ছায়াচরাচর – ২

দুই 

কয়েকদিনের মধ্যেই প্রমোদন পুরন্দর চন্দ্রদ্বীপে উপনীত হইলেন। রাজসরকারে রাজস্বস্বরূপ আম ও ডাবগুলি জমা করিতে এক দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। 

রাজকীয় অতিথিশালায় পিতা-পুত্রের স্থান মিলিয়াছে। ব্রাহ্মণের সেবার জন্য পৃথক ব্যবস্থা আছে। ভাণ্ডার হইতে চাল, ডাল প্রভৃতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মিলে, পুরন্দর তাঁহার ও তাঁহার পুত্রের জন্য স্বপাক রন্ধন করেন। নূতন দেশ ও নূতন পরিবেশে কমলনয়ন মহা উৎসাহে ঘুরিয়া বেড়ায়। অতিথিশালার কক্ষসমূহে নানা দেশ হইতে অতিথি আসিয়াছে। কিশোর প্রাণ খুলিয়া সকলের সঙ্গে মিশে; তাহারাও এই কমনীয় কিশোরের সান্নিধ্য কামনা করে। যে যাহা দেয়, কিশোর কমলনয়ন তাহাই আহার করে, ইহাতে তাহার কোনো বাছবিচার নাই, যদিও এ সকল কথা পিতা প্রমোদন পুরন্দর জানেন না, জানিলে অনর্থ হইত। 

অতিথিশালার এক প্রান্তে ক্ষুদ্র অপরিসর একটি কক্ষে একজন বিচিত্র মানুষের সহিত কমলনয়নের সাক্ষাৎ হইল। লোকটির বয়স হইয়াছে; শরীরের আকৃতি মাঝারি এবং গাত্রবর্ণ গৌর। গোলাকার মুখমণ্ডলে চক্ষুদুইটি বংশপত্রের ন্যায় প্রলম্বিত, নাসা খর্ব। কপালে শ্বেতচন্দনের তিলক, মুখে হাসিটি লাগিয়াই আছে; সে-ব্যক্তি সদাই প্রসন্ন। শ্বেত বস্ত্রধারী, সঙ্গে একটি একতারা আছে, সেই একতারা সহযোগে মধ্যে মধ্যে গান করে। আর একটি ঝুলি আছে, তাহা হইতে খঞ্জনী বাহির করিয়াও বাজায়। কথাবার্তা বড়ো সুন্দর, সুমধুর বাকবিন্যাস। কমলনয়ন উহার নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করিল, অতিথি বলিল, “আমার নাম বনমালী জমাতিয়া, আরও পূর্বে ত্রিপুর রাজ্য আছে, সেখানেই আমার নিবাস। সম্প্রতি নবদ্বীপ হইতে আসিতেছি।” 

‘নবদ্বীপ’ কথাটি বলিবার সময়ে সে দুই হাত জোড় করিয়া কাহাকে যেন নমস্কার করিল। কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল, “নবদ্বীপ গিয়াছিলেন কেন?” 

বনমালী বলিল, “নবদ্বীপ যে গৌরাঙ্গসুন্দরের লীলাস্থান। আমি সেই পুণ্যভূমির ধুলা গায়ে মাখিয়া ত্রিপুররাজ্যে ফিরিতেছি।” 

কমলনয়ন অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “গৌরাঙ্গসুন্দর কে?” 

বনমালী বলিল, “নবদ্বীপে গোরা অবতার হইয়াছেন যে! স্বয়ং ভগবান রাধাভাবসুবলিত তনু ধরিয়া সেখানে প্রেম বিলাইয়াছেন। সে প্রেমের স্পর্শ নবদ্বীপের আকাশে-বাতাসে আজও লগ্ন হইয়া আছে—যে যাইতেছে, সেই-ই আণ্ডিল হইয়া ফিরিতেছে।” এই পর্যন্ত বলিয়া সে খঞ্জনী বাজাইয়া গান ধরিল- 

“প্রেমধন বিলায় গোরারায়। 
প্রেম কলসে কলসে ঢালে তবু না ফুরায়! 
চাঁদ, নিতাই ডাকে আয়! আয়! চাঁদ, গৌর ডাকে আয়! 
(ওই) শান্তিপুর ডুবুডুবু নদে ভেসে যায়।” 

গান গাহিতে গাহিতে বনমালীর দুই চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল। কমলনয়ন অবাক হইয়া তাহাকে দেখিতেছিল। এ লোকটির এ কী দশা হইয়াছে? কমলনয়ন ভাবিতেছিল, সে কেমন লোক, যাঁহার কথা বলিতে বলিতে মানুষ প্রেমে পাগল হইয়া যায়, হাসে, কাঁদে, নাচে, গায়? বস্তুত, বনমালীর অকিঞ্চন ভাব ও নিঃসংকোচ ব্যবহার কিশোরকে যারপরনাই মুগ্ধ করিল। 

কমলনয়ন বুদ্ধিমান, তদুপরি তাহার সংস্কার শুদ্ধ সংস্কার। সে আভাসে বুঝিয়া লইল, নবদ্বীপ নিশ্চয়ই কোনো আশ্চর্য মানুষের স্পর্শে ধন্য হইয়াছে। সে বনমালীকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি যদি নবদ্বীপ এতই ভালোবাসেন, তবে নবদ্বীপ ছাড়িয়া দেশে ফিরিতেছেন কেন?” 

বনমালী কহিল, “আমি তো নবদ্বীপেই থাকিতে চাহিয়াছিলাম। কিন্তু মহাপ্রভুর অন্যতম পার্ষদ নিত্যানন্দপ্রভু আমাকে কহিলেন, বনমালী বাউল! তোমার মাতৃভূমিতে ফিরিয়া যাও। সেখানে আচণ্ডাল সকলের ভিতর হরিনাম বিলাইয়া দাও। এ যুগে হরিনাম মহামন্ত্র! দেখিও, কখনও ঈশ্বর ব্যতীত আর কাহারও দাসত্ব করিও না।”

“আচ্ছা, আমি যদি কোনোদিন মহাপ্রভুর দেখা পাই, তিনি কি আমাকে বালক বলিয়া ফিরাইয়া দিবেন?” ব্যাকুলস্বরে কমলনয়ন প্রশ্ন করিল। 

বনমালী জমাতিয়া কিশোর কমলনয়নের চিবুক ধরিয়া আদর করিয়া কহিল, “তাহার নিকট বালক-বৃদ্ধ, পণ্ডিত-মূর্খ, ধনী-গরিব, জাত-কুজাত কোনো ভেদ নাই। তাঁহার দেখা পাইলে, তোমার এমন বালগোপালের ন্যায় সুন্দর প্রেমের চক্ষু, তোমাকে তিনি সবার আগে টানিয়া লইবেন। কিন্তু ইদানীং তাঁহার দেখা পাওয়া বড়ো কঠিন!” 

‘দেখা পাওয়া কঠিন’ কথাটা কমলনয়ন ভালো করিয়া তলাইয়া দেখিল না। উদগ্র আবেগে সে জিজ্ঞাসা করিয়া ফেলিল, “আচ্ছা, সেই নবদ্বীপ কতদূর?” 

বনমালী হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “কী গো? এখনই যাবে নাকি? নবদ্বীপ এখান হইতে বহুদুরে। সময় হউক, তিনি নিজেই তোমাকে টানিয়া লইবেন।” 

নিজকক্ষে প্রত্যাবর্তন করিয়া কমলনয়ন দেখিল, পিতা তখনও ফিরিয়া আসেন নাই। বেলা দ্বিপ্রহর হইয়াছে! 

বস্তুত, প্রমোদন পুরন্দর বড়োই বিপাকে পড়িয়াছেন। রাজা কন্দর্পনারায়ণের সহিত সাক্ষাতের ব্যবস্থা কোনোমতে করিতে পারিতেছেন না। চন্দ্রদ্বীপ পাঠান সৈন্যের দ্বারা আক্রান্ত। একবার লুঠতরাজ করিয়া পাঠান চলিয়া গিয়াছিল, পুনরায় তাহারা আরও লোকবল সংগ্রহ করিয়া ফিরিয়া আসিতেছে। রাজা প্রতিরক্ষার জন্য সৈন্য সাজাইতেছেন। দরবারে বসিবার সময় নাই। এমতাবস্থায় কীরূপে রাজার সহিত দেখা করিয়া নিজ নিবেদন জ্ঞাপন করা যাইতে পারে, সে-বিষয়ে রাজসভার বিশিষ্ট সদস্যদিগকে তদবির তদারক করিতে করিতে বৈষয়িক কর্মে সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত নিরুপদ্রব পণ্ডিত প্রমোদন পুরন্দর নাজেহাল হইয়া যাইতেছেন। যাহা হউক, ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করিয়া উপযুক্ত সুযোগের নিমিত্ত অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। 

কয়েকদিন পর সেই সুযোগ মিলিল। পুরন্দর তাঁহার পুত্র কমলনয়নকে লইয়া রাজসভার মধ্যে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, সভা সভাসদে পরিপূর্ণ, কিন্তু রাজা তখনও আসেন নাই। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদিগের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে পুরন্দর ও কমলনয়ন উপবেশন করিলেন। 

কিছুক্ষণ পর রাজা কন্দর্পনারায়ণ সভামধ্যে প্রবেশ করিলেন। বন্দীগণ সুর করিয়া রাজার আগমনবার্তা জ্ঞাপন করিল। সিংহাসনে আসিয়া আসীন হওয়ামাত্রই, অমাত্যদিগের কেহ কেহ তাঁহার নিকটে গমন করিয়া কী যেন বলিতে লাগিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সভার কার্য আরম্ভ হইল। 

আলাপ, আলোচনা, মন্ত্রণা দীর্ঘক্ষণ ধরিয়া চলিতে লাগিল। এইরূপে অর্ধপ্রহর অতিবাহিত হইয়া গেল। এতক্ষণ পুরন্দর স্থির হইয়া বসিয়া ছিলেন। কমলনয়ন কিন্তু অস্থির হইয়া উঠিয়াছে। তাহার সঙ্গে একটি তালীপত্রের পুথি আছে। উহা তাহার রচিত শ্লোকভাণ্ডার। উহা হইতেই শ্লোক পাঠ করিয়া রাজাকে শুনাইবে। কমলনয়ন বারংবার তালীপত্রের পুথিটি খুলিয়া স্বরচিত শ্লোকগুলি দেখিতেছিল। 

সভার প্রধান প্রধান কার্য শেষ হইলে পর রাজার দৃষ্টি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদিগের উপর গিয়া পড়িল। এক-একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আহুত হইতে লাগিলেন এবং প্রত্যেকে তাঁহার অন্তরের অভিপ্রায় জ্ঞাপন করিতে লাগিলেন। অবশেষে প্রমোদন পুরন্দরের ডাক পড়িল। 

তাঁহাকে দর্শন করিয়া রাজা যুক্তকরে নমস্কার জ্ঞাপন করিলেন। তাহার পর পুরন্দর কথা আরম্ভ করিবেন, এমন সময়ে একজন অমাত্য রাজার অতি নিকটে গমন করিয়া অস্ফুট স্বরে কী যেন বলিতে লাগিল। রাজা অমাত্যের সহিত কিছুক্ষণ আলোচনায় মগ্ন হইয়া গেলেন। দূর হইতে তাঁহাদিগের আলোচনা কী বিষয়ে, তাহা অনুধাবন করা গেল না, তথাপি পুরন্দরের মনে হইল, আসন্ন পাঠান আক্রমণ লইয়াই আলোচনা চলিতেছে। রাজার মুখমণ্ডল চিন্তামগ্ন, কী যেন অমঙ্গল আশঙ্কায় তিনি মহাভাবিত হইয়া পড়িয়াছেন। পুরন্দর দাঁড়াইয়াই রহিলেন, তাঁহার পার্শ্বে কমলনয়ন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করিতে লাগিল। 

এক দণ্ড পর আলাপ অবসিত হইলে, রাজা সেই চিন্তামগ্ন অবস্থাতেই প্ৰমোদন পুরন্দরকে কথা বলিবার নির্দেশ দিলেন। অবস্থা দেখিয়া পুরন্দর প্রমাদ গণিলেন। এমতাবস্থায় কমলনয়নের কবিতার প্রসঙ্গ প্রথমেই উত্থাপন করিবেন কীরূপে? সময় অল্প; প্রথমেই কাজের কথা বলিয়া ফেলা যাউক। এইরূপ ভাবিয়া পুরন্দর ধীরে ধীরে তাঁহার মনোবাঞ্ছা নিবেদন করিলেন। তিনি বৃদ্ধ হইয়াছেন। সর্বদা অধ্যাপনাকর্মে নিযুক্ত থাকায় তেমন অবসরও পান না। প্রতি বৎসর চারি-পাঁচ দিন নৌপথে এতদূর আসিয়া করস্বরূপ বাগানের ফলগুলি জমা করা সম্প্রতি কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। পরিবর্তে যদি উনসিয়া গ্রামেই বসবাসরত রাজার প্রতিনিধির হস্তে ফলগুলি অর্পণ করিবার অনুমতি পান, ইত্যাদি। 

রাজা কন্দর্পনারায়ণ পুরন্দরের কথা শুনিয়া কিঞ্চিৎ গম্ভীরভাব ধারণ করিলেন। তৎপশ্চাৎ অতি দৃঢ় স্বরে বলিলেন, “না। তাহা কোনোমতেই হইতে পারে না। এই সামান্য ফলকর দিবার উপলক্ষ্যে বৎসরান্তে আপনার একবার দর্শন পাই। আপনি তাহাতেও বঞ্চিত করিতে চাহেন, তাহা কিন্তু হইবে না।” 

পুরন্দর আরও দুই-একবার তাঁহার বক্তব্য যুক্তিসহকারে উপস্থাপনা করিবার প্রয়াস পাইলেন। রাজার কিন্তু সেই এক কথা। রাজকর চন্দ্রদ্বীপে আসিয়াই প্রদান করিতে হইবে, অন্য উপায় নাই। 

পুরন্দর ইহাতে বড়ো নিরাশ হইয়া গেলেন। এদিকে রাজার দৃষ্টি কমলনয়নের উপর আসিয়া পড়িল। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করিবার উদ্দেশ্যে তিনি পুরন্দরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কিশোর কে? আপনার পুত্র?” 

পুরন্দর বলিলেন, “হ্যাঁ। উহার নাম—” এমন সময়ে কমলনয়ন পিতার হস্ত ধরিয়া ইঙ্গিত করিল। পুরন্দর বলিলেন, “উহার নাম মধুসূদন। উহার উপর আমার অনেক আশা। বাল্যেই কবিত্বশক্তি অর্জন করিয়াছে। এক্ষণে আপনাকে তাহার দুই- একটি কবিতা শুনাইতে চায়।” 

রাজা কী যেন ভাবিলেন। বোধহয় ভাবিতেছিলেন, ব্রাহ্মণ সহজ পথে কার্যোদ্ধার হইল না দেখিয়া, এখন পুত্রের কবিতা শুনাইয়া আমাকে প্রীত করিতে চান, যাহাতে আমি সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহার আবেদন মঞ্জুর করি। কিন্তু তাহা হইবে না। রাজা মুখে বলিলেন, “সম্প্রতি আমি রাজকার্যে বড়ো ব্যস্ত। আজ তো সময় হইবে না। সময়ান্তরে উহার কবিতা শুনিব।” 

পিতা-পুত্র নিতান্ত ভগ্নমনোরথ হইয়া রাজসভা হইতে অতিথিশালায় ফিরিয়া আসিলেন। ব্রাহ্মণের অনুরোধ রাজা রাখিলেন না। ইহাতে পুরন্দর নিতান্ত ব্যথিত হইয়াছেন। কবিতা শুনাইবার সুযোগ পাইল না দেখিয়া কমলনয়নও খুবই আশাহত হইয়াছে। 

আরও দুই-একদিন এইরূপেই কাটিল। তাহার পর আবার একদিন রাজদর্শনের সুযোগ আসিল। পুরন্দর পুত্র কমলনয়নের হাত ধরিয়া পুনরায় রাজসভায় উপনীত হইলেন। দেখিলেন, রাজা একইরকম চিন্তামগ্ন। 

চিন্তা হইবে নাই বা কেন? পাঁচ পুরুষ ধরিয়া নিঃসপত্ন রাজ্য ভোগ করিলে যাহা হয়। রাজ্য যে কখনও বিদেশি শত্রুর কবলিত হইতে পারে, সে-সম্ভাবনাই চিন্তার মধ্যে স্থান পায় নাই। ‘রাজা’, ‘রাজা’ বলিতেছি, কিন্তু কন্দর্পনারায়ণকে কি আর ‘রাজা’ বলা যায়? ক্ষুদ্র চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য, তাহারই ভূস্বামী! পুরুষানুক্রমে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সামান্য গোলযোগ মিটাইয়া, প্রজাদের নিকট হইতে কর গ্রহণ করিয়া ভোগসুখে নিমগ্ন হইয়া ছিলেন। এক্ষণে অশ্বারূঢ়, খরতরবারিহস্ত পাঠান সৈন্যের সম্মুখে থরথর করিয়া কাঁপিতেছেন! 

যাহাই হউক, পিতা-পুত্রকে দর্শন করিয়া, কমলনয়নের উদ্দেশে কন্দর্পনারায়ণ বলিলেন, “কই কী কবিতা রচনা করিয়াছ, শুনাও দেখি।” 

কমলনয়ন অতি আগ্রহে পুথি খুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল : 

“পিনাক-ফণী-বালেন্দু-ভস্ম-মন্দাকিনীযুতা। 
প-বর্গরচিতা মূর্তিঃ অপবর্গপ্রদাহস্তু নঃ।। 

পিনাক অর্থাৎ ত্রিশূল, ফণী অর্থাৎ সর্প, বালেন্দু অর্থাৎ চন্দ্রকলা, ভস্ম অর্থাৎ ছাই, মন্দাকিনী অর্থাৎ গঙ্গাধারা—প-বর্গের এই পাঁচটি বর্ণ প, ফ, ব, ভ, ম-দ্বারা রচিত শিবের মূর্তি আমাদিগের মুক্তি বিধান করুক।” 

রাজা বলিলেন, “বাহ, বেশ হইয়াছে!” 

কমলনয়ন আরও পড়িল : 

“গ্রামগুলিকে নদী গ্রাস করিয়া লয়, নদীগুলিকে সাগর গ্রাস করিয়া লয়, সাগরকে গ্রাস করিয়া লয় রাতের অন্ধকার। কিন্তু প্রলয়কালে অন্ধকারকে গ্রাস করিয়া লয় কে?” 

রাজা কহিলেন, “উত্তম! তাহার পর?” 

কমলনয়ন পড়িল, “কে এক বালিকা পূজাশেষে নদীর ঘাটে ফুলদল ভাসাইয়া দিয়া গেছে। নদীর স্রোতে পুষ্পপল্লব ভাসিয়া চলিতেছে। দূরে নীল গগনও যেন এক নদী, উহার উপর দিয়া শ্বেতকরবীর পাপড়ির ন্যায় মেঘখণ্ডসমূহ ভাসিয়া যাইতেছে। আমার জীবন ওই পুষ্পদলের ন্যায় কোন্ স্রোতে ভাসিয়া চলিতেছে? কোন্ ঘাটে গিয়া লাগিবে?” 

রাজা শিরশ্চালন করিয়া মন্তব্য করিলেন, “ভালোই তো হইয়াছে।” 

কমলনয়নের মনে কিন্তু অসন্তোষের একটা দুর্নির্ণেয় বাষ্প জমা হইতেছিল। কী এক প্রকার সন্দেহ মনের ভিতর উঠি-উঠি করিতেছিল। রাজা কি প্রকৃতই তাহার কবিতা মন দিয়া শুনিলেন? ‘বেশ হইয়াছে, ভালোই হইয়াছে’—ইহাই কি কবিতার প্রকৃত মর্মগ্রহণ? ইহা তো তাহার কবিতা লইয়া প্রকৃত আলোচনা নহে, মুগ্ধতার প্রকৃষ্ট অভিব্যক্তিও নহে। ইহা মামুলি প্রশংসামাত্র। কবিতা যদি সত্যই রাজার হৃদয় স্পর্শ করিত, তবে এইরূপ কাজচলা গোছের কথা কি বলিতে পারিতেন? 

কবিতা শ্রবণ করিয়া রাজা কিঞ্চিৎ সহজভাব প্রাপ্ত হইয়াছেন দেখিয়া প্রমোদন পুরন্দর আবার একবার পূর্বকথা পাড়িলেন। যদি কোনোক্রমে উনসিয়া গ্রামের রাজপ্রতিনিধির নিকট ফলকর প্রদান করা যায়, তাহা হইলে এত পথ এ প্রৌঢ়দশায় আর আসিতে হয় না। রাজা এইবারও কঠিন হাস্য করিয়া বলিলেন, “আমি তো আপনাকে পূর্বেই বলিয়াছি, ইহা হইতে পারে না। আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মত নহি। কেন বারংবার একই অনুরোধ করিতেছেন?” 

নিরস্ত হইয়া প্রমোদন পুরন্দর পুত্রসহ অতিথিশালায় ফিরিয়া আসিলেন। 

সেইদিন বৈকালবেলায় কমলনয়ন পিতাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তাত! আমরা কবে গ্রামে প্রত্যাবর্তন করিব?” 

“দেখি, আর দুই চারিদিন অপেক্ষা করিব ভাবিতেছি।”

“কীসের জন্য অপেক্ষা করিবেন, তাত?” 

“যদি কোনোক্রমে রাজাকে সম্মত করানো যায়…”

“না, তাত! রাজা সম্মত হইবেন না। আপনিও এইরূপে বারংবার আবেদন- নিবেদন করিয়া রাজার কৃপাভিক্ষা করিবেন না। উহা ব্রাহ্মণের অপমান, মনুষ্যত্বের অপমান! নিজেকে আপনি আর অসম্মানিত করিবেন না। কাল প্রাতেই আমরা উনসিয়ার উদ্দেশে নৌকায় আরোহণ করিব।” 

পুরন্দর সচমকে পুত্রের মুখপানে চাহিলেন। দেখিলেন, কমলনয়নের মুখে আত্মসম্মানের কী একপ্রকার আভা খেলা করিতেছে। তাহার অধরোষ্ঠ দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় সংবদ্ধ হইয়া আছে। 

পুরন্দর মুখ ফিরাইয়া লইলেন। অতিথিশালার বাতায়নপথে সুদূরের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ধীরে ধীরে কহিলেন, “অগত্যা..” 

পরদিন প্রভাতবেলায় নৌকা ছাড়িয়া দিল। দেখিতে দেখিতে চন্দ্রদ্বীপ ছাড়াইয়া নদীপথে মধ্যস্রোতে নাও ভাসিয়া চলিল। পুরন্দরের মন ভারাক্রান্ত হইয়াছে। রাজা তাঁহার অনুরোধ রাখেন নাই, ইহাতে তত দুঃখ নাই। কিন্তু উপর্যুপরি অনুরোধ করিবার পরও তাঁহার মুখের উপর কেহ যে আবেদন প্রত্যাখ্যান করিতে পারে, ইহা তিনি কখনও ভাবেন নাই। সরল ব্রাহ্মণ, সংসারের কুটিল গতি কখনও জানিতেন না, সমস্ত জীবন শাস্ত্রের ছিন্ন পুথিগুলি লইয়া কাল কাটাইয়াছেন, শিষ্য-প্রশিষ্য গ্রামস্থ সকলেই তাঁহাকে সম্মান করিয়াছে, ধনিকের দুয়ারে প্রার্থী হইয়া দাঁড়াইলে যে এতদূর আত্মাবমাননা ভোগ করিতে হয়, তাহা তাঁহার অজানিত ছিল। তদুপরি রাজসভার কলুষিত পরিবেশে তাঁহার চিত্ত মলিন হইয়াছিল। অন্যমনস্ক হইয়া পদ্মার ঘোলা স্রোতের দিকে ব্রাহ্মণ তাকাইয়া ছিলেন। 

নৌকার অপরধারে কমলনয়ন কিন্তু আরও গম্ভীর হইয়া বসিয়া ছিল। তাহার মুখভাবে কোনো সম্ভাপ ছিল না, দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ, কী যেন অন্বেষণ করিতেছে। অধর ওষ্ঠকে চাপিয়া ধরিয়াছে, যেন অন্তরে কী ঝড় চলিতেছে, সেই ঝড়ের ভিতর একলক্ষ্যে মনস্থির হইয়া আছে। কমলনয়ন নিজেকে প্রশ্ন করিতেছিল, “কেন আমি রাজদরবারে কবিতা শুনাইবার জন্য গিয়াছিলাম? কেন আমি কবিতা লিখিয়া একে ওকে শুনাইবার জন্য ফিরি?” মন হইতে উত্তর উঠিতেছিল, “আমার কবিতা অন্যের হৃদয়কে স্পর্শ করিয়াছে জানিতে পারিলে আমার চিত্তের প্রসাদ হয়, তাই আমি অন্যকে আমার রচনা শুনাইবার প্রয়াস করিয়া থাকি।” কমলনয়ন পুনর্বার নিজেকে প্রশ্ন করিল, “ইহা কি মনুষ্যের ভজনা নহে? ইহা কি অন্যের দাসত্ব নহে?” 

স্মৃতিপথে বনমালী বাউলের কথা জাগিয়া উঠিতে লাগিল। তাহাকে নবদ্বীপের সেই প্রেমঘন পুরুষ বলিয়াছিলেন, “কখনও ঈশ্বর ব্যতীত আর কাহারও দাসত্ব করিও না।” 

কমলনয়নের মনে হইল, রাজাকে কবিতা শুনাইতে যাওয়া দাসত্ব করা মাত্র। কাহাকেও নিজ রচনা শুনানোর অর্থ, সেই ব্যক্তির দাসত্ব করা। যাহাকে কবিতা শুনাইতেছি, তাহার একটি প্রশংসা আমাকে সুখী করিয়া দিতে পারে, আবার তাহার একটি সমালোচনা আমার হৃদয়কে ব্যথিত করিয়া তুলিতে পারে। তখন আমি তো অন্যের হস্তের পুত্তলিকা মাত্র। অন্যে আমাকে যেমন নাচাইতেছে, আমি তেমনই নাচিতেছি। 

কমলনয়ন যাহা ভাবিতেছিল, তাহাই যে সর্বদা সত্য, এমন নহে। সহৃদয় ও সমানুভবী ব্যক্তির নিকট নিজ রচনা পাঠ করিলে সেই রচনাকে আরও একবার নূতন করিয়া দেখিবার সুযোগ হয়। সহৃদয় ব্যক্তির মন্তব্য রচনা সংশোধনের উপায় করিয়া দেয়। সেক্ষেত্রে রচয়িতা অবশ্যই উপকৃত হন। কিন্তু এ সকল কথা তখন কিশোর কবির চিত্তে উদিত হয় নাই। একে অল্প বয়স, তদুপরি রাজা তাহার কবিতার যথাযথ ভাবগ্রহণ করেন নাই, ফলতঃ কিশোরের চিত্ত অভিমানে ফুলিতেছিল। 

অন্যদিকে পিতার বারংবার রাজসভায় প্রার্থী হইয়া দণ্ডায়মান হওয়া কমলনয়নের জাগ্রত আত্মসম্মানবোধকে পীড়িত করিতেছিল। মনে হইতেছিল, পিতা পুত্র উভয়েরই অপমান হইয়াছে। উভয়কেই রাজা প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। কমলনয়ন মনে মনে বলিল, “আমি আর কাহারও দাসত্ব করিব না। দাসত্ব যদি করিতেই হয়, তবে একমাত্র ঈশ্বরের দাসত্ব করিব। কবিতা যদি শুনাইতে হয়, তবে একমাত্র ঈশ্বরকে শুনাইব।” ভাবিতে ভাবিতে কমলনয়নের দৃষ্টি পার্শ্বে রক্ষিত সেই তালীপত্রের পুথির উপর গিয়া পড়িল। “মনুষ্যের তৃপ্তিসাধন করিবার জন্য কী ছার কাব্য রচনা করিয়াছি!” কমলনয়নের মনের ভিতর কে যেন এই কথা বলিয়া উঠিল। তালীপত্রের পুথিটাকে যেন কলুষিত মনে হইতে লাগিল। নিতান্ত ঘৃণ্যবস্তুর ন্যায় পুথিটিকে বামহস্তে ধারণ করিয়া দুরত্ত আবেগে কমলনয়ন উহাকে নদীমধ্যে নিক্ষেপ করিল। সুকুমার কবিতার অনুপম ছন্দোবল্লরী স্রোতোবক্ষ সামান্য সংক্ষুব্ধ করিয়া পদ্মার সর্বগ্রাসী অতল গহ্বরে মুহূর্তে ডুবিয়া গেল। 

জলশব্দে চমকিত হইয়া পুরন্দর ঘাড় ফিরাইয়া পুত্রের এই অস্বাভাবিক কাণ্ড দেখিয়া উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “কী করিলি রে? সরস্বতীর প্রসাদ নদীতে ফেলিয়া দিলি?” 

কমলনয়ন অতি শান্তস্বরে বলিল, “হাঁ ফেলিয়া দিলাম। আজ এই মুহূর্তে স্থির করিলাম, আমি কবি হইব না। ভক্ত হইব। ঈশ্বরের শরণ লইব। নবদ্বীপে তিনিই গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুরূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন। আমি তাঁহারই চরণ আশ্রয় করিব। তন্নিমিত্ত গৃহত্যাগ করিয়া নবদ্বীপ যাত্রা করিব। আপনি অনুমতি দিন।” 

পুরন্দর ভাবিলেন, ইহা বালকের আবেগের কথা। কয়েকদিন গত হইলে সব ভুলিয়া যাইবে। তিনি কিছু না-বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। কিন্তু কমলনয়ন বারংবার একই কথা বলিতে লাগিল। সেইদিন, তাহার পরদিন, পরাপরদিন যখনই পিতা- পুত্রের বাক্যালাপ হয়, সব কথাবার্তা ঘুরিয়া ফিরিয়া সেই এক কথায় আসিয়া ঠেকে। কমলনয়ন গৃহত্যাগ করিয়া নবদ্বীপ যাইতে চায়। শেষে পুরন্দর বলিলেন, “আচ্ছা! গৃহে চলো, তোমার জননী রহিয়াছেন, গৃহত্যাগ করিবার পূর্বে তাঁহারও তো অনুমতি লওয়া আবশ্যক।” এই কথা শুনিবামাত্র কমলনয়ন চকিতে পিতার চরণ ধরিয়া বলিল, “তবে পিতঃ! বলুন— আপনার সম্মতি আছে?” পুরন্দরের হৃদয় রাজসভার ব্যাপারে বিপর্যস্ত ছিল, পুত্রকে বুঝাইবার মতো মানসিক শক্তি অবশিষ্ট ছিল না, তিনি ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, তাহাই হইবে।” 

তাঁহার অনেক কথা মনে পড়িতেছিল। সেসকল তাঁহার জীবনের প্রথম পর্বের কথা। প্রথম জীবনে তাঁহার গৃহত্যাগী হইয়া অনিকেত জীবন কাটাইবার বড়োই বাসনা ছিল। কিন্তু তাহা হইল না। জীবন কাটিয়া গেল, সংসারের কুলালচক্রে বাঁধা পড়িয়া গেলেন। বার্ধক্য আসিয়া পড়িল, তবু সে ঘর ছাড়িয়া ঈশ্বরকে স্মরণ করিয়া পথে নামিবার বাসনা পূর্ণ হইল না। আর এখন এই বালক নিতান্ত অপরিণত বয়সে ঈশ্বরাশ্রিত জীবনের পথে বাহির হইতে চলিল। কী আশ্চর্য! এ জীবন-প্রহেলিকার কী অর্থ, পদ্মার প্রবহমান স্রোতোরাশির ভিতর প্রৌঢ় পুরন্দর উদাসমনে তাহাই খুঁজিতে লাগিলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *