সাত
মথুরানাথ তর্কবাগীশের টোলে উপস্থিত হইয়া কমলনয়ন দেখিল, বহু দেশ হইতে নানা বয়সের বিদ্যার্থিগণ তথায় বিদ্যাভ্যাস করিতেছে। শিক্ষার্থিদিগের বসিবার জন্য বহু ধাপ সমন্বিত সোপান নির্মিত আছে। প্রথম শিক্ষার্থিবৃন্দ সর্বনিম্ন ধাপে, তাহার পর ক্রমশ উচ্চ উচ্চ শ্রেণীর ছাত্রগণ ক্রমোচ্চ ধাপে বসিয়া শাস্ত্র আয়ত্ত করিতেছে। অপেক্ষাকৃত নিম্ন শ্রেণীর ছাত্রদিগের পড়াইবার ভার তাহাদের অপেক্ষা উপরের শ্রেণীর ছাত্রদের উপরেই ন্যস্ত। সোপানের উপরিভাগে সর্বোচ্চ শ্রেণীর ছাত্রদিগের দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া পুস্তকস্তূপের মধ্যে তেজস্বী তীক্ষ্ণদৃষ্টি মথুরানাথ স্বয়ং গম্ভীরভাবে অধ্যাপনা করিতেছেন।
কমলনয়ন মঞ্চোপরি উপবিষ্ট মথুরানাথের নিকট উপস্থিত হইয়া প্রণাম নিবেদন করিল। সৌম্যকান্তি কিশোরের কমনীয় মূর্তি দেখিয়া মথুরানাথের চিত্তে কিশোরের প্রতি বাৎসল্যভাবের উদয় হইল। কিন্তু তিনি তা বাহিরে প্রকাশিত হইতে দিলেন না। গম্ভীর স্বরে কমলনয়নের পরিচয়, কী উদ্দেশ্যে অত্র আগমন ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করিলেন।
কমলনয়ন অতি সম্ভ্রমের সহিত উত্তর দিল, “আমার নাম মধুসূদন। পিতার নাম প্রমোদন পুরন্দরাচার্য। নিবাস বিক্রমণিপুরের কোটালিপাড়ার অন্তর্গত ঊনসিয়া গ্রাম। সম্প্রতি ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষার মানসে নবদ্বীপে আপনার চরণপ্রান্তে উপস্থিত হইয়াছি।”
সে যে শ্রীগৌরাঙ্গের চরণরেণু মস্তকে ধারণ করিয়া ভক্তের জীবন লইবার জন্য নবদ্বীপে আসিয়াছিল, শ্রীগৌরাঙ্গের দর্শন পায় নাই, অতঃপর পিতার আদেশানুসারে বিদ্যাচর্চায় ব্রতী হইয়াছে, এত কথা কমলনয়ন বলিল না। সেসব কথা এখানে বলিয়া কী হইবে? উহা কমলনয়নের নিতান্ত ব্যক্তিগত হাহাকার, হৃদয়ের বেদনাকুসুম হৃদয়েই ফুটিয়া উঠিয়া হৃদয়েই ঝরিয়া পড়ুক! সেই প্রথম অনুরাগচন্দনে লিপ্ত অমলা ভক্তির পুষ্পার্ঘ্য দেবতার চরণে অর্পিত হইল না, তাহার ব্যথিত সুবাস আপন হৃদয়ে লুকাইয়া রাখিয়াই শুষ্ক ন্যায়শাস্ত্রের চর্চা করিতে হইবে। অন্য উপায় নাই!
মথুরানাথ দেখিলেন, কিশোরের ওষ্ঠদ্বয় কী যেন অভিমানে কাঁপিতেছে, তাহার নয়নে যেন কী গোপন বেদনা আঁকা হইয়া রহিয়াছে। সমস্ত জীবন সুকঠিন ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপনা করিলেও মথুরানাথের হৃদয় বধির হইয়া যায় নাই, সূক্ষ্ম বেদনা তাঁহার মনোবীণার তন্ত্রীতে অনুরণিত হইত। মথুরানাথ বুঝিলেন, কোনো-না-কোনো কারণে এই তরুণবয়স্ক বিদ্যার্থীর হৃদয়দেশ আহত হইয়া আছে, কিন্তু কী কারণে যে নবাগত কিশোর বেদনাহত হইয়া আছে, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন না।
তিনি প্রশ্ন করিলেন, “এখানে আসিবার পূর্বে কোন্ কোন্ গ্রন্থ চর্চা করিয়াছ?” কমলনয়ন উত্তর দিল, “পিতার নিকট ন্যায়শাস্ত্রের প্রাথমিক পরিচয় পাইয়াছি। উদয়নাচার্যের ‘লক্ষণাবলী’ ও বল্লভাচার্যের ‘ন্যায়লীলাবতী’ অধ্যয়ন করিয়াছি।”
“বেশ। এই দুই গ্রন্থ তুমি এখানে পুনর্বার অধ্যয়ন করো। এই দুই গ্রন্থই এক্ষণে ন্যায়দর্শনসৌধের ভিত্তিভূমিস্বরূপ। পুনঃপাঠের দ্বারা যখন এই দুই গ্রন্থ তোমার মজ্জাগত হইবে, তখনই নব্যন্যায়শাস্ত্র পাঠের অধিকার জন্মাইবে। অন্যথায় নব্য ন্যায় দুরূহ মনে হইতে পারে।”
বস্তুত, ন্যায় দর্শনের দুইটি বিভাগ —প্রাচীন ন্যায় ও নব্য ন্যায়। ন্যায় দর্শনের জনক আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক হইতে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে কোনো এক সময়ে আবির্ভূত ঋষি গৌতম। আবার ন্যায় দর্শনের সদৃশ ও সর্বাধিক সমীপবর্তী দর্শন হইল বৈশেষিক দর্শন। উহার উদ্গাতা মহর্ষি কণাদ। এই বৈশেষিক দর্শন ইতিহাসের বিচারে ন্যায় দর্শন অপেক্ষাও প্রাচীনতর।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া ইহাদের চর্চা, সংযোজন, সংশোধন চলিয়াছে। এইরূপে চলিতে চলিতে খ্রিস্টীয় দশম শতকে উদয়নাচার্যের আবির্ভাব হয়। তিনি ন্যায় দর্শন ও উহার সমান্তরাল বৈশেষিক দর্শনের ভিতর সেতুবন্ধন করিবার প্রয়াস করেন। উদয়নাচার্যের এই প্রয়াসকেই ভিত্তিভূমি করিয়া ত্রয়োদশ শতকে মিথিলার গঙ্গেশ উপাধ্যায় নব্য ন্যায়মতের প্রবর্তন করেন।
কমলনয়ন উদয়নাচার্যের ‘লক্ষণাবলী’ ও বল্লভাচার্যের ‘ন্যায়লীলাবতী’ পাঠ করিতে লাগিল। পুনঃপাঠে স্মৃতি সজীব হইয়া উঠে, পূর্বে ওই দুই গ্রন্থের যে-স্থল অস্পষ্ট ছিল, পুনঃ পুনঃ অভ্যাসের ফলে সেই সকল স্থানে মেধার প্রখর আলোক আসিয়া পড়িল; সংশয় ও দুর্বোধ্যতার মেঘ কাটিয়া গেল।
কয়েকদিবস অতিবাহিত হইলে মথুরানাথ অদূরে পাঠরত কমলনয়নকে নিকটে ডাকিয়া বলিলেন, ‘মধুসূদন! এখন হইতে অন্য ছাত্রদিগের নিকট হইতে পাঠ না- লইয়া তুমি সরাসরি আমার নিকট হইতেই পাঠ লইও।’
এত অল্পবয়স্ক নবাগত ছাত্রকে মথুরানাথ স্বয়ং পড়াইবেন শুনিয়া অন্য বিদ্যার্থিগণ বিস্মিত হইয়া কমলনয়ন ও মথুরানাথ—উভয়ের মুখের দিকেই তাকাইয়া রহিল। তাহাদের সেই দৃষ্টিতে কেবল বিস্ময় ছিল না, ঈষৎ ঈর্ষাও মিশ্রিত ছিল।
ন্দুই-একটি প্রশ্ন করিয়া কমলনয়ন ‘লক্ষণাবলী’ ও ‘ন্যায়লীলাবতী’ পড়িয়াছে কেমন, মথুরানাথ তাহা পরীক্ষা করিলেন। কমলনয়নের উত্তরে নিতান্ত সন্তুষ্ট হইয়া মথুরানাথ অতঃপর বলিলেন, “প্রাথমিক পাঠ যথেষ্ট হইয়াছে। এক্ষণে গঙ্গেশ উপাধ্যায়- বিরচিত তত্ত্বচিত্তামণি’ আয়ত্ত করো। এই ‘তত্ত্বচিন্তামণি’ সত্যই চিন্তামণিস্বরূপ। ইহা হাতে লইয়া যে যাহা চিন্তা করিবে, তাহাই পাইবে।” কথাটি বলিয়া তিনি কিঞ্চিৎ হাসিলেন।
ওইরূপে হাসিবার কারণ ছিল। গঙ্গেশ উপাধ্যায়ের তত্ত্বচিন্তামণি’ গ্রন্থটি হাতে লইয়া যে যাহা চিন্তা করে, সে তাই-ই পায়, এই প্রবাদটির অর্থ যদি এইরূপ করা যায় যে, ইহা সম্যক পাঠ করিলে দর্শনশাস্ত্রের কোনো বিষয়ই আর অনায়াত্ত থাকে না, তবে ওই প্রকার ব্যাখ্যায় মথুরানাথের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু তাহা না- হইয়া, যদি ‘তত্ত্বচিন্তামণি’ গ্রন্থের অলৌকিক শক্তিতে পৃথিবীর যে-কোনো বাঞ্ছিত বস্তু করায়ত্ত হয়, কিংবা যে-কোনো পার্থিব বাসনাই পরিপূর্ণ হয়—যদি এইরূপ লোকপ্রচলিত বিশ্বাসের কথা ধরা যায়, তবে তাহা যে সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক, এ কথা বুঝিতে প্রখর বস্তুবাদী নৈয়ায়িক পণ্ডিত মথুরানাথের কোনো অসুবিধা হইবার কথা নহে। পরন্তু গ্রন্থটি অতি দুরূহ; ইহা এত বিখ্যাত যে, ইহার টীকা না করিতে পারিলে সেযুগে কেহ পণ্ডিত মহলে পরিচিতিই পাইত না। এই এক তত্ত্বচিন্তামণি’ গ্রন্থের বহুবিধ টীকা রচিত হইয়াছিল। গঙ্গেশ উপাধ্যায়ের পুত্র বর্ধমান, মিথিলা-প্ৰখ্যাত পক্ষধর মিশ্র, নবদ্বীপ-গৌরব রঘুনাথ শিরোমণি, বাসুদেব সার্বভৌম, জগদীশ তর্কালঙ্কার, গদাধর ভট্টাচার্য প্রমুখ প্রত্যেকেই ইহার টীকা করিয়াছেন। স্বয়ং মথুরানাথ ‘তত্ত্বচিন্তামণি’ গ্রন্থের টীকা ‘তত্ত্বালোক রহস্য’ রচনা করিয়াছিলেন। একই গ্রন্থের এত টীকা রচিত হওয়ায়, ইহা বুঝিতে পারা যায় যে, মূলগ্রন্থটি কী পরিমাণ দুরূহ ও নানামুখী আলোচনায় সমৃদ্ধ। সেই কঠিন গ্রন্থ মথুরানাথ যখন কমলনয়নের হস্তে তুলিয়া দিলেন, তখন তিনি নিশ্চিতভাবে জানিতেন যে, কমলনয়ন উহা অত শীঘ্ৰ আয়ত্ত করিতে পারিবে না। না পারুক, তবু কঠিন বিষয় চর্বণ করিতে গিয়া যেমন বালকের দুধে-দাঁত ধারালো হয়, তেমনই ইহা অভ্যাস করিতে গিয়া মেধাবী কিশোর কমলনয়নের মেধা আরও শাণিত হইবে, এই বিশ্বাসেই মথুরানাথ উহা কমলনয়নকে পড়িতে আদেশ দিয়াছিলেন। আর ওই দুগ্ধপোষ্য শিশুর হস্তে বিপুল কলেবর ‘তত্ত্বচিন্তামণি’ গ্রন্থখানি দেখিয়া যুগপৎ পুলক ও কৌতুকে মথুরানাথের ওষ্ঠাধরে বিদ্যুতের ন্যায় হাস্যরেখা খেলিয়া গিয়াছিল।
কিন্তু কৌতুকের সে-হাস্য মিলাইয়া গিয়া মথুরানাথের মুখমণ্ডলে অচিরেই বিস্ময়ের ভাব জাগিয়া উঠিল। কিশোর কমলনয়ন দুর্জয় প্রতিভাবলে এই গ্রন্থ দ্রুতবেগে আয়ত্ত করিতে লাগিল। মথুরানাথ শিষ্যকে পক্ষধর মিশ্র প্রণীত ‘আলোক’ টীকা ধরাইলেন, কমলনয়ন উহা যেন দীপ্ত হুতাশনের ন্যায় গ্রাস করিয়া লইল। মথুরানাথ ইহার পর রঘুনাথ শিরোমণিকৃত জগদ্বিখ্যাত ‘দীধিতি’ টীকা উপস্থাপন করিলেন, কমলনয়ন সাগ্রহে ও সানুরাগে উহাও সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিয়া লইল। এইবার মথুরানাথ তাঁহার স্বরচিত ‘তত্ত্বালোক রহস্য’ আনিলেন, উহার সুকঠিন যুক্তিপ্রণালী আত্মসাৎ করিতেও কমলনয়নের বিলম্ব হইল না। কমলনয়নকে পড়াইয়া মথুরানাথ যত আনন্দ পাইতেছিলেন, আর কাহাকেও পড়াইয়া তত আনন্দ পান নাই। এক্ষণে এইসব টীকার তুলনামূলক আলোচনা করিয়া মথুরানাথ মেধাপ্রখর কমলনয়নকে তৃপ্ত করিতে লাগিলেন। গুরু ও শিষ্য এই অধ্যয়ন-অধ্যাপনাকালে যেন আনন্দের সাগরে ভাসিতেছিলেন।
কিন্তু তাহার পর যখন পাঠে বিরতি হইত, টোল ছুটি হইয়া যাইত, মথুরানাথ আবশ্যকীয় গার্হস্থ্য কর্মে মন দিতেন, টোলের বিদ্যার্থিগণ স্ব স্ব কক্ষে ফিরিয়া আসিত, কমলনয়ন তখন তাহার পুঁথিপাতড়ায় বন্ধন দিয়া নিজ গৃহদ্বারে আসিয়া বসিত। দিবস অবসন্ন হইয়া আসিতেছে, অপরাহ্ণ নামিতেছে, আকাশ বাহিয়া পাখির দল বাসায় ফিরিতেছে, কুটিরের পশ্চাদ্ভাগে অযত্নবর্ধিত ঘেঁটকোল পাতার জঙ্গল হইতে বন্য সুবাস উঠিয়া আসিতেছে, সেসময় কমলনয়নের মন কেমন লক্ষ্যহারা উদাস হইয়া বাজিত। চরাচরে তাহার কেহ কোথাও নাই, জগতের সকল মায়িক বন্ধন খসিয়া পড়িয়াছে, সে যেন ঈশ্বরের এক বর্জিত সৃষ্টি… দূরে গঙ্গার ঘাটের কাছে নহবতে সানাইয়ে মূলতান রাগ বাজিত, কী এক সকরুণ, মন্থর সুর সমস্ত বৈকালটা উদাস করিয়া রাখিত… কমলনয়নের মনে হইত, তাহার হৃদয় কাহাকে যেন ভালোবাসিতে চাহিয়াছিল, পায় নাই। দূর দিগন্তের নিকট মেঘ করিয়া আসিত, ওই মেঘের ভিতর যেন তাহার কিশোর মনের প্রথম প্রেমের মুকুল ঝরিয়া গিয়াছে… আর কখনও ফুটিবে না… শুষ্ক পুথিগুলার পৃষ্ঠায় সেই প্রেমের স্পর্শমাত্র নাই, উহাতে বুদ্ধির কসরৎ মাত্র আছে, মেধার শাণিত অস্ত্রে শব্দের হীরক কাটিয়া বাক্যহার গড়িবার অনুপম রীতি আছে, কিন্তু হৃদয়ের বিশুদ্ধ অনুভূতি রাখিবার জায়গা নাই… মনে হইত, সে তো কবি হইতে চাহিয়া কবি হইতে পারে নাই… কেন জানি মনে হইত, সে যাহা হইতে পারে নাই, আর কেহ তাহাই হইয়াছে—সে যাহা যাহা লাভ করিতে পারে নাই, অন্য কেহ সেসকল লাভ করিয়াছে; গৃহত্যাগ করিয়া অনিকেত জীবনে আসিয়া সে শ্রীচৈতন্যদেবকে ভালোবাসিতে চাহিয়াছিল, দেখা পায় নাই; না দেখিয়াই এত ভালোবাসিয়াছে… যদি দেখা পাইত, তবে তনুমনপ্রাণ সেই রাতুল চরণে বিকাইয়া দিত… ভাবিতে ভাবিতে উঠিত, প্রদীপ জ্বালাইয়া পুথির পাতা খুলিয়া বসিত, পড়িতে পড়িতে অন্তরের অতল হইতে দীর্ঘশ্বাস উঠিয়া আসিত… কে যেন সন্ধ্যার সেই স্তিমিতালোকে তাহার কানে কানে বলিয়া যাইত, ‘এ জীবন নিরর্থক, এ জীবনে কিছুই হইল না’… নদীর অশান্ত বাতাস উঠিয়া আসিয়া হৃদয়হীন পুথির ব্যাপ্তি’ আর ‘হেত্বাভাস’-এর অধ্যায়গুলির পৃষ্ঠায় মর্মরিত হইয়া চলিয়া যাইত।
একদিন বৈকালে গঙ্গার উপর মেঘ জমিয়াছে, ঘরে বড়ো গুমোট, কমলনয়ন ভাবিল, নদীতীর হইতে ঘুরিয়া আসিবে। নগরের বেষ্টনীর বাহিরে গঙ্গার পাড়ে আসিয়া স্নিগ্ধ বাতাসে তাহার শরীর ও মন যেন শান্তি পাইল। ঘাটের উপর বসিয়া আছে, কে এক ব্যক্তি সন্ধ্যাস্নান সারিতেছে। স্নানান্তে সে-ব্যক্তি যখন উঠিয়া আসিল, লোকটিকে দেখিয়া কমলনয়ন নিতাক্ত বিস্মিত হইয়া গেল। এ যে সেই লোক, যাহার সহিত প্রথম সে মথুরানাথের কথোপকথন শুনিয়াছিল; এই ব্যক্তিই প্রথম, যাহার নিকট সে মথুরানাথ তর্কবাগীশের বিদ্যাশ্রমের পথনির্দেশ পাইয়াছিল! তাহার পর কত বছর কাটিয়া গেছে। মনে হইল, লোকটিও তাহাকে চিনিতে পারিয়াছে। সম্মুখে আসিয়া কমলনয়নের মুখের সম্মুখে আঙুল নাচাইয়া নাচাইয়া সেই স্থূলাকার গৌরবর্ণ ব্যক্তিটি রহস্য করিয়া কহিল :
“কিং গবি গোত্বং? কিমগবি গোত্বম্? যদি গবি গোত্বং ময়ি ন হি তত্ত্বম্।
অগবি চ গোত্বং যদি ভবদিষ্টম্, ভবতি ভবত্যপি সম্প্রতি গোত্বম্ ॥”
কমলনয়ন তাহার কথায় হাসিয়া উঠিল। কথাটি রহস্যপূর্ণ ও নৈয়ায়িক মহলে অতি প্রচলিত। নব্য ন্যায়ের জনক গঙ্গেশ উপাধ্যায়ের জীবন সম্পর্কিত একটি কিংবদন্তী। বাল্যে গঙ্গেশের দুরন্তপনায় বিরক্ত তাঁহার মাতুল গঙ্গেশকে একবার ‘গোরু’ বলিয়া তিরস্কার করিয়াছিলেন। গঙ্গেশ তখন এই শ্লোকটির দ্বারা মাতুলের তিরস্কার ফিরাইয়া দিয়া কহিয়াছিলেন, “তাত! গো-ত্ব কি গোরুতেই থাকে, নাকি গোরু ভিন্ন অন্য কোনো পদার্থে থাকে? যদি গোরুতেই গো-ত্ব থাকে, তবে আমাতে তাহা সম্ভব নয়, কারণ আমি গোরু নই, মানুষ। আর গো-ত্ব যদি গোরু ভিন্ন অন্য কিছুতে থাকে এমন হয়, তবে গোরুর ওই বৈশিষ্ট্য গো-ত্ব আপনার উপরেও প্রযুক্ত হইতে পারে কি না?”
তাহার ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা শুনিয়া কমলনয়ন বালকের ন্যায় হাসিতেছে দেখিয়া স্থূলোদর লোকটি বলিল, “চিনিতে পারিয়াছ তাহা হইলে? এই গঙ্গার ঘাটে সেই দেখা। ভালো আছ? সম্প্রতি মথুরানাথ তর্কবাগীশের টোলে অধ্যয়ন করিতেছ বুঝি?”
কমলনয়ন কহিল, “হাঁ। আপনার সর্বাঙ্গীন কুশল তো? আপনি কি নিকটেই থাকেন?”
লোকটি বলিল, “এই বিষ্ণু দামোদরের মন্দিরের পাশেই আমার কুটির। আসিবে নাকি?”
কমলনয়ন লোকটির সহিত চলিল। মন্দিরের পাশে গঙ্গার ধার ঘেঁষিয়া উহার একচালা গৃহ। গৃহে অন্য কেহ নাই। লোকটির বহুদিন হইল স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছে। আর দারপরিগ্রহ করে নাই। ক্রমে ক্রমে লোকটির সব কথা প্রকাশ হইয়া পড়িল সে বলিল, “আমার নাম হরিরাম চক্রবর্তী। আমার যখন তোমাদের ন্যায় তরুণ বয়স, সেই তখন নবদ্বীপ আসিয়াছিলাম। সেই হইতে রহিয়া গিয়াছি।”
কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল, “পিতৃপুরুষের নিবাস কোথায় ছিল?”
হরিরাম কহিল, “বনবিষ্ণুপুর। আমি কিন্তু শৈশবেই পিতৃহীন ছিলাম। বিদ্যালাভের উদ্দেশে নবদ্বীপ আসিয়াছিলাম। পাঠ সমাপ্ত হইবার পূর্বেই জননী পরলোকগতা হইলেন। সংসারে আর কেহ কোথাও নাই; তাই বিদ্যা উপার্জনের পর নবদ্বীপেই বিবাহ করিয়া ঘর বাঁধিলাম। কিন্তু বিবাহের দুই বৎসরের মধ্যে স্ত্রীবিয়োগ হয়। তাহার পর আর ঝামেলা বাড়াই নাই। তোমাকে কী খাইতে দিই? খই-দুধ আর খাজুরের গুড় আছে, খাইবে?”
কমলনয়ন ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি প্রকাশ করিল। ঘরের মেঝেতে পিঁড়িতে বসিয়া কাংস্যপাত্রে খই দুধ গুড় মাখিয়া খাইতে খাইতে জিজ্ঞাসা করিল, “নবদ্বীপে কি ন্যায়শাস্ত্র পাঠ করিতে আসিয়াছিলেন?”
হরিরাম উত্তর দিল, “হাঁ। আমার বড়ো সাধ ছিল, প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক হইব। কিন্তু ন্যায়ের টোলে আমার ন্যায় সাধারণ মেধার ছাত্রের পক্ষে অন্তত দশ বৎসরের কমে কিছুতেই বিদ্যা সমাপ্ত হয় না। প্রথমে ন্যায়ের টোলেই প্রবেশ করিয়াছিলাম। দুই বৎসর পড়িয়াও ছিলাম। কিন্তু তখন চিন্তা, গৃহে জননী জীবিতা আছেন। বনবিষ্ণুপুরে সেই জঙ্গলাকীর্ণ লোকপরিত্যক্ত গৃহে মা একাকী পড়িয়া আছেন। আমি দ্রুত পাঠ সমাপ্ত করিয়া দেশে গিয়া টোল খুলিয়া না বসিলে তাঁহার ভরণপোষণ হয় না। অগত্যা ন্যায়শাস্ত্র ছাড়িয়া কাব্যসাহিত্যের শ্রেণীতে প্রবেশ করিতে হইল। তখন কি আর জানিতাম, পাঠ সমাপ্ত হইবার পূর্বেই হতভাগিনী মা অনাহারে অনিদ্রায় ভুগিয়া সংসারের মায়া কাটাইয়া চলিয়া যাইবেন? আমারও ন্যায় পড়া হইল না, মায়েরও সুখের মুখ দেখা হইল না।”
এই পর্যন্ত বলিয়াই হরিরাম সাগ্রহে কমলনয়নকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কী কী পড়িতেছ, বলো। রঘুনাথ শিরোমণির দীধিতি-টীকা পড়িয়া ফেলিয়াছ? বাব্বাঃ! আমি তো কেবল ওই টীকার নামটাই শুনিয়াছি। মথুরানাথ তর্কবাগীশ তোমাকে উহার উপর টিপ্পনীও লিখিতে বলিয়াছেন? আহা, তাহা হইলে তো তুমি ধুরন্ধর নৈয়ায়িক পণ্ডিত হইবে, বলো?”
কমলনয়ন দেখিল, হরিরামের খুব বিদ্যাবাসনা ছিল। সে অনেক পড়িতে চাহিয়াছিল। কিন্তু দারিদ্র্য তাহাকে সে সুযোগ দেয় নাই। তাহার বিদ্যা হইল না। এখন গুটিকতক ছাত্র লইয়া কাব্যশাস্ত্রের সামান্য অধ্যাপনা করিয়া আর ছাত্ররা যে যাহা দেয়, তাহা দ্বারাই অতি দরিদ্রভাবে নগরীর একপ্রান্তে এই জীর্ণ কুটিরে বসবাস করে।
কমলনয়ন তথাপি বলিল, “আচ্ছা, এখনও তো বিদ্যাভ্যাস করা যায়। আমাদিগের টোলে আপনার অপেক্ষাও বয়স্ক ছাত্র আছে।”
হরিরাম হাসিয়া বলিল, “নাহ। এই বয়সে আর হয় না। আমার মস্তিষ্ক জীবিকার সন্ধান করিতে করিতে অনুর্বর হইয়া গিয়াছে। সূক্ষ্ম চিন্তা করিতে পারি না। স্মৃতি দুর্বল হইয়া গিয়াছে। অনেক স্বপ্ন লইয়া বিবাহ করিয়াছিলাম। বড়ো চতুষ্পাঠী খুলিব। বহু ছাত্রের সমাগম হইবে। তাহাদিগকে কালিদাস, রঘু, নৈষধ পড়াইব। কিন্তু হইল আর কই? স্ত্রীবিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে আমার সে বহুলালিত স্বপ্ন ঘটের ন্যায় ভাঙিয়া খাপরায় পরিণত হইয়াছে। ওই যে তোমরা ‘ধ্বংসাভাব’ না কী যেন বলো…”
কমলনয়ন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করিবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করিল, “আপনি তো তবে বহু প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িককে দর্শন করিয়াছেন?”
হরিরামের মুখভাব উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। বলিল, “অবশ্য। তোমার আচার্য মথুরানাথ তর্কবাগীশের পিতা শ্রীরাম তর্কালঙ্কারকেও দেখিয়াছি। কিন্তু যাঁহাকে দেখিলে তুমিও নিজেকে ধন্য মনে করিতে, ন্যায় দর্শনের সেই প্রবাদপুরুষ রঘুনাথ শিরোমণির পুণ্যদর্শন পাইবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছে। মথুরানাথ প্রথমে পিতার নিকট শিক্ষালাভ করিয়া পরে রঘুনাথ শিরোমণির ছাত্র হইয়াছিলেন। কেন, তুমি মথুরানাথ তর্কবাগীশের নিকট রঘুনাথ শিরোমণির কথা শুন নাই?”
কমলনয়ন বলিল, “শুনিয়াছি। তবে অল্প। আমার আচার্য দর্শনের নিগূঢ় চিন্তাতেই অধিক কাল নিমগ্ন থাকেন।” হরিরাম কহিল, “তবে তুমি আমার নিকট মহাত্মা রঘুনাথের কথা শুন। শুনিবে?”
কমলনয়ন অত্যন্ত আগ্রহী হইয়া কহিল, “হাঁ। নিশ্চয়ই শুনিব।”
হরিরাম বলিল, “বেশ। আমি এক্ষণে তোমাকে রঘুনাথের গল্প বলিব। বাহিরে খুব বৃষ্টি পড়িতেছে। এখন তো আর ফিরিতে পারিবে না। নিকটে সরিয়া আইস। মন দিয়া শুন।”