ছায়াচরাচর – ২৭

সাতাশ 

চেতনার নদী বহু অকিঞ্চিৎকর ঘটনাস্রোতের ভিতর দিয়া আরও ছয় মাস বহিয়া গেল। 

আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে দশহরার দিন মঠে সাধু-ভাণ্ডারার আয়োজন করা হইল। ভাণ্ডারা হইতেছে সাধুদিগের নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়া ভোজ দেওয়া। কাশীস্থ বিভিন্ন মঠের সন্ন্যাসিগণ এই ভাণ্ডারা উপলক্ষে মঠে সমবেত হইলেন। মঠটিও এতদুপলক্ষে পুষ্প, মাল্যে সুশোভিত হইয়া উঠিল। 

শিবমন্দিরের চাতালে চন্দ্রাতপের নিম্নে সন্ন্যাসীরা আসিয়া বসিলেন। নানা শাস্ত্রীয় আলোচনা হইতে লাগিল। কমলনয়ন সেই আলোচনায় প্রত্যক্ষ যোগ না-দিয়া সকলের কথা শুনিতেছিল। মধ্যে মধ্যে দু-এক কথায় আলোচিত বিষয়ে কীরূপ সিদ্ধান্তে আসিতে পারা যায়, তৎসম্বন্ধে আলোকপাত করিতেছিল। সন্ন্যাসিগণ সহর্ষে কমলনয়নের কথা অনুমোদন করিতেছিলেন। 

জনৈক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী, নাম তাঁহার হরিহরানন্দ, সহসা সাহ্লাদে বলিয়া ফেলিলেন, “আপনি আমার গুরু!” 

ইহাতে কমলনয়ন নিতান্ত লজ্জিত বোধ করিল। হরিহরানন্দ বয়োজ্যেষ্ঠ, তদুপরি সন্ন্যাস-জীবনে তাঁহার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সে সংকুচিত হইয়া হরিহরানন্দকে বলিল, “না, না, এ কথা বলিবেন না। ইহাতে আমার অপরাধ হইবে!” 

হরিহরানন্দ সেই কথায় আমল না-দিয়া কহিলেন, “কোনো অপরাধ হইবে না। বয়সে আপনি আমাপেক্ষা কনীয়ান হইতে পারেন, কিন্তু প্রজ্ঞায় আমার অগ্রবর্তী। আর ভগবদ্‌পাদ আচার্য শঙ্কর স্বয়ং বলিয়া গিয়াছেন, সদ্গুরু কো বা? হিতোপদেষ্টা। যিনি হিত উপদেশ করেন, তিনিই সদগুরু। তবে?” 

“কিন্তু আমি কি আর উপদেশ করিতে পারি? আমি শুধু সেই পন্থায় আপনাদিগের সহযাত্রী।” 

“সে আপনার বিনয়। উপদেষ্টার অভিমান না থাকিলে তবেই উপদেশ ফলপ্রসূ হইয়া উঠে। উহা লইয়া আপনি ভাবিবেন না।” 

কথায় কথায় বেলা বাড়িল। আহারের সময় হইল। দ্বিতলের অলিন্দে সাধুদের পঙ্ক্তিভোজন বসিল। সন্ন্যাসীরা কেহ মুণ্ডিতমস্তক, কেহ জটাজুটসমন্বিত শ্মশ্রুগুম্ফধারী, কেহ পীতবসন, কেহ-বা শ্বেতবাস—সব আহারে বসিয়াছেন। প্রথমেই শ্রীমদ্ভবদ্‌গীতার পঞ্চদশোধ্যায় উর্ধ্বমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্’ ইত্যাদি সন্ন্যাসীরা সুর করিয়া স্মৃতি হইতে আবৃত্তি করিতেছিলেন। গীতাপাঠ শেষ হইলে এক-এক করিয়া প্রত্যেককে মাল্যচন্দনে বিভূষিত করিয়া বরণ করিয়া লওয়া হইল। তাহার পর নববস্ত্র ও কম্বল উপহার দেওয়া হইল। কমলনয়ন ও মঠের অন্যান্য সন্ন্যাসিবর্গ সমস্ত কিছুর সুব্যবস্থা হইতেছে কি না দেখিতেছিলেন। 

পরিবেশন আরম্ভ হইল। শালপত্রের স্থালীর উপর প্রথমে অন্ন ও শুক্রুনি পরিবেশিত হইল। তাহার পর পীত সুগন্ধি ঘৃত ভাতের উপর দেওয়া হইল। মুগের ডাল, দশবিধ শাক, দুগ্ধ তুম্বী, দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড, বেশারী নাফরা, মোচার ঘণ্ট, মোচাভাজা, ভুষ্ট বার্তাকু, ফুলবড়ি একে একে সব আসিতে লাগিল। শেষ পাতে ঘোল ও পায়সান্ন। 

পঙ্ক্তিভোজন খাইতে খাইতে সাধুদের ভিতর শ্লোকাবলী ও দোঁহা আবৃতি করিবার প্রথা আছে। জনৈক সন্ন্যাসী উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন : 

“মহেশ্বরে বা জগতামধীশ্বরে জনার্দনে বা জগদান্তরাত্মনি। 
ন বস্তুভেদপ্রতিপত্তিরস্তি মে তথাপি ভক্তিস্তরুণেন্দুশেখরে।।
ওঁ নমঃ পার্বতীপতয়ে হর হর হর…” 

সকলে বলিয়া উঠিলেন, “সাধু, সাধু!” 

আহারের পর হরিহরানন্দের সহিত কমলনয়নের আরও কথা হইতেছিল। হরিহরানন্দ বলিলেন, “নাগা সন্ন্যাসীদের অস্ত্রশিক্ষা ভালোই চলিতেছে। উঁহারা অশ্বারোহণ ও যুদ্ধবিদ্যায় রীতিমতো পারদর্শী হইয়া উঠিয়াছেন।” 

কমলনয়ন উত্তর দিল, “তথাপি আমার সংশয় যায় নাই। ইহা কি ঠিক হইল? সন্ন্যাসীদের হস্তে অস্ত্র তুলিয়া দেওয়া হইল। ইহা তো আমাদিগের শাস্ত্রবিধি উল্লঙ্ঘন করা হইল। শাস্ত্রে কোথাও নাই, সন্ন্যাসী অস্ত্রধারণ করিবে।” 

হরিহরানন্দ বলিলেন, “কিন্তু দেশের রাজা যদি প্রতিরক্ষা না দিতে পারেন, তাহা হইলে বিকল্প উপায়ই বা কী?” 

“উপায় নাই। নিরুপায় হইয়াই….”

বেলা পড়িয়া আসিল। সকলেই ফিরিয়া যাইতেছেন। কেহ কেহ-বা মঠের সর্বত্র ঘুরিয়া ঘুরিয়া দর্শন করিতেছেন। কয়েকজন সন্ন্যাসী ঘুরিতে ঘুরিতে কমলনয়নের কক্ষের সম্মুখে আসিলেন। দ্বার অর্গলবদ্ধ। কমলনয়ন নাই, হরিহরানন্দকে আগাইয়া দিতে গিয়াছে। তথাপি, দ্বারে অর্গল দেওয়া সন্ন্যাসীবিধি নহে। সন্ন্যাসীর দুয়ার সর্বদা উন্মুক্ত থাকিবে। ইহা দেখিয়া অনেকেরই কৌতূহল হইল। 

একজন স্থূলকায় সন্ন্যাসী হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “দ্বার রুদ্ধ কেন? আচার্য মধুসূদন এই কক্ষের ভিতর কী সংগুপ্ত রাখিয়াছেন?” 

আর-একজন তরুণ বলিলেন, “ইহা সত্যই অদ্ভুত! মধুসূদন সরস্বতীর ইহা শোভা পায় না। ঘরে কি মণিমুক্তা লুকাইয়া রাখিয়াছেন?” 

প্রথমজন বলিলেন, “চল তো দেখি, কী আছে।” 

তাঁহারা দ্বার খুলিলেন। ঘরে কিছুই নাই। কয়েকটি গৈরিক বসন আর কয়েকটা জীর্ণ পুথি 

দেখিতে দেখিতে ঘরের এককোণে ক্ষুদ্র আর একটি দ্বার চোখে পড়িল। 

স্থূলকায় ব্যক্তি বলিলেন, “এই এখানে কী আছে? এ যে আর-একটি কক্ষ!”

তরুণ সন্ন্যাসী বলিলেন, “হইবে মঠের কোনো সম্পত্তি। চল, চলিয়া যাই।”

অন্যদের কৌতূহল তখন অত্যধিক বাড়িয়া উঠিয়াছে। জনৈক মধ্যবয়স্ক সন্ন্যাসী বলিলেন, “দেখই না খুলিয়া। কী আর হইবে রে বাপু?” 

ক্ষুদ্র দ্বারটি খোলা হইল। আলো হইতে সহসা অন্ধকারে আসিয়া সব ঝাপসা লাগিতেছিল। আঁধারে চক্ষু সহজ দশাপ্রাপ্ত হইলে দেখা গেল, আধো-অন্ধকারে একটি ঘৃতপ্রদীপ জ্বলিতেছে। চাঁপাফুলের সৌরভের ভিতর সিংহাসনে কৃষ্ণকিশোর দাঁড়াইয়া আছেন। প্রভাতে তাঁহার পূজা করা হইয়াছে। এখনও পুষ্পসম্ভার অমলিন রহিয়াছে। 

স্থূল ব্যক্তি অবাক হইয়া বলিল, “ইহা কেমন হইল? আচার্য মধুসূদন অদ্বৈতবাদী; তিনি গোপনে দ্বৈতভাবাত্মক কৃষ্ণপূজা করেন?”

তরুণ বলিল, “বড়োই আশ্চর্য! ইহা তো মন-মুখ এক হইল না। ইহা কী হইল?”

মধ্যবয়স্ক সন্ন্যাসী বলিলেন, “যে লোক অদ্বৈতসিদ্ধি’ লিখেছে, সেই-ই দ্বৈতবাদের পূজার্চনা করিতেছে?” 

আর-একজন কে যেন বলিয়া উঠিল, “ইহা কি দ্বিচারিতা নহে?” 

“দ্বিচারিতাই বটে! আমি দ্বিচারিণী, কুলটা—তাহাতে সন্দেহ নাই!!” পিছন হইতে কাহার যেন কণ্ঠস্বর শুনা গেল। সকলে ফিরিয়া দেখিল, স্বয়ং মধুসূদন। 

মধ্যবয়স্ক সাধুটি বলিলেন, “আপনার অনুমতি না-লইয়া এ সাধনালয়ে প্রবিষ্ট হইয়াছি—আমাদিগের অপরাধ ক্ষমা করিবেন। কিন্তু আপনার এবংবিধ আচরণের অর্থ আমরা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।” 

স্থূলকায় সন্ন্যাসী বলিলেন, “আপনি এত বড়ো অদ্বৈতবাদী। এক অদ্বয় ব্ৰহ্ম ব্যতীত অন্য কিছুই মানেন না। কাশীর ঘাটে বসিয়া এসকল কতই ব্যাখ্যা করেন। দ্বৈতবাদীদের যুক্তি খণ্ডবিখণ্ড করিয়া দেন। আর আপনার এ কেমন বিকৃতি? আপনি কৃষ্ণপূজা করিতেছেন? ইহা তো সম্পূর্ণ দ্বৈতভাব। ইহার ব্যাখ্যা করুন।” 

কমলনয়ন ধীরে ধীরে সামনে আসিল। কৃষ্ণকিশোরের সম্মুখে নতজানু হইয়া বসিয়া পুষ্পপাত্র হইতে অবশিষ্ট একটি চাঁপাফুল তুলিয়া বিগ্রহের চরণে দিল। কেবল বেণুধরের মুখপানে চাহিয়া রহিল। তাহার চক্ষুদ্বয় নয়নজলে ভাসিয়া যাইতেছে… 

“এ তুমি কী করিলে, মুরলীধর? এখন আমি কী করিব? কী উত্তর ইঁহাদের আমি দিব?” 

“বেশ হইয়াছে! ঠিক হইয়াছে! এবার ঠেলা সামলাও।” 

“ইহারা যে তোমাকে মানে না। এখন যে ইহারা আমাকে ত্যাগ করিবে!”

“ভালোই তো! তোমাকে সবাই ত্যাগ করিলে, তুমি শুধু আমার, শুধু আমার হইয়া যাইবে।” 

“তুমি এমন হাসিতেছ কেন? তোমার হাসি দেখিয়া আমার গা জ্বলিয়া যাইতেছে যে!” 

“তুমি কাঁদিতেছ, তাই দেখিয়া আমি হাসিতেছি।” 

কমলনয়ন উঠিয়া দাঁড়াইল। সকলে তাহার উত্তরের অপেক্ষায় তাকাইয়া আছে। তথাপি একজন জোর দিয়া বলিলেন, “এ আচরণের ব্যাখ্যা আপনাকেই দিইতে হইবে, মধুসূদন। আপনি অদ্বৈতবাদী। অদ্বৈতবাদীর দৃষ্টিতে এসব স্বপ্ন, পুতুলখেলা মাত্র। ইহা তো আপনি নিজেই বহুবার ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আর আজ সেই পুতুলখেলায় আপনি মাতিয়া উঠিলেন কীভাবে? ইহার ব্যাখ্যা কী?” 

কমলনয়নের দুই গণ্ডদেশ অশ্রুবারিতে ভাসিয়া যাইতেছে। কোনোমতে মুখ তুলিয়া অশ্রুপরিপ্লুত কণ্ঠে সে বলিতে পারিল, 

“অদ্বৈতসাম্রাজ্যপথাধিরূঢ়াস্তূণীকৃতাখগুলবৈভবাশ্চ। 
শঠেন কেনাপি বয়ং হঠেন দাসীকৃতা গোপবধূবিটেন।।

অদ্বৈতসাম্রাজ্যের পথ ধরিয়া ইন্দ্রের অতুল ঐশ্বর্যকে তৃণবৎ উপেক্ষা করিয়াই তো চলিতেছিলাম, কিন্তু পথিমধ্য হইতে কে এক শঠ, কে এক গোপবধূলম্পট জোরপূর্বক হরণ করিয়া লইয়া গিয়া তাহার চরণের দাসী করিয়া রাখিল যে!” 

তরুণবয়স্ক সন্ন্যাসীটি বলিল, “ইহা বড়োই অদ্ভুত। আপনি কি বলিতেছেন, ইহা আপনার অসম্পূর্ণতা? কিন্তু ইহা তো আমাদের বিশ্বাস হইতেছে না। এত ভাব-ভক্তি লুকাইয়া রাখিয়াছেন? বেশ, তবে এক্ষণে বলুন, আপনি সমস্ত জীবন ধরিয়া কী সত্য পাইয়াছেন, কী সত্য জানিয়াছেন? অদ্বৈত সত্য? না, দ্বৈত সত্য?” 

কমলনয়নের মনে হইতেছিল, যেন তাহার কানের কাছে বজ্রাঘাত হইতেছে। অদ্বৈত, দ্বৈত—কিছুই তাহার আর শুনিতে ইচ্ছা হইতেছে না। সে প্রেম খুঁজিয়াছিল, প্রেম পাগল করিয়া দিয়াছে। কৃষ্ণকিশোর তাহার মাথা খাইয়া ছাড়িয়াছে। সব দার্শনিক আলোচনা বিস্বাদ বোধ হইতেছে। 

ওই, ওই আবার সেই বাঁশিটা বাজিয়া উঠিল। ওই সেই বাঁশির সুর আদিম নাগমাতার মতো তাহাকে পাকে পাকে জড়াইয়া ধরিতেছে! শ্বাস বন্ধ হইয়া আসিতেছে। 

সে কী উত্তর দিবে? কী বুঝাইবে? বলিয়া দাও, কৃষ্ণকিশোর, বলিয়া দাও। কী বলিব, বলিয়া দাও! প্রেমভরে আর্দ্রস্বরে আচম্বিতে সে বলিয়া উঠিল, 

“বংশীবিভূষিতকরান্নবনীরদাভাৎ 
পীতাম্বরাদরুণবিম্বফলাধরোষ্ঠাৎ। 
পূর্ণেন্দুসুন্দরমুখাদরবিন্দনেত্রাৎ 
কৃষ্ণাৎ পরং কিমপি তত্ত্বমহং ন জানে।। 

যাঁহার দুটি কর বংশীবিভূষিত, নবীন মেঘের ন্যায় যাঁহার গাত্রবর্ণ, পীতাম্বর যাঁহার অঙ্গের বসন, আরক্তিম বিম্বফলের ন্যায় যাঁহার অধরোষ্ঠ, চাঁদের ন্যায় যাঁহার সুন্দর মুখ, পদ্মের ন্যায় যাঁহার দুইটি চক্ষু, সেই কৃষ্ণ ছাড়া আর কোনো তত্ত্ব আমি জানি না!” 

সে আর কথা কহিতে পারিতেছে না। কণ্ঠস্বর ক্রন্দনের ভিতর ডুবিয়া গিয়াছে। চারিপাশে কী হইতেছে, সে আর দেখিতে পাইতেছে না। নেশায় পা টলিতেছে। বাঁশির সুরে সুরে তাহার সত্তা দ্রবীভূত হইতে চলিল। নুনের পুতুল সমুদ্রে গলিয়া গেল। 

.

অনেকক্ষণ পর যখন তাহার বাহ্যজ্ঞান ফিরিল, দেখিল সকলেই চলিয়া গিয়াছে। শূন্যঘরে সে শুধু একা আর আসনের উপর মুরলীধর তাহারই পানে তাকাইয়া হাসিতেছে! 

কী করিলে, কৃষ্ণকিশোর, এ তুমি আমার কী করিয়া দিলে? এমন করিয়া হাটে হাঁড়ি ভাঙিয়া দিতে হয়? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *