এ কাহাকে দেখিতে আসিয়াছে? 

কিন্তু এ করুণরস কিছু পরেই কৌতুকের উজ্জ্বলতায় ঝলমল করিয়া উঠিল। অশ্রু শুকাইয়া কৌতুকের কিরণ ফুটিয়া বাহির হইল। হনুমানের পুচ্ছে রাক্ষসেরা অগ্নিসংযোগ করিয়াছে। হনুমান ইচ্ছা করিয়াই ধরা দিয়াছে। তাহার পর পুচ্ছের অগ্নিতেজে লঙ্কা পোড়াইয়া দিল- 

“দেহ বিসাল পরম হরুআঈ। মন্দির তেঁ মন্দির চড় ধাঈ।। 
জরই নগর ভা লোগ বিহালা। ঝপট লপট বহু কোটি করালা।।”

হনুমানের দেহ বিশাল কিন্তু অত্যন্ত লঘুভার হইয়াছে। এক মহল হইতে অন্য মহলের উপর লম্ফ দিয়া উঠিয়া পড়িতেছেন। নগর জ্বলিতেছে, লোকজন বেহাল হইয়া গিয়াছে। কোটি অগ্নিশিখার লেলিহান হুতাশন প্রাসাদশীর্ষে দুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছে। 

এইখান হইতেই বীররসের সূচনা হইল। রাম-রাবণের যুদ্ধ ঘোররূপ ধারণ করিল। যুদ্ধে রাবণ নিহত হইল। যুদ্ধজয়ের পর বানরদিগের উল্লাসের ভিতর রাম সীতাসহিত পুষ্পকরথে অযোধ্যায় ফিরিতেছেন। 

“রাজত রামু সহিত ভামিনী। মেরু সৃঙ্গ জনু ঘন দামিনী।। 
সুন্দর বিমানু চলেউ অতি আতুর। কীন্হী সুমন বৃষ্টি হরষে সুর।।”

প্রিয়তমা পত্নীর সহিত রামচন্দ্রকে বড়ো সুশোভিত দেখাইতেছে। যেন সুমেরু পর্বতের শিখরে বিদ্যুতের দীপ্তিবিলসিত সুশ্যাম মেঘ। সুন্দর বিমান বড়ো দ্রুত চলিতেছে। দেবতাগণ হর্ষিত হইয়া আকাশপথে পুষ্পবৃষ্টি করিতেছেন। 

কোথায় যেন একটা বাঁশি বাজিতেছে। বড়ো মধুর সুর! বৃন্দাবনের কথা ভাবিলেই কমলনয়নের হৃদয়ে যে-চকিত ব্যথাটা হয়, তাহাই যেন আজ আবার হৃদয়ের তন্ত্রীতে টান মারিতেছে। কিন্তু কমলনয়নের জ্ঞাননিষ্ঠ মন। কে যেন ভিতর হইতে বলিতেছে, সাবধান হও! ভাবের স্রোতে ভাসিয়া যাইও না। পথের কবি কাব্য লিখিয়াছে ভালো, কিন্তু রামের স্বরূপ কী উন্মোচন করিয়াছে? কে এই রাম? এই কথা চিন্তা করামাত্রই তুলসী মধুর কণ্ঠে গাহিল— 

“তুম্‌হ সমরূপ ব্রহ্ম অবিনাসী। সদা একরস সহজ উদাসী।। 
অকল অগুণ অজ অনঘ অনাময়। অজিত অমোঘসক্তি করুণাময়।।”

তুমি সমরূপ ব্রহ্ম অবিনাশী। তুমি নিত্য, একরস, সহজ উদাসীন। তুমি অখণ্ড, নির্গুণ, জন্মরহিত, নিষ্পাপ, নির্বিকার। তুমি অজেয়, অমোঘশক্তি, করুণার নিত্য আলয়। 

এ তো সব জ্ঞানের কথা! লোকটা ভক্তিরসে দ্রাবিত হইয়া এমন কাব্য লিখিয়াছে—সে এত জ্ঞানের কথা জানিল কী করিয়া? কমলনয়ন তন্ময় হইয়া ভাবিতেছে। তবে কি ভক্তিপথেও সেই এক নির্বিকল্প জ্ঞানভূমিকায় উপনীত হওয়া যায়? বাঁশিটা কোথা হইতে আবার যেন বাজিতেছে। হৃদয় মথিত হইয়া যাইতেছে… তুলসীর রামায়ণপাঠ শেষ হইয়া গিয়াছে। কে একজন পণ্ডিত গম্ভীরস্বরে বলিল, “কাব্য উত্তম। কিন্তু সংস্কৃত হইল দেবভাষা। দেবচরিত্র দেবভাষাতেই বর্ণিত হওয়া উচিত। তাহা না করিয়া এই লোকচলিত ভাষায় রামকথা প্রকাশ করিলে কি পুরুষোত্তমের মর্যাদার হানি হয় না?” 

তুলসী কাহার উদ্দেশে যেন নমস্কার করিল। তাহার পর তদ্‌গতভাবে উচ্চারণ করিল- 

“হরি হর যশ সুর নর গিরা, বরণহি সম্ভ সুজান। 
হাণ্ডী হাটক চারুচীর, রান্ধে স্বাদ সমান। 

হরি ও হরের যশোগান সাধুগণ দেবভাষায় কিংবা মানবীয় ভাষায় বর্ণনা করুন না-কেন, সবই সমান। যেমন সোনার তৈরি হাঁড়িতে বা মাটির হাঁড়িতে রাখিলেও ব্যঞ্জনের আস্বাদ একই হয়।” 

আর-একজন পণ্ডিত এই উত্তরে সন্তুষ্ট হইতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, “তাহা হইলেও ভদ্রসমাজে মাটির হাঁড়িতে ব্যঞ্জন রাখিয়া আহার করা বিধেয় নহে। ব্যঞ্জন উত্তম হইতে পারে। কিন্তু তাহা উত্তম পাত্রে রাখিয়াই আহার করিতে হইবে। দেখ বাপু, তোমার কবিত্বশক্তি আছে, ভক্তি আছে, প্রকাশ করিবার সামর্থ্য আছে। সংস্কৃতও অল্পবিস্তর শিখিয়াছ। রামায়ণ লিখিতে হয় সংস্কৃতভাষায় লেখো-না কেন? উহাতে বিবুধমণ্ডলীমধ্যে তোমার সুযশ প্রচারিত হইবে। রামায়ণের মর্যাদাও রক্ষিত হইবে।” 

ইহার উত্তরে তুলসীদাস কিছুক্ষণ কিছু বলিল না। খানিক পরে ধীরে ধীরে বলিল, “আপনারা কাশীর সর্বাগ্রগণ্য পণ্ডিতমণ্ডলী। আপনাদিগের চরণে আমার শতকোটি প্রণাম। আমার অপরাধ ক্ষমা করিবেন। দেশের সরল সাধারণ মানুষ সংস্কৃত কিছুই বুঝে না। বাল্মীকিরামায়ণ সংস্কৃতে লিখিত হওয়ায় তাহারা রামচরিত্রশ্রবণে বঞ্চিত। তাই, আওধি ভাষায় রামচরিত লিখিয়াছি। ইহা লোকে সহজে বুঝিতে পারে। নানা কাজে সমস্ত দিন ব্যাপৃত থাকিয়াও গুনগুন করিয়া এই রামগান গাহিতে পারে। তাহাতে তাহাদের প্রচুর আনন্দ হয়। আপনাদের নিকট করজোড়ে বিনতি করিতেছি, আপনারা দয়া করিয়া তাহাদের রামকথা শুনিতে দিন। লোকসাধারণের ভিতর রামকথা প্রচারে দয়া করিয়া আপনারা বাধা দিবেন না—এই আমার প্রার্থনা।” 

অপেক্ষাকৃত তরুণবয়স্ক এক পণ্ডিত এইবার বলিলেন, “তা রামকথা শুনিয়া তাহাদের লাভ হইবে কী?” 

তুলসীদাস পুনরায় গলবস্ত্র হইয়া করজোড়ে বলিতে লাগিল, “দেশে সাধারণ মানুষের চরিত্র অত্যন্ত অবনত হইয়াছে। বহু লোক সুরাপায়ী, পরস্ত্রীসম্ভোগী ও মিথ্যাবাদী হইয়াছে। রামকথা শুনিলে তাহারা রামের চিন্তা করিবে। রামচিন্তা করিলে কামচিন্তা আর আসিতে পারিবে না। যে যাহার কথা ভাবে, সে তাহার চরিত্র পায়। তাই রামকথা লোকসমাজে সাধারণের উপযুক্ত ভাষায় নিবেদন করিতে চাই।” 

“আর আমরা যদি সকলে মিলিয়া তোমার বিরোধিতা করি? পারিবে তুমি তোমার এই আওধি ভাষায় রামচরিত্র প্রচার করিতে?” এক বৃদ্ধ ক্রুরহাস্য করিয়া বলিয়া উঠিলেন। 

তুলসী এইবার বিনীত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলিল, “আমি কিছুই জানি না। রামজি আমাকে আদেশ করিয়াছেন। তাঁহার আদেশ অলঙ্ঘ্য। আমি রামচরিত সাধারণ লোকের মধ্যে প্রচার করিবই। আপনারা আমার সহায় হউন।”

সভামধ্যে গুঞ্জন আরম্ভ হইয়া গেল। সকলে এই হেঁটো ধুতিপরা লোকটার স্পর্ধায় বিচলিত বোধ করিতেছে। কিছুক্ষণ পর এক সভামুখ্য দুই হাত তুলিয়া গুঞ্জন থামাইল। তাহার পর উচ্চকণ্ঠে বলিল, “আমরা যাহা শুনিবার শুনিয়াছি। এক্ষণে এই বিচারসভার মধ্যস্থ শ্রীমৎ মধুসূদন সরস্বতী কী মীমাংসা করেন, দেখা যাউক।” 

কমলনয়ন এতক্ষণ কিছুই বলে নাই। সে যেন নিজের ভিতর তলাইয়া গিয়াছে। বিচারসভার তর্কবিতর্ক বিবাদবিসম্বাদ তাহার কর্ণে প্রবেশ করিয়াছে কি না সন্দেহ। মনের ভিতর ডুবিয়া গিয়া সে দৃশ্য দেখিতেছিল। গোদাবরীতীরে এক পর্ণকুটির। সেখানে রঘুকুলোত্তম রাম ভিখারিবেশে বহুলপরিহিতা জানকীর সহিত কপোতকপোতীর ন্যায় মহাসুখে নিবাস করিতেছেন। কুটীরদ্বারে রামানুজ লক্ষ্মণ 

তীরধনু হস্তে পাহারা দিতেছে। পাখির কূজনে নিভৃত বনভূমি মুখরিত হইয়া আছে। আর কেহ কোথাও নাই। 

বুকের ভিতর সেই যন্ত্রণাটা চাপিয়া বসিতেছে। বাঁশির সুর মৃগীর পশ্চাতে ধাবমান ব্যাধের ন্যায় হৃদয়শিকার করিবার জন্য ফিরিয়া আসিতেছে। দুই চক্ষু দিয়া অশ্রুধারা গণ্ডদেশ বাহিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। সে আজ কী শুনিল? কী বলিবে? 

তাহার মনে হইল, সকলে তাহার দিকেই চাহিয়া আছে। যেন কোনো উত্তরের অপেক্ষায়। উত্তরীয়ের প্রান্তে চক্ষুমার্জনা করিয়া কমলনয়ন দ্রাবিত স্বরে বলিয়া উঠিল- 

“পরমানন্দপত্রোহয়ং জঙ্গমস্তুলসীতরুঃ।
কবিতা মঞ্জরী যস্য রামভ্রমরচুম্বিতা।। 

তুলসীদাস কোনো সাধারণ মানুষ নন, তিনি গমনশীল তুলসীতরু; তাঁহার পত্র পরমানন্দ স্বরূপ, কবিতাই তাঁহার মঞ্জরী, সেই মঞ্জরী রামরূপ ভ্রমরের দ্বারা চুম্বিত।” 

তাহার পর অতি সুস্বর অথচ স্পষ্ট উচ্চারণে বলিল, “এই তুলসীরামায়ণ প্রচারিত হইবেই। আওধি ভাষাতে যেরূপে লিখিয়াছেন, সেই রূপেই। ইহাই বিশ্বনাথের বাঞ্ছা। ইহাতেই লোকসাধারণের মহৎ উপকার সাধিত হইবে। একদিন আমাদিগের সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিচারঋদ্ধ গ্রন্থগুলি বিলুপ্ত হইয়া যাইবে, কিন্তু লোকচলিত ভাষায় রচিত এই রামকথা অনন্তকাল ধরিয়া গঙ্গার প্রবাহের মতন বহিয়া চলিবে। ইহা আমি স্পষ্ট দেখিতেছি। আপনারা ইহাকে বাধা না দিয়া, এই সুমহতী চেষ্টার সহায়ক হউন।” 

সভা ভাঙিয়া গেল। তুলসীদাসের রামকথার উপর নিষেধাজ্ঞার ভাব আপাতত স্থগিত হইয়া গেল। সকলে চলিয়া যাইতেছে। সকলের শেষে তুলসীও তাহার পুথিটি বস্ত্ৰখণ্ডে বাঁধিয়া লইয়া উঠিয়া গেল। তাহার চলার পথে অপরাহ্ণের আলোক আসিয়া পড়িয়াছে। 

কমলনয়ন তুলসীর গমনপথের দিকে অন্যমনস্ক হইয়া চাহিয়া ছিল। সেই বাঁশিটা থামিয়া গিয়াছে। কিন্তু এখন আবার সেই সুর থামিয়া যাইবার বেদনা… 

কমলনয়ন জানে না, জানিলেও তাহাকে চেনে না, কে এতক্ষণ ধরিয়া ওই বাঁশি বাজাইতেছিল। দশাশ্বমেধ ঘাটের নিকটে বসিয়া সেদিন উৎপলদৃষ্টি বাঁশিতে দিনান্তবেলায় পূরবীর আলাপ করিতেছিল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *