বত্রিশ
বৈকালবেলায় কমলনয়ন নদীর তীরে বসিয়াছিল—ঝড়টা তখনই আসিল।
প্রথমে নদীর পরপারে আকাশের গায়ে এক খণ্ড জলভরা কালো মেঘ, কিছুক্ষণের মধ্যে কোথাও কিছু নাই, সহসা সেই মেঘ বিপুলাকার ধারণ করিয়া সমস্ত আকাশপট ছাইয়া ফেলিল। নদীর সলীল ঊর্মিমালা সিকতাভূমি অতিক্রম করিবার প্রয়াস করিতে লাগিল। তাহার উপর তাম্রাভ আকাশে মেঘের ভিতরে সুগম্ভীর মেঘ; মেঘের দ্বারা মেঘলোক আবৃত। বাতাস দ্রুতবেগে বহিতেছিল, মেঘনিহিত সৌদামিনী তাহার লোলজিহ্বা দ্বারা মসীকৃষ্ণ গগনপটকে ক্ষণে ক্ষণে লেহন করিতেছিল। ঝড় আসিতে পারে ভাবিয়া কমলনয়ন উঠিয়া দাঁড়াইল। তখনই প্রচণ্ড বেগে বায়ু স্বনিত হইতে লাগিল, ঊর্ধ্বাঙ্গের উত্তরীয়খানি সবেগে আলোড়িত হইতেছিল। কিয়ৎপরেই নদীতীরে বনভূমি আকুল হইয়া উঠিল, ঊর্ধ্ববাহু বনস্পতিসমূহ এ উহার গাত্রে আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল। কড়-কড়-কড়াৎ শব্দে নভোমণ্ডল পাণ্ডুর করিয়া বিকট নিনাদে বজ্রপাত হইল। বাত্যাবেগে উৎক্ষিপ্ত বনরাজির ভিতর দিয়া কমলনয়ন গৃহে ফিরিবার ব্যর্থ প্রয়াস করিতে লাগিল।
বিদ্যুতের চকিত শিখায় পথ দেখা যায় না, কখনো কখনো সম্মুখে প্রস্তরের স্তূপ মহিষাসুরের মুণ্ডের ন্যায় পথ অবরোধ করিয়া থাকে। কোথা হইতে খড়, কুটা, পাতা প্রচণ্ড প্রভঞ্জনে চক্ষের উপর উড়িয়া আসিয়া পড়ে। পথ যাহা ছিল পদচিহ্নরেখায় নির্মিত, তাহাও এই মসীকৃষ্ণ অন্ধকারে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। বৃক্ষসমূহ এমন দুরন্ত বেগে আন্দোলিত হইতেছে যে, যে-কোনো মুহূর্তে শিরোপরি বৃহৎ শাখা ভাঙিয়া পড়িতে পারে। বিদ্যুতের কশা একমুহূর্তে আকাশটা এদিক হইতে ওদিক পর্যন্ত ফাঁড়িয়া চলিয়া যাইতেছে, পরমুহূর্তেই ঘোর অন্ধকার। কী করিবে, কোথা যাইবে কমলনয়ন কিছুই বুঝিতে পারিতেছিল না।
এমন সময়ে সুদূর হইতে যেন লক্ষকোটি অশ্বক্ষুরের ধাবনশব্দ বায়ুস্তর আলোড়িত করিয়া দিল। বুঝিতে বিলম্ব হইল না, বৃষ্টি আসিতেছে। এক মুহূর্ত পরেই বড়ো বড়ো ফোঁটায় বল্লমের ফলার মতো বৃষ্টি নামিয়া আসিল। সঙ্গে সঙ্গে সিক্তা ধরিত্রীর সেই আদিম ঘ্রাণ! কখনও বৃক্ষের পত্রসম্ভারে বারিধারা প্রতিহত হয়, কখনও বায়ুবেগে শাখাস্তর চালিত হওয়ায় বরিষণধারা পৃথিবীর উপর নামিয়া আসে। মনে হইল, আকাশটা যেন ফাটিয়া পড়িতেছে। এই আরণ্যক মাতামাতির ভিতর বৃষ্টি হইতে বাঁচিবার অভিপ্রায়ে কমলনয়ন এক সুবৃহৎ বনস্পতির নিম্নে আশ্রয় লইল। দেখিল, বৃক্ষের আর্দ্র জটাভার অশনির সঘন নিঃশ্বাসে ভয়াবহভাবে কম্পিত হইতেছে। যে- কোনো মুহূর্তে ভাঙিয়া পড়িতে পারে।
কড়-কড়-কড়াৎ। আবার বিদ্যুতের নীলশিখা মুহূর্তে বনের উপরিভাগ আলো করিয়া নিভিয়া গেল। বজ্রপতনের প্রচণ্ড শব্দ কর্ণপটহ যেন ভেদ করিয়া যাইতেছে।
মরিয়া হইয়া কমলনয়ন বৃক্ষতল পরিত্যাগ করিয়া যেইদিকে পথ পায়, সেইদিকেই হাঁটিয়া চলিতে লাগিল। কোথা যাইতেছে, কোনো ঠিক নাই। পরিধেয় বস্ত্র, গাত্রাবরণ সমস্ত ভিজিয়া গিয়াছে। সেদিকে তাহার ভ্রুক্ষেপ নাই, যেভাবে হউক এ বনভূমি হইতে বাহির হইতে হইবে। বারংবার বৃক্ষসমূহের নিম্নবর্তী শাখা গায়ের উপর আসিয়া পড়িতেছে। কোনোমতে তাহাদের আঘাত হইতে বাঁচিয়া চলিবার চেষ্টা করিতেছে। এইরূপে কয়েক দণ্ড প্রাণপণ প্রয়াস করিবার পর বনভূমির একপ্রান্তে অন্ধকারের ভিতর জড়ীভূত কী যেন উত্তুঙ্গ হইয়া আছে সে দেখিতে পাইল।
একটা প্রকাণ্ড মন্দির! গ্রামের প্রান্তে এরূপ মন্দির যে আছে, কমলনয়ন আবাল্য তাহা দেখে নাই। এখানে মন্দির কোথা হইতে আসিল? সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত দেবালয়— তাহাতে কত যুগ পূর্বে যেন পূজা পরিত্যক্ত হইয়া গিয়াছে। উহার শিখরদেশ, আমলক ও কলসের উপর অবিশ্রান্ত বারিপাত হইতেছে। মন্দিরের চারিপার্শ্বে অযত্নবর্ধিত জঙ্গল এবং সোপানসমূহ শৈবালে আচ্ছন্ন, চলিতে গেলে পদে পদে বাধা লাগে। সম্মুখে বৃহৎ অর্ধমণ্ডপ পার হইয়া কমলনয়ন সিক্ত বস্ত্রে আধো-অন্ধকারে আচ্ছন্ন মণ্ডপে উঠিয়া আসিল। পুরোভাগে অন্তরাল ও গর্ভগৃহ স্তব্ধ হইয়া আছে। মণ্ডপের এক স্তম্ভ অবলম্বন করিয়া বসিয়া পড়িতেই কমলনয়ন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করিল তাহার পূর্বেই কে একজন ব্যক্তি তাহারই ন্যায় ঝটিকাবর্ষণ হইতে বাঁচিবার জন্য মন্দিরের মণ্ডপে আশ্রর লইয়াছে। সহসা এমন স্থানে কোনো ব্যক্তি কীভাবে আসিতে পারে? যাহাই হউক, সে মন্দিরটির স্তম্ভ, খিলান প্রভৃতি ভালো করিয়া লক্ষ করিতেছিল। তাহার মনে হইল, কেন জানি মনে হইল, এ মন্দির পাষাণ দ্বারা নির্মিত নহে… মন্দিরটি যেন শব্দ দিয়া গাঁথা। রাশি রাশি অক্ষর স্তূপাকৃতি হইয়া যেন এ মন্দিরের কুট্টিম, ছাদ, স্তম্ভ, অন্তরাল, বিমান নির্মাণ করিয়া রাখিয়াছে। স্তম্ভগুলি যতিচিহ্নের ন্যায় হেলিয়া পড়িয়াছে, অলংকরণসমূহ শব্দপুঞ্জের ন্যায় ঝুলিয়া রহিয়াছে, সোপানগুলি কবিতার স্তবকের ন্যায় একে অপরের উপরে স্থাপিত হইয়া যেন শ্লোকাবলী রচনা করিয়াছে। কমলনয়ন মণ্ডপের পার্শ্বে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বসিয়া রহিল। বাহিরে বর্ষণসম্পাত অক্ষুণ্ণ আছে, এমতাবস্থায় অপর লোকটি কোথা হইতে আসিল, কৌতূহল প্রবল হইয়া উঠিতেছে। অপরিচিত ব্যক্তির সহিত আলাপ করিবার বাসনায় কমলনয়ন কণ্ঠে একপ্রকার শব্দ করিল, তাহাতে অপর লোকটি অণুমাত্রও আগ্রহ দেখাইল না। সে-ব্যক্তি যেমন বসিয়াছিল, তেমনই বসিয়া রহিল। অতঃপর কমলনয়ন লোকটির ঘনিষ্ঠ হইয়া মুখামুখি বসিল, তাহাতেও লোকটি দৃকপাত করিল না। অগত্যা কিছুক্ষণ পর কমলনয়ন ঝড়ের ঘোর শব্দের উপর গলা তুলিয়া বলিতে উদ্যত হইল, “মহাশয় কি এস্থানে…”
কিন্তু প্রশ্ন সম্পূর্ণ করিবার পূর্বেই অপর ব্যক্তি ওষ্ঠে অঙ্গুলি স্থাপন করিয়া ইঙ্গিতে বলিল, “চুপ, চুপ!”
কমলনয়ন চুপ করিয়া গেল। আরও কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইলে লোকটি স্বাভাবিক অপেক্ষা নিম্নতর স্বরে যেন কী এক গোপন কথা বলিবার ভঙ্গিমায় বলিয়া উঠিল, “চুপ! ঝড়ের শব্দের ভিতর তিনি সুরের আলাপ করিতেছেন।”
কে সুরের আলাপ করিতেছে? এই ঝড় কাহার আবার সুর? এ লোক কী বলিতেছে, কিছুই বুঝা গেল না। খানিক পরে লোকটি আবার বলিল, এবার স্পষ্টতর শব্দ, “কথা কহিও না। কথা কহিলে সুর থামিয়া যাইবে।”
লোকটি কি উন্মাদ? তাহার কথার ভিতর কীসের যেন একটা আচ্ছন্নতা, কী একটা আবেশ প্রকাশিত হইতেছে।
লোকটি পুনরায় বলিল, “শুনিতে পাইতেছ? মেঘমল্লার রাগ? এমন আশ্চর্য আলাপ, এমন অভূতপূর্ব বিস্তার!”
কমলনয়ন এইবার লোকটির বারণ সত্ত্বেও প্রশ্ন করিল, “আপনি কে? এখানে কী করিতেছেন?”
“আমি এক ব্যর্থ গায়ক উৎপলদৃষ্টি। ন্যায় ও বেদান্তের বিপুল দ্বন্দ্ব মিটাইবার জন্য আমি সুরের আশ্রয় লইয়াছি।”
কমলনয়ন অবাক হইয়া গেল। ন্যায়দর্শন ও বেদান্তদর্শনের দ্বন্দ্ব? সে নিজেও বহুকাল এই দ্বন্দ্বে মথিত হইয়াছিল বটে! সে যে কতকাল আগের কথা! কিন্তু সে- দ্বন্দ্বের সমাধান সংগীতের ভিতর আছে নাকি?
লোকটি আত্মগতভাবে বলিতে লাগিল, “আমি এই গ্রামেই জন্মিয়াছিলাম। কৃতবিদ্য হইয়া কাশী যাই। সেখানে ন্যায় ও বেদান্তের দ্বন্দ্বের ভিতর পড়িয়া যাই।”
বাহিরে সজোরে বজ্রপাত হইল। বিদ্যুতের প্রখর আলোতে মন্দিরের অভ্যন্তরভাগ চকিতে উদ্ভাসিত হইয়া গেল। তাহার পর আবার প্রগাঢ় অন্ধকার। সেই মসীকৃষ্ণ তমসার ভিতর বসিয়া কমলনয়ন অনুভব করিল, লোকটি সঘন শ্বাস লইতে লইতে সম্মুখে পশ্চাতে আন্দোলিত হইতেছে। এ ব্যক্তি কি সত্যই উন্মাদ? কিন্তু তাহার কথাগুলি তো উন্মাদের মতো মনে হইতেছে না। প্রতিটি কথার একটা গূঢ় অর্থ আছে।
কিছুক্ষণ পর লোকটি স্থির হইল। আবার কী যেন কান খাড়া করিয়া শুনিতেছে। সহসা সোল্লাসে বলিয়া উঠিল, “তিনি ওই বাঁশি বাজাইতেছেন!”
কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “কে?”
লোকটি মস্তক অবনত করিয়া কহিল, “আমার মুর্শিদ এনায়েৎ খাঁ সাহেব। আমার সংগীতগুরু।”
কমলনয়নের আচম্বিতে মনে পড়িল, হরিশচন্দ্র ঘাটে নাগা সন্ন্যাসীরা যেসব নিরীহ ব্যক্তিদের নির্বিচারে হত্যা করিয়াছিল, তাহাদের একজনের নাম এনায়েৎ খাঁ ছিল বটে! নিহত হইবার পূর্বে তিনি ঘাটে বসিয়া বাঁশি বাজাইতেছিলেন, শুনিয়াছিল। এ ব্যক্তি কি সেই এনায়েৎ খাঁর কথাই বলিতেছে? এ কেমন করিয়া তাঁহার কথা জানিল?
“খাঁচা ভাঙিয়া গিয়াছে। পাখি তাই খাঁচা হইতে মুক্ত হইয়া চরাচরে বাতাসে মিশিয়া গিয়াছে। ওই শুন, তিনি বাঁশিতে মেঘমল্লার বাজাইতেছেন!” লোকটি অকস্মাৎ এই কথা বলিল।
কমলনয়ন কথাগুলি বুঝিবার চেষ্টা করিতেছিল। উহাদের একটা নিশ্চিত অর্থ আছে। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকিয়া কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “আপনি কি সেই সুরালাপ শুনিতেই এখানে আসিয়াছেন?”
“হাঁ, অবশ্যই। আমারই অনেক অনুরোধে তিনি যে পুনরায় বাঁশি তুলিয়া লইয়াছিলেন। সরযুবাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি তো বাঁশি ছাড়িয়া দিয়াছিলেন।”
“কিন্তু এখানে কেন?”
“তিনি যে বলিয়াছিলেন, তাঁহার মৃত্যুর পর তিনি আমার গ্রামের বাতাসের সঙ্গে মিশিয়া থাকিবেন। আমাকে সুরের শিক্ষা দিবেন। আমি যে তাঁহার প্রিয়তম শিষ্য ছিলাম।”
লোকটি এত কথা বলিল, কিন্তু একবারও কমলনয়নের পরিচয় জানিতে চাহিল না, ইহাও আশ্চর্য বটে। বাহিরে আঝোরধারায় বৃষ্টি পড়িতেছে। সেই বরিষনমুখরিত সন্ধ্যায় অজ্ঞাত রহস্যময় মন্দিরে আরও রহস্যময় এক সুরোন্মাদ ব্যক্তির সম্মুখে অন্ধকারে বসিয়া থাকিতে থাকিতে মনে হইল, সে যদি সব ছাড়িয়া সুরের সাধনা করিত, তবে কেমন হইত? সেও কি এইরূপ সংগীতের মেহফিল হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়া এমন উন্মাদ হইয়া যাইত?
সজল বাতাস মন্দিরের ভিতর ভাসিয়া আসিতেছে। কমলনয়নের বসন সিক্ত হইয়া আছে, বাতাসের শীতল স্পর্শ পাইয়া সে ভিতরে ভিতরে কাঁপিতেছিল। কখন যে এ ঝড়বৃষ্টি থামিবে!
সহসা একেবারে মন্দিরের সমীপে কোথাও ঘোররবে বজ্রপাত হইল। প্রথমে প্রখর নীল দীপ্তিতে মন্দির চকিতে উদ্ভাসিত হইয়া গেল। তাহার পর প্রচণ্ড শব্দে বজ্রনির্ঘোষ যেন মন্দিরের অধিষ্ঠানকে কাঁপাইয়া দিয়া গেল।
সেই অস্বাচ্ছন্দ্যকর বিদ্যুৎশিখায় কমলনয়ন দেখিল, মণ্ডপে আর কেহ নাই— সে একাই বসিয়া আছে।
সেই ব্যক্তি সহসাই কোন্ ইন্দ্রজালে মিলাইয়া গেল? ইহা কি কোনো অশরীরী আবির্ভাব? ভাবিতে ভাবিতে কমলনয়ন আড়ষ্ট হইয়া গেল।
বৃষ্টি ঈষৎ ধরিয়াছে, যদিও বজ্রপাত ও ধারাসম্পাতের সম্পূর্ণ বিরাম নাই। কমলনয়ন ভাবিতেছিল, কখন গৃহে ফিরিবে। কৃষ্ণকিশোরকে ভোগ দেওয়া হয় নাই। এখান হইতে কোন্ দিকেই বা বাড়ি ফিরিবার পথ?
বসিয়া থাকিতে থাকিতে তন্দ্ৰামতো আসিয়াছিল, হঠাৎ কাহাদের আলাপশব্দে চেতনা ফিরিয়া আসিল। তড়িতের চকিত প্রকাশে কমলনয়ন দেখিল, মন্দিরের দ্বারপথ দিয়া দুইজন ব্যক্তি কী বিষয়ে উত্তেজিত স্বরে আলাপ করিতে করিতে প্রবেশ করিতেছে।
“তাই বলিয়া ভগবদ্পাদপদ্ম ছাড়িয়া লৌকিক বিষয় লইয়া কাব্যচর্চা করা? ইহাই কি জীবনের কৃতকৃতার্থতা?” প্রথমজন বলিল।
“কে জীবনের কী অর্থ বুঝিয়াছে, তাহার উপরেই কৃতকৃতার্থতার বিচার হইতে পারে,” দ্বিতীয়জন উত্তর দিল।
এইসব কথা বলিতে বলিতে তাহারা কমলনয়নের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। অথচ কী আশ্চর্য। তাহারা কমলনয়নকে দেখিতেও পাইল না। বিদ্যুৎ চমকিত হইতেছে। তাহার আলোকে কমলনয়নকে দেখিয়া ফেলা অতি সহজ। তথাপি, ইহারা যে কমলনয়নকে লক্ষই করিতেছে না, ইহা তো সত্যই বিস্ময়াবহ!
কমলনয়ন যে-স্তম্ভে হেলান দিয়া বসিয়াছিল, উহারা তাহারই বিপরীত স্তম্ভ অবলম্বন করিয়া বসিল। ইহারাও বুঝি ধারাসম্পাত হইতে বাঁচিবার জন্য এই মন্দির আশ্রয় করিয়াছে।
প্রথম জন এইবার ভালো করিয়া বসিয়া দ্বিতীয় জনকে বলিল, “আমাদের তর্কটার একটা মীমাংসা করা হউক। মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য কী? কাব্যচর্চা, নাকি ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তিলাভ?”
দ্বিতীয় জন বলিল, “কে আপনাকে বলিয়াছে যে, কাব্যচর্চার ভিতর দিয়া ভক্তিলাভ হয় না?”
“হাঃ- এই মানবিক প্রণয়ের কাব্যরচনা করিয়া?”
“প্রথমত, প্রণয় যদি বিশুদ্ধ হয়, তবে তাহাতে ইহা মানবিক, উহা ঐশ্বরিক ইত্যাকার ভেদ লুপ্ত হইয়া যায়।”
“আর দ্বিতীয়ত?”
“দ্বিতীয়ত, যে-কোনো মহৎ ভাবনাই চিরকাল কবিতা হইয়া উঠিয়াছে। উপনিষদ কি মহত্তম কাব্যবস্তু নহে?”
“তথাপি, জপ-ধ্যান, সাধন-ভজন প্রভৃতি যেমন একটা ঈশ্বরলাভের দীর্ঘসেবিত ঐতিহ্যবাহী পন্থা, কাব্যচর্চা তো সেরূপ নহে।”
“যদি আপনার কথা মানিয়াও লই, তথাপি ইহা তো একটা নবীন মার্গ হইতে পারে! কবিতার ভিতর দিয়া পরমের ভিতর বিলীন হওয়া। হইতে পারে না?”
“কিন্তু কবিতা কি কোনো পরম সত্যে উপনীত হইতে চাহে?”
“অবশ্যই হইতে চাহে। হয়তো পারে না। আর সেই না-পারার বেদনার ভিতর দিয়াই কবির মনোলোক বিরহব্যাকুলতায় তন্ময় হইয়া যায়।”
প্রথম জন বলিল, “বেশ। কিন্তু তুমি আমাকে বলো, তুমি যদি রাজার অনুগ্রহ না পাইতে তবে কি কবি হইতে?”
“নিশ্চয় হইতাম। কেবল রাজসভার কবিই কি আর কবি? কবি সেই—যাহার অন্তরে কবিতা প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে। তাদৃশ ব্যক্তি এক পক্তি কবিতা না লিখিলেও কবি। তবে রাজসভায় সুযোগ না পাইলে আমি হয়তো আপনার ন্যায় গৌরাঙ্গ পদাশ্রয় করিতাম। ভক্ত হইতাম।”
এই কথা শুনিবামাত্র কমলনয়ন একেবারে উৎকর্ণ হইয়া বসিল। ইহারা কাহারা?
প্রথম জন বলিল, “তাহা হইলে ইহা তো প্রমাণিত হইল, তোমার জীবন অসম্পূর্ণ থাকিয়া গিয়াছে।”
“না, আমি তাহা মনে করি না। জীবনের এক স্তরে বাধা পাইলে আর-একটা নূতন অভিজ্ঞতার স্তর খুলিয়া যায়, এই মাত্র। কিন্তু তাই বলিয়া পরবর্তী অভিজ্ঞতাটি পূর্ববর্তী অপেক্ষা উন্নততর—ইহা কিছুতেই প্রমাণিত হয় না।”
প্রথম জন বলিল, “ভালো বুঝিলাম না।”
দ্বিতীয় জন বলিল, “বুঝাইতেছি। এই ধরুন, আপনি নবদ্বীপে উপনীত হইয়া যদি দেখিতেন, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য নবদ্বীপে নাই, পুরী চলিয়া গিয়াছেন, তাহা হইলে কী হইত বলুন তো?”
“কী হইত?”
“আপনি হয়তো ন্যায়শাস্ত্রের চর্চা করিতেন।”
“তাহার পর?”
“হয়তো আপনার গুরু আপনাকে আদেশ করিতেন, কাশী যাও। সেখানে বেদান্ত শিক্ষা করিয়া বেদান্তকে ন্যায়ের যুক্তি দিয়া কাটিয়া ফেল।”
“তাহার পর?”
“কী তাহার পর? তাহার পর কাশীতে বেদান্ত শিক্ষা করিতে গিয়া আপনার মত পরিবর্তন হইতে পারিত। বেদান্ত পড়িতে পড়িতে আপনি স্বয়ং বেদান্তী হইয়া যাইতে পারিতেন। হয়তো সন্ন্যাস লইতেন।”
“বেশ। ইহা হইতে তুমি কী সিদ্ধান্তে আসিতে চাহিতেছ?”
“বলিতে চাহিতেছি, তাহা হইলেও আপনি যে অধিকতর উন্নত আদর্শের সন্ধান পাইতেন, তাহা নহে। কিংবা সন্ন্যাসী না হইয়া এই যে আপনি শ্রীচৈতন্যের ভক্ত হইয়াছেন, ইহাতে আপনার জীবন অসম্পূর্ণ হইয়া থাকিয়া যায় নাই। কী ভাবিতেছেন?”
“ভাবিতেছি, আমি সন্ন্যাসী হইলে কেমন হইত?”
দ্বিতীয় জন বলিল, “কেমন আর হইত? আপনি আর আপনি হইতেন না। অন্য কেউ হইয়া যাইতেন।
“কে অন্য কেউ?”
“এই ধরুন, এখন আপনার নাম রাজীবলোচন, তখন আপনার নাম হইত কমলনয়ন!”
প্রথম জন বলিল, “তা তুমি এত কথা কেমন করিয়া জানিলে বলো তো, পদ্মাক্ষ?”
দ্বিতীয় জন বলিল, “আমি জানি। কারণ, আমি কবি।”
পুনরায় আরও নিকটে ঘোররবে বজ্রপাত হইল। চারিদিক ধোঁয়া ধোঁয়া হইয়া গিয়াছে। সমস্ত মন্দির যেন চুরমার হইয়া যাইতেছে। শব্দনির্মিত মায়াকুহক খসিয়া পড়িতেছে। অন্ধকার আর আলোক এক হইয়া গিয়াছে। মাথার উপর হইতে অলংকৃত খিলান বিকট নিনাদে খসিয়া পড়িতেছে…
কমলনয়নের একবার মনে হইল, সে আর বাঁচিয়া নাই। পরমুহূর্তে সংজ্ঞা পাইয়া দেখিল, সে বনভূমির বাহিরে নিরর্থক দাঁড়াইয়া আছে। সেই মন্দির, সেই আলাপরত ব্যক্তিদ্বয় সকলই কোন্ মায়াবী ঐন্দ্রজালিকের ইন্দ্রজালমায়ায় অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে।
এই তো চিরপরিচিত সেই পথ। এই পথ ধরিয়াই তো কতদিন সে গৃহে ফিরিয়াছে। এতক্ষণ সে তবে কোথায় ছিল? কাহারা এতক্ষণ কথা বলিতেছিল? কীরূপে তাহারা এস্থানে আসিয়াছিল? কোথায় বা চলিয়া গেল? বিস্ময়ে হতবাক হইয়া কমলনয়ন পথের উপর দাঁড়াইয়া রহিল। সেই স্তম্ভিত দশায় তাহার নিজের ভিতর হইতেই এইবার কে যেন সুমুধুর স্বরে কথা কহিয়া উঠিল :
“কমল! ও কমল! আমি যাহা দেখি, তুমি তাহা দেখ?”
“কী দেখিব?”
“বলো তো কোথায় কুমারীর অস্পষ্ট সিঁথির ন্যায় একটা পথ জ্যোৎস্নাজলে মাখামাখি হইয়া পড়িয়া আছে?”
“কোথায় আবার? এই যে আমার পায়ের পাতার নীচে!”
“তবে ওই পথ বাহিয়া ঘরে ফিরিয়া আইস। আমার ক্ষুধা লাগিয়াছে…
কমল! তুমি এত অবাক হইয়া গিয়াছ কেন?”
“কী আশ্চর্য মায়া দিয়া গড়া তোমার এ সৃষ্টি, কিশোর! অবাক না হইলে আর আনন্দ কোথায়? এই আশ্চর্য বিস্ময়—পরমা প্রজ্ঞা অপেক্ষাও যে মহত্তর।”
“এতক্ষণ তবে কী দেখিলে?”
“দেখিলাম, জীবনে আমি কী কী হইতে পারিতাম…”
“কী বুঝিলে?”
“বুঝিলাম, আমার কিছুই হওয়া হইল না।”
“ভাগ্যিস তুমি কিছুই হও নাই। কিছু না-হওয়াই সবথেকে বড়ো হওয়া। কিছু হইলে আমি তো তোমাকে আর পাইতাম না। কমল! ও কমল! কিছু হও নাই— ভালোই হইয়াছে। কিছু হও নাই বলিয়াই তোমাকে আমি আমার করিয়া পাইয়াছি।”
.
ঝড় থামিয়া গিয়াছে। মেঘ কাটিয়া আকাশে চাঁদ বাহির হইয়া আসিয়াছে। পথ, ঘাট, বনভূমি, পুষ্করিণী—বর্ষণধৌত নিখিল ছায়াচরাচর মেঘনিমুক্ত আকাশের চন্দ্রালোকে ভাসিয়া যাইতেছে।
***
অন্তিমে কমলনয়ন বা মধুসূদন সরস্বতী উত্তরকাশীতে অবস্থান করিতেছিলেন। সময় আসিল, তিনি মহাসমাধিতে প্রবেশ করিলেন। প্রপঞ্চ বিলীন হইয়া গেল। মধুসূদন স্বস্বরূপে স্থিত হইলেন।
মধুসূদন তাঁহার শিষ্যদের কাহাকেও তাঁহার জীবনচরিত লিপিবদ্ধ করিতে বলেন নাই। তাঁহার কোনো মূর্তি বা চিত্র রচিত হয় নাই। তিনি তাঁহার মনোভাব শিষ্যদের ভিতরেও সঞ্চারিত করিতে পারিয়াছিলেন। শিষ্যরা কেহ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়াও তাঁহার জীবনচরিত রচনা করেন নাই। কেবল তাঁহার প্রবল প্রজ্ঞা ও খরশান মনীষার প্রমাণস্বরূপ তাঁহার রচিত গ্রন্থগুলি আজিও গবেষক ও বিদ্যার্থিদিগের গভীর আগ্রহের বিষয় হইয়া রহিয়াছে।
অন্যদিকে কৃষ্ণকিশোরের প্রতি তাঁহার তন্নিষ্ঠ প্রেম প্রবাদপ্রতিম হইয়া রহিয়াছে। এই প্রেমাভক্তি তাঁহার অনুসারী সরস্বতী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের জ্ঞান ও ভক্তিসাধনায় যুগপৎ প্রবৃত্ত করিয়াছে।
সময় শুধু তাঁহার বিষয়ে কতগুলি উপাখ্যান কুড়াইয়া রাখিয়াছে। সেই উপকথাগুলির গাত্রে কালের চিহ্ন লাগিয়া আছে। ওই উপাখ্যানগুলিকে জোড়া লাগাইলে যে ছবি ফুটিয়া উঠে, এক অর্থে তাহা কেবল কমলনয়ন বা মধুসূদনের জীবনকথা নহে, উহা আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনকথা। আমরা যাহা যাহা হইতে পারিতাম, যাহা যাহা আমাদের হইয়া উঠা হইল না, যাহা যাহা না-হইয়াই আমরা ঠিক যাহা, তাহাই হইয়া উঠিয়াছি, সেই অসমাপ্ত জীবনখণ্ডগুলি সংকলিত হইয়াই এই আশ্চর্য জীবনের উপাখ্যানমঞ্জরী রচিত হইয়াছে।
.
উপাদান
১. অদ্বৈতসিদ্ধিঃ/ মধুসুদন সরস্বতী/ ভূমিকা, ১ম ও ২য় খণ্ড/ শ্রীযোগেন্দ্রনাথ তর্কসাংখ্যবেদান্ততীর্থ ও শ্রীরাজেন্দ্রনাথ ঘোষ / প্রকাশক শ্রীক্ষেত্রপাল ঘোষ, ৬, পার্শিবাগান লেন, কলিকাতা; ১৯৩১
২. বৃহৎ বঙ্গ/১ম ও ২য় খণ্ড /দীনেশচন্দ্র সেন / দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা- ৭৩/১ম প্রকাশ, ১৯৩৫/চতুর্থ সংস্করণ, এপ্রিল ২০১৬।
৩. নদিয়ার ইতিহাস/১ম পর্ব/কমল চৌধুরী/ দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩/২য় মুদ্রণ, এপ্রিল, ২০১৫
৪. “শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত/কৃষ্ণদাস কবিরাজ /প্রকাশক শ্রীরামদেব মিশ্র, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ/২য় সংস্করণ, ১৩২২ বঙ্গাব্দ।
৫. চৈতন্যদেব, যুগল ভজনা ও পাঁচসিকার বোষ্টমী / সোমব্রত সরকার/খড়ি প্রকাশনী, হাওড়া/ ১ম প্রকাশ, ২০১৮।
৬. Outlines of Indian Philosophy/ M Hiriyanna/ Motilal Banarasidass, Delhi, 1933
৭. A Critical Survey of Indian Philosophy/ Chandradhar Sharma/ Motilal Banarasidass, Delhi, 2003
৮. ব্যাপ্তি পঞ্চক/শ্রীরাজেন্দ্রনাথ ঘোষ / লোটাস লাইব্রেরি, কলকাতা, ১৩২২ বঙ্গাব্দ
৯. পত্রাবলী/ স্বামী বিবেকানন্দ/উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা/ ৩য় সংস্করণ, মার্চ ১৯৬৪
১০. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও গূঢ়ার্থদীপিকা/মধুসূদন সরস্বতী/অনুবাদ ও ব্যাখ্যা–শ্রীভূতনাথ সপ্ততীর্থ / নবভারত পাবলিশার্স, কলিকাতা-৯, ১৯৮৬
১১. আকবর/রাহুল সাংকৃত্যায়ন/ অনুবাদ-আশরফ চৌধুরী/ চিরায়ত প্রকাশন, কল-৭৩/৩য় মুদ্রণ, ২০১৭
১২. যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ ১ম ও ২য় খণ্ড/ অনুবাদ— শ্রীচন্দ্রনাথ বসু / মহেশ লাইব্রেরি, কল-৯, ১৯৯৯
১৩. রামচরিতমানস/গোস্বামী তুলসীদাস/ অনুবাদ—সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত/খাদি প্রতিষ্ঠান, ১৫, কলেজ স্কোয়ার / প্রথম সংস্করণ, ১৩৪০ বঙ্গাব্দ
১৪. বৈরাগ্যশতক/রাজর্ষি ভর্তৃহরি/ অনুবাদ—- স্বামী ধীরেশানন্দ / উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা
১৫. বেদান্ত দর্শন— অদ্বৈতবাদ ১ম খণ্ড /শ্রীআশুতোষ শাস্ত্রী/ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়/ ২য় সংস্করণ, ১৯৬২
১৬. শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত / শ্ৰীম কথিত / উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা-৩, ২০০২
One of the masterpieces in Bengali literature.
অপূর্ব গ্রন্থ। সুলিখিত, নিরন্তর গতি। পড়ার ঠিক শেষেই এই কথাগুলি মনে হলো।
Opurbo grontho. Su likhito. Nirontor goti.