1 of 2

কুকুরদল – ১৪

অধ্যায় ১৪

ইতির সাথে শেষ দেখা হলো জিয়া উদ্যানে। মুহিব কসরত করে একটা বাদাম ছেলার চেষ্টা করছিলো। ঝালড় দেওয়া জ্যাকেট পরে তার পাশে এসে বসলো মেয়েটা। সরাসরি তার দিকে তাকাচ্ছে না আজ। হাত বাড়িয়ে দিলো, “ডায়রি এনেছো?”

এক মুহূর্তের জন্য বাদাম ছেলার প্রচেষ্টা থামালো মুহিব। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার মধ্যে কিছু একটা খুঁজলো। নেই। সেই মায়া আজ তার মধ্যে নেই। সেই সারল্যও তার মধ্যে নেই আজ। যে মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলো সে, আজ তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই মেয়েটি মরে গেছে। এপিটাফবিহীন মৃত্যু।

“ড্যাব ড্যাব করে তাকাতে হবে না। ডায়রি দাও, যাই গা।” কর্কশ কণ্ঠে বলল প্রাক্তন প্রেমিকা।

সম্পর্কের এই নতুন দিকে মোড় নেওয়ার ঘটনাটা অবশ্য বেশ পুরাতনই বলা চলে। শামসভাই যেদিন মারা গেলেন, তার পরদিন শেষবার ইতির কণ্ঠে মাধুর্য শোনার মতো সৌভাগ্য হয়েছিলো মুহিবের। এরপর ইতি তাকে আর ফোন দেয়নি। মুহিবও ফোন দেওয়ার তেমন প্রয়োজন বোধ করেনি। মাঝে মাঝে ইতিকে ফোন দেওয়ার জন্য হাত নিশপিশ করেছে। তবে এই তাড়না প্রেমের টানে নয়। অভ্যাসের আবেদনে। অভ্যাসকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিলাসীতা মুহিব করেনি। প্রবল আত্মসম্মানবোধ তাকে সেই কাজ থেকে বিরত রেখেছে। সেজন্যই হয়তো ইতি যেদিন বলেছিল এই সম্পর্ক টেনে নিয়ে যাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না, মুহিব একরকম হাঁফ ছেড়েই বেঁচেছে। পাগলকে সাঁকো নাড়ার কথা দুইবার বলতে হয় না। চুপচাপ ইতির ডায়রিটা বের করে দিলো মুহিব।

এতক্ষণ চলে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করলেও এবার ডায়েরি হাতে বসেই রইলো ইতি।

“যাচ্ছো না যে?” অগত্যা উপযাজক হয়ে জানতে চাইলো মুহিব নিজেই।

“হুঁ। তাড়াতে পারলেই তো বেঁচে যাও।”

মৃদু হাসলো মুহিব, “নতুন প্রেম ভালো যাচ্ছে না?”

কাঁধ ঝাঁকাল ইতি, “তা যাচ্ছে। না যাওয়ার কি আছে?”

“তাহলে আমার তাড়াতে চাওয়া না চাওয়ায় তো কিছু এসে যাওয়ার কথা না।”

“যাচ্ছে না তো।”

বাদাম নিয়ে পড়লো মুহিব। সেই হতচ্ছাড়া বাদামটিকেই ভাঙার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। এর মধ্যেই বলল, “তাহলে যাও গা। ডায়েরি পেয়েছো, মিশন অ্যাকমপ্লিশড। আংকেল নিশ্চয় তোমার এক্স-বয়ফ্রেন্ডের সাথে সময় কাটানোটা পছন্দ করবেন না।”

“আংকেল?” কটমট করে তার দিকে তাকালো ইতি।

“তোমার নতুন প্রেমিক। বোকাচোদা প্রফেসর। ভাইয়ের বয়সী তো আর না যে ভাই বলবো।”

ছ্যাঁত করে উঠলো ইতি, “শাট আপ। ওর নখের কাছে যাওয়ার যোগ্যতা আছে তোমার?”

“তা নেই।” বিনা যুদ্ধেই পরাজয় মেনে নিলো মুহিব, “কিন্তু বসলেই যখন, এসো ঠিকমতো ফিনিশিং দেই। এরপর মনে হয় আমাদের আর দেখা হবে না। প্রেম চলে যাওয়ার পরও শুধুই বন্ধু হয়ে থাকার ক্ষমতা তোমারও নেই, আমারও না।”

ইতি কিছু বলল না।

“তোমার ওপর আমার রাগ বা ক্ষোভ নেই। আমার দিকটা পরিস্কার করলাম। তোমার অন্য কোনো অনুভূতি থাকতে পারে এই প্রসঙ্গে। সেটা তুমি বলার সুযোগ পাচ্ছো।”

ডায়েরির কোণ কিছুক্ষণ কামড়ালো ইতি, “সত্যি বলছো?”

“অবশ্যই। নির্বিঘ্নে তুমি তোমার অসমবয়সী প্রেমিকের কাছে ফিরে যেতে পারো।”

“তাহলে ওকে এভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলছ কেন?”

“কারণ,” বাদামটা অবশেষে বের করতে পেরেছে মুহিব, “দুনিয়ার সব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের প্রতিই আমি সেনসিটিভ। আমি এই শ্রেণিটাকে দেখতে পারি না। আমি যে কয়টা দেখেছি, সবগুলো ইডিয়েট। বইপত্র পড়েছে কেবল, দুনিয়া চেনেনি একটাও। এইগুলোই হয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক! এখানে তোমার বুড়ো প্রফেসর ইস্যু নন।”

নিজের উত্তরটা নিয়ে এক মুহূর্ত ভাবলো মুহিব। সব শিক্ষক? তা নয়। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত পাঁচজন শিক্ষকের নাম সে বলতে পারবে যারা তার শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন। প্রফেসর হাকারবিন তো ফেরেশতা তুল্য। তবে মোট শিক্ষকের সংখ্যা যেখানে তিনশ’ সেখানে পাঁচজন শ্রদ্ধা কুড়ানোর অর্থ তো একই হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুহিব বিশ্বাস করে না। ভাগ্যের ফেরে প্রেমিকাহরণ করেছে এমন এক শিক্ষকই। তার ছোটো চাচার বয়েসী একজন শিক্ষক!

“অ! তোমার সমস্যা তাহলে পেশায়। কি চমৎকার দৃষ্টিভঙ্গি।” শ্লেষের সঙ্গেই বলল ইতি, “ফেসবুকে দেখলাম, গল্প-টল্প লিখছো।”

“তা লিখছি।”

“গুড ফর ইউ। বই টই প্রকাশের ইচ্ছে আছে? কোনো হেল্প লাগলে বইলো। প্রকাশনা সংস্থাগুলোর সাথে জহিরের অনেক লাইনঘাট আছে।”

“নো, থ্যাংকস।” সময় নিয়ে সদ্য বের করা সিগারেটটায় আগুন ধরালো মুহিব, “তোমার বোকাচোদা প্রফেসরের সাহায্য আমার লাগবে না। পুরুষ মানুষকে নিজের পথ নিজে করে নিতে জানতে হয়।”

রহস্যময় হাসি মুখে নিয়ে তার দিকে তাকালো ইতি। বর্তমান প্রেমিকের প্রতি প্রাক্তন প্রেমিকের ঝাঁঝ সে উপভোগ করছে, এটা বোঝার জন্য লেখকসুলভ মন থাকার প্রয়োজন মুহিবের ছিল না। মেয়েটিকে অসহ্য লাগতে শুরু করেছে তার। এই মেয়ের সাথে এতোগুলো ঘণ্টা সে কিভাবে কাটিয়েছিলো?

“জহির তোমার ব্যাপারে জানে।”

“না জানাটাই অস্বাভাবিক ছিল।” তার দিকে তাকালো না মুহিব।

“তোমার লেখাও সে ফেসবুকে পড়েছে।”

এবার ইতির চোখে চোখ রাখলো ও, “আর?”

“জহির মনে করে” একটু ইতস্তত করলো ইতি, “ইউ আর গিফটেড।”

“ওয়াও।” সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেললো মুহিব, “দিনটা আরও জোস করে দেওয়ার দরকার দেখি না। বোকাচোদা প্রফেসর আমার নামে ভালো কিছু বলছে তা শোনার চেয়ে তোমার সাথে তার ছবি দেখাটা আমার জন্য বেশি স্বস্তির। আমার ব্যাপারে কিছু বলার থাকলে বলে ফেলো। জহিরের কাসুন্দি ঘাঁটবে বাসায় ফিরে। আমার সামনে ওই কাজটা করার দরকার নাই।”

ভ্রুজোড়া ওপরে তুললো ইতি, “ফাইন। জহিরের প্রসঙ্গ বাদ।”

চারপাশে প্রেমলীলা চলছে। জিয়া উদ্যান মূলত: ডেটিং জোন হিসেবেই সুপরিচিত। মুহিব-ইতির মতো দু’ তিনটে সদ্যভঙ্গুর জুটি বাদে সবাই বেশ প্রফুল্ল মুখে সময় কাটাচ্ছে। তাদের ওরা দু’জনই দেখলো। হয়তো নিজেদের পুরোনো স্মৃতির কথা মনেও করলো। তবে এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো কথা হলো না ওদের। প্রাক্তন হয়ে যাওয়ার পর এধরণের কথা বলা যায় না, এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে তো নয়ই।

তোমার যে বিষয়টা আমার খারাপ লেগেছে…” শুরু করেও থেমে গেলো ইতি।

“দ্বিধাদ্বন্দ্বের কিছু নাই। বলে ফেলো। হাঁ-হাঁ করে তোমার সাথে প্যাচ আপের বায়না ধরবো না। এই সম্পর্কে থাকা আমার পক্ষেও আর সম্ভব ছিল না।”

“তুমি আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করতে।”

কাঁধ ঝাঁকালো মুহিব, “কথাটা সত্য। আমি তোমাকে এখনও আন্ডারএস্টিমেট করি। না করার অভিনয় করতে পারতাম রিলেশনটা থাকলে। এখন অভিনয়ের প্রয়োজন ফুরিয়েছে।”

“সত্যটা স্বীকার করে নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”

“আমার ল্যাকিংসগুলোর মধ্যে তাহলে এটাই সবচেয়ে বড় ছিল তোমার কাছে।” একটু হাসলো মুহিব, “তাও ভালো।”

“বিদায় বেলা, মুহিব।” ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো ইতি।

সিগারেটের প্যাকেটটা পকেটে পুরে, বাদামের ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে দাঁড়ালো মুহিবও। একে অন্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ওরা। তাদের চোখে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ছিল না। ডান হাতটা লম্বা করে বাড়িয়ে দিলো মুহিব।

হাতটা প্রত্যাখ্যান করে তাকে শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলো ইতি। এক মুহূর্তের জন্যই। সে আলিঙ্গনেও কোনো কামভাব ছিল না। মেয়েটার পিঠে বার দুই চাপড় দিয়ে সরে এলো মুহিব।

“গুডবাই, ইতি।” হাসিমুখেই বলল সে।

“বাই।” ইতির মুখেও হাসি। সামান্য বেদনার ছাপ হয়তো সেখানে থেকে থাকবে, তবে খুব স্পষ্ট কিছু নয়। একসাথে ওখান থেকে বের হওয়ার পর যখন তাদের পথ আলাদা হলো, মেয়েটি কয়েকবার পেছন ফিরে তাকালো। মুহিব তাকিয়েছিলো, একবার। তারপর জোর করেই আর ঘোরায়নি ঘাড়।

একটা অধ্যায় শেষ হয়েছে। বেশ ভালোভাবেই শেষ হয়েছে বলা যায়। এর চেয়ে বেশি আর কি আশা করতে পারতো সে?

এখন সময় হয়েছে। কাজে নামছে মুহিব, সেজন্য যেতে হবে রামপুরায়। শামসভাইয়ের বাসা সেখানে।

*

দরজার ওপাশে পাঁচফুট ছয় ইঞ্চির মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলো মুহিব। রেশমি চুল, একদিকের গাল ঢেকে রেখেছে। ঠিক ফর্সা নয় রঙটা, শ্যামভাব প্রবল। তবে চোখের মণিদূটো অন্যরকম। বাঙালির কয়লা কালো রঙ সেখানে নেই। কয়রা চোখ। মেটে রঙের একটা ফতুয়া আর পায়জামা পরে আছে। ঘরোয়া পোশাক।

“আসসালামু আলাইকুম। আমি শামসভাইয়ের জুনিয়র।” এভাবেই শুরু করলো মুহিব।

পাঁচ মিনিটের মাথায় দেখা গেলো সুসজ্জিত এক ড্রইং রুমে বসে আছে সে। সামনে বসে আছেন রাশভারি এক পুরুষ। তার পরিচয় অনেকগুলো। লালমাটিয়া কলেজের অধ্যাপক, অবসরপ্রাপ্ত। এলাকার উন্নয়ন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ মেম্বার। মসজিদ কমিটির সদস্য। তবে সব ছাপিয়ে এখন তার মধ্যে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে আরেকটি পরিচয়।

একজন নিহত পুত্রের পিতা।

সন্তান পিতার আগে পৃথিবী ছাড়লে তা কোনো পিতাই মেনে নিতে পারেন না, এধরণের প্রবাদ মুহিব অনেক শুনেছে। তবে চোখের সামনে এমন কোনো পিতাকে সে দেখেনি আজ পর্যন্ত। আজকে শামসভাইয়ের বাবার সামনে বসে তার হিমালয়সম অসহায়ত্ব সে টের পেলো পুরোপুরি।

অসহায়ত্ব। এ ছাড়া আর কোন্ অনুভূতিকে জড়ানো যায়?

ভদ্রলোকের কণ্ঠে তেমনটাই ফুটে উঠলো, “এসব নিউজ করে আর কি লাভ, বাবারা? কোনো লাভ নাই।”

মুহিব একটু আগে বলা কথাগুলোই আরও একবার বলল, “দেশটা তো স্যার চলে গেছে নষ্টদের হাতে। একচুল ছাড় দিলেই প্রশাসন ভুলে যায় ঘটনা। আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন এর আগে কতোগুলো ঘটনা ঘটেছে এমন। তোলপাড় হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, তোলপাড় হয়েছে রাজপথ। তখন বিচারকাজ এগিয়েহে দ্রুত। যেই রাজপথ খালি হয়ে গেলো, বিচার-আচার শেষ ওখানেই। হয়েছে এমন। আমরা চাই না, শামসভাইয়ের কেসটাও বিচারবিহীন রয়ে যাক। আমরা এর একটা শেষ না দেখে ছাড়বো না। আর সেজন্য দরকার মিডিয়া প্রেশার। আমরা চাই নিয়মিত প্রশাসনকে মিডিয়ার প্রেশারে রাখবো। নিয়মিত।”

মুহিবের চোখেমুখে যে দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে তা ছড়িয়ে পড়েছিলো তার কণ্ঠেও। ওর এই কথাগুলো শুনলে হয়তো শামসের খুনিদেরও বুক কেঁপে উঠতো। ঝাঁঝালো এই ভঙ্গিতে শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখলে হয়তো দুই হাজার সাধারণ ছাত্র নেমে আসতো রাজপথে। কিন্তু একজন পুত্রহারা পিতার ওপর এই দৃঢ়তা কোনো দৃশ্যমান প্রভাবই ফেলতে পারলো না।

একই ধাঁচে মুখ নিচু করে বলে গেলেন তিনি, “লাভটা কি বাবা? সরকার যদি চায় এই বিচার না হোক, তোমরা কয়েকশ’ মিডিয়াও কিছু করতে পারবা না।”

“কিন্তু আমাদের চেষ্টা করতে হবে, স্যার। আপনি কি চান ভাইয়ের খুনিরা মুক্ত মানুষের মতো ঘুরে বেড়াক বাইরে? ওরা পৃথিবীর সুখ-স্বাদ ভোগ করার কোনো অধিকার রাখে না, স্যার। সেই স্বস্তি আমরা তাদের দেবো না।”

মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, “ওদের ফাঁসিতে ঝোলালেও কি আমার ছেলেটাকে ফিরে পাবো? বলো তুমিই? পৃথিবীর সবগুলো মানুষকে যদি আমি বন্দুক দিয়ে একে একে ফেলে দেই, ফিরে পাবো আমার ছেলেটাকে?”

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকসাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো মুহিব। সেখানে ধিকিধিকি জ্বলছে আগুন। তবে এই আগুনে প্রতিশোধ নেই। নেই সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। নরোম এই আগুন হতাশার, অসহায়ত্বের। প্রবল প্রতিপত্তি থাকার পরও যা চাইছেন তা না পাওয়ার। এই আগুন পাল্টে বহ্নিশিখায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি খুনিদের কি হলো তা নিয়ে ভাবছেন না। তিনি চান না খুনিদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলে পড়ার দৃশ্যটা প্রথম সারিতে বসে উপভোগ করতে।

তিনি শুধু চেয়েছেন ছেলেকে আরেকবার দেখতে। স্পর্শও করতে চাননি সেভাবে। পাশের ঘরে ছেলে মুভি দেখছে এটুকু অনুভূতিই তার জন্য যথেষ্ট।

এই বাবাটি এতো মামুলি এক অনুভূতিও পাচ্ছেন না। তার থেকে এসব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি শুধু অতোটুকুই ফিরে পেতে চান। খুনির বিচার তিনি চান না।

অথচ এটুকু মুহিবের জন্য যথেষ্ট নয় মোটেও। শামসভাইয়ের কাছের মানুষগুলোর সাথে কথা বলতে হবে তাদের। বের করতে হবে কার্যকরী তথ্য। জানতে হবে কারা ছিল শামসভাইয়ের প্রিয়জন, কাদের বিরাগভাজন তিনি হয়েছিলেন। জানতে হবে রেদোয়ান আর তোফায়েলের সঙ্গে শামসভাইয়ের বেঁধে যাওয়ার কারণটা কি হতে পারে। সেরাতে ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডটির পেছনের গল্পটা বের করে আনতে হবে ওকে। সেজন্য প্রয়োজন পরিবারটির সহযোগিতা। প্রয়োজন শামসভাইয়ের বেডরুমে ঢুকে প্রয়োজনীয় সবকিছু নোট করে আনা।

“স্যার-” শুরু করেছিলো মুহিব, তবে আলোচনায় ছেদ পড়লো। শ্যামলামতো মেয়েটা একটা ট্রে নিয়ে ঢুকেছে ড্রইং রুমে। এক কাপ চা সেখানে, হাল্কা কিছু নাস্তা।

“শোনো ছেলে,” সামনে ঝুঁকে এলেন শামসের বাবা, “ওর মা আজ এক মাস হলো বাবার বাড়িতে। এই বাড়িতে তাকে রাখা যায় না। সারাদিন কাঁদে, শামসের ঘরে গিয়ে বসে থাকে। তার জামাকাপড় ধরে। কোথায় যেন সব জমিয়ে রেখেছিলো… ছেলেটার বয়স যখন দুই, তখনকার জামা, জুতো। ওগুলো বুকের মধ্যে নিয়ে সে কাঁদে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছি, তিনি বলেছেন ছেলের স্মৃতির সাথে বেশি সময় কাটালে ক্ষতিটা হতে পারে বেশি। এখান থেকে তাকে সরিয়ে দিয়েছি। সে এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি।”

পরিবারের একমাত্র ছেলে নির্মমভাবে খুন হয়ে গেলে তাদের ওপর কেমন বিভীষিকা নেমে আসতে পারে তার নির্মমতা প্রত্যক্ষ করলো মুহিব। সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা সে করলো না।

“আমি চাই না শামসকে নিয়ে মিডিয়াতে বেশি তোলপাড় হোক। যতো তোলপাড়, ততো আলোচনা। ওর মায়ের জন্য এখন শামসকে নিয়ে আলোচনা খারাপ ফল আনবে। আর মিডিয়া এসে তাকে প্রশ্ন করলে…” কেমন যেন শিউরে উঠলেন ভদ্রলোক, “আমি চাই না পুরো পরিবারটা ধ্বংস হয়ে যাক। বুঝতে পারছো তো আমার কথা?”

মাথা দোলালো মুহিব। সে ভদ্রলোকের কথা স্পষ্টই বুঝতে পারছে। তিনি ভালোবাসার একজনকে হারিয়েছেন, আর কাউকে হারাতে চাইছেন না।

“আমি খুশি হয়েছি যে তুমি বাসায় এসেছো। খোঁজ নিচ্ছো। কিছু একটা করার চেষ্টা করছো। আমি সত্যই খুশি হয়েছি। তোমরা চেষ্টা করো। সম্ভব হলে দায়ি ব্যক্তিদের ধরে ফেলো। তাদের কপালে যাই থাকুক, আমার খুব একটা মাথাব্যথা নেই। আমি চাই আমার বাকি পরিবারটুকু দু’দণ্ড শান্তিতে ঘুমাক।”

মুহিব চুপ করে থাকলো। চায়ের কাপ থেকে উড়তে থাকা ধোঁয়া দেখছে।

“আমি আমার ছেলেটাকে তো আর ফিরে পাচ্ছি না। এটা আমাকে মেনে নিতে হবে। তাই না?” নিজেই যেন প্রলাপ বকে যাচ্ছেন ভদ্রলোক। দুচাখ আঙুল দিয়ে টিপে ধরে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। মুহিবের মায়া হলো খুব। এমন অবস্থায় তো আর চায়ের কাপ তুলেও চুমুক দেওয়া যায় না।

পরিস্থিতি সামাল দিলো মেয়েটি। বাবার কাঁধ জড়িয়ে ধরে সোফা থেকে তুলে দাঁড় করালো।

“বাবা, বিশ্রাম নেবে তুমি। চলো।”

মেয়ের কাঁধে ভর দিয়ে ঘর ছাড়ার সময় মুহিবের দিকে একবার তাকালেন তিনি। করুণ এক অভিব্যক্তি সেখানে। খোঁচা খোঁচা পাকা দাঁড়ি আর এলোমেলো মাথার চুল। কেমন যেন উদভ্রান্ত মনে হচ্ছে তাকে। চশমার মোটা কাঁচের ভেতর ভেজা চোখ। বয়সে তিনি মুহিবের বাবার চেয়েও বড় হবেন।

“আমি খুবই দুঃখিত।” ভদ্রলোক বললেন।

এই কথাটা তিনি মুহিবকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন কি না তা সে জানে না। বাবা-মেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে কাপে একটা চুমুক দিলো। মুখ বিকৃত হয়ে এলো তার, এক ছটাক চিনিও দেওয়া হয়নি ভেতরে। ভয়ঙ্কর দুঃসময় যাচ্ছে পরিবারটির।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো মেয়েটি। তার মুখের ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজকের মতো তাদের সাথে আলোচনার সমাপ্তি ঘটেছে। এর পর আর কখনও এখানে সে ঢুকতে পারবে কি না তাও অনিশ্চিত। শামসভাইয়ের পরিবার কোনো রকম সাহায্যই করতে প্রস্তুত না।

মেয়েটির শেষ কথাটায় তা আরও স্পষ্ট হলো। প্রয়োজনের চেয়েও উচ্চস্বরে সে বলল, “বাবা আর ভাইয়ার ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাইছেন না। বুঝতে পেরেছেন তো? আপনি আজকে আসলে ভালো হয়।”

মাথা দোলালো মুহিব। তাদের মনের অবস্থা সে বুঝতে পারছে না, তবে চেষ্টা করতে পারছে। ঘরের ভেতরের বাতাস বিষণ্নতার আবরণে বিষাক্ত হয়ে আছে। প্রতিবার এখানে শ্বাস নিতেও ভয় হচ্ছে ওর।

মাথা নিচু করেই দরজা পর্যন্ত এলো মুহিব। পেছনে পেছনে এলো মেয়েটি। দরজা খুলছে সে, কেউ একজন কাঁধের কাছে বার দুয়েক টোকা দিলো। অবাক হয়ে ফিরে তাকালো মুহিব। মেয়েটি একটা কাগজের টুকরো তার দিকে বাড়িয়ে রেখেছে।

হাতে নিয়ে একবার চোখ বোলালো মুহিব।

“বিকালে বের হবো। ফোন দেবেন।”

নিচে একটা বাংলালিংক নাম্বার লিখা। ভূতের মতো বাড়িটা থেকে বের হয়ে এলো মুহিব। কাছাকাছি একটা দোকান থেকে সিগারেট কিনে যখন ধরালো, বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় কাঁপছে। বিকাল বেলার অপেক্ষা এখন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *