1 of 2

কুকুরদল – ২৯

অধ্যায় ২৯

আননোন নাম্বারটা দেখেই তোফায়েল বুঝতে পারলো অতোটা অচেনাও নয় এই কনট্যাক্ট নাম্বার। মেরুদণ্ডে শিরশিরে অনুভূতি হলো ওর, এই নাম্বার থেকেই ফোন এসেছিলো সেদিন। টেবিলের অপর প্রান্তে ইলোরার সুন্দর মুখটা আগ্রহের সাথে কিছু একটা বলে যাচ্ছে। এরকম একটা পরিবেশ থেকে তোফায়েলের মনোযোগ অন্য কোনোদিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কারও ছিল না, শুধু এই ফোনকলটাই সব গড়বড় করে দিলো।

“এক সেকেন্ড, বেবি।” হাত তুলে বলল তোফায়েল, “এই ফোনটা আমাকে ধরতে হবে। হাই কমান্ড।”

মেকি হাসিটা মুখে ঝুলিয়ে ইলোরার সামনে থেকে সরে এলো সে। রেস্তোঁরার বাইরের বের হয়ে রিসিভ করলো ইনকামিং কলটা। এখান থেকে নদীর চমৎকার ভিউ পাওয়া যায়। রিভারভিউ নামটি একেবারেই যুতসই হয়েছে।

প্রত্যাশিত নারীকণ্ঠটি ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলল, “ দেরি করতেছোস ক্যান, র‍্যাড? কুইক, ম্যান।”

প্রথমদিনের মতো চমকে গেলো না তোফায়েল। আজকে সে সম্পুর্ণ প্রস্তুত। রেলিংয়ে একটা হাত রেখে দূরের নিঃসঙ্গ নৌকার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, “আমি সোজা সাপ্টা কথার মানুষ। প্যাঁচ খেলানো আমার পছন্দ না। সরাসরি জানতে চাইবো, ঠিক কি চাইছেন আপনি আমার থেকে?”

খিলখিলে নারীকণ্ঠের হাসির শব্দ ভেসে এলো এবার। মেয়েটার বয়স খুব বেশি না। উনিশ থেকে পঁচিশের মধ্যে যে কোনো একটা হতে পারে। গলা শুনে এই বয়সের মেয়েদের একটা বছরে আটকে ফেলা যায় না।

“আমি চাই তুই রেদোয়ানের স্মৃতির কুঠুরিতে একটা দোলা দে।” নারীকণ্ঠটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো এবার। যেন কোনো কবিতার লাইন ভেঙ্গিয়েছে কেবল, খুব মজার কিছু ঘটে গেছে।

“সত্য বলতে, সে এরই মধ্যে দুলছে।” একটু ভেবে যোগ করলো তোফায়েল, “তবে আমার ধারণা আমাদের দেখা হওয়া উচিত।”

“দেখা হবে। তোর চামচিকার মতো গলা শোনার জন্য তো আর ফোন দেই নাই। আচ্ছা, তোর সাথে ঐ মেয়েটা থাকে কি দেখে আমাকে বোঝা তো? ইলোরা নাম না ওর? মেকানিক্যালের? তোর পার্সোনালিটি মাগিদের থেকেও খারাপ, গলাখান ছাড়লে রাস্তার কুত্তাও মুখ খোলার সাহস পায় না, সেই সাথে চেহারাও তো ধর্ষকের মতো…” আবারও খিলখিলে হাসিতে ফেটে পড়লো ফোনের অন্যপ্রান্তের মেয়েটা, “ওহ সরি, তুই তো আবার পার্ট-টাইম সিরিয়াল ধর্ষকও। কি আয়রনি!”

রেলিং শক্ত করে খামচে ধরলো তোফায়েল, “ইলোরাকে এর মধ্যে টানবি না!”

“টানবো না? ওমা!” খুব অবাক হয়ে যাওয়ার ভান করলো মেয়েটা, “বেশ বেশ। বেশ। তালিকার সবার ওপর অবশ্য ওরই নাম রেখেছিলাম।”

তোফায়েল লক্ষ্য করলো ওর মুখ ঘামে ভেসে যাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলে এমনটা হয়, আগেও লক্ষ্য করেছে।

“কিসের তালিকা?”

“ইনফ্রা রেড ক্যামেরায় তোলা তোদের বীরপুঙ্গবদের যে ছবিগুলো ধরেছিলাম সে রাতে, তাদের প্রিন্টেড কপি কাদের দেবো সেই তালিকা। টাইম স্ট্যাম্প আছে বিলকুল বিলক্ষণ। শামস মার্ডারের সাথে সময় মিলিয়ে দেখতে কারও সমস্যা হবে না।” চাপা হাসির শব্দ এবার, “তো, আমার যেটা ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে, প্রেমিকের হাতে রক্ত দেখতে পেলে মেয়েটা কি করবে? চমৎকার একটা নাটক হবে যা হোক।”

তোফায়েল এখন কুল কুল করে ঘামছে। ইলোরা তাকে কি বলেছিলো তা মনে পড়ে যাচ্ছে এখন। আমি এতোদিন শুনেছি আপনি কোন স্তরের জানোয়ার। শোনা কথায় আমি বিশ্বাস করি না। তাই নিজের চোখে সেইটা দেখতে আসছি।

অজানা ব্ল্যাকমেইলার তাহলে ইলোরার চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ নিতে চলেছে। সেই দিন রাতে যা ঘটেছে তার সবটাই ভুল ছিল, যতো দিন যাচ্ছে ততো এই উপসংহারে থিতু হচ্ছে ও। এতো রাতে নাকি খানকি একটা মেয়ে ইনফ্রা রেড ক্যামেরা ধরে ঐ জঙ্গলে বসে ছিল! এ কেমন খানকি?

মিথ্যে কি বলছে খানকিটা? তোফায়েলের তা মনে হয় না। উদ্ধৃতি ধরে ধরে তাদের সেরাতে হওয়া কথোপকথন বলে দেওয়া ওখানে উপস্থিত নয় এমন কারও পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু এতোদিন পরে কেন? এতোদিন পর যখন ওরা মনে করছে শামসের ঘটনাটা ভুলে নতুন কিছু শুরু করা যেতে পারে, তখন কেন এই গায়েবী ব্ল্যাকমেইলার উড়ে এসে জুড়ে বসলো?

“আমার কাছে কি চাস তোরা? টাকা?” চেষ্টা করেও গলা নামিয়ে রাখতে পারলো না তোফায়েল।

“ব্যস্ত হওয়ার কিছু নাই। পরে জানানো হবে। অনুগ্রহপূর্বক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন।” খিলখিলে হাসিটা শুরু হলো আবার। হাসির মাঝপথেই ফোনটা কেটে দিলো রহস্যময় নারী।

বিভ্রান্তি আর হতাশায় রেলিংয়ে দু-হাত দিয়ে জোরে থাবা মারলো তোফায়েল।

*

মুহিবের ছয়-ফিট বাই সাত ফিট ঘরে প্রায় দু’মাস পর পা রাখলো শামীম চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, আগের থেকে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি ঘরটায়। ছোট্ট খাটটায় জমে থাকা বইয়ের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। বেড়েছে কাপড়ের স্তুপ, খাটের এক কোণে এখনও ভাঁজ করে রাখা আছে সেই লেপটা। এই চল্লিশ ডিগ্রির গরমে মুহিব লেপ দিয়ে কি করে কে জানে! লেপের কভারের ময়লার স্তর আরও পুরু হয়েছে।

কানে হেডফোন, মুহিব তখন ঝড়ের বেগে টাইপ করছে। দরজা খোলা রেখে ওকে কখনও লিখতে দেখেনি শামীম। চুপচাপ চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। এই মুহূর্তে মুহিবকে দেখে মানুষ মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে যন্ত্র। শিরদাঁড়া সোজা করে চেয়ারে বসে আছে সে। ঘাড় টানটান, চোখের দৃষ্টি সরাসরি সামনের মনিটরে। এক চুল নড়ছে না শরীরের কোনো অংশ, কেবলে দু-হাতে কব্জির নিচে দশটা আঙুল বুকে হেঁটে চলা কোনো প্রজাতির মতো অনিয়মিত ছন্দে আছড়ে পড়ছে টেবিলের ওপর রাখা কালো কিবোর্ডে। যন্ত্রের মতো এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিখে যায় মুহিব, এমনটা শামীমের জানা আছে। এটা নাকি তার “স্নায়ু ঠাণ্ডা রাখতে” সাহায্য করে। কিভাবে তা করে এটা শামীম জানতে চায়নি। কতোরকম পাগল আছে দুনিয়ায়।

একদিন চায়ের দোকানের আড্ডায় মুহিবের কব্জির নিচে যেখানে পালস মাপতে হয় সে জায়গাটা কুচকুচে কালো হয়ে থাকতে দেখে জানতে চেয়েছিলো জায়গাটা পুড়ে গেছিলো কি না। মুহিব তখন ওকে দেখতে দিয়েছিলো তার কব্জি। দু-হাতের একই দশা। কালশিটে পড়ে গেছে ওখানটায়। কালো কালো দাগ। মুহিব হেসে বলেছিলো, “এটা হলো রাইটার’স মার্ক। কেউ যদি বলে সে লেখালেখি করে তাহলে প্রথমেই হাতে রাইটার’স মার্ক খুঁজবি। যদি না পাস তাহলে বুঝবি সেই লোক অলস। সে আমার বালের লেখক। লেখক হতে হলে কব্জিতে কালশিটে অবশ্যই ফেলতে হবে। এতোটুকু পরিশ্রম না করলে আবার লেখক পরিচয় দাবি করা কি?”

এই মুহূর্তে পরিশ্রমের খণ্ডচিত্র দেখে অবাক হলো না শামীম। মুহিব এভাবে গত চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে বসে আছে, সে জানে। ক্লাস আপাতত হচ্ছে না। তার বদলে হচ্ছে আন্দোলন। অ্যাড বিল্ডিংয়ের সামনে ছেলেরা খাট পালঙ্ক বিছিয়ে বসে পড়েছে। ভিসি স্যারকে তার অফিসের মধ্যেই ঘেরাও করা হয়েছে। সরাসরি ভিসি স্যারের দরজার বাইরে অনেক ছেলে অবস্থান নিয়েছে। ওখানে নানা রকম নাটক হচ্ছে। ভিসি স্যারকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। জুনিয়র কিছু ক্ষমতালোভী শিক্ষক এগিয়ে এসেছিলেন। তারা ছাত্রদের নিরস্ত করার চেষ্টা না করে বলেছিলেন, “দেখি, রুমের ভেতরে যেতে দাও তো।”

বিপদের সময় ভাইস চ্যান্সেলরের পাশে দাঁড়ানোর আলাদা মর্যাদা আছে। সেই মর্যাদা লাভের সুযোগ প্রতিদিন পাওয়া যায় না। মর্যাদা লাভের লোভে অনেক শিক্ষক ব্যতিব্যস্ত হয়ে ভাইস চ্যান্সেলর স্যারের রুমে ঢুকে পড়েছেন। আহাজারি করেছেন, ছাত্রদের নিন্দা করেছেন। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিস থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না এতো রীতিমতো ক্রাইম! তারপর ভিসি স্যারকে তারা আশ্বাস দিয়েছেন এখনই বাইরে গিয়ে তারা সর্বশক্তিতে এই বেয়াদব ছাত্রদের বিরুদ্ধে নামবেন। সেই মর্মে ভিসি স্যারের রুমেই মিটিং ডাকা হয়েছিলো। যেহেতু ভিসি স্যার বাইরে বের হতে পারছেন না, তাই সবাইকে ভেতরে ডাকা। একে একে অন্য শিক্ষকরাও মিটিংয়ে যোগ দিতে উপাধ্যক্ষের অফিসে ঢুকে পড়েছিলেন।

মিটিং শেষ হওয়ার পর ছাত্রদের পরিকল্পনার চাতুরিপূর্ণ অংশটা টের পেলেন তাঁরা। শিক্ষকদের দলটাকে অফিস ঘেরাও করা ছাত্ররা ভেতরে হাসিমুখে ঢুকতে দিয়েছে কেন তাও স্পষ্ট হয়ে গেলো। ভেতরে যারা ঢুকে পড়েছে তাদের আর কোনোমতেই বের হতে দিচ্ছে না তারা। একবার ঢুকে পড়েছেন যখন, তখন বেশ, থাকুন না! তারা অবরুদ্ধ করা শিক্ষকদের খাবার আর পানিও অফার করেছে। আত্মসম্মানবোধের উদাহরণ ধরে রাখতে মনুমেন্টের সমান ইগোধারীরা সেই খাবার ছুঁড়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছেন।

ভিসি স্যারকে তার অফিসে অবরুদ্ধ করার পরিকল্পনাটা সখের বশে করা হয়নি। প্রশাসন গত চল্লিশ বছর ধরে ছাত্রদের একটা দাবিকেও পাত্তা দেয়নি। যদিও বা কোনো দাবি মেনে নিয়েছে, তার বদলে দিয়েছে নানা রকম যন্ত্রণা। পরীক্ষা পেছানোর দরখাস্তে সাইন করার পর সেই পরীক্ষার ডেট তিন মাস পর দেওয়া, একদিনের ছুটির দরখাস্ত সাইন করে এক মাসের জন্য ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি ধরণের আচরণ থেকে প্রশাসন তাদের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতাই বার বার নির্লজ্জের মতো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। নিঃশর্ত দাবি মেনে নেওয়ার ঘটনা এখানে ঘটানোটা কঠিন। কঠিন সময় নিয়ে আসে কঠিন সব সিদ্ধান্ত, সেখান থেকেই শিক্ষক অবরুদ্ধ করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

তবে এই কাজটা করার জন্য পর্যাপ্ত সাহস জোগাড় করা গেছে শিক্ষকদের আক্রমণাত্মক ভূমিকার কারণেই। প্রথমদিন সকালে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য মেয়েদের হল থেকে মেয়েরা বের হচ্ছিলো। তাদের এসকর্ট করে আনতে গিয়েছিলো দুইশজন ছেলেদের একটা দল। তখন শিক্ষকদের একটা দল তাদের পথ আটকায়। মেয়েরা রাস্তায় বেপর্দা আন্দোলন করবে, এমন জাহেলী পরিবেশ এই ক্যাম্পাসে তারা হয়তো মেনে নিতে পারেননি। ছেলেমেয়েরা স্যারদের বিনীতভাবে সরে যেতে বললে হিতে বিপরীত হয়। রাস্তা থেকে নেমে ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করায় একাধিক ছাত্রকে চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করেন শিক্ষকদের একজন। এক পর্যায়ে সিকিউরিটি গার্ডের হাত থেকে পুলিশ ব্যাটন খুলে নিয়ে কয়েকজনকে আঘাত করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে স্কুলে পড়া শিশু নয়, তাদের যে প্রকাশ্যে লাঠিপেটা করা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সাজে না তা হয়তো তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন। সেখানে সিএসই-র এক ম্যাডাম চলে এসে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে দেন। নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ছাত্রিদের ভিডিও করতে শুরু করেন তিনি। সেই সঙ্গে চেঁচিয়ে হুমকি দেন, “তোমাদের সবার রোল নাম্বার আমি জোগাড় করবো।”

ভারি নিতম্বের অধিকারী হওয়ার কারণে এই ম্যাডামকে নিয়ে ছেলেদের হলে বেশ কিছু নোংরা কৌতুক প্রচলিত ছিল। ভদ্রমহিলার অজায়গায় নাক গলানোর বেশ কিছু ঘটনা আছে। ছাত্রছাত্রিরা তাকে প্লেগের মতোই ঘৃণা করে। এমন একজন মানুষের মুখ থেকে “রোল নাম্বার” শব্দ দুটো শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউ। বিশেষ করে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা পরীক্ষার খাতায় যেন কেউ চরিতার্থ করতে না পারে সেজন্যই ওরা এই আন্দোলনে নেমেছে। এমন একটা আন্দোলনের উত্তপ্ত পরিবেশে যদি শিক্ষক সমাজের একজন সেই একই হুমকি দিয়ে বসেন, স্বভাবতই পরিস্থিতি আর কারও হাতে থাকে না।

বারুদ ফেটে পড়লো ক্যাম্পাসে।

ছেলেমেয়েরা যখন ক্যাম্পসের ঐ প্রান্তে শিক্ষকদের হাতে লাঠিপেটার শিকার হচ্ছে, শিক্ষিকা যেখানে নিয়েছেন ভিডিও করার দায়িত্ব, একরকম বিনা যুদ্ধে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিংয়ে অপর একটা দল ঢুকে পড়ে। বিনীতভাবে ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসে ঢুকে দাবি দাওয়ার কাগজপত্র জমা দেয়, তাতে সিগনেচার করে দেওয়ার অনুরোধ জানায়। ভাইস চ্যান্সেলর সিগনেচার করতে অস্বীকৃতি জানান। পীড়াপীড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় তাদের মুখের সামনে থেকে সরাতেই হয়তো বলেন, “সময় লাগবে।” ছাত্ররা ভদ্র ছেলেদের মতো হাঙ্গামা না করে বের হয়ে এসে সেখানেই অবস্থান নেয়। এবং তখন থেকেই ভাইস চ্যান্সেলরের অফিস অবরোধ করার শুরু।

লাঠিসোটা রেখে বীর শিক্ষকদের দলটা যখন ভিসি স্যারের অফিসে এসে পৌছেছেন, রাজধানী দখল হয়ে গেছে।

ভাইস চ্যান্সেলর মান্ধাতা আমলের নিয়ম কানুন এখনও চোখ বন্ধ করে মেনে চলেন। গোঁড়ামিতে তিনি পুরো বিভাগজুড়েই বিখ্যাত। গোঁড়া মানুষ দাবি-দাওয়া সহজে মেনে নেবেন না সেটাও ছাত্রদের জানা আছে। সেজন্য তিনদিন টানা অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার পরও যখন শিক্ষকরা তাদের দাবি মেনে নিলো না, তাদের কেউ অবাক হলো না। পয়ত্রিশ ক্রেডিট সিস্টেম রাখার জন্য যদি শিক্ষক সম্প্রদায় সাতদিন উপবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন (প্রতিদিন খাবার সরবরাহ করা হলেও তারা সেই খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। একটু কাব্যভরে বলা হলে ‘ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন) তো থাকুন তারা উপবাসেই। বিন্দু বিন্দু জমে ঘৃণার পাহাড় ছাত্রদের মধ্যে আজ হিমালয়ের চূড়ো হয়ে উঠেছে। পয়ত্রিশ ক্রেডিট বাতিল না করলে ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসের সামনে থেকে একজনও নড়বে না। মানবিকতা দেখানোর জন্য খুব একটা ব্যগ্র নয় তাদের কেউ।

শামীমের সাথে অবরোধের মিছিলে দেখা হয়েছিলো সিএসই-র মেহতাবের সঙ্গে। মুখ বাঁকিয়ে সে বলেছিলো, “এইটা আমি কমু হেরা নিজেগোর উপরে নিজেরাই টাইনা আনছে। ঘাউরামির লিমিট তো রাখে নাই। আমাদের বড় ভাইদের লগে করছে। এরে ওরে ফেল করাইছে। আমাদের আপুদের লগে করছে, এরে ওরে প্রেমের প্রস্তাব দিছে। আমাদের লগে করতেছে। এইসবের বিরুদ্ধে কিছু কওয়া যাইবো না, তাইলে সিজিপিএ নামায়া দেবো। ঘাউরামি আর ফাইজলামির একটা লিমিট তো থাকা দরকার। অহন কেউ হেগোরে মায়া কইরা ছাইড়া দেবো না। দাবি মানলে সাইন কইরা বাইর হও। নাইলে না খায়া মইরা যাও। হু কেয়ারস।”

সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসে একরকম বারুদ ঠাসা পরিবেশ। বিস্ফোরণ এখনও ঘটেনি। গেটের সামনে তিনটা পুলিশের গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে সব সময়। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের খুবই অর্গানাইজড অবস্থায় রাখা হয়েছে। কোনো ভাঙচুর যেন না হয়। পুলিশকে কোনো সুযোগ দিতে তারা চায় না।

এরকম একটা পরিবেশে ভাইস চ্যান্সেলর তার পোষা ক্যাডারদের ফোন করে বলেন সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ‘মিশে যেতে’। তারপর একটা গাড়ি ভেঙে দিলেই পুলিশ হারে-রে-রে করে মাঠে নেমে পড়বে। ধড়পাকড় হবে। আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর নিজের গোঁড়ামির কারণেই আজ রাজনৈতিক সাহায্য পাচ্ছেন না। এই ভাইস চ্যান্সেলর ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি ছাত্রনেতাদের বিশেষ পাত্তা দেননি। হয়তো ভাবেননি কোনো একদিন এই ছেলেগুলোকে তাদের প্রয়োজন পড়তে পারে। সংগঠনগুলোও প্রশাসনের প্রতি বর্তমানে বিন্দুমাত্র সহানুভূতিশীল নয়। রাজনীতি করা ছেলেরা সরাসরি আন্দোলনে নামেনি, এতে করে এটাকে আর গণ-ছাত্রদের আন্দোলন হিসেবে দেখানো যাবে না। তবে কেউ যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য বানচাল করতে না পারে সেদিকে তারা লক্ষ্য রাখছে। পরিকল্পনা সেটাই, ক্যাম্পাসকে বারুদঠাসা উত্তেজনায় তুলে রাখা, তবে বিস্ফোরণটা না ঘটানো। স্নায়ুর এই যুদ্ধে শিক্ষকপক্ষ কতোক্ষণ লড়ে যেতে পারেন তাই এখন দেখার বিষয়।

বন্ধুকে নিজের ঘরের দরজায় হঠাৎই খেয়াল করলো মুহিব, “আরে! কতোক্ষণ হয়েছে দাঁড়িয়ে আছিস?”

চট করে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ফাইলটা মিনিমাইজ করে দিলো সে। একটু হেসে নোংরা খাটটায় বসলো শামীম। এই ঘরে জুতো খুলে ঢোকার ঝামেলা নেই। মুহিব নিজেই স্যান্ডেল পরে ঘুরাফেরা করে। মেঝের সঙ্গে সাহারা মরুভূমির তফাত সামান্যই।

“বেশিক্ষণ দাঁড়াইনি। তোর জরুরি তলব যে হঠাৎ?”

কোনো কথা না বলে দরজাটা লাগিয়ে দিলো মুহিব। একটা প্রিন্ট করা কাগজ ধরিয়ে দিলো বন্ধুর হাতে।”এখানে সব লিখা আছে। তুই পড়ে দ্যাখ এই কলমটা ধর। এডিট করা দরকার যেসব সেগুলোতে গোল্লা মার।”

পড়ে দেখলো শামীম। কাউকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য যে কেউ এতো অর্গানাইজড প্ল্যান করতে পারে তা সে আগে কখনও কল্পনাও করেনি। খুঁটিনাটি কোনো পয়েন্ট সে বাদ দেয়নি। যেটাই ধরা পড়ার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ভূমিকা রাখবে মনে করেছে, আলোচনা করেছে। একটা পয়েন্টে লিখা

“মানি ড্রপ : মানি ড্রপের ঘটনা থেকে ভাইপার চেষ্টা করবে ব্ল্যাকমেইলারের পরিচয় বের করার। কাজেই ড্রপের ব্যাপারটা আমাদের সুবিধাজনক পরিবেশে ঘটানো হবে। এমন এক পদ্ধতিতে যাকে ট্রেস করা যায় না এবং যার রেসপন্সে কেবলমাত্র ভাইপার একাকি আসবে। এখানে লেভারেজ হিসেবে বারবিকে ব্যবহার করতে হবে।”

অবাক হয়ে শামীমকে তাকাতে দেখে ব্যাখ্যা করলো মুহিব, “ভাইপার হচ্ছে তোফায়েল। আর বারবি–”

“ইলোরা।”

“কারেক্ট।”

মুহিবের পরিকল্পনা তেরো পৃষ্ঠার। নিজস্ব প্রিন্টার ব্যবহার করে প্রিন্ট করেছে, গোপনীয়তা নিয়ে ফাঁক সে রাখেনি। পড়া শেষ করে কাগজের তাড়াটা বন্ধুকে ফেরত দিলো শামীম।

“মনে হচ্ছে আমরা কোনো কম্পিউটার গেমের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। সাধারণ দু’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যাদের কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই, তারা করতে যাচ্ছে প্রথম কোনো পানিশেবল অফেন্স। একজনকে ব্ল্যাকমেইল করতে যাচ্ছি আমরা এটা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।”

“আস্তে বল গাধা। করিডোরে কেউ শুনলে খবর হয়ে যাবে। কোনো ফাঁক ফোকড় রাখা যাবে না!”

“সরি।” লেপে হেলান দিলো শামীম, গলা নামিয়েছে।”হজম করার জন্য বেশ বড় একটা ব্যাপার এটা। আমরা সত্যি একজনকে ব্ল্যাকমেইল করতে যাচ্ছি!”

“এমন একজনকে, যে ব্ল্যাকমেইলারদের পরিচয় জানতে পারলে তাদের খুন করে ফেলবে।”

“সোজা বাংলায়, আগুন নিয়ে খেলছি আমরা।”

এক মুহূর্ত বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকলো মুহিব।”কাজটা খুব রিস্কি মনে হলে তুই না জড়াতে পারিস। আমি আর শিয়া মিলে চালিয়ে নেবো। সমস্যা নেই।”

জোরে জোরে মাথা নাড়লো ড্রামা কিং শামীম, “মাথা খারাপ? এরকম একটা অ্যাডভেঞ্চার শামীম ছেড়ে দেবে?”

মুচকি হাসলো মুহিব, “খরগোশ থিওরির কি হবে তাহলে? শিকারীর গন্ধ শোঁকা, দুই পা এগিয়ে নাকটাকে আকাশের দিকে তাক করে গন্ধ নেওয়া?”

“ওটা নতুন কোনো জায়গায় প্রথম যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমরা এখন পুরাতন। তাছাড়া, শামসভাইয়ের জাস্টিস আমাদের আনতে হবে। এখন এতো কিছু ভাবলে চলবে না। কিছুটা ঝুঁকি থাকবেই। আমরা দুই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার যদি এরকম একটা কাজ র‍্যাশনালি পুল করতে না পারি, কে পারবে? এটাকে আমরা ক্রাইম হিসেবে ট্রিট করবো না, সায়েন্স প্রজেক্ট হিসেবে ট্রিট করবো।”

চাপা হাসলো মুহিব, “সেটাই করার চেষ্টা করছি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অপরাধ। আমার উচিত এ নিয়ে একটা বই লিখে ফেলা।

“লিখিস। এখন আমাকে পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে বল। তোর পয়েন্টগুলো আমি পড়েছি। ওগুলো হলো সমীকরণের একটা পাশ। দুই যোগ দুই। ফলাফল কতো আসবে সেটা তুই নিজের মুখে আমাকে বলে ধন্য কর।”

ড্রয়ার ঘেঁটে অনেক খুঁজে একটা দোমড়ানো সিগারেট বের করলো মুহিব। যত্ন করে আগুন ধরালো তাতে। তারপর ঝুঁকে এলো শামীমের দিকে, “তবে শোন্…..”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *