ছায়াচরাচর – ৫

পাঁচ 

এতক্ষণ পদ্মাক্ষর কথা কহিলাম, এক্ষণে পুনর্বার কমলনয়নের কী হইল, তাহা বলিব। কমলনয়ন গৃহত্যাগ করিয়া শ্রীগৌরাঙ্গ-চরণদর্শন মানসে নবদ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা করিল। কথাটা লিখিতে যতটা সহজ, বাস্তবে উহা ততটাই কঠিন। পিতার নিকট হইতে গৃহত্যাগের অনুমতি একপ্রকার সহজেই মিলিয়াছিল, জননীর নিকট হইতে সে অনুমতিলাভ কিন্তু দুঃসাধ্য হইয়া পড়িল। কমলনয়ন এই অল্প বয়সে গৃহত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবে, এই নিদারুণ সংবাদ শুনিয়া জননী মুহুর্মুহু মূর্ছিত হইয়া পড়িতে লাগিলেন। জ্ঞান ফিরিলে তিনি কী করিবেন, কী বলিবেন—কিছুই বুঝিয়া পান না। অশ্রুজলে তাঁহার বক্ষস্থল ভাসিতে লাগিল। অবশেষে অশ্রুপরিপ্লুত কণ্ঠে পুত্রকে আলিঙ্গন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “বৎস! কী হইয়াছে? সহসা তোমার এই ভাবান্তর কেন হইল? সংসারে থাকিয়া কি ধৰ্মলাভ হয় না?” কতভাবে তিনি কমলনয়নকে বুঝাইবার প্রয়াস পাইলেন, কমলনয়ন কিন্তু প্রতিজ্ঞায় অনড়। সে শুধু বারংবার বলে, “এ সংসার দুঃখময়, মা! ইহাতে থাকিতে হইলে কাহারো না কাহারো দাসত্ব করিতে হয়। আমি ঈশ্বর ছাড়া আর কাহারও দাসত্ব করিব না। এ জীবন, প্রাণ আমি ভগবৎ-চরণে অর্পণ করিব। … তোমার তো আরও তিন পুত্র আছে। আমার মায়া তুমি পরিত্যাগ করো।” 

জননী বলিলেন, “ইহা কি একটা কথা হইল? হস্তে অন্য চারিটি অঙ্গুলি আছে, তাই বলিয়া কি কেহ পঞ্চমটিকে কাটিয়া ফেলিয়া দিতে পারে?” 

তথাপি ক্রন্দন, আদর, প্রবোধ, তর্জন কোনো উপায়েই জননী পুত্রকে বুঝাইতে পারিলেন না। 

তখন পিতা বলিলেন, “আচ্ছা বেশ, তুমি নবদ্বীপে যাইবে, যাও। কিন্তু ভাবাবেগের বশে কোনো মত বা পথ গ্রহণ করিও না। জানিয়া, বুঝিয়া, ভালো করিয়া বিচার করিয়া তবেই অভীষ্ট পন্থা গ্রহণ করিও। নবদ্বীপে যাও, কিন্তু প্রথমে যথারীতি শাস্ত্রজ্ঞান অর্জন করো। তাহার পর নিজেকে উপযুক্ত বিবেচনা করিলে ধর্মপথে অগ্রসর হইও। আর যদি গৃহে ফিরিয়া আসা ভালো মনে করো, তবে তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আসিও।” 

কমলনয়ন কহিল, “কথা দিতেছি, তাহাই হইবে। আপনারা আশীর্বাদ করুন- আমার যেন মনস্কামনা পূর্ণ হয়।” জনকজননী পুত্রের শিরোদেশে কল্যাণহস্ত স্থাপন করিয়া আশীর্বাদ করিলেন। পিতামাতার চরণধূলি লইয়া কমলনয়ন পথে নামিল। 

কে জানিত তখন, এই পথই তাহার চিরসঙ্গী হইবে? চিরসুহৃদ, চিরশিক্ষক? কে তখন বুঝিতে পারিয়াছিল, এই পথই তাহাকে চলিষ্ণুতার মন্ত্র শিখাইবে, অভিজ্ঞতার মণিমুক্তায় পথিকের ঝুলি ভরিয়া উঠিবে, অভিজ্ঞতার দ্বারাই অভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করা সম্ভব হইবে, পথ চিনিতে চিনিতে নিজেকেও চেনা হইবে? 

কমলনয়ন নবদ্বীপের পথ জানিত না। শুনিয়াছিল, নবদ্বীপ পশ্চিমে। সে তাই পশ্চিমাভিমুখেই চলিতে লাগিল। পথে কত শস্যপূর্ণ আদিগন্তবিস্তীর্ণ ক্ষেত্র পড়িল, কত ভয়াল অরণ্য, কত নিস্তব্ধ প্রান্তর, কত খালবিলের উপর ঝুঁকিয়া পড়া বাঁশের সাঁকো, কত জনবহুল হট্ট, খামার, গ্রাম পড়িল। কৃষিক্ষেত্রে কর্ষণরত কত কৃষকের সহিত পরিচয় হইল, কত আপণিক দোকানঘর খুলিয়া প্রিয়দর্শন কিশোরকে চিঁড়া, মুড়ি, বাতাসা, জল খাওয়াইতে খাওয়াইতে তাহাদের সামান্য জীবনের রোদনবেদনের আখ্যানমালা মেলিয়া ধরিল, কত পটুয়া গান গাহিয়া কিশোরের কর্ণপুর মধুরসে দ্রাবিত করিল, সাপের খেলা দেখাইয়া বিশ্রান্ত সাপুড়ের দল দেশবিদেশে ভ্রমণের কত গল্প শুনাইল, কত ফকির-দরবেশ-সন্ন্যাসী তাহাদের অনিকেত জীবনের আশ্চর্য ঘটনাকুসুম দিয়া মধুমালতীর মালা গাঁথিয়া এই ঘরছাড়া কিশোরের সুগৌর কণ্ঠদেশে পরাইয়া দিল। কতদিন বৃক্ষতলে রাত্রি কাটিল, কখনও গৃহস্থের অতিথিশালায়, কখনো-বা কোনো ভগ্ন দেউলের চত্বরে, কিংবা কোনো নদীতীরে বালুকাবেলায় আকাশের তারা গণিয়া নিশীথ ভোর হইল, তাহার আর ইয়ত্তা নাই। দীর্ঘ পথ পার হইয়া অবশেষে কমলনয়ন বর্ষার জলভারে সমৃদ্ধ দুকূলপ্লাবী এক নদীতীরে আসিয়া উপস্থিত হইল। এই নদীর নাম মধুমতী। 

কমলনয়ন নদীর নাম জানিত না। সে কোনো প্রসিদ্ধ পথ ধরিয়া আসে নাই। প্রবল স্বপ্ন ও উৎসাহ লইয়া হাঁটিয়া চলিয়াছে, জানে না পথে নদী পড়িবে। যে-স্থানে সে উপনীত হইয়াছিল, সে-স্থানে মধুমতীর কোনো ঘাট নাই, খেয়াপারাপারের বন্দোবস্তও নাই। সম্মুখে কোনো গ্রাম নাই, নিকটে কোনো শস্যক্ষেত্রও দেখিতে পাইল না। এক বিপুলা নদীর তীরদেশে এক সহায়সম্বলহীন বালক বিমূঢ়বৎ একাকী দাঁড়াইয়া রহিল। 

এখন কী উপায়ে এই নদী পার হইয়া যাওয়া যায়? পিতার মুখে শুনিয়াছিল, সকল নারীই যেমন ভগবতী উমা, সকল নদীই তেমন সুরধুনী গঙ্গা। কমলনয়ন নদীতীরে বসিয়া গঙ্গাদেবীর নিকট পারাপারের উপায় করিয়া দিবার জন্য প্রার্থনা করিতে লাগিল। 

এক দণ্ড পর এক মৎস্যজীবী তাহার ডিঙা লইয়া নদীপথে আসিতেছে, দেখা গেল। কমলনয়নের অনুরোধে সেই মৎস্যজীবী কমলনয়নকে নদী পার করিয়া দিল। 

কেহ বলিবেন, ইহা গঙ্গাদেবীর নিকট প্রার্থনার ফল। মা গঙ্গাই কৃপা করিয়া সেই জেলেডিঙিখানি পাঠাইয়াছিলেন। কেহ-বা আধুনিক সংশয়বাদী, বলিবেন, ইহা তো কাকতালীয় ন্যায় বা প্রাকৃতিক সমাপতন অর্থাৎ ন্যাচারাল কো-ইনসিডেন্স। কমলনয়ন নদীতীরে বসিয়াছিল। আর সেই সময়েই জেলে তাহার নৌকা লইয়া গৃহে ফিরিতেছিল। ইহার ভিতর গঙ্গাদেবীর কৃপার কথা টানিয়া আনা ভক্তদিগের কল্পনা, উহার কোনো সারবত্তা নাই। 

হইবেও বা। আমরা এই বিষয়ে বিশেষ কিছুই বলিব না। কেবল বলিব, যাঁহার যেমন বিশ্বাস। জীবনের আকস্মিক ঘটনাগুলির ভিতর সম্পর্ক খুঁজিতে গিয়া কেহ ঈশ্বরে আস্থাবান হন, কেহ-বা এসকল ঘটনা এমনি এমনিই ঘটিয়াছে, বলিয়া থাকেন— উহাদের পশ্চাতে কোনো দৈব নির্দেশ আছে, ইহা মানিতে চান না। যাঁহার যেমন ভাব, তাঁহার তেমনই লাভ। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কেমন করিয়া বলি? 

যাহাই হউক, মধুমতী পার হইলেই তো আর সব হইয়া গেল না। সেস্থল হইতে নবদ্বীপ বহুদূরে। আজিকালিকার ম্যাপ বহিতে যাহা দেখি, মধুমতী হইল পদ্মার শাখানদী। উহা এখনকার বাংলাদেশের কুষ্ঠিয়া জিলার সন্নিকটে পদ্মার দেহ হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে। তখন উহার নাম গড়াই নদী। ইহাকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁহার কোমলকান্ত ভাষায় ‘গোরাই’ নামে ডাকিয়াছেন। মধুমতী পদ্মাদেহ হইতে প্রসূত হইয়া, পথিমধ্যে আজিকার বাংলাদেশের কুষ্ঠিয়া, যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, ফিরোজপুর, বরগুনা জিলা ধৌত করিয়া, প্রথমে দক্ষিণপূর্বে, পরে আবার দক্ষিণে মোট তিন শত ছয় কিলোমিটার বহিয়া গিয়া সুন্দরবনের বনান্তভূমির ভিতর দিয়া বঙ্গোপসাগরে লীন হইয়াছে। 

এক্ষণে বলিবার কথা এই, কমলনয়নের জন্মভূমি কোটালিয়া পরগনার উনসিয়া গ্রাম সেসময়ে বিক্রমপুরের অন্তঃপাতী হইলেও, বর্তমানে উহা ফরিদপুর জিলার অন্তর্গত। কাজেই কমলনয়ন যদি তাঁহার গৃহ হইতে পশ্চিমাভিমুখে যাত্রা করিয়া মধুমতী তীরপ্রাপ্ত হইয়া থাকে, সেক্ষেত্রে মধুমতী পার হইলে তাহার যশোর জিলার ভিতর প্রবেশ করিবার কথা। যশোর জিলা অতিক্রম করিয়া আজিকার বাংলাদেশের বনগাঁ জিলায় প্রবেশ করিতে হইবে। তাহার পর অধুনাতন কালের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জিলা। উত্তর চব্বিশ পরগনা জিলাকেও উৎক্রমণ করিয়া আজিকালিকার নদিয়া জিলায় আসিয়া পড়িতে হইবে। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থানসমূহের নাম পালটাইয়া যায়। ইদানীন্তন কালের স্থাননাম অনুযায়ী ভাবিতে গেলে এই ক্ষুদ্রকায় কিশোর তাহার স্বগ্রাম হইতে যে-পথ দিয়া নবদ্বীপ আসিয়াছিল, তাহার সম্ভাব্য নির্দেশিকা এইরূপ। ইহা এত দীর্ঘপথ, অথচ ইতিহাস এই পথের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা কিছুই ধরিয়া রাখে নাই। আর ধরিয়া রাখে নাই বলিয়াই আমাদিগের মনোমধ্যে কল্পনার লীলাভূমিতে কত যে প্রশ্ন উঠিতেছে! এই পথ দিয়া চলিতে চলিতে কাহাদের গৃহে তাহার আশ্রয় জুটিয়াছিল? পথিমধ্যে পিপাসা পাইলে কোন্ তড়াগ বা পুষ্করিণীতে সেই তৃষ্ণা পরিতৃপ্ত হইয়াছিল? ছায়াশূন্য মধ্যাহ্নে অসহায় কিশোর একাকী চলিয়াছে, গগন ভরিয়া মেঘ করিয়া আসিয়া কিশোরের মাথার উপর ছায়া ধরিয়াছিল কি? দীর্ঘ পথশ্রমে কিশোর কমলনয়ন যখন ঘর্মাক্ত হইয়া উঠিত, মৃদুমন্দ সমীরণ বহিয়া আসিয়া কেমন করিয়া কিশোরের শ্রান্ত ললাটে স্বেদবিন্দু সস্নেহে মুছাইয়া দিত? সে বড়ো কঠিন সময় ছিল, যখন হিন্দু রাজত্ব অবসিত হইয়া মুসলমান শাসন কায়েম হইতেছে, তখনও মুসলমান শাসকগণ সুদৃঢ় হস্তে রাজ্যশাসনের অবকাশ পান নাই। দেশে সর্বত্র অরাজকতা, পথঘাট দস্যুতস্করে পরিপূর্ণ। কমলনয়ন কি দস্যুদের হস্তে পড়ে নাই? পড়িলে ছাড়া পাইল কীরূপে? সেই দুর্গম পথে কত কী না ঘটিয়াছিল! কে তাহা আজ আর বলিবে? কত বিপদ মাথায় লইয়া কিশোর পথ চলিয়াছিল, কত জননীর স্নেহাঞ্চলে আশ্রয় পাইয়া পৃথিবীর নিঃসুপ্ত কুটিরগৃহে রাত্রিবাস করিয়াছিল, একবার ভাবিতে বসিলে অন্যতর একটা আখ্যানের পথ খুলিয়া যায়। হয়তো আমাদিগের এই সামান্য রচনার কোনো এক পাঠক বা পাঠিকা অদূর ভবিষ্যতে কোনোদিন সেই অজানিত পথে কিশোরের পদচিহ্ন কল্পনায় অনুসরণ করিয়া একটা সম্পূর্ণ নতুন উপন্যাস লিখিতে বসিবেন! কে বলিতে পারে? 

অবশেষে এই সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করিয়া কমলনয়ন নবদ্বীপে উপনীত হইল। কমলনয়নকে গঙ্গা পার হইয়া নবদ্বীপে প্রবেশ করিতে হয় নাই। কারণ, তখন গঙ্গা নবদ্বীপের পশ্চিম দিক দিয়া বহিয়া যাইত। গত পাঁচ শত বৎসরে গঙ্গার সে-গতিপথ পরিবর্তিত হইয়াছে। এখন গঙ্গা নবদ্বীপের পূর্ব দিক দিয়া প্রবাহিত। কমলনয়নের সমকালে গঙ্গা নবদ্বীপের পশ্চিমে, অর্থাৎ নবদ্বীপ গঙ্গার পূর্বকূলে অবস্থিত ছিল। কমলনয়ন পূর্ব দিক দিয়াই তো আসিতেছিল। 

নবদ্বীপে উপনীত হইয়া কমলনয়নের চক্ষে তাক লাগিয়া গেল। মনে হইল, সমগ্র নগরীটি গঙ্গাগর্ভ হইতে উঠিয়া আসিয়াছে। তাহার সেই বিস্তৃত নদীতীর, বাঁধানো গঙ্গার ঘাট, প্রশস্ত সোপানশ্রেণী, সোপানের দুই পার্শ্বে গোলাকার বুরুজ, ঘাটে কলহাস্যমুখরিত রমণীর দল, স্রোতোমধ্যে অর্ধনিমজ্জিত অবস্থায় জপনিরত ব্রাহ্মণকুল, সোপানের উপর ক্রীড়াচঞ্চল বালকদিগের চপলতা, তীরে শাস্ত্রীয় বিচারনিরত স্থুল বপু সশিখ পণ্ডিতকুল, গাত্রে সাহ্লাদে তৈলমর্দন করিয়া মল্লবীরগণ ক্রীড়াচ্ছলে মল্লযুদ্ধ করিতেছে, দূর দেশ হইতে অর্ণবপোত ভাসিয়া আসিতেছে, জেলেরা জেলেডিঙি লইয়া স্রোতোপরি সুদূর দিগন্তে ভাসিয়া যাইতেছে, কোলাহল- কথকতা-আলাপ-উল্লাপনের আর বিরাম নাই। গ্রামীণ কিশোর কমলনয়নের নিকট সমস্ত নগরীটিকে যেন শব্দময় একখানি আলেখ্যের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। এ নগরীর রাজপথগুলি কিন্তু সংকীর্ণ, দুই পার্শ্বে আপণশ্রেণী, সেখানে লক্ষ তঙ্কার আদানপ্রদান চলিতেছে। পথিপার্শ্বে নাটশালা, চতুষ্পাঠী বা পণ্ডিতদিগের টোল, কোথাও কোথাও সুসজ্জিত দেবদেউল, নাগরিকদিগের সৌধ বাসভবন, কোনো কোনো গৃহের চূড়ায় অলংকৃত ধাতু-কলস, গৃহগুলির দ্বারপথে কারুকার্যমণ্ডিত দ্বারকবাট, জনবহুল নগরপথ, কেহ পদব্রজে, কেহ অশ্বারূঢ়, কেহ-বা শকটারূঢ় হইয়া চলিয়াছে–এ যেন একটা শব্দিত চিত্রপট, মুহুর্মুহু যাহার রেখা ও রং পালটাইয়া যাইতেছে। 

প্রাথমিক মুগ্ধতা কাটিয়া গেলে কমলনয়ন শ্রীগৌরাঙ্গের সন্ধানে প্রবৃত্ত হইল। এক বৃদ্ধকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করিলে তিনি বলিলেন, “তোমাকে আরও দক্ষিণে যাইতে হইবে। এ নগরীর দক্ষিণে মিঞাপুর নামক যে-অঞ্চল আছে, সেখানেই তুমি তোমার অভীষ্টের সন্ধান পাইবে।” 

মিঞাপুর? মায়াপুর নহে? না, মায়াপুর কী করিয়া বলি? কমলনয়নের সমকালে স্থানটির নাম মিঞাপুরই ছিল। উহা নবদ্বীপের মুসলমান অধিকৃত অঞ্চল। কিন্তু পরবর্তীকালে মহাপ্রভুর জন্মস্থানটিকে মুসলমানি নামে অভিহিত করিতে তাঁহার জীবনচরিতকারগণ দ্বিধা অনুভব করিয়াছিলেন। তাঁহারা উহার নাম সামান্য পরিবর্তিত করিয়া লিখিলেন—’মায়াপুর’। এই নাম পরিবর্তন যে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার ফলাফল, তাহা আর বলিতে হইবে না। 

পথের সন্ধান পাইয়া কমলনয়নের পথশ্রান্ত চরণও যেন পাখির ডানা পাইল। সে ত্বরিতে মিঞাপুরে উপস্থিত হইল। কিন্তু সেস্থলে পৌঁছাইয়া কমলনয়নের চক্ষে সবই যেন অন্যরকম ঠেকিল। 

সমস্ত পল্লীটি যেন বিষাদে পরিপূর্ণ, কীসের যেন শোকভারে গৃহগুলি মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া আছে। পথে লোক চলিতেছে না, সকলেই নিম্নস্বরে কথা বলিতেছে, বালকবালিকাদিগের ক্রীড়াশব্দ পর্যন্ত নাই। গৃহদ্বারগুলি অবরুদ্ধ, মন্দিরে ‘নমো নমো’ করিয়া পূজা সারিয়া বিপ্রগণ নিঃশব্দে সরিয়া গিয়াছেন। আকাশে কালো মেঘ করিয়াছে, কী এক দুর্নিবার শোকে কৃষ্ণ মেঘখণ্ডসমূহ মিঞাপুরের আকাশে ভারি হইয়া আছে, প্রবল শক্তি দিয়া উচ্ছ্বসিত অশ্রুর ভার কে যেন দশমণি পাথরের ন্যায় বুকের মধ্যে চাপিয়া রাখিয়াছে, রাস্তাগুলিতেও কয়েক বৎসর যেন ঝাঁট পড়ে নাই— এখানে বস্তুত কী হইয়াছে? 

ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়া কমলনয়ন এক গৃহস্থের দ্বারপথ উন্মুক্ত দেখিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত এ গৃহের প্রশস্ত অঙ্গন নিঃশব্দ হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। চারিপাশে কুন্দপুষ্পের ঝাড়, শ্বেত কুসুমে গুল্মগুলি ভরিয়া আছে, কতদিন যেন সেই ফুলবন হইতে কেহ পুষ্পচয়ন করে নাই। 

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিবার পর এক বয়স্ক ব্যক্তি গৃহাভ্যন্তর হইতে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া আসিলেন। তাহার পরনে একখানি খাটো ধুতি ও গাত্রে একটি উড়ানি। শিরোদেশে কেশ ছোটো করিয়া ছাঁটা, কণ্ঠে একগাছি তুলসী কাঠের মালা। অতি ক্ষীণস্বরে বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে? কোথা হইতে আসিতেছ?” 

কমলনয়ন তাহার জাতনামে পরিচয় দিয়া কহিল, “আমার নাম মধুসুদন। এখান হইতে বহুদূরে অবস্থিত কোটালিপাড়ার উনসিয়া গ্রাম হইতে আসিতেছি। মহাশয়ের পরিচয়?” 

বৃদ্ধ কহিলেন, “অধীনের নাম শ্রীবাস। কী উদ্দেশে এ স্থলে আসা হইয়াছে?”

কমলনয়ন উত্তর দিল, “আমি শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর চরণদর্শনের মানসে এত পথ হাঁটিয়া আসিতেছি।” 

‘শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু’ নামটি উচ্চারণ করিবামাত্রই বৃদ্ধের চক্ষু হইতে সহসা অনুরাগাশ্রু নিপতিত হইতে লাগিল। কমলনয়ন দেখিল, অশ্রুজলে বৃদ্ধের গণ্ডদেশ ভাসিয়া যাইতেছে। কিছুক্ষণ পর কথঞ্চিৎ শান্ত হইয়া নিতান্ত করুণ স্বরে শ্রীবাস বলিতে লাগিলেন, “ও নাম তুমি উচ্চারণও করিও না। ওই নাম শুনিলে আমার প্রাণ বাহির হইয়া আসিতে চায়।” তাঁহার আয়ত চক্ষুদুইটি বিস্ফারিত, আরক্তিম হইয়া আছে। 

কমলনয়ন বলিল, “কোথা গেলে তাঁহার সন্ধান পাইব? তিনি এখন কোথায় আছেন?” 

শ্রীবাস কিছু কহিলেন না। কেবল কাষ্ঠমূর্তির ন্যায় স্থির হইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলেন। তাহার পর কম্পিত কণ্ঠে হৃদয় নিংড়াইয়া, সেকি সুর, নাকি ক্রন্দন বুঝা গেল না, গাহিতে লাগিলেন- 

“হরি গেল মধুপুরী, হাম্ কুলবালা, 
বিপথ পড়ল সই! মালতীর মালা…” 

এ আকুল উচ্ছ্বাসের কারণ কী কমলনয়ন জানিত না। না জানিলেও, কী আশ্চর্য, সে তাহার হৃদয়াবেগ ধরিয়া রাখিতে পারিল না। না-বুঝিয়াই সে বৃদ্ধ শ্রীবাসের হস্ত ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল! 

কিছু পরে সে বিমূঢ় স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “কী হইয়াছে? আমরা এমন কাঁদিতেছি কেন?” 

শ্রীবাস হাহাকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “সে পলাইয়া গিয়াছে। ফাঁকি দিয়া পলাইয়া গিয়াছে। এই অঙ্গনে কত দিন, কত রাত্রি সে সংকীর্তনে মাতিয়া আমাদিগকে মাতাইয়াছিল। বাহ্যজ্ঞান থাকিত না। কৃষ্ণনাম লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিত, একবার এই নাম করো। আমি তোমাদিগের চিরদাসী হব। মূর্ছিত হইয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িত। কতবার সমাধিমগ্ন সে পরমপবিত্র সোনার দেহ আমি কোলে তুলিয়া নাম শুনাইয়াছি। আর এখন বহু বৎসর সে প্রেমের হাট ভাঙিয়া গিয়াছে। সব শেষ হইয়া গিয়াছে।” 

কমলনয়ন সভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, “মহাপ্রভুর কী হইয়াছে?” 

শ্রীবাস দ্রাবিত স্বরে বলিলেন, “কতদিন হইল, এক রাত্রে সে গৃহত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হইয়া চলিয়া গেল। আর কখনও ফিরিবে না। জননী শচীদেবীর আকুল ক্রন্দন, গৃহলক্ষ্মী বিষ্ণুপ্রিয়ার মর্মান্তিক শোকসংবেগ তাহাকে বাঁধিয়া রাখিতে পারিল না। সেই হইতে নন্দপুর চন্দ্র বিনা এ নবদ্বীপ, এ নব-বৃন্দাবন অন্ধকার হইয়া গিয়াছে।” কমলনয়ন ব্যগ্র স্বরে প্রশ্ন করিল, “কোনদিকে গেলেন? এক্ষণে কোথায় আছেন?”

“সন্তরণে গঙ্গা পার হইয়া কাটোয়ায় যাত্রা করিয়াছিল, শুনিয়াছি। সেখানে চাঁচর কেশ মুড়াইয়া কেশব ভারতীর নিকট হইতে সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছিল। সন্ন্যাস গ্রহণান্তর তাহার নাম হইয়াছিল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। আবাল্য যাহাকে আমরা ‘নিমাই’ বলিয়া ডাকিয়া আদর করিয়াছি, প্রাণের ‘গোরা’ বলিয়া যাহাকে বুকে তুলিয়া লইয়াছি, সে আমাদের ফাঁকি দিয়া কী বিচিত্র সংস্কৃত নাম লইয়া হৃদয় কঠিন করিয়া সন্ন্যাস লইল,” শ্রীবাসের কথা পুনরায় ক্রন্দনের ভিতর ডুবিয়া গেল। 

কমলনয়ন এইবার আকুল হইয়া কহিল, “আচ্ছা, আমি যদি কাটোয়া যাই? তবে তো সেখানে তাঁহাকে পাইব?” 

শ্রীবাস মুখ তুলিয়া কহিলেন, “সে উপায় কি আর রেখেছে? কাটোয়া নবদ্বীপের অপর পারে, অতএব কাটোয়ায় থাকিলে সে গৃহ, স্বজন, বন্ধুগোষ্ঠীর সংবাদ পাইত। তাহা সে চাহিল না। আমাদিগের সহিত সে সকল সংশ্রব ছিন্ন করিতে চাহিল। সেইজন্য, সংবাদ পাইয়াছিলাম, সে শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে যাত্রা করিয়াছিল। কোন্ পথে গেল, কেহ জানে না। এক্ষণে শ্রীক্ষেত্রেই অবস্থান করিতেছে শুনিতে পাই।” 

এই কথা শুনিয়া কমলনয়নের মস্তকে যেন আচম্বিতে বজ্রাঘাত হইল। যাঁহার জন্য এত পথ শ্রমস্বীকার করিয়া হাঁটিয়া আসিয়াছে, তাঁহার দর্শন পাইবে না, ভাবিতেই কমলনয়নের মন যেন হতাশার অন্ধকারে পরিপূর্ণ হইল। 

তথাপি কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “এই গৃহই কি আপনার আবাসস্থল?” 

রোরুদ্যমান শ্রীবাস বলিলেন, “ইহা আমার সাত পুরুষের ভিটা। কিন্তু নিমাই সন্ন্যাস লইবার পর তাহার বিরহজুরে সত্তপ্ত হইয়া নবদ্বীপ হইতে কুমারহট্ট উঠিয়া গিয়াছি। কুমারহটেও বেশিদিন টিকিতে পারি না। কয়েকদিন পরপর এ গৃহাঙ্গন দেখিবার বড়ো সাধ হয়। এখানে সে কত লীলা করিয়াছে! তাই আসিয়াছি। আবার দুই-একদিন পর কুমারহাটিতে ফিরিয়া যাইব।” 

কমলনয়ন দেখিল, শ্রীবাস তাঁহার গৃহের বাঁশের খুঁটিটি ধরিয়া আকুল হইয়া কাঁদিতেছেন। তাঁহার আর কোনো হুঁশ নাই, কমলনয়ন যে তাঁহারই সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে, সে-বোধও নাই। কমলনয়ন বুঝিল, এখানে আর তাহার থাকিবার কোনো প্রয়োজন নাই। সে নিতান্ত ক্ষিগ্নমনে শ্রীবাসের অজ্ঞতাসারে সেই গৃহাঙ্গনের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। 

সকলই শূন্য হইয়া গিয়াছে। যে-দুর্মর আবেগে সে পিতামাতাকে কাঁদাইয়া গৃহ পরিত্যাগ করিয়া পথে নামিয়াছিল, প্রভূত কষ্ট স্বীকার করিয়া দীর্ঘ, দুর্গম পন্থা অতিক্রম করিয়াছিল, আজ তাহা সম্পূর্ণ বিফল হইল। তাহার ন্যায় নিতান্ত অভাগা জগতে বুঝি আর নাই। তাই তাহার সেই পরম দয়াময়ের চরণে স্থান হইল না। কমলনয়ন লক্ষ্যহীনভাবে মিঞাপুরের পথে পথে একাকী ভ্রমিতে লাগিল। 

বিদ্যুচ্চমকের মতো শুধু একবার মনে পড়িল, চন্দ্রদ্বীপের অতিথিশালায় বনমালী বাউল বলিয়াছিল বটে, ‘ইদানীং তাঁহার দেখা পাওয়া বড়ো কঠিন।’ হায়! সে-কথার অর্থ কমলনয়ন তখন যদি বুঝিত! 

মন হতাশ হইলেও শ্রীমন্ মহাপ্রভুর লীলাস্থানগুলি ইহাকে উহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া কমলনয়ন একবার দর্শন করিয়া লইল। সেই গঙ্গাতীর, যেখানে নিমাই বাল্যকালে খেলা করিতেন, শৈশবে কত মিষ্ট উপদ্রবে স্থানীয় জনসাধারণকে উত্যক্ত করিয়া ফিরিতেন; গঙ্গাদাস পণ্ডিতের সেই টোল, যেখানে কৈশোরকালে তিনি শাস্ত্রাধ্যয়ন করিয়াছিলেন; মুকুন্দসঞ্জয়ের গৃহ, যেখানে টোল খুলিয়া তরুণ যুবক নিমাই পণ্ডিত নিজে অধ্যাপনা করিতেন; নদীর যে-ঘাটে তিনি কেশব কাশ্মীরী নামক দিগবিজয়ী পণ্ডিতের সহিত তর্কযুদ্ধ করিয়া উক্ত পণ্ডিতের দর্পনাশ করিয়াছিলেন; সেইসব নগরপথ, যাহা অবলম্বন করিয়া শ্রীগৌরাঙ্গ, তাঁহার পার্ষদ নিত্যানন্দ, শ্রীবাস, অদ্বৈতাচার্য, হরিদাস প্রভৃতিকে সঙ্গে লইয়া শত শত জনতার মধ্যমণি হইয়া নিশাকালে গোরাই কাজির নির্দেশ অমান্য করিয়া নগরসংকীর্তনে মাতিয়া উঠিয়াছিলেন; সেই স্থান, যেখানে দুর্দমনীয় জগন্নাথ ও মাধবকে প্রেমের মন্ত্রে জয় করিয়াছিলেন; সেই সকলই একভাবে রহিয়াছে— শুধু যাহাকে কেন্দ্র করিয়া এই প্রেমের হাট বসিয়াছিল, সেই সোনার গোরা আজ কোথাও নাই। তিনি চলিয়া গিয়াছেন দুর্লক্ষ্য সন্ন্যাসে, কেহ তাঁহার পদচিহ্নের উপাখ্যান জানে না। কমলনয়ন একবার শ্রীগৌরাঙ্গের পিতৃগৃহও দর্শন করিল, মৃত্তিকানির্মিত ক্ষুদ্র বাটিকাটি অপরাহ্ণে অস্তরাগ মাখিয়া দাঁড়াইয়া আছে, গৃহদ্বার উন্মুক্ত, সন্ধ্যামালতীর ফুল সে-গৃহের দেহলিতে অজস্র ফুটিয়া উঠিয়া সুমিষ্ট সুবাসে বাতাস বিরহবিধুর করিয়া তুলিয়াছে, সে-গৃহের প্রাঙ্গণে কাহাকেও দেখা গেল না, অর্গলবদ্ধ একটি কক্ষে শচীমাতা হয়তো পুত্রবিরহে হতচেতন হইয়া পড়িয়া আছেন। অন্য আর-একটি কক্ষে বাতায়নের পার্শ্ব হইতে যেন এক শীর্ণা ছায়া সরিয়া গেল, পতিবিচ্ছেদকাতরা বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী বুঝি ওই ছায়ারই ন্যায় আজ নিঃশব্দ পদসঞ্চারিণী জীবনৃতা হইয়া কোনোমতে বাঁচিয়া রহিয়াছেন… কাহারও দর্শন মিলিল না, সব পথ ঘুরিয়া ফিরিয়া এক অব্যক্ত হাহাকার বুকের ভিতর ভরিয়া কমলনয়ন গঙ্গাতীরে আসিয়া ঘাটের রানার একপার্শ্বে নিরুদ্যম চিত্তে বসিয়া পড়িল। 

গঙ্গাবক্ষে তখন এক আশ্চর্য সূর্যাস্ত হইতেছিল, পৃথিবীর অন্য কোনো দিগন্তে হয়তো তখনই অন্য এক সূর্যোদয়…. 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *