1 of 2

কুকুরদল – ০

সূচনা

মুহিবের মুখ লাল হয়ে আছে।

মুখ লাল হয়ে যাওয়ার পেছনে যথাযথ কারণ বর্তমান। সস্তাদরের এক মেসে এসে উঠার মাত্র তিনদিন হলো। ঢাকা ছেড়ে মফস্বলে এসে এমনিতেই অগণিত সমাধানের অযোগ্য সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। টয়লেট পেপার কিনতে ছয় কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। বাস-টাস থাকলে ছয় কিলোমিটার কোনো দূরত্ব না। তবে এই পোড়া মফস্বলে বাস চলে না। ব্যাটারিচালিত অটো ধরে টয়লেট পেপার কিনতে হয়েছে।

টয়লেট পেপারের সমস্যা মেটাতে মেটাতে সস্তাদরের মেসটা লোকজনে টইটম্বুর হয়ে গেলো। তিন দিন আগেও বেশ খালি খালি চেহারা ছিল জায়গাটার। মেস ম্যানেজারের নাম বাচ্চু। আগে থেকে এখানে যারা থাকতো তারা শুধু বাচ্চু বলে ডাকে না, বলে বাচ্চুদা। ম্যানেজার দাদা বিনয়ে বিগলিত হয়ে গেলেও অন্যরা আড়ালে মুখ টিপে হাসে।

মুহিব শক্ত মুখে জামা পরতে পরতে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলো। তিনশ’ চৌদ্দের লিটু দরজা খুলে কচ্ছপের মতো মাথা বের করেছে। হাতে বালতি আর শুকনো চুল দেখে প্রশ্ন করলো, “কি রে, গোসল করলি না?”

লিটুর সঙ্গে মুহিবের পরিচয় হয়েছে গতকাল। মুহিবের রুম নম্বর তিনশ’ পনেরো। পাশের রুমে একজন ফার্স্ট ইয়ারের ছেলে পেয়ে খানিক খুশিই হয়েছে ও। এক রাতে হাড়ির খবর বের করে ফেলেছে। লিটুরা সাত ভাই, চার বোন। এটা যে দুই হাজার আঠারো সাল, তা বিশ্বাস হওয়ার জো নেই। পরিবার না, সাক্ষাৎ ফুটবল ক্লাব। দলের চারজন আবার প্রমীলা ফুটবলার প্রমীলা ফুটবলারদের বিয়ে দেওয়ার তোড়জোর করলেও বিশেষ সুবিধে হচ্ছে না। লিটুর বাবা থানা নির্বাহী অফিসার নন যে তার মেয়ের জন্য পাত্রের লম্বা লাইন পড়ে যাবে। তিনি একজন কৃষক, লিটুর ভাষ্যমতে “চাষাভূষো মানুষ”। চাষাভূষো মানুষের মেয়ের বিয়ে মুফতে হয়ে যায় না। মালপানি ঢালা লাগে। লিটুর বাবার মালপানি তেমন নেই।

মুহিবের মুখ এখনও লাল। শক্ত করে একবার ঘাড় নেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লো সে। ঘর বললে অবশ্য জায়গাটিকে অনেক বেশি সম্মান দিয়ে ফেলা হয়। ঘরের ক্ষেত্রফল বেয়াল্লিশ বর্গফুট। একপাশে ছয় ফিট, আরেকপাশে সাত। একে বড়জোর কুঠুরি বলা যেতে পারে। বিমর্ষমুখে একটা সিগারেট ধরিয়ে টেবিলের ওপর থাকা ডেস্কটপটা অন করলো মুহিব।

মফস্বল এই শহরে ঢোকার পর থেকে সিগারেটটা খুব খাওয়া হচ্ছে। ঢাকাফেরৎ বলে টাকার সাগরে ভাসছে তেমন না। বাড়ি থেকে মাসের খরচ বাবদ পাঠানো হয় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। তার মধ্যে ঘর আর খাবার ভাড়া বাবদ বাচ্চুদা বুঝে নেন সাড়ে তিন হাজার। দুই হাজার টাকায় মাস চালানো শক্ত কাজ। শক্ত কাজটা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছে মুহিব। মন মেজাজ খারাপ থাকলেই ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলা এখন কোনো কাজের কথা না। এখানে আসার পর থেকে নিয়মিত মন মেজাজ খারাপ থাকছে।

মন ভালো করার জন্য ইতিকে একটা ফোন দেওয়া যায়। মাউস নেড়ে ডেস্কটপের স্লিপ মুড সরাতে সরাতে ফোনটা কানে ঠেকালো মুহিব।

ফোন ধরলো ইতির মা, কঠিন কণ্ঠে জানতে চাইলেন, “কাকে চাই?”

বাড়তি শব্দ না করে ফোনটা কেটে দিলো মুহিব। ইতির মা ঢাকার এক কলেজে পড়ান। একেবারেই অপচয়। মুহিবের ধারণা এই ভদ্রমহিলা প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে বেশি সাফল্য পেতেন। ওই সংসারের প্রতিটা মানুষের ওপর কড়া নজরদারি চালু রেখেছেন তিনি। সাক্ষাৎ সিকিউরিটি ক্যামেরা। বড় বোন মুনিয়ার সাথে এক ছেলের সম্পর্ক ছিল। তিন মাসের মধ্যে পাকড়ে ফেলেছিলেন। ইদানিং ইতির ফোন সুযোগ পেলেই ধরছেন।

ফোনটা টেবিলে রেখে ইন্টারনেটের কানেকশন দেখলো মুহিব। কচ্ছপও লজ্জা পাবে এমন গতি। মফস্বলে আর কতোটা আশা করা যায়? একহাতে সিগারেট টানতে টানতে আরেক হাতে দেওয়ালের হুকে ঝোলা শার্টগুলো বাছতে শুরু করলো সে। কপাল যখন খারাপ হয় তখন সোজা উঠোনেও নাচা যায় না। আজকে মনে হচ্ছে কপাল খারাপ। বাথরুম থেকে মুখ লাল করে বের হওয়ার সময়ই বিষয়টা বোঝা উচিত ছিল ওর। দিনটা তার নয়।

আজিজ মামার দোকানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকা যায়। নতুন জায়গায় এসে মুহিব প্রথমেই একটা আড্ডা বের করে। প্রথমে সে ওখানেই আস্তানা গাঁড়বে, ধীরে ধীরে নতুন বন্ধুরা এসে ওর সাথে ওখানে যোগ দিতে থাকবে। এমন একটা দোকান হিসেবে পছন্দ হয়েছে আজিজ মামার দোকানটা তেমাথায় একসারি নষ্ট ট্রাকের পাশে নিশ্চল অবস্থান ওটার। তালাটা টেবিলের ওপর থেকে নিতে গিয়ে বিষয়টা লক্ষ্য করলো, নীল রঙের অন্তর্বাসটা টেবিলের নিচে পড়ে আছে।

মৃদু একটা গালি দিতে যাবে, টেবিলের ওপর রাখা ফোনটা বাজতে শুরু করলো। গালিটা মুখে ধরে রেখেই ফোনটা তুলে নিলো ও, ইতির নাম্বার। রিসিভ করে এক সেকেন্ড চুপ হয়ে থাকলো মুহিব। এটা সতর্কতামূলক

বিরতি। ইতির নাম্বার থেকে ফোন এসেছে মানে এই না কলার ইতিকেই হতে হবে। ইতির ভেক ধরে ওর গোয়েন্দা মা-ও হতে পারেন। শুনেছে মুনিয়া আপুর বয়ফ্রেন্ডকে এই পদ্ধতিতেই ধরা হয়েছে। কাঁচি জাল পদ্ধতি।

বয়ফ্রেন্ড বেচারা বলেছিলো, “জান, কি করো?”

ইতির মা মিহি গলায় বলেছিলেন, “শুয়ে শুয়ে তোমার কথা চিন্তা করি।”

“তাও ভালো তোমাকে একবারে পেলাম। আমি তো ভয়ে ছিলাম তোমার মা আবার ফোন না ধরে। ডেঞ্জারাস মহিলা!”

মুহিবের নেওয়া সতর্কতামূলক বিরতি কাজে দিয়েছে। ইতির গলাটা ফোনের ওপাশ থেকে শোনা গেলো, “হ্যালো তিতুন।”

মুহিব একটু হাসলো। এই সপ্তাহের জন্য ওদের কোডনেম তিতুন। এটার কথা নিশ্চয় ইতির মা জানবেন না? এই কোডনেম ঠিক করা হয়েছে ফেসবুকে। মুনিয়া আপুর বয়ফ্রেন্ড কোঁতানি খাওয়ার পর থেকে ওরা সতর্ক হয়েছে। কেউ দেখে শেখে আর কেউ ঠেকে। ওরা ঠেকে শেখার দলে কোনোদিনই ছিল না।

“ইতি, ভালো আছো?”

ফোনে কথা বললেও মুহিবের চোখ আটকে আছে টেবিলের নিচে। ওখানকার দৃশ্য তাকে বিব্রত করছে। পারলে ওখানে একটা নোটিশই টানিয়ে দিতো, হরর চলচ্চিত্রের শুরুতে যেমন লিখে দেওয়া থাকে “ভিউয়ার্স ডিসক্রেশন অ্যাডভাইজড : ডিস্টার্বিং পিকচার ইনসাইড।”

“খুব ভালো আছি। ভার্সিটিতে কি হয়েছে শুনবে? আমাদের এক প্রফেসর ইয়া গাবদা এক বই লিখে বসে আছে। বইয়ের পৃষ্ঠা কতোগুলা জানো? এক হাজার তিনশ চৌত্রিশ। সেই বই তিনি আমাদের দিয়ে কেনাচ্ছেন। বই না কিনলে সিজিপিএ টু-তে নামিয়ে দেবেন, উনার সোজাসাপ্টা কথা।”

“কি সর্বনাশ, তুমি ওই বই কিনেছো?”

বিরক্ত হলো ইতি, “কিনবো না? আমার সিজিপিএ সস্তা নাকি? তোমার মতো সরকারি ভার্সিটিতে তো পড়ছি না যে য্যানোতেনো একটা রেজাল্ট করলেই চলে গেলো। এখানে খরচ জানো? প্রতি সেমিস্টারে অ্যাডমিট হতেই লাগে ত্রিশ হাজার, কোর্স রেজিস্ট্রেশনের খরচ আছে, পরীক্ষার ফি আছে, এই অনুষ্ঠান ঐ অনুষ্ঠানের চার্জ আছে, হাতির ফ্যাসিলিটি ঘোড়ার ফ্যাসিলিটি আছে। এতো টাকা দেওয়া যায়? সিজিপিএ-টা ভালো রাখতে হবে না? তোমার মতো তো না যে ফ্রিতে পড়াশোনা করতে পারবো। ওয়েভার তো ম্যানেজ করতে হবে।”

মুহিব মফস্বলের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এই ক্যানক্যানানি চলছে। ইতির গলায় অভিযোগের সুর থাকলেও প্ৰচ্ছন্ন এক ঈর্ষা মুহিব টের পায়। এটা ওকে বেশ কষ্ট দেয়। ঘটনা উল্টে যেতো যদি? মুহিব যদি আজ প্রাইভেট এক ভার্সিটিতে পড়তো আর ইতি সরকারিতে, ওকে কি ঈর্ষা করতো মুহিব? তা করবে কেন? মেয়েটা খুশি থাকলে, সফল হলে তো ওরই ভালো লাগতো। ইতি তাহলে এমন করে কেন ইদানিং? এসব প্রশ্ন মুখ ফুটে করাও যায় না। মনের মধ্যেই চাপা দিয়ে রাখতে হলো ওকে।

“তোমার খবর বলো। ওখানে গিয়ে খুব সিগারেট খাচ্ছো, তাই না? এই মুহূর্তেও নিশ্চয় হাতে একটা মশালের মতো জ্বালিয়ে রেখেছো?”

চোরের মতো বাম হাতের দিকে তাকালো মুহিব। একদম ঠিক ধরেছে মেয়েটা। এই দিক থেকে ইতির অনুমান ক্ষমতা একদম নির্ভুল। দ্রুত দরজার কাছে ফিল্টারটা ফেলে দিলো মুহিব, “আরে তেমন না। আগের চেয়ে একটা দুটো বেশি।”

“হয়েছে। হাত থেকে সিগারেট ফেলে বাহাদুরি দেখাতে হবে না। ওই সব ছাইপাঁশ খাবা কম। নাকি ছেলেমেয়ে নেওয়ার সখ নাই তোমার?”

“হুঁ।”

ইতির মাথায় খুব ভালোমতো ঢুকেছে বেশি সিগারেট খেলে পুরুষমানুষ সন্তান উৎপাদন ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। সেই থেকে এ নিয়ে লড়ে যাচ্ছে সে। মুহিব আর সিগারেট একসাথে হলেই ইমোশনাল কথাবার্তা। শুরুতে অনাগত সন্তান নিয়ে টুকটাক ভাবতো মুহিব নিজেও। এখন আর তেমন কিছু মনে হয় না। বরং ইতির লম্বা লেকচারই বিরক্ত লাগে।

“আর পানির ফিল্টার কিনেছো? দুই দিনে কলেরা হয়ে মরবা তো দেখছি।”

“কিনে ফেলবো।”

“কিনে ফেলবো না, আজকে বিকেলেই কিনবা। ঘর ঝাড়ু-টারু দিচ্ছো না সাহারা মরুভূমি বানিয়ে রেখেছো?”

চারপাশে তাকিয়ে নব্য সাহারা মরুভূমি দেখলো মুহিব, “না না, দিনে দুইবার ঝাড়ু দিচ্ছি। একটু পর ঘর মুছবো।”

“এই শীতের মধ্যে মুছবা নাকি? ওসবের দরকার নাই। সপ্তাহে একবার মুছলেই হবে। ঝাড়ু দিও। পরে ফুসফুসে বালি ভর্তি হয়ে থাকবে, নিঃশ্বাস নিলে বাতাস ফিল্টার হবে।”

“হুঁ।”

“কী হুঁ-হাঁ করছো? আশেপাশে বন্ধুরা আছে?”

“না। সিঙ্গেল রুম না আমার? একাই আমি।”

“তাহলে গাধার মতো হুঁ হাঁ না করে আমাকে একবার চুমু খাও। শব্দ করে খাবে। ম্যানম্যানা চুমু আমার পছন্দ না।”

মুহিব খুব কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে একবার চুমু খেলো। যে ছোটো ঘর, শব্দ তো অনায়াসে করিডোরে চলে যাবে। বন্ধুদের কানে চলে গেলে কি লজ্জারই না বিষয় হবে!

“তুমি এমন মরা মরা চুমু খাচ্ছো কোন সাহসে? আমার ঠোঁট কি ফিডার? ঠিকমতো চুমু খাও।”

“কি ভয়ানক কথা বার্তা, ইতি। লোকজন শুনবে। আমি কি নিজের বাসায় থাকি এখন আর?”

“আশ্চর্য! আমার চেয়ে লোকজনের ভাবনাই বড় হয়ে গেলো তোমার? গণ্ডগ্রামে ঢোকার তিন দিনের মাথায় এতো আনরোমান্টিক ব্যবহার করছো কিভাবে?”

এসব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলতো হয়তো। করিডোর বেয়ে ভেসে আসা এক তীব্র চিৎকারে আলোচনায় ছেদ পড়লো। রোমহর্ষক ওই চিৎকার শুনে মুহিবের গাল এবার আর লাল হলো না, বরং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠেছে ওর ঠোঁটের কোণে।

“কি হলো, তিতুন? ওটা কি হলো?” ইতির গলা শুনে মনে হচ্ছে সে-ও ঘাবড়ে গেছে।

“ওটা তেমন কিছু না, তিতুন।” হাসি চাপা দিতে দিতে বলল মুহিব, “রাখি, হ্যাঁ? পরে কথা বলবো।”

দরজা খুলতেই বাথরুম থেকে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো বেলায়েত ভাইকে। মোস্ট সিনিয়র ব্যাচ। অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি। এই মুহূর্তে তার মুখ থেকে বজ্রনিনাদ বেরিয়ে আসছে, “রোজ রোজ এক কারবার ভালো লাগে না ভাই! কোথায় লাগে রবীন্দ্রনাথের দাঁড়ি! যেই শালার পুতে বাল কাইটা বাথরুমে ফালায় রাখসে তারে পাইলে…”

ইতির কথা মাথা থেকে রকেটের মতোই বেরিয়ে যায় মুহিবের। মফস্বলের এক শহরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসার দিনটা এভাবেই শুরু হয়েছিলো, সাধাসিধে আলাভোলা সরলমনের একজন চটপটে রাজধানী–ফেরত প্রেমিক, সেদিন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যাবে আগামি কয়েকটা মাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *