1 of 2

কুকুরদল – ২২

অধ্যায় ২২

মুহিবের হাত থেকে সিগারেটটা একরকম কেড়ে নিলো শামীম, “তাহলে তূর্ণা জানে খুনটার সাথে কারা ইনভলভড়! ঠিক তোরই মতো!”

মাথা দোলালো মুহিব, “অবশ্যই। কিন্তু সে তো আর ক্রাইম সিনে উপস্থিত ছিল না!”

“আর সেটা তুই কিভাবে জানিস?” রাস্তার ওপর ছাই ঝাড়লো শামীম। তূর্ণাকে তুলে দিয়ে একটা অটো ধরে মেসের কাছাকাছি নেমে এসেছিলো ওরা। দু’জনের ঠিকানা আলাদা, নিজেদের রুমে ফিরে যাওয়ার আগে এক কাপ চা খেতে আজিজ ভাইয়ের দোকানে একবার ঢু মারার ইচ্ছে। রাত মাত্র দশটা। ওদের ছেলেদের জন্য এটা কোনো রাতই না। হলগুলোয় রাত বারোটায় কাউকে ফোন করে যদি জানতে চাওয়া হয় সে ঘুমাচ্ছিলো কি না, তাকে পাল্টা জবাব দেওয়া হয় আরেকটা প্রশ্ন দিয়ে। ভর সন্ধেবেলায় একজন মানুষ ঘুমাবে কেন?

স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয় চারপাশে রঙিন দেখাচ্ছে। রঙিন আলো থেকে চোখ না সরিয়েই শামীমের প্রশ্নের উত্তর দিলো মুহিব, “সিম্পল। খুনিদের ব্যাপারে আমি হাল্কা ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। তূর্ণার রিঅ্যাকশনের একটাই অর্থ হতে পারে। খুনিদের সে চেনে। এই মিটিংয়ে সে শুধু আমাদের সাবধান করতে আসেনি। সেই সঙ্গে কিছু ক্লু দিতেও এসেছে, ক্লেভার গার্ল।”

“ক্লু?”

“অবশ্যই। আমাদের একেবারেই সহযোগিতা করবে না, এই কথাটা বলার জন্য তাকে রেস্তোঁরা পর্যন্ত আসতে হতো না। কবিরের সাথে একটা ফোনকলই যথেষ্ট হতো। কিন্তু সে রেস্তোঁরায় এসেছে, কারণ সে জানে যাদের পেছনে আমরা লাগছি তাদের ক্ষমতা কেমন। জানে, আমাদের ঘাঁটাঘাঁটির কারণে সম্ভাবনা আছে তাদের কানে চলে যাওয়ার। অন্যভাবে বলতে গেলে, কে কাজটা করেছে সেটা সে স্পেসিফিকভাবে জানে।”

বিকট এক টান দিয়ে সিগারেটটা শেষ করে ফেললো শামীম, তারপর হাত বাড়িয়ে প্যাকেট থেকে আরেকটা বের করে নিলো অবলীলায়।”অতি কল্পনা হয়ে যাচ্ছে না তো?”

“না। মেয়েটা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভেবেছে বলেই দেখা করেছে বলতে চাইছিস? তুই রিকশা ঠিক করতে যাওয়ার পর ঐ কথাগুলো বলার প্রয়োজন পড়তো না তাহলে। ‘একটা মেয়ে যদি কিছু জেনেও থাকে তোমাদের জানাবে না।” আমাদের মার্ডারারের সঙ্গে মেয়েদের ইতিহাসটা খুব একটা ভালো না, ঠিক কি না?”

মাথা দোলালো শামীম, “মেকস সেন্স। কিন্তু এসবই পুলিশি ভাষায় কি বলে না? সার্কামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স। এগুলো দিয়ে কিছুই প্রুভ করা যায় না।”

দু-হাত উল্টে দিলো মুহিব, “আমি পুলিশ না। রাইটার। একজন লেখকের ভাষায় এটাকে বলে ওয়াইল্ড হাঞ্চ। আমার ওয়াইল্ড হাঞ্চের জোর কতোটুকু তা এবার দেখা যাক।”

“তোমার হাঞ্চের জোর আমার দেখা হয়ে গেছে।” মুখ বাঁকালো শামীম, “তূর্ণা সেই ফাঁদে আটকায়নি।”

“না আটকালে ব্লু রেখে যেতো না।” শামীমের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নিলো মুহিব, চাপড় দিলো তার কাঁধে, “আমাদের খেলা এবার শুরু হবে।”

“কোনো ওয়াইল্ড প্ল্যান?”

মুচকি হাসলো মুহিব, “তূর্ণা কিছু একটা জানে। তার পেট থেকে কথা বের করতে হলে আমাদের টোকা দিতে হবে রেদোয়ান র‍্যাডকে। রেপিস্টটার হাত থেকে নিজেকে যদি নিরাপদ মনে করতে পারে, পাখির গানের চেয়েও মিষ্টি আওয়াজ বের হবে তূর্ণার মুখ থেকে। আর একবার তূর্ণার মুখ খোলাতে পারলে জাকির সাথে পুরো ঘটনার ইনভলভমেন্ট জানা যাবে। রেদোয়ান কেন কাজটা করেছিলো তা জানা যাবে।”

বন্ধুকেও অর্ধসত্য বলতে হচ্ছে বলে তোফায়েলের ওপর এক অক্ষম ক্রোধ অনুভব করলো মুহিব। হারামজাদা ইলোরার সাথে ঘুরঘুর না করলে সবখানে কেবল রেদোয়ানের নাম নিতে হতো না ওকে।

শামীম জানতে চাইলো, “এরপর?”

“রেদোয়ানের মোটিভ বের করতে পারলেই আমাদের হাতে যথেষ্ট মাল মশলা চলে আসবে। আমরা এভিডেন্স খুঁজবো। আর তা পাই কিংবা না পাই, ঘটনা একবার খোলাসা হয়ে গেলে সরাসরি যোগাযোগ করবো শিয়ার সাথে। বাকিটা ওদের ফ্যামিলি দেখবে আশা করা যায়। যথেষ্ট তথ্য হাতে চলে আসলে আমি সাক্ষ্যও দিতে পারবো। চাইলেও তখন আর আমাকে স্পটে ফাঁসাতে পারবে না ওদের রেপিস্ট বাহিনি।”

চুপচাপ কিছুক্ষণ সিগারেট টানলো ওরা। আজিজ ভাইয়ের দোকানের পেছনেই ট্রাকের গ্যারেজ। রাত দিন এক করে কাজ চলে সেখানে। হট্টগোল ভেসে আসছে সেখান থেকে, চেসিসে ইঞ্জিন বসাচ্ছে কয়েকজন কর্মি। তাদের

কাজ দেখতে দেখতে শামীমকে বলা কথাগুলো ভেবে দেখলো মুহিব। রেদোয়ান র‍্যাড একজন বিপজ্জনক মানুষ। তাকে ঘাঁটানোর চেষ্টা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ করবে না। শুধু বিপজ্জনক নয়, রাজনৈতিক ব্যাকআপযুক্ত একজন বিপজ্জনক মানুষ। যার সাথেই রেদোয়ান নিয়ে কথা হয়েছে, কেউ-ই রেদোয়ানের ফ্যামিলির পলিটিকাল পাওয়ারের কথা মনে করিয়ে দিতে ভোলেনি। পলিটিকাল ফ্যামিলি! তার সঙ্গে মুহিব বা শামীমের মতো সাধারণ ছাত্ররা লাগতে আসে না। যারা আসে তাদের ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায়। বেশি কাছে চলে আসলে শামসের মতো ক্যাম্পাসের কোণে মরে পড়ে থাকে। তূর্ণার লিস্ট থেকে রেদোয়ান বা তোফায়েলের হুমকি সরিয়ে দেওয়াটা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। তাদের হাত থেকে প্রকৃতপক্ষে কেউ-ই নিরাপদ নয়। ঠিক তখনই মেসের দিক থেকে হেঁটে আসা মানুষটাকে চোখে পড়লো মুহিবের।

“আমরা বেনামী পত্র দিতে পারি।” গলা খাকারি দিয়ে শুরু করেছিলো শামীম, “তুই ক্রাইম সীনের ডিটেইলস জানিস। আর কেউ জানে না। তুই এটা দিয়ে রেদোয়ানকে চমকে দিতে পারিস। হয়তো কোনধরণের অ্যাগ্রিমেন্টে তাকে নিয়ে আসা যাবে। আমাদের হাতে একেবারেই লেভারেজ নেই তা কিন্তু না-”

পা দিয়ে হাল্কা টোকা দিলো তার পায়ে, “চুপ। পরে।”

এবার লিটুকে দেখতে পেলো শামীমও। একটা সস্তা সিগারেট হাতে নিয়ে মেইন রোড ধরে এগিয়ে আসছে এদিকেই। সম্ভবত নদীর ধারে দেওয়া টোটকাটা কাজে লেগেছে। আজিজ মামার দোকানে দূর থেকে ওদের দুইজনকে বসে থাকতে দেখে অযথা অভিমান না করে এগিয়ে আসছে আড্ডায় যোগ দিতে। এই মুহূর্তে ওরা দুইজনেরই মনে হলো এর চেয়ে অভিমানই ভালো ছিল। কাছাকাছি এসে ফক ফক করে সিগারেটের বিশি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একটু চেপে বসতে ইশারা করলো লিটু।

“রাতে খেয়েছিস?”

মাথা দোলালো ওরা, আরেক ধরণের প্রকৌশল-বিদ্যা-প্রশ্নমালা। খাওয়ার সময়ের পর পর বন্ধুদের সাথে দেখা হলে এটা একরকম সাধারণ একটা প্রশ্ন। এধরণের আরও কিছু প্রশ্ন আর উত্তর পর্ব শেষ হওয়ার পর খানিক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় যোগ দিলো লিটু। ওদের সবার জন্যই প্রশ্ন কমন পড়েছে এই প্রসঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েকদিন ধরে নতুন গুঞ্জন উঠেছে। শামস হত্যাকাণ্ডের মতো বড় ঘটনাও কখনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থবির করে দিতে পারে না। কয়েক মাস পর ভুলে যাওয়াই নিয়ম। এমনটা অবশ্য দেশের যে কোনো ভয়ানক ঘটনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ওরা মনে করতে পারে না কোন ইস্যুটি শেষবার দীর্ঘ সময় ধরে চায়ের কাপে ঝড় তুলেছিলো।

মুহিবের জন্য অবশ্য নতুন ইস্যুগুলো অস্বস্তিকর। সেই রাতের পর থেকে ক্যাম্পাসের জটলায় শামসভাইয়ের আলোচনা ছাড়া আর যে কোনো প্রসঙ্গ তার কাছে অদ্ভুত ঠেকে। মনে হয় এমনটা করা অন্যায়। একজন মানুষ খুন হয়ে যাওয়ার পর তার বিচার হলো না, এমনটা সবাই ছোট থেকে দেখে এসে অভ্যস্ত। তবে শামসভাই তো আর পত্রিকার পাতার কোনো অজানা অচেনা যুবকের নাম নয়। তাদের মাঝেই বেড়ে ওঠা, তাদের সঙ্গে তিনটে বছর কাটানো, তাদের মতোই একই রকম ক্লাস, ল্যাব, পরীক্ষা, মেস জীবনের অভিজ্ঞতা নেওয়া, তাদের মধ্যে হেঁটেচলা বেড়ানো একজন মানুষ খুন হয়ে যাওয়ার পর কেন মানুষ নতুন ক্রেডিট সিস্টেম নিয়ে আলোচনা করবে? অথচ ঠিক সে প্রসঙ্গ নিয়েই কথা বলছে লিটু, শামীম তাতে সায় দিয়ে হুঁ-হাঁ করছে। নতুন ক্রেডিট সিস্টেম নিয়ে তারও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মুহিবের মনে হয় না। তবে এটাই আপাতত “টক অব দ্য ক্যাম্পাস”।

লিটু বলে যাচ্ছে, “স্যারদের মাথায় কিসের ভূত চেপেছে তা আমি জানি না। একটা নতুন সিস্টেম চালু করতে হবে নতুন ব্যাচ থেকে। এটা কেন একটা অনগোইং ব্যাচের ওপর চাপিয়ে দেবে?”

শামীম বলল, “তা তো অবশ্যই।”

উৎসাহ পেয়ে লিটু বলে যায়, “বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার এক মাস আগে যদি কেউ বলে এবারের পরীক্ষার কোশ্চেন প্যাটার্ন চেঞ্জ হবে, কোনো পরীক্ষার্থি তা মেনে নেবে? আর এটা তো পুরো সিস্টেমই পাল্টে দেওয়া।”

মুহিবও তাল দিয়ে বলল, “না, কাজটা প্রশাসন অবশ্যই খারাপ করছে। লিটুর চোখ চক চক করে উঠলো, “দোস্ত, আজকে বিকালে নদী থেকে ফিরে আসার পর আমরা কয়েকজন বসেছিলাম। মুহিব ছিলি কোথায়? তোর রুমে গিয়ে পাইনি।”

“আমি আর শামীম একটা ফোন দেখতে বাজারে গিয়েছিলাম।” মুহিব জানালো। রুমে গিয়ে না পাওয়া স্বাভাবিক, তখন ওরা ছিল তূর্ণার সাথে ‘গোপন’ মিটিংয়ে ব্যস্ত।

“যাই হোক, আমি, জাহিদ, আসাদ, অনিক, শাওনরা মিলে বসলাম। নতুন ক্রেডিট সিস্টেম নিয়ে অসন্তোষ আছে সবার মধ্যেই। মানে, শুধু আমাদের কথা বোঝাচ্ছি না। ক্যাম্পাসের ভেতর, বাইরে, সবখানেই। দুই সেমিস্টার পার করে ফেলার পর নতুন সিস্টেম চাপালেই আমরা মেনে নেবো কেন? একটা কিছু করা দরকার।”

এই বয়সটা কিছু করারই। কেউ যখন বলে “একটা কিছু করা দরকার”, বাকিদের নড়েচড়ে বসা নিয়ম। ওরাও নড়েচড়ে বসলো। শামীমকে এখন সত্যই আগ্রহি মনে হচ্ছে, “কিছুটা কি?”

“প্রোটেস্ট। আন্দোলনে নেমে যাবো। এইসব বালছালের সিস্টেম বাতিল করার আগে রাস্তা থেকে সরবো না।” লিটুর চোখে এখন আত্মপ্রত্যয়। সচরাচর এই প্রত্যয়ের অভাবটাই তার চোখে দেখা যায়। নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেদের চোখে দৃঢ়তা থাকে না।”আমরা অফিশিয়াল সব উপায়ে চেষ্টা করেছি। ডিনের কাছে দরখাস্ত করেছি। সবাই মিলে সিগনেচার করে ভিসি স্যারের কাছে আবেদন করেছি। আলাদা আলাদা করে ডিপার্টমেন্টাল হেডদের কাছে গিয়েছি। তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড়। আমাদের জন্য নাকি এই থার্টি-ফাইভ ক্রেডিট সিস্টেমই বেস্ট। এটা তারা বন্ধ করবে না। এমনকি পোস্টপোনও করতে পারবে না। আমাদের এই সিস্টেমের মাঝে ওরা ফেলবেই। আন্দোলন ছাড়া গতি নাই। রাস্তায় নামতে হবে।”

নতুন ক্রেডিট সিস্টেম অনুসারে কোনো বিষয়ে ফেল করলে আবারও পুরো একটা বছর ক্লাস করতে হবে। ক্যারি অন সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এটাকে ছাত্ররা ভালোভাবে দেখেনি।

“তুই নামবি, সেটা ঠিক আছে। রাস্তায় নামতে আমাদের কোনো সমস্যা নাই। নামা উচিত। আমার মনে হয় আমাদের সেকশনের অন্তত আরও দশ–পনেরো জন একমত হবে এ ব্যাপারে। কিন্তু…

তার দিকে সামান্য ঝুঁকে আসলো লিটু, “কিন্তুটা কি এখানে?”

“পাঁচ হাজার স্টুডেন্টের মধ্যে কয়জন রাস্তায় নামবে? ইন টোটাল? সংখ্যাটা যদি খুব বেশি না হয়, ফেঁসে যেতে হবে। সবার রোল নম্বর লিখে নিয়ে যাবে। এই আন্দোলন সরাসরি প্রশাসনের বিরুদ্ধে। জীবনেও আর পাশ করে বের হতে পারবি না।”

শামীমের কথায় যুক্তি আছে। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাবশতঃ ছাত্রছাত্রিদের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার নজির এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো বেশি, যে হাতের কড়া গুণে বলে দেওয়া আর সম্ভব নয়। পরীক্ষার খাতা চ্যালেঞ্জ করার কোনো উপায় রাখা হয়নি, কাজেই একজন শিক্ষক তার নিজের কোর্সে স্বাধীনভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন। ছাত্রদের পারফর্ম্যান্স স্বাধীনভাবে মূল্যায়নের সুযোগ থাকা একটা ভালো দিক অবশ্যই। তবে প্রতিশোধপরায়ন শিক্ষকের ক্ষেত্রে এটা ভয়াবহ এক ক্ষমতা। কেউ যেহেতু একজন শিক্ষকের মূল্যায়নকে পর্যাপ্ত কারণ ছাড়া প্রশ্নবিদ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন না, যে কোনো একজন ছাত্রের জীবন থেকে দুই বা তিন বছর অনায়াসে ধ্বংস করে দিতে পারেন একজন শিক্ষক। সেসব শিক্ষক, যারা প্রফেশনালিজমের ধারণাটি ঠিকভাবে ধারণ করতে পারেননি। ব্যক্তিগত আবেগ যারা টেনে আনেন নিজেদের কর্মক্ষেত্রে। মেকানিক্যাল ০৬ এর এক ছাত্র যে কারণে সাত বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েছিলো, কারণ ভদ্রলোকের একটামাত্র কোর্স আটকে যাচ্ছিলো বার বার। মোট ছয়বার ঐ কোর্সে পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি, প্রতিবারই করেছিলেন ফেল। কারণ, তার প্রেম-জীবন নিয়ে যে বাড়তি আর কুৎসিত আগ্রহ কোর্স টিচার দেখিয়েছিলেন, তাতে মুখ বন্ধ রেখে “ইয়েস স্যার, ইউ আর রাইট স্যার।” বলে নিজের ভবিষ্যত নিশ্চিত করার মতো মানুষ তিনি ছিলেন না। একজন ছাত্র তার ব্যক্তিগত জীবনে অনাহুত নাক গলানোর পর কড়া কিছু জবাব দিয়েছে তার শিক্ষককে, এমন এক ঘটনা বাংলাদেশে এখনও চরমমাত্রার বেয়াদবী বলেই স্বীকৃত। কাজেই ছাত্রটির পাশ করার সম্ভাবনা ছিল না। ক্যাম্পাসের এই বড় ভাইটি পাশ করেছিলেন সাত নম্বর প্রচেষ্টায়। কারণ, ‘আত্মসম্মান’বিশিষ্ট এই শিক্ষক সেবার অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য চলে গিয়েছিলেন। ফলাফল, এ-গ্রেড নিয়ে ঐ ব্যাকলগ পরীক্ষায় সফলভাবে উৎরে গেছিলেন ভিক্টিম। এই ঘটনা ক্যাম্পাসের ভেতরে এবং বাইরে অনেকেই জানেন। বিজ্ঞজনেরা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবেন, “প্ৰশাসনকে এই অনিয়ম সম্পর্কে জানাওনি কেন?” তবে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? আজকে ওরা রাস্তায় নেমে যাবে একটা যৌক্তিক দাবির পক্ষে, তার পর যারা লিড দেবে তাদের ভবিষ্যত অবৈধ এই ফেল করানো প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করার চেষ্টা করা হবে না তার নিশ্চয়তা কি? যেহেতু সর্ষের মধ্যেই ভূতের আনাগোনা।

“কালকে এ নিয়ে আমরা আরেকবার বসতে পারি।” মুহিব একটা উপসংহারে আসার চেষ্টা করলো।”কর্মসূচি ঠিক করতে হবে। পলিটিকাল ছেলেদের মতামত কি? পজেটিভ না নেগেটিভ?”

চোখ টিপলো লিটু, “পজেটিভ না হলে আমাদের বিকালের মিটিং হয়? প্রশাসনের সাথে ওদের অন্য কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা চলছে মনে হয়। এখন স্যারদের যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে পারবি। পেছনে পলিটিকাল ছেলেরা পূর্ণ সমর্থন দেবে।”

“কিন্তু লিডে মনে হয় আসবে না। ওরা দেখাবে এটা সাধারণ ছাত্রদের দাবি। পাশ থেকে সাহায্য কিছু করার থাকলে করবে।” হিসেব মেলালো মুহিব। কখনও কখনও শত্রুর শত্রু হয়ে যায় বন্ধু।

“সেজন্য আমাদের মধ্যে থেকেই লিডে যেতে হবে। সবার মতামত চাইতে থাকলে প্রত্যেকের কথা শুনতেই দুই তিন বছর লেগে যাবে। একেকজন চাইবে আন্দোলনটা একেকরকম হোক। সেজন্য আমরা ওদের কথা শোনার জন্য সময় নষ্ট করবো না। সরাসরি একটা কর্মসূচি ঘোষণা করার প্রস্তাব দেবো। ওটাকে যদি কেউ সম্পাদনা করে পাল্টাতে চায় তাদের মতামত আমরা শুনবো। ঠিক কি না?” বোঝা গেলো বিকাল থেকে লিটু এ ব্যাপারে যথেষ্টই চিন্তা ভাবনা করেছে।

ওর পিঠে বার দুই চাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালো শামীম, “মেসের দিকে যেতে হবে, দোস্ত। তুই আর মুহিব নাহয় আজকে রাতে একটা রাফ দাঁড় করা। আর কালকে আরেকটা মিটিং ডাক।”

একে অন্যের থেকে বিদায় নিয়ে একসাথে মেসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো মুহিব আর লিটু। যথারীতি, “শহর” বলে দাবি করা এলাকাটা রাত এগারোটাতেই কবরের মতো নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। এলাকাবাসীর জন্য এটা গভির রাত। অর্ধেক “শহর” ঘুমের অতলে ডুবে গেছে।

এরকম একটা ফাঁকা রাস্তার মাঝেই কোনরকম আগাম সঙ্কেত না দিয়ে আছড়ে পড়লো লিটু। প্রবল খিঁচুনিতে তার হাত পা ঘষা খাচ্ছিলো অ্যাসফল্টের সাথে। তালুর চামড়া ছিলে যাচ্ছে, মুখ থেকে রীতিমতো ফেনা উঠছে তার।

পুরো ঘটনাটা দেখার জন্য মাথার ওপর কারেন্টের তারে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকা একটা বাদুড় আর খিঁচুনি আক্রান্ত লিটুর পাশে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকা একা একজন মুহিব ছাড়া আর কেউ সেখানে ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *