1 of 2

কুকুরদল – ১৮

অধ্যায় ১৮

একবার মাসুম, একবার আলমগিরের দিতে তাকিয়ে যাচ্ছে শামীম, এখনও। একজন তূর্ণার পেছনে ছয় বছর ধরে ঘুরছে, হাত কেটে আইসিইউ-তেও ভর্তি হয়েছে। অপরজন তূর্ণার সাথে এক বছর ধরে প্রেম করে আসছে। এরা দুইজন পাশাপাশি বসে বন্ধুর মতো সিগারেট খাবে কেন? শামীমের তাবৎ হিসেব গোলমেলে হয়ে যায়।

মুহিব নিজেকে সামলে নিয়েছে অনেকটাই, “এক্স-বয়ফ্রেন্ড?”

দুঃখি মানুষের মতো মাথা দোলালো আলমগির, “হ্যাঁ রে ভাই। আমাদের ব্রেক-আপ হয়ে গেছে এক মাস মতো হয়ে গেলো। দেখছো না, ছ্যাঁকাখোরেরা টিম করেছি?”

“সে তো শামসভাইয়ের মার্ডারের পর পর তাহলে?”

“ঠিক। ঠিক ভাবে বলতে গেলে শামস যেদিন খুন হলো তার পরদিনই আমার সাথে তূর্ণার..” মুখ দিয়ে বাতাসভর্তি পলিথিন ফাটানোর মতো একটা শব্দ তুললো সে, “ফোন ধরেনি, দেখা করেনি।”

“কেন তিনি এমনটা করবেন?”

“আই ডোন্ট নো। বাট আই ক্যান গেস। মেয়েরা শুনেছি প্রাক্তনের ক্ষতি হলে নিজেকেই দুষে থাকে। তার কেয়ার পেলে হয়তো এমনটা হতো না ইত্যাদি তবে আমার মনে হয় তূর্ণা একসময় শান্ত হয়ে আসবে। সিদ্ধান্ত পাল্টাবে তখন, আমাকে ফোন করবে। অবশ্য সিদ্ধান্তটা না পাল্টালেই মাসুম খুশি হয়।”

মাসুম বোকার মতো হাসছে এখন, “দেখা যাক. ভাই। কিন্তু ও মনে হয় না আমার দিকে কোনোদিন ফিরে তাকাবে। জুনিয়রের কষ্টটা আপনি বুঝবেন না।”

অবাক দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকালো শামীম আর মুহিব, আরেকবার। এ তো সুন্দরি এক মেয়ের প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বি নয়, রীতিমতো ভাই-ভাই সম্পর্ক। তাদের ব্যাখ্যা করলো আলমগিরই, “দেখো, আমি প্রেম ইত্যাদিকে প্রতিযোগিতা ভাবি না। তোমরা ওভাবে তাকিয়ো না ভাই। প্রেম হলো ন্যাচারাল প্রসেস। যদি আমার কাউকে ভালো লাগে, আর তার আমাকে, তো হয়ে গেলো। আর যদি ভালো না লাগে, তাহলে তো তাকে বিরক্ত করে লাভ নেই, ঠিক কি না?”

“আমি কিন্তু তূর্ণাকে বিরক্ত করি না।” তড়িঘড়ি করে বলল মাসুম।

“আহা, তোমাকে বলছি না তো। সব নিজের দিকে নাও কেন?” বড়ভাই সুলভ একটা ধমক দিয়ে ডার্বির গোড়াটা মাসুমের হাতে তুলে দিলো আলমগির, “তো, যা বলছিলাম। আবার মেয়েটা যদি আমাকে পছন্দও করে, তার মানে কি সে আমার সম্পত্তি হয়ে গেলো? না ভাই। এসব খুব ন্যারো মেন্টালিটি। একটা মেয়ে আমাকে ভালোবাসলে তাকে অন্য কেউ ভালোবাসতে পারবে না? পারবে। শামস ওকে ভালোবাসতো। মাসুম ওকে ভালোবাসে। আমার কোনো প্রবলেম নেই এতে। শামসের সাথেও আমার দারুণ সম্পর্ক ছিল, এই যে মাসুমের সাথেও মাঝে মাঝে এখানে আড্ডা–ফাড্ডা দেই। সমস্যা তো নেই। তাই না?”

ভদ্রলোক বেশ লিবারেল চিন্তা-ভাবনা করেন, ওরা এবার বুঝতে পারলো। নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এমন খোলামেলা আলাপের একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এটা। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, মাসুম তাকে পছন্দই করে। অবশ্য সামান্য আলাপেই ওরা যা বুঝতে পেরেছে, আলমগির কবির একজন পছন্দ হয়ে যাওয়ার মতোই ব্যক্তিত্ব। এবার ওরাও খোলাখুলি আলাপ করলো, নিজেদের সঙ্গে এই কেসের সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিলো ক্যাম্পাস টোয়েন্টি ফোর সেভেনের মাধ্যমে।”নিউজ” করার লক্ষ্যেই এতো খুঁতখুঁতানি তা ওদের বোঝাতে বেগ পেতে হলো না। এদেশের সবাই জানে, ষোলো কোটি জনগণের জন্য আছে সতেরো কোটি পোর্টাল। খবরের জন্য ছুটকা রিপোর্টার পাগল হয়ে থাকবে এতে আশ্চর্যের কি?

আলমগির হাসতে হাসতে একবার বলল, “আমাকে সম্ভাব্য খুনী ভেবে রিপোর্ট করে দিও না আবার। চাকরিটা চলে গেলে ডার্বি থেকে হলিউডে নেমে আসতে হবে।”

ছোট্ট করে হাসলো মুহিব, এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে অনেকদিন পড়েনি। সূতো আরেকটু ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে। সামনে ঝুঁকে এসে খুব গোপন কোনো কথা বলে দিচ্ছে এমনভাবে বলল, “শামসভাইয়ের ফ্যামিলির সাথে কথা বলেছি আমরা। তাদের ধারণা তূর্ণা আপু কেসটার সম্পর্কে কিছু একটা জানে। এটুকুই আমাদের অগ্রগতি। আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না, আলমগির ভাই। মাসুম ভাইয়ের ব্যাপারটা আমরা সবাই জানি। আপনার নামে কিছু কুৎসা রটিয়ে আপনার ব্যাপারে কিছু তথ্য আদায় করতে এসেছিলাম এখানে, নো অফেন্স মাসুম ভাই। ব্যাকগ্রাউন্ড চেক আরকি…এরপর সরাসরি আপনার সঙ্গেই যোগাযোগ করতাম। ব্যাপারটাকে পার্সোনালি নেবেন না। আপনার ব্যাপারে যা বলেছি একটু আগে, সবই মিথ্যে। এমন কোনো খবর আমাদের হাতে ছিল না। এসব আমরা কখনোই রিপোর্ট করতাম না। তবে তূর্ণা আপুর সাথে আমাদের কথা বলা দরকার।

আরেকটা সিগারেট ধরালো আলমগির, “চাপা মারার জন্য নরকে কোনো বিশেষ জায়গা থাকলে সেটা নির্ঘাত রিপোর্টার দিয়ে ভর্তি করা হবে। তা, আমাকে কেন দরকার পড়লো তোমাদের?”

“তূর্ণা আপু। হুট করে তো আর একজন মানুষের সাথে আলাপ করা যায় না। উনার সাথে আমাদের পরিচয়ও নেই। ভেবেছিলাম আপনি আমাদের ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিতে পারবেন।”

মাথা দোলালো শামীম। এখনও কোনো কথা বলতে পারেনি সে। তবে বন্ধুর দিকে সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। মুহিবের চালটা এখানে স্পষ্ট। শিয়া বলেছিলো তূর্ণার সাথে তার মাত্র একবার দেখা হয়েছে। অর্থাৎ শামসের পরিবারের সাথে তূর্ণার সম্পর্ক তেমন গভীর নয়। এর আরেকটা অর্থ হলো, শামসভাইয়ের পরিবার তূর্ণার দিকে নতুন কোনো লিডই দেয়নি এই মিথ্যেটা  তাদের পক্ষে ধরে ফেলা সম্ভব হবে না।

মাসুমের মাধ্যমে তূর্ণার বয়ফ্রেন্ড, তূর্ণার বয়ফ্রেন্ডের মাধ্যমে তূর্ণার সাথে যোগাযোগ করা ছিল পরিকল্পনা। এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকমতোই এগুচ্ছে।

আলমগিরকে অনেকটাই নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছে এখন, “সেটা কোনো সমস্যা না। শামস অনেক ভালো একটা ছেলে ছিল। দায়িত্বশীলতায় লবডঙ্কা, যে কারণে তূর্ণার সাথে সম্পর্কটা টেকেনি ওর। তবে এটা তো কোনো অন্যায় না, একেকজনের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা একেকরকম। শামসের খুনি ধরা পড়লে আমার মতো খুশি আর কেউ হবে না। তোমরা যদি মনে করো তূর্ণার সাথে কথা বললে কেসটা এগুবে, আমি তোমাদের যোগাযোগ করিয়ে দেবো।”

অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতার সাথেই হাত বাড়িয়ে দিলো মুহিব, “থ্যাংকস এ লট, ভাই। থ্যাংকস এ লট!”

মুচকি হাসলো আলমগির, “আহা, এতো ব্যস্ত হচ্ছো কেন? তোমরা তো তাও কিছু একটা করছো। আমি এখানে বসে বসে ডার্বি খাচ্ছি।”

আরও অনেকক্ষণ আড্ডা দিলো ওরা। জানতে পারলো, আলমগিরের ধরণই এমন। প্রেমিকার প্রতি দুর্বল প্রতিটি ছেলেকে খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেলে। প্রেমিকাও নিরাপদ থাকলো, ভবিষ্যতে জটিলতা কমলো। মুহিবের অবশ্য মনে হলো এর পেছনে ভিন্ন কোনো কারণ আছে, বন্ধুকে পাশের সিটে বসালে শত্রুকে নাকি জড়িয়ে রাখতে হয়। কিপ ইয়োর ফ্রেন্ডস ক্লোজ অ্যান্ড এনিমিস ক্লোজার। তবে উদ্দেশ্য যাই হোক, আলমগির লোকটা চালু মাল। ভাঙবে তো না-ই, মচকাবেও না। এমন অভিনব প্রেমিক ওরা অনেকদিন দেখেনি 1

“তূর্ণা সেইদিনের পর থেকে আমাকে যেভাবে ইগনোর করছে, মনে হয় না হুটহাট তোমাদের সাথে মিটিং করতে রাজি করাতে পারবো। তবে তোমাদের নাম্বারটা দিয়ে রাখো। ও রাজি হওয়া মাত্রই তোমাদের জানাবো আমি।” চোখ টিপলো আলমগির, “বুঝলে না? তোমাদের ছুতোয় যদি আবার কথা বলাতে পারি মেয়েটাকে।”

ওরা বুঝলো। নাম্বার আদান-প্রদানের পর আর দুটো ডার্বি হাতে দোকান থেকে বেরিয়েও এলো। অল্প সময়েই অনেক অগ্রগতি হওয়ায় দু’জনেরই মন প্রসন্ন হয়ে আছে। শামীমকে উদ্দেশ্য করে বলল, “দেখলি? প্রথমদিন আমরা চিন্তায় ছিলাম এই তূর্ণাকে খুঁজে বের করাটাই অসম্ভব হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই প্রাইভেট চ্যানেলে তূর্ণার সাথে কথা বলার ব্যবস্থা পর্যন্ত হয়ে গেলো। আমাদের আসলে সিরিয়াস হওয়া দরকার এই সাংবাদিকতার ব্যাপারটায়। মনে হচ্ছে ভালোই করবো, কি বলিস?”

মাথা দোলালো শামীম, “হুম।”

আলমগিরের পরিচয় জানার পর যে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলো, তারপর এটাই প্রথম শব্দ। কৃত্রিমভাবে চোখ ট্যারা করে হাসলো মুহিব, “চিল। এসব হয়। ঐরকম ক্ষুরের গল্প বানিয়ে ধরা খেয়েছিস দেখেই তো দ্রুত খাতির হলো। মাঝে মাঝে গাধামি করা খারাপ কিছু না।” প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো সে, “লিটুকে দেখি না অনেকদিন হলো। ঘটনা কি?”

ফুটপাতে থুতু ফেললো শামীম, “শ্রাবন্তীর সাথে জমিয়ে প্রেম করছে। ইদানিং ওকে একটু কম দেখতে পাওয়াই স্বাভাবিক। একে তো আগুন সুন্দরি, তার ওপর বাপ এক্স-মেয়র। বাতাসে উড়ছে একেবারে।”

“এটা তো আমরা চেয়েইছিলাম।” সস্তা সিগারেটে অভ্যাসবশত জোরে টান দিয়ে মৃদু কাশলো মুহিব, “লিটু ভালোই আছে তাহলে। ইলোরাকেও তো অনেকদিন দেখি না।”

তোফায়েল ভাইয়ের সাথে লাটিমের সুতার মতো লেগে আছে।” আরেকদলা থুতু ফুটপাতে ফেললো শামীম, যেন ঘটনা দুটোর কোনোটাই তার পছন্দের না।

শিউরে উঠলো মুহিব। তোফায়েলের নামটা ভরা দুপুরের সূর্যের আলোর তেজ থেকে এক হ্যাচকা টানে তাকে নিয়ে গেছে ভিসি স্যারের বাড়ির সামনের খোলা এক মাঠে। রাত। ছটফট করতে থাকা একজন মৃত্যুপথ যাত্রীর হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ির শব্দ উঠছে তারার চাদরের নিচে। মৃদু গোঙানি। থ্যাপ থ্যাপ শব্দ। র‍্যাড, কুইক, র‍্যাড! স্মৃতিতে তোফায়েলের কণ্ঠস্বর আজও এতো বাস্তব! মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল প্রবাহ টের পেলো মুহিব

কাকতাল হতে পারে, তবে ওদের সামনে দিয়ে তখনই ক্রস করলো তোফায়েলের বাইক। পেছনে ইলোরা বসে আছে। সাবলীলভাবে খামচে ধরে আছে ছাত্রনেতার কাঁধ। তোফায়েলের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। ইলোরা আজ ওদের দেখেও না দেখার ভান করলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *