ছায়াচরাচর – ১

এক 

জ্যৈষ্ঠমাসের অকাল বর্ষণে পদ্মা ফুলিয়া ফাঁপিয়া বিপুলা হইয়াছে। স্পষ্ট তীরভূমি আর নাই; নিকটস্থ গ্রামসকল পদ্মা গ্রাস করিয়া লইয়াছে। ধান্যক্ষেত্রগুলি জলমগ্ন, যদিও এতদঞ্চলে জল যত বাড়ে, ধ্যান্যরাজি সেই জলের সঙ্গে সঙ্গে ততই বর্ধিত হইয়া আত্মরক্ষা করিয়া থাকে। সিতশুভ্র জলতলের উপর হরিৎ বর্ণের ধানের শিষ অপূর্ব শোভা বিস্তার করিতেছে। যতদূর দেখা যায়, তরঙ্গসঙ্কুল জলরাশি বিস্তৃত হইয়া একেবারে দিগন্ত চুম্বন করিয়াছে। অপরাহ্ণের স্তিমিত আলোকের ভিতর একটি ‘হংসমুখী’ নৌকা অনুকূল পবনে পাল খাটাইয়া ধীরগতিতে ভাসিয়া চলিতেছে। নৌকার খোলের ভিতর আম্র ও ডাব রাশীকৃত হইয়া পড়িয়া আছে। ফলগুলি কিছু পরিপক্ক সুবর্ণ, কিছু বা মসৃণ শ্যাম। নৌকার ছইয়ের নিকট এক প্রৌঢ় ব্যক্তি এবং প্রায় দ্বাদশবর্ষীয় এক সদ্যোকিশোর বসিয়া আছে। গলুইয়ের সমীপে কয়েকজন মাঝিমাল্লাকেও অলসভাবে বসিয়া কথালাপে কালহরণ করিতে দেখা যায়। 

কিশোর প্রৌঢ়কে সকাতরে জিজ্ঞাসা করিল, “চন্দ্রদ্বীপ পহুঁছিতে আর কয় দিন লাগিবে?” 

প্রৌঢ় উত্তর দিলেন, “আমাদিগের গ্রাম উনসিয়া হইতে চন্দ্রদ্বীপ সচরাচর নদীপথে পাঁচদিনের পথ। কিন্তু এখন ঘোর প্লাবন হইয়াছে, এ সময় জলস্থল একাকার হওয়া তিন দিনের মধ্যেই চন্দ্রদ্বীপে উপনীত হইতে পারিব।” 

কিশোর পুনরায় ব্যাকুল কণ্ঠে কহিল, “রাজা আমার কবিতা শ্রবণ করিবেন তো?” 

প্রৌঢ় কহিলেন, “শুনিবেন বাবা, শুনিবেন। তবে ইদানীং রাজ্য বহিরাক্রমণকারীর দ্বারা আক্রান্ত। রাজাও প্রতিরক্ষাকার্যে মহাব্যস্ত। তথাপি, আমরা ব্রাহ্মণ। আমাদিগের আবেদন শ্রবণ করিবার অবসর নিশ্চয়ই তাঁহার হস্তে থাকিবে। ও বিষয়ে তুমি উদ্‌বিগ্ন হইও না, কমলনয়ন! তোমার জননী তোমার জন্য পুঁটুলির ভিতর কতকগুলি খইয়ের মোয়া বাঁধিয়া দিয়াছেন, এক্ষণে এইসব জলমগ্ন ভূভাগ দেখিতে দেখিতে তুমি সেই মোয়াগুলি ভক্ষণ করো।” 

পিতার বাক্যে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া কিশোর কমলনয়ন পুঁটুলির ভিতর হইতে মোয়া বাহির করিয়া খাইতে লাগিল। তাহার পিতা প্রৌঢ় পণ্ডিত; নাম— প্রমোদন পুরন্দর। ইঁহারা কোটালিপাড়া পরগনার অন্তঃপাতী উনসিয়া গ্রামের পণ্ডিত বংশ। শাস্ত্রাধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজন-যাজনই ইঁহাদের পুরুষানুক্রমিক বৃত্তি—বহু প্রজন্ম ধরিয়া প্রাচীন বিক্রমণিপুরের অংশবিশেষ এই শান্ত পল্লীজীবনে ইহারা নিরুপদ্রবভাবে বসবাস করিয়া আসিতেছেন। প্রমোদন পুরন্দরের বসতবাটী, বাগান ও জমিজমা যা আছে— সকলই চন্দ্রদ্বীপের রাজা কন্দর্পনারায়ণের রাজত্বের অন্তর্গত। প্রতি বৎসর রাজকর দিবার নিমিত্ত প্রমোদন পুরন্দরকে রাজসকাশে যাইতে হয়। বাগানে আম, ডাব, তরমুজ, ফুটি, প্রভৃতি ফলাদি যাহা ফলে, তাহারই কতকাংশ বৎসরে একবার নৌকাযোগে চন্দ্রদ্বীপ রাজসরকারে জমা করিয়া আসেন। কিন্তু সম্প্রতি প্রমোদন পুরন্দর প্রৌঢ় হইয়াছেন, এ কর জমা করিবার হাঙ্গামা এ পরিণত বয়সে আর পোষায় না। ভাবিতেছেন, এইবার রাজসকাশে উপস্থিত হইয়া রাজাকে কোনোমতে প্রীত করিয়া এক বিশেষ নিবেদন জ্ঞাপন করিবেন। উনসিয়া গ্রামেই রাজার এক প্রতিনিধি বাস করেন। ওই রাজপ্রতিনিধির হস্তে রাজকরস্বরূপ এই ফলগুলি তুলিয়া দিলে আর নৌকায় দীর্ঘপথ অতিক্রম করিয়া চন্দ্রদ্বীপে যাইতে হয় না। কিন্তু রাজাকে সন্তুষ্ট করা যায় কী প্রকারে? 

ভাবিতে ভাবিতে প্রমোদন পুরন্দর এক উপায় স্থির করিয়াছেন। তিনি চারি পুত্রের জনক; কমলনয়ন তাঁহার তৃতীয় পুত্র। নামকরণ সার্থক, কিশোরের আয়তসুন্দর চক্ষুদুটি যে দেখিবে, সে-ই এ কথা কহিবে। নেত্রদ্বয় পদ্মের ন্যায় কোমল, পদ্মেরই ন্যায় বিস্তৃত। তাহার কপালের উপর চূর্ণ কুন্তল আসিয়া পড়িয়া মুখশ্রীকে আরও সুন্দর করিয়াছে। নাসা সুচারু, ওষ্ঠ দুইটি আরক্তিম, প্রশস্ত স্কন্ধ, দীর্ঘচ্ছন্দ বাহু। কিন্তু সকলের উপর তাহার অঙ্গের লালিত্য; এক আশ্চর্য সুকুমার কমনীয়তা কিশোরের গৌর অবয়বকে অধিকার করিয়া রাখিয়াছে। বাল্যে কমলনয়নের শিক্ষা পিতার নিকটই হইয়াছে, কলাপ ব্যাকরণ ও ন্যায়শাস্ত্রের প্রাথমিক জ্ঞান মেধাবী বালক ইতোমধ্যেই অর্জন করিয়াছে। তথাপি, তাহার বিশেষত্ব কাব্যে; অষ্টম বর্ষ হইতেই সুদর্শন বালক শ্লোক রচনা করিতে পারে। গ্রাম্য প্রকৃতির নিসর্গদৃশ্য, আকাশের মহান বিস্তার, নদীর স্বচ্ছন্দ গতি, সন্ধ্যার অতলান্ত অন্ধকার—কিশোর যখন যাহা দেখে, তাহাই সুললিত কবিতায় প্রকাশ করিয়া থাকে। উনসিয়া গ্রামে পুত্রের এতাদৃশ কবিখ্যাতি দেখিয়া প্রমোদন পুরন্দর ভাবিয়াছেন, এইবার রাজসকাশে কমলনয়নকে সঙ্গে লইয়া যাইবেন। রাজা বিদ্যোৎসাহী; কমলনয়ন রাজাকে কবিতা শুনাইয়া মুগ্ধ করিবেন আর এই অবসরে পুরন্দর তাঁহার মনোগত অভিপ্রায়—আর যাহাতে এতদূরে চন্দ্রদ্বীপে আসিয়া কর না দিতে হয়—রাজসকাশে সেই আবেদনই জ্ঞাপন করিবেন। কমলনয়ন এত কথা জানে না, দূরদেশে নদীপথে যাইবে, দেশের রাজাকে সে কবিতা শুনাইতে পারিবে, এই কথা শুনিয়াই সে সোৎসাহে নৌকায় চাপিয়া বসিয়াছে। খইয়ের মোয়া খাইতে খাইতে সে জলস্রোত দেখিতেছিল। নদীতীরে তাহাদের গ্রাম, নদীঘাটের সমীপেই তাহাদের আবাস, গৃহে বসিয়াই বাতায়নপথে সে নদী দেখিয়াছে, কিন্তু নৌকায় করিয়া ভরানদীতে ভাসিয়া বিপুলা পদ্মার এইরূপ স্রোতোবেগ সে কখনও কল্পনাও করে নাই। তাহাদিগের পল্লী কৃষিক্ষেত্রদ্বারা বেষ্টিত, সুদীর্ঘ বেত ও বাঁশের বনের অন্তরালে গ্রামের গৃহগুলি যেন লুক্কায়িত হইয়া থাকে। গ্রামে পুষ্করিণী, তড়াগাদি প্রচুর; পুষ্করিণীর ধারে ধারে জবা, টগর, অপরাজিতা, শেফালিকার মেলা বসিয়াছে। এইসব ফুল পুষ্করিণীর বক্ষে ঝরিয়া পড়িয়া ভাসিয়া যায়, তখন কী শোভাই না বিস্তার করে। পল্লীর দুইদিকে খাল, অনেকসময়ে নৌকা, ডোঙা কিংবা কলার মান্দাসে করিয়া এক গৃহ হইতে অন্য গৃহে, এক গ্রাম হইতে অন্য গ্রামে যাইতে হয়। কাজেই জলের প্রবলতা কিশোর কমলনয়ন বাল্যকাল হইতেই দেখিয়াছে। তথাপি নদীবক্ষে বিহার না করিলে সে কখনও পদ্মার এই সর্বগ্রাসী রূপ প্রত্যক্ষ করিতে পারিত না। দেখিতে দেখিতে কমলনয়ন ভাবিতেছিল, চারিপাশের গ্রামগুলি যেমন এই পদ্মা গ্রাস করিয়া লইয়াছে, তেমনই পদ্মা অপেক্ষাও আরও বিপুলা এমন নদী কি কোথাও আছে, যাহা এই পৃথিবী, দূরের আকাশ, যাহা কিছু দেখিতেছে, শুনিতেছে, সকল কিছুকেই এক লহমায় গ্রাস করিয়া লইতে পারে? আচ্ছা, রাত্রির অন্ধকারে তো সবই ডুবিয়া যায়, অন্ধকার ধরিত্রীকে গ্রাস করে, কিন্তু সেই অন্ধকারকে গ্রাস করে কে? কিশোরের মন বিচিত্র কল্পনায় ও ততোধিক বিস্ময়ে আবিষ্ট হইয়া যায়। কিছুক্ষণ পরে সে পিতাকে প্রশ্ন করে, “তাত! পদ্মাই কি একমাত্র নদী? ভূমণ্ডলে আর নদী নাই?” 

প্রমোদন পুরন্দর বলিলেন,”পদ্মাই কি আর একমাত্র নদী? আরও কত নদী আছে। কলিকলুষনাশিনী ভাগীরথী গঙ্গারই তো অংশবিশেষ এই পদ্মাবতী। এই পদ্মা কিয়দ্দূর প্রবাহিত হইয়া ব্রহ্মপুত্র নদের সহিত মিশিয়াছে। তখন তাহার স্থানীয় নাম হইয়াছে যমুনাবতী। যমুনা আবার দক্ষিণাভিমুখে কিয়দ্দূর গমন করিয়া মেঘনার সহিত মিলিয়াছে। মেঘনা ক্রমে ক্রমে বিপুলা হইয়া আরও দক্ষিণদিকে গমন করিয়া সমুদ্রে মিশিয়াছে।” 

“তবে সমুদ্রই কি সকল নদীর অস্তিম গমনস্থল? আচ্ছা, যদি কোনো নদী শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে না যাইতে পারে?” 

প্রমোদন পুরন্দর বলিলেন, “সমুদ্রে যাইতেই হইবে, বৎস। পদ্মার ওই স্রোতোশব্দে কান পাতিয়া শুন— শুনিতে পাইবে অশান্ত ঢেউগুলি ‘সমুদ্রে যাইব, সমুদ্রে যাইব’ বলিয়া কলরব করিতেছে। আর দেখ বৎস, আমাদিগের জীবনও এই নদীর ন্যায়!” 

“আমাদিগের জীবনও নদীর ন্যায়? আমরা তাহা হইলে কোথায় যাইতেছি?”

ব্রাহ্মণ এ প্রশ্নের উত্তরে ক্ষণেক চুপ করিয়া রহিলেন। কিয়ৎপরে কাহার উদ্দেশে যেন নমস্কার জ্ঞাপন করিয়া সুললিত কণ্ঠে উচ্চারণ করিলেন, “নৃণামেকো গম্যত্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব—তুমিই মানুষের সেই এক গন্তব্যস্থল—সেই একমাত্র সমুদ্রসঙ্গম!” কিশোর কিছু বুঝিল, কিছু বুঝিল না; নিজমনে আপন প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে লাগিল। 

ক্রমশ অপরাহ্ণ পড়িয়া আসিল। মাঝিমাল্লারা দাঁড় টানিয়া নৌকাকে তীরের নিকট লইয়া যাইতে লাগিল। নিকটস্থ তীরভাগে নৌকা বাঁধিয়া এস্থলে রাত্রি যাপন বিধেয়। রন্ধনবণ্টনাদি নদীতীরেই সমাধা করিতে হইবে। 

সায়াহ্নে ছায়া নদীর উপর আসিয়া পড়িতেছে। ছায়া ছায়া অন্ধকারের ভিতর নীড়ে প্রত্যাবর্তনকারী পক্ষীকুল বিহগভাষায় কী কথা বলিতে বলিতে আকাশপথে উড়িয়া চলিয়াছে। কিশোর কমলনয়ন মুগ্ধনেত্রে সব দেখিতেছিল, শুনিতেছিল। গৃহগত বেষ্টনীর বাহিরে এই প্রথম আজ প্রাক্সায়াহ্নে যেন তার জীবনের মুগ্ধপাঠ হইতেছিল। বন্ধনহীন মুক্ত জীবনের সংগীত তাহার অন্তরবীণার তারে প্রথম রণিত হইতেছিল। পশ্চিম দিগন্তে অস্তরশ্মির আভা যেন কোথায় হারাইয়া যাইতেছে। কে এক উদাসী পথিক জীবনের সকল পথ পার হইয়া ওই অস্তাভার ভিতর যেন লীন হইতে চলিল। সে যেন কোন্ সুদূর লোক! সে-অজানিত জগতে যেন সকলকেই একদিন যাইতে হইবে, সেখান হইতে আর কোনোদিন প্রত্যাবর্তন হইবে না। সেই অজ্ঞাত রাজ্যে আলোকের উদয় নাই, অস্ত নাই… অথচ তাহারই বিভায় যেন এই নদী, এই সন্ধ্যার আকাশ, ওই বিহগকুল, ওই দূরের গ্রামগুলি প্রকাশমান হইয়া রহিয়াছে… 

পিতার স্পর্শে কিশোরের সম্বিৎ ফিরিল। প্রমোদন পুরন্দর অতি কোমল স্বরে পুত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৎস! জননীর জন্য মন উদাস হইতেছে?” 

কিশোর ঈষৎ শিরশ্চালন করিয়া কহিল, “না।” তাহার পর ধীরে ধীরে আত্মগত স্বরে পিতার উদ্দেশে বলিল, “রাজা যদি আমার নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন, তবে আমার গৃহগত নাম ‘কমলনয়ন’ কহিবেন না।” 

“তবে কী কহিব?” 

“জাতপত্রিকায় আমার যে-নাম আছে, উপনয়নের সময়ে আমায় যে-নাম ধরিয়া ডাকিয়াছিলেন, রাজসমীপে সেই নামেই আমার পরিচয় দিবেন। আমার নাম মধুসূদন!” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *