1 of 2

কুকুরদল – ১৩

অধ্যায় ১৩

কমনরুমে বসে পাতা ওলটাচ্ছিলেন প্রফেসর শাহাবুজ্জামান। ইনাকে ছাত্রছাত্রিরা আড়ালে ডাকে সাবু। চাচা চৌধুরীর চরিত্র। ছাত্রছাত্রিরা যে তাকে সাবু ডাকে এটা তিনি জানেন। সে কারণেই হয়তো তাদের প্রতি এক বিজাতীয় বিদ্বেষ মনে পুষে রেখেছেন অনেকদিন ধরে। কথায় কাজে ক্ষণে ক্ষণে বেরিয়ে আসে তা। এই মুহূর্তে পেপারেও তেমন একটা খবর পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন।

“দেখুন না, জোতকার্তিকে শিক্ষক সমিতির বিরুদ্ধে আন্দোলন কালে তিন ছাত্র গ্রেফতার।” উৎসাহের আতিশয্যে পেপারখানা বাড়িয়েই দিলেন তার বন্ধুপ্রতীম সহযোগী অধ্যাপক হরিপদ গুপ্তের দিকে।

“কই আমাদের সময় তো এমন ছিল না।” নাক দিয়ে বিদঘুটে এক শব্দ তুলতে তুলতে বললেন শাহাবুজ্জামান, ‘পড়াশোনা করতে এসেছে। পড়াশোনা করবে। চার বছর পর চলে যাবে। আন্দোলন করবে কেন? এসব বেয়াদবদের বাড়িতে শিক্ষার অভাব, আমার ধারণা। নাহলে এধরণের বেয়াদবি কেউ করে না। এই তিন বেয়াদবকে জেলখানায় পাঠিয়ে দিক। দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক বাকি ছাত্রদের কাছে। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। বোঝেনি এখনও। হুঁহ!”

উষ্ণ এই বক্তব্যের পর আর কথা চলে না। কমনরুমে বেশিরভাগ শিক্ষকই ব্যস্ত। অধ্যাপকসাহেবের বাজে বকা শোনার সময় তাদের নেই। এখানে সাধারণত তারা একত্রিত হন ব্রেক স্টেটা করতে। শাহাবুজ্জামানকে শুধু যে ছাত্রদের অপছন্দ, তা নয়। এখানকার অনেক শিক্ষকও তাকে দেখতে পারেন না। তবে পেশাদারিত্বের খাতিরে সিনিয়র শিক্ষককে এ তো আর মুখ ফুটে বলা যায় না। বরদাস্ত করতেই হয়। হরিপদ গুপ্তও বরদাস্ত করে গেলেন।

“ওভাবে মাথা দোলাবেন না। ছাত্রদের প্রতি আমার মনোভাব আপনি অ্যাপ্রুভ করেন না মনে হয়।” ঠিক ধরতে পেরেছেন অধ্যাপক শাহাবুজ্জামান, তাই প্রতিবাদ করলেন না হরিপদসাহেব। তবে এতো সহজে ছাড়ার লোকই নন তিনি, “আপনার নামে কি চলছে তা হয়তো জানেন না। সেদিন শুনলাম ফার্স্ট ইয়ারের এক ছেলে বলছে ‘এরপরের ক্লাস হাগুর।” বুঝতে পারছেন অবস্থাটা? আপনার নামকে তারা কি বানিয়েছে? ছি ছি।”

“ইংরেজি ইনিশিয়ালস ধরলে নামটা ওরকমই হয়ে যায় যে।” অধোঃবদনে বললেন হরিপদ বাবু।”একটু রসিকতা তো করবেই। অল্প বয়স।”

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছিলেন প্রফেসর রবিন। তাকে দেখেই জোঁকের মুখে লবণ পড়লো যেন। পত্রিকা বাড়িয়ে দিলেন তার দিকে, “আপনার সামনে তো আবার ছাত্রদের দোষ ধরাই যায় না, রবিনস্যার। নিন, দেখুন। গুণধর এই পুত্রদের কাজটা শুধু দেখুন। একেবারে পেপারে উঠে এসেছে।”

পেপারটা হাতে নিলেন না প্রফেসর। একবার হেডলাইনটা দেখেই মাথা দোলালেন। এক হাতে ব্যাগ, আরেক হাত কনুই থেকে কাটা। অদ্ভুত উপায়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে নিজের লকারের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। লকার খোলার আগে পায়ের কাছে নামিয়ে রাখলেন ব্যাগ। সেই হাত পকেটে পুরে বের করলেন লকারের চাবি। তারপর লকার খুলে আবারও পকেটে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন হাত, যথাস্থানে চাবি রাখছেন। সবশেষে নিচু হয়ে ব্যাগটা তুলে লকারে ভরলেন। এরপর ফিরে এলেন টেবিলের কাছে। আর্দালি–কাম-ওয়েটার জলীল ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার নাস্তা নিয়ে ঢুকলো।

কমন রুমের সবার কান খাড়া হয়ে গেছে। শাহাবুজ্জামানের সঙ্গে রবিনস্যারের দ্বন্দ্ব যে প্রথম দিন থেকেই লেগে আসছে তা তারা জানে। এসবকে তারা বলেন নির্দোষ রঙ্গ। এ ওকে আক্রমণের চেষ্টা করবে, আর দ্বিতীয়জন করবেন প্রতিরক্ষা। এক বিতর্ক প্রতিযোগিতা যেন। প্রফেসর রবিনকে অবশ্য তারা কেউ আক্রমণ করতে দেখেননি। তিনি প্রতিরক্ষা বিভাগটিকেই কব্জা করেছেন। শাহাবুজ্জামানসাহেব নিজের চেম্বারেই নাস্তা করতেন আগে। পদমর্যাদার ব্যাপার আছে।”আত্মসম্মানের” ব্যাপার আছে। তবে প্রফেসর রবিন কমনরুমে রেগুলার হওয়ার পর তিনিও ধীরে ধীরে ঢোকা শুরু করেছেন। এখন তো তাকে নিজের রুমে পাওয়াই দুষ্কর। রবিনসাহেবকে ভুল প্রমাণ করতে না পারলে তার রাতের ঘুম সম্ভবত ঠিকমতো হচ্ছে না।

তারই আরেক প্রচেষ্টা এই নাকের সামনে দ্বিতীয়বার পত্রিকা ঠেলে দেওয়া। রবিনস্যার অবশ্য আবারও দেখেও না দেখার ভান করলেন। তার বদলে অল্পবয়সী ম্যাডামটির দিকে তাকালেন, “মিস নীতু, আপনার জ্বর সেরেছে?”

ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠলো নীতু। সেরেছে। জ্বর নয়, তার ভাগ্য। রবিনস্যার নিজের প্রতিরক্ষা বুহ্যে তাকেও টানছেন। এর ফলাফল বিশেষ শুভ হবে না কারও জন্যই। প্রথমত, শাহাবুজ্জামান ধরেই নেবেন এখানে গুঢ় এক ষড়যন্ত্র না হয়েই যাচ্ছে না। নতুবা একজন সিনিয়র শিক্ষককে অগ্রাহ্য করে জুনিয়র শিক্ষিকার সাথে কেন কথা বলবেন প্রফেসর রবিন? টিচার্স

কমিউনিটিকে টেনে এনে তর্ক করছেন প্রতিপক্ষ—এটাই ধরে নেবেন শাহাবুজ্জামান। কাজেই বিষ ঝাড়ার জন্য তিনি বেছে নেবেন একজন নগণ্য লেকচারারকে। আর নীতুই সেই লেকচারার। দ্বিতীয়তঃ রবিনস্যার তাকে নিয়ে ইদানীং যে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, এতে করে সহকর্মী মহলে হাসি ঠাট্টা চলছে। আজকের পর সেই ঠাট্টা আরও বাড়বে। এরই মধ্যে লম্বা টেবিলের ওই পাশে ব্যাচমেট মনিরকে মুখ লুকিয়ে হাসতে দেখা যাচ্ছে। হারামজাদা ছিল তার ব্যাচের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। অবশ্য শিক্ষক হয়ে যাওয়ার পর ক্যাম্পাসের মাটিতে তাকে এই নামে আর ডাকা যায় না। নীতু একবার চারপাশে খেয়াল করে দেখলো অন্য কেউ দেখছে না তার হাসি। সবাই মনোযোগ দিয়েছে নীতুর দিকে। খেয়াল করলো বেশ কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে রবিনস্যারের প্রশ্নের পর। হাতের নোটবুকটা দ্রুত নামিয়ে রাখলো সে।

“জি, স্যার। আল্লাহর রহমতে এখন ভালো।”

বলেই দ্বিতীয় দফা জিভ কাটলো সে। রবিনস্যার আল্লাহ খোদা বিশ্বাস করেন না বলে প্রবল এক জনশ্রুতি আছে। তিনি নিজ মুখে কখনও এমনটা বলেননি। তবে জনপ্রিয় বিশ্বাস হলো, প্রফেসর রবিন নাস্তিক। ধর্মে বিশ্বাস করেন না। এ প্রসঙ্গে ডিপার্টমেন্টাল হেড একদিন উত্তপ্ত কিছু বাক্য ব্যবহার করেছিলেন। ওই সভায় নীতুও ছিল। ভাগ্য ভালো রবিনস্যারের কানে এসব কিছু আসেনি। এলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো একেবারে। তবে আল্লাহর নাম নেওয়া হলে প্রফেসর রবিনের চেহারায় বিতৃষ্ণার ছাপ পড়ে। এই ছাপ কারও চোখ এড়ানোর মতো নয়। তাছাড়া তাকে কখনও মসজিদে যেতে দেখা যায়নি। শুক্রবার পর্যন্ত না। এই মুহূর্তেও তার কোনও ব্যত্যয় ঘটলো না। গম্ভীর মুখে মাথা দোলালেন তিনি, দু-বার। তারপর তাকালেন শাহাবুজ্জামানের দিকে।

“জোতকার্তিকের ভিসি কি করেছেন জানেন?”

এই দিক থেকে প্রশ্ন আসবে তা শাহাবুজ্জামান আশা করেননি।

“কয়দিন ধরে ওখানে ছাত্ররা আন্দোলন করছে তার খবর রাখেন?”

এই খবরও শাহাবুজ্জামান রাখেননি। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরই রাখেন না যিনি তিনি কি আর বাইরের এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজ নেওয়ার ঝামেলা করবেন?

“অনেকদিন ধরেই তো শুনছি তারা আন্দোলন করছে। ভিসির পদত্যাগ চায় তারা।” কমজোর গলাতেই বললেন তিনি।

“এক মাস দুই দিন হলো তাদের আন্দোলনের। জাতীয় পর্যায়ের একটা আন্দোলন করে ফেলছে তারা। দেশের প্রায় কারও জানতে বাকি নেই তাদের কথা।” একটু থেমে শাহাবুজ্জামানকে দেখলেন তিনি, “মানে, প্রায় সবার।”

“আপনি তাদের এই নারকীয় আন্দোলনকে সমর্থন দেন নিশ্চয়?” প্রচ্ছন্ন খোঁচা দিয়েই প্রশ্নটা করলেন শাহাবুজ্জামান।

“মানসিকভাবে সুস্থ এবং ব্যক্তিগতভাবে সৎ এমন যে কোনও মানুষই তাদের সমর্থন দেবে।”

রবিনস্যারের উত্তর শুনে না হেসে পারলো না নীতু। তবে অবশ্যই মুখ চেপে। সাবুর চোখে পড়লে খবর আছে।

“ ঝেড়ে কাশুন, রবিনসাহেব। আপনার অবস্থান কিন্তু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দেওয়া এই উত্তরে জানা গেলো না।”

জলীল নাস্তা নিয়ে এসেছে। তাকে বিদায় করে স্যান্ডউইচে কামড় বসালেন রবিনস্যার, “আন্দোলনের কারণটা কি জানার চেষ্টা করেছেন?”

মুখ দিয়ে বিদঘুটে এক শব্দ করলেন শাহাবুজ্জামান, “ভিসি স্যারকে তারা বলছে করাপ্ট।”

“আপনি তাদের কথা বিশ্বাস করছেন না। তাই তো?”

“তাদের বয়স হয়েছে একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষকে জাজ করার মতো? সেই যোগ্যতা আছে তাদের?” গলার রগ ফুলিয়ে জানতে চাইলেন শাহাবুজ্জামান।”স্বয়ং প্রেসিডেন্ট স্যার যেখানে ভিসিকে মনোনয়ন দিয়ে ওই পদে বসিয়েছেন!”

“আচ্ছা।” কৌতুক খেলে গেলো রবিনস্যারের চোখে, “এমনটাই মনে করেন আপনি?”

“অবশ্যই। একজন ছাত্রের যোগ্যতা আছে তার শিক্ষককে জাজ করার? সেদিন কমনরুমে পোস্ট দেখলাম, আমাদেরই এক ছেলে লিখেছে। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পর নাকি ছাত্রদের থেকে মতামত নিতে হবে। ট্রায়াল ক্লাস নিতে হবে লেকচারারদের, সেই ক্লাস ভালো লাগলো না খারাপ লাগলো তা নাকি ছাত্ররাই ইভ্যালুয়েট করবে! ছাত্ররা যদি চল্লিশ শতাংশ বা তার বেশি না ভোট দেয়, তো সেই শিক্ষককে বের করে দিতে হবে। চূড়ান্ত পর্যায়ের নিয়োগ তাদের দেওয়া যাবে না। চিন্তা করলেন বেয়াদবিটা? তারা এখন ঠিক করবে কিভাবে আমরা চাকরি পাবো?”

শাহাবুজ্জামান স্যারের সাথে একমত হয়ে মাথা নাড়লেন আরও দুই

সহযোগী অধ্যাপক। তবে রবিনস্যার নিজের অবস্থানে অনড়।

বেয়াদবির কি হলো এখানে? আপনারা পড়াতে পারবেন না, আপনাদের পড়া তাদের বুঝতে সমস্যা হবে। এরপর প্রশ্ন আসবেই তাদের মনে, এ কেমন শিক্ষক?”

মনিরও ফিক করে হেসে ফেললো।

“আদব-বেয়াদবির ট্যাগ দিয়ে তো আর সত্যটা সরাতে পারবেন না তাদের চোখের সামনে থেকে। তাই না? মেকানিক্যালে সিএসই পড়াতে পাঠিয়েছিলেন কাকে? রুশদি তৌকিরকে। তৌকির ছেলেটা এই ভার্সিটি থেকে পাশ করেছে ফোর আউট অব ফোর নিয়ে। গোল্ড মেডাল দিয়েছেন ভিসি স্যার। তুখোড় এক ছাত্র সে, কোনও সন্দেহ নেই। তাকে আপনারা বানালেন শিক্ষক। তার কোর্সে ফেল করেছে চুয়ান্ন জন। ষাটের মধ্যে।”

শাহাবুজ্জামান কথা খুঁজে পেলেন না।

“শিক্ষক হিসেবে সে ডি-গ্রেড পাওয়ারও যোগ্য না। আপনারা ব্লেম করেছেন ঐ চুয়ান্নজন ছাত্রকে। বাসায় শুনলাম চিঠিপত্রও দিয়েছেন। একজনও কি তাদের সাথে কথা বলেছেন?”

পুরো কমনরুমের দিকে তাকালেন রবিনস্যার। এদফায় সবার মুখ থেকে হাসি মুছে গেছে। মনির আর নীতুও মনোযোগ দিয়ে টেবিলের কাভার দেখতে থাকলো।

“আমি ওদের সাথে কথা বলেছি। ওরা তখন আমাকে জানালো রুশদি তৌকির, আপনাদের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট কিভাবে তাদের পড়াতো। লাইব্রেরি ফাংশন না বুঝিয়ে গাধাটা দ্বিতীয় লেকচারে বুঝিয়েছে অ্যারে। লাথি দিয়ে তাকে টিচার্স কমিউনিটি থেকে বের করে দেওয়া দরকার।”

“অবজেকশন, রবিনস্যার। আপনি শিক্ষক হয়ে আরেকজন শিক্ষকের সম্পর্কে এমন এক মন্তব্য করতে পারেন না।”

প্রবল বেগে মাথা দোলালেন প্রফেসর, “আপনারা পারলে আমি কেন পারবো না? দেশের বাইরে ছিলাম তাই ব্রিটিশদের মতো ভদ্ৰ বক্তব্য আশা করছেন, এই তো?”

“আমরা কখনোই “

“ সেদিন হেড স্যারের রুমে আপনারা মিটিং করেছেন। হেডস্যার আমাকে নাস্তিক বলেছেন, শুয়োরখেকো বলেছেন।” পাংশু হয়ে গেলো মিটিংয়ে উপস্থিত সবার মুখ।”এধরণের ব্যক্তিগত আক্রমণ করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে বলুন? সেখানে তো আপনিও উপস্থিত ছিলেন শাহাবুজ্জামানসাহেব। আমার অপরাধটা কি বলতে পারেন? ধর্ম সংক্রান্ত আলাপ আলোচনায় যোগ দেই না সেটাই তো? আমাদের কর্ম তালিকায় কি বড় করে কোথাও লিখা ছিল, প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনা করতে হবে? ছিল না। আমার দায়িত্ব আমি অবহেলা করি? দায়িত্বে অবহেলার কারণে আমাকে গালি দিতে পারবেন? পারবেন না।”

“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে—”

“নির্জলা মিথ্যেচারের দরকার নেই, শাহাবুজ্জামানসাহেব। আপনি একজন শিক্ষক। দেশের আর দশজন মানুষ আপনাকে আদর্শ মানে। মিথ্যে বলার অভ্যাসটা সরিয়ে ফেলবেন সম্ভব হলে। হেড স্যারের বক্তব্যে তো আর আপনার হাত নেই। মিথ্যে বলছেন কেন?”

কমনরুমে এখন নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা।

“আমি রুশদি তৌকিরকে নাম ধরে লাথি দিতে চেয়েছি, কারণ সে দায়িত্বে অবহেলা করেছে। এরকম ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ছেলেমেয়েদের আমাদের দরকার নাই। এরা একদিন পুরো ক্যাম্পাসকে কবরস্থান বানিয়ে ফেলবে। এধরণের শিক্ষক নিয়োগ তো দেন আপনারা, যারা কমিটিতে আছেন। আমি তো দেই না। তাই লাথি মারতে চেয়েই ক্ষান্ত দেই। দিতে পারি না।”

কমনরুমের নিস্তব্ধতা বজায় থাকলো।

“তৌকিরের কানে আমার কথাটা পৌছে দেবেন পারলে। বলবেন সে যেন আমার নামে মানহানির মামলা ঠুকে। তাকে এক হাত দেখার ইচ্ছে আমারও আছে। পুরো একটা ব্যাচ প্রোগ্রামিং-এর পি–পর্যন্ত শিখতে পারেনি। এদের তো রিটেক করানোও যাবে না, সেই উপায় রাখেন নাই আপনাদের নীতিনির্ধারক। সাত দিন পড়ে ব্যকলগ পরীক্ষা দিতে বসবে। টেনেটুনে হয়তো পাশ করে যাবে, কিন্তু প্রোগ্রামিং সাতদিনে শেখার জিনিস না। এই কম জানা ছেলেগুলোই এখান থেকে ইঞ্জিনিয়ার হবে। এই দায় কার?” সবার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমবার খেয়াল করলেন যেন তিনি, “এহহে, আমাদের আলোচনা তো বাকিদের মন খারাপ করে দিচ্ছে। আপাতত নাহয় থাকুক শাহাবুজ্জামান স্যার। আমরা এ নিয়ে পরে আরও কথা বলবো।” একটু হাসলেন তিনি, “তাছাড়া, লুক অ্যাট দ্য ব্রাইট সাইড। আমাদের হাতে মনিরের মতো ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট টিচারও আছে।”

একটু হাসলো মনির, “আমার কিন্তু স্যার ফোর আউট অব ফোর না।”সেজন্যই হয়তো বাঁচা গেছে।” মুচকি হেসে বললেন প্রফেসর, “তবে যা নিয়ে কথা হচ্ছিলো। জোতকার্তিকেরর ভিসি নর্দমার মতোই নোংরা। দুই নম্বুরি করার জন্য সে ওখানে প্রো-ভিসি পদও চালু করেছে। ছাত্র রাজনীতি করে একটা ছেলে, তার সিজিপিএ ছিল টু পয়েন্ট এইট নাইন। আপনার মতে ছাত্ররা যাকে জাজ করার অধিকার রাখে না, সেই ভাইস চ্যান্সেলর ওই রাজনীতি করা ছেলের ফাইনাল রেজাল্টে বসিয়ে দিয়েছে থ্রি পয়েন্ট এইট নাইন। এক পয়েন্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। কি এমন অন্যায় করেছে বলুন?”

এর জবাব শাহাবুজ্জামান দিতে পারলেন না।

“আর এই জানোয়ারটার বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে বলে পুলিশ সাধারণ ছাত্রদের ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। জানোয়ারটা গদি ছাড়বে না তাও। দেখুন না আরও কতো কি হবে। তরুণ প্রজন্মকে পাত্তা না দিলে কি ঘটতে পারে তা আপনারা জানেন না হয়তো। আমি জানি। ছাত্রদের বিনা কারণে শত্রু বানান। তাদের মধ্যে যে সম্ভাবনা আপনার মধ্যে তো সেটা নাই। বুড়ো হয়েছেন আপনি, আমরা সবাই। নতুন কিছু করার বয়স আমাদের কারও নেই; তবে ওদের আছে। ভুল বললাম?”

খাবারের অবশিষ্টাংশ ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি টয়লেটের দিকে যাচ্ছেন। দরজা খুলে আরেকবার তাকালেন কমন রুমের ভেতরে।

যে তিনজনকে আজ পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে, তারা প্রত্যেকেই আপনার চেয়ে বেশি যোগ্যতাধারী হতে পারে ভবিষ্যতে, অসম্ভব না। তাদের অসম্মান করে কথা বলছেন, তাদের আপনি জাজ করছেন, এটা আমার অপছন্দের একটা কাজ। আমি এই আলোচনায় যোগ দেবো না।

দরজা বন্ধ হয়ে গেলো শাহাবুজ্জামানের বিস্মিত মুখের সামনে। নাস্তিকটা তাও ছাত্রদের পক্ষই নিয়ে কথা বলে গেলো! প্রবল আক্রোশে পেপারটাকে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলেন অধ্যাপকসাহেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *