ছায়াচরাচর – ১৪

চোদ্দো 

সংখ্যায় প্রায় দশ-বারো জন হইবে। সকলেই অশ্বারূঢ়। প্রচণ্ড জিঘাংসায় সকলেই দুর্বোধ্য ভাষায় হুংকার করিতেছে। অশ্বের হ্রেষারবে, আততায়ীদিগের গর্জনে, অসির ঝনৎকারে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। কমলনয়ন সভয়ে দেখিল, জনৈক অশ্বারোহী অশ্ব হইতে সামান্য ঝুঁকিয়া পড়িয়া এক হতভাগ্য পুণ্যার্থীর শিরোদেশ বাম হস্তে সবলে আঁকড়াইয়া দক্ষিণ হস্তে তরবারির এক আঘাতে মুণ্ডচ্ছেদ করিল। অশ্ব উত্তেজিত হইয়া সম্মুখের দুই পদ শূন্যে উঠাইল বটে, কিন্তু আরূঢ় ব্যক্তি তাহাতে বিন্দুমাত্রও বিচলিত হইল না; অশ্বের পৃষ্ঠদেশ অনায়াসে ধারণ করিয়া সশব্দে অসি আস্ফালন করিল। 

আর-একটা অশ্ব প্রবল বেগে বৃত্তাকারে ঘুরিতেছে, তাহার পৃষ্ঠে বল্লম হস্তে আর- এক আরোহী চতুষ্পার্শ্বে যাহাকে পাইতেছে তাহারই বক্ষদেশ বিদীর্ণ করিতেছে। ইহাদের নেতৃস্থানীয় এক ব্যক্তি অশ্ব হইতে ঝম্প দিয়া ভূমির উপর পড়িল ও মুহূর্তে অশ্বের লাগাম সংযত করিয়া এক অসহায়া বৃদ্ধার চুলের মুঠি চাপিয়া ধরিল। বৃদ্ধা চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “আমাকে প্রাণে মারিও না গো, যাহা সঙ্গে আছে সব দিতেছি!” বৃদ্ধার নিকট লোহিত বর্ণের একটি ক্ষুদ্র পুঁটুলিতে মোহর ছিল, তাহাই সে তুলিয়া দিতে গেল, কিন্তু তৎপূর্বেই দস্যু মোহরের পুঁটুলি কাড়িয়া লইয়া বল্লমের ফলায় বৃদ্ধার জীর্ণ শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করিয়া প্রবল অট্টহাস্যে ফাটিয়া পড়িল। রক্তের ধারায় গঙ্গার ঘাট ভাসিয়া গেল। ভয়ে কম্পিত কমলনয়ন সেদিক হইতে দৃষ্টি ফিরাইতেই ঘাটের চাতালের উপর অন্য এক বিচিত্র দৃশ্য অবলোকন করিয়া ভয়ে বিস্ময়ে শিহরিত হইয়া উঠিল। জনৈক আক্রান্ত ব্যক্তি দুই হস্তে উদরদেশ ধারণ করিয়া চাতালের উপর পড়িয়া আছে আর তাহার বিদীর্ণ উদর হইতে এক ধাবমান অশ্বারূঢ় দস্যুর বল্লমের খোঁচায় অন্ত্রতন্ত্র গাঁথিয়া গিয়া গলগল করিয়া ক্রমান্বয়ে বাহির হইয়া আসিতেছে। অসির আঘাতে আর-এক ব্যক্তির মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গিয়াছে, করোটি ভাঙিয়া অভ্যন্তরস্থ ঘিলু রক্তের সহিত মিশিয়া ঘাটের উপর ছিটকাইয়া পড়িল। 

অশ্বারোহীগণ দ্রুতবেগে ঘাটের নিম্নদিকে নামিয়া আসিতেছে। কমলনয়ন বুঝিল, সম্মুখে সাক্ষাৎ মৃত্যু! আর উপায় নাই! সকলেই প্রাণভয়ে পলাইতেছে, কেহ-বা গঙ্গাবক্ষে লম্ফ দিয়া পড়িতেছে। বাঁচিবার অন্য উপায় না দেখিয়া কমলনয়ন আলোকস্তম্ভটির পশ্চাতে আত্মগোপন করিবার চেষ্টা করিল। স্তম্ভের উপর মশাল জ্বলিতেছে, নিম্নে গভীর অন্ধকার। তথাপি, স্থানটি সংকীর্ণ, এখনই ধরা পড়িয়া যাইবার সম্ভাবনা। অন্যত্র কোথাও নড়িবারও উপায় নাই। এত দ্রুত হৃৎকম্প হইতেছে যে, মনে হয়, বক্ষ ফাটিয়া যাইবে। 

জনৈক দস্যু ত্বরিতবেগে আলোকস্তম্ভের নিকটে আসিয়া পড়িয়াছে। সে-ব্যক্তির পা হইতে মাথা পর্যন্ত কৃষ্ণবর্ণ আবরণে আবৃত, মুখ লৌহজালিকায় ঢাকা, শিরোদেশে রক্তবর্ণের উষ্ণীষ, হস্তে উদ্যত রুধিরাক্ত বল্লম। সে একবার গঙ্গায় লম্ফপ্রদানকারী জনতার দিকে তাচ্ছিল্যের সহিত তাকাইল, কিন্তু নদীতে নামিবার চেষ্টা করিল না। একবার কমলনয়ন যেখানে লুক্কায়িত আছে, সেইদিকে ফিরিয়া তাকাইল… কমলনয়ন যেন নিজে নিজের হৃৎস্পন্দন শুনিতে পাইল…. কী মনে করিয়া লোকটা মুখে একটা বিচিত্র আওয়াজ তুলিয়া অশ্ব ফিরাইয়া সোপান বাহিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেল। স্তম্ভের আড়ালে আত্মগোপন করিয়া কমলনয়ন এই আর্তনাদ, এই গর্জন, এই তাণ্ডবধ্বনি অবিরত শুনিতেই লাগিল। শেষে একবার সমস্বরে উল্লাসধ্বনি উঠিল: ‘আল্লা হু আকবর!’ তাহার পর সব চুপ; যেন একটি জীবিত প্রাণীও আর অবশিষ্ট নাই। 

বহুক্ষণ পর স্তম্ভের আড়াল হইতে মুখ বাহির করিয়া কমলনয়ন দেখিল, আক্রমণকারীগণ চলিয়া গিয়াছে। সেই ক্ষুদ্র পরিসর অন্তরাল ছাড়িয়া সে বাহির হইয়া আসিল। মনে হইল, গঙ্গার এই ঘাট যেন আজ প্রত্যক্ষ নরকে পরিণত হইয়াছে। কাহারও কর্তিত হস্ত, কাহারও-বা কর্তিত মুণ্ড, কাহারও ছিন্ন পদ, কেহ মৃত্যুর পূর্বে শেষ নিঃশ্বাস ফেলিতেছে, কেহ আর্তস্বরে গোঙাইয়া মৃত্যুকে ডাকিতেছে, সর্বত্র রক্তের স্রোত সোপান বাহিয়া গঙ্গার উপর নামিয়া আসিতেছে, পরিধেয় বস্ত্রসমূহ শোনিতসিঞ্চিত হইয়া যত্রতত্র পড়িয়া আছে, হতাহত ব্যক্তিদিগের ভিতর কেহ শিশু, কেহ নারী, কেহ যুবক, কেহ-বা বৃদ্ধ। কমলনয়ন এক মুমূর্ষু ব্যক্তির মুখে করপুটে গঙ্গাজল আনিয়া ঢালিয়া দিল; কিন্তু বারিবিন্দু ওষ্ঠাধর বাহিয়া গড়াইয়া পড়িল। আর-এক ব্যক্তিকে কমলনয়ন উঠাইয়া বসাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু বৃথা চেষ্টা। ভয় হইতেছিল, পুনরায় যদি দস্যুদল ফিরিয়া আসে। এ ভয়ানক স্থানে আর বৃথা কালক্ষেপ না-করিয়া সেই তাবৎ মৃতদেহস্তূপ ও রক্তস্রোতের ভিতর দিয়া কমলনয়ন কোনোমতে ঘাটের উপরিভাগে উঠিয়া আসিল। বারাণসীর সংকীর্ণ গলিপথ ধরিয়া সতর্ক দৃষ্টিতে চারিপাশ দেখিতে দেখিতে কমলনয়ন ভয়ার্ত শ্বাপদের ন্যায় সম্মুখে অগ্রসর হইতে লাগিল… 

সঙ্গোপনে নগরীর অন্য পথ দিয়া সে যখন রামতীর্থের আবাসস্থলে উপনীত হইল, তখন রাত্রির প্রথম প্রহর অনেকক্ষণ অবসিত হইয়া গিয়াছে। প্রবেশ করিয়াই দেখিল, ভগ্ন নাটমন্দিরে রামতীর্থ একাকী আধো-অন্ধকারে চিন্তিত ভঙ্গিমায় পদচারণা করিতেছেন। দশাশ্বমেধ ঘাটে আক্রমণের সংবাদ তাঁহাদের কর্ণে পশিয়াছে এবং কমলনয়নের বিলম্ব দেখিয়া তাহার দুই-একজন সতীর্থ তাহারই অন্বেষণে বহির হইয়া গিয়াছে। দীর্ঘক্ষণ সন্তানের অদর্শনের পর তাহাকে ফিরিয়া পাইলে মা যেমন ব্যগ্র হইয়া সন্তানের সমীপে ছুটিয়া আসে, রামতীর্থও তেমনই কমলনয়নকে সহসা দেখিতে পাইয়া সাগ্রহে নিকটে সরিয়া আসিয়া বলিলেন, “মধুসূদন! কী হইয়াছে? এতক্ষণ কোথায় ছিলে? দশাশ্বমেধ ঘাটে যাও নাই তো?” 

—সেখান হইতেই আসিতেছি। 

—বলো কী? হামলার মধ্যে পড়ো নাই? 

—পড়িয়াছিলাম। মরণের হাত হইতে কোনোক্রমে ফিরিয়া আসিয়াছি।

—অনতিবিলম্বে আমার কক্ষে আইস, সমস্ত কিছু বিশদে শুনিব। 

ঘটনার ঘূর্ণাবর্তে মন প্রবলভাবে অশান্ত, বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে। সন্ধ্যার হত্যাকাণ্ড জীবন্ত স্মৃতির ন্যায়, নিরাময়হীন বিস্ফোটকের ন্যায় মস্তিষ্কের ভিতর দপদপ করিয়া জ্বলিতেছে। কোনোমতে হস্তপদ প্রক্ষালন করিয়া কমলনয়ন সত্বর রামতীর্থের কক্ষে আসিয়া সমস্ত নিবেদন করিল। গঙ্গার ঘাটে আচম্বিতে অশ্বারূঢ় আততায়ীদের আক্রমণ, নিরস্ত্র অসহায় পুণ্যার্থীদের নিধন, রক্তস্রোতে গঙ্গা লাল হইয়া যাওয়া, আলোকস্তম্ভের নিম্নে তাহার আত্মগোপন করিয়া প্রাণরক্ষা—এক-এক করিয়া সকলই কহিল। সব শুনিয়া রামতীর্থ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিলেন। নীরব কক্ষে একটি ঘৃতদীপ শীর্ণ শিখায় জ্বলিতেছে। 

ধীরে ধীরে যেন কতদূর হইতে চিন্তিত স্বরে রামতীর্থ বলিলেন, “এই এক অভিশাপ আমাদিগের তীর্থস্থল ও সমস্ত দেশের উপর নামিয়া আসিতেছে। যে কেহ যখন খুশি আক্রান্ত হইতে পারে। ভিন্ন দুই ধর্মসম্প্রদায়ের ভিতর বিরোধ প্রবল আকার ধারণ করিতেছে। আরও কত শতাব্দী ধরিয়া যে এ হত্যালীলা চলিতে থাকিবে, তাহার ইয়ত্তা করিতে পারি না…” 

কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “কিন্তু এ সাম্প্রদায়িক বিরোধের মূলীভূত কারণ কী?” 

—বিদ্বেষই ইহার কারণ। 

—এরূপ বিদ্বেষ কেন হয়? 

—বেদান্তের বাণী কেবল গ্রন্থমধ্যে নিবদ্ধ থাকিয়া আমাদের শাস্ত্রীয় চর্চা ও পাণ্ডিত্যপ্রকাশের আশ্রয় হইয়া রহিয়াছে বলিয়াই এই বিদ্বেষ। যদি বিন্দুমাত্র বাস্তবজীবনে অনুষ্ঠিত হইত, এ বিদ্বেষের মেঘ কাটিয়া বিশ্বাসের অরুণোদয় হইত।

এ রক্তাক্ত মৌষলপর্বেও রামতীর্থ বেদান্তপ্রসঙ্গ টানিয়া আনিতেছেন! কমলনয়ন বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল, “বেদান্ত এ সামাজিক সমস্যার সমাধানে কী করিতে পারে?” 

—সমাজটা মনেরই প্রতিফলন, কমলনয়ন! বাহিরে যুদ্ধ বাঁধিবার পূর্বে ব্যক্তির অন্তরেই রণক্ষেত্র রচিত হয়। অন্তরে সন্ধি স্থাপিত হইলে, বাহিরে যুদ্ধ-অবসানের বিলম্ব হয় না। প্রকৃত বেদান্তবাদীর তো কোনো শত্রু নাই, বিরুদ্ধতা নাই। 

—কীভাবে? 

—দেখ, বেদান্তমতে আত্মা ব্যতীত অন্য কোনও কিছুর সত্তা কি স্বীকৃত হইয়াছে?

—না, তাহা হয় নাই। বেদান্তমতে আত্মাই একমেবাদ্বিতীয়ং সত্য। 

—তাহা হইলে, এ হিন্দু, ও মুসলমান, এ মিত্র ও অরাতি—ইত্যাকার ভেদ কোথা হইতে আসিল? এই ভেদদর্শনই তো মিথ্যা। তুমি নিজেকেই তো এসকল নানা রূপে, নানা ভেদে অভিব্যক্ত হইতে দেখিতেছ। ইহা তো ভ্রান্তি! মায়ার খেলা মাত্র! বস্তুত, তুমি ছাড়া আর কিছুই তো নাই! এ কথা একবার বুঝিতে পারিলে কে কাহাকে আঘাত করিবে? কে কাহার আঘাতে হতাহত হইবে? তুমি নিজে নিজেকে আঘাত করিবে? তাহা তো হইতেই পারে না। 

সন্ধ্যাকালে দশাশ্বমেধ ঘাটে দৃষ্ট আততায়ীদিগের ভয়াল রক্তপিপাসু মূর্তি কমলনয়নের মনে পড়িতেছিল। ইহারা—এই নরপিশাচেরা—ইহারাও তাহারই আত্মস্বরূপের মায়িক অভিব্যক্তি? বেদান্তের চরম সিদ্ধান্ত তাহাই। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত আমাদিগের প্রাত্যহিক যাপনের ক্লেদকলুষ হইতে কত দূরে! কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল, “ইহা সত্য হইলে অনুভব হয় না কেন?” 

—কে বলে, ইহা অনুভব হয় না? সত্যদ্রষ্টা ঋষির অবশ্য ইহা অনুভব হয়। 

—তাহা হইলেও, বেশিরভাগ মনুষ্যের তো ইহা অনুভবে ধরা দেয় না! 

—নাই বা হইল। তথাপি, ইহা তো একটা দর্শন। অভেদানুভূতিই ইহার লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হইতে হইলে এই অভেদভাবের অনুশীলন প্রয়োজন। অনুশীলন করিতে করিতে একদিন অজ্ঞানের আবরণ চক্ষু হইতে খসিয়া পড়িবে। 

—ব্যবহারিক জীবনে কী করিয়া বা ইহার অনুশীলন সম্ভব? 

—আচ্ছা, মধুসূদন! কাদা দিয়া কখনও কাদা ধোওয়া যায়? রক্ত দিয়া কখনও রক্তস্রোত মুছিতে পারো? যে-ব্যক্তি বেদান্তের সাধন করিতেছে, সে ব্যবহারিক জীবনে যুগের পর যুগ ভেদভাব অভ্যাস করিয়া, একে ঘৃণা করিয়া ওকে আঘাত করিয়া চরমে অভেদতত্ত্বে উপনীত হইবে—ইহা কি কখনও হইতে পারে? 

—কিন্তু সকলে তো আর বেদান্তের সাধন করিতেছে না। 

—নাই-বা করিল। তবু মুষ্টিমেয় সাধকদের সাধনার প্রভাবেই অন্যরা কমবেশি প্রভাবিত হইবে। এসবের কিছুই এযুগে হয় নাই, কমলনয়ন। আমরা কেবল পুথিপাতড়া লইয়াই পড়িয়া আছি। এই মহান দর্শন হিন্দুদের উপনিষদেই আছে। তাহা হইলে, হিন্দুরই তো প্রথম কর্তব্য ছিল, ভিন্নধর্মাবলম্বী মুসলমানদিগকে নিজের আত্মা জ্ঞান করিয়া তাহাদের সহিত নিজেদের ভেদভাব দূর করা। পরিবর্তে হিন্দুরা তাহাদের ঘৃণা করিয়া ফিরিতেছে। 

—তাহারা যে আততায়ী, তাহারা যে আক্রমণকারী! 

—দেখ, বহিরাক্রমণ ভারতে নুতন হইতেছে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী এ ভারতবর্ষ বহিরাক্রমণকারীদিগের মুখামুখি হইয়াছে। কিন্তু অতীতে আমাদিগের পূর্বপুরুষগণ যে-অনুভূতির আলোকে বহিরাক্রমণকারীদিগকে নিজ সংস্কৃতির সহিত একীভূত করিয়া লইতে পারিয়াছিলেন, আমরা তাহা পারিতেছি না। কারণ, আমাদিগের সে-অনুভূতির ঐশ্বর্যে টান পড়িয়াছে, প্রেমের রাজকোষ শূন্য হইয়া গিয়াছে। ইহা কাহার দোষ? 

কমলনয়নের মনে পড়িল, নবদ্বীপে সেই মহাত্মার প্রেমের মন্ত্রেই দুই সম্প্রদায়ের লোক মিলিয়া মিশিয়া রহিয়াছে। সেখানেও সাম্প্রদায়িক দুর্ঘটনা যে ঘটে না, তাহা নহে, তবু এ স্থানের তুলনায় সেখানে অপেক্ষাকৃত শান্তির বাতাবরণ রচিত হইয়াছে। কমলনয়ন রামতীর্থের কথাগুলি লইয়া মনে মনে তোলাপাড়া করিতেছিল। বেদান্তেই তবে অপ্রেমের হাত হইতে মুক্তি? 

রাত্রি অন্ধকার। রামতীর্থের কক্ষের পশ্চাদ্বর্তী জঙ্গল হইতে তক্ষকপুরুষের ডাক ভাসিয়া আসে। বারবার ডাকিয়া থামিয়া যায়। অরণ্যের ঈশ্বর বুঝি-বা নিশীথের নিস্তব্ধতা পরিমাপ করিতেছেন। কমলনয়ন গবাক্ষের অন্ধকারের দিকে চাহিয়া ছিল। কিছুক্ষণ পরে সে চিন্তিতস্বরে বলিল, “…জানি না, আপনার এ ব্যবস্থা অনুযায়ী সমাজসমস্যা দূরীভূত হইবে কি না, বা কতদূর দূরীভূত হইবে, কারণ সমাজে নানা শ্রেণীর, নানা ভাবের লোক বিদ্যমান। সকলের পক্ষেই অভেদভাব তথা প্রেম অনুসরণ সম্ভব নয়। অনেকের জন্যই প্রত্যাঘাত করার প্রয়োজন আছে… কিন্তু আজ আমি অন্য আর-একটি সংকটেও পতিত হইলাম। ইহা আরও গভীর, আরও কঠিন।” 

রামতীর্থ প্রশ্ন করিলেন, “কী সমস্যা?” 

—আজ আমি প্রথম মৃত্যুভয় কী, জানিয়াছি! বড়ো মরমে মরিয়া গিয়াছি!! 

—কেন এরূপ বলিতেছ? 

কমলনয়ন পুনর্বার নিজের ভিতর তলাইয়া গেল। সদ্যোলব্ধ ভয়ানক অভিজ্ঞতা হৃদ্দেশে পুনরায় ভাসিয়া উঠিতেছে। কী নারকীয় অভিজ্ঞতা! মানুষ মানুষের রক্তে এমন করিয়া পিপাসা মিটাইতে পারে, সে কখনও দেখে নাই। আর তাহার সেই প্রাণরক্ষার ভয়ার্ত লজ্জাজনক প্ৰয়াস! কী বিপুল আত্মগ্লানি! নতমুখে বলিতে লাগিল, “…আলোকস্তম্ভের নিম্নে কোনোমতে আত্মগোপন করিয়া আছি… অসিহস্তে দস্যু যাতায়াত করিতেছে… মৃত্যুভয়ে কাঁপিতেছি। আমি যুবক, উচ্ছিন্নমূল! আমার কোনো গৃহ নাই, আত্মীয়পরিজন নাই, পিছুটান নাই। তা সত্ত্বেও আমার এত ভয়! বেশি কী হইত? মরিয়া যাইতাম। কত লোক তো চক্ষের সম্মুখে মরিল। কিন্তু আমি? আমি যে ভয়ের হস্তে পরাজিত হইলাম! শরীরে না মরিয়াও অন্তরে মরিয়া গেলাম! এই আমার শাস্ত্রপাঠ? এই আমার দর্শনচর্চা?”

—তোমার তো চরম অনুভূতিলাভ হয় নাই, মধুসূদন! তাই, ভয়। পড়ো নাই, ‘যাহার পরম অনুভূতি হয় নাই, সে বিবেকবান হইলেও ক্রূরদৃষ্টি, গর্জনকারী ও উদ্যতখড়গহস্ত বলবান আক্রমণকারীকে দর্শন করিয়া তাহাদিগের নিকট হইতে সভয়ে পলাইয়া যায়। অতঃ সমানঃ পশ্বাদিভিঃ পুরুষাণাং প্রমাণপ্রমেয়ব্যবহারঃ— অতএব, এইরূপ মনুষ্যের প্রমাণ-প্রমেয় ব্যবহার পশুর সহিত সমান’? কী পড়ো নাই? 

—পড়িয়াছি। আচার্য শঙ্করকৃত অধ্যাসভাষ্যে এইরূপই আছে। কিন্তু আমি কবে এই পশুত্বের ঊর্ধ্বে উঠিতে পারিব? ভয় কি কাহারও যায়? 

রামতীর্থ স্থির হইয়া কিয়ৎকাল বসিয়া রহিলেন। যেন এই নির্জন রাত্রির ভিতর দিয়া কত যুগের অন্ধকার নিশাকাল পার হইয়া চলিয়াছেন। একবার শুধু প্রদীপের শিখাটিকে শলাকার দ্বারা উন্মুখ করিয়া দিলেন। তাহার পর কক্ষের নীরবতা ভাঙিয়া কহিলেন, “শুন, একটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলি। আজ হইতে বহু বহু শতাব্দী পূর্বে গ্রীকবীর সেকেন্দার শাহ ভারত আক্রমণ করিয়াছিলেন…” 

—যবনেরা যাঁহাকে আলেকজান্ডার বলিয়া জানে? 

—হ্যাঁ সেই গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের গুরু ছিলেন এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি- অ্যারিস্টটল। গুরুর নির্দেশ ছিল, ভারত হইতে এ দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাবান পুরুষকে গ্রীসের ম্যাসিডোনিয়ায় লইয়া যাইতে হইবে। আলেকজান্ডার অনেক খুঁজিয়া শেষে সরস্বতী নদীতীরে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষীকে পাইলেন। অবাক হইয়া দেখিলেন, নদীতীরে এক প্রকাণ্ড বটবৃক্ষের নিম্নে এক দীর্ঘদেহী, সম্পূর্ণ নগ্ন, বয়োবৃদ্ধ সন্ন্যাসী শুইয়া আছেন। তাঁহার মুখমণ্ডল কী এক অনির্বচনীয় আনন্দে উদ্ভাসিত। আলেকজান্ডার ভাবিলেন, ইনি তো হতদরিদ্র! ইঁহার তো পরিধেয় বস্ত্র পর্যন্ত নাই! ইনিই ভারতের শ্রেষ্ঠ মনীষা? 

—আলেকজান্ডার বুঝিতে পারেন নাই। অন্তরে ব্রহ্মজ্ঞান উদিত হইলে বাহিরের কোনো কিছুর আর প্রয়োজন থাকে না। 

— যথার্থ বলিয়াছ, মধুসূদন। যাহাই হউক, আলেকজান্ডার সসৈন্য সেই নগ্ন সন্ন্যাসীর সমীপে উপস্থিত হইলেন। সন্ন্যাসী সম্রাটের দিকে দৃকপাত পর্যন্ত করিলেন না। না করুন, শুনিতে তো পাইতেছেন। আলেকজান্ডার বলিলেন, ‘আপনি কি আমার সহিত ম্যাসিডোনিয়ায় যাইবেন?” বৃদ্ধ হাসিমুখে ঘাড় নাড়িয়া অসম্মতি প্রকাশ করিলেন। তখন আলেকজান্ডার প্রলোভন প্রদর্শনপূর্বক বলিলেন, ‘আপনি ম্যাসিডোনিয়ায় যাইতে সম্মত হইলে আমি আপনাকে মূল্যবান বস্ত্র, নানা রত্ন, বহু উপঢৌকন দিব। সুবেশা রমণীগণ আপনার পদসেবা করিবে। যাইবেন কি না?’ বৃদ্ধ সন্ন্যাসী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসিলেন। সেই হাসি দেখিয়া আলেকজান্ডার ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন। কোষ হইতে অসি নিষ্কাসিত করিয়া রুষ্টস্বরে গর্জন করিয়া উঠিলেন, ‘কী? এতদূর স্পর্ধা? আমি দিগ্‌বিজয়ী বীরশ্রেষ্ঠ সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর আলেকজান্ডার! আমার কথাকে উপেক্ষা করা? আমি এখনই আপনাকে হত্যা করিব।’ 

—তাহার পর? 

—আলেকজান্ডার এই কথা বলিবামাত্র সেই নগ্ন সন্ন্যাসী অট্টহাস্যে ফাটিয়া পড়িলেন। সেই বিপুল হাস্যের তরঙ্গ যেন দমকে দমকে বাহির হইয়া অরণ্যের বিহগকুলকে সন্ত্রস্ত করিয়া আকাশে উড়াইয়া দিল, অপ্রস্তুত আলেকজান্ডারের ভীতকম্পিত হস্ত হইতে উদ্যত তরবারি সশব্দে খসিয়া পড়িল। হাস্যবেগ প্রশমিত হইলে সন্ন্যাসী সগর্জনে বলিলেন, ‘ঐহিক জগতের সম্রাট! তুমি আজ কী কৌতুকের কথাই না কহিলে। কী হাসির কথা! তুমি আমাকে মারিবে? জানো, আমি কে? আমি দেহ নই, প্রাণ নই, মন নই, বুদ্ধি নই, অহংকার নই—আমার মৃত্যু নাই, জন্ম নাই, ভয় নাই, আমি শাশ্বত, অমোঘ, অবিনাশী সত্তা। আমি এক সর্বব্যাপী বোধ। আমা ভিন্ন আর কিছুই নাই। পরমার্থতঃ তুমি আমিই—অন্য কেহ নহে। তাহা হইলে, কে কাহাকে হত্যা করিবে? ব্যবহারতঃ তুমি তো বালক, এখনও ভালো করিয়া কথা কহিতে শেখো নাই… তুমি আমাকে মারিবে?’ 

কোন্ সুদূর অতীতের দৃশ্যাবলী এসব! সরস্বতী নদীতীরে দিগ্‌বিজয়ী সম্রাট ও নগ্ন সন্ন্যাসীর আলেখ্য কমলনয়নের মনোভূমিকায় যেন আঁকা হইয়া গেল। প্রলোভন ও আক্রমণের সম্মুখে সন্ন্যাসীর সেই অভয়মূর্তি যেন জীবন্ত হইয়া কমলনয়নের চেতনাকে আমুল নাড়া দিয়া গেল। ভাবিতে ভাবিতে তন্ময় হইয়া সে বলিয়া উঠিল, “কী আশ্চর্য!” 

—হাঁ, মধুসূদন, যাহাকে তোমার এত আশ্চর্যজনক মনে হইতেছে, তাহাই অনুভূতিমান পুরুষের নিকট স্বাভাবিক! “দ্বিতীয়া বৈ ভয়ং ভবতি’—দ্বিতীয় হইতেই ভয় হয়। যেখানে দ্বিতীয় নাই, সেখানে অদ্বিতীয় আত্মায় কীসের ভয়? ভিন্নতা হইতেই ভয়ের সূত্রপাত! আর অদ্বয়তত্ত্বেই অভয়, বৈরাগ্যই অভয়প্রদ! 

—বেদান্তদর্শন ব্যতীত দর্শনের অন্যান্য কোনো শাখাই তো এই অভয়ের কথা বলে না! 

—তাহা সত্য। কারণ একমাত্র, বেদান্তেই এই অদ্বিতীয় আত্মার কথা প্রতিপাদিত হয়। সেই আত্মা মৃত্যুরহিত— অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। 

কমলনয়নের মুখশ্রী আনন্দে ঝলমল করিয়া উঠিল। কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই মুখভাব মলিন হইয়া গেল। সে যেন ভিতরে ভিতরে কী ভাবিতেছে। 

শিষ্যের মুখশ্রী পাংশুবর্ণ দেখিয়া রামতীর্থ সস্নেহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী ভাবিতেছ, মধুসুদন? 

নিম্নস্বরে কমলনয়ন বলিল, “আমি আপনার নিকট মহা অপরাধ করিয়াছি। মিথ্যা কহিয়াছি।” 

রামতীর্থ বলিলেন, “কই? আমি তো তোমার কোনো অপরাধ দেখি না। হইয়াছে?”

—আমি আপনার নিকট পরিচয় গোপন করিয়াছিলাম। আপনার ছাত্র হইতে আসিয়া আমি আপনাকে বলি নাই, আমি পূর্বে নৈয়ায়িক ছিলাম। নবদ্বীপে মথুরানাথ তর্কবাগীশের টোলে ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছিলাম। আমার এখানে আসিবার উদ্দেশ্য ছিল, বেদান্ত অধিগত করিয়া ন্যায়ের যুক্তি দিয়া বেদান্ত কাটিয়া ফেলিয়া ভক্তিভাবের অনুকূল একটি গ্রন্থ রচনা করা। 

—তোমাকে পাঠ দিতে গিয়া আমি কি তাহা বুঝিতে পারি নাই, মনে করো? তোমার যুক্তিসিদ্ধ বিচারক্ষমতা, ন্যায়শাস্ত্রের কঠিন বিষয়গুলিতে তোমার স্বচ্ছন্দ অধিকার—এসকল হইতেই আমার বুঝিয়া লইতে অসুবিধা হয় নাই যে, তুমি কৃতবিদ্য নৈয়ায়িক। কিন্তু তোমার এ আত্মপরিচয় গোপন করায় যদি কোনো পাপ হইয়া থাকে, তবে তাহার হেতু তুমি নহ, সেই হেতু—আমি। 

—এ কী বলিতেছেন? আপনি কেন আমার সত্যগোপনরূপ পাপের হেতু হইবেন? 

—ঠিকই বলিতেছি। পঞ্চদশবর্ষপূর্বে তুমি যখন আমার নিকট বিদ্যালাভ করিতে আসিয়াছিলে, তখন আমিও তো কম সম্প্রদায়বুদ্ধি দেখাই নাই! তখন যদি নৈয়ায়িক পরিচয় দিতে, তবে তো আমিই তোমাকে শিষ্যস্বীকার করিতাম না, মিথ্যাপরিচয় দেওয়া ছাড়া তোমার উদ্দেশ্য সাধনের আর কোনো উপায় অবশিষ্ট ছিল কি? কিন্তু আমার সেই ‘আমি’ বিগত পঞ্চদশ বৎসরে মরিয়া গিয়াছে। এই সময়ের মধ্যে তুমিও যেমন বহু সংশয় অতিক্রম করিয়াছ, আমিও তেমনই আমার সম্প্রদায়বুদ্ধির নাগপাশ হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছি। বাহিরে সমাজে হিন্দু-মুসলমানের এই সকল সাম্প্রায়িক বিরোধ আমাকে আমার নিজ অন্তরস্থিত সীমাবদ্ধতাকে চিনাইয়া দিয়াছে। এখন বুঝিয়াছি, সকল সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিই যাবতীয় দুঃখের কারণ। তাই সে সম্প্রদায়বুদ্ধি নিঃশেষে পরিত্যাগ করিয়াছি। 

—কিন্তু সত্যগোপনের এই পাপ, যাহা আমি আপনার নিকট করিলাম, ইহার কী প্রায়শ্চিত্ত হইবে? 

রামতীর্থ একটু মৃদু হাসিলেন। তাঁহার কপালে যেন মেধাবিদ্যুৎ খেলিয়া যাইতেছিল। কিছু পরে বলিলেন, “তোমার বর্তমান মানসিক অবস্থা কী? কী সত্য বুঝিলে?” 

কমলনয়ন যেন নিজ অন্তঃকরণের পরীক্ষা লইতেছে। কিয়ৎকাল বিরুদ্ধ স্রোতের ভিতর সাঁতার দিয়া সে যেন প্রত্যয়ের বেলাভূমিতে উঠিয়া আসিল। অবশেষে দৃঢ় কণ্ঠে বলিল, “অনেক ভাবিয়া দেখিয়াছি, ন্যায়শাস্ত্র বড়ো অসম্পূর্ণ। উহাতে আত্মার অদ্বিতীয়ত্ব, অভেদত্বের কথাই নাই। ঈশ্বরের সহিত প্রেমে লীন হইয়া যাইবার ভাবও নাই। উহা যুক্তিনিষ্ঠ করে ঠিকই, কিন্তু বেদান্তের মতো এত শক্তি দেয় না, সাহস জোগায় না। বিপদে পড়িয়া আজ আমি বুঝিয়াছি, দীর্ঘকাল ন্যায়শাস্ত্রের চর্চা করিয়াও আমার মৃত্যুভয় অপগত হয় নাই, ন্যায়দর্শন আমার ভয়ার্ত হৃদয়ের কম্পন থামাইতে পারে নাই। তাই, আজ হইতে আমি এই ন্যায়দর্শন পরিত্যাগ করিলাম। ভিতরে ভিতরে অনেক রক্ত ঝরাইয়া আমি বেদান্তকেই বরণ করিয়া লইলাম… কিন্তু আমি আপনার নিকট সত্য গোপন করিয়াছি, মিথ্যাচার করিয়াছি—আমার সেই পাপের কী হইবে? কোনো উপায় নাই?” 

রামতীর্থ হাসিয়া বলিলেন, “আছে। সর্বপাপের প্রায়শ্চিত্ত হইল সন্ন্যাস। তুমি সন্ন্যাস গ্রহণ করো। এখন তোমার মন প্ৰস্তুত হইয়াছে।” 

—কে আমাকে সন্ন্যাস দিবে? তবে আপনিই আমাকে সন্ন্যাসাশ্রমে দীক্ষিত করুন। 

—না, তাহা হইবে না। তাহা হইলে তোমার পরীক্ষা হইবে না। তোমাকে পূর্বেই মাধব সরস্বতীর নিকট মীমাংসাশাস্ত্র উত্তমরূপে অধ্যয়ন করিবার নিমিত্ত পাঠাইয়াছিলাম। এক্ষণে সেই একই মঠের মণ্ডলেশ্বর বিশ্বেশ্বর সরস্বতীর নিকট সন্ন্যাস প্রার্থনা করিতে বলিব। তিনি এই বারাণসীরই চৌষট্টি ঘাটে থাকেন। তুমি তাঁহার নিকট যাও। 

পরদিন চৌষট্টি যোগিনীর ঘাট নামক বারাণসীর প্রখ্যাত ঘাটে উপস্থিত হইয়া লোকজনের নিকট জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া কমলনয়ন অনতিদূরে বিশ্বেশ্বর সরস্বতী যে- মঠে অবস্থান করিতেছেন, তাহা খুঁজিয়া পাইল। প্রভাত মধ্যাহ্নের দিকে যাইতেছে, অলিন্দে ভূতলের উপর পার্শ্ববর্তী স্তম্ভ সমূহের ছায়া ক্ষুদ্র হইয়া আসিয়াছে। শৈবালমলিন ছাদের উপর কয়েকটি গৈরিক কাষায় রৌদ্রে শুষ্ক হইতেছে। আলিশায় একটি ঘুঘুপাখি ঘুৎকারধ্বনিতে মধ্যাহ্নের নৈঃশব্দ্য গাঢ়তর করিয়া তুলিতেছে। দ্বিতলের অলিন্দের বহু কক্ষ অতিক্রম করিয়া কমলনয়ন এক অনতিপরিসর কক্ষে বিশ্বেশ্বর সরস্বতী সকাশে উপস্থিত হইল। বিশ্বেশ্বর সরস্বতী স্থূলবপু, ক্রোড়ের উপর কী একখানা পুথি খুলিয়া অখণ্ড মনোযোগ সহকারে লিখিতেছেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিবার পর বিশ্বেশ্বর চোখ তুলিয়া চাহিলেন। প্রসন্নগম্ভীর বদন, দিবাভাগের উত্তাপে সামান্য ঘর্মাক্ত হইয়াছেন। চরণে দণ্ডবৎ পতিত হইয়া কমলনয়ন স্বীয় অভিপ্রায় জ্ঞাপন করিল। 

বিশ্বেশ্বর কমলনয়নের পরিচয় পাইয়া হৃষ্টচিত্তে বলিলেন, “তোমার কথা পূর্বেই আমি মাধব সরস্বতীর নিকট শুনিয়াছি। সন্ন্যাস লইবার শুভবাসনা হৃদয়ে জাগরিত হইয়াছে, ইহা জগৎপিতা বিশ্বানাথের বিশেষ অনুগ্রহ! সংসারকে নিঃসার জানিয়া, সারবস্তু কী, তাহারই অনুসন্ধানে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ না করিয়া পরবৈরাগ্য আশ্রয় 

করিয়া প্রব্রজিত হইতে চাও— ইহা তো অতি ভাগ্যের কথা—কুলং কুলং পবিত্রং জননী কৃতার্থা! তবে ওই যে তুমি পাপ, প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাকার কী যেন বলিতেছ, উহা আমরা ভালো বুঝি না। সন্ন্যাস হইবে বই-কি বাবা, নিশ্চয় হইবে। আমিই তোমাকে সন্ন্যাসদীক্ষা দিব, কিন্তু—” 

— কিন্তু? 

—কিন্তু আমি যে একবার তীর্থদর্শনমানসে যাইব স্থির করিয়াছিলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই বাহির হইয়া পড়িব, ভাবিয়াছি। ইহার মধ্যে সন্ন্যাসদীক্ষাদানের অবসর পাইব কি? এক কাজ করো, তুমি কিছুদিন অপেক্ষা করো। আমি তীর্থদর্শন সারিয়া ফিরিয়া আসি। তখন ঈশ্বরকৃপায় সকলই সাধিত হইয়া যাইবে 

—ইত্যবসরে আমি কী করিব, যদি বলিয়া যান…. 

—মনকে শান্ত করিবে। আর মন শান্ত করিবার প্রধান উপায় হইল স্বাধ্যায়। তুমি শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার উপর একটি সুন্দর টীকা প্রস্তুত করো না কেন? যাহাতে জ্ঞান ও ভক্তির ভিতর সার্থক সমন্বয় হইবে। উহা রচনা করিয়া রাখো। আমি ফিরিয়া আসিয়া দেখিব। সময় হইলেই সব হইবে। নিরাশ হইও না, কেমন? 

বিশ্বেশ্বর সরস্বতীর আশ্রম হইতে দ্বিপ্রহর বেলায় ফিরিয়া আসিয়া রামতীর্থচরণে কমলনয়ন সকলই নিবেদন করিল। রামতীর্থ সব শুনিয়া বড়োই খুশি হইলেন। বলিলেন, “আমার নিকট হইতে তুমি শাংকরভাষ্য, আনন্দগিরির টীকা ও শংকরানন্দের টীকা লইয়া যাও। এসকল ভাষ্য ও টীকাগ্রন্থ তোমার এই নূতন টীকাটির প্রণয়নে বিশেষ সহায়ক হইবে। আজ হইতেই রচনা আরম্ভ করো।” 

গুরুর আশীর্বাদ লইয়া ফিরিতে ফিরিতে কমলনয়নের হৃদয়ের ভিতর কত কথা যেন উঠিয়া আসিতে লাগিল… সেই স্বর্ণপ্রসূ শৈশব… সেই নদীতীর…. সেই শান্ত প্রকৃতি। কত কাল পর আবার লিখিতে হইবে। কিন্তু কবিতা নহে, কল্পনা নহে, দর্শনশাস্ত্রের শিরোমণি শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার তত্ত্বগম্ভীর টীকা। আচ্ছা, উহা যদি কবিতা দিয়াই আরম্ভ করা যায়? কেমন হইবে? নূতন কিছু নহে?… কোথা হইতে মধ্যদিনের আকাশ ব্যাপিয়া একটা দুরাগত পাখির ডাক তাহাকে আনমনা করিয়া দিতেছে… কে যেন তাহাকে ডাকিতেছে… সুদূর হইতে… 

বৈকাল হইয়া গেল, গঙ্গার সজল বাতাস বারাণসী নগরীর দেহলিদেবালয় স্পর্শ করিয়া কমলনয়নের অতি ক্ষুদ্র কক্ষের ভিতর প্রবেশ করিতেছে। ঘরে ধূপের গন্ধ ঘুরিতেছে। সদ্যোপ্রস্তুত তুলট কাগজে নির্মিত নূতন পুথির ঘ্রাণ। লেখনী মসীপাত্রে ডুবাইয়া লইয়া কমলনয়ন পুথির উপর টানিয়া টানিয়া লিখিতে লাগিল … 

ওঁ নমো নারায়ণায়। 

ভগবৎপাদভাষ্যার্থমালোচ্যাতিপ্রযত্নতঃ। প্রায়ঃ প্রত্যক্ষরং কুর্ব্বে গীতাগূঢ়ার্থদীপিকাম্‌।… 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *