ছায়াচরাচর – ১৮

আঠারো 

প্রভাতবেলায় গঙ্গাস্নানে যাইবে বলিয়া দ্বিতল হইতে নামিয়া আসিতেছে, এমন সময়ে কমলনয়ন সোপাননিম্নে কয়েকটি কণ্ঠের সম্মিলিত বার্তালাপ শুনিতে পাইল। 

কে একজন চাপাস্বরে বলিতেছে, “মঠের অন্য কোনো কাজই করে না, কেবল নিজ কক্ষে বসিয়া পুথি রচনা করে। ইহা কি সুবিচার হইল?” 

আর-একজন বলিল, “ইহাতে তাহার কী করার আছে? মঠাধ্যক্ষ যাহাকে যেরূপ দায়িত্ববণ্টন করিয়াছেন … “ 

“কিন্তু মধুসুদন ছাড়াও তো কৃতবিদ্য এখানে অন্য অনেকে ছিল। মঠাধ্যক্ষ অন্য কাহাকেও গীতাভাষ্যের টীকা করিতে বলিলেন না। কেবল মধুসুদনকেই ওই আদেশ দিলেন। ইহাই তো অন্যের মেধার প্রতি অবিচার হইল।” 

প্রথমজন বলিল, “এখন দাঁড়াও, মধুসূদন কী টীকা প্রস্তুত করে আগে দেখ। ভগবৎপাদ শঙ্করাচার্যের ভাষ্যের টীকা করিতে গিয়া নিজের মতই কতখানি-বা ঢুকাইয়া দেয়!” 

“আরে, ওই জন্যেই তো টীকার নাম দিয়াছে ‘গূঢ়ার্থদীপিকা’! অহহহহ! আচার্য শঙ্কর তাঁহার ভাষ্যে যেসকল কথা নিগূঢ় রাখিয়া গেলেন, এখন এই কলিকালে সেসব উদ্ধার করিবেন তোমাদের মধুসূদন!! কালে কালে আর কত-বা দেখিব!” 

সোপান বাহিয়া কমলনয়ন নীচে নামিয়া আসিল। সহসা তাহাকে দেখিয়া অলোচনাকারীরা অপ্রস্তুত হইয়া চুপ করিয়া গেল। 

তিনজন ব্যক্তি। সিঁড়ির নীচে জটলা করিতেছিল। সকল কথা কর্ণে প্রবেশ করিলেও কমলনয়ন যেন কিছুই শুনে নাই, এমন ভাব ধরিয়া তাহাদের পাশ দিয়া মঠ হইতে বাহির হইয়া আসিল। রৌদ্র প্রখর হইতে আরম্ভ করিয়াছে। গঙ্গার ঘাটে ভিড় জমিয়া যাইবে। 

এই এক সমস্যা ইদানীং প্রবল হইয়া উঠিতেছে। মঠে যত্রতত্র তাহাকে লইয়া কানাকানি হয়। অল্পদিন হইল সন্ন্যাস হইয়াছে। ইহারই মধ্যে সে মঠাধ্যক্ষ বিশ্বেশ্বর সরস্বতীর অতি প্রিয়ভাজন হইয়া উঠিয়াছে। তিনিও কমলনয়নকে একের পর এক রচনার আদেশ দিতেছেন। ইহা তো কমলনয়নের দোষ নয়। সে তো পূজাদি নানা কর্মে হাত লাগাইতে চাহিয়াছিল। কিন্তু বিশ্বেশ্বর জানিতে পারিয়া “এসব তোমার কর্ম নয়, ইহার জন্য অন্য লোক আছে” বলিয়া তাহাকে বারংবার নিরস্ত করিয়াছেন। অথচ, অন্যরা ভাবিতেছে কমলনয়ন কর্মবিমুখ! ভাবিতেছে, না ভাবিতে চাহিতেছে? কাহারও দোষ অন্বেষণ করিতে চাহিলে এইরূপ ভাবিবারই চেষ্টা করা হয় বটে! 

কিন্তু ইহারা তাহার দোষ অন্বেষণ করে কেন? ঈর্ষা! কমলনয়ন মেধাবী, সেই মেধাই তাহার প্রতি মঠাধ্যক্ষের স্নেহের কারণ, আর সেই মেধাকেই অন্যরা ঈর্ষা করিতেছে। কিন্তু কমলনয়নের মনে হয়, সে কি সত্যই মেধাবী? গীতাভাষ্যের কত স্থান এখনও তো তাহার নিকট স্পষ্ট হয় নাই। কত অবোধ্য রহস্যের কুহেলি তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। তাহা হইলে ইহারা তাহাকে মেধাবান মনে করে কেন? 

স্নান সারিয়া মঠে প্রত্যাবর্তন করিয়া কমলনয়ন মঠাধ্যক্ষের কক্ষে গেল। দেখিল, বিশ্বেশ্বর গবাক্ষপথে বাহিরের আকাশের দিকে তাকাইয়া আছেন। কমলনয়নের পদশব্দে বিশ্বেশ্বর সচকিত হইয়া উঠিলেন। পিছনে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু কি বলিবে?” কমলনয়ন উত্তর দিল, “বলিতেছিলাম, মঠে আছি, মঠেই প্রসাদ পাইতেছি, কিন্তু গ্রন্থরচনা ব্যতীত মঠের অন্য কোনো কর্মে ব্যাপৃত নহি। আপনি যদি আমাকে অপরাপর কোনো কর্মের দায়িত্ব দেন…” 

বিশ্বেশ্বর গম্ভীর হইয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পর সে তৃষ্ণীদ্ভাব ভঙ্গ করিয়া কহিলেন, “কাহাকে কোন্ দায়িত্ব অর্পণ করিতে হইবে, আমি তাহা বেশ জানি, মধুসূদন। উহা লইয়া তোমার ভাবিবার কোনো কারণ নাই।” 

তাঁহার গম্ভীর ভাব দেখিয়া কমলনয়ন এ বিষয়ে আর কিছু বলিবার সাহস পাইল না। ক্ষণপরে বিনীত কণ্ঠে শুধু বলিল, “আমার অপরাধ ক্ষমা করিবেন, আচার্য! আপনার কর্তব্যনির্দেশ করিবার স্পর্ধা আমার নাই।” 

বিশ্বেশ্বর মৃদু হাসিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “কখনও গর্ভিণী নারীর আচার- আচরণ-কার্য কিছু লক্ষ করিয়াছ?” 

কমলনয়ন অপ্রস্তুত বোধ করিল। ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, “অতি বাল্যবয়সে গৃহত্যাগ করিয়াছি। এ বিষয়ে বিশেষ কিছু জানি না।” 

বিশ্বেশ্বরের হাস্য বিস্তৃত হইল। বলিলেন, “তোমার জানিবার কথাও নয়। পুত্রবধূর গর্ভসঞ্চার হইলে শ্বশ্রুমাতা তাহার কর্ম কমাইয়া দেন। পাছে গর্ভস্থ শিশুর কোনো ক্ষতি হয়। প্রসবের পূর্বে গর্ভিণীর কোনো কর্মই অবশিষ্ট থাকে না। সন্তান ভূমিষ্ঠ হইলে প্রসূতি সদ্যোজাত সন্তানটিকে লইয়াই থাকে। অন্য কর্ম তখন তাহাকে দেওয়া হয় না। বুঝিলে?” 

কমলনয়ন বলিল, “বুঝিলাম।” 

বিশ্বেশ্বর প্রশ্ন করিলেন, “তোমার টীকার আর কতটা অবশিষ্ট আছে?” 

“সামান্যই। যদি এ বিষয়ে কোনো প্রয়োজনীয় উপদেশ দেন…” 

“না, নূতন কিছুই আর বলিবার নাই। যতটা লিখিয়াছ, দেখিয়াছি। ইহা এক যুগান্তকারী টীকা হইবে, ইহাতে আমার আর কোনো সংশয় নাই। জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়। আচার্য শঙ্করের ভাষ্য হইতে তুমি এক চুলও বিচ্যুত হও নাই। অথচ, ভাষ্যমধ্যে যাহা কিছু স্থানে স্থানে তর্কজালে আচ্ছন্ন ছিল, তুমি সেসকল কথা তোমার টীকায় টানিয়া বাহির করিয়া আনিয়াছ। ইহাতে কেবল দার্শনিকদিগের উপকার হইবে তাহাই নহে, মোক্ষার্থীর নিকটও এই টীকা সাধনপথের বিশেষ সহায়ক হইবে।” 

কমলনয়ন কহিল, “এসকলই আপনার কৃপায় সম্ভব হইয়াছে।” 

বিশ্বেশ্বর সহজ হইয়া প্রসঙ্গ পরিবর্তন করিলেন। বলিলেন, “ভাবিতেছি, আর একবার তীর্থে বাহির হইয়া যাইব। এইবার মঠস্থ সাধুদিগকে লইয়া যাইব, ভাবিতেছি। যদি এক মাস পরে বাহির হই, তুমি তোমার টীকা সম্পূর্ণ করিয়া আমাদিগের সহিত আসিতে পারিবে?” 

কমলনয়ন কহিল, “পারিব।” 

সেদিন আর কোনো কথা হইল না। মঠাধ্যক্ষের কক্ষ হইতে কমলনয়ন নিজ কক্ষে ফিরিয়া গেল। 

বর্ষাকাল শেষ হইয়া আসিল। মঠে তোড়জোড়—সকলেই তীর্থভ্রমণে বাহির হইবার জন্য প্রস্তুতি লইতেছে। কমলনয়নের টীকাটিও সমাপ্ত হইয়া গিয়াছে। বিশ্বেশ্বর সরস্বতী টীকাটি সঙ্গে লইতে বলিলেন। তীর্থভ্রমণকালে দেখিয়া দিবেন, যদি কোথাও সংযোজন বিয়োজনের প্রয়োজন থাকে। টীকা ছাড়াও আরও অন্য রচনার নির্দেশ দিয়াছেন। সেই কাজগুলিতেও হস্তক্ষেপ করিতে হইবে। 

ভাদ্রপদ মাসের এক শুভ প্রভাতবেলায় সকলে মঠ হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। পদব্রজে যাইতে হইবে। মধ্যে মধ্যে বিশ্রাম। প্রথমে প্রয়াগতীর্থ দর্শন করিয়া বৃন্দাবনের উদ্দেশে যাত্রা করিতে হইবে। বিশ্বেশ্বরের সান্নিধ্য ও ভগবত্তত্ত্বের আলোচনা সকলের পথশ্রম দূর করিতে লাগিল। সন্ধ্যায় কোনো চটিতে আশ্রয় মিলিত। সন্ধ্যাবন্দনা ধ্যানচিত্তন সারিয়া বিশ্বেশ্বর রাত্রি ঘন হইলে শিষ্য কমলনয়ন ও তাহার টীকা লইয়া বসিতেন। আলোচনা চলিতে লাগিল। অন্যরাও কেহ কেহ এই অলোচনায় আসিয়া যোগ দিতেন। 

দীর্ঘ দুই মাস পর সকলে বৃন্দাবনে উপস্থিত হইলেন। হেমন্তকাল। সবে প্রভাত হইতেছে। কার্তিকের কুয়াশা ভেদ করিয়া পথের দুই পার্শ্বে কী একপ্রকার লতায় থোকা থোকা লোহিত বর্ণের পুষ্প ফুটিয়া আছে। ধীরে ধীরে কবোষ্ণ রৌদ্র উঠিল। 

সকলে বাঁকেবিহারীর মন্দিরে আসিয়া উপনীত হইলেন। একটি তিরস্করণীর আড়ালে লীলাময় কৃষ্ণকিশোর বাঁশি হস্তে দাঁড়াইয়া আছেন। তিরস্করণী একবার চকিতে সরিয়া যায়। অলক্ষ্যের আভাস স্পষ্ট হইয়া উঠে। পরমুহূর্তেই পর্দা সব ঢাকিয়া দেয়। এই আচম্বিত দর্শন ভক্তপ্রাণে প্রবল ব্যাকুলতার সঞ্চার করে। 

মথুরা ও বৃন্দাবনে কৃষ্ণলীলার উল্লেখনীয় স্থানগুলি এক-এক করিয়া দেখা হইল। নিধুবনে রাধাকৃষ্ণের নিত্যবিহার কমলনয়নকে আবিষ্ট করিল। ইহার পর বর্ষাণা শ্রীমতীর নিজ গ্রাম। দেখিতে দেখিতে কমলনয়নের মন যেন সেই ফেলিয়া-আসা কিশোরবেলার স্মৃতিসমীপে ফিরিয়া যাইতেছে। কূটতর্ক বিস্বাদ বোধ হইতেছে। কী একটি সুগভীর প্রেমের আবেশ প্রাণে হিল্লোল বহিয়া আনিতেছে। 

একদিন রাত্রে বিশ্বেশ্বর সরস্বতী সহ তাহারা কয়েকজন যমুনাতীরে গিয়াছিল। শীর্ণতোয়া যমুনা একাকিনী বান্ধবীর মতো বহিয়া যাইতেছে। বালুচরের উপর ফিনিক ফোটা জ্যোৎস্না আসিয়া পড়িয়াছে। নদীর বাতাসে তীরস্থ তরুবীথিকার পত্ররাজি মৃদু শব্দে মর্মরিত হইতেছে। জনহীন বালুকাবেলা বুঝি-বা কোনো বিরহতাপে জর্জরিতা নারীর কপোল; তাহার উপর দিয়া শীর্ণা যমুনা রুপালি অশ্রুলেখা হইয়া বহমানা। 

ঊর্ধ্বে চন্দ্রালোকিত নীলাকাশ ময়ূরীর চক্ষের মণির ন্যায় দীপ্তি পাইতেছে। অনন্তের ওই নীল রং নিকটে গিয়া দেখিলে বর্ণহীন দেখাইবে। তবু সুদূর হইতে দেখিলে এ আকাশ যেন আজ সুগম্ভীর প্রেমের সমুজ্জ্বল নীলমণি! 

এই সেই বিজন নদীতীর; এইখানে মধ্যরাত্রে বাঁশির সুর বাজিয়া উঠিত। কে এক কিশোর প্রণয়ী বাঁশির রন্ধ্রে রন্ধ্রে অঙ্গুলি বুলাইয়া সুরের মায়াজাল বিস্তার করিত। আর সেই সুরে কে এক প্রণয়পিপাসার্ত নারীর হৃদয় আকুল হইয়া উঠিত। গোপনে, নির্জনে কোনো এক ছায়াদ্রব তরুতলে তাহারা আসিয়া মিলিত। কিশোর কিশোরীকে বাঁশি শিখাইত। 

আজও সেই বাঁশি নাকি বাজে। মথুরা চলিয়া যাইবার পূর্বে কৃষ্ণ সে-বাঁশি যমুনায় ফেলিয়া দিয়াছিলেন। জলের অতল হইতে মধ্যনিশীথে সেই বাঁশি আজও কাদিয়া উঠে। যাহাদের কান আছে, তাহারা ঠিকই শুনিতে পায়। চিরবুভুক্ষু প্রেমেশ্বরের বংশীধ্বনি প্রেমার্ত ভক্তের হৃদয় আকর্ষণ করিয়া ফিরিতেছে। জ্যোৎস্নাজলে ভিজিয়া যাইতে যাইতে কমলনয়নের মনে হইল, এসব বিতর্ক-বিচার সব মিথ্যা। এই প্রেমই হৃদয়কে ধারণ করিয়া রাখিয়ছে। তাহার আরও মনে হইল, সে নিজে এক মুগ্ধা কিশোরী। কিশোর প্রেমিকের আকর্ষণে কুল-মান-ত্যজিয়া গৃহের বাহিরে চলিয়া আসিয়াছে। আর কখনও ফিরিবে না। 

ওই তো কদম্বতলে কে যেন দাঁড়াইয়া আছে। চিনিতে পারিতেছ না? ওই তো শ্যাম! কেমন ছল করিয়া দাঁড়াইয়া আছে দেখ! যেন আমাকে দেখিয়াও দেখিতে পাইতেছে না। ওই সে তাহার বাঁশিতে ফুঁ দিল। চরাচর সুরের অভিঘাতে দুলিয়া উঠিতেছে, শুনিতেছ? সে আমাকে ডাকিতেছে! আমি যাইব। আমি যাইব যে! আর কোনো বাধা মানিব না! এতদিন আমি তার ছিলাম, আজ হইতে সে আমার হইবে। তাহার পর যুগল সম্মিলনে ন সো রমণ, ন হম রমণী…. 

বিশ্বেশ্বর সরস্বতী দেখিলেন, কমলনয়ন মুগ্ধা হরিণীর ন্যায় বালুচরের উপর হাঁটু মুড়িয়া আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া বসিয়া আছে। তাহার তদ্‌গত ভাব তাঁহাকে অভিভূত করিল। নিকটে আসিয়া কমলনয়নের গ্রীবা স্পর্শ করিলেন। কমলনয়ন চমকিত হইয়া তাঁহার দিকে তাকাইল। উন্মনা দৃষ্টি, নয়নপল্লবে যেন এক মুহূর্তে ভাবতন্ময়তার বিশ্ব হইতে সহসা স্খলিত হইয়া পড়ার আবেগ… 

বিশ্বেশ্বর বলিলেন, “মধুসূদন! এইখানেই তুমি কিছুদিন অবস্থান করো। আমরা অন্যান্য তীর্থদর্শন করিয়া ফিরিবার পথে তোমাকে লইয়া যাইব।” 

কমলনয়ন হৃষ্ট হইয়া ঘাড় নাড়িল। ইহাপেক্ষা সৌভাগ্যের আর কী আছে?

বিশ্বেশ্বর জিজ্ঞাসা করিলেন, “গূঢ়ার্থদীপিকা টীকাটি রাখিয়া যাইব কি?”

কমলনয়ন আতঙ্কিত স্বরে বলিল, “না, না। গ্রন্থের কোনো প্রয়োজন এখন নাই।” 

বিশ্বেশ্বর হাসিলেন। যেন এই মুহূর্তেরই অপেক্ষা করিতেছিলেন। কমলনয়নের শিরোদেশে হাত রাখিয়া বলিলেন, “গর্ভ পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। এখন সুপ্রসব হউক।” 

পরদিন কমলনয়নকে বৃন্দাবনে রাখিয়া তাঁহারা চলিয়া গেলেন। যমুনাতীরে একটি ছায়াঘন তমালবৃক্ষের নিম্নে কমলনয়ন তাহার আসন পাতিল। এখন হইতে এইখানেই অবস্থান করিবে। 

সামান্য দূরেই ছোটো গ্রাম। সূর্য খর হইবার পূর্বেই কমলনয়ন এই ক্ষুদ্র গ্রামগুলির কোনো একটার তিন কিংবা পাঁচ বাড়ি ভিক্ষা মাঙিয়া আনে। সমস্ত দিন তমাল তরুমূলে ধ্যানচিন্তনে কাটিয়া যায়। নিকটে কেহ নাই। 

দ্বিপ্রহর হইলে যমুনায় স্নান সারিয়া আসিয়া ভিক্ষাহার করে। যমুনার চর বিরহতপ্ত প্রেমিকের আর্তির ন্যায় ধু-ধু করিতে থাকে। কী এক আবেশ আসিয়া হৃদয় অধিকার করিয়া লয়। মনে হয়, সব আছে, শুধু যাহাকে কেন্দ্র করিয়া আনন্দের হাট বসিয়াছিল, সেই-ই নাই। তাহাকেই দেখিতে পাইতেছি না। সেই সে, তাহার কৈশোরকালের প্রেমের মূর্তি—-তপ্তকাঞ্চন গোরা—সে যে কোথায় হারাইয়া গেল! 

বিরহের সেই জ্বর ধীরে ধীরে কঠোর তপস্যার রূপ পরিগ্রহ করিতেছে। সময়ে সময়ে গণ্ডদেশ প্রেমাশ্রুধারায় ভিজিয়া যায়। কখনও এই ভাবাবেগকে সে প্রবল নিগ্রহ করে। মনে মনে বলে, আমি না বেদান্তী? এসব কাঁদাকাটা আমার বিহিত নয়। আমি তো সেই পরমপ্রেমাস্পদে লীন হইব। তিনি যে সৎস্বরূপ, চিৎস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ। কোনো কোনো অপরাহুবেলায় বনের পাখি আসিয়া তাহার মস্তকে বসে। গভীর ধ্যানে নিমগ্ন কমলনয়নের দেহে যেন কোনো সাড় নাই। সমস্ত মন তন্ময় হইয়া গিয়াছে। 

একদা মধ্যদিনে ভিক্ষাহার সমাপ্ত করিয়া কমলনয়ন ধ্যানাসনে বসিয়া আছে, নদীর উপর দিয়া জলচর একটি পক্ষী উড়িয়া পরপারে যাইতেছে, এমন সময়ে দেখিল পুরোভাগে ও পশ্চাতে রক্ষীপরিবৃত একটি তাঞ্জাম আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল। রক্ষীদিগের বুকে ও পিঠে লোহার সাঁজেয়া, মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ, কটিতে তরবারি, আপাদমস্তক কৃষ্ণবেশবাসে আবৃত। পালকির দুই পার্শ্বে রাজপুত রমনীর দল চোলি, ঘাঘুরি ও দোপাট্টায় আবৃত 

জনৈক ব্যক্তি প্রথমে কমলনয়নের সম্মুখে আসিয়া হাঁটু মুড়িয়া বসিল। সে-ব্যক্তি সম্পন্ন রইস মুসলমান। ঊর্ধ্বাঙ্গে চোগা, পরনে পাইজামা। কটিদেশে মাণিক্যখচিত পটকার বন্ধন এবং মস্তকে একটি বাসন্তী রঙের পাগড়ি। পদদ্বয় নাগরা জুতায় আবৃত। কর্ণে, মণিবন্ধে, কণ্ঠে আভূষণ। 

সম্মুখে সামান্য অবনত হইয়া দক্ষিণ করপুট আচমনের ভঙ্গিতে ওষ্ঠাধরে স্পর্শ করিয়া সে কমলনয়নের উদ্দেশে কদমবুসি অভিবাদন করিয়া বলিল, “আসসালাইমালেকুম, মহাত্মন! সারে হিন্দুস্তানের বাদশা মালিক উল মুলক মহামতি আকবরের বেগম মালেকা-ই-হিন্দুস্তান মরিয়ম্ উজ জামানি আপনার দর্শনপ্রার্থিনী!” 

কমলনয়ন বুঝিল, ইহারা মুঘল। কিন্তু তাহার সহিত কী কথা? কী জ্বালা! দ্বিপ্রহরে কোথায় ধ্যানচিন্তনে ডুবিয়া থাকিবে, ইহার মধ্যে এই বিপদ! যাহাই হউক, মুহূর্তের অপ্রতিভতা কাটাইয়া কমলনয়ন বলিল, “আমার সঙ্গে তাঁহার কী প্রয়োজন? আমি তো অনিকেত সন্ন্যাসী!” 

সে-ব্যক্তি উত্তর দিল, “মালেকা-ই-হিন্দুস্তান যমুনায় স্নান করিতে আসিয়াছিলেন। আপনাকে নদীতীরে দেখিয়া তাঞ্জাম থামাইতে বলিলেন। তাঁহার কথা তিনি স্বয়ং আপনাকে বলিবেন।”

কমলনয়ন ভাবিতে লাগিল। আকবরের মহিষী তো ধর্মবিশ্বাসে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হইবার কথা। তাহা হইলে যমনায় স্নান করিতে আসিবার প্রয়োজন পড়িল কেন? 

যেন কমলনয়নের মনোগত সংশয় ধরিতে পারিয়া আগন্তুক ব্যক্তি বিস্তার করিয়া বলিল, “ইনি বাদশার তৃতীয়া স্ত্রী। রাজপুত রমণী। বিবাহের পূর্বে অম্বরের রাজপুত্রী ছিলেন। ভারমলের কন্যা। ইঁহার প্রকৃত নাম মানাবাই বা হরখাবাই। বিবাহের পরেও সম্রাট ইহার ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করেন নাই। ইনি ধর্মান্তরিতও হন নাই। ফতেপুর সিক্রিতে শাবিস্তান-ই-ইকবাল অর্থাৎ জেনানার ভিতর সম্রাট ইঁহার জন্য একটি সূর্যমন্দির নির্মাণ করিয়া দিয়াছেন।” 

কমলনয়ন বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেল। সম্রাট আকবরের কী মহানুভবতা! রাজপুতদিগকে বিনা যুদ্ধে নিজ শাসনাধীন করিবার জন্য বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করিয়াছেন বটে, কিন্তু বিবাহিত পত্নীর ধর্মবিশ্বাসে কোনো পরিবর্তন বা আঘাত দেন নাই। 

কিন্তু সে-বিস্ময়ের ঘোর কাটিতে-না-কাটিতে তাঞ্জাম হইতে এক পরমাসুন্দরী সৌম্যা মাতৃমূর্তি নামিয়া আসিলেন। রাজপুত রমণীদিগের অনুরূপ বেশবাস চোলি, ঘাঘুরি, ওড়নি পরিহিতা; পায়ে শুঁড় তুলা নাগরা জুতা। বিশেষ এই, গাত্রে বহুবিধ অলংকার এবং ওড়না দ্বারা মুখ ও কপাল এইরূপে আবৃত যে, গণ্ডদেশের লজ্জারুণ আভাটুকু ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। হাঁটিয়া আসিবার ভঙ্গিমায় এমন একটা আভিজাত্য যে, তাহা তাঁহাকে অন্য রমণীদের হইতে পৃথক করিয়াছে। 

নারী কমলনয়নের সম্মুখে নতজানু হইয়া বালির উপর বসিয়া পড়িলেন। রক্ষী তৎক্ষণাৎ উঠিয়া গিয়া তাঞ্জাম হইতে মূল্যবান আসন আনিয়া তাঁহার পদতলে বিছাইয়া দিতে গেল, কিন্তু তাঁহার ইঙ্গিতে সভয়ে সরিয়া গেল। তিনি কৃতাঞ্জলিপুটে কমলনয়নের উদ্দেশে মধুক্ষরা কণ্ঠস্বরে অতি সুললিত ঠেট হিন্দিতে বলিলেন, “দাসীর নাম মানাবাই। যমুনায় স্নান সারিতে আসিয়াছিলাম। কয়েক বৎসর যাবৎ শূলবেদনায় বড়ো কষ্ট পাইতেছি। একদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখিলাম, যমুনাতীরে তমালতরুতলে কে একজন সন্ন্যাসী বসিয়া আছেন। মনের ভিতর হইতে সুস্পষ্ট নির্দেশ আসিল, এই সাধুর আশীর্বাদেই আমি সুস্থ হইব। আজ যমুনায় স্নান সারিয়া ফিরিবার সময়ে আপনাকে দেখিতে পাইলাম… ঠিক আমার স্বপ্নের অনুরূপ… সব মিলিয়া যাইতেছে।” হা কৃষ্ণ! আজ এ কী পরীক্ষায় ফেলিলে! কমলনয়ন মনে মনে ভাবিতেছিল, এ তোমার কী অচিন্তনীয় লীলা প্রভু! 

“কতদিন এই পীড়া হইতেছে?”

“আমার পুত্রজন্মের পর হইতেই।”

“পুত্রের কী নাম রাখিয়াছেন?”

“সেলিম!” 

“আর কি কোনো সমস্যা হয়?”

“না। কেবল উদরে অসহ্য পীড়া!” 

কমলনয়ন গভীরভাবে ভাবিতে লাগিল। সে কেমন পুত্র, যে জন্মিয়াই জননীর শূলবেদনার কারণ হইয়াছে? ভাবিতে ভাবিতে মনে হইল, পৃথিবীর সমস্ত পাপ, রিরংসা, ক্রোধ ও পরিতাপের বাষ্প যেন বালুচরের উপর ধিকিধিকি জ্বলিতেছে। আর এই ধরিত্রীই যেন ইহাদের প্রসূতি, অসহ্য বেদনায় তাঁহার উদর কম্পিত হইতেছে। এত পাপ তিনি কেমন করিয়া সহ্য করেন? 

চক্ষু উম্মীলন করিয়া কমলনয়ন কহিল, “মা! ঈশ্বরেচ্ছায় আপনার শূলবেদনা আরাম হইয়া যাক!”

কী আশ্চর্য! এই কথা বলিবামাত্র মরিয়ম্-উজ-জামানি সদ্য সদ্য সুস্থবোধ করিতে লাগিলেন। কিছু পরে তিনি বলিলেন, “ঈশ্বর পরমকরুণাময়!” এই বলিয়া কমলনয়নের চরণে আনত অভিবাদন জানাইয়া তাঞ্জামে গিয়া উঠিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঞ্জাম পরিচারিকাবৃন্দ ও সৈনিকবর্গসহ দৃষ্টিসীমার অন্তরালে চলিয়া গেল। 

কয়েকদিন পর সেই রক্ষী কিন্তু আবার আসিল। এবার একাকী অশ্বপৃষ্ঠে আসিয়াছে। অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া কমলনয়নের প্রতি কদমবুসি করিয়া বলিয়া উঠিল, “আল্লাহ্ মেহেরবান! আপনার আশীর্বাদে মালেকা-ই-হিন্দুস্তান সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হইয়া গিয়াছেন।” 

কমলনয়ন শুধু বলিল, “আনন্দের কথা।” 

রক্ষী বলিল, “আপনি আমাদিগের সহিত দিল্লি চলুন। সম্রাট আপনাকে দেখিয়া বড়ো প্রীত হইবেন।” 

“না, তাহার কোনো প্রয়োজন দেখি না। আমি এখানে আনন্দে নিমগ্ন হইয়া আছি।” 

“মহাত্মন! আপনার নাম কী?” 

“কেন? আমার নাম জানিবার প্রয়োজন হইল কেন?’ ‘ 

“মালেকা-ই-হিন্দুস্তানের রোগ উপশম হইবার সঙ্গে সঙ্গে আপনার সহিত মুঘল সাম্রাজ্যের চির-আত্মীয়তার সম্পর্ক সূচিত হইয়াছে। তাই আপনার নাম জানিতে চাহিয়াছি।” 

“আমার নাম মধুসূদন সরস্বতী।” 

রক্ষী অশ্বপৃষ্ঠ হইতে কতকগুলি থলি নামাইয়া আনিল। বলিল, “মালেকা-ই- হিন্দুস্তান আপনার চরণে এই রত্নসম্ভার নিবেদন করিয়াছেন।” 

“উহাতে আমার কোনোই প্রয়োজন নাই। আমি সন্ন্যাসী। ওইগুলি আমার নিকট মাটির ঢেলার ন্যায় মূল্যহীন। ওইগুলি তুমি শীঘ্র লইয়া যাও।” 

“ফিরাইয়া লইয়া গেলে আমার গর্দান যাইবে। বেগমসাহেবা বলিয়া পাঠাইয়াছেন, আপনার আর কোন্ সেবায় আমরা লাগিতে পারি?” 

“নাহ, বর্তমানে আমার কোনো প্রয়োজন নাই। তুমি এক্ষণে আসিতে পারো।”

রক্ষী নিতান্ত ক্ষিন্ন মনে বালির উপর মোহর ও রত্নসম্ভারে পরিপূর্ণ থলিগুলি রাখিয়া অশ্বপৃষ্ঠে উঠিয়া বসিল। 

বালুকাবেলায় রত্নসম্ভার তেমনই পড়িয়া রহিল। কমলনয়ন উহাদের দিকে ফিরিয়াও তাকাইল না। কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া চক্ষুনিমীলনপূর্বক গভীর ধ্যানে ডুবিয়া গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *