ছায়াচরাচর – ১৭

সতেরো 

বারাণসীর ন্যায় এত বৃহৎ নগরীতে কমলনয়নকে খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার ছিল। নবদ্বীপ হইতে এত দীর্ঘপথ পার হইয়া আসিয়া বারাণসীতে উপস্থিত হইয়া যাদবের চক্ষে যেন ধাঁধা লাগিয়া গেল। দীর্ঘ দীর্ঘ বৎসর নবদ্বীপে অপেক্ষা করিবার পরেও ভ্রাতা যখন ফিরিল না, একখানা পত্রও নাই, তখন উপায়ান্তর না দেখিয়া ভ্রাতার অন্বেষণে যাদব এই দীর্ঘ পথশ্রম স্বীকার করিয়াও বারাণসী আসিয়াছিল। কিন্তু এখানে কোথায় খুঁজিয়া পাইবে কমলনয়নকে? এ ঘাটে ও ঘাটে বৃথা ঘুরিয়া ঘুরিয়া, এ মঠে ও মঠে অন্বেষণ করিয়া ব্যর্থমনোরথ হইয়া অবশেষে একদিন প্রভাতবেলায় চৌষট্টি যোগিনীর ঘাটে বসিয়া আছে, দেখিল এক মুণ্ডিতমস্তক সন্ন্যাসী স্নানান্তে উঠিয়া আসিতেছেন। যুক্তকরে সন্ন্যাসীকে অভিবাদন-অন্তর যাদব জিজ্ঞাসা করিল, “অবধূত! আপনি কি এই ঘাটের সমীপেই কোথাও অবস্থান করেন?”

সন্ন্যাসী বলিল, “হাঁ, আমি আচার্য বিশ্বেশ্বর সরস্বতীর প্রব্রজিত সন্ন্যাসী। আপনি?”

যাদব উত্তর দিল, “আমি যাদব। ব্রাহ্মণ। অতিসম্প্রতি কাশী আগমন করিয়াছি। আপনাদিগের মঠে কমলনয়ন নামে কি কোনো অন্ত্যেবাসী আছেন?” 

“না, কমলনয়ন নামে তো কেহ নাই!” 

যাদব তৎক্ষণাৎ বুঝিল, তাহার ভুল হইতেছে। প্রকাশ্যে কমলনয়ন কখনও তাহার বাল্যনামে পরিচয় দিত না। সর্বদাই তাহার জাতপত্রিকায় যে-নাম আছে, সেই ‘মধুসূদন’ নামে পরিচয় দিয়া আসিতেছে। অতএব ‘কমলনয়ন’ বলিলে কেহ চিনিবে না। সে দ্রুত নিজেকে সংশোধন করিয়া প্রশ্ন করিল, “আচ্ছা, মধুসুদন নামে কি কেউ…?”

সন্ন্যাসী বলিলেন, “বিলক্ষণ! দুই-তিন মাস হইল, আমাদিগের মঠে আচার্য বিশ্বেশ্বর সরস্বতী জনৈক কৃতধী ব্যক্তিকে সন্ন্যাস দীক্ষা দিয়াছেন। সদ্যোপ্রব্রজিত সেই সন্ন্যাসীর নাম মধুসূদন সরস্বতী। তিনি অতি মেধাবী, শাস্ত্রসেবী, গভীর ধ্যানশীল, কিন্তু আপনি তাঁহার অন্বেষণ করিতেছেন কেন?” 

যাদবের মস্তকে যেন বজ্রাঘাত হইল। কমলনয়ন সন্ন্যাস লইয়াছে। তবে তো তাহার আর গৃহে ফিরিবার কোনো সম্ভাবনাই নাই। তথাপি, একবার শেষ চেষ্টা তো দেখিতেই হইবে। এ কী অভাবিত ঘটনা! কমলনয়ন, তাহার শৈশবের সাথী কমলনয়ন…পিতা-মাতা-ভ্রাতাদিগের উপর এত নিষ্ঠুর হইল কী প্রকারে? যাহাই হউক, নিজ ভাব ঈষৎ সংবরণ করিয়া লইয়া যাদব সম্মুখস্থ সন্ন্যাসীকে বলিল, “আমি কমলনয়নের…না, না…মধুসূদনের পূর্বাশ্রম সম্বন্ধে অগ্রজ। আমাকে আপনি কি একবার তাহার সমীপে লইয়া যাইতে পারেন?” 

সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন, “পারি। কিন্তু মধুসূদন আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন কি না বলিতে পারি না। আসুন, আমার সহিত আসুন!” 

নগরীর শীর্ণ গলিপথ বাহিয়া চলিতে চলিতে সন্ন্যাসীদিগের মঠ আসিয়া পড়িল। প্রবেশদ্বারে দুইটি প্রস্তরনির্মিত সিংহ দ্বাররক্ষা করিতেছে। দ্বারপথ দিয়া কিছুদূর অগ্রসর হইলে অতি বিস্তৃত একটি উঠান। তাহার পর দীর্ঘ সোপান অতিক্রম করিয়া শ্বেতপাথরে আবৃত অলিন্দে উঠিতে হয়। সমস্ত মঠটি অতি পরিষ্কৃত—সব কিছু ঝকঝক তকতক করিতেছে। অলিন্দের স্তম্ভগুলি অতি স্থূল; চারিজন মনুষ্য পাশাপাশি দাঁড়াইলে যতখানি হয়, ততখানি বেধ। সন্ন্যাসী অনুসরণকারী যাদবকে দ্বিতলে একটি কক্ষের সম্মুখে লইয়া গেলেন। দ্বার উন্মুক্ত দেখা গেল। সন্ন্যাসী চক্ষের ইঙ্গিতে যাদবকে ভিতরে প্রবেশ করিতে বলিয়া চলিয়া গেলেন। 

দ্বারে দাঁড়াইয়া যাদব অভ্যন্তরে দৃষ্টিপাত করিয়া মুগ্ধ হইয়া গেল। কক্ষে ভূতলে একটি ব্যাঘ্রাজিন বিস্তৃত করিয়া এক তরুণ সন্ন্যাসী উপবিষ্ট। তাহার মস্তক সদ্যোমুণ্ডিত গাত্রের গৈরিক বস্ত্র ও উত্তরীয় প্রভাতের প্রথম আলোকের ন্যায় উজ্জ্বল। চতুষ্পার্শ্বে নানাবিধ শাস্ত্রগ্রন্থ, বিবর্ণ পুথি উন্মুক্ত অবস্থায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়া আছে। সম্মুখে একটি লিখিবার উপযুক্ত পীঠিকা। উহার উপর বসিয়া ঝুঁকিয়া বসিয়া সন্ন্যাসী কী একটি পুথি এক মনে রচনা করিতেছেন—এত গভীর মনঃসংযোগ যে, বাহিরের হুঁশমাত্র নাই। 

চিনিতে বিলম্ব হইল না। আহা! কত সৌম্য, কত শান্ত, কী সুন্দরই না হইয়াছে! যাদব স্তিমিত কণ্ঠে ডাকিল, “কমলনয়ন। ও কমলনয়ন!!” 

কমলনয়ন নয়ন উত্তোলন করিয়া দেখিল। দাদা! দাদা আসিয়াছে! কী একটি উচ্ছ্বাসের ভাব মুখমণ্ডলে ফুটি ফুটি করিয়াও অবশেষে সংযত হইয়া গেল। অভিবাদন জ্ঞাপন করিয়া কমলনয়ন কহিল, “আইস, অভ্যন্তরে আইস। উপবেশন করো।” 

কুট্টিমের এক পার্শ্বে একটি কুশাসন ছিল। যাদব তাহাতেই উপবেশন করিল। বলিল, “এ কী ব্যাপার? তুই সন্ন্যাসী হইয়াছিস? শুনিয়াছিলাম, তুই বেদান্তমত খণ্ডন করিবার জন্য কাশীতে বেদান্তপাঠ করিতেছিলি। ন্যায়মতের সর্বোৎকৃষ্টতা প্রমাণ করাই তো তোর উদ্দেশ্য ছিল! তাহা হইলে…?” 

“ন্যায়মত পরিত্যাগ করিয়াছি, দাদা। ওই মত ভ্রান্ত—আমার এতাদৃশ বোধ হইয়াছে। বেদান্তমত গ্রহণ করিয়া এষণাত্রয় পরিত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস বরণ করিয়াছি।” 

“সন্ন্যাস লইবার পূর্বে পিতা-মাতা কাহারও অনুমতি লইবার তোর প্রয়োজন হইল না? একবার আমাদিগের কথা চিন্তাও করিলি না? হৃদয় এতদুর পাষাণ করিয়াছিস?” যাদবের কণ্ঠস্বরে ক্ষোভ ঝরিয়া পড়িল। 

কমলনয়ন প্রথমে কিছু কহিল না। তাহার পর ধীরে ধীরে বলিল, “গৃহত্যাগ করিবার পূর্বে মাতাপিতাকে এইরূপ ইঙ্গিত দিয়াই তাঁহাদের অনুমতি লইয়াছিলাম। তাহার পর পথে নামিলাম। সেই পথই আমাকে এই অবস্থায় লইয়া আসিয়াছে।” 

“আর আমি? আমি যে তোর জন্য পথক্লেশ স্বীকার করিয়া উনসিয়া হইতে নবদ্বীপ আসিয়াছিলাম? আমাকে বলিয়া আসিলি, কাশী হইতে তুই শীঘ্রই নবদ্বীপে ফিরিয়া যাইবি—তোর সে-প্রতিশ্রুতি মিথ্যা হইয়া গেল?” 

“তখন ওইরূপই স্থির করিয়াছিলাম, দাদা। কিন্তু কাশী আসিয়া মনোভাব পালটাইয়া গেল। কী আর করিব!” 

“বেশ। কিন্তু পিতামাতা বৃদ্ধ হইয়াছেন। তাঁহাদের কথা তো একবার চিন্তা করিতে হয়!” 

“এ সংসারে পিতা-মাতা-ভ্রাতা-দারা সুত সকলই মায়িক সম্বন্ধ, দাদা। উহার কিছুই সত্য নয়, শাশ্বত নয়। সংসার পদ্মপত্রে নীরবৎ! এই আছে, এই নাই। তাই সমস্ত ছাড়িয়া ঈশ্বরের শরণ লইয়াছি।” 

“কিন্তু বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি তোর একটা কর্তব্যও তো আছে! সে-কথা কি তুই অস্বীকার করিতে পারিস?” 

“না, পারি না। কর্তব্য আছে, সত্য। কিন্তু ভিতর হইতে আর-একটা ডাক আসিল। সেই ডাক কর্তব্যের আহ্বান অপেক্ষাও উচ্চতর।” 

“ভালো কথা। কিন্তু সংসারে থাকিয়া কি ধর্ম হয় না? রাজা জনক তো সংসারধর্ম পালন করিয়া ধর্মলাভ করিয়াছিলেন!” 

“সংসারে থাকিয়া যাহাদের ধর্ম হয়, হউক। আমার তো হইল না। আর সংসারে থাকিয়া যদি সকলেরই ধর্মলাভ হইত, তবে তো প্রত্যেকেই রাজর্ষি জনক হইতেন। তাহা তো হয় না। বেশিরভাগ সংসারী ব্যক্তিই সংসারের মধ্য দিয়া ধর্মলাভ করিবেন ভাবিয়া অন্তিমে পুত্রকন্যার জনক ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারেন না।” 

“ও। আর সব সন্ন্যাসীই বুঝি ব্রহ্মজ্ঞানী হইয়া যায়?” 

“না, তাও হয় না। ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী সর্বথাই বিরল। কিন্তু যে-ব্যক্তি সম্মুখে বহু বাধা আছে জানিয়াও তীর্থপথ ধরিয়া সাবধানে চলিতেছে, তাহার সহিত তুমি যাহারা সংসারের ভোগসুখে নিমগ্ন হইয়া কালহরণ করিতেছে, তাহাদের তুলনা করিতে পারো না।” 

“তোর দৃষ্টিতে সংসার তাহা হইলে অসার?” 

“হাঁ, অসার।” 

“কীরূপে? আমার সহিত বিচার কর।” 

“করিব। কিন্তু এখন নহে। তুমি কল্য রাত্রিতে কোথায় ছিলে?”

“কোথায় আবার থাকিব? তুই কি আমাকে এতটুকু শান্তিতে রাখিয়াছিস? কয়েকদিন ধরিয়া বারাণসীর এক ধর্মশালায় পড়িয়া আছি!” 

“তবে চলো। আহারাদি করিয়া লইয়া একটু বিশ্রাম করিবে। এ কয়দিন তোমার আহারনিদ্রাও বুঝি হয় নাই।” 

মঠের পাকশালায় বসিয়া যাদব আহার করিল। আহার্য সামান্যই, রুক্ষ অন্ন, জলবৎ সৃপ, কদলী ও মুগসিদ্ধ। এইরূপ কর্কশ আহার কমলনয়নকে প্রত্যহ করিতে হয় ভাবিয়া যাদবের চক্ষে জল আসিল। 

আহারের পর মঠের অতিথিশালার এক কক্ষের কুট্টিমের উপর একটি কম্বল পাতিয়া যাদব শুইয়া ছিল। কমলনয়ন চলিয়া গিয়াছে। সমস্ত মঠটি নিঃশব্দ। যেন জনপ্রাণী নাই। অথচ এতগুলি সাধু এখানে থাকে, বোধহয় সকলেই নিজ নিজ কক্ষে নীরবে ধ্যানচিন্তন, পাঠাভ্যাসাদি করিতেছে। 

শুইয়া শুইয়া যাদব ভাবিতেছিল, কমলনয়ন সংসারকে অসার বলিতেছে কেন? কোন্ যুক্তিতে? বাতায়নপথে রৌদ্র আসিয়া ঘরের ভিতর বাঁকাভাবে পড়িয়াছে। কোথাও ছাদের কোণে ঘুঘুপাখি আমন্থর ঘুৎকার ধ্বনিতে মধ্যাহ্নের নির্জনতাকে গাঢ় করিয়া তুলিতেছে। ভাবিতে ভাবিতে অক্ষিপল্লবে তন্দ্রা নামিয়া আসিল। 

জাগিয়া উঠিয়া যাদব দেখিল, বেলা পড়িয়া আসিয়াছে। সে পুনরায় কমলনয়নের কক্ষে গেল। দেখিল, কমলনয়ন সেই একভাবে পুথির পৃষ্ঠায় আনতগ্রীব হইয়া আছে। 

যাদব কুশাসনের উপর গিয়া বসিল। কিছু পরে কমলনয়ন পুথি হইতে চোখ তুলিয়া স্মিতহাস্যে বলিল, “কী? ঘুম হইয়াছে?”

“হাঁ, তাহা হইল।” 

“কোনো কী স্বপ্ন দেখিলে?” 

কমলনয়নের প্রশ্নে যাদব সামান্য বিস্মিত হইল। কখন যে কী কথা বলে। স্বপ্নের কথা স্মরণ করিয়া ধীরে ধীরে বলিল, “তা দেখিয়াছি বটে। আমাদিগের উনসিয়া গ্রামের স্বপ্ন…কে একটি বালিকা আমাদের উদ্যানে চুরি করিয়া ফুল পাড়িতেছে…আমি তাহাকে বলিলাম, না বলিয়া পুষ্পচয়ন করিতেছ কেন?…” 

কমলনয়ন যাদবের স্বপ্নবৃত্তান্তে তেমন আগ্রহী হইল না। সে জিজ্ঞাসা করিল, “স্বপ্ন দেখিবার সময় কি একবারও মনে হইয়াছিল, স্বপ্নের সেই গ্রাম, সেই বালিকা, পুষ্পচয়নাদি মিথ্যা? স্বপ্নদর্শনকালে স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে কি তোমার একবারও মনে হইয়াছিল, এই স্বপ্ন আসলে একপ্রকার কল্পনা? সে-অবস্থায় একবারও মনে হইয়াছিল, স্বপ্ন মিথ্যা?” 

“না। স্বপ্ন দেখিবার সময়ে স্বপ্নকে সত্যই মনে হয়।” 

“তাহা হইলে, এখন যে জাগিয়া উঠিয়া তোমার এই মঠ, ঘট, পট সব সত্য মনে হইতেছে, এই জাগরণও তো তোমার একটা দীর্ঘস্থায়ী স্বপ্ন হইতে পারে। পারে না?” 

যাদব চারিপাশে একবার চোখ তুলিয়া তাকাইল। এই কক্ষ, কমলনয়ন, বিবর্ণ পুথির পৃষ্ঠা, ওই উন্মুক্ত বাতায়ন, নিজ শরীর — সকলই সে একপ্রকার স্বপ্ন দেখিতেছে নাকি? 

তথাপি সেই ঘোর কাটাইয়া যাদব তর্কে প্রবৃত্ত হইল, “বেশ। কিন্তু স্বপ্ন ভাঙিলে তো জাগিয়া উঠিয়া স্বপ্নকে মিথ্যা বুঝা যায়, বাপু। কিন্তু এই জাগ্রৎ অবস্থা তো দেখি আর কখনও ভাঙে না!” 

“কেমন করিয়া জানিলে, ভাঙে না? ইহার উপরেও তো একটা অবস্থা থাকিতে পারে। যদি এখনই এই জাগরণ ভাঙিয়া যায়? তখন তো জাগরিত অবস্থায় দৃষ্ট সংসার, এই সকল মায়িক সম্বন্ধ, এই ঘট-পট-মঠ সকল কিছুই মিথ্যা মনে হইবে?” 

“তুই যে জাগরণ হইতেও পুনর্জাগরণের কথা বলিতেছিস! কিন্তু তাহার নিশ্চয়তা কী? কাহারও কি এমন হয় যে, জাগরিত অবস্থা হইতেও জাগিয়া উঠে? ইহা তো আমি ভালো বুঝিতে পারিতেছি না।” 

“আচ্ছা বেশ, নাহয়, নাই বুঝিলে। কিন্তু আমাকে একটা কথা বলো। তুমি তো কাশীতে শুইয়া উনসিয়ার স্বপ্ন দেখিতেছিলে, তাই না?” 

“তা বটে। কিন্তু তাহাতে কী হইল?” 

“হইল এই যে, তোমার স্বপ্নাবস্থা তোমার জাগ্রত অবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করিয়াই রচিত হইয়াছিল। যদিও তুমি কাশীতে শুইয়া আছ, অথচ স্বপ্ন দেখিতেছ উনসিয়ার! কেমন কি না?” 

“হাঁ। যদিও জাগরিত অবস্থায় কাশীতে আছি, তথাপি স্বপ্নে দেখিলাম, আমি উনসিয়ায় রহিয়াছি।” 

“আর জাগিয়া উঠিয়া দেখিলে, তুমি উনসিয়ায় নাই, কাশীতে এক সন্ন্যাসীদের মঠে শুইয়া আছ। অতএব, তোমার স্বপ্ন অবস্থা আর তোমার জাগ্রৎ অবস্থা—উভয়ে উভয়কে খণ্ডন করিতেছে। এক অবস্থার সাপেক্ষে অন্য অবস্থা মিথ্যা প্রমাণিত হইয়া যাইতেছে।” 

“কিন্তু তুই শুধু জাগরণ আর স্বপ্নের কথা বলিতেছিস কেন রে? আরে, মানুষের এমন অবস্থাও তো হয়, যখন সে গভীর ঘুমে থাকে। সে অবস্থায় সে কোনো স্বপ্ন দেখে না। উহাকে ‘সুষুপ্তি’ অবস্থা বলে।” 

“বেশ তো! ওই গভীর ঘুমের অবস্থায় কি জাগ্রৎ অবস্থার কোনো কিছু অনুভূত হয়?” 

“না। কিছুমাত্র অনুভূত হয় না।” 

“স্বপ্ন অবস্থার কোনো কিছু অনুভূত হয় কি?” 

“আরে, না, না। সেই সুষুপ্তি অবস্থায় আন্তর, বাহ্য কোনো কিছুরই অনুভব হয় না। এমনকি ‘আমি’ বোধও সুষুপ্তি অবস্থায় লুপ্ত হইয়া যায়। সুষুপ্ত অবস্থায় যেন কিছুই নাই।” 

“তবে দাদা, সুষুপ্তি অবস্থায় ওই ‘না-থাকা টার সাক্ষী থাকে কে?”

“যদি বলি, কেহই না?” 

“কেহই যদি সাক্ষী না থাকিত, তবে জাগিয়া উঠিয়া কে বলে, ‘সুখে ঘুমাইয়াছি; কিছুই অনুভব করি নাই?”“ 

যাদব ভাবিতে লাগিল। সত্যিই তো! কমলনয়ন তো ঠিকই বলিতেছে। সুষুপ্তি অবস্থায় সেই ‘কিছু-না-থাকা’টা যদি সে-অবস্থায় কেহ না অনুভব করিত, তবে জাগিয়া উঠিয়া ‘আমি কিছু অনুভব করি নাই’ এই স্মৃতিই বা হইতেছে কাহার? সুষুপ্ত অবস্থায় এই ‘কিছু না’ যে অনুভব করিয়াছে, জাগরিত হইয়া সেই-ই ইহা স্মরণ করিতেছে। সত্য বটে! 

যাদবের চিন্তায় বাধা দিয়া কমলনয়ন বলিল, “দেখ, দাদা। জাগ্রৎ অবস্থা সরিয়া গিয়া স্বপ্ন আসিতেছে। স্বপ্ন সরাইয়া দিয়া সুষুপ্তি আসিতেছে। একের পর এক। কিন্তু এই তিন অবস্থার সাক্ষী এক জন, নাকি তিন জন? তিন জন হইতে পারে না। কারণ, একাধিক সাক্ষী হইলে ‘আমি জাগিয়া ছিলাম, আমিই ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিলাম, আমিই স্বপ্নহীন গভীর ঘুমের মধ্যে তলাইয়া গিয়াছিলাম, পুনরায় আমিই জাগিয়া উঠিয়াছি’ একই লোকের এইরূপ অনুভব হইত না। অতএব, পরিবর্তনশীল এই জাগ্রৎ-স্বপ্ন- সূযুপ্তির এক নির্বিকার অপরিবর্তনীয় সাক্ষী বর্তমান।” 

“কে একভাবে এই অবস্থাত্রয়কে দেখিয়া চলিয়াছে?” 

“অবশ্যই সে তোমার এই জাগ্রত অবস্থার ‘আমি’ নহে। স্বপ্ন অবস্থার ‘আমি’ও নহে। এমনকি সুষুপ্তি অবস্থার ‘আমি-হীনতা’ও নহে। জাগ্রত অবস্থার ‘আমি’ জাগ্ৰত অবস্থার দ্বারাই সীমাবদ্ধ। জাগ্রত অবস্থার সেই ‘আমি’র পরিচয় মুছিয়া গিয়া স্বপ্নের ‘আমি’ ফুটিয়া উঠিতেছে। স্বপ্নের ‘আমি’ সুষুপ্তিতে তলাইয়া যাইতেছে। এ সকল ‘আমি’ও ‘আমার’ সেই এক অপরিবর্তনীয় সাক্ষীর উপর আরোপিত মাত্র। আর যাহা আরোপিত, তাহাই অসার। তাই বলিতেছি, সংসার অসার। এক সেই সাক্ষীই সত্য। ইনিই আত্মা। জীবের প্রকৃত স্বরূপ।” 

যাদব মুগ্ধ হইয়া শুনিতেছিল। কী আশ্চর্য কথা যে কমলনয়ন বলিতেছে! 

কমলনয়ন আবার বলিয়া উঠিল, “এই বিশ্বপ্রপঞ্চের দিকে তাকাও। ইহাও পরিবর্তনশীল। ইহারও নিশ্চয়ই একজন সাক্ষী থাকিবে। শাস্ত্র বলিতেছেন, প্রলয়কালে এই দৃশ্যমান বিশ্বপ্রপঞ্চ লীন হইয়া যায়।” 

“লীন হইলে কী থাকে?”

“কতগুলা ভাব বা সূক্ষ্ম চিন্তা। সেই সূক্ষ্ম ভাবগুলাও এক পরম শূন্যতায় লীন হয়। তাহার পর আবার সেই শূন্যতা হইতে বিপরীতক্রমে সৃষ্টি বা বিকাশ হইয়া থাকে।” 

“তবে কি এই দৃশ্যমান প্রপঞ্চ এক বিরাট পুরুষের জাগ্রৎ অবস্থা?” 

“ঠিকই ধরিয়াছ, দাদা! আর এই দৃশ্যমান প্রপঞ্চ লীন হইলে যে-চিন্তারাশি থাকে উহা সেই মহান পুরুষের স্বপ্ন। এবং সকল চিন্তারাশি যে পরমশূন্যতায় লীন হয়, তাহা সেই অব্যক্ত পুরুষের সুষুপ্তি। কিন্তু এই বিশ্বপ্রপঞ্চের পরিবর্তনসমূহের সাক্ষীও এক, অর্থাৎ অপরিবর্তনীয়। তিনিই ব্রহ্ম।” 

“আচ্ছা, আমার দেহ-মনের সাক্ষী আত্মা। আর এই বিশ্বপ্রপঞ্চের সাক্ষী ব্রহ্ম- ইহারা যদি দুই হয়?” 

“না, তাহা হইতে পারে না। দেহ-মনের সাক্ষী আত্মা স্থান-কালের অতীত হওয়ায় অসীম হইবে। আবার বিশ্বপ্রপঞ্চের সাক্ষী ব্রহ্ম—তিনিও স্থান-কালের অতীত; অতএব,অসীম। এখন দুইটা অসীম হইতে পারে না। তাহা যদি হইত, তবে একটা অপরটাকে সীমায়িত করিয়া দিত। তাই, এই আত্মাই ব্রহ্ম। অয়মাত্মা ব্ৰহ্ম!” 

যাদবের মনে এক অননুভূতপূর্ব ভাব জাগিয়া উঠিতেছিল। তাহার মনে হইতেছিল, যে-আমি এই ক্ষুদ্র দেহ-মনের পশ্চাতে দাঁড়াইয়া আছি, সেই আমিই এই বিরাট ব্রহ্মাণ্ডের পশ্চাতেও দাঁড়াইয়া আছি? আমি এত মহীয়ান, এত বিশাল, এত মুক্ত, এত নিৰ্ভয়! 

দাদার এই ভাবান্তর কমলনয়ন লক্ষ করিতেছিল। কিছু পরে সে বলিল, “চলো, এখন আর বেদান্তবিচার নহে। সন্ধ্যারতির সময় হইল।” 

যাদব আচ্ছন্ন কণ্ঠে বলিল, “তাহা হইলে কে কাহার আরতি করিবে?” 

“দাদা, যতক্ষণ না সেই জ্ঞান হইতেছে, ততক্ষণ আমার ‘আমি’ বোধ বা অহং- বোধ ষোলো আনা রহিয়াছে। আর যতক্ষণ এই ‘আমি’ বোধ আছে, ততক্ষণ ‘আমি বদ্ধ, সাধনা করিয়া মুক্ত হইব’ এই বোধও রহিয়াছে। ততক্ষণ সন্ধ্যাবন্দনাদি সকলই রহিয়াছে।” 

মঠে সন্ধ্যারতি হইতেছিল। সন্ন্যাসীরা শিবের পূজন, আরতি ইত্যাদি করে। আরতির পর “প্রভুমীশমনীশমশেষগুণম্” ইত্যাদি স্তোত্রপাঠাদি হইল। 

আরতি সমাপ্ত হইলে যাদব কমলনয়নের নিকট হইতে ধর্মশালায় ফিরিয়া গেল। সমস্ত রাত্রি কমলনয়নের যুক্তিগুলি মনে ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতেছিল। 

শুধু যুক্তিতর্ক নহে, সন্ন্যাসীদের সেই মঠ, কমলনয়নের সেই সৌম্যমূর্তি, সেই সন্ধ্যারতির সুর যেন ভাসিয়া আসিতেছে। কী পবিত্র জীবন সব! সর্বস্ব ত্যাগের কী দৃপ্ত রূপ! 

পরের দিন যাদব পুনরায় মঠে চলিল। পরপর কয়েকদিন। অবশেষে একদিন সে কমলনয়নকে মনের কথা খুলিয়া বলিল। তাহার অন্তর পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। সেও সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া কৃতকৃতার্থ হইতে চায়। 

কমলনয়ন তাহাকে মঠাধ্যক্ষ বিশ্বেশ্বর সরস্বতীর নিকট লইয়া গেল। সকল কথা শুনিয়া বিশ্বেশ্বর বড়োই প্রীত হইলেন। তিনি যাদবকে কিছুদিন মঠবাস করিতে বলিলেন। উপযুক্ত সময় অসিলেই তাহাকেও সন্ন্যাসদীক্ষা দিবেন। 

কিন্তু হায়! বিধি বাম! যতবার যাদবের সন্ন্যাসগ্রহণের উপলক্ষ আসে, ততবারই কোনো-না-কোনো একটা বাধা আসিয়া উপস্থিত হয়। একবার তো বিশ্বেশ্বর সরস্বতী স্বয়ং অসুস্থই হইয়া পড়িলেন। 

অবশেষে একদিন তিনি যাদবকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ বাবা! তোমার সন্ন্যাস গ্রহণ সম্ভবত ঈশ্বরের অভিপ্রেত নহে। তুমি দেশে ফিরিয়া যাও। তুমি ব্ৰাহ্মণ। গৃহে ফিরিয়া শাস্ত্রের প্রচার করো। আমি আশীর্বাদ করিতেছি, ইহাতেই তোমার সর্ববিধ কল্যাণ হইবে।” 

ফিরিবার পূর্বে যাদব কমলনয়নের সহিত দেখা করিল। নিতান্ত হতাশার স্বরে বলিল, “তুই থাক, আমি কাল প্রভাতে উঠিয়া চলিয়া যাইব।” 

কমলনয়ন কিছু বলিল না। তাহার হৃদয় হইতে কী যেন একটা উঠিয়া আসিতেছিল। কান্নার ন্যায় কিছু একটা। কিন্তু উহা মায়িক, পার্থিব। উহাও ত্যাগ করিতে হইবে। অন্তর্গত বাষ্পকে কণ্ঠে অবরুদ্ধ করিয়া কমলনয়ন শুধু বলিতে পারিল, “শূলপাণি তোমার সহায় হউন!” 

এক অনন্তবিসর্পী পথ দ্বিধাবিভক্ত হইয়া দুই দিকে চলিয়া গেল। পথ কি আর কখনও ফিরিয়া আসে? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *