1 of 2

কুকুরদল – ৪৯

অধ্যায় ৪৯

শাহাবুজ্জামান যখন কমনরুমে ঢুকলেন, ভেতরে প্রফেসর রবিনকে ঘিরে একটা জটলা তৈরি হয়েছে। গত সপ্তাহে ইংল্যান্ডে এক কনফারেন্সে যোগ দিয়েছেন তিনি এবং হরিপদ গুপ্ত স্যার। এখন ঐ কনফারেন্স কিংবা ট্যুরের ব্যাপারেই কথা হচ্ছে। প্রফেসর রবিন আড্ডাবাজ মানুষ, খুব সাধারণ বিষয়গুলো এমনভাবে বলছেন যে শিক্ষকদের এই দলটা না হেসে পারছে না। শাহাবুজ্জামান মনে মনে খুব নোংরা একটা গালি উচ্চারণ করলেন।

সশব্দে হাতের ফাইলগুলো টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন তিনি তারপর কিছু ফাইল বের করে একটা কলম নিয়ে বসে পড়লেন চেয়ার টেনে 1 নিজের উপস্থিতি জানানোর জন্য যতোটা সম্ভব শব্দ করা যায় তিনি করে যাচ্ছেন। এদের দেখাতে তো হবে, সবাই কমনরুমে আড্ডাবাজি করতেই আসে না। কেউ কেউ হাতের কাজটুকু করতেও এখানে আসেন। সেমিস্টার ফাইনালের খাতাগুলো কাটতে শুরু করলেন প্রবল মনোযোগ দেওয়ার ভান করে। এই খাতাগুলো এতো মনোযোগের দাবিদার নয়, কাজেই ভানটুকু করার জন্য উপযুক্ত।

নীতু মেয়েটা বেহায়ার মতো হাসছে। শব্দটা কানে যেতে বিরক্তির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন তিনি। মেয়েমানুষ থাকবে পর্দার ভেতর। তারা বের হয়ে এসে মাঠেঘাটে কাজ করছে তা বেশ কথা। পনেরো কোটি মানুষের ত্রিশ কোটি হাত। কিন্তু বাবার বয়েসী বুড়ো প্রফেসরের সঙ্গে লেপ্টালেপ্টিটা যে বাড়াবাড়ি সেটা যে কেউ স্বীকার করবে। এই মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিয়েছে কে?

শাহাবুজ্জামানের মন-মেজাজ বিগড়ে থাকার পেছনে অবশ্য নীতুর হাসি দায়ি নয়। লুলা প্রফেসর আর ধ্বজভঙ্গ হরিপদ গুপ্তকে ইংল্যান্ডের কনফারেন্সে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এটা জানার পর থেকেই দিনকাল খুব ভালো যাচ্ছে না তাঁর। সিনিয়রিটির দিক থেকে তিনি কি ঐ হরিপদের থেকে এগিয়ে না? প্রফেসর রবিন নাহয় একজন নাস্তিক, ইউরোপ-আমেরিকার দোসর, ডুয়াল সিটিজেনশিপ–সে এসব জায়গা থেকে ডাক পেতেই পারে। অথচ শাহাবুজ্জামানের বিষয়ের ওপর একটা কনফারেন্স হলো তাও খ্রিস্টানগুলো তাকে দাওয়াতপত্র দিলো না একটা? তার কনফারেন্স পেপারটা সরাসরি রিজেক্ট করে দিলো তারা? পেছনের কারণটা অবশ্য তিনি একেবারেই জানেন না এমনটা না।

শাহাবুজ্জামানের ইংলিশ স্পিকিং স্কিল একেবারেই জঘন্য। তিনি এই একটা কারণে ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়। একবার সেন্ট্রিফিউগাল পাম্পের কার্যপদ্ধতি বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “ইট ক্যান নট এক্সপ্লেইনড বাই মাউথ।” সেই উক্তিটি অনেকে কাভার ফটো দিয়েছে। গ্রামার ধ্বংসকারী, বিধ্বংসী সব শব্দগুছের জন্মদাতা হিসেবে ছাত্রসমাজ তাকে এমন ভয়ানক রকমের শ্রদ্ধা করে যে ক্যাম্পাসে টেকাই দিন দিন সমস্যার হয়ে যাচ্ছে। এই একটা কারণে থাইল্যান্ডে পিএইচডি-টা করতে গিয়েও ছিটকে পড়েছেন। কোথা থেকে যেন ঐ ব্রিটিশগুলোও বিষয়গুলো জেনে গেছে। শাহাবুজ্জামান ভুল ইংরেজির জেরে স্টিম ইঞ্জিনের ওপর একটা কাজকে তিনি স্টেম সেলের বিতর্কে পরিণত করতে নিয়েছিলেন, থাইল্যান্ড বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির উচ্চপদের সব পণ্ডিতের সামনে, ঘরভর্তি কনফারেন্স রুমে। ভদ্রতাবশতঃ অনেকেই হাসি চাপার চেষ্টা করেছিলো, শেষটায় কনফারেন্স রুম কাঁপিয়ে হেসে ফেলেন থাই অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট সাকারিন্দ্র ভূমিরত্ন। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে বিমানের টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।

এই ঘটনার পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো অবশ্য ছাত্রছাত্রিরা। যাদের ক্লাস-ই তাকে দেওয়া হয়েছে তাদের তিনি অত্যাচার করেছেন ভুল ইংরেজি আর ভুলভাল সংজ্ঞা পড়িয়ে। ছাত্ররা জানতো এই স্যারের কোর্সে ভালো নাম্বার তুলতে হলে ভুলটা মুখস্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে জানতেও হবে ঠিকটা। নয়তো পাশ করে বেরিয়ে সাবুর মতোই ইজ্জত খোয়াতে হবে। এমন একটা মানসিক অত্যাচারে পড়ে যাওয়ার পর কোনো ছাত্রেরই তাকে ভালোবাসার কারণ নেই। কয়েকদিন আগে হয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোড়ন তোলা আন্দোলনে শাহাবুজ্জামান স্যারকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি অশ্লীল স্লোগান দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে সহকর্মিদের সামনে পড়লে লজ্জাবোধ করতেন তিনি। নিজেকে বিজ্ঞানী বলে প্রচার করে এসেছেন এতোদিন, অথচ সেটা খুব একটা প্রতিষ্ঠা পায়নি। প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো ছাত্রদের দেওয়া নামগুলো। ভালো জিনিস প্রচার পায় না, খারাপগুলো ছড়ায় বাতাসের আগে আগে। রাগে-ক্ষোভে এগারো নাম্বারের একটা অঙ্কে শুন্য বসিয়ে দিলেন শাহাবুজ্জামান।

তার হাতে ধরে থাকা খাতাটা আন্দোলনকারীদের একজনের। খাতা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এদের খাতাগুলো আলাদা করেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ফাইনালের খাতা দেখার প্রক্রিয়ায় আর যাই থাকুক, স্বচ্ছতার কোনো ব্যাপারই নেই। প্রথমত, খাতাগুলোর প্রথম পাতায় স্পষ্ট করে লিখা থাকে ছাত্র বা ছাত্রির রোল নম্বরখানা। দ্বিতীয়তঃ কোনো ছাত্র বা ছাত্রি যদি মনে করে থাকে তাকে কম নাম্বার দেওয়া হয়েছে, সে খাতা চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। এমন কোনো সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখা হয়নি। ছাত্র-ছাত্রিদের একটা বিচ্ছিন্ন গ্রুপ এসব নিয়ে অনেকদিন ধরেই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে, খাতা যে দেখবে সে ছাত্র বা ছাত্রির রোল নাম্বার দেখার সুযোগ পাবে কেন? এ তো রীতিমতো এক অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া! তারা মনে করে এধরণের অস্বচ্ছ মূল্যায়নের মাধ্যমে যে কোনো স্বাধীন মত প্রকাশের দাবি দমিয়ে রাখা হচ্ছে। কোনো শিক্ষকের সঙ্গে কোনো ছাত্রের সম্পর্ক খারাপ যেতেই পারে। শিক্ষকটি যদি চান ছাত্রটির খাতাটি খুব কড়াভাবে দেখবেন, তাও তিনি দেখতে পারছেন। স্রেফ রোল নম্বরটা খুঁজে বের করে খাতাটা বের করে নিলেই হলো। এই মুহূর্তে শাহাবুজ্জামান ঠিক সেই কাজটাই করে যাচ্ছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।

এই আন্দোলনকারী ছেলেটি এগারো নম্বরের এক অঙ্ক কষেছে। প্রক্রিয়া পুরোটাই ঠিক আছে। তবে শেষে ক্যালকুলেটর চাপতে করেছে ভুল, কাজেই উত্তর ভুল এসেছে। এমন ভুলের জন্য এগারোয় নয় দেওয়া নিয়ম। তিনি গতকাল রাতে আন্দোলন করেনি যারা তাদের খাতায় সেভাবেই মার্কিং করেছেন। তবে এই ছেলের খাতায় তিনি একটা স্পষ্ট শুন্য বসিয়ে দিলেন। এতে করে বিবেকের দংশন মোটেও অনুভব করলেন না। তিনি তো আর হারাম কাজ করছেন না। ঠিক অঙ্কতে শুন্য দেননি, বরং উত্তর ভুল হয়েছে বলেই শুন্য দিয়েছেন। এতে কেউ দোষ দিতে পারবে না তাকে। অবশ্য দোষারোপের প্রশ্নও আসে না। কেউ তো আর খাতা চ্যালেঞ্জ করে এই শুন্য পাওয়া দেখতে পারছে না। এই ছেলে ফেল করবে। শুধুমাত্র রেজাল্টশিটে নিজের রোলের পাশে ফেলের ঘরে এই বিষয়টার নাম খুঁজে পাবে, ওখানেই গল্প শেষ। সে তো আর এসে খাতা খুলে দেখতে পারবে না তার নাম্বার শাহাবুজ্জামান কোথায় কোথায় কেটেছেন আর কমিয়েছেন।

ফেল একবার করলেই যে তাদের মুক্তি চিরন্তন, এমনটা নয়। এই বিষয়ের ওপর তাদের আবার ব্যাকলগ পরীক্ষা দিতে হবে। যেহেতু কোর্সের টিচার শাহাবুজ্জামান নিজেই তিনি সেই ব্যাকলগের খাতাও দেখবেন। এই খাতাও আসবে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাত্রের রোল নম্বর নিয়েই। তিনি চাইলে আবারও ছোটোখাটো ভুল ধরে ধরে একেকটা প্রশ্নে শুন্য শুন্য করে দিতে থাকতে পারবেন। এবং এই ছাত্র ব্যাকলগ পরীক্ষাতেও ফেল করবে। এটা এমন কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। বাৎসরিক মূল্যায়ন সভাগুলোয় তাকে অবশ্য জবাবদিহিতার সামনে পড়তে হবে, ক্লাসে কেন বিশজন ফেল করলো তার জন্য তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে। এসব সামান্য অপমানের, তবে এই বেয়াড়া ছাত্রগুলোকে গাড্ডায় ফেলার জন্য মূল্যটা খুবই সামান্য। এই সামান্য মূল্য চুকাতে শাহাবুজ্জামান রাজি আছেন। এবার এরা বুঝবে কে কার ‘ইয়ে’ মারে। তিনি পরের বড় প্রশ্নটাতেও নির্দ্বিধায় শুন্য দিলেন। গুরুত্বপূর্ণ একটা শব্দগুচ্ছ সে নিজের ভাষায় লিখলো কেন? সংজ্ঞা বইয়ের ভাষায় মুখস্ত না লিখলে তার কি করার আছে?

“তারপর, শাহাবুজ্জামান স্যার তো ইদানিং কথাই বলেন না আর কারও সাথে।” প্রফেসর রবিন খুব অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বললেন, “অবশ্য আপনার ব্যাপারটা আমি বুঝি। এখন অত্যন্ত জরুরি কাজে ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে আপনাকে। আন্দোলনকারীদের সেমিস্টার ফাইনালের খাতায় শুন্য দিচ্ছেন।”

শাহাবুজ্জামান স্যারের হাত থেকে কলম পড়ে গেলো।

“না, না। বিচলিত হচ্ছেন কেন? আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজ করতে থাকেন। এটা আপনার কাজ, তা নিয়ে কথা বলার অধিকার তো আমাদের নেই। আমি এসব জানি, কষ্ট করে ভাষণটা দিতে হবে না।” একটা হাত তুলে তাকে নিরস্ত করার ভঙ্গি করতে করতে বললেন প্রফেসর রবিন। হাত অবশ্য উনার ওই একটাই।

“সেটাই। এই প্রসঙ্গ আর না তুললে খুশি হবো।” কলমটা তুলে নিয়ে দ্বিগুণ মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখার ভান করতে থাকলেন তিনি।

প্রফেসর রবিনকে মনে হয় আজ কথা বলার ভুত পেয়েছে। নতুন এক প্রসঙ্গ তুললেন তিনি, “ছাত্ররা আপনাকে নিয়ে এতোগুলো স্লোগান দিলো, আপনার এই জনপ্রিয়তার কারণ কি মাঝে মাঝে ভাবি। আমাদের তো জানাতে পারেন অন্তত রহস্যটা।” চোখ টিপ দিলেন তিনি, “আমাদেরও তো কখনোও কখনোও স্লোগান শুনতে ইচ্ছে করে।”

সজোরে কলম টেবিলে নামিয়ে রাখলেন শাহাবুজ্জামান, “এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, প্রফেসর। আপনি ঐ কালপ্রিটগুলোর ব্যাপারে এতো নরোম মনোভাব নিয়ে কথা বলেন যে তা প্রশ্রয়ের কাতারেই চলে যায়।”

“আহা, চটছেন কেন?” গলায় মধু ঢেলে জানতে চাইলেন প্রফেসর রবিন, “আপনারা নাকি চৌদ্দ দফা দাবি পেশ করছেন কর্তৃপক্ষের কাছে? তার মধ্যে মানহানীকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলেছেন?”

“অবশ্যই বলেছি।” গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করলেন শাহাবুজ্জামান, “অপমান করে পার পেয়ে যাবে? ওদের বয়স কারোই আঠারোর কম না। এখন অন্যায় করলে আর তা আদালতে প্রমাণ হলে জেলে যাবে। সিম্পল। স্কুল-কলেজ পেয়েছে, এহ? মামলা করবো সবার নামে। বিচার না পেলে ওদের ক্লাসই নিবো না।”

উরুতে জোরে জোরে চাপড় দিলেন প্রফেসর রবিন, “হাততালি দিতে পারলাম না বলে এই অভিবাদনটাই নিতে হবে আপনাকে। বাহ্, চমৎকার বলেছেন তো। আঠারোর বেশি যখন ওদের বয়স, তখন তো প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই ট্রিট করা উচিত। মামলা করা উচিত ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলে। এটা খুবই প্রফেশনাল কথা, খুবই যৌক্তিক কথা। আমি কিন্তু আপনাকে পূর্ণ সমর্থন জানাই এ ব্যাপারে।”

এই লোকটাকে এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করতে পারলেন না শাহাবুজ্জামান। সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তার সন্দেহকে অভ্রান্ত প্রমাণ করে নীরবতা ভাঙলেন স্বয়ং প্রফেসর রবিনই।”সমস্যা তো তখন হয় যখন আপনারা ভাতেও তাদের মারেন, পানিতেও মারেন। মানে, মামলা ঠুকবেন এদিক দিয়ে, ওদিক দিয়ে হাল্কা ছুতো পেলেই খাতায় নাম্বার দেবেন শুন্য। ব্যাকলগের পরীক্ষা দিলে আবারও শুন্য টেকনিক খাটিয়ে ফেল করাবেন। এসব তো আপনারা অনেকেই করে আসছেন, অনেক বছর ধরে। এসব ছাড়েন, বুঝলেন? ক্লাস এইটের মেয়েদের মতো মান–অভিমান খেলা খেলে একটা ছাত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলবেন না। মামলা করবেন সেটা ঠিক আছে। একদম ঠিক আছে। কিন্তু অনৈতিকভাবে অ্যাকাডেমিকভাবে হেনস্থা করে তাদের জীবন নষ্ট করবেন সেটা ঠিক না। খাতায় ঠিক লিখলে নাম্বার দিতে আপনি বাধ্য, কিন্তু তা তো দিচ্ছেন না। এটা নৈতিক কাজ হলো কি? আর, কিসের আঠারোর বেশি বয়স? ক্লাস যখন নেন তখন তাদের সেই সম্মান কি দিয়েছেন? একবারও তাদের ‘আপনি’ করে বলেছেন? বলেন নাই। বলেছেন তুমি-তুমি করে। নাম ধরে ডেকেছেন। পারবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ওদের বয়েসী কাউকে এভাবে নাম ধরে ডাকতে, তুমি করে বলতে? পারবেন না। প্রাপ্তবয়স্কের সম্মান তাদের দেন নাই একবারও। যখনই কোনো ঝামেলা হয় তখন অবশ্য ঠিকই প্রাপ্তবয়স্ক টানেন। এসব হিপোক্রেসি ছাড়েন।”

কমন রুমে আবারও পিনপতন নিরবতা নেমে এসেছে। আরও একবার লেগে যাচ্ছে শাহাবুজ্জামান এবং প্রফেসর রবিনের। এই পরিবেশে একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ইদানিং। আগে আক্রমণভাগে সব সময় দেখা যেতো প্রফেসর শাহাবুজ্জামানকেই। ইদানিং তাকে বেশি বেশি রক্ষণামত্মক ভূমিকাতে খেলতে দেখা যায়। এমন পরিবর্তন এসেছে ছাত্রদের সেই বিতর্কিত আন্দোলনের পর থেকে। প্রফেসর রবিন সেই আন্দোলনে কারও পক্ষ নিতেই অস্বীকৃতি জানিয়েহিলেন। না শিক্ষকদের মিটিংগুলোয় অংশ নিয়েছেন, না ছাত্রদের মিছিলে নিয়মিত থেকেছেন। পুরো ঘটনাটায় তিনি একরকম আমোদ পেয়েছেন বলেই মনে হয়েছে। সেই থেকে তিনি চলে গেছেন আক্রমণে। আজকের আক্রমণটাও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

প্রফেসর রবিন বলে চললেন, “আবার এমন কথা বলাও তো নিষেধ 1 তখন বলবেন আপনাদের সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্কটা পিতা-পুত্রের। তবে এতে করে কিন্তু দায় এড়ানো যাচ্ছে না। বলতে নেই আবার বলতেও হয়, আমাদের টিচার্স কমিউনিটির অনেকেই ছাত্রিদের প্রতি হাল্কা দুর্বলতা দেখান। পিতা–কন্যার মধ্যে আবার প্রেম এলো কি করে? এতো টারগারিয়ানদের জন্যও বাড়াবাড়ি হয়ে যায়! এধরণের অভদ্রতা কি স্টুডেন্ট কমিউনিটিতে কিছুটা হলেও অসন্তোষের সৃষ্টি করছে না? এর আগেও তো অনেক ছাত্রকে প্রতিহিংসা বশত লগ দিয়েছেন। ছাত্রসমাজ কিন্তু এসব মনে রাখে। আন্দোলনের মতো একটা ব্যাপার যখন চলে আসে তারা সব উগরে দেয়। এগুলো যখন আপনারা করেন, তখন মনে হয় তেমন কিছুই হচ্ছে না। আপনার ক্ষতি হচ্ছে না, বরং উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদেরই শিক্ষা হচ্ছে বলে আপনারা ভাবেন, কিন্তু এর একটা লং টার্ম ইফেক্ট আছে।”

শাহাবুজ্জামান কলম খাতা একপাশে সরিয়ে রগ ফুলিয়ে বললেন, “আপনি যে কাদের পক্ষে তা আমার বোঝা হয়ে গেছে, স্যার। আপনাদের মতো শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাটা একটা অভিশাপ। ডিসপ্লিন বলতে কিছু থাকে না। একটা প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে কিছুটা ডিসিপ্লিনের দরকার আছে। সেজন্য আমাদের কখনো কখনও কঠোর হতে হয়। এটাকে আপনি বলবেন অন্যায়, তাই তো? তাহলে মনে হয় আপনি তেমন কোনো ছাত্রের সামনে পড়েননি, ওই ওরা, চূড়ান্ত মাত্রার বেয়াদব কিছু আছে। তাদের আপনার নরোম কথা কোনো প্রভাবেই প্রভাবিত করতে পারবে না। এদের আপনি এসব মিষ্টি কথা শুনিয়ে কিভাবে লাইনে আনেন তা আমার দেখার খুব ইচ্ছে।”

বিনয়ের মতোই দেখায় এবার প্রফেসর রবিনের হাসিটা, “ভালোবাসায় সব হয়। আমাদের তো পাঁচ হাজার রকেট সায়েন্টিস্টের দরকার নেই, এটা আপনারা কবে বুঝতে পারবেন আমি জানি না। আমাদের দরকার সব ছাত্ররা যেন তাদের ফুল পোটেনশিয়াল ব্যবহার করতে শিখে যায়। সেই পোটেনশিয়াল খুঁজে বের করার দায়িত্ব তাদের, এটা আমাদের দায়িত্ব না। আপনি একটা পর্যায়ে কাউকে গিয়ে গিয়ে হাতে তুলে জ্ঞান খাইয়ে দিতে পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয় জগতটা এমনই। আমরা শুধু পারি তাদের সক্ষমতার পুরোটা বের করে আনতে। এটা তারা নিজেরাই করবে, আমাদের কেবল গাইড করতে হবে। তা না করে যদি আমরা তাদের সিজিপিএ বাড়ানোর জন্য গাইড করতে শুরু করি তখন ঝামেলাগুলো বেঁধে যায়। ওরা আমাদের প্রতি শ্রদ্ধা হারায়, আমরা হারাই সম্মান, আর তারাও আমাদের শ্রদ্ধা হারায়। আপনার কি মনে হয় আজকে ছাত্র-শিক্ষকের যে সম্মানের অবনতি তা একদিনে হয়েছে?”

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কাউকে আগ্রহি দেখা গেলো না। তারা সবাই জানে এসব ঘটনা একদিনের প্রতিক্রিয়া অবশ্যই নয়। এবং এতে নিজেদের দিকেও যে কিছুটা ভ্রান্তি থাকতে পারে সেটা প্রতিটি শিক্ষকই বুঝতে পেরেছেন, আন্দোলনটা অনেকের জন্যই নতুন উপলব্ধি নিয়ে এসেছে। সেই উপলব্ধি অস্বীকার করার জন্য অনেকে প্রতিশোধের রাস্তা বেছে নিয়েছেন, অনেকে নিয়েছেন সংশোধনের পথ। শাহাবুজ্জামানের বিপরীত অবস্থান এখানে হরিপদ গুপ্তের। তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ধীরস্থির হয়ে কথা শুরু করলেন।

“প্রফেসর রবিনে সাথে এক্ষেত্রে আমি একমত। আমাদের কিছু দোষ তো অবশ্যই আছে। আমরা বছরের পর বছর ওদের মানসিক আর শারীরিক অত্যাচার করে গেছি। আমরা বলতে আমি পুরো কমিউনিটিটাকেই বলবো। কারণ, কম হোক আর বেশি, আমি নিজেও সিস্টেমের অংশ। যদিও আপনারা জানেন এধরণের নিয়ন্ত্রণ আমি সমর্থন করি না। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আমি করেছি, অনেকেই করেছে। হয়তো আমি কাউকে লগ খাইয়ে দেইনি, তবে সত্যি করে যদি বলি…অ্যান অনেস্ট কনফেশন…ক্লাস টেস্টে বেয়াড়া ছাত্রদের নাম্বার তুলনামূলক কমিয়ে দিয়েছি এমন হয়েছে কখনও কখনও। যাদের অ্যাটেন্ডেন্স কম, বা জানি পড়াশোনা করে না, এর ওর টুকলি করে পরীক্ষা দেয় এমন ছাত্রদের নাম্বার ক্লাস টেস্টে আমি কম দেই। এদের কিন্তু আমি মার্ক করে রাখছি। তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। আমার উদ্দেশ্য অবশ্যই তাদের মানসিকভাবে হেনস্থা করা ছিল না। বরং ক্লাস টেস্টে একটা ধাক্কা খেলে তারা নিজেদের অবস্থাটা কম হোক আর বেশি বুঝতে পারবে। এটা তাদের জন্য সেমিস্টারে ভালো করবে। হয়তো ওরা বুঝবে পড়াশোনা করার বা নিয়মিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা। তবে যেটা বলেই জাস্টিফাই করার চেষ্টা করি না কেন, নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আমিও করেছি। যেটা বলতে চাইছি, আমাদের মতো যারা এইভাবে ওদের কন্ট্রোলের চেষ্টা করি, তারা নিজেদের কাজটাকে ঠিক মনে করেই করি।”

মাথা দোলালেন হাকারবিন, “আপনার পয়েন্টটা আমি বুঝি, হরিপদ স্যার। কিন্তু যেটা আপনাদের বোঝাতেই পারি না–এখানে একটা দ্বিমুখী সম্পর্ক আছে। এটা ঠিক একলা বাথরুমে গিয়ে স্বমেহনের মতো কোনো ঘটনা না।” প্রফেসর রবিনের লাগামহীন মুখের ব্যাপারে সবাই কম বেশি জেনে ফেলেছেন এতোদিনে, সেজন্য অশ্লীল এই শব্দটা ব্যবহারের পরও কেউ আঁতকে উঠলেন না।”যেটা বলছিলাম, এখানে দুটো দিক আছে। দুটো পক্ষ জড়িত আছে। আপনার আমার ইচ্ছেই এখানে সব না। ছাত্রদের মনে কি আছে, তারা কি চাইছে তাও আমাদের জানতে হবে। অন্তত সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের পাত্তা দিতে হবে আমাদের। এই কাজটা আমরা যদি না করি, একসময় ঘটবে কনফ্লিক্ট। সেই কনফ্লিক্টের একটা চেহারা আপনারা দেখতে পেয়েছেন। আমি একটা কথা বলে রাখি, আপনারা আজকে লাল কালি দিয়ে লিখে রাখতে পারেন।”

সবাই উৎসুক হয়ে তাকালো তারছেঁড়া মানুষটার দিকে।

“আপনারা আজকে একটা কোল্ড ওয়ার লাগাচ্ছেন, আমি টের পাই এসব। এই যে ছেলেরা আন্দোলন করলো আপনারা তার প্রতিশোধ নিতে অনেকগুলো ছেলেকে লগ দিলেন। যারা লগ খেলো না, তাদের রেজাল্টের অবনতি হবে আমি জানি। সাধারণ ছাত্রদেরও সুযোগ পেলেই নানা কথা শুনিয়ে দিচ্ছেন। এধরণের ঠাণ্ডা কিন্তু স্পষ্ট একটা আঘাত আপনারা তাদের ওপর করে চলছেন। আপনারা কি ভাবছেন আমি জানি। এমন একটা পাল্টা আঘাত তাদের ওপর হানা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এটা একটা ওয়ার্নিং হিসেবে যাবে। তারা এমনটা আর করতে পারবে না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। কিন্তু আপনারা এই একটা জায়গাতেই ভুল করছেন।” সবার মুখের দিকে একবার করে তাকালেন প্রফেসর, শেষে দৃষ্টি স্থাপন করুলেন প্রফেসর শাহাবুজ্জামানের দিকে, “ওরা হয়তো দশ বছর চুপ থাকবে। আবারও সহ্য করে যাবে। আপনাদের রোষের আগুনে জ্বলে পুড়বে নতুন ব্যাচগুলোও, যারা এই আন্দোলনের সাথে বিন্দুমাত্র জড়িত ছিল না। তারপরও আপনারা তাদের ওপর কঠোর হবেন। এই ভয় থেকেই কঠোর হবেন যে মুঠো আলগা করে দিলেই তারা হয়তো একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে, বিদ্রোহ করবে এই ব্যাচগুলোর মতো। কিন্তু আপনাদের প্রতিশোধ তারা ডিজার্ভ করে না, যেমন তা করে না আন্দোলনকারীরাও। ফলাফলটা কি দাঁড়াবে বুঝতে পারছেন? মানুষ তাদের ওপর হওয়া শোষণ টের পায়। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো এভাবেই। সাধারণ জনগণ রাজনীতি বুঝতো না। একদমই জানতো না রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ সব সংজ্ঞা। তারা অর্থনীতি বুঝতো না। অথচ তারা শোষণটা বোঝে। এই ছাত্রগুলোও, আমাদের চেয়ে বয়সে হাঁটুর সমান যারা…তারা আমাদের দিক থেকে জ্ঞানের পাল্লায় সম্ভবত অনেক পিছিয়ে। তারা অনেক কিছু বুঝতে পারে না যা আমরা পারি। কিন্তু তারা শোষণটা বুঝে, নিজের অধিকার বোঝে। আপনাদের শোষণ ওরা বছরের পর বছর হজম করে যাবে। তারপর একদিন ঘটবে বিস্ফোরণ। ঠিক এই আন্দোলনটার মতোই, তবে আমার ধারণা পরবর্তি আন্দোলনটা হবে আরও কঠিন। আরও বীভৎস।”

আরও একবার সবার দিকে তাকালেন তিনি, “এই প্রসঙ্গ তোলার ইচ্ছে আমার ছিল না। তবে আপনাদের ভালোর জন্যই বলছি, স্ট্যান্ড ডাউন। বছর পাঁচেক পর রীতিমতো সম্মান হারানোর মতো একটা অবস্থানে নিজেদের নিয়ে যেতে না চাইলে, প্রতিশোধের যা যা পরিকল্পনা ছকে রেখেছেন তা ভুলে যান। এটা একটা দ্বিমুখী প্রক্রিয়া, দুটো পক্ষ যখন ছাত্র আর শিক্ষক হারানোর পুরোটাই আছে আমাদের শিক্ষকদের। একজন ছাত্র চার বছর পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যায়, কিন্তু একজন শিক্ষক এখানে আটকে থাকেন চল্লিশ বছর। আক্রমণ-প্রতিআক্রমণে হারানোর থাকে কেবল তার, যার আছে পিছুটান। ওটা আপনাদের আছে, ওদের নেই। আপনারা গুরুত্বটা বুঝতে পারছেন আশা করি। স্ট্যান্ড ডাউন, প্লিজ।”

কিছু না বলে খাতাপত্রগুলো ফাইলে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর শাহাবুজ্জামান। তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠেছে, টকটকে লাল মুখ নিয়ে বাইরের দিকে রওনা দিলেন তিনি। টিচার্স কমন রুমের দরজাটা লাগালেন সশব্দে। অসহায় একটা ভঙ্গি করলেন প্রফেসর রবিন। কেউ নিজের ভালো বুঝতে না পারলে তার কি করার আছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *