ছায়াচরাচর – ২২

বাইশ 

তুলসীদাসের বিচারসভা হইবার কয়েকদিন পর মঠে এক নিদারুণ সংবাদ আসিয়া আছড়াইয়া পড়িল। কেদারঘাটে শতাধিক হিন্দু তীর্থযাত্রীর উপর বিধর্মীরা হামলা করিয়াছে। দুই-একজন মাত্র আহত হইয়া বাঁচিয়া আছে, বাকিরা স্ত্রী-পুরুষ-শিশু সকলেই নির্বিচারে নিহত হইয়াছে। 

কাশীর বাহিরে এইরূপ ঘটনা মধ্যে মধ্যে ঘটে—পূর্বে শ্রুতিগোচর হইত বটে, কিন্তু একেবারে বারাণসী নগরে প্রকাশ্য দিবালোকে এরকম হত্যাকাণ্ড উপর্যুপরি অনুষ্ঠিত হইতেছে, এমন শুনা যায় নাই। বহু বৎসর পূর্বে দশাশ্বমেধ ঘাটে কমলনয়ন একবার এইরকম হত্যাদৃশ্যের সাক্ষী হইয়াছিল, তাহার পর এতদিন কাশীর পরিবেশ শান্তই ছিল। কিন্তু ইদানীং ইহা বাড়িয়াই চলিতেছে। কয়দিন পর আবার মণিকর্ণিকায় হামলা, তাহার পর অসিঘাটে, হরিশচন্দ্র ঘাটে একই কাণ্ড ঘটিতে লাগিল। নিরীহ হিন্দু তীর্থযাত্রীদের উপর বিধর্মী মুসলমান আক্রমণকারীরা কোথা হইতে যেন অশ্বারূঢ় হইয়া আসিয়া ঝাঁপাইয়া পড়ে। লুঠপাট, স্ত্রী-হরণ, হত্যাকাণ্ডে স্থানটি নরক হইয়া উঠে। 

ইহার কী প্রতিকার? ভাবিতে ভাবিতে কমলনয়ন মঠের অলিন্দে উন্মত্তবৎ ঘুরিয়া বেড়ায়। অসহায়ের ন্যায় মাথা ঝাঁকাইতে থাকে, কখনও প্রচণ্ড ক্রোধে রগের দুইপাশে শিরা ফুলিয়া উঠে, কখনও স্কন্ধের উপর শিরোদেশ একপার্শ্বে হেলিয়া থাকে। তথাপি,কোনো সিদ্ধান্তে আসিতে পারে না। কোনো সরলীকৃত সমাধান তাহাকে শান্তি দেয় না। সে জানে, সে সন্ন্যাসী; অসহায় প্রজাপুঞ্জের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাজার, তাহার নয়। কিন্তু মন ইহা মানিয়া লইতে চাহে না, একটা প্রতিকারোপায় খুঁজিবার চেষ্টা করে। দুই সম্প্রদায়ের ভিতর কীরূপে যে সমঝোতা হইতে পারে, ভাবিয়া পায় না। এমন সময়ে একদিন এক অতিথি মঠে আসিলেন। 

কমলনয়ন ঘরে বসিয়া লিখিতেছিল; তাহার শিষ্য বলভদ্র আসিয়া সংবাদ দিল, এক রাজকীয় পুরুষ মঠে আসিয়াছেন। শিবমন্দিরে প্রণাম নিবেদন করিয়া কমলনয়নের অনুসন্ধান করিতেছেন। তিনি কে, তাহার পরিচয় তিনি কাহাকেও দেন নাই। শুধু বলিতেছেন, আচার্য মধুসূদন সরস্বতী উপস্থিত হইলে তবেই আত্মপরিচয় দিবেন। কমলনয়ন সব শুনিয়া দ্রুত প্রস্তুত হইয়া মঠের প্রাঙ্গণে নামিয়া আসিল। দেখিল, কোনো রাজা-মহারাজাই হইবেন। সঙ্গে লোক-লস্কর, রক্ষী-সান্ত্রী – ছত্রধারী প্রভৃতি রহিয়াছে। আগন্তুক ব্যক্তি দীর্ঘাকার, গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল গৌর, স্কন্ধের উপর চাঁচর কেশ আসিয়া পড়িয়াছে। পরনে বহুমূল্যবান বস্ত্র বাঙালি ধরনে পরা এবং গাত্রে চাপকানের উপর একটি সুদৃশ্য কাশ্মীরী শাল বিলম্বিত। চিবুক ও ভূযুগ ঈষৎ গর্বোন্নত, মুখমণ্ডল গোলাকার, নিখুঁতভাবে কামানো কিন্তু ওষ্ঠের উপর চাড়া গুল্ফ আছে। গালে গালপাট্টা; গণ্ডদেশ ও চক্ষুর নিম্নভাগ স্ফীত। চক্ষু দুইটি আরক্তিম, তাহাতে স্বভাববশতই যেন কী একপ্রকার ক্রোধময় বহ্নিজ্বালা খেলা করিয়া বেড়াইতেছে। অথচ তাহার আননের হাসিটি পঞ্চমবর্ষীয় শিশুর ন্যায়। দেখিয়া মনে হয়, অহংকৃত স্বেচ্ছাচারী অথচ তেজস্বী একটি বালক। 

পরস্পর অভিবাদন বিনিময়ের পর আগন্তুক ব্যক্তি মন্দ্রস্বরে নিজ পরিচয় জ্ঞাপন করিলেন। বলিলেন, “আমি যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য। সম্প্রতি তীর্থদর্শন মানসে কাশী আসিয়াছি।” 

প্রতাপাদিত্য? কমলনয়নের মনে পড়িল : 

“যশোর নগর ধাম          প্রতাপাদিত্য নাম, 
মহারাজ বঙ্গজ কায়স্থ; 
নাহি মানে পাতসায়           কেহ নাহি আঁটে তায়,
ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ!” 

সেই প্রতাপাদিত্য? ইঁহার কথা কমলনয়ন পূর্বেই শুনিয়াছে। বঙ্গদেশে মুঘল শাসনের বিরোধিতা করিয়া যে-বিদ্রোহীগণ বারো ভুঞা নামে পরিচিতি পাইয়াছে, প্রতাপাদিত্য তাহাদের অন্যতম। ইনি অত্যন্ত স্বাধীনতাপ্রিয় ও যুদ্ধবাজ—ইহা কমলনয়ন পূর্বেই শুনিয়াছিল। কিন্তু তাহার সহিত ইঁহার কী যোগ? তাহার কাছে ইনি কেন আসিলেন, কমলনয়ন তাহা বুঝিতে পারিল না। 

বোধহয় কমলনয়নের মনোগত সংশয় ধরিতে পারিয়া প্রতাপাদিত্য বলিয়া উঠিলেন, “আপনার জন্মভূমি কোটালিয়া পরগনার উনসিয়া গ্রাম আমার রাজ্যসীমার মধ্যেই পড়ে। ইতোমধ্যেই আপনার খ্যাতি দেশময় পরিব্যাপ্ত হইয়াছে। আমিও আপনার কথা অনেক শুনিয়াছি। তাই দর্শন করিতে আসিলাম,” এই পর্যন্ত বলিয়াই অপেক্ষাকৃত নিম্নস্বরে বলিলেন, “আপনার সঙ্গে আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে। এখানে অনেক লোক। গঙ্গার উপর এক বজরায় আমি অবস্থান করিতেছি, আপনি কি একবার তথায় চরণধূলি দিবেন? কথা আছে।” 

কমলনয়ন প্রতাপাদিত্যের আমন্ত্রণে সম্মত হইল। 

দুই-একদিন পর গঙ্গার ঘাটে প্রতাপাদিত্যের লোক কমলনয়নকে ডিঙানৌকায় তুলিয়া বজরার সমীপে লইয়া গেল। বজরায় প্রবেশ করিবার পর প্রতাপাদিত্য যে- কক্ষে অবস্থান করিতেছিলেন, কমলনয়ন এক রক্ষীর দ্বারা তথায় নীত হইল। কমলনয়ন দেখিল, রাজসিংহাসনে বসিয়া প্রতাপাদিত্য তাহারই অপেক্ষা করিতেছেন। প্রতাপাদিত্য কমলনয়নকে আর-একটি সিংহাসনে বসিতে অনুরোধ করিলেন। আসনে উপবেশন করিয়া কমলনয়ন জিজ্ঞাসুনেত্রে রাজার মুখপানে চাহিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল। 

অভিবাদনান্তর প্রতাপাদিত্য কথা আরম্ভ করিলেন, “আপনি হয়তো আমার কার্যধারার বিষয়ে সম্যক অবগত আছেন।” 

কমলনয়ন বলিল, “কিছু কিছু কথা লোকমুখে প্রবাদাকারে শুনিয়াছি মাত্র।” 

“উত্তম। আমার উদ্দেশ্য হইল, বঙ্গদেশকে কেন্দ্র করিয়া এক অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র সংঘটিত করা। দিল্লীতে মহাবল মুঘল সম্রাট, ইহারা বিধর্মী মুসলমান। ইহাদের হস্ত হইতে আমি হিন্দু সম্প্রদায়কে মুক্ত করিতে চাই।” 

কমলনয়ন বলিল, “মুসলমান মুঘল সম্রাট যদি দেশে সুশাসন স্থাপন করেন, তবে পৃথক হিন্দুরাজ্য গঠনের প্রয়োজন থাকিবে কি?” 

প্রতাপাদিত্য উত্তেজিত হইয়া পড়িতেছিলেন। কিন্তু দ্রুত সেই উত্তেজনা সংযত করিয়া অধর ওষ্ঠে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, “প্রথমত, মুঘল অধিকারে দেশে সুশাসন হওয়া প্রায় অসম্ভব, আর তা ছাড়া হিন্দুরাই বা কেন চিরকাল মুসলমান রাজার অধীনে থাকিবে?” 

কমলনয়ন অকম্পিত কণ্ঠস্বরে কহিল, “আপনি আমার কথায় কিছু মনে করিবেন না। ইহাই যদি আপনার উদ্দেশ্য হয়, তবে পাঠান আমলে আপনার পিতা ও আপনি বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন কেন? পাঠানও তো মুসলমান!” 

“উহা একটা রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিল মাত্র। উহার উদ্দেশ্য ছিল শক্তি সংগ্রহ করা। আমার পিতা বিক্রমাদিত্য ও খুল্লতাত বসন্ত রায় পাঠান বাদশাহ দাউদ খাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন বটে। আমিও প্রথম যৌবনে কতলু খাঁর পক্ষাবলম্বন করিয়া মুঘলদিগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছি—তাহাও সত্য। মানসিংহ বঙ্গাধিপ হইয়া আসিলে আমি যে মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করি, তাহার একমাত্র কারণ—মানসিংহ হিন্দু। কিন্তু মানসিংহের পর এখন ইসলাম খাঁ শাসন করিতে আসিতেছে। আর আমি ইহার বশ্যতা স্বীকার করিব না। পাঠান সাম্রাজ্যের পর এইবার দেশে হিন্দুরাজত্ব ফিরিয়া আসিবেই।” প্রতাপাদিত্য পিঞ্জরাবদ্ধ ব্যাঘ্রের ন্যায় ছটফট করিয়া কথা বলিতেছিলেন। 

কমলনয়ন শান্তস্বরে বলিল, “হিন্দুশাসনেই যে দেশে সর্বাঙ্গীন শান্তি প্রতিষ্ঠা পাইবে, ইহা কি নিশ্চিত?” 

প্রতাপ হাসিয়া বলিলেন, “সর্বাঙ্গীন শান্তি’ একটা কথার কথা মাত্র। উহার তেমন কোনো অর্থ নাই। অন্তত রাজনীতি বিষয়ে। তবু অরাজকতা কমিয়া আসিবে। আর দেশের লোক শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলিয়া জানিবে, তাহারা মুসলমানের লবণ ভক্ষণ করিতেছে না। মাথার উপর হিন্দু রাজা রাজত্ব করিতেছে।” 

“কিন্তু ইহা তো আপনার স্বপ্ন!” কথাটা বলিবার সময়ে কমলনয়ন ‘আপনার’ কথাটার উপর জোর দিয়া বলিল। অর্থাৎ যাহা আপনার ব্যক্তিগত স্বপ্ন, দেশের সকল হিন্দুরা তাহা সহসা দেখিতে শুরু করিবে কেন? অন্যদের এ স্বপ্ন দেখাইবার কী অধিকার আপনার আছে? . 

প্রতাপাদিত্য সে-কথার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলেন না। তিনি উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “স্বপ্ন নয়। ইহাই বাস্তব হইবে। আমি ইহা স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি।” 

ইহাকে বুঝানো মুশকিল! হিন্দুরাজ্যের পিপাসা ইঁহাকে খাইয়া বসিয়াছে। কমলনয়ন মুহূর্তে আলোচ্য প্রসঙ্গ হইতে মনকে সরাইয়া লইয়া এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ লোকটাকে লইয়া খেলা করিতে চাহিল। প্রতাপাদিত্যকে আরও উত্তেজিত করিবার ইচ্ছায় বলিয়া বসিল, “আপনি একা কী করিতে পারেন?” 

প্রতাপ এইবার হুংকার দিয়া বলিয়া উঠিলেন, “আমি একা নহি। আমার একান্ত বন্ধু জমিদার শংকর চক্রবর্তী এবং মহাবলশালী সূর্যকান্ত গুহ একত্র হইয়াছি। মুঘলের বিরুদ্ধে আমরা শীঘ্রই ফাটিয়া পড়িব। তাহা ব্যতীত আরাকান অধিপতিও আমার পক্ষাবলম্বন করিয়াছেন। এই আরাকানের মগ রাজার মৈত্রী লাভ করিবার জন্য আমি কী করিয়াছি, জানেন?” 

কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “কী?” 

“আরাকানরাজের চিরশত্রু হইল পর্তুগিজ কার্ভালো। অমি তাহাকে আতিথ্যদানের অভিনয় করিয়া নিজ রাজধানীতে টানিয়া আনিয়া হত্যা করিয়াছি। আরাকানরাজের নিকট কার্ভালোর ছিন্নশির উপহার পাঠাইয়াছি। এখন আরাকানরাজ আমাদের সহিত মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত।” এই বলিয়া প্রতাপ ক্রূর হাস্য করিতে লাগিলেন। তাঁহার সুন্দর মুখ বীভৎস দেখাইতে লাগিল। 

কমলনয়ন মনে মনে বলিল, তোমার যে দেখি গুণের ঘাট নাই! মুখে বলিল, “তাহাও যেন হইল, কিন্তু মহাবলশালী মুঘল সম্রাটের সঙ্গে লড়িবার উপায় আপনার হাতে কী আছে?” 

প্রতাপাদিত্য বলিলেন, “কেন? আমার পিয়ারা, মহলগিরি, ঘুরাব, পাল, মাচোয়া, পশত, ডিঙ্গি, গছাড়ি, বালাম, পলওয়ার, কোচা—সব আছে!” 

কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল, “এইগুলি কী?” 

“এইগুলি হইল রণতরী। আমার উৎকৃষ্ট যুদ্ধ জাহাজের সংখ্যা কত জানেন? দশ হাজারেরও অধিক। এই রণতরীগুলি এক দুর্ধর্ষ পর্তুগিজ কর্মচারী ফ্রেডারিক ভুডলীর অধীন। আমার সৈন্যবাহিনী ঢালী, অশ্বারোহী, তীরন্দাজ, গোলন্দাজ, নৌসৈন্য, গুপ্তসৈন্য, রক্ষিসৈন্য, হস্তিসৈন্য—এই আট বিভাগে বিভক্ত। কে আমার মোকাবিলা করিতে পারিবে? ‘ষোড়শ হলকা হাতী, অযুত তুরঙ্গ সাতী, বায়ান্ন হাজার যার ঢালী!” হাঃ হাঃ হাঃ!!” হাসিতে হাসিতে প্রতাপাদিত্য চাড়া গোঁফে তা দিতে লাগিলেন। 

কমলনয়নের মনে হইল, একটি অপরিণামদর্শী বালক সগর্বে তাহার খেলার সামগ্রীগুলি দেখাইয়া ফিরিতেছে। যাহাই হউক, আর কথা না-বাড়াইয়া বলিল, 

“আমাকে ডাকিয়াছেন কেন? আমি কী করিতে পারি?” 

“আপনি আমার সহায় হউন। আপনাকে বহু বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তি দিতেছি। আপনি দেশে ফিরিয়া আসুন। দেশে বসিয়া অধ্যাপনা করুন। আপনি বঙ্গদেশে আসিয়া বসিলে কাশী হইতে ছাত্ররা দলে দলে বঙ্গদেশে শিক্ষালাভ করিতে যাইবে। যশোহর দ্বিতীয় মগধ হইবে—যশোহর নবদ্বীপ ও বারাণসীর যশ হরণ করিয়া লইবে।” 

“আমি বারাণসীধামে বিশ্বনাথচরণে পড়িয়া আছি। এখানেই বিদ্যাচর্চা ও সাধনার তীর্থ!” 

প্রতাপাদিত্য বলিলেন, “কাশীতে পড়িয়া থাকিবেন কেন?” 

কমলনয়ন প্রতিপ্রশ্ন করিল, “আপনি কাশীধামে আসিয়াছেন কেন?” 

প্রতাপাদিত্য হাসিয়া বলিলেন, “তীর্থ করিতে।” 

সে-উত্তর যে কতই ফাঁকা, কমলনয়নের বুঝিতে বিলম্ব হইল না। তীর্থবাসনা মোটেই নয়, প্রতাপাদিত্যের নির্ঘাত অন্য উদ্দেশ্য আছে। শক্তি সংগ্রহ করা, দেশীয় রাজাদের স্বপক্ষে টানিয়া আনা। ইহাই হইবে। তীর্থদর্শন ছলমাত্র। 

প্রতাপাদিত্য আবার বলিলেন, “কাশীতে থাকিয়া কী হইবে? এখানে তো হিন্দুরা উপদ্রুত। দেখিতেছেন না, কাশীর ঘাটে ঘাটে অসহায় নিরীহ তীর্থযাত্রীরা মোল্লাদিগের হস্তে কেমন নৃশংসভাবে খুন হইয়া যাইতেছে। ইহার প্রতিকারার্থ আপনারা হিন্দু সাধুরা কী করিতে পারিতেছেন?” 

সহসা প্রতাপাদিত্যের কথায় কমলনয়নের বুকের ভিতর যেন একটা বৃহৎ কাঁসার ঘণ্টায় আঘাত পড়িল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সে বলিল, “অনেক ভাবিয়াছি। কিন্তু কোনো প্রতিকারোপায় দেখিতেছি না।” 

“আপনারা কেবল ভাবিয়াই চলেন। আর আমি কার্য করিয়া দেখাই। আমার হস্তে ইহার প্রতিকার আছে!” 

“কী প্রতিকার?” 

“তবে, শুনুন। কাশী আমার রাজ্য নহে। এখানে প্রকাশ্যে আমার শাসন চলিবে না। কিন্তু প্রকাশ্যে না হইলে, গোপনে। সোজা আঙুলে ঘি না উঠিলে, আঙুল বাঁকাইতে হইবে…” 

“বাঁকা আঙুলটাই বা কী?” 

“কাশীতে একদল সশস্ত্র গুপ্তঘাতক রাখিয়া যাইতে পারি। ইহারা মোল্লাদিগকে দেখিলেই কচুকাটা করিবে।” 

কমলনয়ন ভিতরে ভিতরে শিহরিয়া উঠিল। কিন্তু বাহিরে সেই ভাব বুঝিতে দিল না। বলিল, “সকল মুসলমানই আক্রমণকারী নয়। অনেক নিরীহ মুসলমান নরনারী আছেন। আর যাহারা আক্রমণ করে, তাহারাও প্রকৃত মুসলমান নয়। আক্রমণ কিংবা হত্যা সকল ধর্মাচরণের বিরোধী—সে হিন্দুই হউক, মুসলমানই হউক। আপনার দ্বারা নিযুক্ত গুপ্তঘাতকের দল মুসলমান-নামধারী আক্রমণকারীদের সহিত নির্বিচারে বহু সাধারণ শত শত নিরীহ মুসলমানদিগকেও হত্যা করিবে। ইহা তো অতি অসঙ্গত!” 

প্রতাপাদিত্য উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “ও! আর মোল্লারা যখন নির্বিচারে হিন্দু নরনারী বধ করে, তখন?” 

কমলনয়ন উত্তর দিল, “ইহা তো নিতান্ত শিশুর মতো কথা হইল। তুই কেন উহার উপর উৎপাত করিতেছিস? না, সে আগে আমার উপর উৎপীড়ন করিয়াছিল! ইহা তো কোনো সমাধান হইল না। তাহা হইলে তো পারস্পরিক হত্যাকাণ্ড অনন্তকাল ধরিয়া চলিতেই থাকিবে। কোনো মীমাংসা হইবে না।” 

“ইহা ছাড়া আর উপায় কী?” 

“না, ইহা আমি মানিতে পারি না। ইহাতে আততায়ীর স্তরে নামিয়া যাওয়া হয়। যাহারা আক্রমণ করিতেছে, তাহারা ইহাই তো চাহিতেছে। যাহাতে আমরা তাহাদের স্তরে নামিয়া গিয়া প্রতি-আক্রমণ করি। আমরা ফিরিয়া তাহাদের আক্রমণ করিলে তাহাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধি হইবে। দেশে অবাধ অরাজকতা নামিয়া আসিবে এবং উহারা লুটিয়া-পুটিয়া খাইবে।” 

প্রতাপাদিত্য চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া কমলনয়নকে দেখিতেছিলেন। পরে বলিলেন, “এই যুক্তি অবলম্বন করিলে তো দেশের বাহির হইতে বহিরাক্রমণকারীরা আসিলেও তাহাদের ঠেকানো উচিত হইবে না। হাস্যকর যুক্তি!” 

কমলনয়ন এইবার সামান্য উত্তেজিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কে বহিরাক্রমণকারী?”

প্রতাপাদিত্য বলিলেন, “কেন? মুসলমানরা বহিরাক্রমণকারী!” 

কমলনয়ন বলিল, “মুসলমানদিগেকে এক্ষণে আর বহিরাক্রমণকারী ভাবা ঠিক হইবে না। চারিশত বৎসর পূর্বে যাহারা উন্মুক্ত তরবারি হস্তে ভারতভূমে অশ্বপৃষ্ঠে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারা বহিরাক্রমণকারী ছিল ঠিকই। কিন্তু সেদিন গিয়াছে। পূর্বযুগের আক্রমণের দুঃস্বপ্নস্মৃতি লইয়া আজিকার ভারতবর্ষকে দেখিলে চলিবে না। ইতোমধ্যে মুসলমানরা ভারতদেহে একাত্ম হইয়া যাইতেছে।” 

“কেমন করিয়া যে একাত্ম হইল। মুসলমানরা সর্বভাবে হিন্দুদের বিপরীত নয় কি?” 

কমলনয়ন ধীরে ধীরে বলিল, “আজ যাহারা মুসলমান, গত পরশু তাহারা হিন্দু ছিল এবং গতকল্য তাহারা মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হইয়াছে।” 

প্রতাপাদিত্য বলিলেন, “তবে তো দোষ উহাদেরই। উহারা স্বধর্ম ত্যাগ করিল কেন?” 

“না, দোষ উহাদের নয়। দোষ আমাদের, এই উচ্চবর্ণের হিন্দুদের। নিম্নবর্গীয় হিন্দুদিগকে আমরা অস্পৃশ্য করিয়া রাখিয়াছিলাম, তাহাদিগকে সকল মনুষ্যোচিত অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছিলাম বলিয়াই তাহারা মুসলমান হইয়াছে।”

প্রতাপাদিত্য বলিলেন, “সে যাহাই হউক। মুসলমানগণ হিন্দুদিগের বিরোধী। অতএব, হিন্দুরাও নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া থাকিতে পারে না।” 

কমলনয়ন ক্লান্ত স্বরে বলিল, “আপনার কথা মানিতে পারিলাম না। এই বিরোধ স্বাভাবিক নহে। এই বিরোধ একশ্রেণীর মানুষ আপন স্বার্থ চরিতার্থ করিবার মানসে ইচ্ছা করিয়া বাঁধাইয়াছে। যেখানেই এই সাম্প্রদায়িক হামলা হইতেছে কিংবা যাহারাই এই হামলা বাঁধাইতেছে, তাহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ভারতের এক শ্রেণীর মানুষের উপর আর-এক ধর্মান্তরিত মানব গোষ্ঠীকে উত্তেজিত করিয়া তুলা। ইহা বস্তুত এক ভ্রাতার দেহে অন্য ভ্রাতার অস্ত্রাঘাত। ইহাতে আরব, ইরান, তুরস্ক কাহারও প্ররোচনা নাই। ইহা একটা ক্ষমতার খেলা, একটা রাজনৈতিক অভিসন্ধি ব্যতীত অন্য কিছু নহে!” 

প্রতাপাদিত্য এসকল কথার কিছুই বুঝিলেন না। তিনি ব্যঙ্গবিদ্রূপের স্বরে কহিলেন, “মুসলমান কবে আমাদের ভাই হইল?” 

কমলনয়ন দেখিল, বিষ গলা অবধি পৌঁছাইয়াছে। উহাকে আর নামানো যাইবে না। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু সুনিশ্চিত। কে প্রতাপাদিত্যকে বুঝাইতে সমর্থ? কে কবে প্রতাপাদিত্যদের বুঝাইতে পারিয়াছে? সে শুধু তিক্ত নিরাসক্ত স্বরে বলিল, “গুপ্তহত্যার পরামর্শে আমার কিছুমাত্র সম্মতি নাই।” 

প্রতাপাদিত্য বলিলেন, “বেশ। তবে আপনাদের মঠটিকে রক্ষা করিবার জন্য কিছু সৈন্য রাখিয়া যাই?” 

“না, প্রয়োজন নাই। অসহায় হিন্দু তীর্থযাত্রীদের যাহা হইবে, আমাদেরও তাহাই হউক। আমরা বিশেষ সুবিধা চাহি না।” 

“তাহা হইলে আপনি আমার নিকট হইতে কিছু দান গ্রহণ করুন।” 

“তাহারও প্রয়োজন নাই। বিশ্বনাথের কৃপায় আমাদিগের বেশ চলিয়া যাইতেছে।”

“তবে মঠের সংস্কারসাধনের জন্য কিছু গ্রহণ করুন।” 

“উহাও প্রকারান্তরে আমারই লওয়া হইবে। প্রয়োজন নাই।” 

“তবে আপনাদিগের মঠের সন্নিকটস্থ চৌষট্টি ঘাটটি বাঁধাইয়া দিই?’ 

“তাহা করিতে পারেন। তাহাতে লোকসাধারণের বড়োই উপকার হইবে।”

“বেশ তাহাই করিয়া দিব। কিন্তু আপনি আমার কথাটা ভাবিয়া দেখিবেন, যদি কখনও যশোহর আসিয়া বসবাস করেন…” প্রতাপাদিত্য অনুনয় করিয়া বলিলেন।

“এখন তো ওইরূপ কিছু ভাবি নাই। ভবিষ্যতে সেরূপ সিদ্ধান্ত করিলে আপনাকে নিশ্চয়ই স্মরণ করিব।” 

আর কোনো কথা হইল না। কমলনয়ন ধীরে ধীরে বজরা হইতে ডিঙায় নামিয়া আসিল। 

.

কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (১৮শ শতক) সন্ন্যাসী মধুসূদন সরস্বতী (১৬শ শতক) বা কমলনয়নের বহু পরে জন্মেছিলেন। তা সত্ত্বেও এখানে কমলনয়ন এবং প্রতাপাদিত্যের মুখে যে ভারতচন্দ্রের কবিতা ব্যবহার করা হয়েছে, তা কেবল রসসৃষ্টির তাগিদে। এটি লেখকের সচেতন অ্যানাক্রনিজম্। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *