ছায়াচরাচর – ৪

চার 

কিশোর পদ্মাক্ষ পথশ্রমে ক্লান্ত হইয়াছিল, তাহার পশ্চাতে হৈমবতী একটি পুঁটুলি বক্ষে জড়াইয়া ধীরে ধীরে আসিতেছিল। পুষ্পপুরের বহিঃসীমা পার হইয়া অনেক দুরে আসিয়াছে, এমন সময়ে নদীর ধারে ঝোপের আড়াল হইতে কাহার একটি ডাক শুনিয়া হৈমবতী পিছন ফিরিয়া চাহিল। আর কোনো শব্দ হইল না। তাহারা চলিতে আরম্ভ করিল। তখন ঝোপের দিক হইতে একটা ঢিল আসিয়া পায়ের কাছে পড়িল। হৈম ভয় পাইয়া আরও দ্রুতবেগে পদ্মাক্ষর অনুসরণ করিতে লাগিল। 

তখন যদি সে জানিত, গলার আওয়াজ আর ঢিল কোথা হইতে আসিতেছে! যাহাই হউক, চরবান্ধিয়া গ্রামে উপনীত হইয়া পদ্মাক্ষ দেখিল, এখানে ব্যাপার অন্যরূপ। পাঠান এ গ্রাম স্পর্শ করে নাই। তাহারা পুষ্পপুর ধ্বংস করিয়া নদীতীর দিয়া একেবারে চন্দ্রদ্বীপ চলিয়া গিয়াছে। উভয়েই পথশ্রান্ত, এক্ষণে প্রকৃতির কৃপাস্নিগ্ধ বর্ধিষ্ণু গ্রাম চরবান্ধিয়ায় পৌঁছাইয়া দুইজনে কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইল। 

এক গৃহস্থের বাটীতে হৈমবতীর আশ্রয় মিলিল, পদ্মাক্ষ গ্রামের অতিথিশালা আশ্রয় করিল। সময়-সুযোগ মতো পদ্মাক্ষ গ্রামের প্রবীণসভায় হৈমবতীর কথা নিবেদন করিল। কিশোরী হৈমবতী নিরাশ্রয়া, তাহার পিতামাতা আত্মীয়স্বজন তাহাকে ফেলিয়া গিয়াছে, গ্রাম পাঠানসৈন্যের হস্তে লুণ্ঠিত হইয়াছে, এখন কী করা কর্তব্য, ইত্যাদি। 

এক বয়োবৃদ্ধ বলিলেন, “প্রথমেই তাহাদের গ্রামে সংবাদ লওয়া কর্তব্য। লোকজন ফিরিয়া আসিয়াছে কি না। হৈমবতীর পিতা-মাতার কোনো সংবাদ পাওয়া যায় কি না।” 

পরদিন পুষ্পপুরে লোক প্রেরিত হইল। বহু সন্ধান করিয়া হৈমবতীর পিতা- মাতার সংবাদ পাওয়া গেল। পাঠানের আক্রমণে পর্যুদস্ত হইয়া সকলে আরও ভিতরের দিকের গ্রামে এতদিন আত্মগোপন করিয়াছিলেন। 

কয়েকদিন পর হৈমবতীর পিতা আরও কয়েকজন লোক লইয়া চরবান্ধিয়ায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পিতা-পুত্রীর সম্মিলন হইল। হৈমবতী কাঁদিতে কাঁদিতে তাহার সকল কথা পিতাকে নিবেদন করিল। 

চরবান্ধিয়া গ্রামে গ্রামপ্রধানদের সভা বসিল। জনৈক ব্যক্তি হৈমবতীর পিতার উদ্দেশে বলিলেন, “কন্যাটিকে ভাগ্যবলে ফিরিয়া পাইয়াছেন। এক্ষণে উহাকে স্বগৃহে লইয়া যান।” 

হৈমবতীর পিতা ধীরে ধীরে অতি দুঃখিত স্বরে কহিল, “আমার প্রাণ তো তাহাই চায়। কিন্তু একটি ঘোরতর সামাজিক সমস্যা উপস্থিত।” 

গ্রামবৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী সমস্যা?” 

হৈমবতীর পিতা বলিলেন, “আমরা সকলে গ্রাম ছাড়িয়া পলাইয়াছিলাম। হৈম তখন নদীর ঘাটে গিয়াছিল। ফিরিবার পথে গ্রাম জ্বলিতেছে, সে দেখিতে পায়। ভয়ে কম্পিত হইয়া হৈম তখনই গ্রামে প্রবেশ করে নাই। সমস্ত রাত্রি ইক্ষুবনে যাপন করিয়াছে। পরদিন গৃহে ফিরিয়া আসে।” 

জনৈক যুবক উত্তেজিত হইয়া প্রশ্ন করিল, “অহাতে কী হইল?” 

হৈমবতীর পিতা বলিলেন, “হৈম বলিতেছে, সে ইক্ষুবনে রাত্রি অতিবাহন করিয়াছে, পাঠানের সংস্পর্শে আসে নাই। আমি তাহাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু তাহার এই কথা আমি ছাড়া গ্রামের অন্য কেহ বিশ্বাস করিবে না। সকলেই সন্দেহ করিবে, সে পাঠানের দ্বারা গৃহীত হইয়াছিল কি না। তাহার নামে কলঙ্ক রটিবে। আমি তাহার বিবাহও দিতে পারিব না। এমতাবস্থায় আপনারা যদি সকলে উদ্যোগী হইয়া আমার কন্যাটিকে এ গ্রামের কোনো সদ্বংশজাত পুরুষের হস্তে অর্পণ করেন, তবে আমি বাঁচিয়া যাই।” 

আর-এক বৃদ্ধ বলিলেন, “আপনার এই কথা শুনিবার পর এ গ্রামের কে আর আপনার কন্যাকে বিবাহ করিতে সম্মত হইবে?” 

হৈমবতীর পিতা বলিলেন, “তাহা হইলে আমার সম্মুখে আর-একটি মাত্র পথ অবশিষ্ট থাকে। কন্যাটির হাত ধরিয়া আমি দেশান্তরী হইব। তাহার পর বাঁচিব কি মরিব, নারায়ণই জানেন!” কথাটা বলিতে বলিতে হৈমবতীর পিতা করূণ স্বরে অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। 

আর-এক বয়স্ক গ্রামবাসী অতি কঠিন স্বরে বলিলেন, “দেশান্তরী হইয়াই কি বাঁচিবে, ভাবিয়াছ? এ মেয়ের কুৎসা যেভাবেই হউক ছড়াইয়া পড়িবে। যেখানেই যাও, কুৎসা তোমাদিগকে অনুসরণ করিবে।” 

কোনো সুষ্ঠু সমাধান হইল না। সভা মুলতুবি হইয়া গেল। 

এতক্ষণ সভামধ্যে একপার্শ্বে বসিয়া কিশোর পদ্মাক্ষ সকল কথাই শুনিতেছিল। সেও চিন্তিত মনে অতিথিশালায় ফিরিয়া আসিল। 

সে-রাত্রে পদ্মাক্ষর কিছুতেই ঘুম আসিতেছিল না। সে নানারকম ভাবিতেছিল। কী করিয়া হৈমবতীকে সুপাত্রস্থ করা যায়। উহা ছাড়া হৈমবতীর বাঁচিবার আর অন্য উপায় নাই। আচ্ছা, চন্দ্রদ্বীপের বর্তমান কী অবস্থা? রাজার নিকট সমস্ত সমস্যাটি নিবেদন করিলে কিছু-না-কিছু উপায় হইত। কিন্তু পাঠান আক্রমণে সে-রাজ্য আছে, কি গেছে, তাহাই তো নিশ্চিত নহে। রাজা কন্দর্পনারায়ণ কি সুস্থ দেহে বাঁচিয়া আছেন? 

বহু চিন্তা করিয়াও কোনো উপায় মিলিতেছিল না। তাহার পর শেষরাত্রের দিকে সহসা হৈমবতীর সমস্যার এক আশ্চর্য সমাধান হইল। হৈমবতীর উপযুক্ত পাত্র পদ্মাক্ষ এইমাত্র খুঁজিয়া পাইল। কেন সে এতক্ষণ ইহা বুঝিতে পারে নাই? সমস্যার সমাধান বাহির হওয়ামাত্রই পদ্মাক্ষ পরম স্বস্তিতে অতিথিশালার শয্যায় নিশ্চিন্তে ঘুমাইয়া পড়িল। 

পরদিন পদ্মাক্ষ হৈমবতীর পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া নিবেদন করিল, সে হৈমবতীকে বিবাহ করিতে ইচ্ছুক। এমন অভাবিত প্রস্তাবে বৃদ্ধ যেন হাতে চাঁদ পাইয়া হাসিয়া কাঁদিয়া আকুল হইল। একে তো তাহার কন্যার সমস্যা যে এইরূপে সমাধান হইবে, ইহা বৃদ্ধ স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই, তদুপরি পদ্মাক্ষ সদ্বংশজাত কুলীন ব্রাহ্মণ—সে নিজে আসিয়া কন্যাটির পাণিপ্রার্থনা করিয়াছে। 

উনসিয়া গ্রামে এই সংবাদ লোকমুখে প্রেরিত হইল। কয়েক দিবসের মধ্যেই পদ্মাক্ষর পিতা, পিতৃব্য, অন্যান্য কুটুম্বসকল চরবান্ধিয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সকল কথা শুনিয়া ও সর্বসুলক্ষণা কন্যাটিকে দর্শন করিয়া তাঁহারা কেহ পদ্মাক্ষর ইচ্ছার বিরোধিতা করিলেন না। 

তথাপি হৈমবতীর পিতা একবার তাঁহার কন্যাকে সকল কথা জানাইলেন। হৈম কিছু কহিল না। কেবল লজ্জারুণ মুখে পিতার সম্মুখ হইতে উঠিয়া গেল। তাহার প্রীতিস্নিগ্ধ মুখশ্রী অবলোকন করিয়া পিতার বুঝিতে বিলম্ব হইল না, সে ইহাতে সম্মত আছে। 

চরবান্ধিয়ার এক সম্পন্ন গৃহস্থের বাটিকায় এক গোধূলি লগ্নে বিবাহ অনুষ্ঠিত হইল। বিবাহ ও আনুষাঙ্গিক স্ত্রী-আচার সমাপ্ত হইলে বর-বধূকে বাসরকক্ষে লইয়া যাওয়া হইল। সেখানে শ্রীমান পদ্মাক্ষ ও তাহার নবপরিণীতা কান্তা শ্রীমতী হৈমবতী পল্লীর অন্যান্য যুবতী রমণীদিগের দ্বারা পরিবৃত হইয়া কড়ি খেলিতে বসিল। 

বাসরে হৈমর লজ্জা ভাঙানো গেল না, কলহাস্যমুখরিতা যুবতী কন্যাদিগের অনুরোধে পদ্মাক্ষকে গান গাহিতে হইল। তাহার পর আর-এক বিপত্তি! কী করিয়া যেন সকলে জানিয়া ফেলিয়াছিল, পদ্মাক্ষ রাজসভার সভাকবি, কে একটি প্রভা রমণী পদ্মাক্ষর কানের কাছে মুখ আনিয়া কহিল, “জামাইঠাকুর, তুমি নাকি কবিতা লিখিয়া থাক? তা কেমন সে-কবিতা, একবার শুনি… 

পদ্মাক্ষ কী আর করে? সে তাহার সদ্যোরচিত একটি পদ সুর করিয়া গাহিল। পদটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি দুর্গাবন্দনা। পদ্মাক্ষর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর ও সংস্কৃত ভাষার লালিত্যময় ঝঙ্কার সকলের কানে ভালো লাগিল বটে, কিন্তু উহার অর্থ যে কী, গ্রাম্য রমণীগণ কেহ কিছুই বুঝিল না। কিছু বুঝিতে না পারিয়া এ উহার গা ঠেলিয়া হাসিতে হাসিতে সকলে গড়াইয়া পড়িল। ইহাতে পদ্মাক্ষর মুখমণ্ডল লজ্জায় একেবারে আরক্তিম হইয়া উঠিল। 

হাস্যবেগ কিঞ্চিৎ প্রশমিত হইলে এক সুদর্শনা যুবতী ঠানদি স্থানীয়া এক বৃদ্ধাকে ধবিয়া বসিল, “ঠানদি, আমাদিগের জামাইঠাকুর তো পণ্ডিত মানুষ। তুমি কত ছড়া- কবিতা জানো। জামাইকে তোমার দুই-একটা রসের নমুনা শুনাইয়া দাও তো, দেখি।” 

ঠানদি বয়স্কা হইলেও রসিকা। যৌবন তাহার শরীরে শেষ ক-টি চিহ্ন রাখিয়া চলিয়া গিয়াছে। বৃদ্ধা বিবাহ উপলক্ষ্যে অঙ্গে একটি সূক্ষ্ম কারুকার্যমণ্ডিত শাটিকা ও হার, মাকড়ি, কেয়ুর প্রভৃতি নানাবিধ অলংকার পরিয়াছেন। হাসিতে হাসিতে রসিকা বৃদ্ধা ঠানদি পদ্মাক্ষর গালে হাত বুলাইয়া চিবুকে আদর করিয়া কহিলেন, “ভাই, আমরা হইলাম গ্রামের মুক্‌খু মেয়েমানুষ! আমরা কি আর তোমার ওই সংস্কৃত অংবংচং বুঝিতে পারি। আমাদিগের হইল রসের ছড়া। মনে কিছু করিও না। একটি শোলোক শুন—” এই বলিয়া ঠানদি হাত-পা নাড়িয়া শুরু করিল : 

“বসন্তে নাগর-বর নাগরী বিলাসে, 
বরবালা দুই ইন্দু, স্রবে যেন সুধা বিন্দু 
মৃদুমন্দ অধরে ললিত মধু হাসে,
প্রফুল্লিত বনস্পতি, কুটিল তমাল দ্রুম 
ঝংকৃত মধু ব্রত কুঞ্জে রত রাসে, 
বসন্তে নাগর-বর নাগরী বিলাসে।” 

এইবার পর্যাপ্ত হইল। ঠানদির ছড়ার ভিতর আদিরসের গুপ্ত ইঙ্গিত পাইয়া যুবতী রমণীগণ হাসিয়া বকিয়া একেবারে আকুল করিয়া তুলিল। 

সে-কলহাস্যমুখরিত পরীর ন্যায় সুন্দরী রমণীকুল অধিক রাত্রে বর-বধূকে শয়ন দিয়া চলিয়া গেল। মধ্যে মধ্যে কানাকানি, হাসাহাসির দুই-একটি কণিকা কবাটের ওপাশ হইতে শ্রুতিগোচর হইতেছিল। তাহার পর সকলই নিঃস্তব্ধ। সকলেই চলিয়া গিয়াছে। কিশোরী হৈমবতী সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত হইয়া পালঙ্কের বাজুর উপর মাথা রাখিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। পদ্মাক্ষর ঘুম আসিতেছিল না। সহসা জীবনের এমন পরিবর্তন, বিগত কয়েকটি দিনের ঘটনাস্রোত তাহার মনের ভিতর উঠাপড়া করিতেছিল। উন্মুক্ত বাতায়নপানে চাহিয়া পদ্মাক্ষ দেখিল, আজ খুব জ্যোৎস্না উঠিয়াছে। সে বাতায়নপার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইল। 

আকাশে চাঁদ হাসিতেছে। বাতাসের স্পর্শ জননীর স্নেহ-নিঃশ্বাসের ন্যায় পদ্মাক্ষর অঙ্গে কোমল স্পর্শ বুলাইয়া যাইতেছে। পদ্মাক্ষ ভাবিতেছিল, জীবন কেমন এক লহমায় পরিবর্তিত হইয়া যায়। বেশ তো ছিল একাকী কুটিরে স্বাধীন, নিমুক্ত। দেশে যাইবে বলিয়া যখন নৌকায় উঠিয়াছিল, তখন কি আর জানিত দেশ হইতে ফিরিবার পথে কী অপেক্ষা করিয়া আছে? কোথায় ছিল এই কন্যা? কেমন করিয়া এ কিশোরী কন্যাটি আসিয়া তাহার জীবনের সঙ্গে জুড়িয়া গেল? এখন সে ধরা পড়িয়াছে। কোনো একটা ভাবকে পদ্মাক্ষ যেমন তাহার কবিতায় ছন্দের নিগড়ে, অক্ষরের গারদে ভরিয়া শ্লোক রচনা করে, তেমনই আজি এই আনন্দসন্ধ্যায় সে নিজে এই সোনার বাসরে বন্দী হইতে চলিল। 

সহসা পশ্চাতে কটিভূষণের কিঙ্কিণী শুনিয়া সে মুখ ফিরাইয়া দেখিল, হৈমবতী শয্যা হইতে উঠিয়া আসিয়া বাতায়নের নিকট দাঁড়াইয়া আছে। সেও মুগ্ধ হইয়া জ্যোৎস্না দেখিতেছিল। চাঁদের আলোক তাহার মুখের উপর বাঁকা ভাবে পড়িয়া আলোছায়ার সৌন্দর্যলোক রচনা করিয়া রাখিয়াছে। 

পদ্মাক্ষ কহিল, “হৈম, বাহিরে যাইবে?” 

হৈমবতী অবাক হইয়া পদ্মাক্ষর মুখপানে তাকাইয়া রহিল। 

পদ্মাক্ষ পুনরায় কহিল, “বাহিরে সেই নদীতীরে এখন খুব জ্যোৎস্না ফুটিয়াছে। ঘরের ভিতর বড়ো উষ্ণ। নদীতীরে খুব বাতাস বহিতেছে। যাহিবে?” 

হৈমবতী অবগুণ্ঠনের ভিতর মৃদু শিরশ্চালন করিয়া অস্ফুট স্বরে কহিল, “না, না। কেহ যদি দেখিয়া ফেলে?” 

“কেহ দেখিবে না। সকলেই সুপ্তিমগ্ন। বেশি দূরেও নহে। লুকাইয়া যাইব। আবার ভোররাত্রে কেহ জাগিবার পূর্বে এই কক্ষে ফিরিয়া আসিব। চলিয়া আইস।” 

হৈমবতী ইতস্তত করিতেছিল। তাহার পর পদ্মাক্ষর কথায় যেন সে সাহস পাইল। কিশোরী বধূর চক্ষে লুকাইয়া নদীতীরে যাইবার উত্তেজনা ক্ষণিকের জন্য নাচিয়া উঠিল। পদ্মাক্ষ দুয়ার খুলিয়া দিল। হৈমবতী ভয়ে ভয়ে পা টিপিয়া টিপিয়া কক্ষ হইতে বাহির হইয়া আসিল। 

আলোক ও অন্ধকারের ভিতর ঘরের দাওয়া নিস্তব্ধ পরীরাজ্য হইয়া পড়িয়া আছে। সেই অলিন্দ পার হইয়া উঠানে নামিয়া তাহারা অগ্রসর হইতে লাগিল। পদ্মাক্ষ কিছুদূরে যায়, পশ্চাতে ফিরিয়া দেখে হৈম আসিতেছে কি না। হৈম সামান্য অগ্রসর হইয়াই কোনো স্তম্ভের আড়ালে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া পড়ে। লজ্জা, সঙ্কোচ, ভয় কিছুতেই আর যাইতে চাহে না। পদ্মাক্ষ অদূরে দাঁড়াইয়া চাপাস্বরে হৈমকে আহ্বান করে, “চলিয়া আইস। শীঘ্র। কেহ না জাগিয়া উঠে।” হৈম পুনরায় পা টিপিয়া টিপিয়া আগাইয়া আসে। এইরূপে গৃহ হইতে বকুলতলা, জবাতলা পার হইয়া দোলমঞ্চ অতিক্রম করিয়া নাটমন্দির ছাড়াইয়া কোথাও দ্রুত চলিয়া, কোথাও- বা ত্বরিতে ছুটিয়া তাহারা নদীতীরের দিকে যাইতে লাগিল। একস্থানে আকন্দঝোপের কাঁটায় হৈমবতীর চেলাঞ্চলের প্রান্ত আটকাইয়া গেল। পদ্মাক্ষ সত্বর ফিরিয়া আসিয়া চেলির প্রান্ত কাঁটাঝোপ হইতে মুক্ত করিয়া দিল। অযত্নবর্ধিত ঘাসের জঙ্গলের ভিতর হৈম ঠিকমতো হাঁটিতে পারিতেছে না দেখিয়া, পদ্মাক্ষ তাহার হস্ত ধারণ করামাত্রই এই নৈশ অভিসার ও কী জানি স্পর্শের কোন্ অস্ফুট পুলকে পদ্মাক্ষর সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। এইরূপে তাহারা দুইজন নদীতীরে বালুকাবেলায় আসিয়া উপস্থিত হইল। 

হৈমবতী পূর্বতন সকল লজ্জা ভুলিয়া এই সংগোপন পলায়নের আনন্দ-উত্তেজনায় পাগলিনীর ন্যায় হাসিতেছিল। পদ্মাক্ষও তাহার এই নূতন পরিকল্পনার উল্লাসে উল্লসিত। দুইজনে বালুচরের উপর শ্রান্ত হইয়া বসিয়া পড়িল। 

যেন মুক্তি জ্যোৎস্নার আলোক হইয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। ‘নদীজল চাঁদের আলোয় চিক্কণ হইয়া এই কিশোর-কিশোরীর নিভৃত অভিযানের সংবাদ পাইয়া দুলিয়া দুলিয়া উঠিতেছে। কখনও ঘুমন্ত নদী অন্ধকারের ভিতর পাশ ফিরিয়া শুইতেছে। 

পদ্মাক্ষর প্রতি হৈমবতীর সে প্রাথমিক সংকোচ কাটিয়া গিয়াছে। পদ্মাক্ষ অতি ঘনিষ্ঠ হইয়া হৈমবতীর পার্শ্বে বসিয়া আছে। হৈমর সজ্জীকৃত খোঁপা অর্ধেক খুলিয়া পদ্মাক্ষর স্কন্ধের উপর বিলোল হইয়া পড়িয়া আছে। জ্যোৎস্না দেখিতে দেখিতে পদ্মাক্ষ ঘোর-লাগা কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন করিল, “হৈম, এই নীল আকাশ দেখিয়া তোমার কী মনে হয়?” 

হৈমবতী বলিল, “জানি না!” তাহার পর কী ভাবিয়া আবার কহিল, “আমাদিগের গ্রামে কাত্যায়নীদিদি বলিয়া আমার এক সই আছে। বাল্যে তাহার এক কুলীন ব্রাহ্মণ যুবকের সহিত বিবাহ হইয়াছিল। কিন্তু বিবাহের পর কাত্যায়নীদিদির বর আর আসে না। কাত্যায়নীদিদিকে পিত্রালয়ে ফেলিয়া রাখিয়াছে। বছরের পর বছর ঘুরিয়া যায়। তাহার পর গত শ্রীপঞ্চমীতে কাত্যায়নীদিদির বর আসিয়াছিল। সেইদিন নদীর ঘাটে কাত্যায়নীদিদি জল আনিতে আসিয়া যেমন করিয়া হাসিয়াছিল, এই চাঁদের আলো- ধোওয়া দূরের আকাশটা দেখিয়া কেন জানি আমার মনে কাত্যায়নীদিদির সেই হাসির কথা ভাসিয়া উঠিতেছে।” 

পদ্মাক্ষ মুগ্ধ হইয়া গেল। সে পুনরায় ত্বরিতে কহিল, “আর নদীর অপর পারের ওই অন্ধকার বনানী? কেমন নিস্তব্ধ হইয়া রহিয়াছে। উহা দেখিয়া তোমার কী মনে হইতেছে?” 

হৈমবতী কোনো উত্তর দিল না। সে নিশ্চুপ হইয়া রহিল। কিছুক্ষণ পর পদ্মাক্ষ দেখিল, সে নিঃশব্দে কাঁদিতেছে। শংকিত হইয়া পদ্মাক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “কী হইয়াছে, হৈম? কাঁদিতেছ কেন?”

অশ্রুবিগলিত স্বরে হৈম আরও আকুল ক্রন্দন করিতে করিতে বলিল, “ও অন্ধকারের কথা আমাকে বলিবেন না। পাঠানের ভয়ে এক রাত্রির সমস্ত প্রহর আমি ইক্ষুবনে লুকাইয়াছিলাম। ওই অন্ধকারের কথা বলিলে আমার সেই ভীষণ রাত্রির কথা মনে পড়ে।”

পদ্মাক্ষ হৈমবতীর স্কন্ধে হাত রাখিল। তখনই স্নেহের স্পর্শ পাইয়া রোরুদ্যমানা কিশোরী আরও আকুল হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কুলায়প্রত্যাশী পাখির ন্যায় স্বামীর বুকের ভিতর মুখ গুজিয়া দিল। 

পদ্মাক্ষর মনে হইল, সহসাই মনে হইল, সে এতদিন কীসব অনর্থক উপাদান লইয়া কাব্য রচিয়া আসিতেছে! চাঁদ, আকাশ, নদী, কুসুম, বাতাস লইয়া শ্লোকের পর শ্লোক লিখিয়াছে। কিন্তু মানবের হৃদয়ে এই যে হাসি, কান্নার ধারাস্রোত বহিতেছে, সরল জীবনের এসকল ক্ষুদ্র দুঃখসুখের কথা সে তো কখনও রচনা করে নাই। এই ক্ষুদ্র কিশোরীটির রোদনবেদনের ভিতর দিয়াই তাহার কাব্যের সার্থকতা দেখা দিতে পারে, ইহার ন্যায় অগণ্য মানবজীবনের আনন্দশোকের কথাই সে এখন হইতে লিখিবে—নিছক প্রাকৃতিক বর্ণনাই কি আর কাব্য হইয়া উঠিতে পারে, যাহাতে অস্তিত্বের সুগভীর সংবেদনা নাই? 

হৈমবতীকে বক্ষে লইয়া তাহার আরও মনে হইতেছিল, এই তো তাহার জীবনের পরম আশ্রয়! এই কিশোরীটির হৃদয় না পাইলে সে অনন্তকাল একাকী হইয়া ফিরিত, তাহার জীবন চিরকাল অপূর্ণই হইয়া থাকিত। কী মহেন্দ্ৰক্ষণেই না সে পিতার সহিত চন্দ্রদ্বীপের রাজার নিকট কবিতা শুনাইতে গিয়াছিল! কী সৌভাগ্যেই না রাজা তাহার কবিতা শুনিয়া মুগ্ধ হইয়া তাহাকে সভাকবি নিযুক্ত করিয়াছিলেন! রাজা যদি তাহার কবিতা শুনিয়া মুগ্ধ না হইতেন, তবে তো সে তাহার গ্রাম ও গৃহবেষ্টনীর বাহিরে আসিতে পারিত না। তখন কি আর তাহার একাকী চন্দ্রদ্বীপে গমনাগমন ঘটিত? একাকী পথ না চলিতে শিখিলে, পথিপার্শ্বে সে কোনোদিন হৈমবতীর দেখা পাইত কি? আজ যে সে কাব্য, প্রণয় ও জীবনের সারাৎসারের আভাস পাইল, হৈমবতীকে না পাইলে তাহা তো তাহার পাওয়া হইত না। কী শুভযোগেই না চন্দ্রদ্বীপের রাজার সহিত দেখা হইয়াছিল। রাজা তাহার কবিতা শুনিয়া মুগ্ধ না হইলে, তাহার কী যে হইত! 

কী হইত, তাহা সে জানে না। জানা সম্ভব নহে। জানিলে, সে পদ্মাক্ষ হইত না, কমলনয়ন হইত। অপরদিকে কমলনয়ন যাহা হইতে পারে নাই, পদ্মাক্ষ তাহাই হইয়া উঠিয়াছে। আমাদিগের পরিচিত পৃথিবীতে কমলনয়নের ব্যর্থতা বিকল্প সম্ভাবনার বিশ্বে পদ্মাক্ষর সাফল্যের মধ্যে চরিতার্থতা লাভ করিয়াছে। কিন্তু কমলনয়নও কি আর ব্যর্থ? কমলনয়ন কমলনয়নই, সে পদ্মাক্ষ হইতে পারে নাই, কিন্তু পদ্মাক্ষ না-হইয়া সে তবে কী হইয়াছিল? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *