পনেরো
হে কমলনয়ন! তুমি বাতায়নপার্শ্বে বসিয়া শান্ত চিত্তে আনতগ্রীব হইয়া শাস্ত্র রচনা করিতেছ। তুলট কাগজের উপর মুক্তার ন্যায় অক্ষরের পাঁতি ফুটিয়া উঠিতেছে। পাঁচশত বর্ষপূর্বের দিনান্তবেলা গবাক্ষের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। আর পাঁচশত বর্ষের পরপার হইতে আমি, তোমার বিকল্প জীবনবৃত্তের লেখক, তোমাকে লক্ষ করিতেছি। তোমার শিরোদেশে কুন্তলরাশির ভিতর গঙ্গার বাতাস খেলা করিতেছে। তোমার উজ্জ্বল চক্ষু পুথির পাতায় সন্নত হইয়া রহিয়াছে। মধ্যে মধ্যে কী যেন ভাবিতেছ! দার্শনিক চিন্তার কূটপ্রশ্ন তোমার ভূযুগে কম্পন তুলিয়া মিলাইয়া যাইতেছে। তোমার অন্তরের কবিত্বশক্তি শব্দগুলিকে স্নান করাইতেছে, পরিধান পরাইতেছে। মসীপাত্রে বারংবার লেখনী ডুব দিতেছে, আবার উঠিয়া আসিয়া খসখস শব্দে বাক্য রচনা করিতেছে। তোমাকে আমি দেখিতেছি আর ভাবিতেছি।
ভাবিতেছি, তুমি কী ছিলে, আর কী হইলে। কবি, ভক্ত নৈয়ায়িক—কিছুই তোমার হওয়া হইল না। প্রতিবার লক্ষ্য সম্মুখে আসিয়া শেষ মুহূর্তে ফিরিয়া চলিয়া গিয়াছে। শেষে তোমার মস্তিষ্কের ভিতর ন্যায়দর্শন ও বেদান্তদর্শনের প্রবল স্নায়ুযুদ্ধ চলিতেছিল। কী উপায়ে সে-দ্বন্দ্ব মিটাইবে, ভাবিয়া পাইতেছিলে না। এমন সময়ে তোমার চক্ষের সম্মুখে গঙ্গার ঘাটে নারকীয় হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হইল। এই দুর্ঘটনার আঘাতে প্ৰহত হইয়া তুমি তোমার পথ খুঁজিয়া পাইলে। দেখিলে, ন্যায়শাস্ত্র তোমাকে সাহসী করে নাই: বেদান্তের ভিতরেই অভয়ের মন্ত্র শুনিতে পাইলে। নৈয়ায়িক কমলনয়ন বৈদান্তিক কমলনয়ন হইতে চলিল।
ভালো কথা! কিন্তু ভাবিয়াছ কি, সেদিন গঙ্গার ঘাটে ওইরূপ যদি না ঘটিত, তাহা হইলে কী হইত? যে-যন্ত্রণা তোমার মাথার ভিতর হইতেছিল, দুর্ঘটনা না ঘটিলে, তাহার উপশম এত সহজে হইত না। তখন তুমি কী করিতে? সে-যন্ত্রণা লইয়া কোথায় যাইতে?
ভাবিতে ভাবিতে আর-একটা গল্পের কুয়াশা, আর-একটা সম্ভাবনার দুয়ার খুলিয়া যাইতেছে। চোখের সম্মুখে তুমি নও, কিন্তু তোমারই সদৃশ আর-একটি চরিত্র ফুটিয়া উঠিতেছে। ধরো, তাহার নাম ‘কমলনয়ন’ নয়, তাহার নাম ‘উৎপলদৃষ্টি’। সেও তোমারই ন্যায় বিক্রমপুরে উনসিয়া গ্রামে জন্মিয়াছিল। স্থানীয় রাজসভায় তোমারই ন্যায় কাব্যপাঠ করিতে গিয়া রাজার মনোযোগ আকর্ষণ করিতে পারে নাই। তোমারই ন্যায় সেও নবদ্বীপ যাত্রা করিয়াছিল, কিন্তু মহাপ্রভুর দেখা পায় নাই। এমনকি তোমারই মতন সেও ন্যায়শাস্ত্র পাঠ করিয়া কাশী আসিয়াছিল, ছদ্মপরিচয়ে বেদান্তপাঠ করিতেছিল। এ পর্যন্ত তোমার সহিত সে সম্পূর্ণ এক! কিন্তু ইহার পর হইতেই সে তোমা হইতে আলাদা হইয়া পড়িয়াছে। তুমি যেমন কাশীর ঘাটে পুণ্যার্থীদিগের উপর আততায়ীদের আক্রমণ প্রত্যক্ষ করিয়া জীবনসমস্যার একপ্রকার সমাধান খুঁজিয়া পাইলে, তাহার জীবনে এমন কিছুই ঘটে নাই। মনে পড়ে কি সেদিন গঙ্গার ঘাটে আততায়ীদের আক্রমণের পূর্বে কী ঘটিয়াছিল? তোমার সতীর্থ অদ্বয়ানন্দ কেদারঘাটের বিচারসভায় যাইবার জন্য তোমাকে আহ্বান করিয়াছিল। তুমি যাও নাই। কিন্তু যদি ধরো, এইরূপ হইত—
সতীর্থ অদ্বয়ানন্দ প্রশ্ন করিল, “আজ কেদারঘাটে কর্ণাট দেশ হইতে এক নৈয়ায়িক আসিয়াছেন। তাঁহার সহিত কাশীর বেদান্তসেবী পণ্ডিতদিগের বিচার হইবে। বিচারসভা দেখিতে তুমি সেখানে যাইবে নাকি, বন্ধো?”
ধরো, তুমি নও, কিন্তু তোমার অপর প্রতিকৃতি উৎপলদৃষ্টি ইহাতে উত্তর দিল, “বেশ তো! চলো, যাই। বড়ো শিরঃপীড়া হইতেছে। দেখি বিচার শুনিয়া যদি এ মাথার বেদনা উপশম হয়!” তাহা হইলে ইহার অব্যবহিত পরে ওইরূপ কোনো আকস্মিক আক্রমণের ঘটনাই তাহার সম্মুখে হইত না। ফলত, নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সম্মুখে দাঁড়াইয়া তুমি যেরূপ তোমার জীবনসমস্যার একপ্রকার সমাধান খুঁজিয়া পাইয়াছিলে, উৎপলদৃষ্টি সে-সুযোগ পায় নাই। বিচারসভা দর্শন করিয়া অবশ্য . তাহার শিরঃপীড়া উপশম হয় নাই, বরং সংকট প্রবর্ধিত হইয়াছিল। ন্যায়দর্শন ও বেদান্তদর্শনের কূট দ্বন্দ্ব লইয়া তাহাকে দীর্ঘকাল উত্তপ্ত মস্তিষ্কে উন্মত্তবৎ ঘুরিয়া বেড়াইতে হইয়াছিল। ধরিয়া লও, এ পরিচিত বিশ্বে নহে, অন্য এক সমান্তরাল বিশ্বে। সেখানেও গঙ্গা আছে, কাশী আছে, ন্যায়দর্শন আছে, বেদান্ত আছে। এ বিশ্বে যাহা কিছু, সে-বিশ্বে তাহার সবই অবিকল আছে। শুধু কমলনয়ন সেখানে নাই, তাহার পরিবর্তে উৎপলদৃষ্টি সেই বিশ্বে লীলা করিতেছে।
উৎপলদৃষ্টি কিছুতেই দার্শনিক সমস্যা মিটাইতে পারিতেছে না। যত ভাবিতেছে, ততই নূতনতর সমস্যায় জড়াইয়া পড়িতেছে। বেদান্তের হস্তে ন্যায়দর্শনের প্রবল পরাজয় হইতেছে দেখিয়াও সে নিজের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বশবর্তী হইয়া ন্যায়মত পরিত্যাগ করিতে পারিতেছিল না। ফলত, প্রভূত শিরঃপীড়া হইতেছিল। ন্যায়দর্শন ছাড়িয়া দেওয়া মানে নিজের ব্যক্তিত্বের বিলোপ; অবার বেদান্তদর্শন অস্বীকার করার অর্থ সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা। সে-সমস্যা যে কীরূপ, কী ভয়ংকর অন্তর্দহনের, তাহা যে না প্রাণে প্রাণে অনুভব করিয়াছে, সে বুঝিবে না। সাধারণ লোকের নিকট দর্শনচিন্তা কতগুলি মানব মস্তিষ্কের খেয়াল মাত্র; কিন্তু ওইগুলি যাহার নিকট জীবন- মরণ সমস্যা হইয়া দাঁড়ায়, তাহার নিকট এ জাতীয় দ্বন্দ্ব অস্তিত্বের ভিত্তিভূমিকে ধরিয়া এমন সমূলে নাড়া দেয় যে, প্রাণসংশয় হইয়া পড়ে।
উৎপলদৃষ্টিও ওই সমস্যায় পীড়িত হইয়া উন্মত্তপ্রায় হইল। তাহার আহারবিহারের কোনো নিয়ম রহিল না। খ্যাপার ন্যায় গঙ্গার ঘাটে ঘুরিয়া বেড়ায়। কাহারও সহিত কথা কহে না। সর্বদা অন্তর্মুখ হইয়া কী যেন ভাবিতে থাকে। মাঝে মাঝে রামতীর্থের আশ্রমেও ফিরিয়া যায় না। গঙ্গার কোনো একটা ঘাটের রানার উপর কিংবা পরিত্যক্ত কোনো মন্দিরের চাতালে শুইয়া বিনিদ্র রাত্রি অতিবাহিত করে। মাথার চুলে জটা পড়িয়াছে, শ্মশ্রুগুম্ফ ক্ষৌরির অভাবে অযত্নবর্ধিত হইয়াছে। অমন পদ্মের ন্যায় চক্ষু কোটরাগত হইয়া পড়িয়াছে। উদ্যত হনু ছাপাইয়া খড়্গগের ন্যায় নাসিকা সমুদ্যত হইয়া উঠিয়াছে। চক্ষের মণি হইতে একটা নীল অস্বচ্ছন্দ দীপ্তি বাহির হইয়া আসিতেছে। তাহাকে দেখিলে ভয় হয়, মধ্যে মধ্যে তাহাকে বড়ো কঠিন মানুষ বলিয়া মনে হয়।
কী, কেমন শুনিতেছ? ও কমলনয়ন! ইহা তোমার জীবন নহে গো! ইহা এক অন্য জীবন! তুমি বৈদান্তিক হইয়া মনোব্যথার সুষ্ঠু সমাধান না পাইলে যাহা হইতে, এ উৎপলদৃষ্টি তাহাই। সে তোমার জীবনের উলটা পিঠ। তাহার কথা তুমি কল্পনাও করিতে পারো না। তুমি শাস্ত্র, ভাষ্য, টীকা লিখিতেছ; লিখিয়া যাও। কিন্তু আমি তোমার পরিত্যক্ত জীবন লিখিব। উৎপলদৃষ্টিই তোমার সেই পরিত্যক্ত জীবন। তোমার কথা ইতিহাসগ্রন্থে সমুজ্জ্বল শব্দে লিখিত আছে, কিন্তু তাহার গল্প কেহ লেখে নাই। উৎপলদৃষ্টি তাহার জীবনের গল্প লইয়া ইতিহাস পুথির বর্জিত পৃষ্ঠার অংশ হইয়া দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। আমি সেই পুথির বর্জিত পৃষ্ঠাগুলি খুঁজিয়া বাহির করিব, তাহাদের অবলুপ্তপ্রায় অক্ষররাশি খনন করিয়া ভুলিয়া যাওয়া উৎপলদৃষ্টির জীবনবৃত্তকে তুলিয়া আনিব।
উৎপলদৃষ্টি ঘাটের উপর বসিয়া থাকে, গঙ্গার পানে শূন্যদৃষ্টি মেলিয়া চাহিয়া থাকে। তাহার চাহনিতে আর সাড় নাই। একদিন কত কবিকল্পনা তাহার এই দুই চোখের ভ্রমর পঙ্ক্তিবৎ নেত্ররোমে কম্পন তুলিত—এখন তাহা নিথর। একদিন প্রেমাভক্তির আবেশে এই দুই চোখ নবাঙ্কুভারে নম্র দূরবিলম্বিত মেঘপদবীর ন্যায় আনত হইয়া থাকিত—এখন তাহা শুষ্ক। একদিন ন্যায়শাস্ত্রের কূটসমস্যা সমাধান করিয়া তাহার এই দুই চোখে মেধাদীপ্তি বিদ্যুতের শিখার মতো নাচিয়া উঠিত—এখন তাহা নির্বোধ, অস্বচ্ছ। রৌদ্রের প্রখর তাপের ভিতর জগতের যাবতীয় অর্থহীনতা লইয়া উৎপলদৃষ্টি বসিয়া আছে। শুষ্ক তর্কের চিতাকাঠ জ্বলিতেছে, দর্শনচিন্তা তাহার সর্বনাশ করিয়া দিয়াছে।
একদিন কী জানি কী হইল; রৌদ্রদগ্ধ মধ্যাহ্নে বোধহয় রবিখরতাপ অসহা হওয়াতে সে সোপান বাহিয়া গঙ্গায় নামিয়া গেল। স্নানার্থী-স্নানার্থিনীদের ভিড় পার হইয়া ভরা গঙ্গার উপর গিয়া চিত হইয়া ভাসিয়া রহিল। উপরে সূর্য কিরণ দিতেছে, গঙ্গার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঊর্মিশিশুগুলি অস্ফুট শব্দ করিয়া বহিয়া যাইতেছে, দুই পাশে তীরভূমি বর্ষিয়সী রূপসীর ন্যায় চরের উপর হাত-পা এলাইয়া শুইয়া আছে, চৈত্র- আকাশের দুর্নিরীক্ষ উচ্চতায় পাখিগুলা চক্রাকারে ঘুরিতেছে, সান্দ্র মেঘ জলভারে স্থির হইয়া আছে, নদীর বক্ষ হইতে তাপতরঙ্গ থরোথরো ব্যাকুলতায় শূন্যপানে উঠিতেছে, জগতে যেন কেহ কোথাও নাই।
কতক্ষণ জলের উপর উৎপলদৃষ্টি পড়িয়া আছে জানে না, এমন সময়ে কোথা হইতে একটা সুর আসিয়া তাহার কর্ণে প্রবেশ করিল। বাঁশির সুর। কোথা হইতে আসিতেছে, প্রথমে সে বুঝিতে পারিল না। সেই সুরটা যেন চরাচরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজিতেছে। মনে হইল, তাহার প্রতিটি কোষে উহা কম্পিত হইতেছে। সহসা উৎপলদৃষ্টি টের পাইল, মাথার সেই যন্ত্রণাটা আর নাই, কেহ যেন তাহার মস্তিষ্কের উপর কোমল শীতল শান্ত করস্পর্শ বুলাইয়া দিতেছে। দ্রব্য, গুণ, সামান্য, সমবায়, ব্ৰহ্ম, আত্মা, অবিদ্যা—যাহা কিছু দার্শনিক পরিভাষা মাথার ভিতর সর্বদা জট পাকাইতেছিল, সেসকল সবই যেন স্মৃতি হইতেও আচম্বিতে মুছিয়া যাইতেছে। শুধু স্থির আনন্দের একটি বোধ সমস্ত সত্তাকে অধিকার করিয়া বসিতেছে।
কী যে হইল, হৃদয়ে প্রবল আকর্ষণ অনুভূত হইতেছে। কে এমন বাঁশি বাজায়? কে সে? সে কি তাহার পীড়া জানে? না জানিলে উপশম করে কীভাবে? জলের উপর উপুড় হইয়া কিয়দ্দুর বুকসাঁতার দিতে দিতে উৎপলদৃষ্টি দেখিল, গঙ্গার মধ্যস্রোতের উপর দিয়া একটা নৌকা যাইতেছে। সে সর্বশক্তি দিয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া বলিয়া উঠিল, “ভো, ভো কাণ্ডারি, নাও থামাও, চলিয়া যাইও না!” কিন্তু নৌকা তাহার কথায় কর্ণপাত না-করিয়া অনুকূল স্রোতে চলিতেই লাগিল।
তাহার মনে হইল, এ সুর কোথা হইতে আসিতেছে, কে বাজাইতেছে, না জানিলে সে আর বাঁচিবে না। তাহার পীড়া তাহাকে গ্রাস করিয়া লইবে। এই সুরই তাহার রোগের একমাত্র ঔষধ। আরও সাঁতরাইয়া সে নৌকার সমীপবর্তী হইল। দেখিল, চারি মাল্লার এক বড়ো আকারের নৌকা যাইতেছে, তাহার উপর ছাউনির নীচে বসিয়া এক বৃদ্ধ বাঁশি বাজাইতেছেন। সে মাল্লাদিগকে তাহাদের নৌকায় তুলিয়া লইবার জন্য অনুনয় করিতে লাগিল। প্রথমে মাঝিরা রাজি হইতেছিল না, কিন্তু বৃদ্ধের সম্মতিসূচক চক্ষের ইঙ্গিতে তাহারা উৎপলদৃষ্টিকে নৌকায় তুলিয়া লইল। নৌকা একবার একটু কাত হইয়া আবার সোজা হইল। উৎপলদৃষ্টি দেখিল, বৃদ্ধ কোনো খানদানি মুসলমান, গলা হইতে পা পর্যন্ত কালো আলখাল্লা পরা, মাথায় বস্তুনির্মিত সাদা ফেজ টুপি, চক্ষু নিমীলিত, বুকের উপর শ্বেত শ্মশ্রুর ভার ঢলিয়া পড়িয়াছে। দুই হস্তদ্ধৃত বাঁশরীতে তিনি সম্পূর্ণ তন্ময় হইয়া বাজাইতেছেন। পার্শ্বে একজন যুবক মৃদঙ্গে তাল রক্ষা করিতেছে।
উৎপলদৃষ্টি মুগ্ধ হইয়া সুর শুনিতেছিল। তাহার গাত্র সিক্ত, চক্ষু আরক্ত, নয়নের কোণ দিয়া অজান্তেই অশ্রুবিন্দু বাহির হইয়া আসিল। কতক্ষণ পর বাঁশি শমে আসিয়া থামিল, কিন্তু ভাবজগৎ হইতে উৎপলদৃষ্টি তখনই নিষ্ক্রান্ত হইতে পারিল না। কিছুকাল পরে সে তাহার দুইটি ব্যগ্র নয়ন মেলিয়া ধরিয়া বিহ্বল ব্যাকুল হইয়া বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিল: “এ সুর কোথা হইতে আসে?”
বৃদ্ধ স্মিতগম্ভীর স্বরে বলিলেন, “বাঁশিকে জিজ্ঞাসা করো। বাঁশি উত্তর দিবে, আমি শুষ্ক বেণুদণ্ড, আমি সুরের কিছু বুঝি না। বাতাস সব জানে।”
উৎপলদৃষ্টি বলিল, “আর যদি বাতাসকে জিজ্ঞাসা করি?”
বৃদ্ধ বলিলেন, “বাতাস বলিবে, আমি তো একটুখানি হাওয়া। আমি সুরের খবর রাখি না। মুরলীর রন্ধ্রে যে ফুৎকার দিতেছে, দেখ, সে যদি কিছু বলিতে পারে!”
“তবে বংশীবাদককেই জিজ্ঞাসা করি। সুর কোথা হইতে আসিতেছে?”
“চল্লিশ বৎসর এই বাঁশুরির সাধনা করিতেছি। আজও জানিতে পারিলাম না, সুর কোথা হইতে আসে। ইহা তো আমার সৃষ্টি নয়। ইহা নিশ্চয়ই খোদার আরশ হইতে নামিয়া আসিতেছে। আমিও তাহাকেই খুঁজিতেছি। তুমিও কি সুরের ভিতর দিয়া তাহাকে খুঁজিতে চাও? বাঁশি শিখিবে?”
উৎপলদৃষ্টি সোল্লাসে কহিল, “শিখিব!”
বৃদ্ধ বলিলেন, “বেটা! এ সুর বড়ো খতরনাক চীজ! এ সর্বনাশা সুরের সাধনা করিতে হইলে জীবন বরবাদ হইয়া যাইবে যে! ভাবিয়া দেখ। মনে হয়, তোমার হৃদয়ে কী যেন বেদনা আছে! কী যেন ঘায়েলকী খত! এক যন্ত্রণার উপশম করিতে গিয়া আর-এক যাতনায় প্রবেশ করিতে চাও? মনে রাখিও, শিল্পীর কখনও খোঁজা শেষ হয় না। তাই তাহার শান্তি কখনও আসে না। শান্তি আসিল, তো অমনি কলাবতেরও মওৎ হইয়া গেল, সে মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িল।”
উৎপলদৃষ্টি বালকের ন্যায় উদগ্র আগ্রহে বলিল, “হউক তাহা। আমি সর্বস্ব ছাড়িতে পারি। আমি সুর শিখিবই!
“তবে আইস। আমার সহিত চলো। আজ হইতে আমার হাভেলিতে থাকিয়া তুমি সুরসাধনা করিবে।”
দীর্ঘক্ষণ পরে কাশীর বাহিরে এক নির্জন ঘাটে নৌকা লাগিল। ঘাট দিয়া উঠিয়া কিছুদূর চলিবার পর এক বৃহৎ অট্টালিকা, এক নির্জন হাভেলি দেখা গেল।
ক্রমে ক্রমে উৎপলদৃষ্টি সব জানিতে পারিল। বৃদ্ধের নাম এনায়েৎ খাঁ। এই হাভেলিতে আজ চল্লিশ বৎসর আছেন। প্রথম যখন আসিয়াছিলেন, তখন তিনি বিশ বৎসরের যুবক। তাঁহার গুরু সুলেইমান খাঁ হাভেলির মালিক ছিলেন। মৃত্যুকালে পুত্রসম প্রিয়শিষ্যকে গুরু সব সম্পত্তি সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন।
যে-যুবকটি মৃদঙ্গ বাজাইতেছিল, সে জন্ম-মূক। তাহার নাম মেহবুব। এলাহাবাদের ত্রিবেণী সঙ্গমে কুম্ভমেলায় সে নিত্যন্ত শিশুবয়সে হারাইয়া যায়। এনায়েৎ তাহাকে কুড়াইয়া পাইয়াছিলেন। এনায়েতের শিক্ষায় মেহবুব এখন এক দক্ষ মৃদঙ্গবাদকে পরিণত হইয়াছে।
দূরদূরান্ত হইতে বহু শিক্ষার্থী এনায়েৎ খাঁর নিকট বাঁশি শিক্ষা করিতে আসে। তিনি বারাণসীর মসুর কলাকার। কিন্তু এনায়েৎ তাহাদের কাহাকেও হাভেলিতে থাকিতে দেন না। উৎপলদৃষ্টিকে তিনি যে হাভেলির বহির্বাটিতে স্থান দিয়াছেন, ইহা পরম সৌভাগ্যের বিষয়। উৎপলদৃষ্টি হিন্দু ব্রাহ্মণ জানিয়া তাহার পৃথক স্বপাকের ব্যবস্থাও এনায়েৎ করিয়া দিলেন।
সে-যুগের পক্ষে আবাল্য হিন্দুসংস্কারে লালিতপালিত উৎপলদৃষ্টির মুসলমান এনায়েৎ খাঁর আবাসে বসবাস করা অভাবনীয় ছিল বটে, কিন্তু উৎপলদৃষ্টির সে- সকল কথা ভাবিবার অবকাশ ছিল না। সে অনন্যোপায় হইয়া নিমজ্জমান ব্যক্তি যেমন করিয়া খড়কুটা পাইলেও তাহাই আঁকড়াইয়া ধরে, তেমন করিয়াই এনায়েতের শরণ লইয়াছিল। জাতপাতের কথা মনে আসে নাই। বাহিরের লোকও এনায়েৎ খাঁর প্রসিদ্ধির কারণে জাতপাতের কথা তুলিতে কখনও সাহস করে নাই।
এনায়েৎ খাঁর তত্ত্বাবধানে উৎপলদৃষ্টির সুরসাধনা আরম্ভ হইল। সংগীতবিদ্যা গুরুমুখী। গুরু হইলেন মুর্শিদ, আর শিষ্য হইল মুরীদ। এই মুর্শিদ-মুরীদ-পরম্পরা ধরিয়াই অনাদিকাল হইতে সুরধারা বহিয়া আসিতেছে।
যেন একটা নূতন জগৎ উৎপলদৃষ্টির চোখের সামনে খুলিয়া যাইতেছে। সে এ জগতের কিছুই জানিত না। কী কতগুলা দার্শনিক মত-মতান্তর লইয়া পড়িয়াছিল সে এতদিন! সংগীতের আনন্দের নিকট সেসব অতি তুচ্ছ। পরম আগ্রহে সে সব শিক্ষা করিতেছিল। কেমন করিয়া বাঁশরী ধরিতে হয়, কীভাবে সন্তর্পণে তাহাতে ফুঁ দিইতে হয়, বাঁশির ছয়টা ছিদ্রের উপর দুই হাতের আঙুলের টিপেটোপে কেমন করিয়া সরগম বাহির করিতে হয়, সপ্তসুরের মিলনবিরহে কেমন করিয়া রাগরাগিনীর আবির্ভাব হইতে থাকে… শিখিতে শিখিতে সে একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেল। বিচিত্র সব রাগের ভাবরূপ উৎপলদৃষ্টির চারিপাশে যেন এক মায়াপৃথিবী রচনা করিতেছিল।
দ্বিতলের উপর যে ঘরে তাহার থাকিবার ব্যবস্থা হইয়াছে, জানালার ঝরোখা খুলিলে দেখা যায়, তাহার সম্মুখে একটা বিস্তৃত বালুর চর। ওই চরটা পার হইলে গঙ্গার ঘাট। ঘাটের নীচ দিয়া চ্ছলোচ্ছলো শব্দে ত্রিপথগা ভাগীরথী বহিয়া চলিয়াছেন। স্থানটি বড়ো নির্জন। ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলে দেখা যায়, জনহীন একটা অলিন্দ। শ্বেত পাথরের আবরণে ঢাকা। এই অলিন্দ হইতে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া চবুতরা পার হইয়া পার্শ্বস্থ অট্টালিকায় উঠিলে এনায়েৎ খাঁর কক্ষ পাওয়া যায়। এনায়েৎ বহু যত্ন করিয়া উৎপলদৃষ্টিকে এক-একটি রাগ শিক্ষা দেন। যতক্ষণ না আয়ত্ত হইতেছে, ততক্ষণ আর অগ্রসর হন না। প্রথম যৌবনে উৎপলদৃষ্টি যেমন শুনিবামাত্র ন্যায়শাস্ত্রের দুরূহ সমস্যা শিক্ষা করিয়া লইত, এখনও তেমনই অতি দ্রুত সে যেন যথাসাধ্য মার্গসংগীতের সারাৎসার শুষিয়া লইতেছিল।
এনায়েৎ খাঁ কিন্তু কোমলে কঠোরে গড়া মানুষ। খুশি হইলে তিনি রাগ ললিত, ক্রুদ্ধ হইলে রাগ দীপক! উৎপলদৃষ্টি এত দ্রুত শিক্ষা করিতেছে দেখিয়া তিনি যারপরনাই আনন্দিত হইয়া উঠিতেন, কিন্তু বারবার প্রযত্ন করা সত্ত্বেও কোনো সুর বাঁশিতে উঠিতেছে না দেখিলে ক্রোধে আরক্তিম হইয়া উৎপলদৃষ্টির খাওয়া বন্ধ করিয়া দিতেন। যতক্ষণ না সেই রাগ বাঁশিতে সাবলীল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে, ততক্ষণ ছাড় নাই। আবার পরে শান্ত হইলে, ‘এত কেন নারাজ হইয়া গিয়াছিলাম’ বলিয়া দুঃখ করিতেন।
ধীরে ধীরে উৎপলদৃষ্টির সমস্ত দিনরাত্রি সুরের আবেশে ভরিয়া উঠিতে লাগিল। এনায়েৎ খাঁ সাহেবের বংশীতে ভৈরবী রাগিনীর আলাপের ভিতর দিয়া তাহার প্রভাত আসিত। তন্দ্রাজড়িমা ভাঙিয়া মানুষ ও প্রকৃতি যেন ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিতেছে। মনে হইত, কে এক বালক তাহার সকরুণ ব্যাকুলতা লইয়া মাতৃক্রোড়ে ফিরিয়া যাইবার আর্তি প্রকাশ করিতেছে। উৎপলদৃষ্টি প্রভাতবেলায় গঙ্গাস্নান সারিয়া আসিয়া বাঁশি লইয়া বসিত। ধীরে-ধীরে রৌদ্র উঠিলে সেই জরির ন্যায় ঝিলমিল দিবসের দ্বিতীয় প্রহরে সে আস্তে আস্তে বাঁশিতে টোড়ি রাগে আলাপ করিত। ঘরের ভিতর সুর ঘুরিয়া ঘুরিয়া কী এক বিচিত্র মায়াজাল রচনা করিয়া ফিরিত। কখনও এনায়েৎ খাঁ উৎপলদৃষ্টিকে তাঁহার সহিত বাজাইতে বলিতেন। মেহবুব মৃদঙ্গে সঙ্গত করিত। ক্রমে রৌদ্র ঘুরিয়া যাইত, মুরীদের যদি-বা সময়ের হুঁশ আছে, মুর্শিদের সেদিকে একেবারে নজর নাই। মধ্যাহ্ন অতিক্রান্ত হইলে বাঁশরীতে কিয়ৎকাল বিরাম দেওয়া হইত। দিন পড়িয়া আসিত, অগ্রে মধুবন্তী, তাহার পর মুলতান, অপরাহুবেলায় পূরবীর বিরহবিধুর বিলাপব্যথায় ঘরটি ভরিয়া উঠিত। সন্ধ্যা নামিয়া আসিলে কল্যাণ ঠাটে প্রার্থনাগম্ভীর ইমন গঙ্গার বাতাসের উপর দিয়া আসন্ন রাত্রির আকাশের শূন্যতাকে পূর্ণ করিয়া দিত। সন্ধ্যার অন্ধকার জমিয়া উঠিয়া যখন চরাচরের সকল কোলাহল শান্ত হইয়া আসিত, তখন রাত্রির প্রথম প্রহরে উৎপলদৃষ্টি হামীর বাজাইত। কে এক রহস্যময় বীরপুরুষের ধীরোদাত্ত প্রেমে রাত্রির নিঃশব্দতা, নদীর বালুচর ও আকাশের নক্ষত্ররাজি মুগ্ধ হইয়া যাইত। তাহার পর মধ্যনিশীথে এনায়েৎ বাঁশিতে সুগম্ভীর ফুঁ দিয়া মালকোশ ধরিতেন। যেন কোন্ ব্যথার অতলে নামিয়া অস্তিত্বের সুগোপন প্রদেশে সুর বুঝি-বা হাত বুলাইয়া বেড়াইত, ধীরে-ধীরে উৎপলদৃষ্টির নয়নে নিদ্রাদেবী মায়াকাজল পরাইয়া দিতেন।
শেষ রাতে এনায়েৎ কখনও তাহাকে তুলিয়া দিয়া কহিতেন, “বেটা! রাত শেষ হইয়া আসিতেছে। পরজ রাগে আলাপ করো।” শিষ্যের সেই জাগরতন্দ্রার অবসন্ন বিহুল সুর কিছু পরে গুরুর বাঁশরীতে মাড়ওয়া ঠাটে সোহিনীর ক্লান্ত ব্যাকুলতায় মিশিয়া যাইত। যেন সুদূর হইতে গান ভাসিয়া আসিত – আজু মধুময় যামিনী রে…
এইভাবে বৎসরের পর বৎসর চলিতে চলিতে সুর আসিয়া একটা কথা উৎপলদৃষ্টিকে বুঝাইয়া দিল। একদিন নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে গবাক্ষপথে ধু-ধু করা বালুচরের দিকে উদাস হইয়া চাহিয়া তাহার মনে হইল, ন্যায়মত ও বেদান্তমতের দ্বন্দ্ব সে কেন পূর্বে মিটাইতে পারে নাই, আর এখনই-বা কেন সেই দ্বন্দ্বের হাত হইতে সে নিষ্কৃতি পাইয়াছে। উহারা দুই বিপরীতমুখী দর্শন, উহাদের বিরোধ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু যে-মানসিক স্তরে ওই বিরোধ উপস্থিত হয়, সেই স্তরে উহার সমাধান নাই। ওই স্তর হইতে আরও ঊর্ধ্বে উঠিলে উহাদের বিরোধ মিটিয়া যায়। অর্থাৎ এই বিরোধের সমাধান যুক্তিতে নাই, সমাধান রহিয়াছে অনুভূতিতে। সংগীত উৎপলদৃষ্টির হৃদয়ে নামিয়া আসিয়া সরাসরি উহাদের বিরোধ মিটায় নাই; সংগীত কেবল উৎপলদৃষ্টির হৃদয়কে চেতনার আরও ঊর্ধ্বস্তরে তুলিয়া লইয়া গিয়াছে। সেই ঊর্ধ্বস্তরে, সুরের সেই ভুবনে ন্যায় বা বেদান্ত কোনোকিছুর তর্ক নাই। সেই উচ্চতা হইতে দেখিলে পর্বত ও সমতলভূমি কাহাকেও উচ্চ বা অবচ দেখায় না।
কমলনয়নের মতন ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড উৎপলদৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করিতে হয় নাই বটে, কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিরোধ তাহাকে সম্যক জানিতে হইয়াছিল। একদিন সে এই বিষয়ে এনায়েৎ খাঁকেও প্রশ্ন করিয়াছিল। উৎপলদৃষ্টি জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “শুনিয়াছি, ইসলাম ধর্মে সংগীত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। উহার কথা বলিলেও মৌলবিগণ কানে হাত চাপা দিয়া ‘হারাম, হারাম’ বলিয়া উঠেন। তাহা হইলে এই যে আপনি সুরসাধনা করেন, ইহা কি আপনার ধর্মবিরুদ্ধ নহে?”
উৎপলদৃষ্টির কথা শুনিয়া এনায়েৎ খাঁ শিহরিয়া উঠিলেন। শিষ্যের অজ্ঞানকৃত অপরাধের জন্য বারংবার মা সরস্বতীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া তিনি চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, “কে বলে ইসলামে সংগীত হারাম? এসব আনপড় বাত মূলে ছিল না; এসব কাহারা যেন ইদানীং চালাইয়া দিতেছে। মসজিদে যে আজান দেওয়া হয়, তাহা কি বিশুদ্ধ সংগীত নহে? সুরের জান্নাতে হিন্দু, মুসলমান বলিয়া কিছু নাই। উহা এক আনন্দের জগৎ। সুরসাধনা করিতে করিতে রাগ-রাগিনী সাক্ষাৎ মূর্তি ধরিয়া দেখা দেয়। এই মহব্বত, এই প্রেমের অনুভূতিকে কোন্ মৌলানা নিষেধ করিতে পারে? আমি এসকল কিছু মানি না!”
কোনো কোনোদিন সন্ধ্যায় এনায়েৎ খাঁ তাহাকে আর মেহবুবকে সরযূবাইয়ের কোঠিতে লইয়া যান। সরযূবাই পিল্লাই নর্তকী, ভরতনাট্যম শিল্পী। তাঁহার গৃহে মেহফিল বসে। বারাণসীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা আসিয়া সমবেত হন। ধীরলয়ে সংগীতের আলাপ শুরু হয়। নানারূপ বাদ্যযন্ত্র ধ্বনিয়া উঠে। এনায়েৎ ও উৎপলদৃষ্টির বাঁশি সুরলহরী বহাইয়া দেয়। মেহবুব মৃদঙ্গে সঙ্গত করে।
সরযূবাই প্রৌঢ়া, কিন্তু নৃত্যের আসরে তাঁহার কলাধৃত মুদ্রাবিভঙ্গের মাধুর্যের কাছে তরুণী শিল্পীও হার মানিয়া যাইবে। যেন বিদ্যুৎ স্বয়ং নারীমূর্তি ধরিয়া আসরের ভিতর ঘুরিয়া ফিরিতেছে।
আহা! যেন এক লাস্যময়ী আনন্দিতা মায়াময়ূরী। ছন্দে, বর্ণে, তালে, রঙ্গে, নাট্যে, সুরে, মূর্ছনায়, বিভঙ্গে ও কলাবিতদিগের সোৎসাহ অভিবাদনে সরযূবাইয়ের গৃহাকাশ ভরিয়া যায়! মেহবুব মূক হইলেও অতি বুদ্ধিমান। কথা কহিতে পারে না, কিন্তু হাবে- ভাবে, আকারে-ইঙ্গিতে মনের ভাব প্রকাশ করিতে পারে। এই বিজন হাভেলিতে তাহার সহিত থাকিতে থাকিতে উৎপলদৃষ্টি মেহবুবের ‘ভাষা’ এখন বেশ বুঝিতে পারে। মেহবুবের নিকট হইতে এই সরযূবাইয়ের একটি আশ্চর্য উপাখ্যান সে শুনিয়াছিল।
সরযূবাই দক্ষিণদেশের নর্তকী, কোনো এক মন্দিরে তিনি দেবদাসী ছিলেন। ব্রাহ্মণ পুরোহিতদিগের লালসাময় গ্রাস হইতে বাঁচিবার জন্য গোপনে বারাণসী পলাইয়া আসেন।
এনাযেৎ খাঁর সহিত তাঁহার সুদীর্ঘ সম্পর্ক। প্রথম যৌবনেই দুজন দুইজনের প্রেমে পড়িয়াছিলেন। এলাহাবাদের রাজসভা হইতে এনায়েৎ খাঁর আমন্ত্রণ আসিয়াছিল; কিন্তু এনায়েৎ তাহা ফিরাইয়া দেন। শুধু সরযূবাইয়ের আকর্ষণে বারাণসীর এই নির্জন হর্মে রহিয়া গিয়াছেন। দুটি শিল্পীসত্তা একে অপরকে ছুঁইয়া আছে। শ্রদ্ধায়, প্রেমে, সুগভীর আকর্ষণে।
সরযূবাই একবার নাচ ছাড়িয়া দিবেন স্থির করিয়াছিলেন। কিন্তু এনায়েৎ বলিয়াছিলেন, যতদিন এ বাঁশুরি বাজিবে, ততদিন যেন ঘুঙুরে বোল উঠে।
নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া উৎপলদৃষ্টি পুনরায় সুমহান নৈঃশব্দ্যের মুখামুখি হয়। রাত্রি কাটিয়া প্রভাত হয়, প্রভাত পার হইয়া মধ্যদিন জলস্থল ব্যাপিয়া বিরাজ করে। প্রচণ্ড সূর্যের খরতাপে সমগ্র নিসর্গপ্রকৃতি যেন চিত্রার্পিত হইয়া থাকে। আকাশের পাখি গঙ্গার উপর দিয়া শূন্যপথে উড়িয়া যায়, কিন্তু ভীষণ উত্তাপে যেন আর অগ্রসর হইতে পারে না। যেন আকাশের ভিতর এক বিন্দুতে স্থির হইয়া, বাধা পাইয়া ফিরিয়া আসে। নদীস্রোত সম্মুখে বহিতে বহিতে উপলকঙ্করের আঘাতে প্ৰতিহত হইয়া যেন পিছনে ফিরিয়া আসে। চরাচর ব্যাপিয়া এই গতি, স্তব্ধতা ও প্রত্যাগমনের খেলা চলে। অভিসারিকার ব্যাকুলতা বুঝি বা কী বাধায় বহুদূর অবধি অগ্রসর হইয়াও পুনরায় প্রত্যাবৃত হয়। যত বার বাধা পায়, তত বার ব্যাকুলতার বেগ তীব্রতর হইয়া উঠে। আর্তি যত তীব্র, বাধাও ততই অধিক। কে যেন সুদূরে বসিয়া বাঁশিতে বৃন্দাবনী সারঙের সুর বাজায়
মধ্যদিন এইরূপ, আর মধ্যরাত্রির রূপ অন্য। সুর চেতনার গভীরতম প্রদেশে নামিয়া আসিতেছে। শান্ত, গম্ভীর। অবচেতনের সকল সংস্কারগুলিকে পরম মমতায় স্পর্শ করিয়া শুশ্রূষা করিতেছে, রূপান্তরিত করিতেছে। বলিতেছে, আইস, ঊর্ধ্বে উঠিয়া আইস। তোমাকে এক নির্ভয়, অমোঘ সত্যের নিকট লইয়া যাইব, যেখানে সূর্য উদিত হয় না, অথচ আলোকেরও অভাব নাই…
এইখানে এমনই এক রাত্রে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটিল।