1 of 2

কুকুরদল – ৩৮

অধ্যায় ৩৮

ইনটেনসিভ কেয়ারের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে মুহিব। শান্ত হয়ে শুয়ে থাকা ছেলেটি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধুগুলোর একজন, যাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কেবলই নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তার মস্তিষ্কে কোনো ভাইরাসজনিত সংক্রমণ ঘটেনি। তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোড়জোর হচ্ছে না। তার জন্য এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এক হাজার মতো ছেলেমেয়ে ছোটাছুটি করছে না। তার জন্য অসংখ্য উপাসনালয়ে এখন প্রার্থনা হচ্ছে না।

মুখের ভেতরে চলে যাওয়া একটা পাইপ যেন প্রমাণ করছে তার এই শুয়ে থাকা শুধুই শুয়ে থাকা নয়। লিটুর সঙ্গে শামীমের মতো ঘনিষ্ঠতা তার ছিল না, তবে প্রতিদিন দুপুর আর রাতের খাবারটা খেতে মেসের নিচের ডাইনিংয়ে একসাথেই যেতো ওরা। কতোদিন অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য বিখ্যাত মুহিবকে রাতে দরজা ধাক্কিয়ে উঠিয়ে খেতে নিয়ে গেছে সে। অসময়ে মন অস্থির লাগছে? লিটুর দরজায় একটা টোকা দিলেই তার সঙ্গে নিচে নেমে আসবে এক কাপ চা খেতে। মাইন্ড রিফ্রেশার হিসেবে লিটুর চেয়ে ভালো সঙ্গি আর হয় না। মুহিব কখনও ভাবেনি চার বছর মেয়াদ সম্পূর্ণ করার আগেই তাকে অনিশ্চয়তার পথে বিদায় জানাতে হবে!

খুব সন্তর্পণে বন্ধুর চুলে হাত বুলিয়ে দিলো মুহিব। প্রায় ফিস ফিস করে বলল, “ফিরে যখন আসবি, মুখের ভেতর ঐসব যেন না দেখি। দুই পায়ে হেঁটে আসবি। এতো বড় দামড়া মরদ, চিত হয়ে পড়ে আছিস। ওঠ ব্যাটা তাড়াতাড়ি!”

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরটা থেকে বের হওয়ার সময় কেমন যেন দলা পাকিয়ে উঠছিলো ওর গলায়। এমন করলে কি আর পুরুষ মানুষের চলে! ইলোরা আর শ্রাবন্তী ওয়েটিং রুমের এক কোণে বসে ছিল। মুহিবকে দেখে শ্রাবন্তী তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো লিটুর কামরার দিকে। ভিজিটিং আওয়ারের বাকি সময়টুকু শুধুই তার।

লিটুর বাবা-মা গতকাল এসে দেখা করে গেছেন। গতকাল রাতেই লিটুকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তোলার কথা ছিল। কিছু টেকনিক্যাল ব্যাপারে সেই ফ্লাইট রিস্কিজিউলিং হয়েছে। আজকে দুপুর সাড়ে বারোটায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স টেক অফ করবে। শ্রাবন্তীর হাতে বেশি সময় নেই।

ইলোরার পাশে বসলো মুহিব। সারাজীবন কিছু সাধারণ কোড মেনে চলেছে সে, জীবনের যতোটা সফলতা তার পুরোটাই এই কোডগুলো মেনে চলার কারণে। এদের একটা ছিল যে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করা। এতোদিন সে এটা মেনে চলতে পারলেও আজকে এই মুহূর্তে লিটুর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ভাইরাস হারামজাদার ওপর হচ্ছে রাগ। ঢোকার জন্য আর কারও মাথা বেছে নিতে পারলি না হতচ্ছাড়া!

পাশে বসা ইলোরা ওর একটা বাহু শক্ত করে ধরলো যেন মুঠোর শক্তির ওপর নির্ভর করবে লিটুর সুস্থতা। তার দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে একটা হাসি ম্যানেজ করলো মুহিব, “চিন্তা করিস না। লিটু বাঘের বাচ্চা। ঠিক ঠিক ফাইট করে ফিরে আসবে এই হতচ্ছাড়া রোগটার সাথে। নাহলে শ্রাবন্তী ওর চামড়া তুলে নেবে।”

মাথা নাড়লো ইলোরা, কিছু বলল না।

“শামীম কোথায়?”

“পুরো টাকাটা তুলে আনতে গেছেন বাদল ভাই। শামীম গেছে সাথে।” ধীরে ধীরে একটা একটা করে শব্দ উচ্চারণ করলো ইলোরা। মুহিবের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলো, “টেনশন হয় রে।”

বান্ধবির দিকে নজর দিলো মুহিব। বেশ শুকিয়ে গেছে এ কয় মাসে, তাতে অবশ্য বেশ ভালোই দেখাচ্ছে তাকে আগের চাইতেও আকর্ষণীয়া দুশ্চিন্তায় রূপ কমে যায় কিছু মেয়ের, তাদের দলে ইলোরা পড়েনি। ওরা ওভাবেই বসে থাকলো মুর্তির মতো। একজন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অপর দুশ্চিন্তাগ্রস্তকে মোটিভেশনাল স্পিচ দিতে পারে না। সব সময় ঐ কাজটা করে নিরাপদ মাটিতে দাঁড়ানো মানুষ। সফলতা পেয়ে যখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি তখনই স্পিকারদের মুখ থেকে অনর্গল মোটিভেশন বের হয়। বিপদগ্রস্তদের জন্য সেসব নয়।

বাদল ভাই লিটুর সঙ্গেই গেলেন। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স টেক অফ করলো ঠিক ঠিক বারোটা একত্রিশ মিনিটে। দূর থেকে তাকিয়ে দেখলো মুহিব, শামীম, ইলোরা, শ্রাবন্তী। সূচালো নাক, মশার মতো দেখতে বিচ্ছিরি রকম একটা প্লেন। চারটা জানালা ঘিরে নীলচে ডিজাইন। ওপরে লিখা ‘ইয়াংওয়ান’। লেজে ‘এসটু-এইডি’। দৃশ্যটা মুহিবের আজীবন মনে থাকবে।

প্লেনটা যখন রানওয়ে ছাড়লো, ইলোরাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো শ্রাবন্তী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *