1 of 2

কুকুরদল – ১২

অধ্যায় ১২

“গান্ধীজির নীতি মেনে চলতো নাকি এই লোক?” বিতৃষ্ণার সাথে মাত্ৰ শেষ হওয়া হাফ লিটারের কোকটাকে লাথি মেরে দূরে ফেললো মুহিব, “মার আগেও খেয়েছে, আবারও খেয়েছে। এক গালে চাপড় পড়ার পর মনে হয় দ্বিতীয় গাল খুশিতে বের করে দিয়েছে। বোকাতোতা। কোনো সন্দেহ নেই তূর্ণার মতো একটা মেয়ে তাকে ডাম্প করবে।”

রাস্তায় গড়াতে থাকা বোতলটাকে নিয়ে ড্রিবল করতে করতে এগিয়ে গেছিলো শামীম, সামান্য পিছিয়ে এলো এবার, “তূর্ণার সাথে তার রিলেশন নাও থাকতে পারে। তাছাড়া সাবলিহা নিয়ে সুমনকে অনেকটাই শিওর মনে হলো। তূর্ণার সাথে জাকি ভাইয়ের সম্পর্কটা ঠিক কি ছিল তা বের করতে হবে আমাদের।”

কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটলো দুই বন্ধু। সমস্যার জট খুলে আসার বদলে তা আরও বাড়ছে। তূর্ণা মেয়েটা কোথায় থাকে বা কোথায় পড়াশোনা করে তা জানতে পারেনি ওরা। তার সঙ্গে পুরো ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে কি না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ওরা জানে না ঠিক কি নিয়ে জাকি ভাইয়ের সাথে তোফায়েলের ঝামেলা বেঁধেছিলো। সুমন এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেনি। তার তৈমুর ভাই হয়তো জানতেন না।

এখন আমাদের হাতে দুটো নিরেট তথ্য।” দুই আঙুল তুললো মুহিব, ‘এক. জাকি ভাইদের গ্রুপের সাথে তোফায়েলদের গ্রুপের সমস্যা আছে। এটা অবশ্য সবাই জানে। তবে তোফায়েল যে দ্বিতীয়বার জাকি ভাইয়ের মাথা ফাটিয়েছে তা ক্যাম্পাসে ছড়ায়নি। ফাটা মাথার কারণেই সে বন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরও ডুব দিয়ে ছিল। হয়তো হাসপাতালেও সময় কাটাতে হয়েছে তাকে। সুমনের মতে, জাকি ভাই এসব গোপন রাখতে চেয়েছেন নিজের অথবা দলের সম্মানের কথা ভেবে। একই সংগঠনের ছেলেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে যায়-এটা দলের রেপুটেশনের জন্য খারাপ। তবে এই ধামাচাপা দেওয়ার পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে। শামস-হত্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত কোনো কারণ। তাই না?”

মাথা দোলালো শামীম, “তা তো অবশ্যই। তোর দ্বিতীয় নিরেট তথ্য কোনটা?”

“মাথা ফাটাফাটির এই ঘটনা ঘটেছে শামস-হত্যার কিছুদিন আগে, নয়তো প্রায় সমসাময়িক কোনো সময়ে। বন্ধুর মাথা ফাটার দু’দিন পর খুন হয়ে গেলো শামস? আমরা ধারণা করতে পারি, ঘটনা দুটো ইন্টার–রিলেটেড।”

“তা ঠিক। তবে আমি তৃতীয় একটা পয়েন্ট যোগ করবো। তূর্ণার সঙ্গে এই ঘটনার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। অন্তত আমার ধারণা তেমনটাই।”

“কাকতালও হতে পারে। আমাদের এই মুহূর্তের সম্পূর্ণ মনোযোগ পাচ্ছে শামস-হত্যা। সেজন্য সব ঘটনাকেই আমাদের মনে হচ্ছে এর সাথে রিলেটেড। যেমন চাঁদে মানুষ দেখেছিলো সাঈদীর ছবি। অটো সাজেশন যা দেখতে চাই তাই দেখাবে। আমাদের তেমন সবখানে দেখাচ্ছে শামস–হত্যাকাণ্ড। কোনটা আমাদের প্যারানয়া আর কোনটা রিয়েলিটি তা বুঝতে আমারই সমস্যা হচ্ছে, তোকে আর কি বলবো।”

“তূর্ণার সাথে ভাইয়ের কানেকশনকে আমি প্যারানয়া বলবো না। বরং ভেবে দেখতে পারিস, মাথা ফাটার কথা যেন কেউ না জেনে ফেলে তাই অনেকগুলো দিন ঘর থেকে বের হয়নি জাকি ভাই। তার সঙ্গে এতো উতলা হয়ে দেখা করতে পারে কে? সাবলিহা, তাই তো? কিন্তু সাবলিহাকে আমরা কাঁদতে কাঁদতে হল ছাড়তে দেখিনি। দেখলাম তূর্ণাকে। জাকি ভাইও ভরা রোদে ক্যাম্পাসে ব্যান্ডেজ নিয়েই বের হলেন কেন? তার চেহারাটা তুই দেখেছিস। ডেসপারেট। যে কারণে জাকি ভাই নিজেকে আড়াল থেকে বের করে আনতে পারেন, তার সাথে শামস-হত্যা জড়িয়ে থাকতে পারে।”

“তোর কথাতেও যুক্তি আছে।” একমত হলো মুহিব, “আসলে আমাদের হাতে তথ্য এতো কম যে সবখানেই শামসভাইয়ের কেসটা দেখতে পাচ্ছি। অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী দশা আরকি।”

ক্যাম্পাসে অন্ধকার নেমে এসেছে। সিভিল বিল্ডিংয়ের পুকুরপাড়ে কারা যেন একটা গিটার নিয়ে বেসুরো গান ধরেছে। বাসর ঘরের বাত্তি থেকে বারো মাস তোমায় ভালোবাসি–সবই চলছে। সেদিকে খানিকটা ঈর্ষা নিয়ে তাকিয়ে থাকলো মুহিব। ওরকম নিশ্চিন্ত মনে আরেকবার আড্ডা দিতে পারবে সে কবে? নতুন দুশ্চিন্তা জাগাবার মতো প্রসঙ্গটা তখনই মনে পড়লো তার।

“মেসের দিকে যেতে হবে আমাকে।” শামীমকে বলল মুহিব, “ফিটিং শপের ল্যাব রিপোর্ট লিখা বাকি। কালকে মনে হয় জেএফকের ক্লাস টেস্ট ও আছে। একটা লাইনও পারি না।”

“আমিও না।” হাতঘড়ি দেখলো শামীম, “সময় আছে অবশ্য। দুই ঘণ্টা ‘রাম’পড়া দিলেই হয়ে যাবে। এখন বল, আমাদের নেক্সট গেমপ্ল্যান কি?”

“শামসভাইয়ের পরিচিতদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। তাদের লিস্ট করবো আমরা। তারপর চেষ্টা করবো একে একে সবার সাথে কথা বলতে।”

“কথা বলার জন্য আমাদের একটা ভ্যালিড গ্রাউন্ড লাগবে। আর দশজন অতি উৎসাহী ছাত্র যে আমরা নই তা বোঝাতে হবে।

“সেজন্যই ক্যাম্পাস-টোয়েন্টিফোর সেভেনের একটা আইডি কার্ড তোকে যোগাড় করে দেবো আমি। কৌশিক ভাইকে বলে দেখি।”

ওদের ক্যাম্পাসের নিউজ পোর্টাল campus247.com। নির্ভরতার প্রতীক। চিন্তিত মুখেই হেসে ফেললো শামীম, “আমাকে মিডিয়া বানাচ্ছিস?”

“নাহলে কার ঠেকা পড়েছে তোর সাথে কথা বলার?” মুচকি হাসলো মুহিবও, “তবে প্রথমে আমাদের দরকার শামসভাইয়ের সব কন্ট্যাক্টকে। গার্লফ্রেন্ড, ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডস। ধীরে ধীরে খোঁজ নে। ঘটনাটা কেন ঘটালো ওরা, তা আমাকে জানতেই হবে।”

আরেকবার সিভিলের পুকুর পাড়ে তাকালো মুহিব। উচ্চকণ্ঠে হাসির শব্দ ভেসে আসছে ওদিক থেকে। সবগুলো যেন চৌদ্দগুষ্ঠিসহ ক্যান্সারে মরে-মন থেকে বদদোয়া দিতে দিতে মেসের পথে পা বাড়ালো মুহিব।

*

ঘুম থেকে উঠে ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠলো লিটু। এতো বেশি বাজবে তা আশা করেনি। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ক্লাস মিস করেছে আজ। বন্ধ দরজার দিকে তাকালো একবার। সকালে মুহিব নির্ঘাত লাখিয়ে এর বারোটা বাজিয়েছে। সিঙ্গেল রুমে থাকে ওরা মেসে। কাজেই ঘুম ভাঙানোর জন্য কার্যকরী পদ্ধতি দরজায় লাথানো। মেসের প্রোপাইটর বাচ্চুদার জন্য জরিমানা ডাকার ক্ষেত্রেও অনেকটা কার্যকর এই পদ্ধতি। আকসার ছিটকানি ভাঙছে। বাচ্চুদা সবগুলো দাঁত বের করে জানাচ্ছেন, “এক হাজার টাকা জরিমানা দাও, মামা। তোমার ছিটকিনি আমি ঠিক করে দিচ্ছি।”

এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে সোজা হয়ে বসলো বিছানায়। মোবাইলটা চেক করে দেখলো একবার। দুপুর দুইটা চৌত্রিশে শ্রাবন্তী একটা মেসেজ দিয়েছে। নির্মল একটা হাসি ছড়িয়ে গেলো লিটুর মুখে। মেসেজটা ওপেন করলো না। করলেই তো শেষ।

শ্রাবন্তীর সাথে টুকটাক মেসেজিং হচ্ছে ইদানিং। একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য আলাপ। নিজেদের কিংবা পরিপার্শ্বের ব্যাপারে না। নাসার নতুন এক প্রজেক্ট শেয়ার করেছিলো মেয়েটা। সেটার সূতো ধরেই তাকে নক দিয়েছিলো লিটু। শ্রাবন্তীর সঙ্গে চ্যাট করা অনেকটা ইউটিউবে ভিডিও দেখার মতো। শুরু করবেন নাসার প্রজেক্ট দেখে, চার ঘণ্টা পর দেখা যাবে তামিম ইকবালের অবিস্মরণীয় কোনো এক ইনিংসে গিয়ে শেষ হয়েছে।

তবে কথা তো হচ্ছে, এটাই অনেক ভালো লাগার। লিটু এতোটুকুতেই অনেক সুখি। শ্রাবন্তীর সাথে তার ভবিষ্যৎ নেই এটা সে জানে। আয়নাতে সে নিজেকে অনেকবার দেখেছে। তাছাড়া শ্রাবন্তীর বাবা এই শহরের প্রাক্তন মেয়র। মানে, ‘লোকাল মেয়ে’! হেজিপেজি ছেলের সাথে মেয়ের সম্পর্ক গড়বে না, বন্ধুত্ব পর্যন্ত ঠিক আছে। এখন অবশ্য শ্রাবন্তীর বাবা ঢোঁড়া সাপ। ক্ষমতা নেই। দেশের মসনদে বিরোধী পক্ষ। তিনি একরকম অদৃশ্য। তবুও প্রাক্তন মেয়রের একটা ওজন আছে। সেই ওজনের তুলনায় লিটুর পরিবার খড়কুটো।

গতকালও বাবা ফোন করে বললেন এবার এমাসে পাঁচশ টাকা কম পেলে লিটুর সমস্যা হবে কি না। বিস্তারিত তিনি বলেন না। চাষাভূষো মানুষ হলেও ছেলেকে ভালোবাসেন প্রচণ্ড। অভাবের সংসারে একজন কর্মক্ষম ছেলের মূল্য গ্রামের মানুষ বোঝে। লিটুর বাবাও বুঝতেন। কিন্তু নিজের আরাম আয়েশের দিকে তাকিয়ে দেখেননি তিনি। পড়াশোনা শেখেননি নিজে, তেমন কি আর বোঝেন? ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে এটুকু অবশ্য বুঝতে সমস্যা হয়নি। এই গ্রামের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে তাই তো এক বিরল ঘটনা। সেখানে ছেলে তার নিজের! দ্বিধা না করে তাকে শহরের দিকে একা ঠেলে দিয়েছেন।

কিন্তু ফসলে মন্দা এলে তেরোজনের সংসার চালানো যা তা কথা নয়। ছেলেকে ফসলের মন্দা বলা যায় না, দুশ্চিন্তা করবে। পড়াশোনায় ক্ষতি হবে। কিন্তু না চাইলেও আগে থেকে বলে রাখতে হয় আগামি মাসে টাকা একটু কম নিতে হবে তাকে। চলবে তো?

পরিবারের সবার মুখ লিটুর সামনে ভেসে উঠলো। ওদের ফেলে সে ঠিক তো বেরিয়ে এসেছে বাইরে। পিচ্চি তিনটা একদম পিঠাপিঠি। স্কুলে যে চারটা পড়ছে তারা আবার সমবয়সী-প্রায়। ওদের ভীষণ মজা। স্কুল তাদের দখলে। স্কুল পার করা দুই বোন কলেজে আর পড়েনি। একজন তো এসএসসি-ই পাশ করতে পারলো না। পড়াশোনায় মাথা নেই। লিটু অবশ্য এটা মানতে রাজি না। নির্দেশনার অভাব। চামেলীর মাথা সবখানেই ভালো। পরীক্ষায় পাশ করতে পারলো না কেন? দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইলটা সরিয়ে রাখলো লিটু।

মফস্বলে টিউশনি করিয়ে টাকা নেই। সাত কিলোমিটার দূরে গিয়ে টিউশনি করিয়ে মাস শেষে পায় দেড় হাজার টাকা। তার মধ্যেও ডাক্তার গৃহকর্ত্রী ধানাই পানাই করেন। টাকা দিতে তার মনে থাকে না। মাসের প্রথম থেকে পড়িয়ে এসে লিটু টাকা পায় মাসের বিশ তারিখের দিকে। অনেক সময় টাকার বাণ্ডিলে একটা দুটো একশত টাকা কম থাকে। খুব নাকি টানাটানি তাদের তিন রুমে এসি লাগানো সংসারে। কিন্তু এই টিউশনিটার ওপরই লিটুর অস্তিত্ব জড়িয়ে। পারলে বাবাকেও কিছু পাঠায়। এ মাসে মনে হয় আর পাঠানো সম্ভব হবে না।

গায়ে কম্বল জড়িয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলো লিটু। টিউশনিতে যেতে হবে। ঘুমিয়ে দেরি করে ফেলেছে। টয়লেট থেকে ফেরার সময় মুহিবের সাথে দেখা হলো। ইলোরাকে নিয়ে কি কাহিনী জানি শোনাতে চাইছিলো, তবে সময় কোথায়! পরে শোনার কথা বলে দ্রুত বের হলো লিটু।

মুহিব এতোক্ষণ শামীমের সাথে আড্ডা দিয়েছে। নিজেকে মাঝে মাঝে বহিরাগত মনে হয় লিটুর। ইদানিং এমনটা হচ্ছে। সেদিন আজিজ মামার চায়ের দোকানে গিয়ে দেখলো মুহিব আর শামীম আগে থেকেই বসে আছে। ও তো এখানেই থাকে, মুহিবের পাশের রুমে। ওকে কি ডাকতে পারতো না? দুটো কি নিয়ে জানি গুটুর গুটুর করে প্রায়। লিটুকে দেখলে চুপ হয়ে যায়।

হাত দিয়ে চুল আঁচড়ানোর চেষ্টা করতে করতে সদ্য থেমে যাওয়া অটোতে উঠে বসলো লিটু। চুলের সাথে চেষ্টা করছে বিক্ষিপ্ত মনটিকেও গুছিয়ে নিতে। পারলো না। মাথায় ঘুরছে শ্রাবন্তী। মুহিব-শামীম। ইলোরা–হাকারবিন। বাবার মুখ, পিচ্চিগুলোর হাসি। অবেলায় ঘুমিয়ে এমন হয়।

হ্যান্ডেল ধরে রাতের রাস্তায় তাকিয়ে থাকলো টিটু। চোখে শুন্য দৃষ্টি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *