1 of 2

কুকুরদল – ২১

অধ্যায় ২১

কাঁচের গ্লাসের ওপাশে কালো রাত। মফস্বলে রাত নামে তাড়াতাড়ি। গুটি কয়েক বিশ্ববিদ্যালয় জায়গাটিকে এখনও প্রাণবন্ত করে রেখেছে, তবে এর তাৎপর্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছুটি হয়ে গেলে বোঝা যায়। যখন একই সঙ্গে একাধিক ভার্সিটির টার্ম ফাইনাল হয়ে যায় অথবা কোনো বড় জাতীয় ছুটিতে খাঁ খাঁ করে জায়গাগুলো। স্থানীয় অধিবাসীদের ভাষায় তখন ‘শহর’টা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। শামীম একবার একজন স্থানীয়কে প্রশ্ন করেছিলো, “তা, শহরটা কোথায়?”

এই মুহূর্তে তথাকথিত শহরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে তূর্ণা। হাতে সফট ড্রিংকসের গ্লাস। সামনে ঠাণ্ডা হচ্ছে খাবার। শামীম তার প্লেট নিয়ে সমান ব্যস্ত, তবে মুহিবের সামনেটা খালি। প্লেটের বদলে টেবিলের ওপর রাখা আছে তার স্মার্টফোনটি। একদৃষ্টিতে তূর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সে। বেশি নিখুঁত, একটু বেশিই নিখুঁত! এর থেকে বেশি কিছু ভাবতে পারলো না মুহিব। সাংবাদিক সত্তাটিকে থামিয়ে লেখক সত্তার ওপর ছেড়ে দিলো দায়িত্বটা।

সরু চোখের পাঁপড়ি, ভারি ভ্রু। ছোটো কিন্তু তীক্ষ্ণ নাক, কিছুটা ভরাট চোয়াল। ওপরের ঠোঁটটা যেন স্রেফ ক্যানভাসের ওপর লালচে এক তুলির আঁচড়, নিচের ঠোঁটে আকর্ষণ আছে, হাল্কা পুরুষ্ঠ আর কালচে ঠোঁট। তবে মেকআপে ঢাকা পড়বে।

“শান্ত একটা শহর।” অনেকক্ষণ পর মন্তব্য করলো তূর্ণা, “আই হেইট দিস সিটি।”

প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেবলমাত্র কিছু বাড়িঘর আর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি তত্তাবধায়নে গড়ে উঠলেই জায়গাটিকে শহরের মর্যাদা দেওয়া যায় কি না তা নিয়ে মুহিবের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা করার জন্য এখানে ওরা আসেনি। গত আধঘণ্টা ধরে তেমনটাই হয়ে এসেছে অবশ্য-অপ্রাসঙ্গিক সব আলোচনা। আলমগির কবিরকে তারা কিভাবে চিনেছে সেই গল্পটা আবার করতে হলো।

এখানে আসার আগে শামস ওকে বলেছিলো, “একটা গল্প লিখে ফেল।” মুহিব কিছুটা অবাক হয়েছে অবশ্যই, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কারও তার লেখালেখির স্কিল নিয়ে আগ্রহ নেই। রোবট কিংবা গাড়ি-টাড়ি বানাতে পারলে আলাদা সম্মান পেতো নিশ্চয়, তবে কেউ গল্প-উপন্যাস লিখে বলে প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্ব দেয় না কাউকে। বন্ধুদের মধ্যেই এই নিয়ে আলোচনা করা চলে না, বাইরের কারও কথা বলে কি হবে! সেখানে আজ প্রথমবারের মতো একজন বন্ধু তাকে গল্প লিখতে বলছে?

শামীম হেসেছিলো, “আমরা তূর্ণা আপুর সাথে দেখা করার আগে যা যা ঘটেছে সব কিছুর ওপর গল্প লিখে ফেলবি। অনেক কিছুই আমরা জানি না, তাতে কি? গল্প লিখতে হলে তো আর বাস্তবটা জানা লাগে না। তোর কাছে যুক্তিযুক্ত সমাধান যেটা মনে হবে তাই লিখবি।”

মুহিবের জন্য ইশারাই কাফি। পাল্টা জানতে চেয়েছিলো, “আমার লেখা খারাপ না। কিন্তু বাস্তবের সাথে তো মিলবে না আমার কল্পনা।”

মুচকি হেসেছিলো শামীম, “মেলার দরকার কি? বাস্তবতা তো তূর্ণা আপুও জানে না। তুই সব লিখে ফেল। লজিকে ঠিক থাকলেই হবে। তারপর তোর গল্পটা আমি একবার পড়বো। যা লিখবি তাই ঘটেছে ধরে নিবো আমরা। গতবারের মতো হোগামারা খাওয়ার ইচ্ছা আমার নাই। উল্টাপাল্টা গল্প ছাড়তে গিয়ে অপমান হওয়ার চেয়ে একটা সলিড স্টোরি লিখে সেটা মুখস্ত করে যাওয়া ভালো।”

পরিকল্পনাটা চমৎকার। এতে করে ওরা যখন তূর্ণার সঙ্গে দেখা করতে এলো, ওদের কাছে এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে সব কিছুরই বিশদ বর্ণনা ছিল। বাস্তবে এদের অনেক কিছুই ঘটেনি, সবই সত্যের সাথে একজন লেখকের অনুমান, কল্পনাপ্রসূত মাল-মশলা, তা আলাদা করে বোঝার উপায় কারও ছিল না।

গল্প শুনে প্রভাবিত না হয়ে পারেনি মেয়েটি। তার মনে হওয়া স্বাভাবিক এই ছেলে দুটো অনেক, অনেক বেশি জানে। শামীমের পরিকল্পনা আদতে সফল হয়েছে, অল্প সময়ের মধ্যেই মেয়েটির মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে ওরা। কিন্তু ওদের এখানে আসার উদ্দেশ্য কারও মনোযোগ ধরে রাখা নয়।

“গত কয়েক মাস ধরে শহরটাকে আগের মতো শান্ত বলা যাচ্ছে না।” কাজের কথায় নামার প্রস্তুতি নিলো মুহিব, “নাহলে হয়তো এই ডিনারটা আমাদের করা হতো না।”

নির্লিপ্তভঙ্গিতে হাতের গ্লাসটায় চুমুক দিলো তূর্ণা, “কবির আমাকে একটা হিন্টস দিয়েছে। শামসের ব্যাপারে তোমরা কাজ করছো। নিউজটা তোলার জন্য আমার সাথে কথা বলতে চাইছো। তবে সেজন্য তোমাদের সাথে দেখা করতে রাজি হইনি আমি। আই হেইট মিডিয়া।”

“আপনার পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখা হবে-” শুরু করেছিলো শামীম। টেবিলের নিচে তার পায়ে একটা লাথি দিয়ে থামালো মুহিব। মেয়েটা একটা পয়েন্ট মেক করতে চাইছে, এর মধ্যে আলাদা করে কিছু বলার দরকার নেই, এখন তাকেই কথা বলতে দিতে হবে।

“কিন্তু?” সরাসরি তূর্ণার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো সে।

কাঁধ ঝাঁকালো মেয়েটি, চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি।

“মিডিয়া ঘৃণা করা সত্বেও আপনি আমাদের সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছেন। একটা কিন্তু তো আছে।”

রহস্যময় একটা হাসি ফুটে উঠলো তূর্ণার মুখে। আনন্দের ছাপ সেখানে নেই, একমাত্র মানবিক অনুভূতি সেখানে নিষ্ঠুরতা। সামান্য ঝুঁকে এলো এলাকার আলোচিত সুন্দরি, “নিউজ করা নিয়ে তোমাদের মাথাব্যথা তো নেই।”

শামীমের হাতের চামচ আর নড়ছে না। মুহিব আগের মতোই ভাবলেসহীন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তূর্ণার দিকে। সুন্দর চেহারার সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার দেখা মেলা একটা বিরল ঘটনা বলে জনশ্রুতি আছে। ওরা এখন তেমন একটা ঘটনাই প্রত্যক্ষ করছে।

“তোমরা দুইজন চাইছো শামসের খুনিকে ধরে বিচারের আওতায় আনতে। ক্যাম্পাসে হিরো হয়ে যাবে তারপর। এমনটাই তো চাইছো তোমরা, তাই না?” টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছে নিলো তূর্ণা, “কবির আমাকে যখন তোমাদের ব্যাপারে বলল তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে হবে আমাকে।”

এবার একে অন্যের দিকে তাকালো মুহিব আর শামীম। দু’জনের কেউই বুঝতে পারছে না আলোচনাটা কোনদিকে যাচ্ছে। টেবিলের ওপার থেকে ডানহাতের তর্জনিটা পিস্তলের মতো মুহিবের বুকের দিকে তাক করেছে তূর্ণা, “তোমরা ভেবেছো এখানে আমি এসেছি নিজের ব্যাপারে বলতে। ভুল। আমি এসেছি তোমাদের ব্যাপারে কিছু বলতে।”

“আমি বুঝতে পারছি না আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন।” সত্যি কথাটাই বলল মুহিব।

“কবির আর ঐ ভ্যাগাবন্ডটার সামনে তোমরা যা বলেছো বলেছো। কিন্তু এই কাজটা তোমাদের থামাতে হবে।” থমথমে হয়ে আছে তূর্ণার মুখ, “বুঝতে পারছো আমার কথা? যেখানে সেখানে গিয়ে তোমরা শামসের খুনিকে নিয়ে প্রকাশ্যে আলাপ করতে পারো না।”

“আমরা—”

“শাট আপ।” ধমকে উঠে মুহিবকে থামিয়ে দিলো তূর্ণা, “আমার মতো একটা মেয়ে আধ মাইল দূরে বসে স্রেফ ফোনে শুনেই যদি বুঝে ফেলতে পারে নিউজ করা নিয়ে তোমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তোমরা চাও খুনিকে নিজেরা তদন্ত করে ধরে ফেলতে, তবে শামসের খুনিও বিষয়টা বুঝতে পারবে। তোমরা নিজেদের জীবন নিয়ে খেলছো। ও যদি একবার জানতে পারে…”

কথাটা শেষ না করেই জানালা দিয়ে বাইরের কালো, শুন্য আকাশের দিকে তাকালো তূর্ণা।

“ও?” শামীমের কানে ধরা পড়েছে বিষয়টা, “আপনার কথার ধরণে মনে হচ্ছে খুনিকে আপনি চেনেন।”

ছোটো বাচ্চারা বোকার মতো কথা বললে যেভাবে তাদের দিকে বড়রা তাকায়, সেভাবেই তাকালো তূর্ণা। অবশিষ্ট তরলটা গলায় চালিয়ে ওয়েটারের দিকে ইশারা করলো।

“বিলটা দিয়ে যাবেন প্লিজ?” ওয়েটার কেটে পড়তেই ওদের দু’জনের দিকে তাকালো তূর্ণা।”তোমরা এখানে নতুন। ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট, নিজেদের বিগ শট ভাবার একটা প্রবণতা দেখি তোমাদের মাঝে। যখন আমি তোমাদের বয়সে ছিলাম, এমনটা আমার সাথেও হয়েছে। দুনিয়া পাল্টে দেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করেছি। তোমাদের অবস্থানটা আমি জানি। আমার কথা শোনো, পরে আমাকেই ধন্যবাদ দেবে। ট্রাস্ট মি।”

“আর শামসভাইয়ের কেসটা ছেড়ে দেবো? আপনিও জানেন এমনি এমনি এই খুনি ধরা পড়বে না।” দাঁতে দাঁত চেপে ধরে উচ্চারণ করলো শামীম।

তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো তূর্ণা, “সো হোয়াট? নিজেদের কি মনে করো তোমরা? শামসের গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল? শামসের তো আর এমন কিছুর দরকার নেই। যে রাতে দরকার পড়েছিলো, তার পাশে কেউ ছিল না।”

অপরাধবোধটা চেপে ধরলো মুহিবকে। চোখ নামিয়ে নিলো এবার, প্রথমবারের মতো। তার প্রতিক্রিয়ার কোন অর্থটা শামসের এক্স-গার্লফ্রেন্ড গ্রহণ করলো সেটা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তবে মুহিবের অপরাধবোধ ছাপিয়ে তুলছে ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি। ক্রোধ, আতঙ্ক আর জেদের মিশ্রণে।

“জাকি ভাইয়ের সাথে এই খুনের সম্পর্কটা কি?” চোখ তুলেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো সে, নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে।

“জাকি? হোয়াট নন্সেন্স।”

“ইয়েস, জাকি। শামসভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড। তার সাথে পুরো ঘটনাটার সম্পর্ক কোথায়?”

“ইউ’ভ লস্ট ইট, মুহিব। ইউ’ভ কমপ্লিটলি লস্ট ইট!”

“দুশ্চিন্তায় পড়লে আপনি ইংরেজি হয়তো একটু বেশি বলেন। আমরা জানি ঘটনাটার সাথে জাকি ভাইয়ের সম্পর্ক আছে।” মুহিবের বারুদে যেন জ্বলে উঠেছে শামীমও, “ঘটনার আগে জাকি ভাইকে প্রচণ্ড মার খেতে হয়েছিলো তোফায়েলের হাতে। ঐ মারামারির সাথে শামসভাইয়ের খুন যে সরাসরি সম্পর্কিত তা আমাদের জানা আছে। আমাদের জানা আছে জাকি ভাইয়ের ভূমিকার কথা, যদিও মনে হয় না ঘটনার আগে এতোকিছু আপনি জানতেন। তবে জাকি ভাইয়ের সিদ্ধান্ত আপনি মেনে নিতে পারেননি, তাই না? আমরা আপনাকে শুধু ডিটেইলসগুলো ফিল আপ করে দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।”

তূর্ণার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। গুলপট্টি মারার স্ট্র্যাটেজি এখনও কাজে লাগাচ্ছে ওরা। হাতে থাকা তথ্যগুলো ব্যবহার করে এই সন্ধ্যাতে লিখে ফেলা গল্পের প্লটটা সফল। মুহিব এখন একজন সফল লেখক। তার লেখা কাহিনীর ওপর ভিত্তি করেই তূর্ণার ওপর প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে মারা হয়েছে এই মাত্র। এবং মেয়েটির মুখভঙ্গি দেখে ওদের মনে হলো, লক্ষ্যভেদ হয়েছে।

“আপনি যদি আমাদের জানা তথ্যগুলোর সঙ্গে বর্ণনাটুকু জুড়ে দেন, তাহলে আমাদের উপকার হয়। আপনারও হয়। কারণ,” ভিলেনের মতো হাসলো মুহিব, “আপনি আমাদের কিছু না বললে আমরা বাকিটা কল্পনা দিয়ে পূর্ণ করে নিবো।” যেন এতোক্ষণ তেমনটা করেনি ওরা, “ভুল তথ্যও চলে যেতে পারে পাবলিকের কাছে। মিডিয়া কিভাবে পাবলিক ক্ষেপাতে পারে তা তো আপনার অজানা নয়। প্লিজ, আপু, চাইছি আমাদের দুই পক্ষের ভালোর জন্য হলেও আপনি কিছু বলবেন।”

ওয়েটার বিল নিয়ে এসেছে। মুহিব অথবা শামীম কিছু করার আগেই বিলটা পুরোপুরি নিজেই দিয়ে দিলো তূর্ণা। ওয়েটারের হাতে করে ফেরত পাঠালো কাউন্টারে। সামান্য এই বিরতিটা নিজেকে ফিরে পেতে ভালোভাবেই কাজে লাগালো ওদের থেকে দুই বছরের সিনিয়র মেয়েটি।

“তোমরা কিছু তথ্য জেনেছো। তবে কিছু তথ্য অনুমানও করছো।” মিষ্টি করে হাসলো তূর্ণা, অনেক ছেলেরই হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার মতো হাসি। চেহারার মতো ভাঁজগুলোও ফুটে উঠেছে নিখুঁতভাবে।”আর মিথ্যে তথ্য দিয়ে রিপোর্ট পাবলিশ হওয়ার পর রিপোর্টারদের লাইফ কিভাবে হেল করতে হয় তার ওপর আলাদা ডিপার্টমেন্টই আছে আমাদের ভার্সিটিতে। তোমাদের মতো কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং-ই এখানে শেখানো হয় না। কিছু পাবলিশ করার আগে সবদিক ভেবে দেখবে আশা করি।”

হাতব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তূর্ণা, “আমি এখন বের হবো। এই কেসটা নিয়ে তোমাদের কিছু অফার করার মতো নেই আমার কাছে। দু’জন ছোটোভাই হিসেবে তোমাদের ডিনার ট্রিট দিলাম ধরে নিতে পারো। আমার কথাগুলো মনে রাখবে। গলিতে গলিতে গিয়ে শামসের ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করো না, তোমাদেরই ক্ষতি হবে। প্রাণটাও খোয়াতে পারো। এটা খুব সেন্সিটিভ একটা ইস্যু।”

রেস্তোঁরার বাইরে রাতের ঠাণ্ডা বাতাস। শামীমকে একরকম জোর করেই আপুর বাসার জন্য একটা রিকশা ধরে আনতে পাঠালো মুহিব। জিন্সের পকেটে দু-হাত পুরে তূর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। স্নিগ্ধ মুখের ত্বক ভেদ করে ভেতরের মস্তিষ্কে কি চলছে জানার কোনো উপায় নেই। মনের কথার ছাপ মুখের ওপর পড়তে দেওয়ার মতো মানুষ এই মেয়েটি নয়।

“আশা করি আমাদের অ্যাপ্রোচে কিছু মনে করেননি।” একটু কেশে বলল মুহিব, “ডিনারের মধ্যে শামসভাইয়ের খুনিকে ধরার জন্য কাজ করছি এমন একটা কথা বলেছিলেন আপনি। অস্বীকার করবো না, ঠিকটাই ধরেছেন। ব্যাটাকে প্রমাণসহ আদালতে তোলার জন্য আমি যে কোনো কিছুই করতে রাজি আছি। আমি জানি আমার ক্ষমতা কম, তবে অন্তত ক্যাম্পাস টোয়েন্টিফোর সেভেনের মাধ্যমে আমরা বার বার পরিবেশটা তাঁতিয়ে তুলতে পারবো। আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তা হবে নিয়ামক …”

কাঁধ ঝাঁকালো তূর্ণা, “প্লিজ! এইসব ফালতু কথা বলে কবিরকে হয়তো হাতিঘোড়া বুঝিয়েছো, আমাকে বোঝাতে এসো না। মিডিয়া কাভারেজ কোনোদিনই তোমাকে জাস্টিস এনে দিতে পারবে না। মিডিয়া কাভারেজের কারণে যদি এক কোটি মানুষকেও রাস্তায় নামিয়ে নিয়ে আসতে পারো, তবুও অনেক সময় প্রকৃত খুনির বিচার না হতে পারে। এক বছর আগে একটা রেপ কেস খুব তোলপাড় তুললো না? প্রায় দশ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে বসে থাকলো। কোথায় সেই রেপিস্ট? কিছু হয়েছে তার? হয়নি। এটাও তেমন একটা কেস, মুহিব। লিভ ইট অ্যালোন।”

তুলনাটা কি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলার মতো হয়ে গেলো না? তূর্ণার চেহারায় এখনও কোনো অভিব্যক্তির ছাপ নেই। নিজের এই বক্তব্য সে কতোটা বিশ্বাস করে? মুহিবের জানা নেই। তবে শিয়ার বাবার মতো সহজে একে ‘হাতিঘোড়া’ বোঝানো যাচ্ছে না।

“শামসভাইয়ের খুনির শাস্তি হোক সেটা আপনি চান না?”

গভির চোখে তার দিকে তাকালো তূর্ণা। নিচু গলায় এর উত্তর দেওয়ার আগে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ওভাবেই।

“আইনের মারপ্যাচ, সাংবাদিকতা আর আন্দোলন কোনোভাবেই এই কেসটা তুমি সলভ করতে পারবে না মুহিব। শামসের খুনির কিছু হতে হলে নেহায়েত দৈব ঘটনার প্রয়োজন। আমার কথা তুমি বুঝতে পারছো?”

উত্তর দিতে কয়েক সেকেন্ড নিলো মুহিবও। তারপর স্রেফ মাথা ঝাঁকালো।

“আর আমি চাই না এর মধ্যে তোমরা আমাকে টানা–হ্যাঁচড়া করো। আজকে তোমাদের সাথে দেখা করে একটা ব্যাপার নিশ্চিত করতে চেয়েছি…” একটু ইতস্তত করলো মেয়েটা, “তোমরা কি আমাকে কথা দিতে পারো যে এইসব এনকুয়ারির মধ্যে আমাকে কোনোভাবে জড়াচ্ছো না?”

রাতারাতি এরকম কোনো কথা দিতে রাজি নয় মুহিব। চুপ করে থাকলো সে।

“তোমরা আমার নিরাপত্তা দিতে পারবে না। যেহেতু তা করতে তোমরা পারছো না, একটা মেয়ে যদি কিছু জেনেও থাকে তোমাদের জানাবে না।” রাস্তার দিকে চোখ ফেরালো তূর্ণা, “যাক, শামীম তাহলে রিকশা পেয়েছে। মেনি থ্যাংকস।”

কয়েক সেকেন্ড পর অপসৃয়মাণ রিকশাটির দিকে তাকিয়ে দু-হাতে নিজের চুল পেছনের দিকে টেনে ধরলো শামীম, “হোয়াট আ ওয়েস্ট অব টাইম! কিছু তো জানা গেলোই না, মাঝ দিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্রাদারজোনড করে দিলো দুই ক্যাম্পাস কাঁপানো সুন্দরি। ছোটোভাইদের ট্রিট দিচ্ছে, হোলি ফাকা

তার কাঁধে বার দুয়েক চাপড় দিলো মুহিব, “তোর ধারণা ভুল। এই মিটিং থেকে যতোটা আশা করেছিলাম তার থেকেও বেশি কিছু জানতে পেরেছি আমরা।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *