ছায়াচরাচর – ২৩

তেইশ 

অন্ধকারের ভিতর জোনাকির মতন এই ময়ূরাক্ষী পৃথিবী জ্বলিতেছে, নিভিতেছে। দীপাবলির রাত্রি। গঙ্গার ঘাটে প্রদীপের মালা; আর্দ্র বাতাসে তাহাদের শিখা কাঁপিতেছে। জলে কতজন পাতার দিয়া ভাসাইয়া গিয়াছে, স্রোতের উপর সেই একটুখানি আলো তাহার করুণ স্পর্শ রাখিয়া দুলিতে দুলিতে চলিয়াছে। অমাবস্যার তমসাবৃত আকাশ কার্তিকের কুয়াশায় ভিজিয়া উন্মুখ ধরিত্রীর উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে… আর সুপ্তা বালিকার ন্যায় দীপমালিকার সমুজ্জ্বল অলংকার পরিয়া গঙ্গা যেন শর্বরীর সেই নিগূঢ় বিতানকের নিম্নে হিমরাত্রির পর্যকে মাথা থুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে; এখন আর কোথাও কোনো শব্দ নাই। 

কমলনয়ন চৌষট্টি ঘাটের রানার উপর আসিয়া বসিল। মধ্যে মধ্যে সে এইখানে আসে। জীবনের প্রবহমান ঘটনাস্রোত হইতে নিজেকে ছাড়াইয়া লইয়া অন্ধকারে তন্নিষ্ঠ করে মন। একান্ত হইয়া প্রশ্ন করে, কী পাইয়াছি, কী পাই নাই, কোথায় চলিয়াছি, কোথা হইতে আসিতেছি। উত্তর নাই; বোবা রাত্রি নিথর হইয়া চোখ বুজিয়া থাকে, কথা কয় না। তবুও সে প্রশ্ন করে প্রকল্পিত শান্তির জন্য, অসমাপ্ত জীবনের নিমিত্ত। এই যে তাহার অকিঞ্চিৎকর জীবন, কে ইহার কথা জানিবে? কে মনে রাখিবে? তাহার সুখ-দুঃখ-রোদন-বেদন আবর্তমান পটচিত্রের ন্যায় মনোভূমিকার উপর ঘুরিয়া যায়, ইহাদের কোনো চিরত্ব নাই। সময় সকলই খাইয়া ফেলে, দৃশ্যমান জগতের কোনোকিছুই টিকিয়া থাকে না। শত শত বৎসর এই জীবননাট্যের অঙ্কগুলি ধুইয়া মুছিয়া লেপিয়া পুঁছিয়া একাকার করিয়া দেয়। 

কৈশোরে প্রেম আসিয়াছিল, চলিয়া গিয়াছে। যাহাকে সে দেখে নাই, যাহাকে সে ভালোবাসিয়াছিল, আর কখনও যাহাকে দেখিবে না—সেই তপ্তকাঞ্চনকায় গৌরসুন্দর তাহার মনোহরণ করিয়াছিলেন। তাহাকে সে না পাইয়া পুথির পাতায় কী যেন খুঁজিয়াছিল। ন্যায়শাস্ত্রের ফাঁকি তাহাকে ফাঁকে ফেলিয়া চলিয়া গেল। বেদান্ত তাহাকে সন্ন্যাসী করিয়াছে। তবু সেই কঠোর সন্ন্যাসের তিরস্করণীর ব্যবধান দিয়া কখন যেন একটা বাঁশির সুর গুপ্তঘাতকের ন্যায় তাহার হৃদয় বিদ্ধ করিয়া চলিয়া যায়। মনে হয়, সে তো ইন্দ্রের অতুল বৈভব পরিত্যাগ করিয়া অদ্বৈতসাম্রাজ্যের পন্থা বাহিয়া ধীর পদক্ষেপে চলিতেছে, তথাপি পথিমধ্যে কে এক প্রণয়ের দূত বারংবার আবির্ভূত হইয়া সব লণ্ডভণ্ড করিয়া দিতেছে, দস্যুতা করিয়া তাহার হৃদয়পুর লুঠ করিয়া লইয়া সেই আশ্চর্য মুরলীধরের চরণের দাসী করিয়া লইয়া যাইতেছে, তাহার যেন বাঁচিবার অন্য কোনো উপায় নাই। 

‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ গ্রন্থটি সে সমাপ্ত করিয়াছে। ইহার কঠোর যুক্তিজাল সে আজিকালি অধ্যাপনা করে। এইসব অন্ধকার রাত্রির গর্ভের ভিতর বসিয়া সংশয় আসে, কে তাহার এ গ্রন্থ মনে রাখিবে? শতাব্দী অতিক্রান্ত হইবার পর কেহ ইহা পড়িবে কি? অথবা, ইহা একটা নামমাত্র হইয়া বাঁচিয়া রহিবে? এত কঠিন বিতর্কবিন্যাস ভাবীকালের মানবকের উপযোগিতাবাদী মস্তিষ্কে প্রবেশ করিতে পারিবে? অথবা, সে শুধু একটা কিংবদন্তী হইয়া বাঁচিয়া রহিবে? ইহার বেশি কিছু নয়! কেহ বলিতে পারে না। কত মহামহোপাধ্যায়ের গ্রন্থ কালের বিবরে হারাইয়া গিয়াছে, এ গ্রন্থও সেইসব লুপ্তচিহ্ন গ্রন্থরাজির পন্থা অনুসরণ করিবে কি না, কোন্ ক্রান্তদর্শী তাহা বলিয়া দিতে পারে? 

হিমবর্ষী যামিনী আর্দ্র হইয়া আসে, এই ঘাটে মধ্যরাত্রে এইরূপে বসিয়া থাকা নিরাপদ নহে, কমলনয়ন তাহা জানে। কাশীর ঘাটে বিধর্মী দস্যুদিগের হামলা ঘটিয়াই চলিয়াছে। তবু সেসব বিপদ অগ্রাহ্য করিয়া এইখানেই সে বসিয়া থাকে। মরিতে আর ভয় পায় না। যাহা অবধারিত, যাহা একদিন আসিবেই, তাহাকে একটা নির্দিষ্ট মরশুম অবধি ঠেকাইয়া রাখিবার ব্যর্থ প্রয়াস সে আর করিতে চাহে না। অদ্বৈতবাদ তাহাকে নিৰ্ভয় হইতে শিখাইয়াছে। সে আজ জানিয়াছে, পরমার্থত তাহার মৃত্যু নাই। সে জন্মমৃত্যুরহিত আত্মা–অভয়, অসঙ্গ, আনন্দ! 

কাহাদের যেন পদশব্দে সমারূঢ় নৈঃশব্দ্য ভাঙিয়া গেল। কমলনয়ন ফিরিয়া দেখিল, দুইজন পথিক এই পথেই আসিতেছে। ঘাটের উপর আসিয়া কিছুদূরে বসিল। একজন মধ্যবয়স্ক, অন্য জন অপেক্ষাকৃত তরুণ। তাহারা কী যেন লইয়া উত্তেজিত স্বরে আলাপ করিতেছে। তাহাদের কথার ভিতর কয়েকবার তাহার নিজের নাম শুনিতে পাইয়া কমলনয়ন উৎকর্ণ হইয়া বসিল। ইহারা তাহাকে লইয়া আলোচনা করিতেছে কেন? 

মধ্যবয়স্ক বলিতেছে, “তুমি আরও একবার ভাবিয়া দেখ, শ্রীজীব, ইহা ঠিক হইতেছে কি না।” 

তরুণবয়স্ক বলিল, “অনেক ভাবিয়াছি। ইহাই রাধারাণীর ইচ্ছা। মধুসূদন সরস্বতীর নিকট হইতে ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ আয়ত্ত না করিয়া লইতে পারিলে ওই মতের খণ্ডন অসম্ভব।” 

“কিন্তু তোমাকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব জানিয়াও তিনি তোমাকে শিক্ষা দিবেন কেন?” মধ্যবয়স্ক প্রশ্ন করিল। 

“কে বলিল যে, আমি তাঁহাকে আমার গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরিচয় প্রদান করিব? বলিব, আমি এক সাধারণ বিদ্যার্থী। কাশীতে অদ্বৈত বেদান্ত শিক্ষা করিতে আসিয়াছি।” 

“ইহাতে কি মিথ্যাচার হইবে না?” 

“ওটুকু মিথ্যাচার বিদ্যালাভ করিতে হইলে দূষণীয় নয়। মহাপ্রভুর মত প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে তাঁহার বিরুদ্ধমত জানিতে হইবে। তবেই উহার খণ্ডন করিয়া অচিন্ত্যভেদাভেদবাদের জয়ধ্বজা উড়াইতে পারিব।” 

“কিন্তু তাঁহার নিকট পাঠ লইতে লইতে যদি তোমার ভাবের পরিবর্তন হয়?” মধ্যবয়স্কের কণ্ঠস্বর এইবার কী এক অজানা আশঙ্কায় কাঁপিয়া উঠিল, “শুনিয়াছি, অদ্বৈতমত বড়ো শুষ্ক। মধুসূদনের পাণ্ডিত্যের খরতেজে তোমার উন্মীলিত ভাবপ্রসূন যদি শুকাইয়া যায়? 

“তাহা কখনোই হইবে না। আমি অতি বাল্যকালে মহাপ্রভুকে দর্শন করিয়াছি। আমার জ্যেষ্ঠতাত ভক্তিমান শ্রীসনাতন ও শ্রীরূপ, আমার পিতা ভক্তশ্রেষ্ঠ শ্রীঅনুপম! আমার ভাব অত ভঙ্গুর নহে। প্রতিপক্ষের বক্তব্য কী, তাহা কেবল আত্মসাৎ করিয়া লইব। তাহার পর খণ্ডন……” এই বলিয়া তরুণটি গঙ্গার অন্ধকার স্রোতের দিকে চাহিয়া রহিল। 

ইহাদের কথা শুনিতে শুনিতে কমলনয়নের মনে বড়ো কৌতুক উপজিত হইল। একদিন এই তরুণের মতোই সেও অদ্বৈতমত খণ্ডন করিবার মানসে কাশী আসিয়াছিল। নিজের নৈয়ায়িক পরিচয় গোপন করিয়া রামতীর্থের নিকট অদ্বৈত বেদান্ত শিক্ষা করিয়াছিল। এখন এই তরুণও সেই একই উদ্দেশ্যে কাশী আসিয়াছে। বলিতেছে, তাহার ভাবভক্তি এতই প্রবল যে, অদ্বৈতবাদ শিক্ষা করিলেও সেই ভাব চলিয়া যাইবে না। তাহার ভাব অত ভঙ্গুর নয়। ভালো কথা! তবে কি কমলনয়নের ভাব ভঙ্গুর ছিল? 

একটুক্ষণ চুপ থাকিবার পর মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটির কণ্ঠস্বর আবার শুনা গেল, “শুনিয়াছি, মধুসূদন সরস্বতী প্রগাঢ় পণ্ডিত। শুধু পণ্ডিতই নহেন, সুগভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতিমান পুরুষ। তিনি যদি তোমার মনে কী আছে, ধরিয়া ফেলেন?”

তরুণটি কৌতুকপূর্ণ স্বরে উত্তর দিল, “তবে আমিও তাঁহার মনের ভিতর ঢুকিয়া খুঁজিয়া বাহির করিব, কেন তিনি এইরূপ শুষ্ক জ্ঞানের পথ ধরিয়াছেন!” তাহারা দুইজনে পরিহাসভরে হাসিতে হাসিতে এ ওর গায়ে ঢলিয়া পড়িল। 

কমলনয়ন এইবার আর ঘাড় ঘুরাইয়া এই দুইজনকে না দেখিয়া থাকিতে পারিল না। দুইজন একটু উপরের ধাপে বসিয়া আছে। নিকটস্থ দীপস্তম্ভের স্তিমিতালোকে ইহাদের অস্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যাইতেছে। তরুণটি শীর্ণকায়, কিন্তু বড়ো সুকুমারদর্শন। গাঁতি দিয়া কাপড় পরিয়াছে, গায়ে একটা উড়ানি। মুখে প্রতিভার ছাপ; গলায় তুলসীকাষ্ঠের মালা। মস্তক মুণ্ডিত, কেবল মাথার পিছনে একটি সুপুষ্ট শিখা আছে। সে উত্তরীয় মুখে চাপিয়া ক্ষুদ্র বালিকার ন্যায় হাসিতেছে। আর তাহারই পার্শ্বে মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটিও খুব হাসিতেছে— সে-ব্যক্তি সামান্য স্থূলকায়। এ দিকে মুখ ঘুরাইল… কিন্তু এ কী! 

পা হইতে মাথা পর্যন্ত কমলনয়নের একটা শিহরন খেলিয়া গেল। এ মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি কে? এ যে একেবারে তাহারই অনুরূপ! সে নিজেই যেন ভিন্ন বেশে সোপানের ঊর্ধ্বতর ধাপে বসিয়া তরুণবয়স্ক ব্রহ্মচারীর স্কন্ধে হাত রাখিয়া হাসিয়া আকুল হইতেছে! এ কেমন হইল? এ যে সেই নবদ্বীপে বিষ্ণুদামোদর মন্দিরের ঘটনার মতো হইল! কিন্তু বিষ্ণুদামোদর মন্দিরে যাহাকে দেখিয়াছিল, সে-ব্যক্তি আর এ ব্যক্তি এক নহে। তাহার ছিল আস্কন্ধবিলম্বিত কুঞ্চিত কেশদাম, আর ইহার মস্তক বৈষ্ণবোচিত অধর্মণ্ডিত, শিখাসমন্বিত। কণ্ঠস্বরও ভিন্ন। 

হাসি কোনোমতে থামাইয়া সেই কমলনয়নের অবিকল সদৃশ মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটি বলিল, “দেখ শ্রীজীব! অন্যের জীবনে তোমার এত কৌতূহল প্রকাশ না করাই উচিত। তিনি যদি আবার তোমার আচার্যস্থানীয় হন, তবে তো ইহা অন্যায্য ব্যাপার! হয়তো প্রথম যৌবনে কোনো মনোবেদনা পাইয়াই কঠোর সন্ন্যাসের পথ ধরিয়াছেন…” 

তরুণবয়স্ক ব্রহ্মচারী হাসিতে হাসিতেই বলিল, “হইতে পারে। যাঁহার নাম মধুসূদন, যিনি স্বয়ং কোমলকান্ত শ্রীহরি, তিনি যে কেমন করিয়া এত শুষ্ক জ্ঞানী হইলেন? নবদ্বীপে যখন ছিলেন, তাঁহার তখনকার সহপাঠী কেহ কেহ আমাকে বলিয়াছেন, তাঁহার বাল্যনাম কী ছিল।” 

মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি বলিল, “কী?” 

“তাঁহার বাল্যনাম ছিল কমলনয়ন। বাল্যে যিনি কমলনয়ন, পরিণত বয়সে তিনিই মধুসুদন। এমন কমনীয় নামধারী ব্যক্তি শুষ্ক জ্ঞানী হইলেন কী প্রকারে?” মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি উৎফুল্ল হইয়া বলিল, “বাহ! তিনি কমলনয়ন আর আমি রাজীবলোচন।” 

তরুণ এইবার হাসিতে মাটিতে লুটাইয়া পড়িবার উপক্রম করিল, “আশ্চর্য! আপনার নাম তাঁহার নামের অবিকল সমার্থক। আপনি রাজীবলোচন আর তিনি কমলনয়ন! দুইজনে একবার দেখা হইলে বেশ হইত!” 

এই তবে রাজীবলোচন? ইহারই অনেক অনুসন্ধান কমলনয়ন আযৌবন করিয়া আসিয়াছে? কমলনয়নেরই ন্যায় উনসিয়া হইতে এ ব্যক্তি নবদ্বীপে আসিয়াছিল। কিন্তু কমলনয়ন যেখানে মহাপ্রভুর দর্শন পায় নাই, এ ব্যক্তি কিন্তু সেস্থলে মহাপ্রভুর দর্শন পাইয়াছিল। মহাপ্রভু ইহাকে লইয়া পুরীক্ষেত্রে গিয়াছিলেন। বড়ো অদ্ভুত তো! অবিকল তাহারই ন্যায় দেখিতে। 

রাজীবলোচন তরুণের কথার জবাব দিল, “দরকার নাই আমার মধুসূদনের সহিত সাক্ষাৎ করার। কী জানি বাবা, ওইসব বড়ো বড়ো জ্ঞানের কথা শুনিয়া আমার আবার ভাব না বিগড়াইয়া যায়! চলো, রাত্রি হইয়াছে। অতিথিশালায় ফিরিতে হইবে।” 

শ্রীজীব বলিল, “চলুন”। এই বলিয়া উভয়ে গাত্রোত্থান করিয়া নগরীর পথ ধরিল। কমলনয়ন শুধু তাহাদের গমনপথের দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। 

দিন কয়েক পর। কমলনয়ন আপন কক্ষে তাহার শিষ্য বলভদ্রকে লইয়া অদ্বৈতসিদ্ধি রচনার সংস্কারসাধন করিতেছিল। বলভদ্র অত্যন্ত বুদ্ধিমান; সংশোধন ও সংস্কারসাধনে সে অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে। বিশেষত কোনো একটি পরিভাষাকে তাহার অভিপ্রেত অর্থের অনুকুলে যথাযথ ব্যবহার করার ব্যাপারে কমলনয়ন প্রায়ই তাহার সাহায্য লইয়া থাকে। একটি শব্দের প্রয়োগ সম্বন্ধে সংশয় উঠিতেছিল; কমলনয়নের রচনায় শব্দটি বারংবার তাহার প্রচলিত অর্থকে অতিক্রম করিয়া গিয়াছিল। বলভদ্র বলিল যে, এক্ষেত্রে একটি উপযুক্ত বিশেষণ প্রয়োগ করিয়া শব্দটির অভীপ্সিত অর্থে পৌঁছানো যাইতে পারে। কিন্তু সেই বিশেষণটি কী হইতে পরে, তাহা লইয়াই গুরু ও শিষ্য দীর্ঘক্ষণ ধরিয়া আলোচনা করিতেছিল। কথায় কথায় বলভদ্র বলিল, “আচার্যদেব! অদ্বৈতবেদান্তের মূল সিদ্ধান্ত কী, এ ব্যাপারে প্রথম প্রবেশকের নিমিত্ত একটি ক্ষুদ্র প্রকরণ গ্রন্থ রচনা করিলে কেমন হয়?” 

কমলনয়ন উত্তর দিল, “এমন তো কত গ্রন্থই রহিয়াছে। আচার্য শঙ্করের বিবেকচূড়ামণি, আত্মবোধ, পঞ্চীকরণম্ এ জাতীয় গ্রন্থ।” 

বলভদ্র বলিল, “তাহা সত্য। তথাপি শংকরাচার্যের ওই গ্রন্থগুলিতে শংকর- পরবর্তী যুগের অদ্বৈতবাদী দার্শনিকদিগের গবেষণার সারভাগ থাকা সম্ভব নহে। ইদানীন্তন কালে কিন্তু এমন একটি প্রকরণ গ্রন্থের প্রয়োজন পড়িয়াছে, যাহাতে পরবর্তীকালের দার্শনিকদিগের দর্শনচিন্তার সারনিষ্কর্ষ ধরা থাকে।” 

কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “কী উপায়ে?” 

বলভদ্র উত্তর দিল, “শংকরভগবদ্‌পাদ-বিরচিত ‘দশশ্লোকী’-র উপর আপনি যদি একটি টীকা প্রস্তুত করেন, তবে ওই টীকাটিই এই জাতীয় প্রকরণ গ্রন্থের অভাব পূরণ করিতে পারিবে।” 

কমলনয়ন হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বেশ! কিন্তু টীকার নাম হইবে কী?”

বলভদ্র একটু ভাবিয়া বলিল, “যদি টীকার নাম হয় ‘সিদ্ধান্তবিন্দু?” 

কমলনয়ন কহিল, “বাহ, উপযুক্ত নামকরণ। তবে তোমার সুখবোধের জন্যই এ টীকা আমি রচনা করিব।” 

এইসব কথা চলিতেছে, এমন সময়ে ঘরের মেঝের উপর কাহার একটি দীর্ঘ ছায়া পড়িল। কমলনয়ন মুখ তুলিয়া দেখিল, দ্বারপ্রান্তে দীপাবলির রাত্রে দৃষ্ট সেই তরুণবয়স্ক ব্রহ্মচারীটি দাঁড়াইয়া আছে। আজ তাহার গলদেশে তুলসী কাঠের সেই মালাটি আর নাই। ব্রহ্মচারী কক্ষে প্রবেশের অনুমতি চাহিল। 

কমলনয়ন সম্মতি দিলে সে নিকটে আসিয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম নিবেদন করিল। বলভদ্র নবাগত ব্রহ্মচারীর মুখপানে চাহিয়াছিল। 

কমলনয়ন শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “নাম কী?” 

ব্রহ্মচারী বলিল, “আমার নাম শ্রীজীব।” 

“নিবাস?”

“গৌড়ের রামকেলি গ্রাম।” 

“সম্প্রতি কোথা হইতে আসা হইতেছে?” 

“নবদ্বীপ হইতে।” 

“কী উদ্দেশ্যে অত্র আগমন?” 

“অদ্বৈতবেদান্ত শিক্ষা করিতে চাই। আপনি কৃপালু হইয়া, আমাকে গ্রহণ করুন। আমি একজন সাধারণ বিদ্যার্থী।” 

কমলনয়ন বলিল, “ইদানীং অন্যবিধ কর্মে ব্যাপৃত আছি। তুমি এই মঠে দিন- দুই-চার অবস্থান করো। তোমার বিদ্যাবুদ্ধি পরীক্ষা করিয়া দেখি। যোগ্য বিবেচনা করিলে তোমাকে নিশ্চয়ই শিষ্যস্বীকার করিব।” 

তরুণ ব্রহ্মচারী শ্রীজীব পুনরায় সাষ্টাঙ্গে প্রণাম নিবেদন করিয়া কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল। ক্ষণপরে কমলনয়ন স্মিতহাস্যে বলভদ্রকে প্রশ্ন করিল, “এই ব্যক্তি কে, জানো?” 

বলভদ্র বলিল, “না তো!” 

“ইহার নাম শ্রীজীব গোস্বামী। ইহার পিতা শ্রীঅনুপম, ইহার জ্যেষ্ঠতাত মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের সাক্ষাৎ পার্ষদ শ্রীসনাতন ও শ্রীরূপ গোস্বামী। ইহারা গৌড়ীয় বৈষ্ণব। ইহার অদ্বৈত বেদান্ত শিক্ষা করিবার উদ্দেশ্য হইল অদ্বৈতমত খণ্ডন করা।” 

বলভদ্ৰ উৎকণ্ঠিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কীরূপে জানিলেন?”

রহস্যপূর্ণ হাস্য করিয়া কমলনয়ন উত্তর দিল, “জানিলাম!” 

বলভদ্ৰ উত্তেজিত হইয়া বলিল, “ইহা জানিয়াও আপনি ইহাকে শিষ্য স্বীকার করিবেন?” 

“করিব। তাহাতে অসুবিধা কী? বিদ্যা কোনো সম্প্রদায়ের নিজস্ব সম্পত্তি নহে। আর যুক্তি দ্বারা খণ্ডনের চেষ্টা করিলেই কি আর সত্য উম্মুলীত হইয়া যায়? অদ্বৈতবাদ কোনো মতবিশেষ নহে, উহা সত্য। উহাকে খণ্ডন করিতে গেলে উহা বরং আরও দৃঢ়মূল হইয়া প্রতিষ্ঠিত হইবে।” 

বলভদ্র বলিল, “ইহা আপনার উদারতা। কিন্তু মধ্যে মধ্যে সংশয় হয়, আপনার এরূপ উদারতায় সম্প্রদায়ের ক্ষতি হয় কি না। কয়েক মাস পূর্বে আপনি ব্যাসরামকে শিষ্য স্বীকার করিয়াছিলেন…. 

“হাঁ, তাহাতে কী হইল?” 

“সেই ব্যাসরাম তাহার প্রকৃত পরিচয় দেয় নাই। বস্তুত, যে-”ন্যায়ামৃত’ খণ্ডন করিয়া আপনি ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ রচনা করিয়াছেন, সেই ‘ন্যায়ামৃত’র গ্রন্থকার ব্যাসতীর্থের শিষ্য হইল ব্যাসরাম।” 

“জানি তো!” 

“সে আপনার নিকটে দিবাভাগে ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’র পাঠ লইত আর রাত্রি জাগিয়া ‘তরঙ্গিণী’ নামে আর-একটি টীকা লিখিয়া আপনার মতের খণ্ডন করিত। তাহার পাঠ শেষ হইল, তখন সে তাহার ‘তরঙ্গিণী’ টীকার একটি অনুলিপি প্রস্তুত করিয়া আপনাকে উপহার দিয়া বিদায় লইল।” 

“আমি তাহার তরঙ্গিণী’ টীকা দেখিয়াছি। আমার ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’কে খণ্ডন করিয়াছে। কিন্তু আমি তাহার উত্তর দিতে আর ইচ্ছা করি না।” 

“কেন?” 

কমলনয়ন বলিল, “দেখ, বলভদ্র! সে আমার ছাত্র। তাহার উত্তর দেওয়া আমার শোভা পায় না। তাহা ছাড়া ইহাও মনে রাখিও— 

শৈবাঃ সৌরাশ্চ গাণেশাঃ বৈষ্ণবাঃ শক্তিপূজকাঃ।
ভবন্তি যন্ময়া সর্ব্বে সোহহমস্মি পরঃ শিবঃ।। 

অর্থাৎ শৈব, সৌর, গাণপত্য, বৈষ্ণব, শাক্ত প্রভৃতি সম্প্রদায়ভুক্ত সাধকগণ তাঁহাদের সাধনার দ্বারা যে-পরম তত্ত্বে তন্ময় হন, আমিই সেই তত্ত্ব, আমি পরমশিবস্বরূপ। আমি সকল সম্প্রদায়বিযুক্ত পরমাত্মা।” 

কিন্তু বলভদ্র এই উত্তরে সন্তুষ্ট হইতে পারিল না। সে বলিল, “বেশ। ব্যাসরাম আপনার ছাত্র, তাই আপনি তাহার আপত্তির উত্তর দিবেন না। কিন্তু আমি যদি তাহার উত্তর দিই, তাহাতে আপনার অসন্তোষ হইবে না তো? 

“না, না, কিছুমাত্র না। তুমি ইহার উত্তর দিতেই পারো। তুমি আমার শিষ্য; তুমি আর সে আমার নিকট উভয়েই সমান সমান।” 

“শুনিয়া বড়ো আনন্দ হইল। আমি ইতোমধ্যেই উহার উত্তর প্রস্তুত করিতেছি। আমি আমার টীকার নাম রাখিয়াছি ‘সিদ্ধিব্যাখ্যা’। ইহাতে আমি আপনার ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’-র ব্যাখ্যা করিয়া ব্যাসতীর্থের শিষ্য শ্রীনিবাসকৃত ‘ন্যায়ামৃতপ্রকাশ’ ও ব্যাসরামকৃত ‘তরঙ্গিণী’র সকল উত্থাপিত আক্ষেপের উত্তর দিতেছি।” 

কমলনয়ন হাসিতে হাসিতে বলিল, “দাও। তোমাদের এই খণ্ডনমণ্ডন আমাকে বেশ আমোদই দিতেছে। ইহাতে অদ্বৈতসত্যের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। উহা স্বপ্রকাশ; উহাকে আর যুক্তি দ্বারা প্রকাশ করিবার প্রয়োজন হয় না। তথাপি যুক্তিতর্কের দ্বারা মনীষা মার্জিত হয়।” 

শুনিতে শুনিতে অকস্মাৎ বলভদ্র অন্যমনস্ক হইয়া কী যেন ভাবিতে লাগিল। একবার কী বলিবে বলিবে করিয়াও বলিল না। কমলনয়ন তাহার এই আচম্বিত ভাবান্তর লক্ষ করিয়া বলিল, “তুমি কি আমার নিকট কিছু প্রকাশ করিতে চাও?” 

বলভদ্র গম্ভীর হইয়া বলিল, “হাঁ।” 

“কী, বলো না!” 

“ভাবিতেছি, বলিব কি না!” 

“নিঃসংকোচে ও নির্ভয়ে বলিয়া ফেলো।” 

“সে একটা সংগোপন বার্তা। একজন লোক—” 

“কে একজন লোক? কী চায়?” 

“একজন রাজকীয় প্রতিনিধি। তাঁহার এখানে আসিবার সমস্যা আছে। এখনই তাঁহার নাম বলিতে পারিব না… তাঁহাকে গোপনতা অবলম্বন করিয়া চলিতে হয়। আপনাকে কিছু সমস্যার কথা বলিতে চান। আমিও তাঁহার সমস্যা বিস্তৃত জানি না। বর্তমানে তিনি কাশীতেই আছেন। আপনি যদি—” 

“তাঁহার নিকট যাইব?” 

“হাঁ, কিন্তু গোপনে। আমি আপনাকে লইয়া যাইব। কথা দিতেছি, ইহাতে আপনার কোনো ক্ষতি হইবে না। পরন্তু আমাদিগের লাভই হইতে পারে।” 

“উত্তম, আমি যাইব। কবে লইয়া যাইবে?” 

“আগামী কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে….”

“বেশ! তাহাই হইবে।” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *