অধ্যায় ১০
হাকারবিনের ক্লাস শেষে ছেলেমেয়েরা বের হতে চায় না, অন্য শিক্ষকদের ক্ষেত্রে তাদেরই লক্ষ্য থাকে পেছনের দরজাটা। অন্য শিক্ষকেরা ক্যালটেক ফেরত এই শিক্ষককে ভেতরে ভেতরে খানিক অপছন্দ (এবং অনেকখানি ঈর্ষা) করতে শুরু করলেন মাসখানেকের মধ্যে। তাছাড়া হাকারবিন যা যা করেন তাতে অধিকাংশ শিক্ষকেরই সায় নেই। তারা নীতিগতভাবে তাকে ‘প্রকৃত’ শিক্ষক মনে করেন না। ক্যালটেক ফেরত তো কি হয়েছে, শিক্ষকের সংজ্ঞা বাংলাদেশে হাল্কা আলাদা না হলে আর কিসের উন্নত জাতি? প্রকৃত শিক্ষক কি করে ছাত্রদের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে ধূমপান করতে পারে? শিক্ষক হিসেবে জয়েন করার সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে দেওয়া হয়, “ছাত্রদের থেকে পরিমার্জিত দূরত্ব বজায় রাখা আবশ্যক।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাই শিক্ষক হওয়ার আগে তুমুল বন্ধুসুলভ, আর শিক্ষক হয়ে যাওয়ার পরই তিনি রাতারাতি দূরত্ব আনেন। এতে করে প্রশাসনের প্রতি ছাত্রসমাজের প্রবল ক্ষোভ অবশ্যই বাড়ে। বিদ্রোহী রণক্লান্ত ছাত্রের সংখ্যা যে প্রতি সিরিজেই বেড়ে যাচ্ছে তার পেছনে অন্যতম কারণ এই শিক্ষকদের ব্যবহার। একটু সমান সমান আচরণ পেলেই সম্মান করতে ছাত্রদের বাঁধা থাকে না। অথচ চল্লিশ বছরের ঐতিহ্যধারণ করা শিক্ষকরা এটুকুই বুঝে উঠতে পারছেন না, তারা কেন ছাত্রদের থেকে মন থেকে আসা সম্মান পান না। উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রফেসর রবিন কেন তা পাবে?
প্রফেসরের আড্ডায় ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও থাকে। টং দোকানে এতো আড্ডারই বা আছেটা কি? ছাত্রদের তো নষ্ট করছে এই শিক্ষক নামধারী! যেখানে ছাত্রিদের সাইকেল চালানো নিষেধ সেখানে ছেলেমেয়ে একসাথে টং দোকানে আড্ডা দেবে কেন? কাজেই অন্যান্য শিক্ষকদের গাত্রদাহের কারণটা স্পষ্ট।
অন্য কোনো শিক্ষক এমন আচরণ করলে তার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যেতো। নিদেনপক্ষে বিশ বছর ধরে আটকে থাকতে হতো “লেকচারার” পদেই। কিন্তু এসবের দায়বদ্ধতা প্রফেসরের নেই। ভিসি স্যারের অপছন্দের একশ’ একটা কাজ তিনি করে থাকেন, তবে কোনোটাই যখন দেশের আইনের পরিপন্থী নয়, ঠেকাবে কে?
ক্যালটেক ফেরত শিক্ষককে তো আর আচরণগত কারণে দূরে ফেলে দেওয়া যায় না। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। উপাধ্যক্ষও যখন লক্ষ্য করলেন প্রফেসর আসার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওজনদার ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সের আয়োজনের পথ সুগম হওয়ার এক সম্ভাবনা দেখা গেছে, সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে তিনি কিছু বলতে চাইলেন না। হাঁস শুধু ডিম পাড়বে তাই তো না, বিষ্ঠাও ছড়াবে। ডিমের খাতিরে বিষ্ঠা মেনে নেওয়া উপাধ্যক্ষের কাছে “ফেয়ার ডিল”।
তবে বাকি শিক্ষকদের গাত্রদাহ চলতে থাকলো। বিভাগীয় প্রধানের কাছে ক্যাফেটেরিয়ায় একটা ক্লাস পার্টি করার আবেদনপত্র নিয়ে যাওয়ার পর তিনি সোজাসাপ্টা বলে দিলেন, “প্রোগ্রামের লিস্ট দাও। দেখি তোমরা কি কি করবা। গান বাজনা থাকবে না কি?”
সত্যবাদী যুধিষ্ঠির খেতাবপ্রাপ্ত জহির বলেছিলো, “বেশি কিছু নয়, স্যার। সাউন্ড সিস্টেমে কিছু প্লে হবে আর তুষার গিটার দিয়ে একটা গান তুলবে—”
আস্তে করে আবেদনপত্রটা ঠেলে দিয়েছিলেন তিনি, “বাদ্য বাজাবা! এসব কাজ বাবারা তোমরা করলে করো। নাজায়েজ কিছুর অংশ আমি হতে পারবো না।”
জহির বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো তিনি সাক্ষর না করলে ক্যাফেটেরিয়াটা তারা পাবে না। আর বাইরের কোনো রেস্তোঁরায় ক্লাস পার্টি করতে গেলে যে খরচটা হবে তা যোগাড় করা সম্ভব নয়। স্পন্সর এখানে টাকা ঢালে না, তা স্বাভাবিক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নাজায়েজ কিছুর বিজ্ঞাপন দিয়ে লাভ নেই তা সবাই জানে। কিন্তু বিভাগীয় প্রধান তার অবস্থানে অটল। তিনি নাজায়েজ কোনো কাজের সঙ্গে নেই, নাসারাদের সংস্কৃতির অনুমোদন তিনি দিতে পারেন না। মুসলমানের সন্তান গিটার বাজাবে কেন?
কাজেই ছেলেরা এবার ধরেছিলো তাদের, যারা সংস্কৃতির দিক বিবেচনায় তেমন গোঁড়া নন। অন্তর স্যার, ইকবাল স্যার আর অতি অবশ্যই রবিনস্যারের কাছে সুপারিশ নিয়ে এলো ওরা, দরখাস্তে তিনজন প্রফেসরের সুপারিশের পর বিভাগীয় প্রধানের গলার সুর অনেকটাই পাল্টে যায়।
চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ নতুন আবেদনপত্রটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। তারপর গলা নামিয়ে শুধু বললেন, “গেয়ো যোগী ভিখ পায় না। তোমরা খালি বিদেশি কালচার আর বিদেশি লোকজনেরে নিয়া মাতামাতি করো। এইভাবে উন্নতি হবে না কিছু এই দেশের।”
তবে সাক্ষর ঠিকই দিলেন সেবার।
হেড স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলো ওরা।
ক্লাসের বাইরে হাকারবিন বেশ মজার মানুষ। নিজের জীবনের নানা বৃত্তান্ত তিনি শোনান তার ছাত্রদের। তবে প্রতিবারই এড়িয়ে যান দুটো প্ৰসঙ্গ। কেন তিনি বিশ্ব র্যাংকিঙের প্রথম পাঁচে থাকা একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এই পৃথিবী বিস্মৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে এসেছেন, আর কিভাবে তিনি হাতটা হারিয়েছেন।
ক্লাস শেষে সেদিন ওরা তিনজন পাশাপাশি হাঁটছিলো। শামীম, মুহিব আর ইলোরা। লিটুটা আজ ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। লেডিস হোস্টেলের এদিকে সারি সারি গমক্ষেত। এই গম ক্ষেত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কতো টাকা কামাচ্ছে তা তারা জানে না। তবে এখানে কিছু দোকানপাট হলে হলের মেয়েরা যে খেয়ে পরে বাঁচতে পারতো সে বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। হলের ক্যান্টিন অকার্যকর। রাত নামলে আর রুমে দিনে কিনে আনা খাবার না থাকলে উপোস করে মেয়েরা। গমের ক্ষেত থেকে এখানে বেশি দরকার কিছু খাবারের দোকান। তবে এ নিয়ে কথা বলবে কে? যেহেতু গত চল্লিশ বছর ধরে চলে আসছে গমের ক্ষেত, এর বিরুদ্ধাচরণ করা গর্হিত কাজ হবে।
“হাশেম ভাইয়ের দোকানটা আমাদের মধুর ক্যান্টিন হবে একদিন।” মন্তব্য করলো ইলোরা।
“যতোদিন আমাদের সঙ্গে হাকারবিন আছে।” যোগ করলো মুহিব।
“হাকারবিন জোস পাবলিক। কিন্তু উনি ভবিষ্যতে না থাকলেও সমস্যা নেই। ট্রেন্ডটা তো গড়ে উঠছে। এই যে টংয়ে দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত বসে থাকলাম, একটা মানুষও চোখ বাঁকা করে তাকাতে পেরেছে আমার দিকে? অথচ তিন মাস আগে হলে কি হতো ভেবে দ্যাখ।”
একবার তার দিকে চোখ বাঁকা করে তাকালো মুহিব। জিন্স আর টিশার্ট, দারুণ লাগছে। তার দিকে কেউ তাকায়নি কথাটা ঠিক নয়, তবে সেই তাকানো আর এই তাকানোর মধ্যে পার্থক্য আছে। হাকারবিন নিয়ে উচ্ছ্বাস কিছুটা কমে এলে আচমকাই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো ইলোরা।
“শামসভাইয়ের ঘটনাটা নিয়ে কিছু আগাতে পারলি?” সরাসরি মুহিবের বাঁকা চোখেই চোখ রাখলো সে।
“না।” শামীমের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে বলল মুহিব।
এদিক ওদিক চোরা চোখে তাকাচ্ছিস কেন? আমাকে লুকাতে চাস?” চোখ পাকিয়ে জানতে চাইলো ইলোরা।
উত্তর দেওয়ার আগেই খুব কাছে একটা ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেলো। বিচ্ছিরি এক শব্দ তুলে তাদের পাশে ব্রেক কষলো মোটরসাইকেলটা। সানগ্লাসটা চোখের ওপর তুলে তাদের দিকে তাকালো আরোহি।
“কি, ইলোরা? খবর কি তোমার?”
“ভালো, তোফায়েল ভাই। আপনি?” ভাই শব্দটার ওপর বাড়তি জোর দিয়ে জানতে চাইলো ইলোরা।
“তোমার শিডিউল এতো বিজি থাকলে ভালো আর থাকা যায় কিভাবে?” হাতঘড়ি দেখলো ছাত্রনেতা, “হল লাগাইতে আরও এক ঘণ্টা আছে। আসো, একটু ঘুইরা আসি।”
অসহায়ের মতো শামীম আর মুহিবের দিকে তাকালো মেয়েটা। দুইজনই কাঁধ ঝাঁকালো একটু। থার্ড ইয়ারের বড় ভাইয়ের সাথে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে তর্ক করা যায় না।
“আরে চিন্তা কইরো না। এক আধ ঘণ্টা দেরি হইলেও কিছু হইবো না। সুপারকে আমি বইলা রাখবো।”
পাংশু মুখে মোটরসাইকেলের পেছনে চেপে বসলো ইলোরা। সঙ্কোচের সাথে চেপে ধরলো তোফায়েলের কাঁধ। ওদের দুইজনের দিকে পালা করে তাকালো তোফায়েল, তারপর কপাল থেকে চোখে নামিয়ে আনলো সানগ্লাস।
“তোমরা দুই ভ্যাগাবন্ড কই যাইতেছো ঐদিকে? লেডিস হলে অ্যালোট পাইছো নাকি?”
তারপর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে টান দিলো মোটরসাইকেল।”বড়ভাই”য়ের পিঠের সাথে সেঁটে যেতে বাধ্য হলো ইলোরা। বিপরীত দিকে রকেটের বেগে ছুটে যাওয়া মোটরসাইকেলটার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ওরা দু’জন।
“এই জিনিসটা থামানো দরকার।”
মাথা দোলালো মুহিব, “ইলোরা ক্ষেপে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।” তার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো শামীম, “কিন্তু ক্ষেপতেছে তো না। কতোগুলা মাস পার হইয়া গেলো।”
আরও একবার মাথা দোলালো মুহিব। এসব তার পছন্দ হচ্ছে না মোটেও। শামসভাইয়ের মার্ডারের সময় একটা কণ্ঠই সে চিনতে পেরেছিলো। পরিচিত সেই কণ্ঠটি ছিল তোফায়েলের
একজন খুনির সাথে ইলোরা মিশছে, কারণ সে এখনও বিষয়টা জানে না। মুহিব এমনকি শামীমকে পর্যন্ত এখনও সবটা বলেনি, বন্ধুকে বিপদে ফেলতে চায় না। সেদিন তাকে নিয়ে নদীর ধারে খানিকক্ষণ বসেছিলো সে। বলেছিলো খুনটা নিজের হাতে করেছিলো র্যাড, তোফায়েলের নামটা ইচ্ছে করেই চেপে গিয়েছিলো মুহিব। র্যাডের বিরুদ্ধে কি করা যেতে পারে তা নিয়েই সেদিন আলোচনা করেছিলো ওরা। বিরোধীদলের সহায়তা নেওয়ার দিকে ওদের আলোচনার মনোযোগ ছিল। সরকারি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তাদের মতো সাধারণ ছাত্ররা লাগতে এলে গুম হয়ে যাবে, তবে বিরোধীদলের সেই আশঙ্কা কম। সারা বছর তারা টক্কর লাগিয়েই রাখে এদের সঙ্গে, অপকর্মের প্রমাণ পাওয়া গেলে বরং বিরোধীপক্ষের নিজস্ব যুদ্ধে এটা অস্ত্র হিসেবে কাজে আসতে পারে। তবে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় এমন কাউকে বিশ্বাস করতে ওদের মন সায় দেয়নি। যে কারণে উপসংহারে না পৌঁছেই সেদিন নদীর তীরের আলোচনা শেষ করতে হয়েছিলো ওদের।
লেডিস হলের পথ থেকে ফিরে শেরে বাংলা হলের সামনে আসতে ভিন্নধর্মি এক দৃশ্য চোখে পড়লো ওদের। হলের বাইরের গেট থেকে বের হয়ে আসছে একটা মেয়ে। ছেলেদের হলের ভেতর থেকে এমন ঝাঁ চকচকে এক মেয়ের বেরিয়ে আসাই যথেষ্ট অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। তার ওপর এই মেয়ে কাঁদছে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে গাল ঘষতে ঘষতে শামীর আর মুহিবের খুব কাছ দিয়েই জোরে হেঁটে গেলো মেয়েটি। দেহগঠন বিবেচনায় বয়সে তাদের চেয়ে এক দুই বছরের সিনিয়রই হবে হয়তো, তবে চেহারা দেখে মনে হচ্ছে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রি।
পেছন পেছন বেরিয়ে আসা ছেলেটি সুদর্শন, গায়ের রঙ ফর্সার দিকেই। লম্বা একহারা গড়ণ। লম্বা চুল ঝুঁটি করা পেছনে। কপালের অনেকখানি ব্যান্ডেজে মোড়ানো। মেয়েটির পেছন পেছন ছুটলো এই ছেলে।
“তূর্ণা। তূর্ণা দাঁড়াও।”
কাঁধ ঝাঁকালো মুহিব, “ডাল তো কিছু কালো হয়েছেই।” হিন্দী প্রবচনকে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বাংলা শব্দে বলল।
“হুঁ।” চিন্তিত ভঙ্গিতে গাল ঘষলো শামীম, “কিন্তু পিছে যেই পোলাটা দৌড়াইলো তারে আমি চিনি। জাকি ভাই। শামসভাইয়ের ক্লোজ ফ্রেন্ড। একলগেই থাকতো তারা সব সময়।”
চোখে চোখে কথা হয়ে গেলো ওদের।
উত্তেজিত কণ্ঠে বলেই ফেললো মুহিব, “তার কপালে এই এতো বড় ব্যান্ডেজ কেন?”