ছায়াচরাচর – ১৩

তেরো 

বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে বৈকাল পড়িয়া আসিতেছে। গঙ্গালহরীর উপর অস্তগামী সূর্যের শেষ আভা আসন্ন তমসার ভিতর ক্রমে ক্রমে লুকাইয়া পড়িতেছে। মন্থরগামিনী গঙ্গাস্রোতে কত যে নাও ভাসিয়া যায়; অদূরে দুই-একটি বজরা মন্দ মন্দ বেগে চলিতে থাকে। ঘাটের নিকটে কেহ কেহ দিনান্তবেলায় স্নান সারিয়া লইতেছে, কেহ বা সোপানের উপর সন্ধ্যাহ্নিক-নিরত। বহু পুণ্যার্থী মঙ্গলকামনায় জলতলে শালপত্রের পূটিকায় করিয়া ঘিয়ের প্রদীপ ভাসাইল। মৃদু দীপালোক স্রোতোবক্ষে দুলিতে দুলিতে কুয়াশা মাখানো অন্ধকারে মিলাইয়া যাইতেছে। 

সিঁড়ির ধাপগুলি অতি বিস্তৃত—এত বহুল সংখ্যক ধাপ যে, গণিবার অবকাশ হয় না। ঘাটের রানার উপর বড়ো বড়ো গোলাকার চাতাল, তাহার উপর কেয়াপাতা ও কাষ্ঠনির্মিত ছত্র। ছাতার নিম্নে ব্রাহ্মণ কথকেরা সুর করিয়া স্তিমিতালোকে শাস্ত্রপাঠ ও ব্যাখ্যা করিতেছেন। চারিদিকে শ্রোতৃমণ্ডলী ঘিরিয়া বসিয়া তাঁহাদের পাঠ শুনিতেছে। 

ঘাটের সোপানশ্রেণী আরও ঊর্ধ্বে উঠিয়া নগরীর গলিপথে মিশিয়া গিয়াছে। এই ঘাট অতি প্রাচীন-ভারতীয় সংস্কৃতির সমবয়স্ক। চতুষ্পার্শ্বে বহু মন্দিরের শাঙ্কব চূড়া দেখা যাইতেছে; এক-একটি চূড়া কলার মোচার ন্যায় আকৃতিবিশিষ্ট অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চূড়ার সমষ্টি। নিকটেই বারাণসীপুরপতি বিশ্বনাথের মন্দির। শীঘ্রই তথায় সন্ধ্যারতি আরম্ভ হইবে–তাহারই আয়োজন চলিতেছে—আর কিছু পরেই শঙ্খ- ঘণ্টা-কাঁসরের মৃদু মৃদু শ্রুতিসুখাবহ ধ্বনি সন্ধ্যার বাতাসে ভাসিয়া আসিবে। কর্পূর, ধূপ, গুগ্গুলের সৌরভ সেই বাতাসের সহিত মিশিয়া জাহ্নবীজলের উপর দিয়া বহুদূর অবধি বহিয়া যাইবে। 

ঘাটের একপার্শ্বে এক গৌরবর্ণ বলিষ্ঠদেহী যুবাপুরুষ বসিয়া ছিল। শ্বেতবস্ত্র পরিধান, বক্ষের উপর শ্বেত উত্তরীয় বিলম্বিত। কণ্ঠদেশে শ্বেতকরবীর একটি ক্ষুদ্র মালিকা। মস্তকের সম্মুখভাগ কামানো, শিরোদেশে সুপুষ্ট শিখা রহিয়াছে। সুদৃঢ় স্কন্ধ, প্রশস্ত বক্ষ ও লীলায়িত বাহুযুগ। চক্ষুদুইটি আয়ত, উজ্জ্বল। এমনিতে চিনিবার উপায় নাই; কেবল সেই চোখে চোখ রাখিয়া ভালো করিয়া দেখিলে তবেই বুঝা যায়—এ যুবক আর কেহ নহে, এ আমাদের সেই কমলনয়ন! কিন্তু সে কমনীয় কিশোর কোথায়-বা গেল? তাহার এ যৌবনদীপ্ত অবয়বে শক্তি ও সৌন্দর্যের খেলা, মুখেচোখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও শাণিত মেধার দীপ্তি—মধ্যে প্রায় পঞ্চদশ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে! 

ঘাটের সোপান বাহিয়া আর-এক যুবক গঙ্গায় কমণ্ডলু ডুবাইয়া জল ভরিয়া উঠিয়া আসিতেছিল। সে কমলনয়নের নিকটে আসিয়া কহিল, “আজ কেদারঘাটে কর্ণাট দেশ হইতে এক নৈয়ায়িক আসিয়াছেন। তাঁহার সহিত কাশীর বেদান্তসেবী পণ্ডিতদিগের বিচার হইবে। বিচারসভা দেখিতে তুমি সেখানে যাইবে নাকি, কমলনয়ন?” 

কমলনয়ন প্রশ্নকর্তার দিকে চাহিয়া দেখিল। অদ্বয়ানন্দ। রামতীর্থের অপর এক শিষ্য—কমলনয়নের সতীর্থ। অত্যন্ত বুদ্ধিমান, কুশলী তার্কিক। 

মুখ ফিরাইয়া লইয়া ঈষৎ আত্মগত স্বরে কমলনয়ন কহিল, “নাহ। আমি আজ আর কোথাও যাইব না। আমার বড়ো শিরঃপীড়া হইতেছে।” 

ঈষৎ হাসিয়া অদ্বয়ানন্দ আর কিছু না-বলিয়া কেদারঘাটের পথ ধরিল। 

মাথার উপর দিয়া কুলায়প্রত্যাশী পারাবতকুল উড়িতেছে। এ সকল পারাবত বারাণসী নগরীর হর্মসমূহের ছাদের আলিশায় কিংবা কোনো মিনারের উপর নীড় বাঁধিয়া থাকে। সমস্ত দিন গঙ্গার উপর উড়িয়া বেড়ায়, পরপারে বালুচরের দিকে উড়িয়া যায়, আবার সন্ধ্যা হইলে বাসায় ফিরিয়া আসে। কমলনয়ন একবার পায়রাগুলির দিকে চাহিল। উহাদের নীড় আছে, কমলনয়নের কোনো নীড় নাই। চতুর্দশ বৎশর বয়সে তাহার বাসা পুড়িয়া গিয়াছে। সেই হইতে আজ অবধি কমলনয়ন আকাশ আশ্রয় করিয়া বাঁচিয়া আছে। 

দেশের রাজা তাহার কবিতা মন দিয়া শুনিলেন না—এই অভিমানে কিশোরের মনে, রাজার রাজা যিনি, তাঁহারই চরণে প্রাণ-মন উৎসর্গ করিবার বাসনা জন্মিল 1 কিশোর কমলনয়ন বিক্রমণিপুর হইতে নবদ্বীপ পথ হাঁটিয়া আসিয়া শ্রীগৌরাঙ্গের পদানুগ হইতে চাহিয়াছিল। কিন্তু নবদ্বীপে মহাপ্রভুর তখন অদর্শন; প্ৰভু তখন পুরীধামে অবস্থান করিতেছেন; অস্পষ্টভাবে কমলনয়ন এই কথা শুনিল। নবদ্বীপ নব্য ন্যায়মতের তীর্থ। অগত্যা কমলনয়ন আর কী করে– মথুরানাথের টোলে সে ন্যায় পড়িতে লাগিল। কিন্তু সেই পাঠ সম্পূর্ণ হইবার পূর্বেই গুরু বলিলেন, “কাশী যাও। কাশী আমাদের প্রধান শত্রু অদ্বৈতবাদাবলম্বিদিগের তীর্থ। তুমি সেস্থলে নিজ নৈয়ায়িক পরিচয় গোপন করিয়া অদ্বৈত বেদান্তের শিক্ষা আত্মসাৎ করিয়া লও। তাহার পর অদ্বৈতবাদের ভ্রান্তিসমূহ আবিষ্কার করিয়া, ওই মত খণ্ডন করিয়া ন্যায়দর্শন ও ভক্তিবাদের পক্ষ পরিপুষ্ট করো।” 

গুরুর নিকট হইতে এই আদেশ পাইয়া কমলনয়নের চিত্ত উৎসাহে জ্বলিয়া উঠিল। এরূপ উৎসাহের আরও কারণ; অদ্বৈত বেদান্তীর দল মহাপ্রভুর ভক্তিবাদেরও বিশেষ বিরোধিতা করে, এ কথা সে শুনিয়াছিল। যাঁহার সহিত দেখা হইল না, অথচ যাঁহার চিন্তা, যাঁহার বিরহবেদনা কিশোরের চিত্তকে আকুল করিয়া তুলে, সেই শ্রীচৈতন্যই কমলনয়নের একমাত্র প্রেমাস্পদ ছিলেন। প্রেমিকের ধর্মই এই; প্রেমাস্পদের নিন্দা সে এতটুকুও সহ্য করিতে পারে না। সাধ্য থাকিলে, প্রেমাস্পদের বিরোধী যাহারা, তাহাদের সে নির্মূল করিবার কাঙ্ক্ষা করে। বস্তুত, এই কারণেই পঞ্চদশবর্ষ পূর্বে কমলনয়ন দীর্ঘদিনের পথশ্রমে কাশী আসিয়াছিল। 

কাশী পহুঁছিয়া সন্ন্যাসী রামতীর্থকে খুঁজিয়া বাহির করিতে কষ্ট হইল না। তিনি এস্থলে বহুল পরিচিত। একটি ভগ্ন, পরিত্যক্ত দেবালয়ের অভ্যন্তরে বহু গ্রন্থরাজিতে পরিপূর্ণ এক নির্জন কক্ষে রামতীর্থ বসবাস করিতেছিলেন। দেশ-বিদেশ দূরদূরাত্ত হইতে ছাত্ররা রামতীর্থের নিকট অদ্বৈত বেদাত্ত শিক্ষা করিবার মানসে ভিড় জমাইয়াছে। কেহ সেই জীর্ণ দেবালয়ের অপরাপর কক্ষে থাকে, কেহ-বা অন্যত্র বসবাস করে। 

রামতীর্থসকাশে উপস্থিত হইয়া কমলনয়ন দেখিল, মেঝের উপর ব্যাঘ্রাজিন পাতা, তাহারই উপর কী একটা পুথিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া রামতীর্থ বসিয়া আছেন। কক্ষের পশ্চাতে একটা উদ্যান আছে, সেই উদ্যানে দিবাভাগেও ঝিঝি পোকা ডাকিতেছে। বেলা দ্বিপ্রহর। কমলনয়নের পদশব্দ শুনিয়া রামতীর্থ চোখ তুলিয়া চাহিলেন। কমলনয়ন রামতীর্থকে প্রণাম নিবেদন করিলেন। তথাপি বেদান্তের ভাবতন্ময়তা ও দার্শনিক চিন্তার নিরবয়ব প্রদেশ হইতে বাহ্যজগতে মন নামাইয়া আনিতে রামতীর্থের কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইল। মুহূর্ত কয়েক পরে সাবহিত হইয়া রামতীর্থ প্রশ্ন করিলেন, “কে? কোথা হইতে আসিতেছ?” 

—আমি বঙ্গদেশোদ্ভব ব্রাহ্মণ, নাম মধুসূদন। স্বদেশ হইতে বহু কষ্ট স্বীকার করিয়া ভবৎসমীপে উপস্থিত হইয়াছি। 

—কী প্রয়োজন? 

—আপনি যদি কৃপা করিয়া অদ্বৈতবাদ শিক্ষা দেন, কৃতার্থ হইব। 

—পূর্বে কী কী অধ্যয়ন করিয়াছ? 

—সামান্য ব্যাকরণ ও ন্যায়শাস্ত্র দেখিয়াছি মাত্র! 

—ন্যায়শাস্ত্র পড়িয়াছ? বেশ তো! তাহা হইলে আর তোমার বেদান্ত জানিবার কৌতূহল কেন? বিদ্যাবাসনা মিটে নাই? 

রামতীর্থের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল। ওষ্ঠাধরে কোথায় যেন বিদ্রুপবঙ্কিম ক্ষুরধার হাস্য লুক্কায়িত ছিল। সেই দৃষ্টির সম্মুখে কমলনয়নের হৃদয় কী এক ভয়ে কম্পিত হইতেছিল। এক্ষণে পরিচয় গোপন করিতে হইবে। মৃদু স্বরে কমলনয়ন উত্তর দিল, “ন্যায়শাস্ত্র পড়িয়াছি সত্য। কিন্তু এক্ষণে আমি আর ন্যায়মতের অনুসারী নহি।” 

—কেন? ন্যায়মত গ্রহণ করিলে না কেন? সেই মত অনুসরণ না করিবার হেতু কী? 

—শুনিয়াছিলাম, অহংকার নিবৃত্ত না হইলে মোক্ষলাভ হয় না। ন্যায়শাস্ত্র পড়িয়া আমার সেই অহংকৃতি তো গেলই না, বরং দিনে দিনে আরও বাড়িয়া উঠিতেছে। তাহা হইলে প্রমাণিত হইল, ন্যায়শাস্ত্র অসার—উহা মুক্তিফলপ্রদ নহে। তাই, এ বিষম অহংকারের অসুখ হইতে ত্রাণ পাইবার জন্য বেদান্তনিষ্ঠ ভবরোগবৈদ্যের শরণাপন্ন হইয়াছি। 

কমলনয়নের যুক্তিনিষ্ঠ মনোভাব ও কবিত্বপূর্ণ বাগীতিতে রামতীর্থ একদিকে যেমন মুগ্ধ হইলেন, অন্যদিকে কী যেন সন্দেহ তাঁহার মনের ভিতর দুলিয়া উঠিতেছিল। তাঁহার মুখাবয়বে বিস্ময় ও কৌতুকের ভাব দেখা দিল। কমলনয়ন সম্পর্কে তিনি যেন কোনো একটা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারিতেছিলেন না। অন্যদিকে ‘ন্যায়মত অসার’, ‘আমি ন্যায়মতের অনুসারী নহি’—ইত্যাকার মিথ্যাবাক্য বলিতে গিয়া কমলনয়ন মরমে মরিয়া গেল। উপায় নাই। রামতীর্থের সম্মুখে ‘নৈয়ায়িক’ পরিচয় গোপন না করিলে প্রত্যাখ্যাত হইবার সম্ভাবনা। তাহাতে কার্যোদ্ধার হইবে না। 

কক্ষের নৈঃশব্দ্য ভাঙিয়া রামতীর্থ পরিশেষে বলিলেন, “বেশ। তুমি এস্থানে কিছুদিন থাকো। তোমাকে ভালো করিয়া পরীক্ষা করিয়া লই। দেখ বাপু, বেদান্ত হইল উপনিষৎ প্রমাণ। যে-কোনো কাহাকেও তো আর শিষ্য স্বীকার করিতে পারি না! তুমি বেদান্তের অধিকারী কি না, তাহা পরীক্ষা করিয়া লওয়া প্রয়োজন।” 

কিছুদিন সেই ভগ্ন দেবালয়ে থাকিয়া কমলনয়ন অপরাপর বিদ্যার্থিদিগের সহিত রামতীর্থের সেবা করিয়া চলিল। রামতীর্থ ক্রমে ক্রমে কমলনয়নের প্রতি প্রসন্ন হইলেন। তিনি কমলনয়নকে শিষ্যস্বীকার করিয়া লইলেন। 

সেই হইতে কমলনয়ন কাশীতে রহিয়া গিয়াছে। আচার্য রামতীর্থের আবাসস্থল সেই ভগ্ন দেবালয়েই থাকে, মধ্যে রামতীর্থের ছাত্রসংখ্যা অধিক হওয়ায় সে বাসা পরিবর্তন করিবে ভাবিয়াছিল। কিন্তু রামতীর্থ তাহাকে নিষেধ করিলেন। ইদানীং কাশীর অবস্থা ভালো নয়। জনজীবন এক দল অশ্বারোহী সশস্ত্র দস্যুর দ্বারা প্রপীড়িত। উহারা ভিন্নধর্মী—নিজেদের ইসলামধর্মাবলম্বী বলিয়া পরিচয় দেয়। পূর্বতন পাঠান শাসনকালে সেনাবাহিনীতে ছিল। নগরীর কোনো গোপন স্থানে লুকাইয়া থাকে, সময়ে সময়ে বাহির হইয়া হিন্দু সন্ন্যাসী ও তীর্থযাত্রীদিগের উপর চড়াও হয়। লুঠতরাজ করে এবং প্রাণবধ করিতেও দ্বিধা করে না। এই দস্যুদিগের দৌরাত্ম্যে অস্থির হইয়া আজকাল তীর্থযাত্রীরা সর্বদা দলবদ্ধভাবে শঙ্কিত চিত্তে রাজপথে গমনাগমন করে। 

কিন্তু অপহরণই ইহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নহে। হিন্দুদিগকে ইহারা শত্রু হিসাবে বিবেচনা করে। তাহাদের হত্যা করিয়া পুণ্যার্জনের আনন্দ অনুভব করিয়া থাকে। কমলনয়ন ভাবিয়া দেখিয়াছে, এইরূপ মানসিকতার কারণ কী। সে তো ইতিপূর্বেও নবদ্বীপে থাকিবার সময়ে ইসলামধর্মাবলম্বীদের দেখিয়াছে। তাহারা তো এইরূপ ছিল না! হিন্দু-মুসলমান–নবদ্বীপে মহাপ্রভুর প্রেমের বন্ধনে মিলিয়া মিশিয়া থাকিত। ‘ইসলাম’ শব্দের অর্থই হইল শান্তি; উহা শান্তভাবের নিরাকার উপাসনার পথ। বস্তুত, পৃথিবীর কোনো ধর্মমতই কাহাকেও হত্যা করিতে শিখায় না। কিন্তু ওই যে, প্রতিটি ধর্মমতেই একদল পুরোহিত আছে, যাহারা সেই সেই ধর্মমতের শাস্ত্রসমূহের অপব্যাখ্যা করিয়া থাকে এবং সাধারণ মানুষের হৃদয়ে অন্য ধর্মাবলম্বিদিগের প্রতি বিদ্বেষের বীজ বুনিয়া দেয়। এ উত্তর ভারতে হিন্দুর পুরোহিত আর মুসলমানের মৌলবী—কেহই কম যায় না। হিন্দু পুরোহিতগণ মুসলমানদিগকে ঘৃণা করিতে শিখাইতেছে। আর মুসলমান মৌলানা হিন্দুদিগকে শত্রু ভাবিতে শিখাইতেছে। ‘হয় ধর্মান্তরিতকরণ, নয় মৃত্যু’এক হস্তে কোরান ও অন্য হস্তে তরবারি লইয়া ইহারা ভারতভূমে প্রবেশ করিয়াছে। আর হিন্দুরা আচার-আচরণে সর্বথা ভিন্ন মুসলমানদিগকে আপন করিয়া বক্ষে টানিয়া লইতে পারিতেছে না; পরিবর্তে তাহাদের ঘৃণা করিতে শিখিতেছে। অন্তরস্থ সত্যের অনুসন্ধানের অভাবেই ধর্মমতগুলি বাতুলতায় পর্যবসিত হয়। 

রামতীর্থের নিকট কমলনয়ন বেদান্তশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে লাগিল। রামতীর্থ আদর্শ শিক্ষক—যুক্তিবিচার ও অনুভূতির উপরেই সর্বাধিক জোর দিতেন, নিছক বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিতেন না। শিষ্যকে নিজে নিজে ভাবিতে ও সমস্যা সমাধান করিতে উৎসাহ দিতেন। সর্বোপরি, রামতীর্থের শিক্ষণ-প্রণালী কমলনয়নের সাতিশয় ভালো লাগিয়াছিল। বেদান্তের প্রধান শাস্ত্র—উপনিষদ্, গীতা, ব্ৰহ্মসূত্র- আচার্য শঙ্করের ভাষ্যসহ কমলনয়ন পাঠ করিতে লাগিল। উহার মেধাবী সংলাপ, প্রখর মনীষা ও তীক্ষ্ণ যুক্তিচেতনা কমলনয়নকে মুগ্ধ করিল। ইহার পর রামতীর্থ শিষ্যের প্রতিভায় সন্তুষ্ট হইয়া একেবারে সর্বজ্ঞাত্মমুনি বিরচিত ‘সংক্ষেপশারীরক’ ধরাইলেন। সর্বজ্ঞাত্মমুনি যেন কমলনয়নের চক্ষে একটা নূতন চিন্তার জগৎ খুলিয়া ধরিলেন। অধ্যাপনাকালে রামতীর্থ এই গ্রন্থের গ্রন্থকার সর্বজ্ঞাত্মমুনি কাহার দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হইয়াছেন, বলিলেন। তিনি প্রকাশাত্ম্যুতি। অতএব, কমলনয়ন প্রকাশাত্ম্যুতির ‘পঞ্চপাদিকা-বিবরণ’ তন্ময় হইয়া পড়িতে লাগিল। ইহা যেন কমলনয়নের রক্তে অনুসন্ধানের আগুন জ্বালাইয়া দিল। স্থানে স্থানে প্রকাশাত্ম্যতি অদ্বৈত বেদান্তের অপর দুই প্রকার ব্যাখ্যার সহিত ভিন্নমত প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। ক্রমে ক্রমে সেই অপর দুই প্রকার ব্যাখ্যা—বাচস্পতি মিশ্রের ‘ভামতী’ টীকা এবং সুরেশ্বরের ‘বার্তিক’-এর সহিত কমলনয়নের আলাপ হইল। অবিদ্যা বা অজ্ঞানের আশ্রয় কী? প্রকাশাত্ম্যতি বলিতেছেন, ব্রহ্মই অজ্ঞানের আশ্রয়; অন্যদিকে বাচস্পতি মিশ্র বলিলেন, জীবই অজ্ঞানের আশ্রয়। উভয় পক্ষেই যথেষ্ট যুক্তি আছে। কমলনয়ন সব ভালো করিয়া বুঝিতে লাগিল। কুয়াশা সরাইয়া সূর্য যেমন নিজেকে ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত করিতে থাকে, সংশয়ের কুহেলিকাজাল অপসারিত করিয়া তেমনই কমলনয়নের হৃদয়ে সত্যের আলোক অপাবৃত হইতে লাগিল। 

একদিকে যেমন এইরূপ, অন্যদিকে তেমনই কমলনয়ন যত পড়িতেছে, ততই বিষম যন্ত্রণা আসিয়া তাহার হৃদয়কে অধিকার করিয়া লইতেছে। সে এক কঠিন সমস্যা! কী করিয়া তাহা হইতে যে উদ্ধার পাইবে, সে জানে না! 

বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে বসিয়া কমলনয়ন এসকল আকাশপাতাল ভাবিতেছে, ঘাটে কিন্তু লোকসমাগমের বিরাম নাই, ক্রমশই ভিড় বাড়িয়া চলিতেছে। বিশ্বনাথ মন্দিরে আরতি সমাপ্ত হইয়া গিয়াছে, তাহার পর গঙ্গার ঘাটে গঙ্গা-আরতি আরম্ভ হইল। সুবৃহৎ দীপ, বর্তিকা, ঝাঁঝ, ঘণ্টা, তালবাদ্য সহ ব্রাহ্মণগণ সমছন্দে গঙ্গারতি করিতেছেন। আরতি দর্শনার্থে শতশত মনুষ্যের সমাগম হইল। তাহার পর তাহাও মিটিয়া গেল। কোথায় কে যেন সুর করিয়া গঙ্গাস্তোত্র পাঠ করিতেছে। ঘাটের পার্শ্বে আলোকস্তম্ভের উপর রাজকীয় সেবায়েতগণ মশাল জ্বালিয়া দিয়া গেল। মশালের আলো নদীবক্ষে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়িয়াছে। দূরে দেখা যায়, একটি নৌকা স্রোতের বিপরীতে দাঁড় টানিয়া যাইতেছে। ওই নৌকার দাঁড় আর স্রোতের সংঘাত দেখিতে দেখিতে কমলনয়ন তাহার হৃদয়ের অন্তর্গত সংকটের কাছে ফিরিয়া আসিল। তাহার মনেও তো ওইরূপ সংঘাতই অহোরাত্র সংঘটিত হইতেছে। রক্তাক্ত সংগ্রাম! 

গুরু রামতীর্থের নিকট পরিচয় গোপন করিয়াছে সত্য, তথাপি কমলনয়ন পূর্বে ন্যায়শাস্ত্রে নিষ্ণাত ছিল। প্রাথমিক পরিচয়ে সে একজন দক্ষ নৈয়ায়িক। অথচ অন্যদিকে বেদান্ত যত পড়িতেছে, বেদান্তদর্শনের সহিত ন্যায়দর্শনের পার্থক্য ততই প্রকট হইয়া উঠিতেছে। মস্তিষ্কের ভিতর যেন নৈয়ায়িক ও বেদান্তীর মল্লযুদ্ধ চলিতেছে। তাহার উদ্দেশ্য ছিল, বেদান্ত শিখিয়া লইয়া বেদান্তকে খণ্ডন করা। অথচ, এক্ষণে সমস্যা হইতেছে এই, ন্যায়দর্শনের বহু ধারণা বা ভাব বেদান্তের যুক্তিপ্রণালীর সম্মুখে আর দাঁড়াইতে পারিতেছে না। নিজে নৈয়ায়িক হইয়াও বেদান্তের হস্তে ন্যায়দর্শনের এই প্রবল পরাজয় প্রতিদিন কমলনয়নকে অসহায়ের ন্যায় লক্ষ করিতে হইতেছে। 

এই মুহূর্তেই এক কমলনয়নের ভিতর দুইজন কমলনয়ন কথা বলিতেছে। একজন নৈয়ায়িক, আর-একজন বেদান্তী। নৈয়ায়িক বলিতেছে, “আমাদিগের পরমাণুবাদের কথাই ধরো। ন্যায়-বৈশেষিক মতে জগতে যাহা কিছু দেখিতেছি, তাহাদের সকলেরই কারণ—মৃত্তিকা, জল, তেজ, বায়ু—এই চারি প্রকার পরমাণু। ইহা কি নির্দোষ নহে?” 

বেদান্তী জিজ্ঞাসা করিতেছে, “তবে বলো, এই পরমাণু আসলে কী?”

নৈয়ায়িক উত্তর দিতেছে, “পরমাণু নিত্য, অবিভাজ্য, সূক্ষ্মতম কণিকা। এই পরিদৃশ্যমান জগৎ যখন বিভাগের চরম সীমায় উপনীত হয়, তখন কেবল পরমাণুই থাকে—উহাকেই প্রলয় বলা হয়।” 

বেদান্তী ঈষৎ হাসিয়া প্রশ্ন করিল, “আর সৃষ্টির সময়?” 

নৈয়ায়িক বলিল, “যেই সৃষ্টির সময় উপস্থিত হয়, অমনি অদৃষ্টবশে প্রথমতঃ বায়বীয় পরমাণুতে একটা বিক্ষোভ, চাঞ্চল্য বা ক্রিয়া জন্মায়। তখন সেই স্পন্দনের ফলে দুইটি বায়বীয় পরমাণু সংযুক্ত হইয়া একটি বায়বীয় ‘দ্ব্যণুক’ উৎপন্ন হয়। ক্রমে তিনটি তিনটি ‘দ্ব্যণুক’ জুড়িয়া একটি ‘ত্রণুক’ হয়। এই রূপে জুড়িয়া জুড়িয়া চতুরক’ প্রভৃতি হইয়া ক্ৰমে স্থূল বায়ু উৎপন্ন হয়। এই একই প্রক্রিয়ায় জল, তেজ ও মৃত্তিকা নামক ভূতও জন্মে, এবং তাহাদের পরস্পরের সংযোগে সমগ্র বিশ্ব উৎপন্ন হয়।”

বেদান্তী সব শুনিয়া বলিতেছে, “ভালো কথা। এখন এই চারি প্রকার পরমাণুর- কার কীরূপ প্রকৃতি, বলো দেখি শুনি।” 

নৈয়ায়িক উত্তর দিতেছে, “চারি প্রকার পরমাণুর ভিতর মৃত্তিকা পরমাণুই সর্বাপেক্ষা স্থূল এবং তাহার গুণ চারিটি—রূপ, রস, স্পর্শ ও গন্ধ। মৃত্তিকা অপেক্ষা জলীয় পরমাণু সূক্ষ্মতর, এবং তাহা রূপ-রস-স্পর্শ—এই তিন গুণবিশিষ্ট। তেজ জল অপেক্ষাও সূক্ষ্ম এবং তাহার গুণ দুইটি—রূপ ও স্পর্শ। বায়ু তেজ অপেক্ষাও সূক্ষ্ম, তাহার গুণ কেবল স্পর্শ। এইরূপে দেখা যাইতেছে, যে-ভূতের গুণ যত বেশি, সে তত স্থূল।” 

বেদান্তী অমনি আপত্তি তুলিতেছে, “তাই নাকি? তাহা হইলে তো পরমাণুর আর পরমাণুত্বই থাকে না; কারণ, তুমিই বলিয়াছ, সর্বাপেক্ষা সূক্ষ্ম যাহা, তাহারই নাম পরমাণু। এক্ষণে আবার এই চারি প্রকার পরমাণুর ভিতর স্থূল-সূক্ষ্ম বিভাগ করিতেছ। পরমাণুরই যেকালে পরমাণুত্ব লোপ পাইল, সেকালে তোমাদের এই ন্যায়-বৈশেষিক- সম্মত পরমাণু-কারণ-বাদ আর দাঁড়াইল কী প্রকারে? যাহাই হউক, তবুও একবার কীভাবে তোমার মতে এই বিশ্বসৃষ্টির কালে পরমাণুদিগের ভিতর গতির উদ্ভব হয়, বলো দেখি, শুনিয়া লই!” 

ন্যায়-বৈশেষিক মতাবলম্বী গম্ভীর হইয়া তত্ত্বকথা পাড়িতেছে, “সৃষ্টির পূর্বে পরমাণুগুলি পরস্পর পৃথক পৃথকভাবে নিস্ক্রিয় হইয়া অবস্থান করে, তাহার পর পরমাণুগুলি নড়িয়া চড়িয়া পরস্পর সংযুক্ত হয়।” 

অবিলম্বে বেদান্তী নৈয়ায়িককে কোণঠাসা করিয়া চাপিয়া ধরিতেছে, “অহহহ! কী কথাই না বলিলে। ওহে বাপু। জিজ্ঞাসা করি, এই যে পরমাণুগুলি নড়িতে চড়িতে আরম্ভ করিল, ইহার কারণ কী? ইহার কারণ দৃষ্ট’ না ‘অদৃষ্ট’?” 

নৈয়ায়িক বলিতেছে, “যদি বলি, দৃষ্ট’?” 

বেদান্তী উত্তর দিতেছে, “ওই কারণ যদি ‘দৃষ্ট’ কোনো কিছু হয়, তবে তাহা সৃষ্টির পূর্বে থাকিতেই পারে না: কেননা, সৃষ্টির পরেই তো যতকিছু ‘দৃষ্ট’ পদার্থের উদ্ভব! আর যাহা সৃষ্টির পূর্বেই থাকিল না, তাহা আবার সৃষ্টির কারণ হইবে কী প্রকারে?” 

নৈয়ায়িক উলটা পথ ধরিতেছে, “বেশ। তবে ওই কারণ ‘অদৃষ্ট’-ই হউক।”

বেদান্তী বড়ো উৎফুল্ল হইয়া কহিতেছে, “কারণ যদি ‘অদৃষ্ট’ হয়, তবে প্রশ্ন হইল সেই ‘অদৃষ্ট’ বা সঞ্চিত কর্মবীজ থাকে কাহাতে?” 

নৈয়ায়িক অসহায়ভাবে বলিতেছে, “আত্মাতে।” 

বেদান্তী বলিতেছে, “ভালো কথা, তাহা হইলে সেই অদৃষ্টযুক্ত আত্মার সহিত পরমাণুর একটা সম্বন্ধ তো স্বীকার করিতে হইবে। কেমন কিনা? তা ওই সম্বন্ধ কি সহসা হয়, না বরাবরই থাকে?” 

নৈয়ায়িক শেষ চেষ্টা করিতেছে, “সহসা সম্বন্ধ হইলে ক্ষতি কী?” 

বেদান্তী বলিতেছে, “ক্ষতি এই, সহসা সম্বন্ধ হইলে অবশ্য তাহারও একটা কারণ থাকিবে, কিন্তু সেরূপ কারণ তো কিছুই দেখাইতে পারিতেছ না।” 

মরিয়া হইয়া নৈয়ায়িক বলিতেছে, “আর যদি সেই সম্বন্ধকে চিরকালীন ধরিয়া লই, তাহা হইলে তো তুমি তৃপ্ত হইবে?” 

বেদান্তী মোক্ষম উত্তর দিতেছে, “আমার তৃপ্তি-অতৃপ্তির প্রশ্নই নহে। যাহা যুক্তিগ্রাহ্য আমি তাহাই গ্রহণ করি। সম্বন্ধ চিরকালীন কী করিয়া হইবে? যদি সেই সম্বন্ধ বরাবরই থাকে বলো, তাহা হইলে তো চিরকালই সৃষ্টি হইতে থাকিত, সময়ে আবার প্রলয় হয় কেন?…” 

মাথার দুইপাশের রগ দুইটা থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। কমলনয়নের মস্তিষ্কের ভিতর দুইটা সত্তা—নৈয়ায়িক ও বেদান্তী—যেন দ্বৈরথ সমরে লিপ্ত হইয়াছে। উহারা এ উহাকে প্রশ্ন করিতেছে… পরাক্রম প্রদর্শন করিতেছে… আক্ষেপ করিতেছে… পরস্পর পরস্পরকে চাপিয়া ধরিতেছে… পুনরায় একে অপরের জন্য নূতন যুক্তির অস্ত্রে শান দিতেছে… মাথা ফাটিয়া যাইবার উপক্রম! কমলনয়ন দুই হাতে শিরোদেশ চাপিয়া ধরিয়া বসিল। 

ঘাটের পার্শ্বে মশাল দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছে আলোকস্তম্ভের উপর। কতগুলা কী প্রকারের পতঙ্গ ওই আগুন দেখিয়া আগুনের রূপে পাগল হইয়া ছুটিয়া আসিতেছে। কে কাহার পূর্বে আগুনকে আলিঙ্গন করিতে পারে, তাহারই প্রতিযোগিতা চলিতেছে। আগুনে পুড়িয়া নিজেরা যে ভস্মীভূত হইয়া যাইবে, সে-খেয়াল কাহারও নাই। কমলনয়ন দেখিল, স্তম্ভের চারিপাশে পতঙ্গগুলা গোল হইয়া ঘুরিতেছে। একে অপরকে আক্রমণ করিতেছে, আঘাত করিতেছে, যে বিজয়ী হইতেছে সেই-ই অগ্নিকে আলিঙ্গন করিয়া অগ্নিময় হইয়া যাইতেছে। তাহার মনে হইল, ওই পতঙ্গগুলাই ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিক মতাবলম্বী তার্কিক। সকলেই সত্যের আগুনকে ভালোবাসিয়া সেই আগুনের সহিত একীভূত হইতে চাহে। ওই যে-একটা পতঙ্গ আর-একটা পতঙ্গের পাখার আঘাতে প্রতিহত হইয়া মাটির উপর পড়িয়া গেল, ওই অগ্নিবঞ্চিত নিক্ষিপ্ত পতঙ্গটাই নৈয়ায়িক। উহার আর আগুন হইয়া উঠা হইল না। কমলনয়ন তো আপন সত্তা ওই আগুনের সত্তার ভিতর নিঃশেষে মিলাইয়া দিতেই চাহিয়াছিল! 

শৈশব হইতে তাহাই চাহিয়া আসিয়াছে। কত দিন কাটিয়া গিয়াছে। সেই সুমধুর বাল্যকাল… নদী আপন সত্তা হারাইয়া কেমন করিয়া সমুদ্রে নিঃশেষ বিলীন হইয়া যায়—ইহা লইয়া সেই বাল্যকালেই সে কবিতা রচনা করিয়াছিল। কৈশোরে প্রেমে উন্মত্ত হইয়া রূপবারিধি শ্রীচৈতন্যের রাতুল চরণে লয় পাইতে চাহিয়াছিল। এসব তাহার কিছুই হইল না। ন্যায় পড়িল। কিন্তু উহাতে ‘লীন হইবার’ কোনো গল্পই নাই। এমনকি মুক্তিলাভ করিলেও ন্যায়মতে আত্মা ঈশ্বরের সত্তায় বিলীন হয় না, পৃথকই থাকে। শুধু কি তাহাই? ন্যায়মতে আত্মা হইল সৎস্বরূপ। চিৎস্বরূপ বা আনন্দস্বরূপও নহে। নৈয়ায়িকের আত্মা বেদান্তীর আত্মার মতন সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপ নহে; কেবলই সৎস্বরূপ। ন্যায় মতে জ্ঞান বা আনন্দ হইল আত্মার সহিত মনের সংযোগের ফল। আর মুক্তিতে আত্মা মন হইতে বিশ্লিষ্ট হইয়া যায়। সে মুক্ত অবস্থায় সত্তামাত্র পড়িয়া থাকে, এতটুকুও জ্ঞান বা আনন্দ অবশিষ্ট থাকে না। এত বিচার করিয়া, এত উপাসনা করিয়া শেষে মুক্তিতে ওইরূপ জড় হইয়া যাওয়াতে যে কী লাভ! ঈশ্বরের সঙ্গে, পরম প্রেমাস্পদের সত্তায় যদি লীন হওয়াই না গেল, তবে— 

সহসা চতুর্দিকে একটা গোলযোগ ও প্রবল আর্তরবে কমলনয়নের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হইয়া গেল। আচম্বিতে ভাবনার ভুবন হইতে সে যেন বাস্তব পৃথিবীর ভিতর নির্মম কর্কশভাবে জাগিয়া উঠিল। কে একটা লোক দিশা হারাইয়া হুড়মুড় করিয়া তাহার ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িল, যন্ত্রণায় কমলনয়ন আর্তনাদ করিয়া উঠিল। কিন্তু ঘাটের উপর পুণ্যার্থীদিগের সোরগোলের নীচে তাহার কণ্ঠস্বর চাপা পড়িয়া গেল। ভিড়ের ভিতরে সকলেই ঊর্ধ্বশ্বাসে পরস্পরকে ঠেলিয়া ফেলিয়া উন্মত্তবৎ প্রাণভয়ে পলাইতেছে। কী হইয়াছে? ইহারা হঠাৎ এমন করিতেছে কেন? 

ভীতরবে সকলের প্রাণান্ত চিৎকার! তাহারই পর দিগ্বিদিক ভেদ করিয়া দ্রুতধাবিত অশ্বক্ষুরশব্দে ও সমস্বরিত প্রচণ্ড গর্জনে দশাশ্বমেধ ঘাটের সিঁড়ির ধাপগুলি থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল— ‘আল্লা হু আকবর!’ কমলনয়ন চকিতে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, ঘাটের উপর একদল কৃষ্ণবেশবাসে আবৃত অশ্বারোহী দস্যু উন্মুক্ত অসি হস্তে কোথা হইতে যেন আবির্ভূত, ইতোমধ্যেই তাহাদের কাহারও কাহারও উন্মুক্ত খরতরবার মনুষ্যশোনিতে আরক্তিম! 

আতঙ্কপাণ্ডুর কমলনয়ন কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় ঘাটের রানার উপর উঠিয়া দাঁড়াইল! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *