ছায়াচরাচর – ৮

আট 

বাহিরে সত্যই অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়িতেছিল। কক্ষগাত্রে একমাত্র মুক্ত বাতায়ন; তাহার ক্ষুদ্র অবকাশের ভিতর দিয়া গঙ্গার জলীয় বাতাস ঢুকিয়া পড়িতেছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিয়াছে। হরিরাম উঠিয়া বাতায়ন বন্ধ করিয়া একটি মাটির প্রদীপ জ্বালাইল। পিলসুজের উপর প্রদীপের স্তিমিত শিখা বাতাসের স্পর্শে নড়িয়া চড়িয়া উঠিল। কমলনয়নের দিকে হরিরাম একবার সস্মিত দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া রঘুনাথ শিরোমণির জীবনের উপাখ্যান বলিতে আরম্ভ করিল : 

“রঘুনাথ এই নবদ্বীপেই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার যখন তিন-চারি বৎসর বয়ঃক্রম, তখনই তাঁহার পিতৃবিয়োগ হয়। সাংসারিক অবস্থা ভালো নয়; মাতাকে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। তাঁহার মাতার নাম সীতাদেবী। এদিকে আবার অতি শৈশবেই রোগে ভুগিয়া রঘুনাথ তাঁহার একটি চক্ষু হারান। সকলে তাঁহাকে ব্যঙ্গ করিয়া বলিত, ‘কানা রঘুনাথ’।”

কমলনয়ন বলিল, “যিনি ভবিষ্যতে এত বড়ো প্রতিভাধর হইবেন, যাঁহার প্রতিভার দীপ্তিতে বঙ্গসরস্বতীর ললাটদেশ গৌরবে উজ্জ্বল হইয়া উঠিবে, এ কী অন্ধকারময় শৈশব তাঁহার!” 

হরিরাম মাথা নাড়িয়া উত্তর দিল, “সত্যই। কে তখন বলিতে পারিত, এই একচক্ষু বালক একদিন সমগ্র বঙ্গদেশের জ্ঞাননেত্র উন্মুক্ত করিবে? যাহাই হউক, রঘুনাথের জননী সীতাদেবীর প্রাণে পুত্রকে লেখাপড়া শিখাইবার বড়ো ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কোনো উপায় করিতে পারেন নাই। সেসময় বাসুদেব সার্বভৌম সদ্য মিথিলা হইতে পাঠ শেষ করিয়া আসিয়া নবদ্বীপে ন্যায়ের টোল খুলিয়াছেন, ছাত্রদের কলরবে তাঁহার চতুষ্পাঠী মুখর হইয়া উঠিয়াছে। গ্রাসাচ্ছাদনের উপায়ান্তর না পাইয়া সীতাদেবী এই টোলের নিকটে বাসুদেব সার্বভৌমের গৃহে গৃহপরিচারিকার কার্য লইলেন। সারাদিন রন্ধনশালাতেই অতিবাহিত হয়। বালক রঘুনাথ টোলের বিদ্যার্থিদিগের মধ্যে ইহার উহার ফাইফরমাশ খাটিয়া বেড়ান। কী, কেমন শুনিতেছ?” 

কমলনয়ন ধীরে ধীরে বলিল, “ভাবিতেছি। সময় না হইলে কিছুই হয় না। সময় যখন মন্দ, তখন সকলই এইরূপ মন্দভাগ্যের অধীন হইয়া পড়ে। আবার সুসময় আসিল, অবস্থার পরিবর্তন হইল।” 

হরিরাম বলিল, “যথার্থ! তথাপি মন্দ সময়েও দারিদ্র্যের ভস্মস্তূপের ভিতর হইতে প্রতিভার অনল জ্বলিয়া উঠে। একদিন রঘুনাথ-জননী সীতাদেবী রন্ধন করিতে করিতে দেখিলেন, উনানের আগুন নিভিয়া গিয়াছে। তিনি পুত্র রঘুনাথকে টোলের জনৈক বিদ্যার্থীর নিকট হইতে অগ্নি আহরণ করিয়া আনিতে বলিলেন। বালক রঘুনাথ মাতার নির্দেশানুসারে ওই বিদ্যার্থীর রন্ধনশালায় উপস্থিত হইলেন। সেখানে তখন স্বয়ং বাসুদেব সার্বভৌম উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যার্থীটি গুরুদেবের সঙ্গে কথোপকথনে ও রন্ধনকার্যে ব্যস্ত ছিল। রঘুনাথ বারংবার অগ্নি প্রার্থনা করিতেছিলেন। বিদ্যার্থী রঘুনাথের কথায় কর্ণপাত করিতেছে না, আর রঘুনাথও একই কথা বারবার বলিতেছেন। অবশেষে সেই বিদ্যার্থী বিরক্ত হইয়া হাতায় করিয়া জ্বলন্ত অঙ্গার লইয়া কহিল, ‘নে, হাত পাত, ধর’। জ্বলন্ত অঙ্গার কেমন করিয়া হাতে ধরিবেন, এই কথা বালক রঘুনাথ একটু চিন্তা করিয়াই পরমুহূর্তে সম্মুখে ভূভাগ হইতে কিছুটা ধুলা-মাটি হাতে লইয়া কহিলেন, হাতের এই মাটির উপরেই অঙ্গার থুইয়া দাও। তাহা হইলে হাত পুড়িবে না’। বিদ্যার্থী হস্তস্থিত ওই মাটির উপরেই অঙ্গার প্রদান করিল ও বালক নির্বিঘ্নে আগুন লইয়া মাতৃসকাশে উপস্থিত হইলেন। পঞ্চম বর্ষীয় বালক রঘুনাথের এতাদৃশ বুদ্ধির প্রাখর্য দেখিয়া বাসুদেব সার্বভৌম নিতান্তই বিস্মিত হইয়া গেলেন।” 

কমলনয়ন বলিল, “বাহ, এত ক্ষুদ্র বালকের কী বিপুল বুদ্ধিমত্তা! তখনই আধার ও আধেয়ের প্রকৃতি সম্পর্কে এতখানি বাস্তব জ্ঞান হইয়াছে!” 

হরিরাম বলিতে লাগিল, “হাঁ, আরও হইল। তাহার কয়েকদিন পরেই একদিন প্রাতঃকালে বাসুদেব সার্বভৌম পূজায় বসিবেন। রঘুনাথকে নিকটস্থ বাগান হইতে ফুল তুলিয়া আনিতে বলিয়াছিলেন। রঘুনাথ অতি দ্রুত বাগান হইতে ফুল তুলিয়া আনিলেন। কুসুমরাশি হাতে করিয়া তুলিয়া আনিয়াছেন দেখিয়া বাসুদেব আক্ষেপ করিয়া বলিলেন, ‘দূর, নির্বোধ! হাতে করিয়া কি ফুল আনিতে আছে? তাহাতে কি আর পূজা হয়?” রঘুনাথ অমনই হাতের উপরের দিকের ফুল সাজিতে নিক্ষেপ করিয়া, নীচেকার ফুলগুলি মাটিতে ফেলিয়া দিলেন। বাসুদেব বালকের এইরূপ আচরণ বুঝিতে পারিলেন না। বলিলেন, ‘ও কী করিলি?’ রঘুনাথ উত্তর দিলেন, ‘কেন? উপরকার ফুলগুলি তো নীচেকার ফুলের উপরেই ছিল। তাই উপরের ফুলগুলি আমার স্পর্শে দূষিত হয় নাই। সেই জন্য উপরের ফুলগুলি সাজিতে রাখিয়া দিলাম। আর নিম্নের ফুলগুলি আমার হাতে লাগিয়াছিল। তাই উহাদের ফেলিয়া দিয়াছি।’ বালকের এইরূপ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাইয়া বাসুদেব তখন রঘুনাথের মা সীতাদেবীকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন এবং রঘুনাথকে তিনি লেখাপড়া শিখাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। সীতাদেবীর আর আনন্দের অবধি রহিল না।” 

কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল, “তাহা হইলে তো রঘুনাথের শিক্ষা একেবারে বর্ণপরিচয় হইতে বাসুদেব সার্বভৌমের হাতেই হইয়াছিল?” 

হরিরাম বলিল, “হাঁ। কিন্তু সেই বর্ণবোধ করাইতে গিয়াই বাসুদেব সার্বভৌমকে রঘুনাথের বিচিত্র সব প্রশ্নের মুখামুখি হইতে হইয়াছিল। বালক অতি দ্রুত অ, আ, ক, খ প্রভৃতি বর্ণসমূহ আয়ত্ত করিয়া লইয়াই প্রশ্ন করিল, গুরুদেব, ‘ক’ আগে, ‘খ’ পরে কেন? আগে ‘খ’, পরে ‘ক’ হইলে কী ক্ষতি হইত? দুইটি ‘জ’ কেন? দুইটি ‘ন’ হইল কেন? তিনটি শ’ থাকিবার কী কারণ? এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়া বাসুদেবকে ঘোষ-বর্ণ, অঘোষ বর্ণ, বর্ণসমূহের উচ্চারণ স্থান, শব্দতত্ত্ব, ব্যাকরণ, কোষশাস্ত্র সকলই এক-এক করিয়া বালকের সম্মুখে উদ্ঘাটিত করিতে হইল। বালকও অতি সহজে সেইসব উচ্চ শ্রেণীর তত্ত্ব নিজ মেধাবলে ও গুরু বাসুদেবের সরল শিক্ষাকৌশলে আয়ত্ত করিয়া লইলেন।” 

কমলনয়ন একটু হাসিয়া বলিল, “এই ধরনের ছাত্র পড়াইতে গেলে শিক্ষক সাতিশয় তৃপ্ত হন বটে, কিন্তু মধ্যে মধ্যে বিপাকেও পড়িতে হয়। রঘুনাথের প্রশ্নগুলি নিতান্ত মৌলিক ছিল, দেখিতে পাইতেছি।” 

হরিরাম সোৎসাহে বলিল, “আরে, ইহা তো বালক রঘুনাথের কথা। তখনই তাঁহার এইরূপ বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়াছে। কাজেই কল্পনা করিয়া দেখ, রঘুনাথ যখন তোমার বয়সে উপনীত হইয়া গুরুর নিকট ন্যায়শাস্ত্রের পাঠ লইতেছেন, তখন গুরু বাসুদেবকে কত-না বিপাকে পড়িতে হইয়াছিল! মধ্যে মধ্যে বাসুদেবও রঘুনাথের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিতেন না। কখনো বা উত্তর দিতেন, কিন্তু নিজের দেওয়া সেই উত্তরে নিজেই সন্তুষ্ট হইতে পারিতেন না। সময়ে সময়ে রঘুনাথ তাঁহার আচার্য বাসুদেবের দ্বারা স্থাপিত সিদ্ধান্তগুলি লইয়াও আপত্তি তুলিতেন। তখন বাসুদেবের মনে হইল, ইহার সংশয় দূর করিবার জন্য, কিংবা আমিই ঠিক বলিতেছি কি না জানিবার জন্য ইহাকে মিথিলায় প্রেরণ করা কর্তব্য। সেখানে নৈয়ায়িকশ্রেষ্ঠ পক্ষধর মিশ্র আছেন। রঘুনাথ তাঁহার নিকট যাক ও তাঁহার নিকট ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করুক। তাহা হইলেই সে বুঝিবে, আমি ঠিক সিদ্ধান্ত স্থাপন করিয়াছি কি না।’ ততদিনে বাসুদেবের টোলে রঘুনাথের শিক্ষা শেষ হইয়াছে এবং বাসুদেব তাঁহাকে ‘শিরোমণি’ উপাধিতে ভূষিতও করিয়াছেন।” 

কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল, “তখনই কি রঘুনাথ মিথিলা গমন করিয়াছিলেন? একা?” 

হরিরাম কহিল, “হাঁ। বাসুদেবের কথা শুনিয়া রঘুনাথের মনে মিথিলাগমনের গভীর আগ্রহ উদ্ভূত হয়। তবে তিনি একাকী তথায় যান নাই। কুশদ্বীপবাসী তর্কসিদ্ধান্ত একজন, নলদ্বীপবাসী সিদ্ধান্ত উপাধিধারী আর-একজন তাঁহার সহিত যাত্রা করিয়াছিলেন। সেসময় মিথিলাই ছিল নব্যন্যায় দর্শনের প্রধান কেন্দ্র এবং সারা ভারতবর্ষ হইতে বিদ্যার্থিগণ মিথিলায় পড়িতে আসিত। ফলত, মিথিলায় বসবাসকারিগণ বঙ্গদেশকে নিতান্ত তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখিতেন। বঙ্গদেশের প্রদত্ত উপাধিও মিথিলায় সম্মানিত হইত না। এইজন্য রঘুনাথের মনে কিঞ্চিৎ ক্ষোভও সঞ্চারিত হইয়াছিল।” 

কমলনয়ন চক্ষু ঈষৎ সঙ্কুচিত করিয়া সন্ধিগ্ধ স্বরে কহিল, “রঘুনাথ কি মিথিলায় শিক্ষালাভ করিতে গিয়াছিলেন, নাকি তাঁহার মনে মিথিলার দর্পচূর্ণ করিবার গোপন অভিপ্রায় ছিল?” 

হরিরাম মাথা নাড়িয়া বলিল, “তাহা তো জানি না। প্রতিভাবানের অন্তরে দুর্নিরীক্ষ বাসনা সকল কাজ করে। যাহাই হউক, দীর্ঘ পথ পার হইয়া এই তিনজন বিদ্যার্থী তো মিথিলায় উপস্থিত হইলেন। পক্ষধর মিশ্রের টোল খুঁজিয়া বাহির করিতেও বিলম্ব হইল না। তখন বেলা দ্বিপ্রহর। টোলে পঠন-পাঠন চলিতেছে। সর্বোচ্চ আসনে পক্ষধর মিশ্র গ্রন্থ রচনা ও অধ্যাপনা কর্মে নিমজ্জিত অছেন। নিম্নে বহুস্তরে বিন্যস্ত বিভিন্ন শ্রেণীর ছাত্ররা পাঠ ও আলোচনা করিতেছে। রঘুনাথ ও তাঁহার সঙ্গী অন্য দুই বিদ্যার্থী পক্ষধর-সমীপে নিজ নিজ প্রার্থনা জ্ঞাপন করিলেন। পক্ষধরের ইঙ্গিতে তাঁহাদের তিনজনের বাসস্থান জুটিল। বাসুদেব সার্বভৌমের নিকট রঘুনাথ পূর্বেই পক্ষধর মিশ্রের রীতি-নীতি জানিয়া আসিয়াছিলেন। পক্ষধর মিশ্রের টোলে গুণানুযায়ী মঞ্চ সাজানো ছিল। সর্বনিম্নশ্রেণীর ছাত্ররা সর্বনিম্ন ধাপে বসিত, ক্রমে উপরের শ্রেণীর ছাত্রদের বসিবার ও পাঠ করিবার স্থান উপরে উপরে স্থাপিত ছিল। সর্বোচ্চ মঞ্চে পক্ষধর মিশ্র বসিয়া গ্রন্থ রচনা এবং অধ্যাপনা করিতেন। এই ব্যবস্থা রঘুনাথ পূর্বেই জানিতেন। কাজেই, পরদিন প্রাতে কাহাকেও কিছু না জিজ্ঞাসা করিয়া রঘুনাথ টোলগৃহে সর্বনিম্ন স্তরে আসন গ্রহণ করিলেন। পক্ষধরের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী নিম্নতম স্তরের প্রধান বিদ্যার্থী রঘুনাথকে ন্যায়শাস্ত্রবিষয়ক দুই একটি প্রশ্ন করিয়া রঘুনাথের বিদ্যাপরীক্ষা করিতে গেলেন। কিন্তু অচিরেই বুঝিলেন, রঘুনাথ তাঁহার পক্ষে গুরুপাক। সুতরাং তিনি রঘুনাথকে উপরের স্তরে উঠিয়া বসিতে বলিলেন। সেখানেও অধিক কথার প্রয়োজন হইল না, ন্যায়শাস্ত্রের একটি কূট প্রশ্ন তুলিয়া রঘুনাথ এই স্তরের বিদ্যার্থিপ্রধানকে হারাইয়া দিলেন। তাহার উপরের শ্রেণীতেও সেই একই অবস্থা। রঘুনাথ ক্রমাগত উপরের শ্রেণী বা স্তরে উঠিয়া বসেন, আর সেই স্তরের বিদ্যার্থীদের তর্কযুদ্ধে হারাইয়া দেন। তখন বিচার-কোলাহল তুমুল হইয়া উঠিল। ছাত্রদিগের প্রধান রঘুনাথকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— 

আখণ্ডলঃ সহস্রাক্ষো বিরূপাক্ষস্ত্রিলোচনঃ 
অন্যে দ্বিলোচনাঃ সর্বে কো ভবানেকলোচনঃ? 

অর্থাৎ ইন্দ্ৰ সহস্রলোচন, শিব ত্রিলোচন, অন্যরা সবাই দুই চক্ষুযুক্ত। কে আপনি একচক্ষু কানা? রঘুনাথ বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না-হইয়া এই ব্যক্তিগত আক্রমণের উত্তর দিলেন। শ্লোকটির প্রথম পঙ্ক্তি অবিকৃত রাখিয়া দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে সামান্য পরিবর্তন করিয়া তিনি বলিলেন: 

আখণ্ডলঃ সহস্রাক্ষো বিরূপাক্ষস্ত্রিলোচনঃ। 
যুয়ং বিলোচনাঃ শাস্ত্রে, ন্যায়েহহমেকলোচনঃ।।” 

কমলনয়ন সোল্লাসে বলিয়া উঠিল, “বাঃ বাঃ! দ্বিতীয় চরণে সামান্য পরিবর্তন করিয়া রঘুনাথ তো অসাধারণ উত্তর দিয়াছিলেন। পদটির অর্থই পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। রঘুনাথ বলিতেছেন, ইন্দ্র সহস্রলোচন এবং শিব ত্রিলোচন। আর তোমরা সব শাস্ত্রে বিলোচন অর্থাৎ কিনা অন্ধ। এবং আমিই ন্যায়শাস্ত্রে ‘একলোচন’ অর্থাৎ আমিই একমাত্র চক্ষুষ্মান! বাঃ! প্রচণ্ড ক্ষুরধার উত্তর! তাহার পর? তাহার পর কী হইল?” 

হরিরাম হাসিতে হাসিতে বলিল, “এইসব বিচার-কোলাহলে পক্ষধরের গ্রন্থরচনায় ব্যাঘাত হইতে লাগিল। তিনি বিরক্ত হইয়া একচক্ষুহীন রঘুনাথের দিকে ক্ষণেক তাকাইয়া রহিলেন। তাহার পর আদেশ করিলেন, উঠিয়া আইস। আমার সহিত বিচার করো!” রঘুনাথ এইবার সর্বোচ্চ স্তরে পক্ষধর মিশ্রের মুখামুখি হইয়া বসিলেন। পক্ষধর জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কে তোমরা? কোথা হইতে আসিতেছ?” রঘুনাথ দর্পিত স্বরে বলিলেন: 

কুশদ্বীপ-নলদ্বীপ-নবদ্বীপ-নিবাসিনঃ।
তর্কসিদ্ধান্ত-সিদ্ধান্ত-শিরোমণিমনীষিণঃ।। 

আমরা একজন কুশদ্বীপবাসী তর্কসিদ্ধান্ত, অন্য একজন নলদ্বীপবাসী সিদ্ধান্ত- উপাধিধারী এবং তৃতীয় ব্যক্তি আমি নবদ্বীপবাসী শিরোমণি—পণ্ডিত! 

পক্ষধর ভাবিলেন, রঘুনাথ ভীষণ দাম্ভিক। ইহার দর্পচূর্ণ করিতে হইবে। অতঃপর পক্ষধর পূর্বপ্রসঙ্গের বিচার করিয়া রঘুনাথের সহিত তর্ক আরম্ভ করিলেন। পক্ষধর নিজ প্রধান ছাত্রের পক্ষ অবলম্বন করিয়া তর্ক করিতে লাগিলেন। আর রঘুনাথ মহাবিক্রমে পক্ষধরের বিপক্ষতা করিতেছেন। তর্কে তর্কে ন্যায়শাস্ত্রসম্মত সামান্যলক্ষণা সন্নিকর্ষের কথা উঠিল। সামান্য লক্ষণা সন্নিকর্ষের কথা তুমি জানো নিশ্চয়ই?” 

কমলনয়ন কহিল, “হাঁ, জানি। সংক্ষেপে, কোনো একটি বস্তু বা ব্যক্তিকে দেখিয়া তার সমগ্র জাতিকে প্রত্যক্ষ করাই সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষণ। ন্যায়মতে, কোনো একটি বস্তুর প্রত্যক্ষকালে বস্তুটির সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের যেমন একটি লৌকিক সন্নিকর্ষ হয়, তেমনই ওই বস্তুর সামান্যধর্মের মাধ্যমে ওই জাতীয় সকল বস্তুর সঙ্গে একটি অলৌকিক সন্নিকর্ষও হইতে পারে… যেমন, মনুষ্যত্ব মানবজাতির সামান্য ধর্ম। মনুষ্যত্ব মানবজাতির অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে বর্তমান। এখন, একজন মানুষকে লৌকিকভাবে প্রত্যক্ষ করার সময় মানবজাতির সাধারণ ধর্ম মনুষ্যত্বও অলৌকিকভাবে প্রত্যক্ষ হইয়া যায়। অর্থাৎ, সকল মানুষের সহিত আমাদের ইন্দ্রিয়ের একটি অলৌকিক সংযোগ রচিত হয়। এইজন্যই পরবর্তীকালে কোনো মানুষ দেখিলে আমাদের কখনও এরূপ সন্দেহ হয় না যে, সন্নিহিত জীবটি কি মানুষ? ন্যায়শাস্ত্রে এই বিশেষ প্রকার প্রত্যক্ষ করাকে সামান্যলক্ষণা সন্নিকর্ষ বলা হইয়া থাকে।” 

হরিরাম কহিল, “ঠিক। এখন এই সামান্যলক্ষণা লইয়াই পক্ষধর বিচার করিতেছিলেন। রঘুনাথ তীক্ষ্ণ যুক্তি সহায়ে ন্যায়শাস্ত্রসম্মত এই সামান্যলক্ষণার ধারণাকে খণ্ডন করিয়া দেন। রঘুনাথ দেখান, সামান্যলক্ষণার ধারণাটি অলীক, ভ্রান্ত!” 

কমলনয়ন বলিল, “সর্বনাশ! ইহা তো পক্ষধরের দুর্গে সাক্ষাৎ শেল নিক্ষেপ করা। পক্ষধর নিশ্চয়ই খুব বিচলিত হইয়াছিলেন?” 

হরিরাম উত্তেজিত হইয়া বলিল, “বিচলিত বলিয়া বিচলিত! রীতিমতো ক্রুদ্ধ হইয়া যাহা তাঁহার করা উচিত নহে, তাহাই তিনি করিয়া বসিলেন। অশালীন রূঢ় ভাষায় রঘুনাথকে গালাগাল দিয়া বলিয়া উঠিলেন : 

বক্ষোজ-পানকৃৎ কাণ! সংশয়ে জাগ্রতি স্ফুটম্। 
সামান্যলক্ষণা কস্মাদকস্মাদবলুপ্যতে? 

মাতৃদুগ্ধপায়ী শিশু! তাহার উপর আবার একচক্ষুহীন কানা!! সংশয় যখন স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, তখন সামান্যলক্ষণা হঠাৎ কীরূপে অবলুপ্ত হইল?” 

এই পর্যন্ত শুনিয়া কমলনয়ন দুঃখিত স্বরে বলিল, “আহা, ইহা অতি অন্যায়। যুক্তিতে হারিয়া গিয়া ‘কানা’ বলিয়া গালিবর্ষণ! ইহা পক্ষধর মিশ্রকে মানায় না।” হরিরাম কহিল, “ঠিকই তো। ইহা অতি অন্যায় হইয়াছিল। রঘুনাথও কিন্তু ছাড়িবার পাত্র নহেন। তিনিও পক্ষধরের উদ্দেশে শ্লেষ প্রয়োগ করিয়া কহিলেন : 

যোহন্ধং করোত্যক্ষিমন্তং যশ্চ বালং প্রবোধয়েৎ। 
তমেবাধ্যাপকং মন্যে তদন্যে নাম-ধারিণঃ।। 

যিনি অন্ধকে চক্ষুষ্মান করেন, যিনি বালককে বা অজ্ঞান-আচ্ছন্ন মানবকে জাগরিত করেন, তাঁকেই আমি অধ্যাপক মনে করি, অন্যরা তো কেবল অধ্যাপক-নামধারী।” কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “এই কথা বলিবার পরেও কি আর পক্ষধরের টোলে রঘুনাথের আশ্রয় মিলিয়াছিল?” 

হরিরাম উত্তর দিল, “নিশ্চয় মিলিয়াছিল। দেখ ভাই! আমাদের দেশে জ্ঞানের ঐতিহ্য বড়ো মহান। শত সহস্র বৎসর ধরিয়া গুরু-শিষ্য পরম্পাক্রমে ইহা আচরিত হইয়া আসিতেছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজারাজড়ার উত্থানপতন, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, বহিরাক্রমণ—কিছুতেই এই জ্ঞানের ঐতিহ্য মরিবার নয়। যতই আঘাত আসে, ততই ইহা আরও সুদৃঢ় হইয়া উঠে। ছাত্রের প্রতিভার সহিত শিক্ষকের প্রতিভার কখনো কখনো সংঘাত হইতে পারে, কিন্তু সেই সংঘাত ছাত্র-শিক্ষকের সুগভীর সম্পর্ককে মোটের উপর বিচলিত করিতে পারে না। কোনো ছাত্র যদি শিক্ষকের নিকট জ্ঞানপ্রার্থী হইয়া দাঁড়ায়, শিক্ষক তাহাকে ফিরাইয়া দিতে পারেন না। পক্ষধরের আশ্রমে রঘুনাথের স্থান হইল। যদিও উভয়ের ভিতর সম্বন্ধ অম্লমধুর ছিল, তথাপি উভয়ে উভয়ের প্রজ্ঞাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করিতেন। ক্রমে ক্রমে রঘুনাথ গুরু পক্ষধরের অতি প্রিয় শিষ্য হইয়া উঠিলেন। এইরূপে তিন বৎসরে রঘুনাথ অপঠিত গ্রন্থসমূহ আয়ত্ত করিয়া লইলেন, আর পঠিত গ্রন্থসমূহে যে-যে স্থলে সংশয় ছিল, সেসকল সম্পূর্ণ বুঝিয়া লইলেন। মধ্যে মধ্যে রঘুনাথের সহিত পক্ষধরের তুমুল তর্কবিতর্ক হইত। কখনও পক্ষধর নিজেকে রঘুনাথের উপরে তুলিয়া ধরিতেন, কখনো-বা রঘুনাথের নিকট সর্বসমক্ষে পরাজয় স্বীকার করিয়া রঘুনাথের অশেষ শ্রদ্ধাভাজন হইয়া উঠিতেন।” 

কমলনয়ন বলিল, “এই যে মধ্যে মধ্যে এত বিরোধ, ইহা কি কেবল দুই প্রতিভাধর ব্যক্তির সংঘাত? নাকি, ইহার ভিতর অন্য কোনো ব্যাপার ছিল?” 

“পাণ্ডিত্যাভিমানের কথা বলিতেছ? না ভাই, তাহা নহে। আসলে রঘুনাথ যেমন বঙ্গদেশকে খুব ভালোবাসিতেন, পক্ষধরও তেমনই মিথিলাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন। আর সেযুগে মিথিলার লোকের একটু উপরি গর্ববোধ তো ছিলই। যে-দেশ হইতে বিদ্যাপতির ন্যায় কবি বাহির হইয়াছেন, সে-দেশের লোক তো একটু গর্বিত হইবেই। বিশেষত, বঙ্গদেশের প্রতি মিথিলাবাসীর তাদৃশ শ্রদ্ধা ছিল না। এ কথা আমি পূর্বেই বলিয়াছি। পক্ষধর একদিন রঘুনাথকে রাগাইবার জন্য বলিলেন, বঙ্গবাসিগণ ইদানীং তর্কশাস্ত্রে পারদর্শী হইয়া উঠিতেছে ঠিকই, কিন্তু কাব্যসাহিত্যে তাহারা অত উন্নত নহে!” 

“রঘুনাথ ইহার উত্তরে কী বলিলেন?”

“রঘুনাথ বলিলেন- 

কাব্যেহপি কোমলধিয়ো বয়মেব নান্যে। 
তর্কেঽপি কর্কশধিয়ো বয়মেব নান্যে।। 
তন্ত্রেঽপি যন্ত্রিতধিয়ো বয়মেব নান্যে। 
কৃষ্ণেহপি সংযতধিয়ো বয়মেব নান্যে।। 

আমরা বাঙালিরা কাব্যে কোমলমতি অন্যরা নহে। আবার আমরা তর্কেও কর্কশবুদ্ধি—অন্যরা নহে। তন্ত্রসাধনায় আমরাই তৎপর—অন্যরা নহে। এবং কৃষ্ণে ভক্তিপরায়ণ; সেও আমরাই—অন্যরা নহে। রঘুনাথ বাঙ্গালিদের জন্য কত গর্বিত ছিলেন। তাঁহার এই উত্তরে বাঙ্গালিজীবনের শাশ্বতরূপটিই ফুটিয়া উঠিয়াছে।” 

কমলনয়ন বলিল, “সত্যই! বাঙালিদের স্বভাবই এই! তাহারা এই চুলচেরা তর্কবিচার করিতেছে, তো এই ললিত কবিতায় মাতিয়া উঠিতেছে। কখনও গোপনে নিশাকালে তন্ত্রমন্ত্রের অনুষ্ঠান করিতেছে, কালীপূজা করিতেছে, আবার অন্যদিকে কৃষ্ণভক্তিতে ভরপুর হইয়া প্রকাশ্যে সংকীর্তনে মাতিতেছে। তাহাদের শরীরের শিরায় স্নায়ুতে যেন উত্তেজনা ও অনুপ্রেরণার আগুন ফুটিতেছে!” 

হরিরাম পূর্বপ্রসঙ্গের অনুসরণ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “এইরূপে তো তিন বৎসর কাটিয়া গেল। পক্ষধর এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রিয় শিষ্য রঘুনাথকে উপাধি প্রদান করিলেন এবং দেশে ফিরিয়া টোল খুলিয়া রঘুনাথও ছাত্রদের শিক্ষা দিতে পারেন, উপাধি প্রদান করিতে পারেন—এইরূপ স্বীকৃতিপত্র লিখিয়া দিলেন। রঘুনাথ এতদিনে বহু গ্রন্থের অনুলিপি প্রস্তুত করিয়াছিলেন, সেইসব শাস্ত্রগ্রন্থ লইয়া দেশে ফিরিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। রঘুনাথ মিথিলা হইতে বহু গ্রন্থ সঙ্গে লইয়া যাইতেছেন শুনিয়া পক্ষধর কিন্তু বিচলিত হইলেন। তিনি বলিলেন, ‘রঘুনাথ। পুস্তক লইয়া যাইতে পারিবে না। ইহা মিথিলার নিয়মবিরুদ্ধ!” 

কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “সে কী! এই যে বলিলেন, পক্ষধর ততদিনে রঘুনাথকে খুবই স্নেহ করিতেন?” 

হরিরাম সামান্য বিরক্ত হইয়া বলিল, “আমি কি বলি নাই, পক্ষধরের মিথিলার প্রতি খুবই পক্ষপাত ছিল? তিনি বুঝিয়াছিলেন, একে তো রঘুনাথ ক্ষুরধার মেধাসম্পন্ন, তাহার পর যদি আবার নব্যন্যায়ের মৌলিক গ্রন্থগুলি মিথিলা হইতে লইয়া গিয়া নবদ্বীপে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন, তবে দেশ-বিদেশ হইতে সকল ছাত্র নবদ্বীপেই যাইবে, মিথিলায় আর আসিবে না। তাই তিনি এইরূপ নিষেধ করিয়াছিলেন।” 

কমলনয়ন উদ্‌গ্রীব হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তখন রঘুনাথ কী করিলেন?” 

“রঘুনাথের মনে তখন পক্ষধরের প্রতি অত্যন্ত ক্ষোভ সঞ্চারিত হইল। টোলের অন্যান্য ছাত্ররা তাঁহার নিকট হইতে সমস্ত পুস্তক কাড়িয়া লইয়াছিল। তিনি ক্রোধে ফুঁসিতেছিলেন। এই যখন মনের অবস্থা, তখন এক রাত্রে রঘুনাথ অদূরবর্তী গৃহে পক্ষধর মিশ্র ও তাঁহার পত্নীর কথোপকথন শুনিতে পান। পক্ষধরের পত্নী বলিতেছেন, ‘স্বামিন্! দেখুন, দেখুন! বাতায়নপথে কেমন সুন্দর জ্যোৎস্না ঝরিয়া পড়িতেছে!’ পক্ষধর উত্তর দিলেন, কী ছার জ্যোৎস্না দেখাইতেছ, প্রিয়ে! ইহার অপেক্ষা আমার শিষ্য রঘুনাথের প্রতিভাদীপ্তি কত স্বচ্ছ, কত অমলিন! এই জ্যোৎস্না তো রঘুনাথের প্রতিভার তুলনায় স্নান। টোলের ছাত্ররা তাহার সমস্ত পুস্তক কাড়িয়া লইয়াছে। দেখ না, সে এখন কী করে!” 

কমলনয়ন মুগ্ধ হইয়া শুনিতেছিল। হরিরাম বলিয়া চলিল, “গুরুর এই কথা শুনিয়া রঘুনাথের ক্ষোভ জল হইয়া গেল। মন শান্ত হইল। তিনি গৃহে ফিরিবার কাল আরও কয়েক মাস পিছাইয়া দিলেন। এই কয়মাসের মধ্যে মিথিলায় প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ রঘুনাথ কণ্ঠস্থ করিয়া লইলেন। তাহার পর দেশে ফিরিবার পূর্বে একদিন পক্ষধরের টোলের মধ্যে দণ্ডায়মান হইয়া সকলের উদ্দেশে সদম্ভে উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, ‘আমি দেশে ফিরিতেছি। আপনাদের সকল গ্রন্থ আমি হজম করিয়া লইয়াছি। এখন হইতে নব্যন্যায়শাস্ত্র শিক্ষার জন্য আর কেহ মিথিলায় আসিবে না, নদিয়ায় যাইবে।” 

কমলনয়ন রোমঞ্চিত কলেবরে শুনিতেছিল। বলিল, “তাহার পর?” 

“রঘুনাথ দেশে ফিরিলেন। বিদ্যাসম্পদে ধনী, কিন্তু তাঁহার অর্থাভাব যথেষ্ট। সব কথা শুনিয়া হরি ঘোষ নামক এক সমৃদ্ধিশালী গোয়ালা তাঁহার বৃহৎ গোশালার একপার্শ্বে টোল খুলিবার ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। সেইখানেই রঘুনাথ অধ্যাপনা করিতে আরম্ভ করিলেন। ক্রমে ক্রমে কনৌজ, উড়িষ্যা, বারাণসী, কাশ্মীর প্রভৃতি ভারতের নানা প্রান্ত হইতে ছাত্ররা সমাগত হইতে লাগিল। এইখানে বসিয়াই রঘুনাথ তাঁহার ‘দীধিতি’ টীকা রচনা ও প্রচার করিলেন। ছাত্রদিগের কোলাহলে টোলটি সর্বদাই মুখরিত ছিল। সাধারণ লোকে ন্যায়শাস্ত্রের সূক্ষ্ম বিচার বুঝিতে পারিত না বলিয়া রঘুনাথের টোলকে পরিহাস করিয়া বলিত ‘হরিঘোষের গোয়াল’। কিন্তু বলিলে কী হইবে? নবদ্বীপে রঘুনাথের এই টোলের খ্যাতি এমন প্রসারিত হইল যে, মিথিলায় ছাত্রাভাব দেখা দিল। মিথিলার গৌরবরবি অস্তাচলগামী হইল। নবদ্বীপ হইয়া উঠিল নব্যন্যায়শাস্ত্রের তীর্থস্বরূপ,” হরিরাম কাহিনির উপসংহার টানিয়া বলিল, “এই হইল রঘুনাথ শিরোমণির জীবনচরিত। অপরিসীম দারিদ্র্য, প্রতিবন্ধকতা ও দুর্ভাগ্যের সহিত সংগ্রাম না-করিলে কাহারও চরিত্র গঠিত হয় না। রঘুনাথের জীবন ইহারই জ্বলন্ত প্রমাণ।” 

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। বাহিরে বর্ষণও থামিয়াছে। কমলনয়ন এতক্ষণ কী যেন ঘোরের ভিতর থাকিয়া রঘুনাথ-চরিত শুনিতেছিল। সে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া রহিল। তাহার পর বলিল, “আমি আপনার নিকট সত্যই কৃতজ্ঞ। আপনার নিকট হইতে আজ আমি অনেক অনুপ্রেরণা পাইলাম!” 

হরিরাম হাসিয়া বলিল, “আমার নিকট হইতে কী আর অনুপ্রেরণা পাইবে? যাঁহার কথা বলিলাম, তিনিই তোমাকে জীবনের কঠোর সংগ্রামের পথে চলিবার প্রেরণা দান করুন। এই দেখ, তোমার সহিত এত কথা বলিতেছি, আমার বুদ্ধি কেমন আউলাইয়া গিয়াছে, দেখ! এখনও তোমার নাম, তোমার আদি নিবাস- এসব কিছুই জানা হয় নাই! তোমার নাম কী, ভাই?” 

কমলনয়ন কহিল, “আমার নাম মধুসূদন। আমি বিক্রমণিপুরের উনসিয়া গ্রাম হইতে আসিয়াছি।” 

হরিরাম অবাক হইয়া বলিল, “সে কী? কিছু বৎসর পূর্বে বিক্রমণিপুরের উনসিয়া গ্রাম হইতে আর-একটি বালকও যে আসিয়াছিল! সে শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর চরণে আশ্রয় লইবার জন্য এখানে আইসে। মহাপ্রভু তখন নবদ্বীপেই ছিলেন। আমি মধ্যে মধ্যে মহাপ্রভুর নিকট গিয়াছি, তাঁহার সংকীর্তনেও যোগ দিয়াছি। মহাপ্রভু উনসিয়া হইতে আগত বালকটিকে তাঁহার চরণে আশ্রয় দিয়াছিলেন। তাহাকে লইয়া তিনি শ্রীক্ষেত্র পুরীতে যাত্রাও করেন।” 

কমলনয়ন বিস্ময়ে শিহরিত হইয়া উঠিল। এ সে কী শুনিতেছে? তাহার পা হইতে মাথা পর্যন্ত যেন বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। ত্বরিতে জিজ্ঞাসা করিল, “কী বলিলেন? আর-একটি বালক? ঊনসিয়া হইতে? মহাপ্রভুর চরণে আশ্রয় লইতে আসিয়াছিল? আচ্ছা, বালকটির নাম আপনার মনে আছে?” 

হরিরাম একটু ভাবিয়া কহিল, “হাঁ। তাহার নাম রাজীবলোচন!” 

কমলনয়ন স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। কিছু পরে বলিল, “আচ্ছা, আজ আমি যাই। রাত্রি হইয়া গিয়াছে।” 

হরিরাম বলিল, “বেশ। তোমার সহিত কথা কহিয়া বড়োই আনন্দ পাইলাম। মধ্যে মধ্যে আমার এ দীন কুটিরে আসিও।” 

কমলনয়ন গঙ্গার ধার দিয়া গৃহে ফিরিতেছিল। নদীর উত্তাল বাতাসের ভিতর হাঁটিতে হাঁটিতে আপন মনে বিড়বিড় করিয়া বলিতেছিল, “রাজীবলোচন! রাজীবলোচন। রাজীবলোচন? কে সে? উনসিয়া হইতে একই উদ্দেশে আসিয়াছিল? তাহার উদ্দেশ্য সফল হইয়াছে। কিন্তু তাহা কেমন করিয়া হয়? আশ্চর্য! রাজীবলোচন!!” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *