ছায়াচরাচর – ১০

দশ 

জলের রং পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। গতকালও নীলাভ ছিল, আর আজ প্রভাতবেলায় অর্ণবপোতের উন্মুক্ত পাটাতন হইতে পদ্মাক্ষ চাহিয়া দেখিল, সমুচ্ছ্বসিত জলরাশি ঘোলা দেখাইতেছে। সমুদ্র শেষ করিয়া এই বৃহৎ সদাগরি অর্ণবপোত এখন বড়ো খাঁড়িপথে প্রবেশ করিয়াছে। তাহার বড়ো সাধ হইয়াছিল, সমুদ্র দেখিবে। সমুদ্রের বর্ণনা সে কালিদাসের কাব্যেই কেবল পড়িয়াছিল। কিন্তু পড়ায় আর দেখায় কত যে প্রভেদ! এই অনন্ত নীল বারিধির বিপুলতা, গভীরতা তাহার ধারণারও বাহিরে ছিল। সমুদ্রযাত্রা সম্প্রতি সমাপ্ত করিয়া সে সস্ত্রীক অগ্রদ্বীপ অভিমুখে যাইতেছে। 

এক্ষণে পূর্বকথা কিছু কহিতে হইবে। বিবাহ-অনুষ্ঠান সমাপ্ত হইবার কিছুদিন পর পদ্মাক্ষ জানিতে পারে, পাঠান সৈন্য চন্দ্রদ্বীপ দখল করিয়াছে ঠিকই, কিন্তু তাহারা রাজা কন্দর্পনারায়ণকে হত্যা করে নাই। কন্দর্পনারায়ণ কেবল পাঠানের অধীন এক করদ রাজায় পরিণত হইয়াছেন। কিয়দ্দিবসমধ্যে পদ্মাক্ষর সহিত রাজা কন্দর্পনারায়ণের সংযোগ স্থাপিত হয়। পদ্মাক্ষ অবিলম্বে হৈমবতীকে সঙ্গে লইয়া চন্দ্রদ্বীপ উপনীত হইয়াছিল। সে চন্দ্রদ্বীপে একাকী বসবাস করে দেখিয়া পদ্মাক্ষর পিতামাতা নববধূকে পদ্মাক্ষর সহিত প্রেরণ করিয়াছিলেন। নদীতীরস্থ তাহার সেই কুটির পাঠানের কবলিত হয় নাই। কুটিরে কী-ই বা ছিল যে, তাহা পাঠান সৈন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে? পদ্মাক্ষ ও হৈমবতী সেই কুটিরেই বসবাস আরম্ভ করে। গার্হস্থ্য, কাব্যচর্চা ও রাজসভা লইয়া চন্দ্রদ্বীপে পদ্মাক্ষর দিনগুলি মন্দাক্রান্তা ছন্দে বিরচিত শ্লোকমালার ন্যায় ধীরগতিতে অতিবাহিত হইতেছিল। 

কয়েক বৎসর এইরূপে চলিবার পর পদ্মাক্ষর সাধ হইল, সমুদ্র কীরূপ দেখিবে। সে তাহার অভিলাষ হৈমবতীর নিকট ব্যক্ত করিল। হৈম মহা উৎসাহে কহিল, সেও পদ্মাক্ষর অনুগামিনী হইবে। পদ্মাক্ষ তাহাকে বাধা দেয় নাই। সে হৈমকে ছাড়িয়া এক মুহূর্তও থাকিতে পারে না। সে কি স্ত্রৈণ হইয়া গিয়াছে? তাহা নহে। এই সদ্যোযৌবনপ্রাপ্ত দম্পতির ভিতর এমন একটা বন্ধুত্বপূর্ণ প্রণয়সম্পর্ক রচিত হইয়াছিল যে, দুইজনে একই দৃশ্য দেখিত, একই সঙ্গে হাসিত, একই সঙ্গে খেলা করিত। উভয়ের মন এক হইয়া গিয়াছিল। একজন কিছু একটা উপভোগ করিয়া অন্যকে তাহার স্বাদ না দেওয়া পর্যন্ত স্থির থাকিতে পারিত না। তদুপরি, পদ্মাক্ষর দৃষ্টিতে জীবনের বৃহৎ রূপটাই কেবল ধরা পড়িত, কিন্তু হৈমর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অণুবীক্ষণের ন্যায়, উহাতে প্রতিটি আপাত-ক্ষুদ্র, আপাত তুচ্ছ বিষয়ও গভীর বেদনা ও বিপুল আনন্দের ঐশ্বর্যের ভিতর ক্ষণে ক্ষণে নূতন হইয়া উঠিত। পদ্মাক্ষ হৈমবতীর চক্ষু দিয়া দেখিয়া জীবনকে অভিনবরূপে চিনিতেছিল। 

রাজা পদ্মাক্ষকে সমুদ্রযাত্রায় অনুমতি দিলেন। স্থির হইল, স্থলভাগে কিছুটা পথ ডুলিতে বাহিত হইয়া, তাহার পর আরও কিছুটা পথ নদীতে নৌকাবাহিত হইয়া পদ্মাক্ষ ও হৈমবতী চট্টগ্রাম অবধি যাইবে। সেখানে বণিকদিগের বাণিজ্যতরণী আছে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, পদ্মাক্ষ ও হৈমবতী চট্টলে উপনীত হইয়া দেখিল, পক্ষকালমধ্যে সাতখানি বাণিজ্যতরী সমুদ্রযাত্রায় বাহির হইবার প্রস্তুতি লইতেছে। সেকালে এসকল জলপথ পর্তুগিজ জলদস্যুদের দ্বারা পর্যুদস্ত ছিল। ডি মেলো, গঞ্জালেস প্রভৃতি নামধারী কুখ্যাত পর্তুগিজ দস্যুদিগের দুর্জয় প্রতাপে সে-যুগে নাবিকেরা থরহরি কম্পমান ছিল। পর্তুগিজ জলদস্যু মগ-জাতীয় দস্যুদিগের সহিত মিলিত হইয়া সমুদ্রগামী জাহাজের অসহায় যাত্রীদের উপর চড়াও হইয়া লুঠতরাজ চালাইত। নৃশংস হত্যা, রাহাজানি, লুণ্ঠন, স্ত্রী-অপহরণ প্রভৃতি ভয়াবহ কর্মে ইহারা সিদ্ধহস্ত ছিল। কখনও নদী বাহিয়া সমতল ভূভাগেও প্রবেশ করিয়া ইহারা দস্যুবৃত্তি করিতে দ্বিধা করিত না। চট্টল উপকূলে এই হার্মাদদিগের ভয়ে বাণিজ্যতরীগুলি একা সমুদ্রে যাইতে সাহস পাইত না। নাবিকদিগের নিকট হইতে পদ্মাক্ষ জানিতে পারিয়াছিল, সাতখানি সমুদ্রগামী অর্ণবপোত একত্রে দল বাঁধিয়া যাইবে। তরণীর এই মিছিলকে নাবিকদিগের ভাষায় ‘বহর’ বলা হয়। ইহাদেরই একটায় পদ্মাক্ষ ও হৈমবতীর স্থান হইল। অবশেষে এক ঊষাকালে, অন্ধকার ফিকা হইয়া যখন সবেমাত্র ভোর আসিতেছে, ‘দুর্গা’ নাম স্মরণ করিয়া সাতখানি সদাগরি তরণী ফেনিল স্রোত কাটিয়া সমুদ্রে ভাসিল। 

হৈমবতীর আনন্দের আর অবধি নাই; কয়েক প্রহরের মধ্যে স্থলভাগের শেষ চিহ্ন দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলিয়া গেল— চতুর্দিকে জলরাশি অশান্ত শিশুদের ন্যায় খেলা করিতেছিল। তাহাদের তরঙ্গভঙ্গ, বিপুল উচ্ছ্বাস, তুমুল শব্দ, জাহাজের পাটাতনের উপর টাঙানো সুনীল আকাশস্পর্শী মাস্তুল ও সুবৃহৎ পালের উপর দিয়া উড়িয়া যাওয়া শ্বেতপক্ষ সমুদ্রসারসদিগের পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ, পোতবক্ষে নাবিকদিগের উল্লাস, সম্মিলিত হাস্যধ্বনি, নৌবহরের রণকুশল ‘বহরদার’-এর গম্ভীর চিন্তামগ্ন বিচক্ষণ মুখ, জাহাজের গাত্র দিয়া বহু গবাক্ষপথে নির্গত অজস্র দাঁড় একত্রে টানিবার প্রণালী; সম্মিলিতভাবে অগণিত দাঁড় যখন ছপাছপ শব্দে জলের উপর পড়িতে থাকে, সমগ্র জাহাজটিকে যেন একটি বহুপদবিশিষ্ট প্রকাণ্ড জলজন্তু বলিয়া মনে হয়—এইসব নানা দৃশ্য, নানা বর্ণ, নানা শব্দে পরিপূর্ণ আশ্চর্য অভিজ্ঞতায় তরুণ পদ্মাক্ষ ও তাহার তরুণী বান্ধবী-তথা-স্ত্রী হৈমবতীর চিত্তাকাশ বিস্ময়ে আবিষ্ট হইয়া গেল। 

কিন্তু এ পথে, অস্বীকার করিবার উপায় নাই, বিপদের বহু সম্ভাবনা ছিল। বন্ধুগণ পরিচিতবর্গ সকলেই পদ্মাক্ষকে সাবধান করিয়াছিলেন, স্ত্রী হৈমকে সঙ্গে না লইবার জন্য বহুবিধ উপদেশ দিয়াছিলেন। কিন্তু পদ্মাক্ষ কোনোমতেই তাহার হৈমর আনন্দপ্রোজ্জ্বল মুখখানি ম্লান, বিষণ্ণবিধুর করিয়া দিতে পারে নাই। পথে বিপদ আছে, কিন্তু বিপদের মুখামুখি হইবার রোমাঞ্চও আছে। আর সর্বদাই যে বিপদ আসিয়া ঝাঁপাইয়া পড়ে, এমনও তো নহে। কতবার বাণিজ্যতরীগুলি নির্বিঘ্নে ফিরিয়া আসিয়াছে। 

নীল সমুদ্রের ফেনা মাখিয়া দূরে আরও দূরে জাহাজের বহর সন্দ্বীপের চর পার হইয়া গেল, এস্থলে নোঙর ফেলিল না। এসকল অঞ্চল জলদস্যুদিগের দ্বারা উপদ্রুত। তাহার পর বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঊর্মিমালা পার হইয়া জাহাজ মধ্যসমুদ্রের শান্ত সলিল বাহিয়া গাঢ় নিশীথের কুয়াশামাখা অন্ধকারের ভিতর দিয়া অগ্রসর হইয়াছিল। 

এ যাত্রায় পদ্মাক্ষ-হৈমবতী অনেক দেখিয়াছে। সমুদ্রের নীল জল ভাঙিয়া তাহারা কতদূর গিয়াছিল। দিন গণিয়া গণিয়া মাস গেল, পথ শেষ হয় না। প্রবল বাত্যাঘাতে অর্ণবপোত কলার মোচার ন্যায় কতবার তরঙ্গশীর্ষে চড়িল, মনে হইল, এ বিপুল স্রোতের অভিঘাতে এই সামান্য পোতগুলি বুঝি স্বর্গগমন করিতেছে, পরমুহূর্তেই সে চলোর্মিমালার শীর্ষদেশ হইতে নামিয়া আসিয়া বাণিজ্যতরণীসমুদায় যেন অতল সমুদ্রে ডুবিয়া পাতালের রহস্য ভেদ করিবার পরামর্শ আঁটিতে লাগিল। স্রোতোপরি আন্দোলিত হইতে হইতে অবশেষে অপরাপর নাবিক ও বণিকদিগের সহিত রোমাঞ্চপ্রিয় এই তরুণ দম্পতি দক্ষিণ ভারতের ‘বাসবসমুদ্র’ নামক এক বন্দরে উপনীত হইয়াছিল। 

বাসবসমুদ্র কাঞ্চীপুরের এক গ্রাম, সমুদ্রের তীরে তীরে বাজার বসিয়াছে— প্রধানত সুগন্ধি মশলার বাজার। পর্তুগাল, ফ্রান্স, মূর ও আরব দেশীয় ব্যবসায়ীগণ সওদা করিতে আসিয়াছে, বিচিত্র তাহাদের গাত্রবর্ণ, বিচিত্র পরিধান। সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত মসলিনের পরিবর্তে বেলজিয়ামের মায়াদর্পণ, মরক্কোর চর্ম প্রভৃতি বহুমূল্য মহার্ঘ পণ্যসম্ভার আমদানি হইতেছে। গ্রামগুলি প্রাকারদ্বারা বেষ্টিত, উজ্জ্বল রৌদ্র গোলাকার কুপ ও চতুষ্কোণ তড়াগে প্রতিবিম্বিত হইতেছে, গ্রাম্য তরুণীগণ কেশে মুক্তার মালা পরিধান করিয়া কার্তিকেয়র মন্দিরে পূজা দিতে যাইতেছে… তাহার পর আরও দক্ষিণে সমুদ্রের জল ঠেলিয়া অর্ণবপোত মম্মন্নপুরমে উপস্থিত হইল। কেহ বলে মম্মল্লপুরম, কেহ বলে মহাবলীপুরম। বালিয়াড়ি ফুঁড়িয়া সেখানে প্রস্তরনির্মিত সব আশ্চর্য মন্দির উঠিয়াছে, মন্দিরগাত্রে সুরসুন্দরীদের অম্লান তনুশ্রী আঁকা রহিয়াছে, বৌদ্ধ চৈত্যের অনুকরণে নির্মিত মন্দিরগুলির চূড়া আকাশের নীলে মিশিয়া গিয়াছে। প্রাচীন তামিল ভাষার ঝঙ্কারে স্পন্দ্যমান স্তোত্রমালায় দেবতার বন্দনাগান গীত হইতেছে। একদিন সিদ্ধিবিনায়কের মন্দিরে আরতি দর্শন করিয়া ফিরিতে ফিরিতে রাত্রি নামিয়াছিল… তারার আলোয় বিধৌত এক বিজন বদ্বীপে পদ্মাক্ষ আর হৈমবতী হাত ধরাধরি করিয়া ভিজা পায়ে বালু জল মাখিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়াছিল… 

তাহার পর ফিরিবার পালা আসিল। শোনা গেল, বাণিজ্যতরীগুলি এখনই চট্টলে যাইবে না। সমুদ্র হইতে তাহারা ভাগীরথী বাহিয়া সপ্তগ্রাম, তাহার পরে নবদ্বীপ হইয়া অগ্রদ্বীপ যাইবে। পদ্মাক্ষ ও হৈমবতী স্থির করিল, তাহারাও অগ্রদ্বীপ দেখিবে। আবার যখন বাণিজ্যতরীর বহর বিপরীত পন্থায় চট্টলে ফিরিবে, তখন বণিকদিগের সহিত চট্টলে ফিরিয়া যাইবে। 

এই মুহূর্তে পদ্মাক্ষ জাহাজের পাটাতনের একটি স্তম্ভের উপর হেলান দিয়া ভাগীরথীর স্রোত দেখিতেছিল। সবেমাত্র সূর্য উঠিতেছে। গঙ্গার স্রোতোরাশির উপর গোলাকার লাল কন্দুকের ন্যায় দিনমণি উদিত হইয়াছেন। প্রভাতের রবি, তাই তার প্রখরতা নাই—উদয়াচলের পার হইতে গঙ্গার চলোর্মিমালার উপর প্রথম কিরণের আরক্তিম আভা, আলোর উত্তরীয় স্রোতোবক্ষে ছড়াইয়া দিয়া দিনকর যেন নিদ্রিতা ধরিত্রীর শিয়রে অনিবার্য আশীর্বাদের ন্যায় দাঁড়াইয়া আছেন। বকের পাঁতি শ্রেণীবদ্ধ হইয়া ধীর নিশ্চিত লয়ে গঙ্গার উপর আকাশপথ বাহিয়া এইদিকেই আসিতেছে। অর্ণবপোতের নিম্নে উত্তাল জলশব্দ এ সুনির্জন প্রভাতকালকে মুখর করিয়া রাখিতেছে। 

কাহার পদশব্দে পদ্মাক্ষ ফিরিয়া তাকাইল—হৈমবতী। এ বাণিজ্যতরণীর ক্ষুদ্র দারুনির্মিত একটি প্রকোষ্ঠে তাহারা এই কয়েকমাস আহার, শয়ন, বসবাস করে। হৈম সেই কক্ষ হইতেই জাহাজের পাটাতনের উপর বাহির হইয়া আসিল। তাহার বসন আলুথালু, চক্ষু দুইটি আরক্তিম, চোখের পাতা ঈষৎ ভারী হইয়া আছে। পদ্মাক্ষ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ঘুম হইল?” 

জাহাজের দোলাচলে তাহারা এতদিনে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে, নিদ্রা যাইতে অসুবিধা হয় না। তথাপি, হৈমবতী মাথা নাড়িয়া রহস্যপূর্ণ স্বরে চক্ষে কী একপ্রকার ইঙ্গিত টানিয়া আনিয়া কহিল, “শেষ রাত্রির দিকে ঘুমাইয়াছি। একে তো কাল রজনীতে ঝড় উঠিয়াছিল, তাহার পর তুমি আজিকালি যা ডাকাত হইয়া উঠিতেছ! ঘুমাইতে দাও কই?” 

পদ্মাক্ষ হাসিয়া উঠিয়া কী যেন কহিল, জলের শব্দে তাহা শুনা গেল না। হৈমবতী নিকটে সরিয়া আসিয়া অস্ফুট স্বরে স্বামীর গললগ্না হইয়া কী যেন কহিতেছিল, 

পদ্মাক্ষ মৃদু মৃদু হাসিতেছিল। হাস্য ও প্রণয়ালাপে জাহাজের পাটাতনখানি প্রভাতবেলায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিতেছিল। 

তাহারা প্রেমালাপ করিতেছে, করুক। এই অবসরে এ উপন্যাসের পাঠক-পাঠিকার সঙ্গে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা সারিয়া লই। হে পাঠক, হে পাঠিকে। গল্প শুনিতে শুনিতে ইহা তো ভুলিয়া যান নাই, পদ্মাক্ষ কে? পদ্মাক্ষ হইল একটি সম্ভাবনা। কমলনয়ন গৃহী হইলে যাহা হইত, পদ্মাক্ষ তাহাই। পদ্মাক্ষ কোনো বাস্তব চরিত্র নহে, সে একটি সম্ভাব্য চরিত্র। আমরা কেবল সেই সম্ভাবনাটিকেই পরীক্ষা করিতেছি। আপনাদের স্মরণে থাকিবে, এই বিষয়ে এই গ্রন্থের প্রথমের দিকেই বিস্তারিত আলোচনা সারিয়া রাখিয়াছি। মনে রাখিতে হইবে, পদ্মাক্ষ আমাদিগের পরিচিত বাস্তব পৃথিবীর অংশ নহে, সে ছায়াচরাচরের একটি ছায়াচরিত্র। ইহা না বুঝিলে, এই উপন্যাসের কোনো অর্থ থাকে না। অবশ্য কোনো উপন্যাসেরই কোনো অর্থ নাই, এমনকি এই জীবনও একটি অর্থশূন্য কাহিনি; মানবজীবনের ন্যায় সম্পূর্ণ নিরর্থক উপন্যাস আর একটিও লিখা হয় নাই। যাহাকে আমরা নিরেট বস্তুবিশ্ব বলিয়া থাকি, তাহাও বস্তুত এক ছায়াচরাচর। কিন্তু সে-কথা এখানে নহে, আমরা বরং আমাদিগের পূর্বপরিচিত সেই দম্পতির নিকট ফিরিয়া যাই, তাহারা কী বলিতেছে, শুনি। পদ্মাক্ষ কহিতেছে, “আমাকে বারংবার ডাকাত বলিতেছ, অমি কী-বা হরণ করিয়াছি?” 

হৈমবতী লজ্জারুণ মুখ নামাইয়া অস্ফুট স্বরে কহিতেছে, “সে আমি জানি না!” পদ্মাক্ষ কৌতুক আরও জমাইবার জন্য কহিতেছে, “তবু তো ভালো! আমি তো আর জলদস্যু নই।” 

হৈমবতী কহিতেছে, “জলদস্যুই তো। তাহা না হইলে কেহ জাহাজের ভিতর…” পদ্মাক্ষ কহিতেছে, “জাহাজের ভিতর কী? যতই বলো, আমাকে তুমি জলদস্যু বলিতে পারো না। আমি যাহা লই, তাহা আবার ফিরাইয়া দিই। তখন তো গ্রহণ করিতে দ্বিধা করো না!” 

হৈমবতী লজ্জায় সিন্দুরের ন্যায় রাঙা হইয়া কহিতেছে, “তুমি বড়ো বাচাল হইয়াছ। মুখে আর কিছুই আটকায় না!” 

পদ্মাক্ষ হাসিয়া কহিল, “সত্যই হৈম, তুমি যদি জলদস্যু দেখিতে, তবে আমার সহিত তাহাদের তুলনা করিতে পারিতে না।”

হৈমবতী কহিল, “আর দেখিতেও চাহি না। তোমার মুখে যা সব গল্প শুনিয়াছি, জলদস্যু দেখিবার সাধ আমার উড়িয়া গিয়াছে। আচ্ছা, উহারা অত নির্দয় হয় কেন?” 

পদ্মাক্ষ বলিল, “উহাদের শিরায় ধমনীতে পর্তুগিজ রক্ত বহিয়া যাইতেছে। সেই রক্তে লোভ, পিপাসা, দস্যুতা, অভিযানপ্রিয়তা ক্ষণে ক্ষণে উচ্ছলিত হইয়া উঠিতেছে।” 

হৈমবতী জিজ্ঞাসা করিল, “উহাদের ঘরবাড়ি নাই? উহারা বিবাহ করে না কেন?”

পদ্মাক্ষ উত্তর দিল, “এই সমুদ্রের লবণাম্বুরাশির ভিতর কী একপ্রকার মাদকতা আছে, হৈম! সেই নীল মাদকতাই উহাদের ঘর বাঁধিতে দেয় নাই। এক দেশ হইতে অন্য দেশ, এক সাগর হইতে অন্য সাগরে ভাসাইয়া লইয়া চলিয়াছে। বঙ্গদেশে ইহারা যে কত নারীর সর্বনাশ করিয়াছে। তবে ইদানীং ইহাদের ভিতর একটা পরিবর্তন আসিতেছে, শুনিয়াছি। লুণ্ঠিত নারীদিগকে এখনও ইহারা সামাজিকভাবে বিবাহ করে না ঠিকই, কিন্তু পূর্বের ন্যায় ভোগ করিয়া ফেলিয়াও দেয় না। নিকটে রাখিয়া দেয়। হয়তো বঙ্গদেশের ললিত প্রকৃতির প্রভাবে তাহাদের মনে এই প্রথম প্রেমের অঙ্কুর জন্ম লইতেছে।” 

হৈমবতী দুই করতল দিয়া মুখ ঢাকিয়া কহিল, “মা গো! এই নাকি প্রেম? এরকম অনাসৃষ্টি কথা তো কখনও শুনি নাই। বিবাহ করে না, অথচ কাছে রাখিয়া দেয়?” 

পদ্মাক্ষ কহিল, “হাঁ। লুণ্ঠিত নারীকে কাছে রাখিয়া দেয়। কখনো কখনো তাহাদের সন্তানাদি হয়। পর্তুগিজ পিতার দৃঢ় দেহ, দুঃসাহসী মন আর বঙ্গীয় জননীর লালিত মাধুর্যের এক অপূর্ব মিশ্রণ এইসব সন্তান। তাহাদিগের নীল চক্ষু, আরক্তিম গণ্ডদেশ, সুললিত হস্তপদ। এই এক নূতন জাতি সৃজিত হইতেছে। আমি তাহাদের কাহাকে কাহাকেও দেখিয়াছি।” 

হৈমবতী বড়ো বড়ো চক্ষু তুলিয়া বলিল, “কীভাবে জানি ইহারা একদিন আমাদের সহিত মিশিয়া যাইবে!” 

পদ্মাক্ষ বলিল, “মিশিয়া যাইবে নয়। এখনই মিশিয়া যাইতেছে। আমাদিগের ভাষার ভিতরেও বহু পর্তুগিজ শব্দ ফলিয়া উঠিতেছে। কল্পনা করো, চারি শতবর্ষ পর ইহাদের কী হইবে।” 

হৈমবতী সরলা বালিকার ন্যায় জিজ্ঞাসা করিল, “কী হইবে?” 

“কী আর? ইহাদের কোনো নিশ্চিত আয়ের পন্থা নাই। ইহাদের পর্তুগিজ পিতা দস্যুতা করিয়া যাহা উপার্জন করিতেছে, সকলই নিজ ভোগে লাগাইয়া যাইতেছে। সঞ্চয় বলিয়া কিছুই নাই। ফলত, এই পর্তুগিজ পিতা ও বাঙালি মাতার সন্তানগণ হতদরিদ্র হইবে। দারিদ্র্য ইহাদিগকে অপহরণ কিংবা বেশ্যাবৃত্তির দিকে লইয়া যাইবে। কেহ-বা দাসদাসীর বৃত্তি লইবে,” পদ্মাক্ষ বলিল। 

হৈম কহিল, “অন্যথায় আর উপায় কী? দারিদ্র্যই মানুষকে পথে নামাইয়া দেয়।” 

পদ্মাক্ষ যেন কোনো সুদূর হইতে আত্মগত স্বরে বলিতে লাগিল, “চারি শত বৎসর পর এইরূপই কোনো এক পর্তুগিজ কন্যা হয়তো বঙ্গদেশে বরিশালের কোনো এক গৃহে পরিচারিকার কার্য লইবে। হয়তো তাহার নাম হইবে ‘মনিয়া’। গৃহস্থ বাটীর একপার্শ্বে থাকে, গৃহের পরিষেবা করে। সেই গৃহের একটি কিশোর হয়তো এই পর্তুগিজ কন্যা মনিয়াকে ভালোবাসিবে। কিন্তু এই পর্তুগিজ কন্যার জীবন তো অভিশপ্ত। হয়তো শহর হইতে একদল যুবক এই গৃহে অতিথি হইয়া আসিয়া মনিয়ার শরীর, যৌবন লুটিয়া লইবে। মনিয়ার কিশোর প্রেমিক চেষ্টা করিয়াও ইহা রুখিতে পারিবে না। তাহার পর অভিশপ্ত জীবনের জ্বালা জুড়াইবার জন্য মনিয়া একদিন আত্মহত্যা করিবে। কিশোর প্রেমের এই করুণ পরিণতি মনিয়ার কিশোর প্রেমিকটিকে হয়তো একদিন সেই আগামী যুগের বিষাদব্যথা লিখিতে প্রবুদ্ধ করিবে। কিশোর হয়তো কবি হইবে একদিন। আচ্ছা, সেই অনাগত যুগের কবির কী নাম হইতে পারে?” 

হৈমবতী একটু ভাবিয়া বলিল, “সে তো জীবনকেই ভালোবাসিবে। পাখির জীবন, পতঙ্গের জীবন, সমুদ্রসারসের জীবনের ভিতরেও যে ক্লান্তিহীন আনন্দের আয়োজন, তাহার সহিত মানুষের কেন দেখা হইল না ভাবিয়া সে হয়তো-বা মনে মনে নিরন্তর ব্যথা পাইবে। তাই হয়তো তাহার নাম হইবে—জীবনানন্দ।” 

পদ্মাক্ষ অন্যমনস্ক হইয়া কহিল, “হয়তো-বা!” তাহার কিছু পরেই অন্যমনস্কতার ভাব পরিত্যাগ করিয়া হৈমবতীকে ভয় দেখাইবার সুরে বলিয়া উঠিল, “কিন্তু একথা ভাবিও না, হৈম, আমরা জলদস্যুদিগের আস্তানা পার হইয়া আসিয়াছি। পথিমধ্যে তাহাদের সহিত দেখা হইয়া যাইতেও পারে!” 

এই সময়ে জাহাজের বহরদার বৃদ্ধ পাটাতনের উপর বাহির হইয়া আসিল। লোকটির কত বয়স হইয়াছে, বুঝিবার উপায় নাই। পঞ্চান্ন-ষাট হইতে পারে, আবার সত্তরের উপরেও হইতে পারে। পাকানো চেহারা, মুখে একটিও বয়সের দাগ নাই, অথচ দাড়ি গোঁফ সব পাকিয়া গিয়াছে। মাথার কেশভার পলিত। সে একটা সাদা আলখাল্লা গোছের পরিধান পরিয়া আছে। হস্তে একটি দূরবীন। মধ্যে মধ্যে সেই দূরবীন দিয়া সে যেন কী লক্ষ করিতেছিল। পদ্মাক্ষর দিকে তাকাইয়া সে বলিয়া উঠিল, “জলদস্যুদের ব্যাপারে কী কথা হইতেছিল?” 

“কহিতেছিলাম, জলদস্যুদের আড্ডা এখনও পার হইয়া আসি নাই।” 

বহরদার বলিল, “হ্যাঁ, ঠিকই তো। সম্মুখেই সপ্তগ্রাম। উহা জলদস্যুদের আড্ডা। পর্তুগিজ জলদস্যুরা চট্টগ্রামকে ‘পোর্তো গ্র্যান্ডি’ অর্থাৎ বড়ো পোতাশ্রয় আর সপ্তগ্রামকে ‘পোর্তো পিকানো’ অর্থাৎ ছোটো পোতাশ্রয় বলিয়া থাকে,” তাহার পর খুবই চিন্তিত হইয়া দূরবীনে চোখ রাখিয়া বহরদার কহিল, “গতকাল হইতে দূরে দিগন্তরেখার নিকট কী একটা যেন দেখিতেছি। জানি না, আমার চোখের ভুল কি না।” 

পদ্মাক্ষ বলিল, “কই? আমাদের একবার দেখান দেখি!” প্রথমে পদ্মাক্ষ দূরবীনে চক্ষু সংলগ্ন করিয়া দেখিল। তাহার পর হৈমবতীকেও দেখাইল। সত্যই দিক্‌চক্ররেখার নিকট কী একটা কালো রঙের বিন্দু রৌদ্রালোকে চকচক করিতেছে। 

বেলা বাড়িলে সেই কালো বিন্দুটা ক্রমশই বড়ো হইতে লাগিল। পদ্মাক্ষ সমস্ত সময় বহরদারের দূরবীনে চক্ষু লাগাইয়া বসিয়া ছিল। ক্রমে যখন মধ্যাহ্নের দীপ্তি প্রকট হইল, তখন সেই দূরবীনে চক্ষু রাখিয়া তাহাদের মুখ শুকাইয়া গেল। 

অদুরে একটা কৃষ্ণবর্ণের জাহাজ সত্যই প্রকাশ পাইতেছে। একবার মনে হইল, জাহাজটা জলের উপর স্থির হইয়া তরঙ্গের উপর কেবল উঠিতেছে, পড়িতেছে। তাহার পর এই ভ্রম দূরীভূত হইল। না, জাহাজটা তাহাদের বহরের দিকেই আসিতেছে। মাস্তুলের উপর একটা কালো পতাকা উড়িতেছে। পতাকার উপর মানুষের মাথার করোটি এবং তাহার নিম্নে দুইটা অস্থি আড়াআড়িভাবে পরস্পর ছেদ করিয়া আছে। বহরদার শুষ্ক কণ্ঠে সভয়ে পদ্মাক্ষর উদ্দেশে কহিল, “আমরা জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছি। যতদূর মনে হয়, এ সেই গঞ্জালেসের জাহাজ!” 

ত্বরিতে কালক্ষেপ না-করিয়া বহরদার বিপদসূচক ঘণ্টা বাজাইয়া দিল। সাতটি বাণিজ্যতরণীর সমস্ত নাবিক, সারেঙ, যাত্রী দ্রুতবেগে কাঠের পাটাতন হইতে যে যাহার কক্ষে প্রবেশ করিল। লাঠি, সড়কি যাহার যাহা আছে, তাহা লইয়াই প্রস্তুত হইতে লাগিল। তোপদাররা তোপ নিক্ষেপ করিবার জন্য আয়োজন আরম্ভ করিল। 

পদ্মাক্ষ দ্রুত পদবিক্ষেপে কক্ষের ভিতর আসিল। প্রভাতে তাহারা যে-জলদস্যুর কথা বলিতেছিল, তাহা যে এত শীঘ্র, এত অনিবার্যভাবে সত্য হইয়া যাইবে, ভাবে নাই। কক্ষের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিল, হৈম রক্তশূন্যমুখে তাকাইয়া আছে। সেও বিপদসংকেত শুনিয়াছে। 

“ভয় পাইও না, হৈম, কিছু একটা ব্যবস্থা হইবে,” পদ্মাক্ষ এ কথা বলিল বটে, কিন্তু বলিবার সময়ে তাহার গলা কাঁপিয়া গেল। 

হৈম নিকটে সরিয়া আসিয়া উত্তেজিত স্বরে কহিল, “কথা দাও, আমার জন্য তুমি তোমার নিজের জীবন বিপন্ন করিবে না।” 

পদ্মাক্ষ বলিল, “ইহা কোনো কথাই নহে। আমি কখনোই তোমাকে বিপদের মুখে ফেলিয়া যাইব না। মরিতে হয়, দুইজনে একসঙ্গে মরিব।” 

হৈম স্থির কঠিন কণ্ঠে বলিল, “না, আমার জন্য চিন্তা করিও না। আমার সহিত এই বিষের কৌটা আছে। ইহা আমি এই অভিযাত্রার প্রথম হইতেই সঙ্গে রাখিয়াছি। প্রয়োজনে কালকূট পান করিয়া প্রাণ দিব, তবু আমার সতীত্ব লুণ্ঠিত হইতে দিব না।” 

কথা শেষ হইবার পূর্বেই কাঠের পাটাতনের উপর একটা গোলা ছুটিয়া আসিয়া সহসা কানে তালা ধরানো প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হইল। কক্ষের দ্বারপথ দিয়া শ্বাসরোধকারী ধুমের ভিতর হৈমবতীর হাত ধরিয়া পদ্মাক্ষ বাহির হইয়া আসিল। দেখিল, অগণিত পতঙ্গের ন্যায় জলদস্যুদের ডিঙাগুলি তাহাদের অর্ণবপোতকে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। অন্যদিকে জলদস্যুদের জাহাজ হইতে মুহুর্মুহু তোপ দাগা হইতেছে। 

পদ্মাক্ষদের বহর হইতেও গোলা ছুটিতেছে। সমস্ত নদী যেন অগ্নিময় হইয়া উঠিয়াছে। গোলা বুকে গায়ে লাগিয়া উভয়পক্ষের লোকজন উড়িয়া গিয়া স্রোতের উপর পড়িতেছে। নদীজল রক্তে লাল হইয়া উঠিতেছে। 

পদ্মাক্ষ কী করিবে ভাবিতেছে, এমন সময়ে তাহাদের বাণিজ্যতরণীর গা বাহিয়া একটা জল্লাদের ন্যায় লোক উঠিয়া আসিল। লোকটা জলদস্যুদের ডিঙিতে করিয়া এই জাহাজে আসিয়াছে। তাহার সহিত ভয়ালদর্শন আরও কয়েকজন লোক উঠিয়া আসিল। ইহাদের সকলেরই গাত্রবর্ণ রৌদ্রে পুড়িয়া তামটে হইয়াছে। কটা চুল, আরক্ত দৃষ্টি, চক্ষের মণি নীল। উহারা লাথি মারিয়া জাহাজের সমস্ত কক্ষের দুয়ার ভাঙিয়া ফেলিতেছে। জাহাজে যা কিছু আছে—অর্থ, বিত্ত, রত্নসামগ্রী সোল্লাসে লুণ্ঠন করিতেছে। 

পদ্মাক্ষ সেই ধুম্রজালের ভিতর দিয়া হৈমবতীর হস্ত ধারণ করিয়া পাটাতনের অন্য দিকে যাইতেছিল। সহসা মাস্তুলের আড়াল হইতে একটা ভীষণদর্শন লোক বাহির হইয়া আসিল। ক্রূর মদির হাসিয়া সে হৈমবতীর দিকে অগ্রসর হইল। 

পদ্মাক্ষ হৈমবতীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “খবরদার! আমার স্ত্রীর গাত্রে হস্তার্পণ করিও না। তাহার পূর্বে আমাকে হত্যা করিতে হইবে।” এই বলিয়া ইতস্তত দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া সে পাটাতনের উপর পড়িয়া থাকা একগাছি স্থুল রজ্জু বা কাছি দেখিতে পাইল। সেই কাছিটাকে তুলিয়া লইয়া পদ্মাক্ষ মাথার উপর ভীষণবেগে চক্রাকারে ঘুরাইতে লাগিল। ততক্ষণে সে লোকটাও কটি হইতে শাণিত তরবারি বাহির করিয়া আনিয়াছে। 

দুর্বোধ্য ভাষায় সেই পর্তুগিজ দস্যু কী যেন গালাগাল দিয়া পদ্মাক্ষকে আঘাত করিবার জন্য সশব্দে তরবারি আস্ফালন করিল। কিন্তু ঘূর্ণমান কাছিতে বাধাপ্রাপ্ত হইয়া সামান্য পিছাইয়া গেল। কখনও মাস্তুলের গাত্রে তরবারি কাটিয়া বসিল, কখনও কাছির একটা অংশে আঘাত লাগিয়া তরবারি হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া আসিল। বাম হস্তে হৈমবতীকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া পদ্মাক্ষ দক্ষিণ হস্তের দ্বারা সবেগে চক্রাকারে রজ্জু ভ্রামিত করিতেছিল। সহসা এক মুহূর্তের অসাবধানতায় রজ্জু শিথিল হইয়া গেল। অমনই দস্যুটা যেন শিকারলুব্ধ হিংস্র ব্যাঘ্রের ন্যায় ব্যূহ ভেদ করিয়া হৈমবতীকে গিয়া ধরিয়া ফেলিল। হৈমবতী আতঙ্কে আর্তনাদ করিয়া উঠিল। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া পদ্মাক্ষ চাবুকের ন্যায় সেই কাছি দিয়া দস্যুটাকে সপাটে প্রহার করিতেই তাহার অতর্কিত আঘাতে দস্যুর হস্ত হইতে তরবারি ছিটকাইয়া পড়িল। লোকটা বাঁচিবার তাগিদে হৈমর হাত ছাড়িয়া দিল। সে পাটাতনের উপর হইতে তরবারি তুলিয়া লইবার জন্য পুনরায় অগ্রসর হইতেছে দেখিয়া পদ্মাক্ষ আর কালক্ষেপমাত্র না-করিয়া হৈমবতীকে কহিল, “হৈম, আর নয়। আইস। আমার হাত ধরো।” 

তৎক্ষণাৎ দুইজনে হাতে হাত ধরিয়া সেই তরণীর পাটাতন হইতে নদীর উত্তাল তরঙ্গমালায় ঝাঁপ দিল। নিম্নে আলোড়িত, উন্মত্ত, ফেনিল, গর্জনশীল স্রোতোঘঘরের ভিতর সেই মুহূর্তে যে তাহাদের কী হইল, তাহা এ উপন্যাসের লেখক ও পাঠক, উভয়ের কেহই আর দেখিতে পাইলেন না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *