ছায়াচরাচর – ১৯

উনিশ 

সেকালে বঙ্গের ভূস্বামিগণ কাশী প্রভৃতি তীর্থক্ষেত্রে প্রাসাদ নির্মাণ করিয়া রাখিতেন; অন্তিম বয়সে কাশীবাসী হইবার বাসনা বলবতী ছিল। চন্দ্রদ্বীপের রাজা কন্দর্পনারায়ণ ও ইহার ব্যতিক্রম করেন নাই। বারাণসীর উপকণ্ঠে তাঁহার একটি সুদৃশ্য অট্টালিকা ছিল; উহাকে কন্দর্পমহল নামে ডাকা হইত। 

ইদানীং পদ্মাক্ষ ও হৈমবতী তীর্থদর্শনমানসে এই কন্দর্পমহলে আসিয়া উঠিয়ছে। তাহারা এখন আর নবযুবক নবযুবতী নহে—মধ্যে বহু বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। যৌবন-উপবনের প্রান্তসীমায় একটি সুস্থির আবাস থাকে, উহার পরেই প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তর। এসময় মনুষ্য সহসা সুন্দর হইয়া উঠে, কিন্তু তাহাতে রূপের অজস্রতা বা আবেগের অস্থিরতা নাই। পদ্মাক্ষ ও হৈমবতী সেই বয়সে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। তাহাদের প্রেম পরিণত, উহাতে উচ্ছ্বাস নাই, কিন্তু পরিপূর্ণতা আছে। 

তাহাদের এক পুত্রসন্তান; পুত্রটিকে তাহারা সেকালের বিধিমতো গুরুগৃহে প্রেরণ করিয়াছে। গুরুগৃহে পদ্মাক্ষ ও হৈমবতীর পুত্র পুণ্ডরীক কাব্য ও ব্যাকরণে বুৎপন্ন হইয়া উঠিতেছিল। পদ্মাক্ষ রাজসভার কবি, তাহার কাব্যে প্রকৃতি ও ঈশ্বরের পাশাপাশি মানব-মানবীর প্রণয়, বিরহ ভালোমতো জমিয়া উঠিয়াছে। কেবল কথা এই, সকল কাব্যেরই নায়িকার বর্ণনা প্রায় এক রূপ – কেহ জানে না, কবিশেখর পদ্মাক্ষের নায়িকারা সকলেই কবিপত্নী হৈমবতীর আদলে গড়া। 

বহুকাল পর তাহারা তীর্থদর্শনমানসে চন্দ্রদ্বীপের বাহিরে আসিয়াছে, রাজকীয় প্রহরীর দল তাহাদের সঙ্গে আসিয়াছে। এখন তো আর সেই নবাঙ্কুরিত যৌবনের তেজ নাই যে, ব্যবসায়ীদিগের বজরায় সমুদ্রে ভাসিয়া পড়িবে কিংবা জলপথে দস্যুদিগের মুখামুখি হইবে। এখন সাবধানে চলিবারই বয়স। 

যদিও এইরূপ, তথাপি পদ্মাক্ষর মনের ভিতর সেই হাস্যোজ্জ্বলদীপ্ত তরুণটি আজও বাঁচিয়া আছে। কেমন করিয়া নিত্যদিন নূতন নূতন প্রণয়ক্রীড়া আবিষ্কার করিবে অথবা নুতন কী উৎপাত করিয়া হৈমকে রাগাইবে ইত্যাকার ভাবনাই তাহার মাথার ভিতর খেলা করিতে থাকে। হৈমও স্বামীর এই নূতন নূতন প্রমোদগুলিতে অংশগ্রহণ করে, যদিও বাহিরে ছদ্মকোপের অভিনয় করিতে ভালোবাসে। 

আজ সকাল হইতে কী হইল, হৈম গঙ্গাস্নান করিতে গিয়াছে, নিকটেই চৌষট্টি যোগিনীর ঘাট, পদ্মাক্ষ কন্দর্পমহলের এক নির্জন কক্ষে পর্যঙ্কের উপর শুইয়া শুইয়া নূতন কী উপদ্রব করা যায়, ভাবিতেছে। সহসা একটা বিচিত্র অভিসন্ধি মস্তিষ্কের ভিতর নড়িয়া চড়িয়া উঠিল। স্থির করিল, হৈমবতীর বেশবাস অঙ্গে ধারণ করিয়া সে নারী সাজিবে। 

পেটিকা হইতে হৈমর কঞ্চলিকা ও অন্তরীয় বাহির করিল। বক্ষে কলিকা পরিল, কটিদেশে অন্তরীয়ে বাঁধন দিল। তাহার পর সদ্যোক্রীত বারাণসীর শিল্পীদের দ্বারা প্রস্তুত একটি মেঘডুমুর শাটিকা যত্ন করিয়া পরিধান করিল। তাহার গ্রীবা পর্যন্ত কুঞ্চিত কেশদাম ছিল, সাবধানে কাকই দিয়া সিঁথি বিনাইল, তাহার পর অতি যত্নে কবরী রচনা করিল। দর্পণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া কপালে কুক্কুম এবং সিঁথিতে সিন্দুর দিল। নয়নের প্রান্তে কজ্জলরেখা টানিল। কণ্ঠে হৈমবতীর হার বাহির করিয়া পরিল। দর্পণে নানাপ্রকার মুখভঙ্গি করিতে লাগিল। বেশ মানাইয়াছে! কে বলিবে পদ্মাক্ষ পুরুষ? ইহার পর চরণে অলক্তরাগ আঁকিবে কি না ভাবিতেছে, এমন সময়ে সোপানের উপর হৈমর পদশব্দ শুনিয়া দ্বারের একপাশে গিয়া লুকাইল। 

হৈম স্নান সারিয়া আর্দ্র বস্ত্রে গৃহে ফিরিয়াছে। সে সটান ঘরে ঢুকিয়া সিক্ত বসন ছাড়িয়া শুষ্ক বস্ত্র পরিতে লাগিল। পদ্মাক্ষ তাহার সব দেখিতেছে, কিন্তু হৈম পদ্মাক্ষকে দেখে নাই। ইহার পর হৈম যখন দর্পণের সম্মুখে কেশ পরিচর্যা করিতে গেল, তখন দর্পণে পদ্মাক্ষর প্রতিবিম্ব দেখিতে পাইয়া বিস্ময়ে হতবাক হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। 

“এ মা-আ! এ কে গো?” বলিয়া হৈম তো হাসিয়া কাঁদিয়া আকুল! “হা ঈশ্বর, তোমার মাথায় এত দুষ্ট বুদ্ধিও আছে? এ কী সাজিয়াছ?” 

পদ্মাক্ষ দ্বারের পার্শ্ব হইতে বাহির হইয়া হাসিতে হাসিতে কাপড় ঝাড়া দিতে দিতে কহিল, “সাজিলাম। দেখ তো, আমাকে সুন্দরী দেখায় কি না?” 

“খুব সুন্দর দেখাইতেছে। কিন্তু নারীর কীরূপে গুল্ফ হয়, তাহা বুঝিতে পারিতেছি না।” হৈম হাসিতে হাসিতে আকুল হইয়া পর্যঙ্কের উপর গড়াইয়া পড়িয়াছে। 

পদ্মাক্ষ অমনই আঁচলের প্রান্ত দিয়া গুল্ফ ঢাকা দিয়া কহিল, “এইবার? এইবার কেমন লাগে?” 

“কেমন আর? যে কোনো পুরুষ দেখিবে, ভালবাসিয়া ফেলিবে।” 

“আর নারী? নারী ভালোবাসিবে না?” পদ্মাক্ষ সবলে হৈমকে জড়াইয়া ধরিল।

“ওহ্, স্ত্রীলোকের গায়ে এত শক্তি? ছাড়িয়া দাও। হাড়গোড় ভাঙিয়া যাইবে।”

“না ছাড়িব না,” এই বলিয়া পদ্মাক্ষ আরও জোর প্রয়োগ করিতে গেল।

হৈমবতী অমনি তাহাকে ঝাড়া দিয়া নিজেকে মুক্ত করিয়া কহিল, “আমার মেঘডুমুর শাটিকার ভাঁজ নষ্ট করিয়াছ? ইস!!” 

“বেশ করিয়াছি। শাটিকার উপর অতো মায়া কেন?” 

“মায়া কি আর সাধে হয় বাপু? আমাকেই তো যত্ন করিয়া ভাঁজ করিয়া রাখিতে হয়। যাও, এসব জবড়জং ছাড়ো। তুমি পারও বটে। কখন যে কী দুষ্ট বুদ্ধি আসিয়া মাথায় ঢুকে। আমি প্রথম দেখিয়া ভয় খাইয়া গিয়াছিলাম।” 

হৈম আবার হাসিতে লাগিল, “সত্যি ভয় পাইয়াছিলাম কিন্তু! ভাবিতেছিলাম, দ্বারপার্শ্বে এ কোন্ নারী আসিয়া আবার কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করিল। ওহ্!” 

পদ্মাক্ষ নারীবেশ ছাড়িয়া, কবরী মুক্ত করিয়া, কপাল ও সিঁথির কুঙ্কুম-সিন্দুর মুছিয়া তাহার ধুতি ও পিরান পরিয়া লইল। হৈমবতী দর্পণের সম্মুখে সিন্দুর পরিতেছিল। তাহার পর মাথা একপাশে হেলাইয়া কানের লতিতে তাটঙ্ক পরিতে পরিতে বলিল, “জানো? আজ গঙ্গার ঘাটে একজন আমাকে লক্ষ করিতেছিল।”

“মাত্র একজন? হায়! এমন সিক্তবসনা সুন্দরীকে সম্মুখে পাইয়া কোন্ পুরুষ না লক্ষ করিবে?” 

“তোমার খালি দুষ্টামি! পুরুষ নয়, নারী!” 

“নারী? আজকাল নারীরাও তোমার রূপে আকৃষ্ট হইতেছে বুঝি?” 

“আরে, কথাই শুনিতেছ না। একজন যোগিনী। অবিকল আমারই ন্যায় দেখিতে। মনে হইল, যেন দর্পণে প্রতিবিম্ব দেখিতেছি। আমারই সদৃশ…নাক, মুখ, চোখ সব…কেবল তাঁহার অঙ্গে গৈরিক বাস… কপালের চারিপাশ বেড়িয়া মাথায় ঘোমটা দেওয়া…” 

পদ্মাক্ষ সচকিত হইয়া উঠিল। এইরূপ সেও একবার দেখিয়াছে। নবদ্বীপের ঘাটে। অবিকল পদ্মাক্ষরই মতো দেখিতে এক বিদ্যার্থী। অনেক কথাও হইয়াছিল। আজ আবার হৈম দেখিল, হৈমরই ন্যায় অবিকল এক যোগিনী! পদ্মাক্ষ গম্ভীর হইয়া গেল। চিন্তিত মুখে ভ্রু কুঞ্চন করিয়া কী যেন সে ভাবিতেছে। 

হৈম স্বামীর গম্ভীর ভাব দেখিয়া দর্পণ হইতে মুখ ফিরাইয়া কহিল, “কী ভাবিতেছ, গো?” 

“ভাবিতেছি, সেই যেগিনী কোথায় থাকেন? একবার দেখা করিব, ভাবিতেছি।” 

হৈম অমনি সহর্ষে বলিল, “আমিও যাইব!” 

“যাইবে তো ঠিকই, কিন্তু তিনি যে কোথায় থাকেন, তাহাই তো জানি না।”

বৈকালবেলায় পদ্মাক্ষ সস্ত্রীক চৌষট্টি ঘাটে গেল। ঘাটের চারিপাশে ঘুরিয়াও সেই যোগিনীকে দেখিতে পাইল না। পথিমধ্যে এক পরিচিত কথক ব্রাহ্মণকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, এই ঘাটে সম্প্রতি কোনো যোগিনীকে দেখিয়াছেন কি?” ব্রাহ্মণ উত্তর দিল, “কতজনই তো আসে। কে কাহার খবর রাখে? তবে আজিকালি কোনো যোগিনীকে আমি এ ঘাটে দেখিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না।” 

“ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখুন, ঘাটের উপর গম্বুজের নিকট বসিয়াছিলেন….” 

“বেশ, আপনি নাহয় একটু বর্ণনা করুন, দেখি মনে পড়ে কি না! দেখিতে কীরূপ?”

“এইরূপ…” এই বলিয়া পদ্মাক্ষ হৈমবতীর অবগুণ্ঠন সরাইয়া দেখাইল। 

হৈম তো লজ্জায় জড়োসড়ো। এদিকে সেই ব্রাহ্মণ আবার অপলক নেত্রে হৈমর মুখপানে তাকাইয়া আছে। হৈম তাড়াতাড়ি ঘোমটায় মুখ ঢাকিয়া স্বামীর হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া গেল। কিয়দ্দূরে গিয়া বিরক্ত ঝাঁঝালো স্বরে কহিল, “ছি ছি! তোমার এই কাণ্ড! পরপুরুষের সম্মুখে আমার ঘোমটা সরাইয়া মুখ দেখাইলে! ঘাট হইয়াছে, আমাকে আর ভৈরবী দেখাইতে হইবে না।” 

পদ্মাক্ষ অনেকক্ষণ অনুনয় বিনয় করিয়া হৈমবতীর মান ভাঙাইবার চেষ্টা করিল। অবশেষে হৈম বলিল, “তুমি বরং সন্ধান করো, নিকটে সন্ন্যাসিনীদের কোনো মঠ আছে কি না।” 

সন্ধান মিলিল। এক ব্যক্তি সব শুনিয়া চিন্তিত মুখে বলিলেন, “নিকটে নহে। ক্রোশ তিনেক দূরে নগরীর বহির্ভাগে একটি অনুচ্চ টিলা আছে। সেইখানে পাহাড়ের গাত্রে কতকগুলি গুহা আছে। ওই গুহাগুলিতে যোগিনীরা বসবাস করেন। তাঁহাদেরই কেহ হয়তো প্রভাতে এই ঘাটে আসিয়াছিলেন। আপনার স্ত্রী অমনই কাহাকেও দেখিয়াছেন, বোধ করি।” 

পদ্মাক্ষ হৈমবতীকে জিজ্ঞাসা করিল, “যাইবে?” 

“যাইব,” হৈমবতীর চোখের তারায় সেই কিশোরকালের ন্যায় অভিযানের আগ্রহ নাচিয়া উঠিল। 

পদ্মাক্ষ দুই প্রহরের জন্য একটি অশ্ব ভাড়া লইল। অশ্বে আরূঢ় হইয়া হৈমকেও তুলিয়া লইল। প্রথমে ধীরে, পরে দ্রুত লয়ে নগরীর বাহিরে দীর্ঘপথ অশ্বপৃষ্ঠে অতিক্রম করিতে লাগিল। পথের দুই পার্শ্বে তরুশ্রেণী, মাঠ-ঘাট জ্যোৎস্নালোকে পিছনে সরিয়া সরিয়া যাইতেছিল। অবশেষে তাহারা এক নির্জন টিলার সমীপে উপস্থিত হইল। এইখানে সর্পিল গিরিবর্ত্ত পাহাড়ের গাত্র বাহিয়া ঊর্ধ্বে উঠিয়া গিয়াছে। 

এদিকে আকাশ কখন যেন মেঘভারে সমাচ্ছন্ন হইয়াছে। থাকিয়া থাকিয়া বিদ্যুতের শিখা মসীকৃষ্ণ গগনপটকে লেহন করিতেছে। ঝড়বৃষ্টি আসিল বলিয়া। 

টিলার নিম্নে অশ্বটিকে এক বৃক্ষের সহিত রজ্জুবদ্ধ করিয়া কিয়দ্দূর উঠিতে উঠিতে একটি গুহামুখ আসিয়া পড়িল। ক্ষণে ক্ষণে চমকিত তড়িল্লতার আলোকে পথ দেখিয়া আর-একটু অগ্রসর হইবামাত্র ভীষণদর্শনা দুই জন যোগিনী ত্রিশূল হস্তে পন্থা অবরোধ করিয়া দাঁড়াইল। তাহাদের চক্ষু ক্রোধে আরক্ত ও আসব-আবেশে ঘূর্ণিত হইতেছিল। কিন্তু পদ্মাক্ষ নিজেদের পরিচয় প্রদান করিবার পূর্বেই গুহার অভ্যন্তরভাগ হইতে সুগভীর নারীকণ্ঠে আদেশ ভাসিয়া আসিল : “উহাদের ছাড়িয়া দে। আমি উহাদের চিনি।” 

পদ্মাক্ষ ও হৈমবতী ভয়ে ভয়ে গুহার ভিতরে প্রবেশ করিল। প্রদীপের স্তিমিতালোকে মনে হইল, ইহা একটি মন্দির। প্রস্তরপীঠিকার উপর দণ্ডায়মানা এক দেবীমূর্তি। ভীষণা রূপ। পদতলে মৈথুনরত এক নারীপুরুষের যুগলমূর্তির উপর লোলজিহ্বা এক দ্বিভুজা দেবী দাঁড়াইয়া আছেন। এক হস্তে নরখর্পর, অন্য হস্তে উদ্যত রুধিরাপ্লুত অসি। মূর্তির পাদপীঠে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে। উহারই সম্মুখে গুহাগাত্রে বিশাল ছায়া ফেলিয়া এক যোগিনী পদ্মাসনে বসিয়া আছেন। 

উভয়ে যোগিনীকে নতজানু হইয়া প্রণাম করিল। যোগিনী গৈরিক বস্ত্রে আচ্ছাদিত, শিরোদেশে কেশভার চূড়া করিয়া বাঁধা। পদ্মাক্ষ ভালো করিয়া দেখিল, সত্যই! যোগিনীর অবয়ব, তাঁহার চক্ষুদ্বয়, নাসিকা, কপাল, মুখশ্রী অবিকল হৈমবতীর অনুরূপ। যেন একে অপরের ছায়া, কোনো সন্দেহই নাই। 

যোগিনী তাহাদের দুইজনকে সম্মুখস্থ আসনে বসিতে বলিলেন। উভয়ে সামান্য ব্যবধান রাখিয়া বসিয়াছে দেখিয়া যোগিনী হাসিয়া বলিয়া উঠিলেন, “উভয়ে উভয়ের ঘনিষ্ঠ হইয়া বোস। তোদের দুইজনকে একত্রে দেখিবার আমার বড়ো সাধ হইয়াছে। পদ্মাক্ষ আর তাহার হৈমবতী!” 

ইনি তাহাদের পরিচয় জানিলেন কী উপায়ে? যেন তিনিই তাহাদের টানিয়া আনিয়াছেন, আর বহ্নিলুব্ধ পতঙ্গের ন্যায় তাহারা কেবল এই অগ্নিময়ী নারীর সম্মুখে আসিতে বাধ্য হইয়াছে। 

যোগিনী ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক স্বরে আদেশ করিলেন, “বল, তোদের কী জানিবার আছে?” হৈমবতী যুক্তকরে নমস্কার করিয়া বলিল, “আপনি কে মা? জানিতে বড়ো সাধ হইতেছে।” 

যোগিনী উত্তর দিলেন, “আমার নাম যোগিনী হিরণ্যবর্ণা। এইমাত্র? আর কিছু জানিতে চাস না?” 

পদ্মাক্ষ কহিল, “আজ প্রাতে গঙ্গার ঘাটে আমার স্ত্রী আপনার দর্শন পাইয়া অবাক হইয়া যায়। কী বলিব! আপনার সহিত আমার স্ত্রীর এতদূর সাদৃশ্য…” 

“কেন? তুই কখনও নিজের অবিকল সদৃশ কোনো পুরুষকে দেখিস নাই?”

পদ্মাক্ষ ভাবিতে লাগিল। ইনি কি সর্বজ্ঞা? এমন ভাবে কথা বলিতেছেন যেন, পদ্মাক্ষ ও হৈমবতী তাঁহার অতি পরিচিত, যেন তাহাদের জীবনের সকল ঘটনাই ইনি জানেন। আশ্চর্য তো! 

পদ্মাক্ষ কহিল, “দেখিয়াছি। নবদ্বীপের ঘাটে। আমারই সদৃশ, একেবারে আমারই অনুকৃতি। তাই তো ভালো বুঝিতে পারিতেছি না।” 

যোগিনী কহিলেন, “বুঝিবার মতো কিছু থাকিলে তবে তো বুঝিবি! স্থানকালের বহুমাত্রায় গাঁথা এ এক বিচিত্র জগৎ! জগতপ্রসবিনী মহামায়ার এ এক বুদ্ধিবিভ্রমকারিণী মায়া। এখন শুনিয়া রাখ, বঙ্গভূমে পুষ্পপুর গ্রামে আমার জন্ম হয়।” 

কোথায় যেন প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হইল! গুহাপ্রাকার থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। সেই ঘোর নিনাদ থামিলে পর হৈমবতী সবিস্ময়ে বলিল, “সে কী? পুষ্পপুর যে আমারও জন্মস্থান। কিন্তু সে গ্রামে তো আপনাকে কখনও দেখি নাই! তাহা হইলে আপনি কি আমাপেক্ষা জ্যেষ্ঠা?” 

“না, তোর আর আমার জন্ম একই দিনে একই মুহূর্তে হইয়াছে।” 

“সে কী! পুষ্পপুরের প্রত্যেককে আমি তো চিনি-কিন্তু সেখানে আপনাকে তো…”

“দূর, দূর, তুই কাহাকেও চিনিস না। এক পুষ্পপুরের গভীরে কতগুলা পুষ্পপুর আছে, তুই জানিস?” 

পদ্মাক্ষ, হৈমবতী এ কথার বিন্দুবিসর্গও বুঝিতে পারিল না। একই স্থানে একই নামের অনেকগুলা গ্রাম কী করিয়া থাকিতে পারে? 

“পুষ্পপুর গ্রামেই আমার শৈশব, কৈশোর কাটিয়াছে। তাহার পর একদিন পাঠান আক্রমণ হয়। দস্যুর হস্তে নিগৃহীত হইবার ভয়ে আমি ইক্ষুখেতে আত্মগোপন করিয়া থাকি।” 

হৈম বলিয়া উঠিল, “আশ্চর্য! এ সবই যে আমার জীবনের ঘটনা! সব মিলিয়া যাইতেছে!” 

“ইহার পর হইতে আর মিলিবে না। দস্যু গ্রামে লুঠতরাজ করিয়া চলিয়া যাইবার পর ইক্ষুবন হইতে বাহির হইয়া আসিয়া আমাদিগের গৃহস্থলীর ধ্বংসাবশেষের ভিতর কয়দিন কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাটাইলাম। তাহার পর, পাঠান আবার ফিরিয়া আসিতে পারে, এই ভয়ে গ্রাম ছাড়িয়া বাহির হইলাম। কত পথ, কত বন পার হইয়া গেলাম। শেষে এক নদীতীরে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।” 

পদ্মাক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “তাহার পর কী হইল?” 

“নদীতীরে এক ঝোপের আড়ালে বসিয়া থাকিতে থাকিতে একদিন দেখিলাম, এক সম্পন্ন যুবক পথ দিয়া হাঁটিয়া চলিয়াছে। আর তাহার পশ্চাতে এক রোরুদ্যমানা কিশোরী পুঁটুলিটি বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া যুবকের অনুসরণ করিতেছে। আমি তাহাদের ডাকিলাম, তাহারা শুনিয়াও বুঝিতে পারিল না। ঢিল ছুড়িলাম। তাহারা ভয় পাইয়া আরও দ্রুতবেগে চলিয়া গেল।” 

হৈম প্রশ্ন করিল, “তাহারা কারা?” 

ভৈরবী হাসিয়া বলিলেন, “চিনিতে পারিলি না? পুরোবর্তী সেই যুবক এই পদ্মাক্ষ আর অনুসরণকারিনী কন্যাটি তুই—হৈমবতী!” 

পদ্মাক্ষ-হৈমবতী বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেল। এ কী শুনিতেছে? 

যোগিনী হিরণ্যবর্ণা বলিয়া চলিলেন, “নদীতীরে ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হইয়া পড়িয়া আছি, এমন সময়ে এক শুভদিনে এক সন্ন্যাসিনী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি যেন সাক্ষাৎ বাগাদিনী সরস্বতী! তন্ত্র, মন্ত্র, বেদ—সব তাঁহার জিহ্বায় অধিষ্ঠান করিতেছে। তিনিই আমাকে এ স্থানে লইয়া আসিয়া যোগিনীজীবনে দীক্ষিত করেন। সেই হইতে এই গুহামন্দিরেই রহিয়া গিয়াছি।” 

পদ্মাক্ষ যুক্তকরে ব্যাকুল হইয়া প্রশ্ন করিল, “মা! ইহা কীরূপে হয়? এসকলের ব্যাখ্যা কী?” 

“সে বড়ো রহস্যকথা!” যোগিনী বলিতে লাগিলেন, “আমাদের জীবনে কতগুলি সন্ধিলগ্ন আসে, যখন জীবনের নদী বাঁক পরিবর্তন করে, ইহা তো বুঝিস?” 

“হাঁ, বিলক্ষণ! ওই মুহূর্তগুলিই জীবনের স্থায়ী পরিবর্তন ঘটাইয়া দেয়।”

“ঠিক। ওইসব সন্ধিলগ্নেই একাধিক সম্ভাবনার জন্ম হয়। যেমন, এই যে হৈমবতীর জীবন। সেদিন পুষ্পপুরের সেই গৃহে প্রবেশ করিয়া তুই যদি রোরুদ্যমানা হৈমকে আবিষ্কার করিয়া উদ্ধার না করিতিস, তাহা হইলে তাহার কী হইত, চিন্তা করিয়াছিস?” 

হৈম বলিল, “অনেক কিছুই হইতে পারিত। হয়তো পুনরায় পাঠানদস্যুরা আসিয়া আমাকে হরণ করিয়া লইয়া যাইত। হয়তো পলায়িত গ্রামবাসীর সহিত আমার পিতা-মাতা গ্রামে কিছুদিন পর ফিরিয়া আসিয়া আমাকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় পাইত। হয়তো…” 

সন্ন্যাসিনী বাধা দিয়া কহিলেন, “হয়তো হয়তো হয়তো! ওই অনেকগুলা হয়তো-র ভিতর আমিও একটা হয়তো। আমিও একটা বিকল্প সম্ভাবনা। পদ্মাক্ষ আসিয়া তোকে উদ্ধার না করিলে, তুই হয়তো সন্ন্যাসিনী হইতিস। তখন তোর নাম হইত যোগিনী হিরণ্যবর্ণা! এইসব সম্ভাবনাগুলিই ভিন্ন ভিন্ন সমান্তরাল বিশ্বে একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হইয়া চলিতেছে। কিন্তু তুই শুধু একটা সম্ভাবনাকেই বাস্তব ধরিয়া লইয়া পদ্মাক্ষর সহিত সুখে ঘরকন্না করিতেছিস।” 

পদ্মাক্ষ বলিল, “আর আমি যে নবদ্বীপে আমারই সদৃশ একজনকে দেখিলাম। সে কি তবে…?” 

“সে তোর জীবনের আর-এক সম্ভাবনা। তুই কবি না হইতে পারিলে, ওইরূপ হইতিস।” 

“আচ্ছা, কখন তবে ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাবনাগুলির সহিত দেখা হয়? মানে, এই যে আপনার সহিত হৈমর দেখা হইল, কিংবা আমার সহিত নবদ্বীপে সেই যে আর- একজনের দেখা হইল—ইহা কীরূপে হয়?” 

যোগিনী কী যেন একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, “সম্ভবত, ভিন্ন ভিন্ন স্থান-কাল- পাত্রের ভিতর বিভাজক রেখা কোনো কারণে কথঞ্চিৎ ক্ষীণ হইয়া গেলে, ইহাদের দেখা হইতে পারে। কিন্তু ইহা তুই এখন বুঝিবি না।” 

“মা! যাহা পূর্বে বলিলেন, তাহাই ভালো বুঝি নাই, তো পরের কথা কী বুঝিব!”

“আচ্ছা, শ্রবণ কর, একটি আখ্যায়িকা বলিব। আমাদিগের মধ্যে একটি গ্রন্থ বহুল জনপ্রিয় হইয়া রহিয়াছে। গ্রন্থটির নাম ‘যোগবাশিষ্ঠ’। সেই গ্রন্থ হইতেই এই আখ্যায়িকাটি বলিতেছি। যদি তাহাতে বুঝিবার সুবিধা হয়… 

আখ্যায়িকার নাম শুনিয়া পদ্মাক্ষ ও হৈমবতী গল্পপ্রিয় বালক-বালিকার ন্যায় আগাইয়া বসিল। গুহার বাহিরে ঘোররবে বৃষ্টি পড়িতেছে। যোগিনী হিরণ্যবর্ণা তাঁহার কাহিনি আরম্ভ করিলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *