অধ্যায় ৪৪
“আমি কখনও কাউকে গুলি করিনি।” মেপে মেপে শব্দগুলো উচ্চারণ করলো মুহিব।
“করোনি। এর মানে তো এই নয় ভবিষ্যতে গুলি করবে না কাউকে।” উঁচুদরের রসিকতা হয়েছে এভাবে হাসলো জাকি।
“কিন্তু আমি কেন?”
“কারণ, তোমার কৌতূহল প্রচুর, মুহিব। এই নোংরা ব্যাপারটায় গলা পর্যন্ত ডুবে গেছো তুমি। নাউ ইউ আর আ পার্ট অব অল দিস। তোফায়েলকে গুলি করার জন্য যদি আমাদের অ্যালিবাইয়ের প্রয়োজন হয়, তবে তুমি হলে সেই লোক যে হতে পারে আমাদের শুটার।”
“আমি-ই কেন? কোনো হিটম্যান-”
“তোফায়েল হাই প্রফাইল। হিটম্যানরা এরকম কাজ নিতে চায় না। নিলেও তারা মুখ বন্ধ রাখবে কি না সন্দেহ আছে। পরে ফেঁসে যেতে হবে।”
“আমি তাকে গুলি করলে ফাঁসবো না?”
“তোমাকে ক্যাম্পাসে কয়জন চেনে?”
“অনেকেই, আই গেস।”
“তারা তোমাকে অনেকভাবে চিনতে পারে, মুহিব। কিন্তু ভায়োলেন্ট হিসেবে না। তোমাদের মেকানিক্যালের ফার্স্ট বয়ের নামটা যেন কি?”
মুহিবের জন্য এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ।
“তুহিন। সিজি থ্রি পয়েন্ট নাইন থ্রি।”
“গুড। আজকে যদি আমি আমার ঘরে গুলি খেয়ে মরে পড়ে থাকি, তোমরা কি তুহিনকে সন্দেহ করবে? তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে?”
মুহিব জানে এই দৃশ্যটা কল্পনা করাও কতোটা হাস্যকর। তুহিন বেঁটে–খাটো একটা ছেলে। চশমা পরা গোলগাল মুখ। থলথলে শরীর। সেকেন্ড সেমিস্টারে উঠে সেকেন্ড বয়কে প্রশ্ন করেছিলো “বাচ্চা কিভাবে হয়?” এ নিয়ে কম হাসাহাসি হয়নি। ক্রিকেট খেলে না। রাস্তায় ঘোরে না। চায়ের দোকানে বসে না কারণ সে চা পর্যন্ত খায় না, সিগারেট দূরে থাকুক। তবে পড়াশোনাটা ভালো পারে। প্রথম সেমিস্টারেই থ্রি পয়েন্ট নাইনের ওপর তোলা মেকানিক্যালদের জন্য বিস্ময়। ক্যাম্পাস শুটআউট হলে কেউ তুহিনের নাম মুখে নেবে না।
“বুঝতেই পারছো।” মুহিবের অনুচ্চারিত উত্তরকেই ধ্রুবক মানলো জাকি, “তুমি যদি দেশের প্রেসিডেন্টকেও গুলি করো, কেউ তোমাকে সন্দেহ করবে না। তোমার সাথে আমাকে ক্যাম্পাসে আজ পর্যন্ত একবারও দেখা যায়নি। সবাই জানে রাজনীতি থেকে তুমি একশ’ হাত দূরে থাকো। তোমার রেকর্ড পরিস্কার। আগেও কখনও কোনো গ্যাঞ্জামে জড়াওনি। এমনকি তোফায়েল ও তোমাকে দেখতে পাবে না।” শুষ্ক হাসলো জাকি, “গুলিটা খাওয়ার আগ পর্যন্ত।”
মাথা দোলালো মুহিব। এখনই কোনো কথা দিতে সে প্রস্তুত না। তবে জাকির পরিকল্পনাটা মুফতে জানতে পারলে খারাপ কি। কাজেই আলাপ চালিয়ে গেলো সে, “আর রেদোয়ানের ব্যাপারে আপনার পরিকল্পনা কি? শামসভাইয়ের গলা সে-ই কেটেছে। তালিকায় তার নাম প্রথমে রাখা উচিত।”
বিষয়টা নিয়ে এতোবার আলাপ হয়েছে যে এতোবড় ঘটনাও হারিয়েছে নতুনত্ব। তবুও জাকির চোখজোড়া ক্রোধে জ্বলে উঠলো এক মুহূর্তের জন্য।
“তার বদলা সে পাবে। তবে দুইজনকে একসাথে সরানো সম্ভব হবে না। বড় মাছ এক বড়শি দিয়ে দুটো ধরার চেষ্টা করলে একটাও পড়বে না। আমরা ফাতনা গেলাবো একটা একটা করে।”
এরকম একটা ষড়যন্ত্রের মধ্যে বসে থাকতে মুহিবের ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে কোনো মানুষের পিঠে গুলি করার জন্য আয়োজন করা হচ্ছে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই এটা না। তবে নিজের কাছে তাকে স্বীকার করতেই হলো তোফায়েল তার জায়গায় থাকলে এটাই করতো। এর আগেও সে এধরণের কাজ করেছে। শামসকে সমানে সমানে লড়াই করার সুযোগ সে দেয়নি। চার-পাঁচ জন মিলে তাকে আক্রমণ করেছে। মাটির সাথে চেপে ধরে অসহায় অবস্থায় জবাই করে মেরে ফেলেছে। একজন ষড়যন্ত্রকারী আর কাপুরুষ হিসেবে তোফায়েলের সঙ্গে একই আচরণ ফেরত দেওয়া ঠিক আছে।
“কি মনে হচ্ছে তোমার? আর ইউ আপ ফর দিস?” উরুতে বন্ধুত্বপূর্ণ চাপড় দিয়ে জানতে চাইলো জাকি।
“এরকম একটা সিদ্ধান্ত আমি এক সিটিংয়ে নিতে পারবো না।” সত্য কথাটাই বলল মুহিব, “তাছাড়া কাজটা আমার কাছে কাপুরুষতা মনে হচ্ছে। যেন কারও পিঠে গুলি করতে যাচ্ছি।”
অন্তত গুলি করার ব্যাপারটা নিয়ে তাকে দুইবার চিন্তা করতে হয়নি, সে ভাবছে গুলি করার প্রক্রিয়াটা নিয়ে। বিষয়টা জাকির জন্য স্বস্তিদায়ক।
বন্ধুত্বপূর্ণ আরও দুটো চাপড় দিলো তাকে জাকি, “সময় নাও। আমি তো আর তোমাকে বলছি না এখনই গিয়ে ওকে গুলি করতে।”
রাজ্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে শেরে বাংলা হল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলো মুহিব। আজকে তাকে আলাদা করে ডেকে আনার অর্থটা পরিস্কার হয়েছে। শামীম এখনও মেসে সম্ভবত। ঘুমাচ্ছে। তাকে ডেকে তোলাও চলবে না। লিটুকে বিদায় দিয়ে আজকেই ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে ওরা। জাকি ভাইয়ের কল পেয়ে মুহিব বের হয়ে গেছে, শামীম সুযোগটা নিয়ে হাল্কা ঘুম দেবে সেটাই স্বাভাবিক। মুহিবও ঘুমাতে চাইছিলো, তবে জাকি ভাইকে পাওয়া সহজ কাজ না। নিজে থেকে সে দেখা করতে চেয়েছে মানে শামস মার্ডারের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবে ভেবে সময় নষ্ট করেনি আর। চলে এসেছে শেরে বাংলা হলে। সময়টা একেবারে নষ্ট হয়নি। জাকির পরিকল্পনাটা জানা গেছে।
তবে নিজের পরিকল্পনাটাও মুহিব জানে। সেখানে অনাকর্ষণীয় এক পিস্তল নিয়ে তোফায়েলকে গুলি করার দৃশ্যপট উধাও। জাকি গ্রুপের যদি প্রতিশোধ নেওয়ার এতো পিনিক থাকে তারা নিজেরা নিক। মুহিব এমনকি শামসের আপন বোনকেও প্রতিশোধ নেওয়ার তাড়া থেকে ঠেকিয়ে রেখেছে, সেখানে নিজেকে এর মধ্যে জড়িয়ে ফেলার মানে হয় না।
শিয়া এরকম কোনো পাগলামি করবে না। অন্তত ভাইয়ের সঙ্গে ঠিক কি ঘটেছিলো জানার আগে সে কিছু করবে না। তবে জাকি গ্রুপকে ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব। তাদের জানার আগ্রহ কম! একটা তথ্যই জানতে চেয়েছিলো তারা, খুনটা কে করেছে। সেই প্রশ্নের উত্তর তারা পেয়ে গেছে। মুহিবের ধারণা রেদোয়ানকে নিয়ে তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা আছে। তোফায়েলকে সরিয়ে দেওয়া গেলে রেদোয়ান একাকি সহজ এক টার্গেটে পরিণত হবে।
“আরে লেখকসাহেব যে।” কানের পাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠটা আরেকটু হলেই ওকে ছুট লাগাতে বাধ্য করেছিলো, “ইয়াং প্রিন্স চার্মিং!”
কণ্ঠে ব্যঙ্গের ভাব স্পষ্ট। মুহিবের ঠিক পাশে এসে থেমেছে তোফায়েলের বাইক। আজও একটা সানগ্লাস পরে আছে সে। কালো চশমার নিচে চোখের তারায় কি অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তা জানা সম্ভব না। চোখের পাশে কাটা দাগটা আজও স্পষ্ট। এই লোকটা কি তাকে অনুসরণ করছে? জাকির রুমে যাওয়ার ব্যাপারে কি সে জেনে ফেলেছে? মুহিবের গলার কাছে হৃৎপিণ্ডটা উঠে এলো যেন। ভাগ্যিস পিস্তলটা সঙ্গে নিয়ে আসেনি! বমাল ধরা পড়লে আর রক্ষা ছিল না।
“আসসালামু আলাইকুম, ভাই।”
সালামটা বিশুদ্ধ উচ্চারণে দিয়েই মুহিবের মনে হলো এটা করা উচিত হলো না। অতিভক্তি করা হয়ে গেলো। তোফায়েলের সঙ্গে সেই প্রথম ‘বিড়ি সেইভ’-এর ঘটনার পর থেকে খুবই ঠাণ্ডা সম্পর্ক ধরে রেখেছে ও। দেখা হলে সালাম কখনোই দেয়নি। সিগারেটও এরপর থেকে আর কোনোদিন লুকায়নি। দূরত্ব একটু বেশি হলে ইচ্ছে করে তাকে উদ্দেশ্য করে ধোঁয়া ছেড়েছে, যেমনটা হলে সিনিয়র একজন ছাত্র স্পষ্ট বুঝতে পারবে তার প্রতি ঘৃণাবশতই জুনিয়র ছাত্রটি এমন করলো, তবে কোনো কিছু বলতে পারবে না। সেখানে বিশুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দেওয়ার অর্থ মুহিবের মনেই শয়তানি। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ।
তোফায়েলও বা-ব্বা করে উঠলো সালামের বহর দেখে, “আজকে দেখি একেবারে সুফি, অ্যাঁ? উঠো, উইঠা পড়ো বাইকে। বাতাস খায়া আসি।”
তোফায়েল আর তার বাইকের দিকে সন্দেহের চোখে তাকালো মুহিব। নিশ্চিতভাবেই সব জেনে গেছে সে! তোফায়েলকে শুট করার আলাপ এতো খোলামেলা একটা জায়গায় ওরা কি ভেবে করলো? ঠিক আছে, শেরে বাংলা হল জাকিদের হল। তোফায়েল গ্রুপের কোনো সিনিয়র বা জুনিয়র ছেলে স্বাভাবিকভাবেই শেরে বাংলায় নাই, তারপরও কথা থেকে যায়। জাকির রুমের জানালায় যে কেউ আড়ি পেড়ে থাকতে পারে। সাউন্ডপ্রুফ রুম তো আর না। আর আড়িপাতা যে কারও জন্য চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার মতোই আলোচনা হয়েছিলো ওখানে। তারপর অসময়ে তোফায়েলের চেহারা মোবারক প্রদর্শনের জন্য একটা ফোনকলই যথেষ্ট।
“আরে তোমারে খায়া ফালামু না। উইঠা পড়ো মিয়া।”
এতো আবেগ নিয়ে তো এই লোক ইলোরাকেও তার বাইকে ডাকে না। চারপাশে তাকালো মুহিব, মানুষজন তেমন দেখা গেলো না। ওরা যখন ঢাকা থেকে ফিরছিলো, ক্যাম্পাসে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। পয়ত্রিশ ক্রেডিটের দাবি প্রশাসন মেনে নিয়েছে। এরপর বিজয়ের আনন্দে ছেলেমেয়েরা ক্যাম্পাসজুড়ে আনন্দ মিছিল করেছিলো। তারপর থেকে মেইন গেট আর তার সামনেটা তুলনামূলকভাবে নির্জন।
কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মানুষ বুঝতে পারে, এটা তার ক্ষতি করবে। তাও সে সেই সিদ্ধান্তই নেয় এবং পরে দেখতে পায় তার ধারণা একেবারেই ঠিক ছিল। ছুরি খেয়ে সেলেব্রিটি আসাদ এভাবেই তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলো। যখন সামনে ছয়-সাতজন টিচার-স্টাফের ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলো, তার ইচ্ছে হয়েছিলো প্রাণটা হাতে নিয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে যেতে। অথচ সে পালাতে পারেনি, তার আত্মসম্মানে বেঁধেছিলো পালাতে। আবার যখন সিদ্ধান্ত নিলো ওদের দিকে এগিয়ে যাবে, তখনও মন বলছিলো এই সিদ্ধান্ত তাকে খুব খারাপ এক ভবিষ্যতে নিয়ে যাবে। তারপরও সে ছুটে পালায়নি। ছিনতাইকারীদের সঙ্গে কথা বলতে গেছিলো এবং ছুরি খেয়ে হাসপাতালে পড়ে ছিল একটা সপ্তাহ।
তোফায়েলের বাইকে যখন মুহিব উঠে বসলো, আসাদের অনুভূতিটা সে সামান্য হলেও বুঝতে পারলো।
তুফানগতিতে বাইক ছোটালো তোফায়েল। স্টেট ইউনিভার্সিটির গেট থেকে ঐ গতিতেই বাইকটা বেরিয়ে এলো। তীরবেগে ছুটে ঢুকে গেলো পার্শ্ববর্তী তাজউদ্দীন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় দুটো, অথচ তাজউদ্দীনের তুলনায় স্টেট ইউনিভার্সিটি নেহায়েতই ক্ষুদ্র। সংস্কৃতিতে পিছিয়ে, শিক্ষক-ছাত্রের মানসিকতাও বেশ পশ্চাৎপদ। কেবলমাত্র পাহাড়সম ইগো আর ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স দিয়ে অনায়াসে তাজউদ্দীনকে পেছনে ফেলতে পারবে স্টেট।
বিশাল ক্যাম্পাসে প্রাণ খুলে বাইক ছোটানো যায়। তোফায়েলও টানলো ইচ্ছেমতো। এই ছোকরাকে অ্যামবুশ করে কতো সহজে উড়িয়ে দেওয়া চলে তা মুহিব এখন নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে। এমন বেপরোয়া গতিতে বাইক চালালে যে কেউ এর ঘিলু বের করে দিতে পারবে, পিস্তল-বন্দুকের প্রয়োজন কি? বাইকের পেছনে সামান্য যা ধাতব অবলম্বন পেলো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মুহিব। বাতাসে চুল এমনভাবে উড়ছে যেন ছিঁড়ে যাবে সব। টাক পড়ে যাবে ওদের সেকশনের জিসানের মতো।
বধ্যভূমির পেছনে বাইক থামালো তোফায়েল। আগে নামতে হলো মুহিবকে, তারপর নেমে এলো তোফায়েল। চারপাশে তাকিয়ে একটা কাকপক্ষীও দেখতে পেলো না মুহিব, মানুষ দূরে থাকুক। এখানে ওকে টেনে আনার অর্থ কি?
তোফায়েলের দিকে জিজ্ঞাসু চাহনি নিয়ে তাকাতেই এর জবাব পেয়ে গেলো মুহিব। একটা হাত ছুটে আসতে দেখলো সে, মধ্যমার আঙটিটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো শেষ বিকেলের আলোয়। ওপরের ঠোঁট থেকে রক্তের স্বাদ পেলো মুহিব, হাতে পেলো ঘাসের সজীব স্পর্শ।
ঘুষির প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে মাটিতে পড়ে গেছে ও, এতোক্ষণে বুঝতে পারলো। সেই সঙ্গে আরও দুটো ভুল ধারণা ভাঙলো তার। এক. ওপরের ঠোঁট নেমে আসা রক্তের স্বাদ পায়নি সে, স্বাদটা পাওয়া গেছে মুখের ভেতরে দাঁতের সঙ্গে ঘষা খেয়ে কেটে যাওয়া ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসা রক্তের। আর থুতনি বেয়ে গড়িয়ে নামা ধারাটা আসছে বাইরের ক্ষত থেকে। দুই. তোফায়েল তাকে এখানে আলাপ করতে নিয়ে আসেনি। এনেছে গুরুতর জখম করার জন্য।
দু-হাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলো মুহিব, মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করছে এখনও। হামাগুড়ি দিয়ে ঘাস থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাঁজরের ওপর প্রবল ধাক্কা অনুভব করলো। চার ফিট দূরের কাঁঠাল গাছে আছড়ে পড়লো ওর পিঠ, তখনও পা নামায়নি তোফায়েল। লাথির প্রচণ্ডতা অনুভব করে দ্রুত আরেকটা সিদ্ধান্তে পৌছে গেলো মুহিব, এই লোকের মারে জোর আছে।
তোফায়েল এগিয়ে আসছে। হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে বসলো মুহিব, পাঁজরে এসে পড়া লাথিটার সাথে সাথে সবটুকু দম হারিয়ে ফেলেছে সে। তোফায়েল এখন আরও কাছে, প্রবল ক্রোধে চোখ মুখ বিকৃত হয়ে আছে তার। চাইলে এখন শত্রুর গোড়ালির ঠিক ওপর বিদ্যুৎগতিতে বেমক্কা লাথি কষিয়ে তাকে ও মাটিছাড়া করে দিতে পারে মুহিব, তবে ক্ষ্যাপা জানোয়ার আরও ক্ষেপিয়ে না তোলার ব্যাপারে নিজস্ব কিছু শিক্ষা আছে ওর। কলেজ জীবনে বেশ কিছু মারামারির পরিণতি মুহিব দেখেছে। ছোটখাটো ক্ষততেই শেষ হতে পারতো ঐসব খণ্ডযুদ্ধ, তার বদলে মার খাওয়া পক্ষকে হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে দেখেছে ক্ষ্যাপা জানোয়ারকে আরও ক্ষেপিয়ে দেওয়ার কারণে। এখন তোফায়েলকে বাঁধা দিলে সে তাকে এখানেও মেরে ফেলতে পারে।
উঠে দাঁড়াতে অনেকটাই পরিশ্রম করতে হলো মুহিবকে। তোফায়েল ওকে কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই এভাবে পেটাতে শুরু করলো কেন! এসব ভাবতে চাইলেও পারছে না সে। মাথা কাজ করছে না, ঝিমঝিমানি বেড়েছে। জাকির সঙ্গে দেখা করার বিষয়টা জেনে ফেলেছে হয়তো, কিন্তু পুরোটা নিশ্চয় জানে না। পুরোটা জানলে ওকে স্রেফ পেটাতো না। মেরে ফেলতো ঠিক শামসের মতো।
নাকি মেরে ফেলার জন্য এখানে তাকে নিয়ে এসেছে তোফায়েল? খালি হাতে পিটিয়ে একজন মানুষকে মেরে ফেলার ক্ষমতা কি রাখে সে? নাকি সে জেনে ফেলেছে ব্ল্যাকমেইলিংয়ে মুহিবের হাত আছে?
তোফায়েল যেন ওর দাঁড়ানোর জন্যই অপেক্ষা করছিলো এতোক্ষণ। পুরোপুরি দাঁড়ানো মাত্রই আগের চেয়েও জোরে ঘুষি মারলো, এবার নাকে। মুহিবের মনে হচ্ছে সে একটা ভিডিও প্লেয়ারের ভেতর আছে। যখন সে নিজে থেকে নড়াচড়া করছে, দর্শক দেখতে পাচ্ছে রিয়েলটাইমের চার ভাগের একভাগ স্লো হিসেবে। যখন তোফায়েল মারছে তখন ভিডিও স্পিড বেড়ে হয়ে যাচ্ছে রিয়েলটাইমের চারগুণ ফাস্ট।
অন্তত ঘুষিটা নিয়ে চোখের পলকে মাথার পেছনদিকটা গাছের পেছনের ঠুকে যাওয়ার সময় তার এমনটাই মনে হলো। শরীরের সবখানে তীব্র ব্যথা পরক্ষণেই বুঝতে পারলো সবখানে নয়। কেবল নাকে, নাকের হাড়টা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে নিঃসন্দেহে। হাঁটুগেড়ে ওখানেই বসে থাকলো মুহিব, গাছের সাপোর্ট পেয়েছে বলেই হয়তো একেবারে ভূপাতিত হয়নি।
একটু নিচু হয়ে পাশ ফিরে থাকা চোয়ালে আরেকটা ঘুষি মেরে ওকে মাটিতে ফেলে দিলো তোফায়েল। আঙটিতে লেগে কানের ঠিক পাশ থেকে গালের অনেকখানি কেটে রক্ত বের হয়ে এলো এবার। আরও নিচু হয়ে তোফায়েল ওর চুল শক্ত করে ধরলো।
“এটা স্রেফ একটা ডেমো।” দাঁতে দাঁত চেপে বলল তোফায়েল। চুল ধরে রেখেই পর পর দুইবার মারলো ওর পেটে। মুহিবের চোখ উল্টে গেলো এবার। পরিবর্তনটা তৃপ্তির সাথে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে আবারও পেটে মারলো তোফায়েল।”ইলোরার সাথে এর পর মাখামাখি করে দেখিস, লাভার বয়। সেদিন ডেমো দেখানো হবে না এটা নিশ্চিত থাকতে পারিস।”
ওকে ছেড়ে দিয়ে বাইকের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েও ফিরে এলো তোফায়েল। মুহিবের উরুসন্ধিতে জোরে একবার লাখি দিলো। এবার সত্যিই কুঁকড়ে গেলো মুহিব। মুখ থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বেরিয়ে এলো অজান্তেই। শত চেষ্টাতেও এই একটা আর্তনাদ বুকের ভেতর চেপে রাখতে পারলো না।
মৃদু হাসলো তোফায়েল, অদ্ভুত আর নিষ্ঠুর এক হাসি। ওতে মিশে ছিল রক্তপিপাসা। মুহিবের আর্তচিৎকার ছাত্রনেতাকে অনেকটাই শান্ত করেছে এনেছে। ওর মনে হলো কেউ ওকে পিঠে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে, মাটিতে পড়ার আগেই অবসন্নতায় ছেয়ে গেলো দেহ। শুয়ে শুয়ে বাইকে চেপে বসা তোফায়েলকে তুফানবেগেই এলাকা থেকে বিদায় নিতে দেখলো ও।
প্রথম পাঁচ মিনিট মুহিব শত চেষ্টা করেও নড়তে পারলো না। ব্যথার অনুভূতিও সেভাবে টের পাচ্ছে না। নিজেকে রক্ষা করতে ইন্দ্ৰিয়গুলোকে ভোঁতা করে দিয়েছে শরীর। মুখের প্রায় পুরোটাই নিজের রক্তে মাখামাখি, তা বুঝতে পারছে পরিস্কার। কান বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, এতো অস্বস্তি লাগছে বলার মতো না। দুই পায়ের ফাঁকের যন্ত্রণার থেকেও বেশি ঝামেলার মনে হচ্ছে কানের সুড়সুড়ি। থুতনির রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করেছে, থকথকে একটা রূপ ধারণ করেছে ওরা। অর্থাৎ ক্ষতটা অতো গভির না। তবে রক্ত ভালোই পড়েছে। কি কুক্ষণে যে আজ সাদা টিশার্ট পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো! বুকের কাছে থকথকে রক্ত পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কোমর ভিজে কাদা হয়ে আছে, ওখানে রক্ত গেলো কি করে?
কাঁঠাল গাছ ধরে ধরে মুহিব দাঁড়াতে পারলো। দাঁড়ানোর সাথে সাথে সে কঠিন মার খাওয়ার একটা বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করে ফেললো। কঠিন মার খাওয়ার পর কোনোভাবে একবার দাঁড়াতে পারলে আর বসতে ইচ্ছে করে না। একটু খুঁড়িয়ে হলেও সে হাঁটতে পারছে। কোমরে টেনে ধরা যন্ত্রণাটা বাদ দিলে, হাঁটতে তার ভালোই লাগছে। মুহিবের দুই চোখ ইতিউতি করে রিকশা খুঁজছে, এটা সে অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারলো। মানুষ বিভ্রান্ত হয়, কিন্তু মানুষের অবচেতন বিভ্রান্ত হয় না। অবচেতন এখন সচেতনভাবেই রিকশা খুঁজছে।
দূর থেকে একটা রিকশা মুহিব দেখতে পেলো। রিকশা দেখে তার মধ্যে নতুন একটা ভয় জেঁকে বসে। এই রিকশায় সে যদি উঠে বসে তাহলে কি আর নামতে পারবে? কঠিন মার খাওয়ার পর একই রকম থাকতে ভালো লাগে। বসে থাকলে বসে থাকাই আনন্দের। উঠতে ইচ্ছা করে না। আবার উঠে গেলে আর বসতে ইচ্ছা করে না। কঠিন মার কিছুটা হলেও নিউটনের সূত্র মানবজীবন প্রতিপাদিত করে হয়তো।
রিকশা ডাকা গেলো না। কাছে আসার পর দেখা গেলো রিকশায় মানুষ আছে। শীর্ণকায় একটা মেয়ে, মুহিবকে বিকালের আলোয় পরিস্কার দেখতে পেলো মানুষ মনে হয় ভুত দেখলেও এতো চমকায় না। রিকশা তো থামালোই না, রিকশাওয়ালাও মনে হলো গতি বাড়িয়ে দিয়েছে।
বধ্যভূমি হিসেবে জায়গাটাকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। একাত্তরে এখানেই ছাত্রসহ সর্বস্তরের মানুষকে একত্র করে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। মেয়েদের হলগুলো এর কাছাকাছি। রাতের বেলায় মেয়ে দেখতেও কেউ এদিকে আসে না। সন্ধ্যার আগেভাগে বধ্যভূমির সামনে মুহিবের মতো রক্তমাখা সাদা কাপড় পরা কাউকে দেখা গেলে অনেকেই রিকশার গতি বাড়াবে।
“আরে মুহিব, তোমার এ কী অবস্থা!”
মিষ্টি কণ্ঠটায় উদ্বেগ। টলে উঠে রাস্তার মাঝেই পড়ে গেলো মুহিব। বাম হাতটা চকেছে, টের পেলো এতোক্ষণে। সারা শরীরে এতো ব্যথা আলাদা করে এতোক্ষণ বোঝেনি।
“কি হয়েছে তোমার?” একহাতে ওকে টেনে তোলার চেষ্টা করলো তূর্ণা।”কিছু না।” বলতে গিয়ে লক্ষ্য করলো ওপরের ঠোঁট সাড়া দিচ্ছে না। বিকৃত উচ্চারণ বের হচ্ছে মুখ থেকে। এর মধ্যেই প্রশ্ন করলো, “আপনি এখানে?”
“আমি এখানেই থাকি। এটা আমার ক্যাম্পাস।”
মোবাইল বের করে কাকে যেন ফোন করতে শুরু করলো তূর্ণা। নিশ্চিন্তভঙ্গিতে শক্ত আর রোদে পুড়ে গরম রাস্তায় মাথা ঠেকালো মুহিব। তূর্ণা এমন করছে কেন? ওর প্রশ্ন বুঝতে পারছে না কেন? ওর তো বাসা এ শহরেই, মেয়েদের হলে থাকার দরকার কি তার? ওকে উত্তর দিচ্ছে না কেন? মুহিবের মনে হচ্ছে এটাই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
“আপনি তো হলে থাকেন না?”
প্রশ্নটা করেই জ্ঞান হারালো মুহিব। তাজউদ্দীন বিশ্ববিদ্যায়ের নাম আর লোগো বসানো অ্যাম্বুলেন্সটার ছুটে আসা তার সেজন্যই দেখা হলো না।